আমি ও আমার পৃথিবী – অধ্যাপক ড. মানিক লাল দেওয়ান

Jumjournal
Last updated Jul 13th, 2020

1823

featured image

কাপ্তাই লেক পরবর্তী পরিবেশ

রাঙ্গামাটি অবস্থান কালে পরিবেশের প্রচুর পরিবর্তন দেখলাম। পুরাতন অর্থাৎ লোয়ার রাঙ্গামাটি সম্পূর্ন জলমগ্ন। চাকমা রাজার ঐতিহাসিক রাজবাড়ী কাপ্তাই হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেছে।

রাঙ্গামাটির পূর্ব-দক্ষিণে সমতল হাজার হাজার একর শস্যক্ষেত জলের নীচে মুখ থুবরে পড়ে আছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল কেটে রিজার্ভ বাজার ও তবলছড়ি বাজার সৃষ্টি করা হয়েছে।

রাঙ্গামাটি শহরটি পশ্চিম দিকে ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে। শুনলাম প্রায় ১ লক্ষ লোক নাকি অপসারিত হয়েছে এবং ৫৪ হাজার একর ধান্যজমি পানির নীচে তলিয়ে গেছে।

সরকারের কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন যে যেখানে পারে চলে যায় এবং নতুন বসতি স্থাপন করে। এক পর্যায়ে প্রায় ৫০ হাজার চাকমা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যায়।

তারা রাজনৈতিক গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে অরুনাচল প্রদেশে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় দীর্ঘ ৪৬ বছর পরেও তারা নাকি ভারতের নাগরিকত্ব পায়নি।

সেখানেও নাকি তাদের একতা নেই এবং অন্যান্য আদি উপজাতিদের বৈরী হয়ে বসবাস করছে। তবে শিক্ষার প্রতি চাকমাদের অনুরাগ থাকাতে তাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে নেই।

১৯৯৯ সালে আমার দিল্লী অবস্থানকালে অরুনাচলের কয়েকজন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তারা চাকমা, হিন্দি ও ইংরেজী বলতে পারে কিন্তু বাংলা বুঝে না। তবে আমাদের বাংলাদেশে চাকমারা যেমন সর্বত্র পরিচিত, বিশাল ভারতে তারা নয়।

চাকমাদের মরণ ফাঁদ বলে পরিচিত কাপ্তাই ড্যাম সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ড্যামটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তৈরী হয়। সেই দেশের কোন এক কোম্পানী নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। সম্ভবত ১৯৫৮ সালে শুরু হয়ে ১৯৬২ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

শোনা যায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ ছিল তার অর্ধেকও নাকি পাকিস্তান সরকার দেয়ানি। যা দেওয়া হয়েছে তার সিংহ ভাগ দুর্নীতির কবলে পড়ে। তখন CHT এর জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব হেলাল উদ্দিন চৌধুরী।

৩০৩ জন দুর্নীতবাজ অফিসারের ভিতরে তিনিও চাকুরীচ্যুত হন। মিষ্টভাষী, জনাব আলী হায়দার খান ছিলেন তখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুনর্বাসন অফিসার। তাঁকেও পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে CHT এর জেলা প্রশাসক হন। আমার এবং পরিবারের সাথে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। তিনি অত্যন্ত অমায়িক ছিলেন।

তিনি পাকিস্তান সরকারের এক গোপন চিঠির কথা আমাকে বলেছিলেন। এ চিঠি ছিল CHT-কাপ্তাই ড্যামের ক্ষতিপূরণ সম্বন্ধীয়।

তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার নাকি পূর্ণ ক্ষতিপূরণের টাকা চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে লিখেছিল যার জবাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন এক সেক্রেটারী নাকি লিখেছিলেন- “CHT people are jungle people, they can live on roots and grasses, hence needs no more compensation” অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজন জংলী, তারা শিখড় ও ঘাস খেয়ে বাঁচতে পারে।

অতএব আর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। জনাব আলী হায়দার খান কুটনীতি সম্পন্ন ব্যক্তি ও চাকমাদের বন্ধু প্রতীম ছিলেন। কিন্তু তার সরল মনে গরলও ছিল।

জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অগনিত বাঙ্গালী শরনার্থী সমতল থেকে পাহাড়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করানোর পরামর্শ তিনিই দেন। যার ফলশ্রুতিতে পাহাড়ে বর্তমান অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষতঃ ভূমি সমস্যা নিয়ে।

জনাব আলী হায়দার খান পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারও হন। কিন্তু তার অবসর জীবন শান্তিপূর্ণ হয় নাই। জেনারেল জিয়ার মত তিনিও এক হৃদয় বিদারক মৃত্যুবরণ করেন।

এক সড়ক দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে নিজস্ব গাড়িতে তার স্ত্রী তৎক্ষনাৎ মৃত্যুবরণ করেন এবং তিনিও মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে জ্ঞান ফেরার পর সহধমনির মৃত্যুর কথা শুনে তিনিও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যবরণ করেন। এ পাহাড়ীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের ফল বলে কেউ কেউ মনে করেন।

অদূরদর্শী পাহাড়ীদের ক্ষতিপূরণের যৎ সামান্য টাকা যথেচ্ছ খরচ করার গল্প লোকের মুখে শোনা যায়। পূর্ব পুরুষের ভিটা, জায়গা-জমি জলমগ্ন হওয়ার আগ পথ বিশ্বাস করতে পারে নি যে, তারা বাস্তুচ্যুত হবে।

তাই অনেকেই রেডিও, টেপরেক ও অন্যান্য সৌখিন জিনিসপত্র ক্রয় করে ক্ষতিপূরণের সমুদয় টাকা খরচ করে ফেলে। কিছু কিছু লোক নাকি “আইয়ুব খান” বনে যায়।

যতদিন টাকা হাতে ছিল ততদিন ভাং ও মাছ, মাংস খেয়ে এবং গা ম্যাসেজ ও গোসল করার জনা চাকর রেখে আইয়ুব খাঁনের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করেছিল। উল্লেখ্য যে, আইয়ুৰ খাঁন তখন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করত তিনি অত্যন্ত সৌখিন ও জাঁকজমক  যাপন করতেন।

সৰ পাহাড়ীরা আবার অপরিনামদর্শী ছিলেন না। উদাহরন স্বরূপ আমার বাবা ১০৯ নং মৌজার হেডম্যান প্রিয়মোহন দেওয়ান তার ধন্যজমি জলমগ্ন হওয়ার পর বিশেষ বিচলিত হন নি।

তিনি অন্যত্র অপরিচিত স্থানে চাষয্যাগ্য জমির খোঁজ না করে নিজস্ব মৌজায় রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশে ৪ একর পাহাড় বন্দোবস্ত নিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করলেন। সেখানে তিনি ফলজ ও বনজ (সেগুন) গাছ রোপন করলেন।

তাঁর কর্মকান্ডে উৎসাহিত হয়ে মৌজার লোকজনও অন্যত্র কোথাও না গিয়ে নিজস্ব মৌজায় আবাদ করতে লাগল। দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা সমান করে কিছু কিছু চাষযোগ্য জমিও প্রস্তুত করল। দশ বার বছরের মধ্যে ফলজ, বনজ ও ফসলী চাষের উৎপাদন পেয়ে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৩টি উপজাতির আবাসভূমি হলেও কাপ্তাই বাঁধে সবচেয়ে বেশী  ক্ষত্যি হয় চাকমারা। তার পরে ক্ষত্মিস্থ হয় আদি মুসলমান বাঙ্গালীরা যারা বালুখালী, ঝগড়াবিল, চিনালা, পুরানবন্তী ইত্যাদি সমতল ভূমিতে চাকমাদের পাশাপাশি চাষ করত।

উল্লেখ্য যে, তাদের পূর্বপুরুষরা চাকমা রাজার বদান্যতায় এবং চাকমাদেরকে চাষাবাদে উবুদ্ধ করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে আসে। তারা অত্যন্ত রাজভক্ত ছিল।

কর্ণফুলী, মাইনি, চেঙ্গী, ও কাচালং নদীর ভ্যালির সমতল ভূমি শস্যভান্ডার নামে পরিচিত ছিল। ৫৪ হাজার একর জমি জলমগ্ন হয়। কাপ্তাই বাঁধের পানি চাকমাদের “অশ্রুজলে“ পরিণত হল।

সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় পথের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। কিন্তু কোথা থেকে তারা যেন শক্তি সঞ্চয় করল। অভ্যন্তরীণ উদ্ভাস্তরা কঠোর পরিশ্রম করে জঙ্গল পরিষ্কার করল।

আবাদি জমি তৈরী করে ফসল উৎপাদন করল এবং একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখল। ক্রমশঃ তারা শিক্ষার প্রতি তাদের জন্মগত অনুরাগকে লালন করে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেষ্ট হতে লাগল।

উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্স এক পর্যায়ে জার্মানীর দখলে চলে যায়। হাজার হাজার জার্মান সৈন্য প্যারিসে ঢুকে পড়ল। অনেকে মনে করল ফ্রান্সের মৃত্যু হয়েছে।

হঠাৎ জৈনক এক দার্শনিক বলে উঠলেন একটি জাতি মৃত্যুবরণ করতে পারে না। বাঁচার জন্য জাতি কি পন্থা অবলম্বন করবে তা কাউকে জিজ্ঞেস করবে না। নিজেই বাঁচার পথ আবিষ্কার করে নেবে।

দার্শনিকের এই উক্তি মৃতপ্রায় ফরাসী জাতিকে প্রচন্ড নাড়া দিল। ক্রন্দনরত জাতি শক্তি সঞ্চয় করল এবং জার্মানীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিরোধ করে দেশকে মুক্ত করল।

সম্ভবত ১৯৫৮ সালে ছাত্রবস্থায় প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা কাপ্তাই বাঁধ তৈরীর বিরুদ্ধে তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে লিখিত প্রতিবাদ করেন। ফলশ্রুতিতে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। জেলে বসেই তিনি বি,এ পাশ করেন।

পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এমএলএ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সংসদে এম,পি নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় করার জন্য সংসদে জ্বালাময়ী বক্তব্য পেশ করেন।

উগ্র বাঙ্গলী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন- একজন বাঙ্গালী যেমন চাকমা হতে পারে না, তে একজন চাকমাও বাঙ্গালী হতে পারে না।

কেন তিনি বাকশালে যোগ দেন জিজ্ঞাসা করলে “মানবেন্দ্র লারমা বলতেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি শেখ মুজিবের ভ্রান্ত ধারনা কিছুটা হলেও পরিবর্তন করার জন্য আমি বাকশালে যোগ দিয়েছি”।

বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর লারমা পরবর্তী সামরিক সরকারকে কিছুতেই আস্থায় নিতে পারেন নি। নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করলে তিনিই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা। তিনি কোন ক্রমেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে গ্রহন করেননি।

১৯৭৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বরর কোন একদিনে মানবেন্দ্র লারমা আমার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে আমার সাথে সাক্ষাত করতে আসেন। সম্পর্কে তিনি আমার ভাগিনা হন এবং আমাকে মামা বলেই সম্বোধন করেন।

আমার বাসায় এক রাত্রি যাপন করেন। মানবেন্দ্র অত্যন্ত অমায়িক ও স্বল্পভাষী ছিলেন। আমার সাথে রাজনীতি বিষয়ে কোন আলোচনা করেননি। আমার কয়েকজন বাঙ্গালী বন্ধুর সাথে পরিচয় করাতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

এতে বুঝা যায় তিনি প্রচার বিমুখ ছিলেন। বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর তার সাথে আর দেখা হয়নি।

পরবর্তীতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গঠন করে সংগ্রামের নেতৃত্ব দেব এবং পরে ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ সালে গৃহযুদ্ধে নিহত হন।

পাহাড়ীদের মহান নেতা প্রতি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সম্বন্ধে উপরে উল্লেখিত কয়েকটি লাইন তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম

ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের তত্তাবধানে ও ব্যড ক্লিকের নেতৃত্বে সমগ্র ভারত দু’ভাগে বিভক্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্য ১৮ই আগষ্ট আগে নির্ধারিত হল না।

কোন জনমত যাচাই ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে (মুসলমান জনসংখ্যা শতকরা ১ ভাগের বেশী নহে) ১৮ই আগষ্টে রাতে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত করার কথা ঘোষনা করা হল।

তবে এখন বুঝা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভাগ্য নির্ধারণে র‌্যাডক্লিকের ইচ্ছাকৃত ভূমিকা ছিল না। মাউন্টব্যাটেন ও তদানিন্তন বাংলার গর্ভনর স্যার ফেড্রিক বেরোসের সিদ্ধান্তই মুখ্য ছিল।

এ ব্যাপারে মতামত আছে যা পরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করব। ১৯৪৭ সালের ১৮ই আগষ্ট চট্টগ্রামের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির খবর যখন প্রচার করা হয় তখন আমি ক্লাশ সিক্স এর ছাত্র। ক্লাশ ফাইভ ও সিক্স আমি অনায়াসে পাস করি।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আন্দোলনের ঢেউ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়েও মৃদু আঘাত করে। তৎকালীন পার্বত্য নেতাদের মধ্যে কামিনী মোহন দেওয়ান ও স্নেহকুমার চাকমার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

প্রথমতঃ এ দু’জনই ভারতীয় কংগ্রেসপন্থী ছিলেন। ১৯৪৭ এর প্রথম দিকে এক সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি রাঙ্গামাটি আসে। এ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এ.ভি ঠাকুর এবং সদস্যরা ছিলেন ডাঃ প্রফুল্ল ঘোষ, জয়পাল সিং, রাজকৃঞ্চ বোস, ফুলবান সাহা ও জয় প্রকাশ নারায়ন।

এ কমিটির কো-অপ্ট মেম্বার ছিলেন স্নেহ কুমার চাকমা। এই কমিটিকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল রাঙ্গামাটির খেলার মাঠে। সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন কামিনী মোহন দেওয়ান। জনগন শতভাগ বিশ্বাসী ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই লক্ষে খেলার মাঠে প্রায় প্রতিদিন সভা সমিতি, যাত্রাগান ও র‌্যালীর ব্যবস্থা করা হয়।

রাঙ্গামাটি সরকারী ইংলিশ স্কুলের ছেলে মেয়েদেরকে র‌্যালীতে ব্যবহার করা হত। “জয় হিন্দ” শ্লোগানে মাঠ-ঘাট মুখরিত ছিল। এই কংগ্রেস পার্টির উপজাতীয় নেতাদের সাথে পার্বত্য রাজাদের কোন যোগাযোগ বা পরস্পরের প্রতি সম্মান বোধ মোটেও ছিলনা।

যুবক নেতা স্নেহ কুমার চাকমা খুবই মেধাবী কিন্তু উগ্রবাদী ছিলেন। তদানিন্তন ডিসি জি, এল হাইডের সাথেও তার ভাল সম্পর্ক ছিল না। ব্রিটিশরা মৃত্যুকালেও যে হুল ফুটাতে পারে সে জ্ঞান তার ছিল না।

১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান জন্মের ঘোষনার পরে পরেই আনুমানিক রাত ১২টায় প্রশেসন সহকারে স্নেহ কুমার ডিসি জি, এল হাইডকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করতে বলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তদুপরি যে কোন দেশের জাতীয় পতাকা রাতে উত্তোলন করা অশোভনীয় হলেও স্নেহ কুমার পীড়া পিড়ি করতে থাকেন। অন্যদিকে সঙ্গে নেওয়া লোকজনকেও তিনি ক্ষেপিয়ে তুলেন।

নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে পরের দিন ১৫ই আগষ্ট ভোরে ডিসি সাহেব পতাকা উত্তোলনের জন্য আসতে বলেন। সহজে বুঝা গেল যে, সেইদিন স্নেহ কুমারের এহেন ব্যবহারের জন্য তিনি অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করেছেন।

পরের দিন কাক ডাকা ভোরে স্নেহ কুমারের নেতৃত্বে এবং বড় ভাইদের পিছনে পিছনে আমরা আবার ডিসি বাংলোতে গেলাম।

ডিসি সাহেব যথাযথ মর্যাদায় গার্ড অব অনার সহকারে ইউনিয়ন জ্যাক নামালেন এবং সাথে সাথে আবার গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটে গেল বিপর্যয়।

পতাকাটি চুড়ান্ত পর্যায়ে উঠার আগে পুলি ভেঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেল। যেনতেন করে ভারতীয় পতাকাটি উত্তোলন করা হল। অজানা এক আশঙ্খা নিয়ে আমরা বাড়ী ফিরে এলাম।

ডিসি জি, এল হাইড একদন্ডও আর অপেক্ষা করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় ঘোড়াটিকে নিজে গুলি করে মারলেন এবং নিজেই বাংলোর পশ্চিম পার্শ্বে কবর দিলেন।

তারপর একটি লঞ্চে করে সোজা চট্টগ্রাম ও পরে কলকাতায় চলে গেলেন। ১৫ই আগষ্ট ছিল রাঙ্গামাটি থেকে তাঁর চির বিদায়ের দিন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোন পার্বত্য নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্য নির্ধারণে হাইডের সহযোগিতা চাননি।

ধারণ করা যায়, হাইড পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথাস্থানে জোর ওকালতি করেছেন। শোনা কথা, ডিসি হাইড নাহি স্নেহ কুমারের প্রতি দেখে তাঁত একটি উচু পদের চাকুরীর জন্য সুপারিশ করতে চেয়েছিলেন।

উত্তরে স্নেহ কুমার নাকি বলেছিলেন “কয়েকদিন পরেই আপনাকে আমার অধীনে চাকুরী করার জন্য আমাকেই সুপারিশ করতে হবে।” আরও জানা যায় যে, কারণে অকারণে স্নেহ কুমার হাইড সাহেবকে উত্যক্ত করেছেন।

রাজাদের সাথে বিশেষ করে তখনকার চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সাথেও তার কোন ভাল সম্পর্ক ছিল না। রাজাদের কাঁদে জোয়াল লাগিয়ে হালচাষ করবেন বলেও দাম্ভিক উক্তি করতেন।

এইসৰ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের প্রতি বোধ হয় চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়ের কোমল আকর্ষন ছিল।

বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা কামিনী মোহন দেওয়ানের সাথে প্রথম দিকে সংগ্রামের একাত্ততা থাকলেও কামিনী বাবু তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি মেনে নেন। কামিনী মোহন দেওয়ান স্নেহ কুমারকে একগুয়ে ও ভাবাবেগ প্রাপ্ত উন্মাদ বলে উল্লেখ করেন।

১৯৪৭ সালের ১৮ই আগষ্টের পর পরেই এই অন্তর্ভুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য প্রচেষ্টা করেন স্নেহ কুমার।

কিন্তু রাজা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হলে তিনি তাঁর গুটি কয়েক কমরেডকে সাথে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চিরদিনের জন্য পালিয়ে যান।

২১শে আগষ্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট ডিসি বাংলা প্রাঙ্গন থেকে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।

পার্বত্য জনগণের আশা আকাঙ্খাকে ধুলিসাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তিকে কেহ কেহ সহজে মেনে নিতে পারছিল না। বিশেষ করে সিনিয়র ছাত্র সমাজ অর্থাৎ ক্লাশ নাইন ও টেনের ছাত্ররা।

পাকিস্তান হওয়ার কয়েক মাস আগে এক ব্রিটিশ আমাদের স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে কাজে যোগ দিলেন। তাঁর নাম ভিসি প্রিন্স। দেশ বিভাগের পরে পরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ডিসি হয়ে যোগ দিলেন আর এক ব্রিটিশ নাগরিক নাম এল,এইচ,নিৰলেট।

যেহেতু পার্বত্য জনগণের নবসৃস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে খাপ খাওয়াতে সময়ের দরকার সেহেতু পাকিস্তান সরকার অত্যন্ত সুবিবেচনার ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এই স্পর্শ কাতর অঞ্চলে প্রথমত: ব্রিটিশ প্রশাসক নিয়োগ দেন।

এল,এইচ,নিবলেটের উপস্থিত পার্বত্যবাসীরা নিরাপদ বোধ করল। অনুভব করল তারা মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনে এই দুই ব্রিটিশ নাগরিক অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে কাজ করে পাকিস্তানের প্রতি জনগনের আস্থা সৃষ্টি করতে লাগলেন।

১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে আমি ক্লাস সিক্স এ প্রমোশন পেয়েছি। তখন ১৩-১৪ বছরের এক কিশোর। এ বয়সে উর্ধগতি অথবা নিগতি লাভ করা সহজ। বিশেষ কারণে আরও ২-৩ জন ছাত্রসহ (আমার সিনিয়র) তালুকদার বাড়ী ত্যাগ করে স্কুলের হোষ্টেলে আশ্রয় নিতে হল।

আবাসিক পরিবর্তন আমার জন্য শুভ হলনা। একেতো স্বাধীনতার আন্দোলনে সমস্ত স্কুলটি ছিল উত্তাল তদুপরি হোষ্টেলে খাওয়ার মান এতই নিম্ন যে এ খাবার খেয়ে প্রাণ রক্ষা করাই কষ্টকর ছিল।

ভাতের ভেতর প্রায় সিকি ভাগই থাকত শিলা বা পাথরের নুড়ি আর ডালের দিকে তাকালে নিজের সমস্ত মুখমন্ডল দেখা যেত। তখন মাসিক ফুড চার্জ বোধ হয় ৫ টাকা। খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য আমার বন্ধু অজিত দেওয়ানের (ওরফে রূপ্যা) সাথে কর্ণফুলিতে মাছ ধরা শিখতে হয়।

অজিত আমার চেয়ে অনেক ভাল মৎস্য শিকারী। সে খালি হাতে বেশ বড়বড় চিংড়ি ও বেলে মাছ ধরতে পারত। কয়েকদিন ট্রেনিং নেওয়ার পর আমিও মাছ ধরতে শিখলাম। মাছ পেতে হলে গভীর পানিতে ডুব দিয়ে পাথরের নিচে অথবা চিপায় হাতরাতে হত।

গর্তেও হাত দিতে হত। একবার একটি বড় চিংড়ি মাছ ধরতে গিয়ে আমার ডান হাত গর্তের চিপায় আটকে গিয়েছিল। গভীর জলে আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। মরণ টান দিয়ে কোন প্রকারে হাতের কব্জি ছড়িয়ে আনি।

জলে ভেসে উঠে দেখি, আমার মুঠোয় সেই চিংড়ি মাছটি বড় দাঁড় বন্দী হয়ে আছে। অজিত রান্নাও করতে জানত। অতএব তার বদৌলতে “মৎস্য মারিয়া সুখে খাইতে” লাগলাম।

আমার চেয়ে বয়সে একটু বেশী হলেও অজিত আমার নীচের ক্লাশে পড়ত। পড়াশুনায় সে ভাল ছিল না। উপর্যপরি কয়েকবার ফেল করার পর সম্ভবত ক্লাশ ফাইল থেকে চিরতরে পড়াশুনা বন্ধ করে সে চলে গেল।

অজিতের বাবা যোগেন্দ্র লাল দেওয়ান রাঙ্গামাটি মৌজার হেডম্যান ও একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়ার ছিলেন। তিনি মোহনবাগানের টিমেও নাকি খেলতেন। তাঁর খেলা রাঙ্গামাটির মাঠ সবাই উপভোগ করত।

তাঁর পায়ে এত শক্তি ছিল যে, একবার তার শটে একটি নতুন বল আকাশে ফেটে যেতে দেখেছি। | নবসৃষ্ট দেশ পাকিস্তানে নতুন পরিবেশে আমাদের শিক্ষাক্রম চলতে লাগল। আমি তৃতীয় অর্থাৎ থার্ড বোর্ডিং-এ থাকতাম।

ফ্লোরে পাটি বা তোষক বিছিয়ে দু’সারিতে আমাদের থাকতে হত। নিজ নিজ বিছানায় বসেই পড়াশোনা করতে হত। কোন চেয়ার টেবিলের বালাই ছিলনা। আমার সহপাঠি যে কর্মজীবনে আমার সহকর্মীও ছিল, অনিল কৃঞ্চ কার্বারি এর কথা বেশ মনে পড়ে।

অনিল ছিল আমার বাম পাশের বিছানায়। তাঁর পাশে কেউ থাকতে চাইতনা। কারণ সে রাতে ঘুমের ঘোরে বিছানা ভেজাত। আসলে এতে বেচারার কোন দোষ নেই, এটি তার জন্মগত রোগ।

বন্ধু বান্ধবেরা তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই রাতে শুতে যেত। পরবর্তীতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে দু’পরিবারের একাত্ততা ও ঘনিষ্ঠতা আমাদের কর্মময় জীবনের কিছু অংশকে অত্যন্ত স্মরণীয় করে রেখেছে। সুযোগ হলে অনিল সম্বন্ধে পরে বলব।

১৯৪৮ সালে ক্লাশ সেভেনে উত্তীর্ণ হলাম। দেশ বিভাগের অস্থিরতা অনেকটা থেমে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু সিনিয়র ছাত্র পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যেন মেনে নিতে পারছিলনা। তারা বিগত প্রায় এক বছর যাবত স্নেহ কুমারের নেতৃত্বে চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল।

অতএব তারা মানসিক বিপর্যস্ত ছিল। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করত। আমাদের মত ছাত্রদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত। মনে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষও পাহাড়ী ছাত্রদের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখছিল।

কারণ সিনিয়র ক্লাশের ছাত্ররা স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। এ লক্ষ্যে একটা কিছু অজুহাত খুঁজছিল। ১৯৪৮ সালের বোধহয় মাঝামাঝি সময়ে জনৈক এক শিক্ষকের তথাকথিত দুর্ব্যবহারকে কেন্দ্র করে ক্লাশ নাইন ও ক্লাশ টেন এর ছাত্ররা চরম উত্তেজিত হয়ে হৈ হল্লা করে ক্লাশ বর্জন করে এবং জুনিয়র ছাত্রদেরকেও বের করে নিয়ে আসে।

সিনিয়র ছাত্ররা যে যেদিকে পারে স্কুল থেকে পালিয়ে গেল। আমরাও তাদেরকে অনুসরণ করে স্কুল ত্যাগ করে চলে গেলাম। স্কুল ত্যাগ করার সময় একটা চমক ও উত্তেজনা উপভোগ করলাম।

কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের জন্য যে কি কঠোর পরিণাম অপেক্ষা করছে তা ভুলেও উপলব্ধি করতে পারিনি। স্বাভাবিকভাবে ছাত্রদের এ উচ্ছলতাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সরকার রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল বলে গণ্য করল।

স্কুল কর্তৃপক্ষ রিং লিডারদের তালিকা প্রস্তুত করতে লাগল। আমি বাবার ভয়ে বাড়িতে না গিয়ে অজ্যংছড়ি গ্রামে আমার কাকাতো বোনের শ্বশুর বাড়িতে চলে গেলাম। কিন্তু পরের বাড়ীতে বেশী দিন থাকা অশোভনীয় বুঝতে পেরে রাঙ্গামাটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

রাঙ্গামাটি থেকে অজ্যংছড়ি ১০ মাইল উত্তরে চেঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এ গ্রামে কুরাকুট্যা গোজার লোকজন বসবাস করত। এ গ্রামে একটি Lower English (LE) স্কুল ছিল।

এই স্কুলের জন্য অজ্যংছড়ি এলাকার করাকুট্যা গোজার লোকজন তুলনামুলকভাবে শিক্ষিত ছিল। গ্রামের বেশীর ভাগ পরিবার ভূমি চাষী ছিল বলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তুলনামুলকভাবে ভালো ছিল।

গ্রামটি ছবির মত সুন্দর ছিল। কাপ্তাই হ্রদের জলে এই গ্রামটি এখন নিমগ্ন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে আমিও কুরাকুট্যা গোজার অন্তর্গত। এ গোজা লেখাপড়ায় অগ্রসর ছিল।

যাক রাঙ্গামাটিতে ফেরার পথে কয়েকজন নেতৃত্বদানকারী ছাত্রের সাথে দেখা হল। তারাও অজ্যংছড়ি গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। অর্ধেক পথ থেকে আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করল।

আমি অনিচ্ছা সত্বেও আমার বোনের বাড়ীতে ৭/৮ জন লোকের জন্য একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিলাম। পরে তারা গেলে পরের দিন আবার রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে হেঁটেই রওনা হলাম।

আসার সময় তারা আমাকে সাবধান করে দিল আমি যেন তাদের অবস্থান সম্বন্ধে কাউকে কিছু না বলি। শিক্ষা জীবন ক্রমশঃ কংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমি সোজা বাড়িতে গিয়ে বাবার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। বাবা পরের দিন সকালে হেডমাস্টার ভি,সি বাংলোতে আমাকে নিয়ে গেলেন এবং আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

ভিসি প্রিন্স সাহেব আমাকে কাছে ডাকলেন এবং এতদিন কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি সত্য কথা বললাম। তিনি নেতাদের অবস্থান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে জানি না বলে মিথ্যা জবাব দিলাম।

আর যেই জবাৰ সেই কাজ। তিনি একটি লম্বা বেত বের করে আমাকে গরু পেটা করতে লাগলেন। তিনি মনের মত আমাকে পেটালেন। যখন তিনি পেটানো শেষ করলেন তৎক্ষনাৎ শুরু হল বাবার কিল, থাপ্পর।

মনে হয়েছিল নিশ্চিত মৃত্যু হবে সেদিন। ভাল করে নিঃশ্বাস ফেলতে পরছিলাম না। উভয়ের কাছে কমপক্ষে পনের মিনিট মার খাওয়ার পর নিস্তেজ হয়ে মেঝে পড়ে রইলাম। হাতের তালু, গিড়া, পিঠ ও সমস্ত শরীরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলাম।

হেডমাস্টার মহোদয় পরদিন থেকে শ্রেণী ক্লাশে যাওয়ার অনুমতি দিলেন কারণ আমার বাবার উপযুক্ত শাসনে তিনি প্রীত হয়েছেন। অবশেষে হেডমাস্টার বেত উচু করে আমাকে যেতে বললেন।

আমি অতি কষ্টে মেঝে থেকে উঠে মাথা হেট করে তাঁর বাসার প্রাঙ্গন ত্যাগ করলাম। সম্মুখে টিলার উপর আমাদের ভুল। বেলা তখন প্রায় ১২টা। ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে উপরে তাকালাম কেহ আমাকে দেখে হাসছে কিনা।

ভাগ্য ভাল স্কুল পুরোদমে চলছিল। ছাত্র-ছাত্রীরা সকলে ক্লাশে, অতএব আমাকে বিপর্যস্ত অবস্থায় কেহ দেখতে পায়নি। রাস্তায় উঠেই আমি উন্মাদের মত উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়াতে লাগলাম।

এক সময় মনে হল এ জীবন রেখে কি লাভ? মনে মনে আরও ভাবলাম স্কুলে আর যাৰ না, পড়াশোনা বন্ধ করে দিব। এই সব আজগুবী চিন্তা করতে করতে আনন্দ বিহারে অবস্থিত আমাদের ছাত্রাবাসে চলে আসলাম।

আপন বিছানায় আঘাতে জর্জরিত দেহখানা বিলিয়ে দিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টেরও পেলাম না। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠ দেখলাম দু’বন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

মনে মনে বললাম তারা কি তাহলে আমার মার খাওয়ার কথা জানতে পেরেছে? আসলে ওরা উভয়েই আমার দুর্ভাগ্যের কথা কিছুই জানত না।

আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলাম। তারা আন্তরিক সমবেদনা জানাল। তারা আমার ভবিষ্যৎ ও পড়াশোনার ব্যাপারে কোন প্রতিকুল সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করল।

পরের দিন দ্বিধা-দ্বন্ধ ত্যাগ করে স্কুলে গেলাম। প্রায় দু’সপ্তাহ অনুপস্থিতির পর আমাকে বিমর্ষ অবস্থায় দেখে সহপাঠীরা অবাক চোখে তাকাতে লাগল।

আমি শ্রেণী শিক্ষকের কাছে রিপোর্ট করলে তিনি “ও তুমি সেই দুষ্টু ছেলে” বলে আমার নাম পুনঃরোল কল রেজিস্টারে অন্তর্ভূক্ত করেন।

পরে জানা যায় প্রায় অর্ধ ডজন সিনিয়র ক্লাশের ছাত্রকে বিশৃংখলা সৃষ্টি ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে চিরতরে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোন ভুল ৰা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করার অযোগ্য বলে ধোষনা করা হয়।

দশম শ্রেণীর ছাত্র সুরতি রঞ্জন খীসা এদের অন্যতম। তারা অনেকেই ভারতে গিয়ে অধ্যয়ন করে এবং পরবর্তীতে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বসবাস করে।

আরও প্রায় অর্ধ ডজন সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রকে দেশের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারবে সাপেক্ষে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ডাক্তার ও সমাজকর্মী প্রয়াত ডাঃ ভগদত্ত খীসা। আমিও হয়ত এ লিস্টে কিন্তু আমার বাবার দুরদর্শীতার কারণে এ অপরাধ থেকে মুক্তি পাই।।

দেখতে দেখতে ১৮৪৮ সাল চলে গেল। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে কম বছর। সপ্তম শ্রেণী পাস করে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি। দায়িত্ববোধ ও তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হল।

ফেলে আসা দিনগুলির প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই কিন্তু আক্ষেপ আছে। স্কুল জীবনে অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। যাদের কথা আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে তাদের কথা কিছু না বললেই নয়।

সুধেন্দু বিকাশ চাকমা পঞ্চম শ্রেণী থেকে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তার বড় বোন বীনাপানিও আমার সহপাঠিনী ছিল। যেহেতু সে সুধেন্দুর বড় বোন সেহেতু আমার বড় বোনের মর্যাদাও লাভ করত। ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় এক পুলিশ অফিসারের সাথে তার বিয়ে হয়।

বীনাপানি সুন্দরী ছিল বলে সিনিয়র ক্লাশের কিছু ছেলে আমার মাধ্যমে বীণাপানির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত। তারা জোর করে চিঠি আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিত। কিন্তু আমি কোনদিন সেই চিঠিগুলি বীণাপানিকে দিইনি, কারণ আমি তাকে বড় বোনের মত সম্মান করতাম।

সুধেন্দু ১৯৫২ সালে আমার সাথে স্কুল ফাইনাল (মেট্রিক) পাশ করার পর চট্টগ্রামে মেডিকেলে ডিপ্লোমা কোর্সে (LMF) ভর্তি হয় এবং যথাসময়ে পাশ করার পর রাঙ্গামাটিতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করে।

কিন্তু সে এত মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে যে, সে প্রায়ই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের পরিবারের উপর অত্যাচার করত। ডাক্তার হিসেবে সে কিন্তু প্রশংসার পাত্র ছিল এবং মানুষ হিসেবেও দয়ালু ছিল।

সে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল কিন্তু ভালবাসার পাত্রীতে এতটুকুও সুখ ও শান্তি দেয়নি। তার স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যায়। পরবর্তীতে সুধেন্দুকে মাদকাসক্ত অবস্থায় নিজ বাড়ীতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ডাক্তার হিসেবে সুধেন্দুর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। গরীবদের প্রতি তার সহানুভূতি ছল। অনেক গরীব রোগী বিনা পয়সায় তার কাছ থেকে চিকিৎসা পেয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপান ও উচ্ছংখল জীবন যাপনের জন্য এক অবধারিত করুন পরিনতির শিকার তাকে হতে হয়েছে।

শোনা কথা তার গুরু জন অর্থাৎ বাবা ও মা সুধেন্দুর বিয়েতে রাজী ছিলেন না। বিয়ের যাত্রা পথে নাকি শুয়ে পড়ে তাঁরা বাঁধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সুধেন্দু তার প্রেমিকার প্রতি এতই আসক্ত ছিল যে, পিতামাতার সকল বাধা অগ্রাহ্য করে তাকে শায়িত শরীরের উপর লাফ দিয়ে চলে যায় এবং প্রেমিকাকে বিয়ে করে।

সুখে জীবনের করুণ পরিণতি কি তার পিতামাতার অভিশাপের ফল? সে যাই হোক এই প্রতিভাবান ডাক্তার বন্ধুটির জন্য আমি ও সমাজ চিরদিন দুঃখিত ও অনুতপ্ত থাকব।

আমার আর এক সহপাঠী বন্ধু ছিল সুশেন বিকাশ চাকমা। শয়নে স্বপনে আমরা বন্ধু ছিলাম। অনেকে আমাদেরকে মানিক জোড় বলত। আমরা প্রায় একত্রে চলাফেরা করতাম ।

তার বাড়ি ছিল ঝগড়াবিল কর্ণফুলি নদীর তীরে। যে কোন উৎসব, পূজা পার্বনে ও খেলাধুলায় আমরা প্রায়ই একত্রে উপভোগ করতাম। কখনও তাদের বাড়ি কখনো আমার বাড়ি গিয়ে ছুটি উপভোগ করতাম।

ভাদ্র আশ্বিন মাসে নৌকা ভাসিয়ে তিন কোণা বিশিষ্ট জাল দিয়ে কর্ণফুলির ইলিশ ধরা আমার কাছে খুবই চমকপ্রদ ও আনন্দময় ছিল। কর্ণফুলির টাটকা ইলিশ খুবই সুস্বাদু ছিল।

১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে কর্ণফুলির সেই জীব-বৈচিত্র্য অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালে স্কুল ফাইনাল পাস করার পর আমি তেঁজগাও, ঢাকাতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজে পাঁচ বছর মেয়াদী ভেটেরিনারি ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই।

কিন্তু সুশেন সম্ভবত অর্থনৈতিক কারণে কোন উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করতে পারেনি। যখন আমি ডিগ্রী কোর্সের তৃতীয় বর্ষে, তখন এক বন্ধে রাঙ্গামাটি চলে আসি। সুশেনের সাথে দেখা হলো।

জানতে পারলাম স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর সে এখনও ভাসমান অবস্থায় আছে। বেসরকারী প্রাইমারী স্কুলে অনিয়মিতভাবে শিক্ষকতা করে যাচ্ছিল।

তাকে ভেটেরিনারি কলেজে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাব দিলে সে আমার এক কাকাত (চাচাত) বোনের সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব দেয়, এই শর্তে যে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স পড়ার খরচ কন্যার পিতাকে বহন করতে হবে।

আমি প্রস্তাবটি কাকা ও কাকীমার কাছে উত্থাপন করলাম। কাকা একজন পরিশ্রমী ও সফল কৃষক। ভবিষ্যতে জামাই এর পিছনে মাসিক একশত টাকা খরচ করা তার জন্য একটু কষ্টসাধ্য হলেও কাকীমা ভেবেচিন্তে রাজী হয়ে গেলেন।

কলেজে ভর্তি ও মাস দুয়েকের আগাম খরচ দিয়ে সুশেনকে আমার সাথেই ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তার আত্মীয় স্বজন বা অভিভাবকদের এ ব্যাপারে অবহিত করার প্রস্তাব দিলে সুশেন যথারীতি অবহিত করা হবে বলে মন্তব্য করে।

যথাসময়ে আমরা তেঁজগাওতে অবস্থিত ভেটেরিনারি কলেজে পেীছলাম। তখন কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল। সুশেন দরখাস্ত ফর্ম পূরণ করে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তির আবেদন করল।

সে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভর্তিও হয়ে গেল। কিন্তু কয়েকদিন ক্লাশ করার পরে তার মতিগতি বদলে গেল। সে বোধ হয় অন্যের প্ররোচনায় পাঁচ বছর মেয়াদী ডিগ্রী কোর্সে ভর্তির ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি স্বাভাবিকভাবে কাকা ও কাকীমার মতামত ছাড়া এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অপারগতা প্রকাশ করলে সে কলেজ ছেড়ে চলে যায়।

একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর এহেন তরিৎ মত পরিবর্তনের মানসিকভাবে মেনে নিতে পারছিলামনা। বিষয়টি বিনা মেঘে বজ্ৰপাত হিসেবে ঠেকল।

পরে সুশেন অন্যত্র বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করে। সে বন্ধুত্বের ইতি টানলেও আমি অতি সহজে তাকে ভুলতে পারিনি। বন্ধে রাঙ্গামাটি এসে একবার তাকে তার আসামবস্তী বাসায় দেখতে গিয়েছিলাম।

তবে তার নুতন বৌ এর সাথে আমার পরিচয় করে দিয়েছিল কিনা আমার স্মরণ নেই। এটি বোধহয় ১৯৫৫ সালের ঘটনা। এরপর সুশেনের সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি।

২০০২ সালে আমি বাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর সুশেনের দুই সুদর্শনী বিবাহিত কন্যার সাথে পরিচয় হয়। তাদের কাছে জানতে পারি সুশেন দীঘিনালায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।

সে অবশ্য ২০০৪ সালে তার কন্যাদ্বয়কে নিয়ে আমার বাসায় আমার সাথে এসেছিল। তখন আমরা দু’জনেই বয়োবৃদ্ধ। সঙ্গতকারণে আমরা কেহই আমাদের পর্বের ইতিহাস সম্বন্ধে বলিনি। কন্যাকুল্য মেয়েদেরকে সাধ্যমত কিছু আর্থিক সাহায্য দিতে পেরে আমি ধন্য হয়েছিলাম।

আমার আরও একজন সহপাঠী মেধাবী বন্ধু ডাঃ সুব্রত চাকমার কথাও কিছু বলতে হয়। সে স্বনামধন্য প্রয়াত শিক্ষাবিদ ও স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর কৃঞ্চ কিশোর চাকমা কনিষ্ঠ সন্তান। সুব্রত সুদর্শন ও মেধাবী ছিল।

ক্লাশের আর একজন মেধাবী ছাত্র রামেন্দু বিকাশ দেওয়ানের সাথে ক্লাশে প্রথম স্থান অধিকার নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা চলত। উভয়েই ১৯৫২ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করার পর এইচএসসি তখন (আই,এস,সি) কৃতিত্বের সাথে পাশ করে।

সুব্রত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও রামেন্দ আসানুল্লাহ ইঞ্জিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়। সুব্রত যথা সময়ে কৃতকার্য হয়ে ডাক্তার হয়। সে পিতৃহীন হলেও তার তেজম্বিস্নী মা মনোরমা দেওয়ানের সার্বিক তত্বাবধানে ছিল।

সুব্রতের প্রতিদ্বন্ধী রামেন্দু দেওয়ান ইঞ্জিয়ারিং ফেল করে। পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে এম এস সি পাশ করে বিলেত চলে যায়। সুব্রত পরিবারের সাথে আমার পরিবারের অনেক মধুর স্মৃতি ও যোগসূত্র আছে।

সুব্রত ও আমি শুধু সমবয়সী নই, তার স্ত্রী মলিনা এবং আমার স্ত্রী দীপিকা ওরফে কল্যানী সমবয়সী এবং সহপাঠিনী। আত্মীয়তা সম্পর্কে কল্যানী মলিনার মাসি হয় এবং সুব্রতও আমার দূর সম্পৰ্কীয় ভাগিনা হয়।

তাই আমরা পরস্পরকে পুত্র (পুত) বলে সম্বোধন করে থাকি। আমাদের সহধর্মিনীরাও পরস্পর পরস্পরকে মাসী বলে ডাকে। রাঙ্গামাটি থেকে আমাদের মানিকছড়ি গ্রামের বাড়িতে সুব্রতসহ বেড়াতে যেতাম এবং কয়েকদিন থেকে গ্রামীণ পরিবেশ উপভোগ করে ফিরে আসতাম।

চাকুরী জীবনেও আমাদের দু’পরিবারের সম্পর্ক ভালো ছিল,বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে পরে সুব্রত যখন ময়মনসিংহে বদলী হয়ে আসল, প্রায় দুই তিন বছর আমাদের একই শহরে কাছাকাছি বসবাস করার সুযোগ হয়েছিল।

তখন দু’পরিবারে উঠাবসা ছাড়াও মধ্যে মধুপুর জঙ্গলে গারোদের গ্রামের কাছাকাছি পিকনিক করে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করতাম। আমাদের ছেলে মেয়েদের জন্য এসব আয়োজন ছিল অত্যন্ত প্রায় আনন্দদায়ক। যাক পরে এ সম্বন্ধে প্রয়োজনবোধে আরও বলা যাবে।

আমার স্কুল জীবনে সপ্তম অষ্টম শ্রেণীর সময়কালটি ছিল ঝঞ্ঝাটময়। এই দু’বছরে আমার নির্দিষ্ট কোন থাকা খাওয়ার জায়গা ছিলনা, যেখান থেকে নির্বিঘ্নে লেখাপড়া চালানো যায়।

কখনো হোস্টেলে, কখনো আনন্দ বিহারের মেসে আর রাঙ্গাপানিতে অবস্থিত আমাদের খামার বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। রাঙ্গাপানি থেকে স্কুলের দূরত্ব ৩ মাইলের কম নয়। যানবাহন ছিল না। হাঁটা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না।

আমার মাতা পিতার সান্তনা ছিল এই দুঃখ কষ্টের মধ্যে লেখাপড়া করার পরও আমি কোন বছরই ফেল করিনি। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাবা আমার জন্য একটি সাইকেল কিনে দেন। সাইকেলটি ইংল্যান্ডের তৈরী ছিল।

কাঁচা রাস্তায় সাইকেল চালানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রাঙ্গাপানি থেকে সাইকেল চালিয়ে ৩ মাইল কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া হাঁটার চেয়ে কম পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। নবম শ্রেণীতে উঠার পর আমাদের স্কুলের কাছাকাছি যে কোন স্থানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলাম ।

আমার শুভাকাঙ্খী নিশিকান্ত তালুকদার বাবুর বাসায় ধর্ণা দিলে তার স্ত্রী সানন্দে প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। উল্লেখ্য যে, পঞ্চম ও ষষ্ট শ্রেণী অধ্যায়নকালে এ বাসায় ছিলাম।

তালুকদার বাবু আমার বাবার কাছ থেকে একটি চিঠি আনতে বললেন কারণ তিনি মনে করেছিলেন আমি আগে হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে তার বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। বাবার কাছ থেকে চিঠি আনার পর পুনরায় তালুকদার বাড়িতে ঠাই পেলাম ।

পিসিমা ও মিলি দিদির স্নেহ মমতার সান্নিধ্যে পুনঃ আসতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করলাম। আমার খোরাকি বাবদ প্রতিবছর একশত আড়ি ধান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে নবম শ্রেণীতে পড়া শুরু করলাম। স্কুল ফাইনাল গ্রুপের পাঠক্রম অনেক কঠিন। গণিতের ছয়টি বিষয়, যেমন পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, বলবিদ্যা এবং পরিমিতি পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আমাদের সময় কোচিং বা প্রাইভেট পড়া অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। একমাত্র কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় এ বিষয়গুলি আয়ত্বে আনতে হত। খুব ভাল ফলাফল অর্জন করে আমি নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম।

দশম শ্রেণীতে প্রমোশন পাওয়ার পর এক অজানা আনন্দে মন উদ্বেলিত হল। সামনে একটি বছর পার হলেই আমি মেট্রিক পাশ করে পরিবারে এবং সমাজে একজন সম্মানিত ও দর্শনীয় ব্যক্তি হিসাবে বিচরণ করতে পারবো এই আশা আমার বুকে জাগ্রত হল।

সাথে সাথে স্কুল পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশাও মনে বাসা বাঁধতে লাগল। কিন্তু বাবার দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা চিন্তা করলে সেই আকাঙ্খা নিভে যেতে চাইত।

ছোটকাল থেকে আমার প্রিয় খেলা হল কুস্তি, যাকে বলি খেলা বলা হয়। চাকমা সমাজে এই খেলাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রতি বছরই রাঙ্গামাটি শহর সহ বিভিন্ন পাড়ায় এ খেলার প্রচলন ছিল। লম্বায় আমি তুলনামূলকভাবে খাটো।

পাঁচ ফুটের একটু বেশী। কিন্তু এই দৈর্ঘ্য নিয়ে আমার চেয়ে উঁচু লোকজনকে কাবু করতে অসুবিধা হতনা। বলি খেলায় যত প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছি প্রায় সবগুলিতেই আমি জয়ী হয়েছি।

প্রায় ডজন খানেক রুপার মেডেলও অর্জন করেছি। জীবনে একবার শুধু পরাজিত হয়েছি। আগেই বলেছি শৈশবকালে আমি অত্যন্ত রোগাগ্রস্ত ছিলাম। জ্বর ও টনসিলের প্রদাহে প্রায়ই কষ্ট পেতাম।

এই বলিখেলার ব্যায়ামের মাধ্যমে আমার অসুখ আস্তে আস্তে ছেড়ে যেতে লাগল। যতদুর মনে পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠার পর আমার পরবর্তী স্কুল জীবনে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম।

আমার মনে হয় শৈশবে ঘন ঘন অসুস্থ হওয়ার কারণে আমার শারীরিক বৃদ্ধি কম হওয়া আমার খর্বকৃতির মূল কারণ ছিল। তবে আমার মোটেও দুঃখ নেই। আমি জানি গ্রীক সম্রাট দিগ্বিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের উচ্চতা নাকি পাঁচ ফুটের নিচে ছিল।

অতএব এ পৃথিবীতে ভালো কিছু অর্জন করতে চাইলে উচ্চতার পরিমাপ দরকার হয়না। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টও খর্বাকৃতির ছিলেন। বিশ্বখ্যাত কমেডিয়ান চার্লি চ্যাপলিনের কথা নাইবা বললাম।

আলেকজান্ডার এত খাটো ছিলেন যে,পারস্য সম্রাটকে পরাজিত করার পর পারস্য সিংহাসনে বসার পর পা রাখার জন্য একটি টেবিল ব্যাবহার করতে হয়েছিল, যেহেতু পা দানিতে তার পা দুটি ঠেকছিলনা।

তালুকদার বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হল দীপিকা। ডাক নাম কল্যাণী। তাঁর মা অর্থাৎ তরঙ্গিনী পিসিমা প্রায়ই ইয়ার্কি করে বলতেন- কল্যাণীকে আমার সাথে বিয়ে দেবেন। কেন জানিনা তিনি এ কথা বলতেন।

হয়তো আমার পরিবারকে পছন্দ করতেন বলেই তিনি এই কথা বলতেন। আমার বাবা ও মায়ের সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল আমার দাদীমার সাথে। দাদীমাতো কল্যাণীকে নাতবো জুড়েই বসলেন।

এসব চলছিল আমি যখন ষষ্ট শ্রেণীতে পড়তাম। তখন কল্যাণীর বয়স ৭/৮ বছর। এসব তামাশা বোঝার বয়স আমার হয়নি, কল্যাণীরতো কথাই আসেনা। তবে পাড়া পড়শি ও বন্ধু বান্ধবদের ঠাট্টা তামাশায় আমরা লজ্জা ও বিব্রতবোধ করতাম।

বিশেষ করে কল্যাণীকে আমার সম্বন্ধে কিছু বললে সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। সে আমাকে মোটেও পছন্দ করত না বলে মনে হয়। কদাচিৎ আমরা পরস্পর কথা বলতাম। একদিন তাঁর এক আত্মীয় ভাই দুটুম করে আমার নাম করে কল্যাণীকে একটি চিঠি লিখে।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কল্যাণী তখন কিশোরী, বয়স ১০ কি ১১ হবে। আমি যখনই তার সামনে এসে পড়লাম সে বাজপাখীর মত আমাকে আক্রমন করে চিঠি লিখার কৈফিয়ত চাইল। আমি যখন অস্বীকার করলাম তখন সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

অদূরে তার চক্রান্তকারী তথা ও অন্যরা মুচকি মুচকি হাসছিল এবং তামাশা উপভোগ করছিল। পরে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে কল্যাণী আক্রমণ করার জন্যে তাদের দিকে ছুটে গেল।

যাহোক, কল্যাণী ও আমি পছন্দ করি বা না করি তার মায়ের ইচ্ছানুযায়ী আমরা যে ভবিষ্যতে এই অপরের হব অর্থাৎ কল্যাণী আমার বাগদত্তা- এ বিষয়টি আমাদের দু’পরিবারে এ সমাজে বিশ্বাস হিসাবে হয়তো প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু উভয় পক্ষের নির্দিষ্ট কোন ওয়াদা ছিলনা।

দশম শ্রেণীতে উঠার পর আমার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন করলাম। উচ্চাশার সাথে যৌবনের আলোড়ন ও বিকিরণ আমাকে দোলা দিতে তালুকদার বাড়ি থেকে আমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম।

পিসিমা তরঙ্গীনি পরীক্ষার সময় আমার জন্য বিশেষ খাওয়া দাওয়া করেছিলেন। দৈনিক স্কুলে ফ্লাক্স ভর্তি দুধ পাঠাতেন। তার মাতৃস্নেহ ভোলার নয়।

১৯৫২ সালের বোধহয় জানুয়ারী মাসে আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি বাড়িতে চলে গেলাম। জুন মাসে খবর পেলাম তরঙ্গীনি পিসি নাকি অসুস্থ। এসে দেখলাম তিনি কঠিন ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যায় শায়িত।

আমাকে চিনতে পেরেছেন কিনা জানিনা। তার মুখ ‘তালাবদ্ধ”। খুলতে পারেন না। স্বনামধন্য হিমাংশু ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নিশিবাবুর বড় ছেলে প্রভাসদা আমাকে চট্টগ্রাম শহরে ঔষধ কেনার জন্য পাঠালেন।

তখন চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি রাস্তা কাঁচা ও বেহাল। তবে “মুড়ির টিনের” মত বাস চলাচল করত। ভ্রমণ অত্যন্ত বিপদজনক ছিল। যাওয়ার সময় রাউজানে একটি ব্রীজ পার হতে গিয়ে বাসটির একটি চাকা ব্রীজের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে সকলের মরার অবস্থা হয়েছিল।

ভাগ্যক্রমে তিন চাকায় ভর করে বাসটি রাস্তায় উঠে পড়াতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাই । চট্টগ্রামে পৌছেই মিনতিদির স্বামী বঙ্কিম বাবুর সহায়তায় চট্টগ্রামে ঔষধ ক্রয় করে লঞ্চে যাত্রা করার জন্য সদর ঘাটে আসলাম।

কিছুক্ষণ বাদে বঙ্কিম বাবু এসে বললেন যে রোগী মারা গেছেন। আমি ঔষধগুলি তার হাতে দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে লঞ্চে উঠলাম। সারা পথ পিসিমার জন্য বুক ফেটে কান্না আসছিল। মনে হল পেীছাতে অনেক সময় লাগবে।

হয়তো তার মরদেহ দেখতে পাবো না। চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে রাঙ্গামাটি পৌছাতে প্রায় ১০/১২ ঘন্টা সময় লাগে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে সারেংকে অনুনয় বিনয় করাতে আমাকে তবলছড়ি মুখে নামিয়ে দেয়া হল তবলছড়ি মুখ শ্বশানের জায়গায়।

আমি একাকী শ্বশানের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় এসে গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য পিসিমার মৃতদেহের সৎকার (দহ কাজ) এরই মাঝে সমাধা হয়ে গেছে।

চিরদিনের জন্য তার সাথে আমার আর দেখা হলনা। আমি অনেক্ষণ গুমরে গুমরে অশ্রুপাত করলাম। তালুকদার বাড়িতে এক অসহনীয় নিস্তব্দতা বিরাজ করছিল।

উল্লেখ্য যে, তরঙ্গিনী পিসিমার মৃত্যুর দু’এক মাস আগে তার বড় ছেলে প্রভাসদার বিয়ে তার মামাতো বোন সান্তিয়া দেবীর সাথে ১৯৫২ সালে চৈত্র মাসে সম্পন্ন হয়। বিয়ের সময় বরের সাথে আমিও কণের বাড়ি মাইনীর কৰাখালীর গ্রামে যাই।

প্রভাসদ ও আমি দুটি সাইকেলে চড়ে রওনা হই। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি বোয়ালখালী রাস্তা ছিল খুবই সংকীর্ণ ও কাঁচা, পায়ে হাঁটার রাস্তা। তবে সাবধানে হলে সাইকেল চালানো যেত। তখন পাকিস্তান আমল আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভালই ছিল।

খাগড়াছড়ি থেকে বোয়ালখালী রাস্তাটি আরও সংকীর্ণ ও বিপদ সংকুল ছিল। রাস্তার দু’পাশে গহীন অরণ্য। রাস্তায় লোক চলাচল খুবই কম ছিল বিশেষ করে খাগড়াছড়ি-বোয়ালখালী রাস্তায় দু’একজন ত্রিপুরা উপজাতীয় লোক ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি।

রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব আনুমানিক ৩০ মাইল আর খাগড়াছড়ি থেকে বোয়ালখালীর দূরত্ব ১৫ মাইল। এই পথ পাড়ি দিতে আমাদের লেগেছিল প্রায় ১২ ঘন্টা। বর্তমানে পাকা সড়ক হয়েছে, মোটর গাড়িতে এ পথ অতিক্রম করতে লাগে মাত্র ৩ ঘন্টা।

নববধুকে রাঙ্গামাটিতে আনার জন্য একটি মাঝারী সাইজের ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে মাইনী নদীর ভাটার স্রোতে ভাসানো হল। বধুর বড় ভাই সমর দা আমাদের সঙ্গী হলেন। আমাদের সাইকেল দু’টিও নৌকায় তোলা হল।

স্রোতের টানে নৌকা চলতে লাগল। মাইনী নদীর দু’কুলে অনেক চাকমা গ্রাম চোখে পড়ল। তবে নদীর বাম তীরে তারাবন্যা নামক গ্রামটির সৌন্দর্য্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।

এক বিশাল সমতল এলাকায় গ্রামটি অবস্থিত ছিল। তারাবন্যা মৌজার তখন হেডম্যান ছিলেন বাবু রাঙ্গাচাঁন চাকমা তিনি প্রভাবশালী ও অবস্থাপন্ন হেডম্যান ছিলেন। আমরা কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করে তার মাটির তৈরী সুন্দর দোতলা বাড়িটি দেখে এসেছিলাম।

পরবর্তীতে তার বড় ছেলে পরবর্তী মৌজার হেডম্যান নিহারবিন্দুর কাছ থেকে জানতে পারি যে, বাংলাদেশ হওয়ার পর পাহাড়ী-বাঙ্গালী সংঘর্ষে এই সুন্দর বাড়িটি পুড়ে যায়। বর্তমানে তারাবন্যা মৌজা নাকি প্রায় সম্পূর্ণ বাঙ্গালী শরণার্থীদের দখলে চলে গেছে।

তারাবন্যার নীচে মাইনী নদীর দু’কুল গহীন অরণ্যে ঢাকা ছিল। কোন কোন জায়গায় নদীর দু’তীরের গাছ বাঁশ পরস্পরকে স্পর্শ করে যেন আলিঙ্গন করছিল। নদীর ধারে অনেক বন্য মোরগ ও একটি কালো বাঘ চোখে পড়ল। কালো বাঘটি (ব্ল্যাক প্যানথার) আমাদের দেখে গহীন জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঝাঁকে ঝাঁকে কালচে ধরণের ঘুঘু পাখি উড়তে দেখা গেল। চাকমারা তাদেরকে ধুনকল বলে। সমর দা বলল সেগুলি নাকি শিকার যোগ্য পাখি। সে তার বন্দুক দিয়ে দুটি পাখি মারল।

মনে আছে মাইনি বাজার চেকপোষ্ট অতিক্রম করার সময় আমরা সে পাখি গুলিকে নৌকায় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলাম, কারণ সংরক্ষিত বনে কোন রকম শিকার করা নিষিদ্ধ।

ব্রিটিশ আমল থেকেই মাইনিমুখ বাজার প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। বর্তমানে মাইনিমুখে একটি বিশাল বাজার। বাজারের দোকানদার শতভাগই বাঙ্গালি। তবে হাটবারে পাহাড়ীদের কাঁচামালে বিশেষত আদা, হলুদ ও কলায় বাজার উপচে পড়ে। বাজার চৌধুরী একজন চাকমা।

মাইনি নদী কাচালং নদীতে পতিত হয়েছে। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলকে মাইনিমুখ বলে। বর্তমানে কর্ণফুলী হ্রদে নিমজ্জিত এ দু’নদীর সঙ্গমস্থলকে চেনার উপায় নেই। মাইনি নদী পেরিয়ে আমরা কাচালং নদীতে এসে পড়লাম।

মাইনির তুলনায় কাচালং কিছুটা গভীর ও খরস্রোতা। কাচালং এর দু’কুলও গহীন বনে ঢাকা। উভয়কূলে অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে আমরা নদীর ভাটায় নৌকা ভাসিয়ে অরণ্যের গভীর নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে মাঝে মাঝে বন্য হাতির পালের কিরিং বিরিং ডাক শোনা গেল।

দু’পাশে সদ্য হাটা হাতির পায়ের ছাপ দেখা গেল। নাদীর উৎপত্তি চেঙ্গীর মত ত্রিপুরা পর্বতমালা আর কাচালং জন্ম নিয়েছে রাঙ্গামাটি জেলা উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের পর্বতমালা থেকে।

কাচালং, মাইনি, চেঙ্গী উপত্যকা পার্বত্য চট্টগ্রামের শস্য ভান্ডার বলে পরিচিত ছিল। কাপ্তাই বা৭ধ হওয়ার পরে ৫৪ হাজার একর ধন্য জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে খাদ্য-উদ্বৃত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল পার হয়ে আমরা এক চাকমা গ্রামে রাত্রি যাপনের জন্য নোঙ্গর ভিড়ালাম। বাড়ীর মালিক আমাদের নৌকার মাঝির পরিচিত। তিনি আমাদের খুবই আদর যত্ন করলেন।

গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম এবং জানতে পারলাম যে, একদল বন্য হাতি কৃষকের ক্ষেতে নেমেছে এবং তাদের তাড়াবার জন্য মশাল জ্বালিয়ে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানো হচ্ছিল।

পরের দিন ভোরে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মাঝে আমরা কাচালং মুখে বা দুয়ারে পৌছে গেলাম। এখানেই কাচালং নদী কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে।

কাচালং মুখের বিপরীতে অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে কিছু ইটের বাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখা গেল। এখানে চাকমা জাতির কিংবদন্তী সংগ্রামী পুরুষ সেনাপতি রনু খাঁ দেওয়ানের বাড়ি ছিল।

উল্লেখ্য সতের শতাব্দীর শেষের দিকে তিনি চাকমা রাজা টব্বর খাঁর সেনাপতি ছিলেন এবং চাকমা রাজ্যে ব্রিটিশ অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সম্ভবত ১৭৯৬ সালে তিনি পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন বলে প্রকাশ।

দেশপ্রেমিক এই চাকমা বীর নাকি বিশাল দেহের অধিকারী ছিলেন। চাকমা জাতির এই মহান নেতার বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখে মন শোকে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।

কাচালং এর মুখ থেকে কর্ণফুলীর ভাটায় নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। নদীর দু’কুলে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সন্ধ্যায় রাঙ্গামটিতে এসে পৌছলাম ।

উল্লেখ্য, আমাদের অনুপস্থিতিতে নিশিকান্ত তালুকদার বাবুর ভাতিজা দেবেনদার জন্য তড়িঘড়ি করে পাত্রী ঠিক করা হয়েছিল। অতএব দুই নববধুকে এখই দিনে গৃহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।

বিয়ের পরে পরেই আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। নববধুর গৃহে প্রবেশের এক মাস পরে তরঙ্গিনী পিসিমা মারা গেলেন। তা আগেই বলা হয়েছিল।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা