বরকল, ফালিটাঙ্যে চুগ আর বরগাঙ এর হাওয়া

Sulav Changma Dhenga
Last updated Sep 1st, 2021

1559

featured image

ফোনে গান বাজছিলো রণজিৎ দেওয়ানের-

“চেঙে মেয়োনী হাজলঙ কর্ণফুলি, শঙ্খ, মাতামুহুরী,
ঝড়ঝড়ঝড় ঝড়ঝড়ঝড় বোই যর ঢেউ তুলি”

আর আমি গান শুনতে শুনতে বরকল কলেজের বারান্দায় বই পড়ছিলাম-
১৮.১০.২০০৩ তারিখ আমি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎকারের সময় শেখ হাসিনা আমাকে বলেন যে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আন্তরিক ছিলেন।

তাই তিনি সন্তু লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী হতে বলেছিলেন। কিন্তু সন্তু লারমা নিজে মন্ত্রী না হয়ে কল্পরঞ্জনকে মন্ত্রী করতে বলেছিলেন। তিনি আরো বলেন কল্পরঞ্জন মন্ত্রী হয়ে নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

চুক্তি বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি দীপঙ্কর তালুকদার সম্পর্কেও মন্তব্য করেন এবং বলেন যে, দীপঙ্করও চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন না।

এভাবে যাদের উপর চুক্তি বাস্তবায়নের দ্বায়িত্ব ছিলো, তারাই চুক্তি বাস্তবায়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান”।(পৃষ্ঠা-৬৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমার জীবন, ২য় খন্ড, শরদিন্দু শেখর চাকমা, সাবেক রাষ্ট্রদূত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)।

বইটি পড়া শেষ হয়ে এলে আনমনা হয়ে যাই। কলেজের মাঠটা একচক্কর দিয়ে এসে, কলেজমাঠের এককোণায় বসে পড়লাম একটা “ফুলসুমোরি” গাছের নীচে।

জায়গাটা থেকে স্পষ্ট করে দেখা যায় “বরগাঙ” টা কীভাবে রাঙামাটিমুখী হয়েছে। দুইপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। মাঝখান দিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে বরগাঙ। বরগাঙটাও দেখছি, পাহাড়ও দেখছি, সাথে বিজু হাওয়ায় বিজুফুলের সৌরভ! আহ্!

চৈত্রের একেবারেই শেষ দিনগুলোতে প্রচন্ড খরতাপে পাহাড়গুলোকে দূর থেকে দেখলে কেমন জানি অসহায় অসহায় লাগে। অবশ্য আমি এসময়টাতেই পাহাড় চড়তে বেশি ভালোবাসি।

যাই হোক, সূর্যটা একটু হেলে পড়লেই আমি আর রিটন দা ফালিটাঙ্যের পথ ধরবো এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা চলছিলো এবং রিটন দা-র পরীক্ষার হলে দ্বায়িত্ব পড়েছিলো।

তাই সেদিন ফালিটাঙ্যে ছোঁয়া কোনভাবেই যে সম্ভব হবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ঢাকা ফিরেই সংগ্রহে থাকা শরদিন্দু বাবুর বইগুলো আরও একবার চোখ বুলাতে হবে।

আমার ধারণা একক লেখক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের লেখকদের মধ্যে প্রকাশিত বইয়ের হিসেব করলে খুব সম্ভব শরদিন্দু শেখর চাকমার বইয়ের সংখ্যায় বেশি হবে। গোটা আট-দশেক বই আছে তাঁর নামে।

উপরের বইটিতে যে তথ্য তিনি হাজির করেছেন, তা একটু খতিয়ে দেখতে হবে এমনটা ভাবছিলাম। পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, ধূর এ আর নতুন কি?? পাহাড়ে যুগে যুগে কারা দালালি করেছে আর কারা সংগ্রাম করেছে তা পাহাড়ের গণমানুষ ঠিকই জানেন।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, তখন মোনঘরে ছিলাম। কল্পবাবু একবার মোনঘরে আথিতেয়তা নিয়েছিলেন। রাঙ্গাপানি খেলার মাঠে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো পাহাড়ের “প্রথম মন্ত্রী” মহাশয় কে।

একটা গান রচনা করে গাওয়া হয়েছিলো, গানের প্রথম কলিগুলো আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে- “মন্ত্রী বাবুউউ উ উ এলও আমা আদামত গম লাগের সুখ লাগের আমা মনানত”।

খুব সম্ভব রণজিত দেওয়ান অথবা পঠন চাকমার লেখা হতে পারে গানটি। গানটি গেয়েছিলেন মোনঘরের সুপরিচিত ক্রীড়াশিক্ষক অরুন কান্তি চাকমার মেয়ে সোমা চাকমা এবং অন্য আরেক সংস্কৃতিকর্মী পঠন চাকমার মেয়ে মেডোনা চাকমা, এরকম মনে আছে।

যাই হোক, কল্পবাবু মোনঘর অথবা পার্বত্যবাসীর জন্য কি কি করেছেন বা করতে পেরেছেন তা ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু তিনি জুম্ম জনগণের কপালে যে পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন বলে শুনেছি, তার জন্য আসলে তাঁর কোন ক্ষমা হয় না।

সত্য কি না জানি না, তবে গ্রহণযোগ্য অনেক সিনিয়রজনের কাছে শুনেছি যে মূলত কল্পরঞ্জন চাকমার সময়েই পাহাড়ে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজাদের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার ডিসিদেরকেও ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং এই দূরভিসন্ধিমূলক শাসকীয় কার্য সিদ্ধি করতে কল্পমিয়াই মুখ্য ভূমিকাটা রেখেছিলেন।

আগে হেডম্যানদের সুপারিশে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিতেন কেবল তিন সার্কেলের চীফ বা রাজারা। কিন্তু কল্পমিয়া করলেন কি, কেবল সার্কেল চীফরা নয় এখন থেকে ডিসিরাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিতে পারবেন এই মর্মে ফরমান জারি।

আর এখন আমাদের কপাল, অনেক জায়গায় সার্কেল চীফদের প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দাপ্তরিকভাবে আমলেও নেওয়া হয় না আর। অনেক ক্ষোভের আগুন নিয়ে তাই গালি দিতে ইচ্ছে করে “হালার কল্প, বুদ্ধি ক্যানে এত স্বল্প”?

যাই হোক, রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলাটিকে খুব সম্ভবত এখনো প্রত্যন্ত এবং দুর্গম একটি উপজেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এই উপজেলা বেশ পিছিয়ে ছিলো এতদিন। এখনো বৈ কি!

তবে জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে কেতু ওস্তাদের বরকল বরাবরের মতোই অসীম সাহসী লড়াই এখনো জিইয়ে রেখেছে তা বলা যেতে পারে বোধহয়। আমি প্রথম বরকল গিয়েছিলাম ২০০২ সালে, তখন ক্লাশ ফাইভের ছাত্র।

এরপরে বেশ কয়েকবার যাওয়া-আসা হয়েছে। একবার গিয়েছিলাম বুয়েটের রিকন দা-র সাথে। সেবছর বরকল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে উচ্চশিক্ষা নিয়ে মতের সহভাগিতা করেছিলাম আমি আর পিসিপির কেন্দ্রীয় নেতা রিকন দেওয়ান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মেধাবী মুখ এবং ছাত্রনেতা বাতায়ন চাকমা দা নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এখন বরকল কলেজের প্রভাষক। এরপরে একবার গিয়েছিলাম দলবল হয়ে আমার ক্যাম্পাস মেটদের নিয়ে “থেগা” দর্শনে।

প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও সৌন্দর্য প্রাপ্তি হিসেবে যোগ হয়। কিন্তু এতবার যাওয়া-আসা হলেও বরকলের “ফালিটাঙ্যে চুগ” উঠার সৌভাগ্য কখনোই হয় নি। এবার বিজুতে হুট করে একটা সুযোগ মিলে গেলো।

তাও আবার সেই বরকল কলেজেরই শিক্ষক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা রিটন চাকমা দা-র মাধ্যমে। রিটন দা-র আরেকটি পরিচয় তিনি আদিবাসী গানের দল “মাদল”-র প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সদস্য।

বরকল সদর উপজেলা বাজারটির কিছুটা পুর্বে বেশ বড় একটি পাহাড়ের উপর বরকল রাগীব-রাগেয়া কলেজটি এইতো সবে কিছুদিন হলো যাত্রা শুরু করেছে। কলেজটি স্থানীয়রা নামকরণ করতে চেয়েছিলো “বড়গাঙ কলেজ” নামে। যুতসই নামই হতো তা।

কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য তা করা যায় নি। নামের জন্য কাম টা আটকে থাকুক, তা হতে পারে না, কেননা বরকলের দরকার ছিলো শিক্ষা। অন্যদিকে তথাকথিত দানবীর রাগীব সাহেব তার নামটা স্বীকৃতি না পেলে কিছুতেই অর্থ সহযোগিতা দিবেন না।

জনগণের তো সামর্থ নেই কলেজ প্রতিষ্ঠা করার! যে সরকার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভ দেখায় সে সরকারের কাছে আমরা একটি কলেজ পাওয়ার ভরসা করতে পারি না কেন?

বরকল সদর উপজেলাটি “ফালিতাঙ্যে” পাহাড়টির একেবারে দক্ষিণ পাদদেশের কোলে গড়ে উঠেছে। বরকলের মাছ এর স্বাদ যে একবার পায় তার মুখে লেগে থাকে। বরগাঙের অমৃত স্বাদের মাছ এখনো এই বরকলেই পাওয়া যায়।

মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এসে জুম্মদের প্রিয় “বড়গাঙ” এই বরকল উপজেলার পাশ দিয়েই সাপের মতন রাঙামাটিমুখী হয়েছে। ঠিক কি কারণে উপজেলাটিকে বরকল নামকরণ করা হয়েছে তা সঠিক বলতে পারব না।

তবে ধারণা করা যেতে পারে বরহলগ/বড়কলগ থেকে বরকল উপজেলাটির নামকরণ হতে পারে। চাকমারা ঝরণা বা প্রপাতকে হলগ/কলগ বলেও অভিহিত করে থাকে। তাই বড়হলগ বা বড়কলগ থেকেই বরকল নামটির উৎপত্তি হয়েছে এমনটা ধরে নেওয়া যেতে পারে।

বর্তমান বরকলের সদর উপজেলা অফিসের পাশেই বড় একটি শুকনো চাদারা (পাথুরে খাদ) আছে যা বেয়ে বর্ষার সময় কিছু পানিও নামে, তবে ঠিক ঝর্ণা বলা যাবে না আর। বোধহয় এটাই একসময় বড়হলগ বা বড় ঝরণা ছিলো।

বিষয়টি ড: সুনীতি ভূষণ কানুগোর লেখা “ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম” শীর্ষক বইয়ে উদ্ধৃত করা ড: বুকাননের নোটগুলো স্মরণ করে খতিয়ে দেখা যেতে পারে-

“বরকল জলপ্রপাত একসময়ে বাংলা প্রদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত ছিল। বর্তমানে এই জলপ্রপাত কাপ্তাই জলাধারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। ড: বুকানন জলপ্রপাতটির সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন,

I walked up about a mile to an higher ledge of rocks over which the river (The Karnaphuli) falls in various beautiful cascades …. The scenery is very beautiful when the river is much swollen and all the small cascades united it must be very granal.

রাঙ্গামাটি থেকে হরিণা পর্যন্ত সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বুকানন লিখেছেন,

As i approached Hattea (Elephant Rock) the scenery became beautiful, and there it is highly romantic.”

(পৃষ্ঠা-১২, ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতেরোধ সংগ্রাম, ড: সুনীতি ভূষণ কানুনগো।)

আলাম্বা হচ্ছে বরকলের একটি গ্রাম। এর কাছাকাছি ইউনিয়ন হচ্ছে হরিণা, ভুষণছড়া আর আইমাছড়া। বরকলের এই এলাকাটার সৌন্দর্য নিয়ে কেবল বুকানন সাহেব নন, আরো অনেকেই বিমোহিত হন। এলাকাটা নিয়ে ভালো একটা চাকমা গানও আছে।

“ভালোকবজর আগে আলাম্বা আগারে বেড়া যিয়োঙ।
একদিন্ন্যে বেলান উধের, মুই এলুঙ মুড়ো লেজাৎ, ছড়া পারত।
জাগায়ান ভারি দোল লাক্কে। এনজান দোল জাগায়ান হুধু আগে হিজেনি”

(বহুবছর আগে আলাম্বার উজানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন,সূর্য উঠছে আর আমি ছিলাম পাহাড়ের পাদদেশে, ছড়ার পারে। জায়গাটি অনেকসুন্দর ছিলো। এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে?)

যদি ভুল করে না থাকি উপরের কথাগুলো সাবেক উপমন্ত্রী মণিস্বপণ দেওয়ানের গাওয়া খুব বিখ্যাত একটি চাকমা গানের প্রারম্বিক কথন। গানটির প্রথম কলিগুলো এরকম-

“রঙ বেরঙর তেন টোঙরি বঙপাদারে যাদন উড়ি
এনজান দোল জাগাগান হুধু আগে কিজেনি
পিনোন পিন্ন্যে খাদি বান্ন্যে গাভুর মিলা ঝাক
বানি শয্য ভুইয়ো সেরেন্দি হুধু যাদন আহজি আহজি
এনজান দোল জাগায়ান হুধু আগে কিজেনি”

(“নানা রঙের ঘাসফরিঙ নানান দিকে ছড়িয়ে উড়ে এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে কে জানে পিনোন পড়া, খাদি জড়ানো রমনীরা ঝাঁক বেঁধে শর্ষে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে কোথায় যায় হেসে হেসে এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে কে জানে”)

অবশ্য আমার সবচেয়ে ভালো লাগে গানটির এই কলিগুলো…

“মনে মনে কেতকেত্যে র আমহক ওইনেই শুনি আগঙ
এগামনে অঘলক্কো চামনি গাজও ভেঙা ঢেলাৎ যার ডুগুরি”

(“আনমনে অবাক হয়ে শুনছি কর্কশ আওয়াজ মগ্ন হয়ে অঘলক পাখি চামার গাছের বাঁকা শাখে অনর্গল ডাকে”)

(বাংলাগুলো ঠিক অনুবাদ হিসেবে ধরে নিবেন না। বুঝার সুবিধার্থে আমার মতো করে বাংলা করার চেষ্টা করেছি মাত্র।)

কাপ্তাই বাঁধটি হওয়ার আগে বরকল বাজার টি বেশ ভালো একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিলো বলে ধরে নিচ্ছি। যেহেতু এই পথ দিয়ে লোকজন মিজোরাম বা ভারত পর্যন্ত আসা যাওয়া করতো আর বরগাঙ চ্যানেলটি সরাসরি পুরাতন রাঙ্গামাটি ও পুরাতন রাজবাড়ি-র সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলো।

কাপ্তাই বাঁধটি হওয়ার পরে শলক দোর বাজার/ চুগুলোঙ বা বর্তমান শুভলঙ বাজারটি-র গুরুত্ব অত্যধিক হওয়ায় ধীরে ধীরে বরকলের অর্থনৈতিক গুরুত্বটা কমে এসছিলো সম্ভবত।

আবার তুলনামূলকভাবে বরকলের মাটিগুলো পাথুরে এবং ফসল উৎপাদনের হারটা অন্যান্য উপজেলার তুলনায় পিছিয়ে বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত, বড়কল উপজেলাটি নিয়ে একটি চিঠির কথা মনে পড়ে গেল।

বহু আগে জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল (জাক)-র একটি প্রকাশনায় এক পাঠকের চাকমা ভাষায় লিখিত একটি চিঠি পড়েছিলাম। সম্পাদকের উদ্দেশ্যে চিঠিপত্র বিভাগে চিঠিটি সম্ভবত লিখেছিলেন বরকল উপজেলার প্রথম বিসিএস অফিসার এবং বর্তমানে উপসচিব পদমর্যাদার শ্রদ্ধেয় কৃঞ্চকিশোর চাকমা।

সম্ভবত চিঠি লিখেছিলেন রাঙ্গামাটি কলেজের ছাত্রাবস্থায়। চাকমা ভাষায় লিখিত চিঠির মূলভাষ্যটা ছিল এরকম যে, “অনুর্বর ভূমির বরকল উপজেলার শিক্ষা-দীক্ষা অর্থনীতিটা বেশ পিছিয়ে আছে। করণীয় কী??”

জাক-র পক্ষ থেকে বা জাকের সেই প্রকাশনাটির পক্ষ থেকে খুব সম্ভব সম্পাদক কবি সুহৃদ চাকমা চিঠি প্রেরককে উত্তর দিয়েছিলেন এরকমভাবে “তোমা বড় হল আন ধোয় ধোয় হিয়ো”। (“আপনাদের বড় মেশিনটি ঘষেমেঝে খেয়েন”)। চিঠিটি আমার মনে খুব করে দাগ কেটেছিলো বরকল সম্পর্কে জানতে!

পরবর্তীতে কলেজে পড়ার সময় কৃঞ্চকিশোর চাকমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি আমার বাল্যবন্ধু শুভকর এবং কৃঞ্চ আংকেল এর পুত্র চুয়েট পড়ুয়া অনুজ কৃতি চাকমার সুবাদে। পুরো বরকল উপজেলাজুড়ে কৃঞ্চবাবুর বেশ সুনাম।

কীভাবে তিনি আর্থিক দূরবস্থায় জর্জরিত পারিবারিক পরিচয়কে ছাপিয়ে পরিশ্রম আর মেধাবলে হয়ে উঠলেন প্রতিষ্ঠিত এবং সৎ সরকারি আমলা তা বিভিন্নসময়ে বিভিন্নজনের মুখে শুনেছি।

কিছু কিছু লিটলম্যাগ এ তার কিছু লেখা-টেখাও পড়েছি বলে মনে হয়। তাঁর সম্বন্ধে যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই বলবেন তিনি একজন নিখাদ ভদ্রলোক, গুণী এবং জ্ঞানী মানুষ।

যাই হোক, সেদিন আর ফালিটাঙ্যে যাওয়া হচ্ছে না- রিটন দা নিশ্চিত করলেন। আমি আর রিটন দা পাহাড় চূড়োয় অবস্থিত কলেজের বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। এরই মধ্যে রাঙামাটি থেকে বিকেলের লঞ্চে বরকল চলে আসলেন রাসেল চাকমা দা।

রাসেল দা-ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা। রাসেল দা রাতে খাওয়ার জন্য কিছু টাটকা মাছ কিনে নিয়ে এসছিলেন। তাঁর পরীক্ষার হলে ডিউটি ছিলো পরেরদিন। দুর্গম হওযার কারণে কখনো কখনো কলেজেই তাঁবু গড়েন এখানকার শিক্ষক মহোশয়রা।

রাঙামাটি থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়াটা বিরক্তিকর আর এখানে স্থায়ী থেকে যাওয়াটাও মনে সায় দেয় না এরকম একটি অবস্থা। গল্পচ্ছলে রাসেল দার নিয়ে আসা মাছগুলো “গঙ” করছিলাম আমি, রিটন দা, রাসেল দা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কৃপায়ন চাকমা দা, ২০০৩-এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানো গ্রোমিকো দা প্রমুখ।

ছাত্ররা নয় বরকল কলেজের প্রাণ যেন এই শিক্ষকরাই। গল্প করতে করতেই জেনে নিলাম কলেজে যে কজন শিক্ষক আছেন, তাঁর মধ্যে সবাই কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে নবীন কলেজ শিক্ষক।

কমবেশি প্রায় সবায়ই ছাত্রাবস্থায় পিসিপির সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে সবাই সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও পাহাড়ের বাস্তবতায় দারুণ রাজনীতি সচেতন। নিখাদ আন্তরিকতা নিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজটির হাল ধরার চেষ্টা করছেন।

মনে মনে ভাবলাম, “এম এন লারমার চেতনা-হারিয়ে যেতে দিব না” এই স্লোগানে এরা কোন না কোন সময় নিশ্চয়ই কোরাস মিলিয়েছে। গ্রোমিকো দা-র জ্ঞানগর্ব সরেস ফাজলামির সাথে কৃপায়ন দা-র বিনয়ী সরল হাসি, সাথে রাসেল দা আর রিটন দা-র গাম্ভীর্য মাখা বিকেলটা নিমেষেই রাত হয়ে এসছিলো।

প্রচন্ড মিস করছিলাম ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের সাবেক মেধাবী মুখ ও ছাত্রনেতা প্রিয় বড়ভাই বাতায়ন চাকমা বা কার্তুজ দা কে! তিনি আর ত্রিজিনাদ দা-ই তো প্রথম আমাকে নিয়ে এসছিলেন এই কলেজের বারান্দায়।

রাতে খাবার-দাবার এর পর্বটা সেরে আমি আর রিটন দা ঠিক করলাম পরের দিন দুপুর নাগাদ ফালিটাঙ্যে-র উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হচ্ছি।

বরহলের (বরকল) পথে, ছবিঃ রিপ রিপ চাকমা

এরইমধ্যে খবর পেলাম ঢাকা পিসিপির ছোটভাই রিপরিপ বরকলের ছেলে এবং বিজুর ছুটিতে সে এখন বরকল অবস্থান করছে।

বরকল বাজারের এক দোকানে চা খেতে গিয়েছিলাম, সেখানে কথাসূত্রে এই খবরটা দিয়েছিলো বরকল কলেজের ১ম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী যে এখন পলিটেকনিক শেষ করে চাকরি খুজতেছে। আমি ছেলেটাকে ঠিক চিনতে পারি নি।

সেই আগ বাড়িয়ে আমাকে বলেছিলো- “দা নমষ্কার, মরে চিনোর নি? উই সেক্কে বো আমা কলেজত লেকচার দোগিদে বাতায়ন স্যার ও লগে? আমি বরকল কলেজর ফার্স্ট ব্যাচ আই।” বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সাথে। তখনই জেনে যাই যে, সে রিপরিপ এর বন্ধু।

তাদের ব্যাচটা ছিলো বরকল কলেজের ১ম ব্যাচ এবং সেই ব্যাচ থেকে একজন ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মনে মনে হাসছিলাম আমি! ভাবছিলাম উফ, আমার লেকচারটা কাজে লেগেছে নিশ্চয়ই! নাকি রিকন দা-র কথাগুলো?

যাই হোক এটুকুই সেদিন আমরা বলেছিলাম যে, “বরকল কলেজের ১ম ব্যাচ হিসেবে, তোমাদের দ্বায়িত্ব হবে তোমাদের পরবর্তীতে যারা এই কলেজে পড়তে আসবে তারা যেন তোমাদের সফলতা দেখে গর্ব করতে পারে এবং উৎসাহিত হতে পারে।”

আমি আর রিকন দা যখন বরকল কলেজে যাই তখন কলেজটা বাঁশের ছিলো সম্ভবত। এখন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে। দেখতে দেখতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে এসছে। তাই অনেককেই ভর্তি করানো সম্ভব হয় না।

কলেজের প্রিন্সিপাল নৈচিং রাখাইন কলেজের উন্নতি নিয়ে খুবই আন্তরিক এবং সচেষ্ট। পাশাপাশি শিক্ষক এবং স্থানীয়রাও যে যার মতো আন্তরিক ভূমিকা নিয়ে চেষ্টা করছেন উপজেলায় শিক্ষা প্রসারে যেন কলেজটি ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে পারে।

যাই হোক, ছেলেটার মাধ্যমে রিপরিপকে খবর দিলাম পরেরদিন যেন সে প্রস্তুত থাকে ফালিটাঙ্যে যাওয়ার জন্য। রিপরিপ রাতে ফোন দিলো। জানালো সে প্রস্তুত এবং দুপুরে তার বাসায় নিমন্ত্রণ। আহ্, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

পরেরদিন সকালে পুরো উপজেলা বাজারটি এ মাথা- ও মাথা একচক্কর ঘুরে নিলাম। দুপুরের দিকে রিপরিপের বাবা প্রতিময় আংকেল এর সাথে পরিচয় হলো। দু’জনে মিলে জুড়ে দিলাম “পানজা নাগর”।

সদা হাস্যজ্জ্বল প্রতিময় আংকেল এর সাথে গল্প করতে করতে জেনে নিলাম অনেক কিছুই। আমি সাধারণত বরকল, জুরাছড়ি আর বিলাইছড়ি বেড়াতে গেলে ২০০৭-২০০৮ এর জরুরী অবস্থার সময় কেমন ছিলো সেখানকার পরিস্থিতি তা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।

এবং এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের কথোপকথন শুনেই আমি বুজে যাই “আপসহীনতার” নামে পাহাড়ে ১৯ বছর ধরে কীভাবে রচিত হচ্ছে প্রপাগান্ডা সাহিত্য(!) আর বিপরীতে কেনই বা জনসংহতি সমিতির পতাকাকে জুম্ম জনগণ নিরাপদ মনে করে।

যাই হোক, সেদিকে আর গেলাম না। জনসংহতি সমিতি-র এযাবৎ কালের আন্দোলন সংগ্রামে বরকল উপজেলার মানুষের বিশাল অবদান। নির্ভরযোগ্য সাংগঠনিক ভিত্তি এলাকা বটে!

রিপরিপের বাবা প্রতিময় আংকেল এর সাথে গল্প শেষ হতে না হতেই রিটন দা’র ফোন। কলেজের ডিউটি শেষ। আর কিছুক্ষণ পরেই আমি, রিপরিপ আর রিটন দা মিলে আমরা যাচ্ছি বহুল কাঙ্ক্ষিত ফালিটাঙ্যে চুগ এর উদ্দেশ্যে।

বাজার থেকে ছুড়িমাছ, সিদোল, মরিচ আর চাউল নিলাম। নিয়মিত পাহাড় চড়ি, তাই কোথায় গেলে কী নিয়ে যেতে হবে তা টুকটাক ধারণা আছে বৈ কি! সূর্যটা সবে পশ্চিমে হেলে পড়েছে এমন সময় পৌঁছে গেলাম ফালিটাঙ্যে চুগ এর কোলে এক জুম্মো ভাইয়ের মোনঘরে।

আশ্রয় চাইলাম, হলুদচাষী গেরস্ত এবছর হলুদের ভালো ফলন পেয়েছেন, হেসে হেসে বললেন “এম্বা মুড়োত গাই গাই থাঙ, তোমারে জাগা ন দিলে হারে জাগা দিদুঙ।” পাহাড়ের মানুষগুলোই এমন- “ঘর ছোট হতে পারে মন ছোট নয়, ধন না থাকতে পারে মন একটা থাকবেই।”

বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা ঝিড়ি। গোসল সেরে নিলাম হাজার বছরের শ্রান্তি মাখানো পাহাড়ি ঝিড়ির জলে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। জোসনা মাখানো ফালিটাঙ্যের চুড়ো থেকে বরগাঙটা দেখতে দেখতে রিটন দা গীটারটা বের করলেন। গাইতে পারি না তবে গাইতে চাচ্ছিলাম-

বরকলও নাঙ শুন্নোনি লুজেই হিল-ও হুরে
 সিদু এল ম ঘরান দন্দছড়া ভিদিরে
 বরগাঙত্তুন ৩ মেল দূরত গোরস্থান আদামান
চেরোহিত্তে ভূয়ে জুমে মুড়োমুড়ি ছড়াগাঙ
আজার বজর ধরি এলং সিদু মনান থেব জনমান

গানটি কার লেখা বা গাওয়া জানি না। বাংলাটা বোধহয় এরকম করে করা যেতে পারে…

বরকলের নাম শুনেছো কি লুসাইহিল এর কাছে

সেখানেই ছিলো আমার ঘর দন্দছড়ার ভিতরে

বরগাঙ থেকে তিন মাইল দূরে গোরস্থান আদামটি

চারিদিক ক্ষেত আর জুম পাহাড় ছড়া আর গাঙ

হাজার বছর ধরে ছিলাম সেখানে মনটাও থাকবে জনমভর।

লেখক : সুলভ চাকমা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা