থিঙ্কারস লাইব্রেরী – মনের এক ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র

Jumjournal
Last updated May 12th, 2021

1320

featured image

খাগড়াছড়ি জেলা থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা উপজেলার বড়াদাম (বড়াদম) গ্রামে বেড়ে উঠা এডিসন চাকমার বই পড়ার শখ ছোট বেলা থেকেই। বয়সের সাথে সাথে সেই শখ বড় হতে হতে একটা নিজস্ব লাইব্রেরী করার স্বপ্নে রূপ নেয়। সেই স্বপ্ন বয়সের সাথে আরও বড় হতে হতে সমাজের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে তাঁরই উদ্যোগে একদিন গড়ে উঠে আজকের ভ্রাম্যমাণ “থিঙ্কারস লাইব্রেরী”। থিঙ্কারস লাইব্রেরীর প্রধান উদ্যোক্তা এডিসন চাকমার সাথে জুমজার্নাল টিমের একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসলো “থিঙ্কারস লাইব্রেরী”-র অদম্য পথ চলার গল্প।

Thinker's Library logo
থিঙ্কারস লাইব্রেরীর লোগো

থিঙ্কারস লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা এডিসন চাকমার কাছে স্বপ্ন বাস্তব হওয়ার মত মনে হলেও শুরুটা এতটা সহজ ছিল না। পিছিয়ে পরা সমাজের তরুণদের বই পড়ার প্রতি অনীহা আর কুসংস্কারাছন্ন সমাজের জীর্ণতা তাঁকে প্রতিনিয়ত ভাবায়। তাই সমাজের ভ্রান্ত ধ্যান ধারণার পরিবর্তন আর তরুণদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির স্বদিচ্ছার সাথে নিজের স্বপ্নের মিল ঘটিয়ে ২০১৩ সালে শেষের দিকে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রাম বড়াদামে (বড়াদমে)। এরপর শুরু হয় আরেক সংগ্রাম। মধ্যবিত্ত পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদে গ্রামে এসেই জীবিকার খোঁজ শুরু করেন। ওদিকে চাকরি থেকে জমানো কিছু টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকায় বেশ কিছু বই নিজের সংগ্রহশালায় যুক্ত করান। বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে নিজের ইচ্ছা এবং স্বপ্নের আলাপচারিতায় একদিন জীবিকার জন্য হঠাৎ ছাগলের ফার্ম করার চিন্তা মাথায় আসে। যেই ভাবা সেই কাজ, জমানো টাকার অবশিষ্টাংশ দিয়ে ছাগলসহ ফার্মের অন্যান্য উপকরণ ক্রয় করেন। উলেখ্য ‘হিল ব্লগারস অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম’-এর সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে সমমনা কিছু মানুষের পরামর্শে ফার্মের নাম রাখেন ‘ব্লগারস ফার্ম’। বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফার্মের দেখাশুনার পাশাপাশি যুগপৎ চলতে থাকে বই পড়া আর লাইব্রেরী গড়ার চিন্তা। নানা রকম সীমাবদ্ধতায় একসময় ফার্মটি চালানো কঠিন হয়ে উঠলে এবার বাড়ির পাশেই নিজের দাদুর দোকানে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিবার থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে দোকান মেরামত এবং যাবতীয় মালামাল নিয়ে চায়ের দোকান চালু করে দেন। নিজ হাতে বানাতে থাকেন সিঙ্গারা, সমুচা, চা, পরটা। ধীরে ধীরে ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি হলে লোনের টাকায় দোকান সংস্কার করে একটি ফ্রিজও ক্রয় করেন। যেহেতু দোকানেই বেশিরভাগ সময় কেটে যেতো সেজন্যে তিনি তাঁর সংগ্রহে থাকা বইগুলি পড়ার জন্যে তাঁর দোকানে নিয়ে আসেন। দোকানে আসা অনেকের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ দেখে তাঁর লালিত স্বপ্নটাকে আরেকটু বড় করে ভাবতে শুরু করেন। তারপরেই ২০১৫ সালের দিকে একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী করার জন্য সমমনা বন্ধুদের প্রস্তাব করেন। বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের আশ্বস্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লাইব্রেরী করার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেন। বিক্রি করে দেন ফার্মে থাকা অবশিষ্ট ছাগলগুলিকে আর সে টাকায় লাইব্রেরী করার চিন্তা থেকে আবারও দোকান সংস্কারের কাজ শুরু করেন। এভাবে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে লাইব্রেরী করার স্বপ্ন। লাইব্রেরী করার জন্য সমাজের সমমনা, আগ্রহী ও সচেতন কিছু মানুষের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। আগ্রহী এসব মানুষদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গঠিত একটি কমিটির হাত ধরে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় ভ্রাম্যমাণ থিঙ্কারস লাইব্রেরীর আলোকিত পথ চলা।

থিঙ্কারস লাইব্রেরী
থিঙ্কারস লাইব্রেরীর ভ্যানে এসে স্কুলের আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীদের বই সংগ্রহের হিড়িক, ছবিঃ থিঙ্কারস লাইব্রেরী

শুরুতেই সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এডিসন চাকমা ব্যক্তিগতভাবে থিঙ্কারস লাইব্রেরীর উপর একটি পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করলে বিভিন্ন মহল থেকে আশাতীত সাড়া আসতে থাকে। অনেকেই বই দিয়ে কেউবা আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থিঙ্কারস লাইব্রেরীর পথ চলায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি শুরুর দিকে তিনিও তাঁর ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত সকল বই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের সংগ্রহশালায় দিয়ে দেন। ভাঁড়া করা একটি নড়েবড়ে ভ্যানে চড়ে ভ্রাম্যমাণ থিঙ্কারস লাইব্রেরীর যাত্রা শুরু হয়, যদিও পরবর্তীতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রেরিত অর্থের কিছু অংশ দিয়ে একটি পুরোনো ভ্যান ক্রয় করা হয়। সেই ভ্যানেই চলছে দীঘিনালার মোড়ে মোড়ে জ্ঞান বিতরণের এই মহৎ স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম।

প্রতি শনিবার বড়াদাম (বড়াদম) থেকে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার যাত্রা শুরু করে যায় বাবুছড়ামুখ উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত। ওই পথে কান্দরপা দোকান, পুকুরঘাট, কার্বারী টিলা, উদালবাগান উচ্চ বিদ্যালয়, বাঘাইছড়ি আনন্দ বাজার, নোয়াপাড়া, বাবুছড়া পুরাতন বাজার, আদর্শ স্কুল, বাবুছড়া নতুন বাজার, বাবুছড়ামুখ উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় থেমে থেমে চলে লাইব্রেরীর সদস্য সংগ্রহ এবং বই বিতরণ কার্যক্রম। আর প্রতি রবিবার বড়াদাম (বড়াদম) থেকে যায় দীঘিনালা উপজেলা সদর পর্যন্ত। ওই পথে আমতলী দোকান, বানছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, হেডম্যানপাড়া দোকান, নারিকেল বাগান দোকান, শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, দীঘিনালা কলেজ, লারমা স্কোয়ার, দীঘিনালা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দীঘিনালা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ দীঘিনালা উপজেলার সদর থেকে বাবুছড়ামুখ বিভিন্ন জায়গায় মোট ১৬টি স্কুলে পয়েন্টে পয়েন্টে সপ্তাহে দুই দিন চলে থিঙ্কারস লাইব্রেরীর ভ্রাম্যমাণ কার্যক্রম।

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর এই স্বেচ্ছাসেবী কাজে লোকবলের অভাব, যথাযথ উপকরণের অভাব, ভ্যান চালকের অভাবসহ আরও অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে অনেক সময় কমিটির সদস্যদেরই নিতে হয় একই সাথে ভ্যান চালক আর বইওয়ালার ভূমিকা। তবুও এতটুকু আপত্তি ছাড়াই এডিসন, জুয়েল, তারেক, এমির মত স্বেচ্ছাসেবীরা সমাজ পরিবর্তনে স্বেচ্ছায় দিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত শ্রম। শুরুর দিকে সপ্তাহের দুই দিন লাইব্রেরীর সকল বই এডিসন চাকমার নিজ বাসা থেকে ভ্যানে তুলে পাঠকদের জন্যে নেওয়া হলেও পরবর্তীতে লাইব্রেরীর স্থায়ী কার্যক্রমের জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একটি লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা যেটি সপ্তাহের ৬ দিন পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তাই সকলের সম্মতিক্রমে প্রথমে এডিসন চাকমার নিজস্ব দোকানের অর্ধেক জায়গায়তেই স্থায়ী পাঠাগারটির ঠিকানা নির্ধারণ করা হয়। এদিকে লাইব্রেরীর সামগ্রিক কার্যক্রম, সদস্য সংগ্রহ, শুভাকাঙ্ক্ষীদের আর্থিক সহযোগিতার কৃতজ্ঞতা, প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, সবকিছুই নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় থিঙ্কারস লাইব্রেরীর ফেসবুক পেজে। আর এভাবে সকলের আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা এবং উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবীদের নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে এগিয়ে চলছে থিঙ্কারস লাইব্রেরীর এই সম্ভাবনাময়ী পথ চলা।

থিঙ্কারস লাইব্রেরী
বড়াদামে (বড়াদমে) থিঙ্কারস লাইব্রেরীর বর্তমান কার্যালয়, ছবিঃ থিঙ্কারস লাইব্রেরী

এডিসন চাকমার লাইব্রেরী গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাত মাস হয়ে গেলেও জীবিকার তাগিদে জীবনের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। তাঁর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি না থাকলেও ঢাকায় বসেই স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে যাচ্ছেন থিঙ্কারস লাইব্রেরীর পরিচালনার যাবতীয় দিক নির্দেশনা। স্বেচ্ছাসেবীরাও নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন থিঙ্কারস লাইব্রেরীর সকল কার্যক্রম। আর সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যাচ্ছেন প্রিয় থিঙ্কারস লাইব্রেরীর টানে, যেখানে প্রতিনিয়তই প্রস্ফুটিত হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের দুরন্ত সম্ভাবনা।

থিঙ্কারস লাইব্রেরী
থিঙ্কারস লাইব্রেরীর স্থায়ী পাঠকক্ষ, ছবিঃ থিঙ্কারস লাইব্রেরী

থিংকারস লাইব্রেরী’র মত এমন স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক জুম্ম তরুণ প্রজন্মের মনে বুনুক প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের উৎকৃষ্ট উর্বর বীজ, যে বীজ প্রস্ফুটিত হয়ে একদিন জ্ঞানের সুভাস ছড়াবে জুম পাহাড়ের কোণায় কোণায়, ছড়ায় ছড়ায়, কেওক্রাডং আর বসন্তমোন হয়ে এদোসিরে মোন পেরিয়ে পৃথিবীর সবখানে, সর্বত্র বয়ে যাক এই পরিবর্তনের সুবাতাস, যে সুবাতাস প্রতিটি জুম পাহাড়ের ঘরে ঘরে জাগিয়ে তুলবে অধিকার সচেতন, মেধাবী, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল এক জুম্ম তরুণ প্রজন্ম, যারাই ধরবে নতুন নেতৃত্বের বৈঠা, আনবে পরিবর্তনের নতুন নতুন সম্ভাবনা আর ‘থিংকারস লাইব্রেরী’ হোক তেমনি এক নতুন দিনের সূচনায় বলিষ্ঠ এক অনুপ্রেরণা।


জুমজার্নাল প্রতিবেদন 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা