বিশ্বের সেরা ১০টি বইয়ের শহর

Jumjournal
Last updated Mar 4th, 2020

1528

featured image

আমাদের এই প্রিয় শহরে অগুণতি বইয়ের দোকান। কয়েকবছর আগেও বড়সড় বইয়ের বাজার বলতে নীলক্ষেত বা বাংলাবাজারের কথা মনে আসত সবার আগে। কিন্তু বিশাল বইয়ের দোকান যেখানে চাইলেই ইচ্ছামত বই খুঁজে পাওয়া যায়, পছন্দমতো জায়গা খুঁজে নিয়ে বই পড়তে পড়তে উপভোগ করা যায় গরম কফি, এরকম বইয়ের দোকানের অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া এই নগরকে বইয়ের নগর বলা যায় কী! আমাদের এই নগরকে বইয়ের নগরী বলা না গেলেও বিশ্বে এমন কতগুলো শহর আছে; যাদের অনায়াসে বইয়ের শহর বলা যায়।

১. বেলপ্রাট, কাতালনিয়া, স্পেন

স্পেনের কাতালনিয়ার ছোট্ট শহর বেলপ্রাটকে নানাভাবেই আদর্শ বইয়ের নগর বলা যায়। রাজধানী বার্সেলোনা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাতালনিয়ার অ্যানোইয়া অঞ্চলের ছোট্ট সুন্দর গ্রাম। চমৎকার মধ্যযুগীয় আবহে ঘেরা বেলপ্রাটের জনগণ বইপ্রেমী দর্শনার্থীদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে সদা প্রস্তুত। কাতালনিয়ার প্রথম বইয়েরও নগর এই বেলপ্রাট।

জুনের প্রথম সপ্তাহে শহরের প্রধান উৎসবজুড়ে সাজসাজ রব পড়ে যায়। উৎসব চলাকালীন শহরের অসংখ্য বাড়ি সাময়িক বইয়ের দোকানে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা-ঘেরা মার্কেটে স্থাপিত বইয়ের দোকান তো থাকেই। এখানে সেল বা ছাড়ও দেওয়া হয় অনেক বইয়ে—তবে তা শুধু কাতালনিয়ার বইগুলোতে।

বেলপ্রাট, কাতালনিয়া, স্পেন

বেলপ্রাটকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা ছাড়াও এই উৎসবে ফুড ব্যাংকে বইয়ের বিনিময়ে ডোনেশন দেওয়া যায়। এছাড়া বই ঘিরে আঞ্চলিক প্রকাশকদের আয়োজনে কনফারেন্স, গোলটেবিল আলোচনা আর বই পড়ার আয়োজন চলতে থাকে এই উৎসবজুড়ে।

এই শহরে আছে আজব ধরনের বুকশপ হোটেল। ক্যাল পিন্যোতা অন প্লাজা কাতালনিয়া নামক এই হোটেলের ঘরগুলো আলাদা আলাদা বইয়ের থিমে সাজানো। যেমন কাতালনিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত গোয়েন্দা পেপ কারভালহো, ঐতিহাসিক ফিকশন ও ভ্রমণ ইত্যাদি নানা থিমে সাজানো ঘর পাওয়া যায় এই হোটেলে।

বিভিন্ন সংগঠন এখানে নানারকম সৃজনশীল লেখালেখির ওয়ার্কশপ ছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটির দিন এখানে পরিবারের সবার জন্য থিমভিত্তিক সাহিত্য উৎসব আয়োজিত হয়। যেখানে পড়ার জন্য থাকে বাছাই করা বই। থাকে গুপ্তধনের সন্ধান আর কারুশিল্প বানানোর কার্যক্রম।

২০০৮ সালে বেলপ্রাটের এক স্থানীয় বন্ধুদের সংগঠন সাদামাটাভাবে বই উৎসব উদযাপন শুরু করেছিল। একশরও কম বাসিন্দার ছোট্ট এই শহরে দর্শনার্থীদের জন্য ২০ হাজারেরও বেশি বই ছাড়ে বিক্রি হয়।

২০২০ সালের মাঝে বেলপ্রাটের আশপাশে আরও অন্তত চারটি বুকসিটি চালুর উদ্দেশে কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে।

২. ফন্তেনি-ওল্যা-জ্যুত, ফ্রান্স

স্ট্র্যাসবার্গ থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমের শহর ফন্তেনি-ওল্যা-জ্যুত শহরটির বুকসিটি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে সাহিত্য কিংবা প্রকাশনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।

১৯৯৪ সালে লেস অ্যামি দ্যু লিভা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই শহরে সৃজনশীল লেখালেখি আর পড়াশোনার সূচনা হয়। ঠিক দুই বছর পর বুক টাউনটির অফিসিয়াল উদ্বোধন করা হয়।

এ ব্যপারে ফ্রান্সের সাবেক কৃষিমন্ত্রী ফ্রান্সিস গিলাউম আর ফন্তেনি-ওল্যা-জ্যুতের মেয়র জিন-ম্যারি ভানোতের অবদান অনস্বীকার্য।

এখানে আছে ১০টি বইয়ের দোকান আর একটা ক্যালিগ্র্যাফি স্টুডিও। প্রায় দুই দশক ধরে আয়োজন করা হয় লেখালেখির প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি জয়ী লেখকদের লেখা নিয়ে একটা শর্ট বইও প্রকাশ করা হয়।

ফন্তেনি-ওল্যা-জ্যুত, ফ্রান্স

গ্রামটির ঠিক মাঝ বরাবর একটা সাইনপোস্ট আছে, যেটি দিকে নির্দেশ করছে বিশ্বজুড়ে ছড়ানো ছিটানো বুকসিটিগুলোর।

ফন্তেনির সবচাইতে পুরনো বইয়ের দোকান হল র‍্যু সেইন্ট-পিয়েরে অবস্থিত আ ওল্যা রিসের্সে দ্যো লিভা পেহদ্যু যার ইংরেজি ইন সার্চ অব লস্ট বুক বা হারানো বইয়ের সন্ধানে।

আরেকটা আছে র‍্যু ডিভিশন ল্যুকরেকে ১৯৯৬ সালে স্থাপিত ল্যু শ্যাট ব্যোট যেখানে আছে বিশাল একটা বাকানো দরজা আর পাথরের প্রাকৃতিক দেয়াল।

৩. গোল্ড সিটিজ, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনাইটেড স্টেটস

১৯৯৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গোল্ড সিটিজ বুক টাউন তৈরি হয়। স্থানীয় অধিবাসী গ্রে স্টলেরি এবং জন হার্ডি হে-অন-ওয়াই ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের শহরে বুকসিটি বা বইনগরি শুরু করে।

দুটো প্রধান এলাকা গ্রাস ভ্যালি আর নেভাদা সিটি ছাড়াও কাছাকাছি পেন ভ্যালির অস্থায়ী বইবিক্রেতারা, নর্থ স্যান জুয়ান, পাইন লেকের আশপাশে প্রায় ৩০টা বইয়ের দোকান অংশ নেয় এই উৎসবে।

গোল্ড সিটিজ, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনাইটেড স্টেটস

বাৎসরিক গোল্ড রাশ বুক ফেয়ার চালু করার পরেও এখানে বইয়ের দোকান লক্ষনীয় মাত্রায় কমে যাচ্ছে। নেভাদা নর্থ পাইন স্ট্রিটে স্টলেরি ও তার স্ত্রী ক্লারিন্ডা এখনো ‘টড হল বুকস’ নামে একটা বুকশপ চালান।

অন্যদিকে হার্ডি বুকস শুধু অ্যাপয়েন্টমেন্টভিত্তিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। পশ্চিম আমেরিকা ও ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় বই বেশি পাওয়া যায় হার্ডি বুকস-এ।

৪. লিলিপুটম্যের, নরওয়ে

ঠিক ধরেছেন, সেই বিখ্যাত গালিভার আর লিলিপুটের গল্পের বই থেকে যেন উঠে এসেছে লিলিপুটম্যের। নরওয়ের এই ছোট্ট গ্রামটা আসলে একটা মিনিয়েচার বা ছোট আকারের ফ্যামিলি অ্যাডভেঞ্চার পার্ক। এখানকার বইবিক্রেতারা শুধু বাচ্চাদের বই বিক্রি করে।

লিলিপুটম্যের, নরওয়ে

এই শহরের সবচাইতে প্রধান অংশ হলে স্টরগাটার লিলেহ্যামার শহরের অনুকরণে তৈরি মিনিয়েচার রাস্তা। রাস্তাটির দুধারের বাড়িগুলো সব ১৯৩০ সালের বাড়িগুলোর অনুকরণে কোয়ার্টার বা চারভাগের এক ভাগ আকারে বানানো।

এখানে দোকান, হোটেল, ক্যাফে, বেকারি আর পুলিশ স্টেশনের পাশাপাশি ছয়টি বাড়িকে সম্পূর্ণ বাচ্চাদের বইয়ের দোকানে রূপান্তর করা হয়েছে।

প্রায় সব ধরণের ১৫ হাজার বই আছে এই শহরে। শিশুদের বয়স, বইয়ের ধরণের ওপর ভিত্তিকরে এক একটা বাড়িতে আলাদা আলাদা ধরণের বই রাখা হয়েছে।

পশুপাখি, রূপকথা, পরিবেশ সংরক্ষণ, কাউবয়েজ, অপরাধ, প্রকৃতি আর আউটডোর লিভিংসহ বিভিন্ন ক্যাট্যাগরিতে ভাগ করা হয়েছে বইগুলো।

৫. বিবলো টোয়েন, অসলো

১০ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চাদের জন্য বানানো হয়েছে এই লাইব্রেরি। এখানে ঢুকতে হলে জুতা খুলে নির্দিষ্ট তাকে রাখতে হয়। বয়স্কদের প্রবেশ নিষিদ্ধ এই লাইব্রেরিতে বাবা-মা আর শিক্ষকদের জন্য রেখা টানা আছে, যেটা পার হয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নাই বয়স্কদের।

লাইব্রেরির উদ্যোক্তাদের মতে পাবলিক লাইব্রেরি, রেস্টুরেন্ট এরকম অনেক জায়গা বড়দের জন্য থাকলেও ছোটদের জন্য বিশেষায়িত জায়গা খুব একটা নেই।

তাই তারা শুধু বাচ্চাদের একটা বইয়ের দুনিয়া গড়েছেন, যেখানে তারা বই পড়ার পাশাপাশি নানারকম ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে। বাচ্চারা এখানে স্কুল থেকে সরাসরি চলে আসতে পারে। এসে হোম ওয়ার্ক করতে পারে, আছে খাবারের ব্যবস্থাও।

তবে এখানে স্কুলের কোনো বই পাওয়া যায় না। জায়গাটা শুধু শিশুদের যা ইচ্ছা তাই করার জন্য, যা ইচ্ছা তাই বই পড়ার জন্য। ক্যাটেগরি অনুযায়ী বই রাখা হয় এখানকার ঝুলন্ত বইয়ের তাকগুলোতে।

বিবলো টোয়েন, অসলো

বিবলো টোয়েনের অন্দরসজ্জাও বেশ বৈচিত্র্যময়। বিশ্বের নানা জায়গা থেকে আনা রি সাইকলড বা পুনঃউৎপাদিত নানা জিনিস দিয়ে সাজানো বাচ্চাদের এই বইয়ের স্বর্গ।

যেমন, ইতালি থেকে আনা পুরনো একটা পিয়াজ্জো কারকে ওয়ার্কশপ কারে রূপান্তর করা হয়েছে।

অস্ট্রিয়া থেকে আনা স্কি লিফট, পোল্যান্ড থেকে আনা কাঠের মেঝে, আয়ারল্যান্ড থেকে আনা জিমিন্যাস্টিকস ফ্লোর—এরকম নানা রকম বৈচিত্র্যময় জিনিস বাচ্চাদের কাছে একইসঙ্গে শিক্ষনীয় আবার আনন্দময়ও।

৬. মনতেরিজিও, ইতালি

ইতালির তাসকানির মনতেরিজিওর বই বিক্রির হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। জ্যাকোপো দ্য ফিভিজ্জ্যানো ১৪৭১ সালে প্রথম ছাপাখানা বানান এখানে।

আর ১৮৯০ সালে প্রথম বইয়ের দোকান চালু হয় মনতেরিজিওতে। এরপর পরবর্তী একশ বছরে স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই বই বিক্রি শুরু করেন।

মনতেরিজিও, ইতালি

ক্ষেত্রবিশেষে পরিবারের সবাই বড় বড় ঝুড়িতে করে মেলা ও বাজরাগুলোতে বই বিক্রি শুরু করে।

মাত্র পঞ্চাশজন বাসিন্দার এই শহরে প্রতিবছর আগস্টে একটি বইমেলা আয়োজন করা হয়। এই মেলায় একটা সম্মানিত বুক অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হয়।

৭. ওবিদস, পর্তুগাল

পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত দেয়ালঘেরা এই ঐতিহাসিক শহরটিতে এখনো মধ্যযুগীয় আবহ বিদ্যমান। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে সে যুগের খোয়ায় মোড়ানো রাস্তা আর ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি।

শহরটি পর্তগালের রাজধানী লিসবন থেকে এক ঘণ্টার পথ। শহরটি আগে বাৎসরিক চকলেট উৎসবের জন্য পরিচিত ছিল। এখানেই চেরি থেকে জিনজিনহা নামক এক ধরনের পানীয়ের জন্যও বিখ্যাত এই শহর।

হোসে পিনহো নামের এক বইয়ের দোকানের মালিক প্রথমবারের মতো এই শহরকে একটি বুকসিটি বা বইয়ের শহরে রূপান্তরর চিন্তা করেন।

ওবিদস, পর্তুগাল

ওবিদস বুক সিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখানে নতুন কোনো বইয়ের শহর গড়ে ওঠেনি। বরং অন্যান্য দোকানে বই বিক্রি শুরু করেছে।

যেমন স্থানীয় আর্ট গ্যালারিতে আর্টের বই, অর্গানিক মার্কেটে স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে তৈরি খাবারের রেসিপি, জাদুঘরে ইতিহাসের বই, ইন্টেরিয়র শপে ডিজাইন ও ঐতিহ্যবাহী টাইলসের ওপর বই ইত্যাদি পাওয়া যায়।

এখানে অবস্থিত লিটারেরি ম্যান হোটেলে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পর্তুগিজ ও ইংরেজি বই রয়েছে। ওবিদস প্রাসাদের পাশে অবস্থিত ১৩ শতাব্দীতে তৈরি চার্চেও চমৎকার কিছু বইয়ের দোকান রয়েছে।

এখানে ফোলিও নামের আন্তর্জাতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় যেখানে দেশ বিদেশ থেকে নামি-দামি লেখকরা অংশগ্রহণ করেন। উৎসব চলাকালীন খালি বাড়িগুলোতে লেখক, শিল্পি ও অন্যান্য সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য নিভৃতে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়।

৮. পাজু, দক্ষিণ কোরিয়া

উত্তর কোরিয়ার সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত এই শহরে অসংখ্য বইয়ের দোকান, বুক ক্যাফে ও প্রাকশনা সংস্থা রয়েছে।

এখানের প্রতিটি বাড়িতেই বই প্রকাশনা, বিক্রি ও কোরিয়ান বইয়ের প্রচারণার কিছু না কিছু কাজ চলে। আড়াইশরও বেশি প্রকাশক রয়েছে এখানে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করছে এই শহর।

১৯৮৯ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার নামকরা সব আর্কিটেক্ট এবং ডিজাইনাররা এই শহরকে ব্যতিক্রমীভাবে গড়ে তোলার কাজ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শহরের কেন্দ্রে কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী হ্যানক হাউজ গড়ে তোলা হয়েছে।

পথের দুপাশে গাছের সারি, গাড়ির ভিড়বিহীন রাস্তা, রাস্তার দুপাশে কাঠের বেঞ্চ, বাচ্চাদের বইয়ের দোকান অ্যালিস হাউজের চারপাশে ঘোরানো ছোট আকারের রেলপথ- সব মিলিয়ে পাজু নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

পাজু, দক্ষিণ কোরিয়া

তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত এই শহর- পাবলিশিং ডিস্ট্রিক্ট, প্রিন্টিং ডিস্ট্রিক্ট ও সাপোর্ট ডিস্ট্রিক্ট।

এখানে আয়োজিত দেড় সপ্তাহের বাৎসরিক উৎসব ‘বুকসরি বুক ফেস্টিভ্যাল’এ প্রায় ৫ লাখ মানুষ অংশ নেন।

আঞ্চলিক শিল্প ও সাহিত্যকে উৎসাহ দিতে এই উৎসব থেকেই প্রতিবছর এশিয়ান সাহিত্যিক, সম্পাদক ও ডিজাইনারদের পাজু বুক অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।

৯. টোরাপ, ডেনমার্ক

ঠিক তথাকথিত বইয়ের শহর নয় এটি। শহরের পুরনো অংশে তিনশ’র মত বাসিন্দা যারা খ্রিস্টপূর্ব এগার শতাব্দি থেকে এখানে পুরুষানুক্রমিকে বাস করছেন।

অন্যদিকে ১৯৯০ সালে শহরের অন্য অংশটিকে ইকো-ফ্রেন্ডলি বা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে যার নাম Økosamfundet Dyssekilde।

পরিবেশবান্ধব এই বুক টাউনকে ভেজিটারিয়ান, আধ্যাত্মিক ও মানবিক গ্রাম হিসেবে গড়া হয়েছে। আধা-স্বশাসিত ছয়টি গোষ্ঠি এই শহরের ছয়টি অংশ পরিচালনা করে। তারা নিজেরাই নিজেদের অর্থ ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা সামলায়।

টোরাপ, ডেনমার্ক

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও টোরাপের অধিবাসী পিটার প্ল্যান্ট এই বুক শহরটির চেয়রাম্যান। ২০০৬ সালে একটি রেডিও প্রোগ্রামে নরওয়ের একটি বুক টাউনের কথা জেনেছিলেন।

সেটা শুনেই তিনি টোরাপকে বুক সিটি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। সেসময় দুই হাজার লোকের অংশগ্রহণে একটি ছোটখাটো উৎসব আয়োজন করেন।

পরে ২০০৭ সালে রাস্তার পাশ দিয়ে পাঁচটি বুক ওয়াগন দিয়ে শুরু করে একবছরের মধ্যে এই শহরে উঠতি লেখকদের জন্য ওয়ার্কশপ আয়োজন করা হয়। শহরজুড়ে এখন ডজন ডজন বুক কার্ট ও বুক ক্যাফে রয়েছে।

২০১০ সালে বুক টাউনের আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবিং ১৯১৬ সালে স্থাপিত রেলওয়ে স্টেশনকে পুননির্মাণ করে সেটিকে তাদের প্রধান কার্যালয় বানায়।

এখানে বর্তমানে নীচের তলায় একটি বইয়ের দোকান, স্থানীয় খাবারের দোকান ও সাইকেল ভাড়া দেওয়ার কেন্দ্র আছে।

ভ্রমণকারীরা এখানে গ্যারেজ থেকে শুরু করে শ্রমিকের কুঁড়ে, অব্যবহৃত আস্তাবল, খামারের প্রবেশপথ, চার্চের সম্মুখভাগ ও সুপারমার্কেটের প্রবেশপথে সবজায়গায়ই ছোট ছোট বইয়ের দোকান খুঁজে পাবেন।

বইগুলো দুধের ক্রেট ও পাউরুটির বাক্সে সাজিয়া রাখা হয়েছে। এখানে কোন কোন দোকানে বিক্রেতা পাবেন না। ক্রেতাকে নিজ দায়িত্বে বই নিয়ে দাম রেখে যেতে হবে।

প্রতিবছর এখানে নরডিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় যেখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই নিয়ে আলোচনা হয়। থাকে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান।

১০. ব্রেডেফোর্ট, নেদারল্যান্ডস

জার্মানির সীমান্তে নেদারল্যান্ডসের অলটেন অঞ্চলে অবস্থিত ব্রেডেফোর্ট ২০০৩ সালে একটি বুক টাউন বা বইয়ের শহর হিসেবে গড়ে ওঠে।

এখানে প্রায় ৩০ টি বইয়ের দোকান ও বই-সংক্রান্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। বুক টাউন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একটি ব্রেডেফোর্ট বুক টাউন।

ব্রেডেফোর্টের মধ্যযুগীয় কেন্দ্রকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক হেংক রুসিংক প্রথমবারের মতো এই বুক সিটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন।

হে-অন-উয়াই ফেস্টিভ্যালে ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি এমন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ হন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্যে তিনি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের শতাধিক বই বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও বই বিক্রির জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন বেছে নেন।

এই শহরের মজার ব্যাপার হলো এখানকার বইয়ের দোকানগুলোতে বিশেষায়িত বই বিক্রি হয়। যেমন, ইংরেজি বইয়ের মধ্যে পাওয়া যায় ইতিহাস, সাহিত্য ও সচিত্র বই, গ্রিক ও ল্যাটিন বই, কার ও ট্রাক্টর নিয়ে পুরনো সব বই, গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং জীববিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ক বইয়ের আলাদা আলাদা দোকান।

ব্রেডেফোর্ট, নেদারল্যান্ডস

এখানেও বেশ কতগুলো সততার বইয়ের দোকান রয়েছে যেখান থেকে পাঠকরা দাম রেখে নিজেরাই বই নিয়ে যাবেন।

এখানে নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে ছোট থিয়েটার রয়েছে যেখানে মাত্র ১৪ জন দর্শক একসঙ্গে বসে শো উপভোগ করতে পারে। এই থিয়েটারে গল্পকথক, কবি ও সংগীতজ্ঞদের পরিবেশনা চলে।

এছাড়া এই শহরে পাবেন বইয়ের নানা রকম সার্ভিস যেমন বই পুনরুদ্ধার, বাঁধাই ও হাঁতে তৈরি সুদৃশ্য কাগজ প্রস্তুত করার কাজও হয় প্রতিমাসের তৃতীয় শনিবার।

তাছাড়া প্রতিবছর মে ও আগস্ট মাসে এখানে ঐতিহ্যাবাহী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জার্মানি, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস থেকে বইবিক্রেতা ও ডিলাররা আসেন ও হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করেন।

কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা

আঠারো শতকের শেষের দিকে কলকাতা হয়ে ওঠে প্রকাশনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় নিতান্ত ব্যবসায়িক স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে।

কলেজ স্ত্রিটে এখনো বংশ পরম্পরায় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন এবং বর্তমানে কলকাতায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা আয়োজিত হয় যা ১৯৭৬ সাল থেকে চালু হয়েছে।

কলেজ স্ট্রিট কিন্তু আসলে কোনো শহর না, এটি উত্তর কলকাতার অতি পুরাতন একটি সড়ক যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইয় কেনাবেচার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে বইপাড়া নামে পরিচিত এই জায়গাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের বাজার। মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে শুরু করে গণেশ চন্দ্র অ্যাভিন্যু পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা ধরে এটি বিস্তৃত।

প্রথাগত বইয়ের দোকানের পাশাপাশি এখানে আছে বইয়ের ছোট ছোট স্ট্রিট শপ, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এখানকার কিছু কিছু বইবিক্রেতারা পারিবারিকভাবে শতবছরেরও বেশি সময় ধরে বই বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এখানে নানারকম বই পাওয়া যায়। তবে বড় একটি অংশেই মেলে পাঠ্যবই। এছাড়া ফিকশন, নন-ফিকশন, প্যামফ্লেটসহ বাংলা ও ইংরেজিতে নানারকম পরিচিতিমূলক ছবির বই মেলে।

কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা

প্রচণ্ড ব্যস্ত এই রাস্তায় ভিড়ভাট্টা থাকলেও এখানে ঘোরার অন্যরকম আনন্দ আছে। এখানকার বেশ কিছু বইয়ের দোকান দারুণ নামকরা।

যেমন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরপাশে অবস্থিত ন্যাশনাল বুকস্টোর, ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজ স্ট্রিটের প্রথম বইয়ের দোকান দাসগুপ্তা অ্যান্ড কোম্পানি, পাঁচ দশক ধরে চালু থাকা বাণী লাইব্রেরি।

তবে কলেজ স্ট্রিটের সবচেয়ে বিখ্যাত দোকান কিন্তু কোনো বইয়ের দোকান নয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরপাশে অবস্থিত ইন্ডিয়ান কফি হাউজ।

এখানকার কফির চেয়েও যুগের পর যুগ ধরে এটি বিখ্যাত সব বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় ছাত্রদের মিলনস্থল হিসেবে বেশি বিখ্যাত।

তথ্যসূত্রঃ সারাবাংলা ডট নেট

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা