icon

চাকমা লোককথাঃ বাঘ ও শামুকের দৌড় প্রতিযোগিতা

Jumjournal

Last updated Jun 1st, 2021 icon 1173

শুরুতেই লোককথার নামটি পড়ে এই প্রতিযোগিতার বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

কারণ, প্রতিযোগিতা সাধারণত হয়ে থাকে প্রায় সমান সমান দুই শক্তিধরের মধ্যে। অর্থাৎ কি না সেয়ানে সেয়ানে।

কিন্তু এখানে বলা হয়েছে এক অমিত শক্তির অধিকারী বাঘের সঙ্গে একরত্তি শামুকের প্রতিযোগিতার কথা। তা-ও যে-সে প্রতিযোগিতা নয়— দৌড়ের প্রতিযোগিতা।

বিষয়টি নিয়ে ভাবলে অবিশ্বাস্যই মনে হয়। কিন্তু চাকমা আদিবাসীদের মধ্যে এরকম অবিশ্বাস্য এক অসম প্রতিযোগিতা নিয়ে একটি লোককথা প্রচলিত আছে।

এবং তাতে নাকি সত্যি সত্যি বাঘটির চরম পরাজয় হয়েছিল। কীভাবে বাঘের এই পরাজয় ঘটেছিল, তাহলে সে-কথা বলছি, শুনুন।

 মোটাসোটা একটি বাঘ শিকারের সন্ধানে হন্যে হয়ে বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় জলতেষ্টায় বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

সে জলের সন্ধানে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নীচে নেমে যায়। নীচু জায়গায় গিয়ে সে একটি ছোট্ট পাহাড়ী ঝরনা খুঁজে পায়।

তখন সে আরাম করে হাঁটু গেড়ে বসে মুখ বাড়িয়ে ঝরনা থেকে জল পান আরম্ভ করে। জলপানের সময় সেঝরনার পরিষ্কার জলের নীচে পাথরের খাঁজে একটি ছোট্ট শামুককে দেখতে পায়।

অতি মন্থরগতির এই শামুকটির চলাফেরা দেখে বাঘ তাচ্ছিল্যসূচক একটুখানি মুচকি হাসি দেয়। শামুকটি বাঘের এই মুচকি হাসি দেখে বুঝতে পারে তার এই মন্থর গতির জন্য বাঘ তাকে ঠাট্টা করছে।

তখন শামুকটি রেগেমেগে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠে এবং বলে –“ তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছো কেন? আমার এই মন্থরগতি দেখে তুমি আমাকে ঠাট্টা করছো?”

বাঘ হেসে হেসেই বললো—“ঠিকই বলছে। আসলে তোমার এই মন্থরগতি দেখে তোমার প্রতি আমার করুণা হয়। কারণ, আমি এতো দ্রুতগামী জীব হওয়া সত্বেও দৌড়ে শিকার ধরার সময় কখনো কখনো তা হাত থেকে ফসকে যায়।

আর তুমি কি না অতি মন্থরগামী জীব। তুমি শিকার আহরণ করবে কীভাবে?” বাঘের কথা শুনে শামুকটি দ্বিগুণ রেগে গিয়ে বললো –“আমাকে অতি মন্থরগামী জীব ভেবে তুমি আমার প্রতি করুণা দেখাচ্ছো?

আসলে তুমি জানো না, আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগামী।

তোমার এই অহেতুক অহঙ্কারের জন্যে বরং তোমার প্রতি আমার করুণা হয়। বাঘ বললো – “তাই নাকি! তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগামী ?” এই কথাটি বলেই বাঘ অট্টহাস্যে গোটা বনবাদাড় কাঁপিয়ে দিল।

শামুকটি বললো – “সত্যিই তো, আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগামী। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? হো না তবে একবার দু’জনের মধ্যে দৌড়ের প্রতিযোগিতা?” বাঘ হেসে হেসেই বললাে – “তুমি কি ইয়ার্কি করছে, না সত্যি সত্যি বলছো?” শামুক তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে বললো – “সত্যি সত্যি বলছি।

হোক একবার দৌড়ের প্রতিযোগিতা।” বাঘ তখন বললো –“ প্রতিযোগিতা হবে কীভাবে? তুমি থাকো জলে আর আমি থাকি ডাঙায়।

প্রতিযোগিতা ক্ষেত্র কী হবে?” শামুক বললো -“তাতে চিন্তার কিছু নেই। তুমি ডাঙায় ঝরনার তীর বরাবর দৌড়াবে আর আমি দৌড়াব ঝরনার জলে। তুমি যথাসাধ্য দৌড়ে গিয়ে যেখানে থামবে সেখানে থেকে আমাকে ডাকবে।

আর আমিও দৌড়ে গিয়ে জল থেকে তোমার ডাকে হৈ’ শব্দে সাড়া দেবো। তখন কে এগিয়ে রয়েছে তা বোঝা যাবে।

এভাবে তিন বার প্রতিযোগিতা হবে। যে জিতবে সে বিজিতের কান মলে দেবে। কেমন হবে তো?” কথাটি শুনে বাঘ তখন রাজী হলো।

এখন প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতির পালা।

শামুকটি তখন নাবালাং(দাড়কিনা) মাছটিকে ডেকে চুপি চুপি বললো—“ তুমি এক্ষুনি ঝরনার ভাটি বরাবর দৌড়ে গিয়ে সব শামুকদের বলে এসো যে, বাঘ ঝরনার পাড়ে যেখানে গিয়ে হাঁক দেবে, তা থেকে ভাটির দিকে দশ বারো হাত দূরের কোন একটি শামুক যেন ‘হৈ’ শব্দে সাড়া দেয়।

যাও, এক্ষুনি কথাটি সবাইকে বলে এসো।” আদেশ পাওয়া মাত্রই নাবালাং মাছটি ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঝরনার ভাটির দিকের সব শামুকদের কথাটি জানিয়ে দিয়ে ফিরে এলো।

এবার প্রতিযোগিতার পালা। আসলে বাঘ এই প্রতিযোগিতার ব্যাপারটি তেমন গুরুত্বই দেয়নি। সে শামুকের সঙ্গে একটু মজা করার জন্য শর্তে রাজী হয়েছিলো।

ফলে যথাসময়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলে বাঘ দৌড় না দিয়ে একটু জোরে জোরে পা ফেলে বিশ-ত্রিশ হাত এগিয়ে গেল এবং কথামতো থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে হাঁক দিল শামুককে।

তৎক্ষণাৎ ভাটির দিকের দশ-বারো হাত দূর থেকে একটি শামুক হৈ’ শব্দে বাঘের ডাকের প্রত্যুত্তর দিল। বাঘটি রীতিমতো অবাক!

সত্যিই কি শামুকটি এতো দৌড়তে পারে! তার চলাফেরা দেখে তো বিশ্বাস হয় না! অথচ শামুকটি সত্যি সত্যি তার তুলনায় দশ-বারো হাত এগিয়ে রয়েছে।

এবার বাঘটি ভাবলো— শামুকটিকে হারিয়ে দিতে আমাকে রীতিমতো দৌড়তে হবে দেখছি।

তখন লেজ তুলে বেশ জোরে দিল সে এক ছুট। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাত দূরে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ালো। আর আগের মতোই পেছন ফিরে হাঁক দিল।

এবারও সামনের দশবারো হাত দূর থেকে অন্য একটি শামুক হৈ’ শব্দে সাড়া দিল। সামনের দিক থেকে শামুকের সাড়া পেয়ে বাঘ দারুণভাবে হতভম্ব হলো। সে ভাবলো – তা কী করে সম্ভব?

শামুকটি কি সত্যি এতো দ্রুত দৌড়তে পারে! আজ তো দেখছি শেষমেষ শামুকের হাতে কানমলা যেতেই হবে। কানমলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে দৌড় দিয়ে সে শামুকটিকে হারিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে।

সে একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করলো, এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লেখানি উঁচু করে দিল তার শেষ দৌড়টি।

এবার প্রায় একশো হাত দূরে দৌড়ে গিয়ে সে থামলো এবং শামুকটি এবার অবশ্যই পেছনে পড়ে রয়েছে ভেবে সে হাঁক দিল।

আগের মতোই প্রায় দশ-বারো হাত দূর থেকে অপর একটি শামুক হৈ’ শব্দে সাড়া দিল।

সাড়া পেয়ে বাঘটি এবার সত্যিই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। তখন সে আর কী করতে পারে। কোন উপায় না দেখে লেজ বাঁকিয়ে সোজা পালিয়ে গেল দূর বনের গভীরে।

পরে সে আর কোনদিন ভুলেও পা বাড়াল সেই ঝরনার দিকে।

তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply