বম জনগোষ্ঠী বিবাহ বিচ্ছেদ (মাকসেহ)

Jumjournal
Last updated Sep 30th, 2021

1685

featured image

বম বিবাহ বিচ্ছেদ

বম পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘মাকসেহ’ বলা হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি

স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে বম সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘মাকসেহু’ হয়ে থাকেঃ

ক) স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বা বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘মাকসেহু’ সম্পাদিত হতে পারে।

খ) স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়ে কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ সম্পাদন করতে পারে। তবে স্বামীর কারণে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাহলে স্বামীকে বম সমাজের রীতি অনুসারে অর্থদন্ড দিতে হয়। বিবাহ উপলক্ষে স্ত্রীকে দেওয়া পণ বাবদ টাকা স্বামীকে ফেরৎ দেওয়া হয় না। স্বামীকে দেওয়া অর্থদন্ডকে ‘মাকপ্রেহ’ (Mak_Preh) বলা হয়।

স্ত্রীর দোষে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্ত্রীকে এক কাপড়ে স্বামীর সংসার ত্যাগ করতে হয় এবং পণ বাবদ নেওয়া টাকার পুরোটাই স্বামীকে ফেরত দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রী যার কারণেই বিচ্ছেদ হোক না কেন উভয়ের সংসারে আসা সন্তান এবং স্থায়ী সম্পত্তি (ভূমি, লাইসেন্স করা বন্দুক ও অন্যান্য) স্বামীর অধিকারে থাকে।

যদি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর হেফাজতে সন্তান লালিত-পালিত হয় সেক্ষেত্রেও পিতার গোত্র পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হয়। কন্যা সন্তানের বিবাহকালে নেওয়া কনেপণ থেকে মায়ের প্রাপ্য অংশ (নুমান) তার মা’কে দিতে হয়।

গ) বম জনগোষ্ঠীর বম সোশ্যাল কাউন্সিলের ইউনিট, এরিয়া ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের পরামর্শমতে কার্বারীর আদালতে অথবা কার্বারী আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ এর নিকট আপীল করতে পারে।

এ বিষয়ে সার্কেল চীফের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়, তবে অদ্যাবধি বম সমাজে ‘মাকসেহ’ সংক্রান্ত কোনো প্রকার সামাজিক মোকদ্দমা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।

কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীমাকসেহ’ দাবী করার অধিকার লাভ করে –

নিম্নোক্ত কারণে বম সমাজে স্বামী বা স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে সামাজিক প্রথা ও আইন স্বীকৃত উপায়ে ‘মাকসেহ’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ-

স্বামী যদি যৌন মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনা একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘মাকসেহু’ দাবী করতে পারে।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অপরজন ‘মাকসেহ’ দাবী করতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ বম সোশ্যাল কাউন্সিল, সামাজিক আদালত বা প্রচলিত আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ সম্পাদন করতে পারে।

ঘ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ ৰম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা প্রচলিত আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ প্রদান করতে পারে।

ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন গুরুতর অপরাধে দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ ৰম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা প্রচলিত আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ দাবি করতে পারে।

চ)  স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক, সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা সরকারী আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসহ’ দাবী করতে পারে।

ছ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা সরকারী আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ সম্পাদন করতে পারে।

জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা সরকারী আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ প্রদান করতে পারে।

বিবাহ বিচ্ছেদের (মাকসেহ্) আইনগত ফলাফল – 

ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা সরকারী আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘মাকসেহ’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।

খ) ‘মাকসেহ’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ মিলনে ভূমিষ্ট সন্তান পিতার স্বীকৃতি পায় এবং সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন সাপেক্ষে উত্তরাধিকারী হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘মাকসেহ’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে চার্চ/চার্চ-এন্ডারের মাধ্যমে ধর্মীয় রীতিমতে পূনঃ বিবাহ দ্বারা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়। সেক্ষেত্রে পুনঃ বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজনে সমাজের অংশগ্রহণ, অতিথি আপ্যায়ন ও পণ বাবদ টাকা পরিশোধের রীতি অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।

ঘ) ‘মাকসেহ’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।

ঙ) ‘মাকসেহ’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়। তবে স্বামীর ইচ্ছায় ‘মাকসেহু’ হলে স্ত্রী বিচ্ছেদ দাতা স্বামীর সংসারের ৫০% সম্পত্তি পায়।

চ) স্বামী অথবা স্ত্রী যে কারোর কারণে ‘মাকসেহু’ সম্পাদিত হোক না কেন সেক্ষেত্রে সন্তান পিতার হেফাজতে থাকে তবে নাবালক সন্তান তিন বছর পর্যন্ত পিতার ভরনপোষণে মায়ের হেফাজতে লালিত-পালিত হয়। সেক্ষেত্রে সন্তান পিতার আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘মাকসেহ’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।

মাকসেহ্’ সম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থা

ক) ‘মাকসেহ’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের উপর দায়দায়িত্ব থাকে অথবা ‘মাকসেহ’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত জন্মদাতাকে পিতৃত্বের দায় স্বীকার করা হয়।

উক্ত সন্তান অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় না। সন্তান পিতার আইনগত উত্তরাধিকার লাভ করে। তবে তিন বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সন্তান পিতার ভরনপোষণে মাতার হেফাজতে লালিত-পালিত হয়। সন্তান প্রসবকালে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর মৃত্যু হলে তার সত্ত্বার বিচ্ছেদ দাতা স্বামীকে নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করতে হয়।

খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘মাকসেহ্’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রী যদি গর্ভ ধারণ করে সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের গ্রহণে আইনতঃ বাধ্য নয়। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভজাত এ ধরণের সন্তানের দায়-দায়িত্ব বম সমাজের রীতিনীতি অনুসারে সামাজিক আদালত নির্ধারণ করে।

তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা