জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে মাতৃভাষার ভূমিকা

Jumjournal
Last updated Oct 3rd, 2020

893

featured image

ভূমিকা:
জাতি গঠনে ভাষা একটি মৌলিক উপাদান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার জন্য ভাষা সৈনিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এদেশের মাটি (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান)। বাংলা ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণতি লাভ করে।

১৭৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার ২৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী,আন্তর্জাতিক মাতুভাষা দিবস ঘোষিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় বিশ্বের সকল জাতিসমূহের ভাষার উন্নয়নের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টির উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।

ভূমিষ্ট হবার পর সর্বপ্রথম মায়ের মুখ থেকে নিসৃত শব্দগুচ্ছ থেকেই একটি মানব শিশুর পরিবেশ পরিচিতি ঘটে এবং মায়ের ভাষায় তার ইচ্ছা-আকাঙ্খা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়।

এভাবে ব্যক্তি,সমাজ ও সভ্যতা বিকাশে ও জাতি গঠনে মাতৃ ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সমাজ ব্যবস্থা সভ্যতার যে স্তরেই থাকুক নাকেন ভাষার মাধ্যমে ব্যক্তি এবং একটি জাতির পরিচয় ঘটে।

যুগে যুগে মানুষের সমাজব্যবস্থা বিকাশে বিশেষ গ্ররুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল ভাষা। বিশেষ করে মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে উৎপাদন ব্যবস্থা সামাজিক হওয়াতে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ভাষার গুরুত্ব অত্যধিক বেড়ে যায়।

সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে গড়ে উঠে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং আইন প্রণয়ণেও ভাষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাই বিশ্বের প্রত্যকটি জাতির ভাষা উন্নয়নের লক্ষ্যে “ইউনেসকো” ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

ইউনেসকো গঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ৪ নভেম্বর। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্টসমূহ্র পদাধিকার বলে ইউনেসকোর সদস্য হয়ে থাকে। শিক্ষা,বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় ১৯৮৯ সাল থেকে।

১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর,আঃলীঃ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে পিসিজেএসএসএর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (যা শান্তি চুক্তি হিসেবে সমধিক পরিচিত)সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির সুবাদে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকো পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৯৮ সালে।

পুরস্কৃত হবার ১৯ বছর পর এবছরের (২০১৭) প্রথমার্ধে দেশে মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়। সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য।

সরকারের এই উদ্যোগকে কাজে পরিণত করার জন্য মূল ভিত্তি হচ্ছে আদিবাসী জাতিসমূহের শিল্প,সাহিত্য,ভাষা ও সংস্কৃতি প্রেমী বুদ্ধিজীবি সমাজ। এরাই আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা গবেষণার কাজে অগ্রগণি ভূমিকা পালন করতে পারেন। আর সাধারণ শিক্ষিত সমাজ তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।

এভাবেই পৃথিবীর অপরাপর প্রতিষ্ঠিত জাতিসমূহের অস্তিত্ব সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় নির্দিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বলিত এদেশের আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্বের কথাও ইতিমধ্যে ব্যাপকহারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

ভাষা বিকাশের প্রেক্ষাপট:
ভাষার গুণে মানুষ অন্য প্রাণী সমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। বনের পশু-পক্ষীকে বশীভূত করে নিজেদের চাষাবাদের কাজে লাগিয়েছে। বন্যহাতিকে বশীভূত করে তদ্বারা মানুষ অনেক কাজ সম্পাদন করেছে।

অবশ্য মানব সমাজ বিকাশের শুরুতে মানুষ আজকের মতো সমৃদ্ধ ভাষা নিয়ে ভাব বিনিময় করেনি। সমাজ বিকাশের সাথে সাথেই মানুষের ভাষা বিকশিত হয়েছে। মানুষের ভাষার প্রাথমিক রূপ ছিল ইশারা বা সংকেত।

পরে তার সাথে অষ্পষ্ট কন্ঠস্বর যোগ হয়। মানুষ থেকে শুরু করে ইতর প্রাণী পর্যন্ত তা দেখা যায়। কিন্তু মানুষের ভাষা যেভাবে বিকশিত হয়েছে অন্যান্য ইতর প্রাণীর ভাষাতে তা হয়নি। যেমনি শত্রুর পূর্বাভাস পেলে বনের পশু-পক্ষী একসঙ্গে বিপদ সংকেত সূচক সম্মিলিত আওয়াজ সহকারে পালাতে শুরু করে।

একটা মা-মুরগী তার ছানাগুলোকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার্থে লম্বা ও উচ্চস্বরে একটা সতর্কবাণী মূলক আওয়াজ করার সাথে ছানাগুলো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অথবা খাদ্য সংগ্রহের সময় মায়ের ডাকে মুরগীর ছানাগুলো তাদের মা’র অনুসরণ করে। ইতর প্রাণীগুলোর বিকাশ সে পর্যন্তই।

কিন্তু মানুষের সমাজ ও ভাষার বিকাশ থেমে নেই। অধুনা মানবজাতি আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ হয়েছে। মুখোমুখী কথা বলা ছাড়াও আজ মানূুষ রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দ্বারা বিভিন্ন ভাষায় অনুষ্ঠানমালা ইত্যাদি সম্প্রসার করে। বিভিন্ন ভাষায় পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে একটি দেশে নানারকম খবর প্রচার করা এবং জনমত তুলে ধরা হয়।

বলা যেতে পারে,ভাষা একদিকে একটি জাতির পরিচয় বহন করে অন্যদিকে ভাববিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলে। এসবই মানুষের ভাষার অগ্রগতির ফলেই সম্ভবপর হয়েছে।

ভাষা সম্পর্কে ভাষাবিদদের মতামত:
মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য এই যে,মানুষ হচ্ছে তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন জীব। মানুষের প্রবৃত্তি সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করা। অনুভব উপলব্দির সমষ্টি নিয়েই আমাদের জীবন। আর এই অনুভবের বাহন হচ্ছে ভাষা।

ভাষার মাধমেই মানুষ মানুষকে কাছে টানে।গড়ে তোলে সমাজ। সৃষ্টি করে সভ্যতা।আদিম মানুষের ভাষা ছিলনা।তারা আকার ইঙ্গিতে মনের ভাব ব্যক্ত করত। কখনোবা চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে একে অন্যকে জানার জন্য সে ধ্বনি উচ্চারণের নামে বোবার মতো গুমরাতো।

এ ভাবেই নির্বাক মানুষ একদিন যখন নিজের অজান্তেই ধ্বনি সৃষ্টি করল,তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইলনা। তারপর মানুষ একদিন ধ্বনির প্রতীক আবিস্কার করল। এভাবেই সূচিত হল ভাষার মূল ভিত্তি।

ভাষা যদিও ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়,কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এটি সমাজের সৃষ্টি। অপরের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্যই ভাষার উদ্ভব। নির্জনে নিরালায় ভাষার প্রয়োজন হয়না। চিন্তার জন্য ধ্বনিহীন অব্যক্ত ভাষার প্রয়োজন পড়ে।

গ্রীকরা একে বলত ‘খড়মড়ং’। শ্রোতারূপে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে ভাষার রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যে পরিবার বা যে সমাজের মধ্যে মানুষ বসবাস করে সে পরিবার বা সে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তার চিন্তা,উদ্দেশ্য ও কর্মগত সমস্যা কিছু না কিছু থাকেই।

ভাষার মধ্য দিয়েই আদিম মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তির প্রথম অঙ্কুর প্রকাশিত হয়,যা মানুষকে মননশীল ও সভ্য করে গড়ে তুলেছে। যার ফলে মানুষ প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃতিকে বশ করেছে। প্রকৃতিকে বশ করার ক্ষেত্রে সর্বৈব ভূমিকা রয়েছে ভাষার।

মানুষ জন্মসূত্রে ভাষা পায়না,এটি তাকে অর্জন করতে হয়। শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে অর্থহীন ‘আওয়াজ’ করে। এই আওয়াজ ভাষা নয়। শিশু তার পরিবেশ থেকে আস্তে আস্তে ভাষা শেখে।

সে যখন মায়ের সান্নিধ্যে থাকে তখন মা যে ভাষায় কথা বলেন,সেভাবেই সে ভাষা রপ্ত বা আয়ত্ব করে নেয়। সেটিই হয় তার মাতৃ ভাষা। মানুষের রয়েছে একটি উন্নত বাগযন্ত্র; যা অন্যান্য প্রাণীর বাগযন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

আদিম মানুষ বাগযন্ত্রের সাহায্যে যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করত, সেগুলোই হচ্ছে ভাষার প্রাচীনতম রূপ। ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, বাগযন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্ট ও উচ্চারিত যে সব অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি দ্বারা মানুষ তার নিজের মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশে সহায়তা করে এবং যা একটি নির্দিষ্ট ভাষাভাষী এলাকার মানুষের মনোভাব প্রকাশে সহায়তা করে তাকে ভাষা বলে।

ভাষাবিদ পন্ডিতগণ ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং ভাষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এথেকে কয়েকটি বিশিষ্ট সংজ্ঞা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন

# “মনের ভাব প্রকাশের জন্য,বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন,কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত,স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত,তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।” Ñড.সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়।

# “মনুষ্য জাতি যে সব ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলা হয়ে থাকে।” ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

# “মানুষের উচ্চারিত,অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি সমষ্টিই ভাষা।” ড:সুকুমার সেন

# “ মানুষ বাগযন্ত্রের সাহায্যে সমাজভূক্ত জনগণের বোধগম্য যে সমস্ত ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি উচ্চারণ করে সে সমস্ত ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে ভাষা বলে।” Ñড:মুহম্মদ এনামুল হক
# “এক এক সমাজের সকল মানুষের উচ্চারিত ধ্বনিবোধক ধ্বনি সমষ্টিই ভাষা” ড.মুহম্মদ আবদুল হাই।

ভাষার উপরিউক্ত সংজ্ঞার ভিত্তিতে নিম্মরূপ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়-
# ভাষা বাগযন্ত্রের সাহয্যে উচ্চারিত ধ্বনি।
# ভাষার অর্থদ্যোতকতা বিদ্যমান। অর্থাৎ ধ্বনি ও ধ্বনি সমষ্টির অর্থ থাকতে হবে।
# ভাষা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ও ব্যবহৃত। ভাষা মনের ভাব প্রকাশক,অর্থাৎ পরস্পর ভাব বিনময়ের মাধ্যম।

পন্ডিতগণের উপরোক্ত মতামতের ভিত্তিতে ভাষা প্রসঙ্গে বলতে গেলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষাও এর বাইরে নয়। আদিবাসী জাতিসমূহের বিকাশ ঘটাতে হলে স্বস্ব ভাষার বিকাশও ঘটানো প্রয়োজন রয়েছে।

পৃথিবীতে ভাষার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটেছে। যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটেছে।

আর তারি সাথে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীকে ইউনেসকো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বলা যায় এদিনটি বিশ্বের সকল জাতির ভাষাসমূহের স্বীকৃতির সনদ স্বরূপ। ভাষার স্বীকৃতি অর্থ সে ভাষাভাষী মানব সম্প্রদায়কে প্রাথমিকভাবে জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দানের সামিল। সেদেশের ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ভাষা,শিল্প,সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার স্বীকৃতি।

সে দেশে বসবাসকারী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দান করে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রবর্তন করা। আইন অনুসারে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের।

১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। এপর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। ২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপ্রত্রে উল্লেখিত অধিকারসমূহ বিবেচনায় রেখে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এই বাংলােেদশর ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের ছিল এমনটাই একটা প্রত্যাশা।

এমতাবস্থায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কর্মসূচীকে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।

বিশ্বে আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ অনস্বীকার্যঃ
বিশ্বে বর্তমানে ৫০০০ এর অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৪০ কোটিরও বেশী জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের ৯০ টি দেশে বসবাস করছে। যারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫%। এটা অনুমিত হয় যে,সারা বিশ্বের ৬০০০ ভাষার মধ্যে ৫০০০ এর অধিক ভাষাভাষী আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে।

আদিবাসীদের ভাষা এবং তাদের প্রথাগত জ্ঞান মানব সমাজকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সেখানে বিশ্বে দারিদ্র্যের ১৫% ভাগ হচ্ছে এই আদিবাসী জনগণ। বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল মিলে তাদের লোকসংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক ধরা হয়।

এই আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য তাদের ভাষাকে রক্ষা করা জরুরী। একটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে গেলে অচিরেই সে জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্তি হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।

আজ আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিলুপ্তি না সংরক্ষণ ঠিক এমনি এক ক্রান্তি লগ্নে মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদান সরকারের একটি মহতি উদ্যোগ বলা যায়। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথম ধাপে সমতলের গারো, সাঁওতাল ও সাদারি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এই ৬ ভাষায় ৬ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কার্যক্রম হাতে তাদের স্বস্ব ভাষায় পাঠক্রম প্রণয়নের জন্য লেখক নির্বাচন করা হয়।

এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারের একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এক্ষত্রে আদিবাসীদের সমন্বয়ে আদিবাসী ভাষা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ণ এবং পাঠ্য বই প্রস্তুত করার বেলায় দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের স্বীকৃত লেখকদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে ভাষা সম্পর্কে আদিবাসীদের কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণের পূর্ব সর্ত।

পরিেেশষে আদিবাসী ভাষা গবেষণা কেন্দ্রে যাতে আদিবাসী ভাষা গবেষকদের বিশেষ ভূমিকা থাকে দেশে সেরকম ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠা প্রয়োজন। সর্বোপরি সকল আদিবাসী লেখক ও গবেষকদের একটা যায়গায় বসা প্রয়োজন।

সরকারীভাবে বাংলাদেশ আদিবাসী ভাষা গবেষণা কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগীতা এবং পরামর্শের জন্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদতো রয়েেেছই।

আদিবাসীদের ভাষা ও বাংলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থান সম্পর্কে:
আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন তথা আদিবাসীদের ভাষা গবেষণার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৩০ লক্ষাধিক মানুষকে খূঁজে পেতে হবে।

তাদের নিজেদের ভাষার বিকাশ ঘটানোর জন্য তাদের মতামত ও সসুপারিশ গ্রহণ প্রয়োজন হবে। এক নজরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিন্মে উল্লেখ করা গেল। উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী আদিবাসীরা হচ্ছে- সাঁওতাল, ওঁড়াও, মাহালী, মুন্ডা, মাহাতো, রাজবংশী, পাহান, সিং, রাজুয়াড়, মালো, রাই, পাহড়ীয়া, বড়াইক, কর্মকার,তুরী, গন্ড,মুসহর,বেদিয়া, কোল, মুরিয়ার ও বর্মন। দক্ষিণবঙ্গে বসবাসকারী আদিবাসীরা হচ্ছে- মাহাতো, মুন্ডা, বাগদী, ভূমিজ,রাই ও রাজবংশী।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীরা হচ্ছেন- গাড়ো, হাজং, বর্মন, ডালু, কোচ, হাদি, বানাই ও রাজবংশী। উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে আপাতত কেবলমাত্র রাখাইনদের সন্ধান পাওয়া গেছে। কুমিল্লা ও চাঁদপুর অঞ্চলে হচ্ছে- ত্রিপুরা।

সিলেট অঞ্চলে-খাসি, মুণিপুরি, পাত্র ,গারো, খারিয়া, কুন্ড, ত্রিপুরা, মুন্ডা, অহমিয়া, কোল, মাহালি ও সাঁওতাল। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে হচ্ছে- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খুমি, গুর্খা, অহমিয়া, চাক, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে আছে-ত্রিপুরা(যারা আজ বিলুপ্তি দ্বার প্রান্তে)। বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ে সর্বমোট ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাদেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখিত ১৩টির অধিক আদিবাসী জাতিসমূহ; যারা চৌদ্দশ সালের পূর্ব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এদেশে বসবাস করে আসছে।

ইতিমধ্যে তারা মোগল আমল(১৪০০-১৮৬০)ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী আমল,ব্রিটিশ আমল(১৮৬০-১৯৪৭),পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১) পেড়িয়ে এসছে। বর্তমানে বাংলাদেশ আমল(১৯৭১- ১৭) পাড় করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সমতলে ও পাহাড়ে আদিবাসীদের অবস্থান সম্পর্কে বিতর্ক নিরসনের লক্ষ্যে, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রদ্ধাভাজন মংসানু চৌধুরী “এই বিভ্রান্তি আর কতকাল?” শিরোনামে সম্প্রতি তাঁর লেখা একটা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, “আদিবাসী” আর “আদিঅধিবাসী” এক নয়।

‘আদিবাসী’ ধারণার সঙ্গে ‘কে আগে, কে পরে এসেছে’ এই প্রত্যয় কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। আদিবাসী প্রত্যয়কে বিবৃত করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এযাবৎ যতগুলো ধারণা প্রচলিত হয়েছে, কোনটাতেই ‘আগে পরে আসা’ ও আদিবাসী শব্দকে সমার্থক করা হয়নি।

অর্থাৎ আদিবাসী বা তার ইংরেজী প্রতিশব্দ ওহফরমবহড়ঁং (ইন্ডিজিনাস) এর আভিধানিক শব্দার্থ ‘স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত’ অর্থে পৃথিবীর অনেক জনগোষ্ঠীকেই তাদের আদি বসবাসের সূত্রে আদিবাসী বলার সুযোগ নেই।

কারণ পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীই এখন যেখানে বসতি গড়ে আছে, দেখা যাবে তাদের পূর্ব পুরুষরা কোন না কোন সময় পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্ত থেকে এসে বর্তমান স্থলে স্থায়ী হয়েছে। বাঙ্গালীদের আদি পুরুষরাও দ্রাবিড়ীয়, তিব্বতোবার্মান ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীভূক্ত মানুষ যাদের সকলেই বহিরাগত।”

কাজেই বর্তমানে দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের পরিচিতি আগে-পরে আসা নিয়ে নির্ভর নয়। সুতরাং তাদের অবস্থান ও পরিচিতি বিচার্য্য সূত্র হবে- ‘‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র।”

সে যাক,প্রসঙ্গক্রমে এটুকুই। আসলে মূল কথা হচ্ছে আদিবাসী ভাষা প্রসঙ্গে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার এবং ভাষার বিকাশে অতীতে কোন সরকারই মনোনিবেশ করেনি।

তাই বর্তমানে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে মাতুভাষায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের মতো এরকম একটি উদ্যোগকে যথাযথ কাজে পরিণত করা যুক্তিযুক্ত।

জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৩ সালকে বিশ^ আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা, ৯আগষ্টকে আদিবাসী দিবস ঘোষণা; ২০১১ সালের ১৩জুলাই বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠন; আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র (প্রথম প্রকাশ-অক্টোবর,২০০৯), সর্ব সম্প্রতি মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের এই শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের ঘোষণা ইত্যাদি সরকারী উদ্যোগকে আদিবাসীরা স্বগত জানিয়েছে।

এই সব ঘটনা প্রবাহ আদিবাসীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণতি করেছে। তারি সাথে এই কাজে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ণ এবং আদিবাসীদের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হলে সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক বাতাবরণ তৈরী হবে।

আদিবাসী ভাষায় সরকারীভাবে শিক্ষা দান কাজের সুািবধার্থে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে আদিবাসী বর্ণমালাসহ আদিবাসী ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করা গেলে এই কার্যক্রম আরো ত্বরাণ্বিত হতো। আদিবাসীরা কোননাকোন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে জাতি হিসেবে তাদের ভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ পিছিয়ে পড়া বলা যায়।

এসব পশ্চাৎপদতা কেটে উঠার জন্য জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন সাংবিধানিক অধিকার। বা আইন অনুসারে সব কিছু রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার। সর্বোপরি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জাতীয় চিন্তা-চেতনার। অধিকার সচেতন নাহলে কোন সরকারী সুযোগ-সুবিধা এবং আদিবাসী বান্ধব আইন ইত্যাদি কোন কাজে আসবেনা।

আজকে আদিবাসী ভাষা চর্চার ক্ষেত্রেও একই কথা। কোন জাতির ভাষা বিলুপ্তির সাথে সেজাতির বিলুপ্তি অবধারিত হয়। সমূহ এই বিলুপ্তি থেকে বাঁচতে হলে প্রয়োজন ভাষা চর্চা। সমাজের শিক্ষিতজনরাই সমাজের সাধারণ মানুষকে চলার পথ দেখায়।

কিন্তু আমাদের আদিবাসী সমাজে সেই সংস্কৃতি এখনো আশানুরূপভাবে বিকাশ লাভ করেনি।শিক্ষিতরা কেবলমাত্র সরকারী চাকরীর জন্য নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন।নিজের সীমাবদ্ধতার কারণে(আদিবাসী) সরকারী চাকরীজীবিরা নিজেকে সরকারী কর্মচারীর পাশাপাশি সরকারী মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।

অথচ আদিবাসী সমাজের অভ্যন্তরেই তার অর্থনৈতিক,সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা প্রবাহমান। তবুও আদিবাসী জাতিসত্বার মানুষ হয়েও আদিবাসীদের সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে অনাগ্রহী।

বাড়ীতে নিজস্ব ভাষার বদলে শাসকগোষ্ঠীর ভাষাকেই বেশী চর্চা করেন। ফলে অপসংস্কৃতির আক্রমণের শিকার হয়ে কাঙ্খিত সন্তান অনাকাঙ্খিত জীবন বেছে নেয়। বিশেষ করে কন্যা সন্তানদের বেলায় এই ঝোঁকটা অপেক্ষাকৃতভাবে দেখা যায়।

ভাষা সংরক্ষণে চর্চার প্রয়োজন:
অধ্যয়ণ অনুশীলন ছাড়া মানুষের জ্ঞানের বিকাশ হয়না। তেমনি ভাষার চর্চা ব্যতিরেকে কোন ভাষার বিকাশ ঘটানো যায় না। “একটি জাতির ভাষা তখন হারিয়ে যায়,যখন সে ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ভাষাটি ব্যবহার করেনা।এবং তাদের সন্তানদের শেখায় না।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা সংরক্ষণ চর্চার ব্যবস্থা না করার কারণে।” তাহলে দেখা যাচ্ছে যে,ভাষা রক্ষার জন্য প্রথমত: যেকোন জনগোষ্ঠী তার নিজের ভাষাকে নিজের পরিবারে ও সমাজে ব্যবহার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত: তাদের সন্তানদের শেখাতে হবে। তৃতীয়ত: রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা সংরক্ষণ চর্চার ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আদিবাসীদের নিজেরদের ভূমিকা কীরকম সেটা দেখার বিষয়। নিজেদের বর্নমালা ও ভাষায় পড়ালেখা করতে জানা এবং অপরকে শেখানোর ক্ষেত্রে নিজেরা কতটুকু অগ্রসর সেটা তলিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

দেশের ৫৪টির অধিক আদিবাসী রয়েছে যারা নিজস্ব ভাষায় ভাববিনিময় করতে পারলেও পড়ালেখার বেলায় হয়তো এখনো সবাই সমানভাবে অগ্রসর হতে পারোনি। যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বলে দাবী করে থাকেন তারা কিন্তু রাষ্ট্রভাষা কিংবা শাসকেগোষ্ঠীর ভাষায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন।

যে ভাষায় শিক্ষা অর্জন করেছেন সে ভাষার সংস্কৃতি তাদের নিজেদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে নিজেদের জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে গৌণ স্থান দিয়েছে অবচেতনমনে।

যার ফলশ্রুতিতে আমাদের উচ্চশিক্ষিত কন্যা সন্তানদের ভিনজাতির সমাজে হারাতে বসেছি। তাই অপ্রিয় হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রভাষায় পারদর্র্শী হলেও তারা নিজেদের ভাষা চর্চার বেলায় অনগ্রসর রয়ে গেছেন।

নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক জীবন চর্চার স্থলে শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতির চর্চাই করে থাকেন। কিছু উচ্চ শিক্ষিত আজ জীবিকার তাগিদে চিরদিনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেখানে একই কারণে সেদেশের ভাষা,সংস্কৃতিকে প্রথম স্থান দিয়ে নিজেকে দ্বিতীয় স্থানে বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এভাবে ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে নিজেরা হারিয়ে যেতে বসেছেন। এটা কিন্তু আদিবাসীদের জন্য সুখবর নয়;যা আদিবাসী ছাত্র-যুব সমাজ তথা শিক্ষিত সমাজকে অবশ্যই গভীরভাবে তলিয়ে দেখার বিষয়।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ-ভারতের সভ্যতার ক্ষেত্রেও ভারতবাসীদের অবস্থা এমনতাই দেখা গেছে। তখন ভারতের সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন বলে যারা স্বনামধন্য তারা বাড়ীতে ইংরেজী ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করতেন,ইংরেজী ভাষী গৃহ শিক্ষক রাখতেন।

ছেলেমেয়েদের ইংরেজী ভাষা ও সংস্কৃতি শেখাতে পারলে তবেই তারা উচ্চ শিক্ষিত হিসেবে নিজেদের মনে করতে পারতেন এমনটি ধারা একসময় ছিল। আর এক সময় আসলো যখন বিলেতি কাপড়-চোপড় বর্জন করা হলো।

ভারতের কংগ্রেস নেতা মহাত্মাগান্ধী যখন বিলেত ফেরত হলেন তখন সাহেবী পোষাক(কোট,টাই,পেন্ট) বর্জন করে কদ্দের কাপড় ব্যবহার শুরু করলেন। শুধুমাত্র ভাব বিনমিয়ের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজী(ভাষা)কে রেখে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিটা বাদ দিলেন আর তার জায়গায় ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার উপর গুরুত্ব দিলেন।

তখনতো সেখানে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তখন সমগ্র ইউরোপ এশিয়া মহাদেশ জুড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের দামামা বাজছিল। এই যুদ্ধ পরিস্থিতি কিন্তু বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) আদিবাসী জাতিসমূহকে রাজনৈতিকভাবে আলোড়িত করতে পারেনি।

যারা শিক্ষিত বলে পরিচিত হয়েছিলেন তারা সরকারী চাকুরী ছাড়া অন্য কোনভাবে নিজেদের জাতীয় পরিচয় তুলে ধরা কিংবা ভাষার ব্যাপারে তেমন কিছুই করতে সক্ষম হননি।

১৮৯৫ সালে কৃষ্ণ কিশোর চাকমার জন্ম আর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। তিনি ৪০ বছর বয়সে মৃতু বরণ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন স্কুল পরিদর্শক। তার সাথে আদিবাসী জুম্ম সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ করলেও সময় কিন্তু বেশী পাননি।

তার কর্মজীবন ছিল স্বল্প দৈর্ঘ। তারপরও এই স্বল্প পরিসরে আদিবাসী সমাজে দীর্ঘস্থায়ী শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা করে গিয়েছিলেন যে আন্দোলনের ধারা তার উত্তরসূরী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম.এন.লারমা,জন্ম-১৫ এপ্রিল ১৯৩৯, মৃত্যু-১০নভেম্বও,১৯৮৩), জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা ) এবং তাদের সহযোগী নেতৃবর্গের সহযোগীতায় আজকে এতদূর এসেছে।

এপর্যায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আদিবাসী প্রসঙ্গ জোড়ালো হবার পর পরই বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা শুরু হয়েছে। যে ধারার সৃষ্টি ১৯৭০ দশকে। আর আজকে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর এই প্রথম আদিবাসী ভাষায় সরকারীভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ গৃহীত হয়।

তাসত্বেও ইপ্সিত ফল লাভ অনেক দূর বাকী। ভাষাবিদদের মতে বর্তমানে পৃথিবীর মানুষ ৫০০০ হাজার ভাষায় কথা বলে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে ১০টি আদিবাসী ভাষা।

আর রয়েছে ১১টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। সমগ্র বাংলাদেশে রয়েছে ৫৪টির অধিক আদিবাসী যার লোকসংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক। আদিবাসী শিশুদের মাতৃ ভাষায় শিক্ষাদানের বেলায় দীর্ঘ পদযাত্রা পাড়ি দিতে হবে। যাহা নিঃসন্দেহে গবেষণাধর্মী এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার বটে।

উপসংহারঃ
আদিবাসী পরিবারে,সমাজে, দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালতে এবং শিক্ষাঙ্গনে (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে) সর্বত্র আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক তথা বুদ্ধিজীবি সমাজের সক্রিয়তা ও সচেনতার উপরই মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের এই শিক্ষা কার্যক্রমের ফলাফল বহুলাংশে নির্ভরশীল।

কিন্তু দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কেবলমাত্র ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার ভাবমানসের দিকেই শিক্ষিতদের ধাবিত করে। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে দেশের শিক্ষিত সমাজ অত্যধিক ঝুঁকে থাকেন।

দেশের উচ্চ শিক্ষিত সমাজ যে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেন আদিবাসী শিক্ষিত যুবসমাজও এর উর্ধে নয়। এর উর্ধে উঠে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রসারিত করে এগিয়ে তবেই আদিবাসী সমাজের বুদ্ধিজীবিরা স্বকীয় ভাষা ও জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের পথ প্রশস্থ করতে পারেন। পারেন আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ পাশাপাশি জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করতে। আর সেটাই আদিবাসীদের জন্য আন্তরিকভাবে কাম্য।

তথ্য সূত্রঃ
১। উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা- অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী +অধ্যাপক ড.সফিউদ্দীন আহমেদ (পৃ: ৪৩)।
২।আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র,(অনুবাদ:মঙ্গল কুমার চাকমা,তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পিসিজেএসএস)।
৩। কাপেং ফাউন্ডেশন,ঢাকা।
৪। এই বিভ্রান্তি আর কতকাল? –মংসানু চৌধুরী(জাক’র রাঝুং- বার্ষিক সংকলন’২০১৭)।
৫।পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক সম্মেলন ২০১৬(২য়) “স্মারক সংকলন”।

ধীর কুমার চাকমা; সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা