মণিপুরী সম্প্রদায় : উষালোকে দীপ্ত সূর্য

Jumjournal
Last updated Mar 20th, 2020

960

featured image

মণিপুরীরা স্বাধীনতাপ্রিয় ও সৌন্দর্যপ্রিয় জাতি। এ জাতির রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য ও মহিমান্বিত অতীত। সে অতীত যেমন বীরত্বের মহিমায় উজ্জ্বল তেমনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চেতনায় ভাস্বর।

এককালে মণিপুর ছিলো একটি স্বাধীন রাজ্য। বিভিন্ন শক্তির সাথে যুদ্ধে মণিপুরের স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়।

বার-বার বিভিন্ন সংগ্রাম ও সংঘাতে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণে তারা বিধ্বস্ত হয়েছে-সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে, কিন্তু স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বিসর্জন দেয়নি। এ স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্যই আজও তারা স্বমহিমায় উজ্জ্বল।

মণিপুরী সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার জানার আগ্রহ সেই ছাত্রজীবন থেকেই। তবে এই আগ্রহ আরো প্রগাঢ় হয়েছে সিলেটে এসে। এখানে এসে আমি তাদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মেশার ও আলাপ-আলোচনার সুযোগ পেয়েছি, পেয়েছি তাদের উষ্ণ সান্নিধ্য ও অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের পরিচয়।

বিশেষত আমার কয়েকজন মণিপুরী-বন্ধু ও ছাত্র-ছাত্রী তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানার ব্যাপারে আমাকে অকুণ্ঠ সাহায্য করেছে।

শান্তিনিকেতন থেকে আমার এক অধ্যাপক-বন্ধু প্রায়ই চিঠি লিখতেন, ‘এবারতো তুমি সিলেটে মণিপুরীদের মধ্যে আছো, তাদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু জানাও।’ মণিপুরী সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে এদেশের শিক্ষিত সমাজকে প্রথম আকৃষ্ট করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তার চিত্রাঙ্গদাতো মণিপুরী রাজকন্যাকে নিয়ে এবং শান্তিনিকেতনে তিনি মণিপুরী নৃত্যশিক্ষার যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তা আজও বলবৎ আছে। মণিপুরী নৃত্য সমগ্র উপমহাদেশ এমনকি ইউরোপেও নন্দিত।

কবিগুরু এসেছিলেন ‘শ্রীভূমি’ সিলেটে। শ্রীভূমি সিলেটের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর মণিপুরী নৃত্য তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিলো।

তাই তিনি লিখেছিলেন –

‘মমতবিহীন কাল-স্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে,
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী ‘শ্রীভূমি।

… … … …

ভারতী আপন পূণ্য হাতে
বাঙালীর হৃদয়ের সাথে,
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাংলার আশির্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’

আরো মুগ্ধ হয়েছিলেন মণিপুরী নৃত্য দেখে। সিলেট থেকে ফিরেই আগরতলা থেকে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক নিয়ে গিয়ে শান্তিনিকেতনে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষার। আজ এ-নৃত্যকলা চরম উৎকর্ষে উন্নীত এবং স্বতন্ত্র এক নৃত্যকলা ও নৃত্যভঙ্গিমা হিসেবে পরিচিত।

আমি আগেই বলেছি মণিপুরীরা স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি। গোলামীর জিঞ্জির গলায় ধারণ করতে তাদের প্রচণ্ড ঘৃণা বলেই বশ্যতা স্বীকার না করে বিভিন্ন অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে পড়েছিলো।

বর্তমানে বাংলাদেশে মণিপুরী সম্প্রদায়ের বহুলোক আছে। তবে এ সংখ্যার আধিক্য বৃহত্তর সিলেট জেলায়ই। বহু আগে তারা পররাজ্যগ্রাসীর আক্রমণে মাতৃভূমি ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে বাংলাদেশে আসে।

এখন বাংলাদেশই তাদের মাতৃভূমি এবং এর মাটি ও আবহ আর জীবনমানসের সাথে তারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও একাত্ম হয়ে গেছে।

এবার মণিপুরীদের ভাষা ও সাহিত্য প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলা যেতে পারে। মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা আছে, আছে নিজস্ব লিপিও।

আমার এ মণিপুরী বন্ধুর মাধ্যমে এ ভাষা আমি কিছুটা আয়ত্বও করেছি। দেখেছি-এ ভাষার শব্দসম্পদের প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের কী অফুরন্ত ভাণ্ডার! অল্প কথায় অধিক ভাব ও অর্থ ধারণ করা এ-ভাষার একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য।

মণিপুরীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্বের উপর অনেক বই-পুস্তক আমি দেখেছি। দেখেছি তাদের পত্র-পত্রিকা ও পঞ্জিকা। ইতিহাস ও গবেষণা সম্পর্কিত বইয়ের কী প্রাচুর্য! গল্প, কবিতা, নাটক এবং উপন্যাসের সংখ্যাও কম নয়। আজও তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এবং আত্মিক সম্পদে ঋদ্ধ এক গৌরবোজ্জ্বল জাতি।

মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস অতীব প্রাচীন। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের। এ-দিক দিয়ে চিন্তা করলে এ উপমহাদেশে একমাত্র বৈদিক ভাষার পরেই এর স্থান।

মণিপুরীদের যে বইগুলো আমাকে বেশী আকৃষ্ট করেছে তা হলো- ক) চৈগারোল কুম্বাবা, খ) নুমিৎ কাপ্পা, গ) পোইরৈতোন খুনথোকপা, ঘ) খোংজোংনবী নোঙ্গরোন, ৬) লুংবান পোম্বী লুওয়াউবা, চ) মণিপুরী ভাষায় অনূদিত রামায়ণ।

আধুনিক মণিপুরী সাহিত্যও অতীব সমৃদ্ধ। এ-ধারায় রয়েছে উপন্যাস, কবিতা ও নাটক। উল্লেখযোগ্য কিছু উপন্যাস হলো- লবঙ্গলতা, জহেরা, মাধবী, থাদোকপা, লমন, খুদোল, অরোয়বা পাউদম, ঐখোয় তাদা, রাধা, মরূপ অনী, তাৎ ওনবা ইত্যাদি।

আধুনিক মণিপুরী কবিতার ধারাও খুবই সমৃদ্ধ। এদের মধ্যে রয়েছে তনু লাইজীং, শৈদম শৈরেং, বসন্ত শৈরেং, শৈরেং অনৌবা, কবোলোয়, ঈখৌ লাংবা, কেতকী, লৈপরেং, তীর্থযাত্রা, অশৈবগী নিতাইপোদ, ও অমত্তা হায়গে তেলঙ্গা, বসন্ত কুন্নিপালগী লৈরাং (এ কে শেরাম)।

এ সমস্ত কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও মণিপুরী ভাষায় অনেক আধুনিক বাংলা কবিতা অনূদিত হয়েছে। এর মধ্যে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য ও মেঘনাদ বধ কাব্য, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ আরো অনেক কবিতা।

কালিদাসের অমর কাব্য মেঘদূতও মণিপুরী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আধুনিক নাট্য সাহিত্যেও মণিপুরীদের অবদান খুবই উল্লেখযোগ্য।

নিম্নে আমি কয়েকটি নাটকের নাম উল্লেখ করছি- সতী খোংনাং, নরসিংহ, মোইরাং, চিংডু খোংনাংথাবা, মাইনু পেমচা, কেগে লমজা, সীতা বনবাস, ইস্ফাল থাইবী, মনি মমৌ প্রভৃতি।

মণিপুরী সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় সিলেটের মণিপুরী সম্প্রদায়ও পিছিয়ে নেই। প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনরাও এ-ব্যাপারে নিবেদিতপ্রাণ।

এ ব্যাপারে সূর্য কুমার সিংহ গবেষণাধর্মী কর্মে বেশ এগিয়ে এবং এ কে শেরামের ‘বসন্ত কুন্নিপালগী লৈরাং’ (আটাশ বসন্তের ফুল) কাব্যটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে।

সিলেটের বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের অবদান এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পর্যন্ত এই সংসদ ‘দীপান্বিতা’ নামক একটি সাহিত্য ও গবেষণা পত্রিকার ১৪টি সংখ্যা বের করেছে।

এছাড়া মণিপুরী সাহিত্যের আরো বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছে এই সংসদ। এগুলোর মধ্যে মণিপুরী ভাষায় রচিত কবি এ কে শেরামের ‘বসন্ত কুন্নিপালগী লৈরাং’ (আটাশ বসন্তের ফুল) কাব্যগ্রন্থ এবং ‘মণিপুরী লিপি পরিচিতি’ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও এই সংসদ প্রতি বছর গুণীজন সংবর্ধনা এবং বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলনের ব্যবস্থা করে থাকে। মণিপুরীদের কেনো ‘উপজাতি’ বলা হয় এর উত্তর আমি কোথাও খুঁজে পাইনি।

আমার মনে হয় একটি সুসভ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পদে ঋদ্ধ এবং ইতিহাস ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে প্রদীপ্ত জাতিকে জোর করে ‘উপজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে কলঙ্কিত ও অপমানিত করা হচ্ছে।

যতটুকু জানি যারা আজও আদিম সভ্যতার স্তরগুলো উত্তরণ করতে পারেনি এবং যাদের কোনো লিখিত ভাষা ও লিপি নেই, সাহিত্য ও দর্শন নেই অর্থাৎ যারা আজও আদিম জীবন-প্রথায় অভ্যস্ত তারাই ‘উপজাতি’, এ সংজ্ঞায় কি মণিপুরীদের ফেলা যায়? কেউ কেউ বলেন মণিপুরীরা রাজ্যচ্যুত ও উদ্বাস্তু এজন্য তারা উপজাতি, এ কোনো যুক্তির কথা নয়।

প্যালেস্টাইনীরা উদ্বাস্তু, এজন্য তারা কি উপজাতি? আর অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করলেই কি উদ্বাস্তু হয়? তবে কি লণ্ডন-প্রবাসী সিলেটের লোকদের সেখানে উপজাতি বলে?

স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ না করে রাজ্যচ্যুত মণিপুরীরা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এসে কবে বসতি স্থাপন করেছে এ-জন্য তাদের উপজাতি হিসেবে আখ্যা দেওয়া মানেই তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং শিল্প ও সভ্যতাকে অস্বীকার করা।

আমাদের ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ এবং গবেষক ও তত্ত্ববিদদের মণিপুরী সম্প্রদায়ের নবমূল্যায়নের দিকটি বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।

(বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ, সিলেট-এর সাহিত্য সংকলন ‘মৈরা’র এপ্রিল, ১৯৮৮ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটি এখানে পুনর্মুদ্রিত হলো)

লেখক: ড. সফিউদ্দিন আহমদ : বরেণ্য লেখক ও গবেষক। যষস্বী অধ্যাপক; সাবেক প্রধান, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা