প্রথাগত আইনে আদিবাসী মারমা নারীর অবস্থান

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

2094

featured image

জনসংখ্যার দিক দিয়ে মারমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। মারমা আদিবাসী জনগোষ্ঠী তিন পার্বত্য জেলা তথা তিন সার্কেলে বসবাস করলেও তা সংখ্যাগুরু অংশটি বসবাস করে বোমাং সার্কেলে।

মঙ্গোলীয় বংশোদূত মারমা জনগোষ্ঠীর ভাষা টিবেটো বর্মণ পরিবারের বর্মী দলভুক্ত। পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসরত মারমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দশটি গোত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ভাষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে কর্মী ও আরাকানীদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা আদিবাসীদের যথেষ্ট সাদৃশা , ঐতিহাসিক যোগসূত্র পাওয়া যায়। মারমাদের সমাজব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতোই পিতৃতান্ত্রিক।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মারমা নারীরা পুরুষের অধীনে থাকলেও উত্তরাধিকার প্রথাসহ কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসী নারীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে।

তবে গোত্র ও সার্কেল ভেদে এদের মধ্যেও প্রথা ও রীতিনীতির কিছু পার্থক্য আছে। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী আদিবাসী মারমারা জন্মান্তরবাদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করে।

তারা পূজার মন্ত্র ও নিয়ম পদ্ধতি, পাণ্ডুলিপি আকারে তন্ত্রমন্ত্র জপ, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ লিখন বা প্রস্তুতকরণের পদ্ধতি, ভেষজ চিকিৎসা, জন্মকুষ্ঠি ও রাশি বিচার, জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে প্রচলিত বংশানুক্রমিক রীতিনীতি মেনে চলতে চেষ্টা করে। যদিও এ সকল বিষয় বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক।

বিয়ে

মারমা সমাজে বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। মারমারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হলেও ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানাদির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।

বিয়ের এইসব অনুষ্ঠানাদির মূল উদ্দেশ্য সমাজসিদ্ধভাবে এক জোড়া নর-নারীর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসের লক্ষ্যে সমাজের অনুমোদন লাভ। মারমা সমাজে বিয়ে নিবন্ধনের কোনো রীতি নেই।

বিয়েতে উপস্থিত সমাজপতি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জোড়াবন্ধন (লাক থে পোই) পরিচালনাকারী ব্যক্তি বিয়ের সাক্ষী ও অনুমোদনকারী।

নিষিদ্ধ সম্পর্ক: মারমা সমাজে রক্তসম্পর্ক/গোত্রগত সম্পর্ক বা যেসব আত্মীয়তার মঞ্চে বিয়ে হতে পারে না, তা হলো একই পিতার ঔরসজাত সৎ ভাই-বোন, আপন চাচাত/মামাত/খালাত/পিসিত ভাই-বোন, কাকা-ভাইঝি, পিসি-ভাইপো, মামা-ভাগিনা, আপন বোন, মাসি-ভাগিনা, বিমাতা, একই ঔরসে জন্ম নেয়া ভিন্ন ভিন্ন মাতার ছেলে-মেয়ে ভ্রাতুস্পুত্রের স্ত্রী, ভাগিনার স্ত্রী, মামি সম্পৰ্কীয় আত্মীয়, কাকি সম্পর্কীয় আত্মীয়, তালতো ভাইয়ের সাথে আপন কন্যা, ইত্যাদি।

এছাড়াও, একই গোত্রভুক্ত আত্মীয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ অতিক্রান্ত না-হওয়া পর্যন্ত পুনরায় বিয়েসূত্রে আত্বীয় স্থাপন করা যায় না।

মারমা সমাজে একজন নারী বিয়ের পর তার পিতার পরিবার ছেড়ে স্বামীর সংসারে এসে পিতৃপ্রদত্ত উপাধির পরিবর্তে স্বামীর উপাধি গ্রহণ করেন।

মারমা সমাজেও দুই ধরনের বিয়ের প্রচলন দেখা যায় : ১. সামাজিক/নিয়মিত বিয়ে ও ২. পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে।

রক্তসম্পর্কীয় নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হওয়া দম্পতিকে মারমা সমাজে সমাজচ্যুত করা হয়। এছাড়াও মারমা সমাজে পুরুষের বহুবিবাহ এবং অনুমোদিত বিয়ের প্রচলন থাকলেও এসব বিয়েকে মারমা সমাজে স্বীকৃত বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হয় না। বিধবাদের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।

– সামাজিক বা নিয়মিত বিয়ে (ত্রইঞো রোহ) : পিতা-মাতা বা অভিভাবক ও পাত্রপাত্রীর সম্মতিতে সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার মাধ্যমে যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তা সামাজিক নিয়মিত বিয়ে।

সামাজিক/নিয়মিত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পর্বে ‘চুংমংলে বা ‘গংউনাইউ’, ‘লাকথেকপোই’, ‘লাকখছংপপাই’-এর মতো সামাজিক আচারানুষ্ঠান সম্পন্ন করা অপরিহার্য। পাত্রকে ঘরজামাই হিসেবে গ্রহণ করে মেয়ে বিয়ে দেয়ার রীতিটিও নিয়মিত বিয়ের অন্তর্ভুক্ত।

– পলায়ন বা অনিয়মিত বিয়ে (ব্রিরো/অহশখা নিজাই-চ) : পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া যুবক যুবতী প্রণয়াসক্ত হয়ে প্রচলিত সামাজিক নিয়মে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে পলায়ন বিয়ে/অনিয়মিত বিয়ে বলে।

পলায়ন বিয়ের ক্ষেত্রে যুবক-যুবতী অভিভাবকের অজ্ঞাতে পালিয়ে গিয়ে কোনো পরিচিত বা আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সাধারণত ছেলেপক্ষ মেয়েপক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়।

যদি ছেলে ও মেয়ের বিয়ে নিষিদ্ধ সম্পর্কভুক্ত না-হয় এবং মেয়ের পিতা-মাতার দাবি-দাওয়া ছেলেপক্ষ মেনে নেয়, তাহলে সমাজের অনুমোদন সাপেক্ষে পলাতক যুগলের বিয়ে বৈধতা লাভ করে।

তবে যুবক-যুবতী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় যদি কোনো ভাবে মেয়েপক্ষের কারো কাছে ধরা পড়ে, তাহলে মেয়েকে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর যদি প্রেমিকযুগল কোনো ভাবে পাত্রের বাড়িতে পৌছে যায়, তাহলে পাত্রী সেই বাড়ির বউ হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।

তবে অনিয়মিত বিয়ে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতাভুক্ত হলে তা কখনোই সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত বা বৈধ বলে গণ্য হয় না।

বিয়ে হোক বা না-হোক এ ধরনের পলায়নের পর প্রেমিক যুগলকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।

বিয়ে-বহির্ভূত ভাবে দৈহিক মিলনের অপরাধে সামাজিক আদালতের রায় অনুযায়ী সাজা হিসেবে যুবককে একটি শুকর, নগদ টাকা ও এক বোতল মদ এবং যুবতীকে একটি মোরগ, নগদ টাকা ও এক বোতল মদ দিতে হয়।

বর্তমানে শহুরে মারমা সমাজে পলান বিয়ের পরিবর্তে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা মূলে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী রূপে ঘোষণার প্রবণতা দেখা যায়, যা প্রচলিত ভাষায় কোর্ট ম্যারেজ নামে পরিচিত। তবে এই ধরনের কোর্ট ম্যারেজ বা বিয়ে মারমা সমাজে প্রথাসিদ্ধ ও অনুমোদিত নয়।

সম্বন্ধ করে অনুষ্ঠিত সামাজিক বিয়ের ক্ষেত্রেও পাত্র-পাত্রীর সম্মতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেলায় পিতা বা পুরুষ অভিভাবকের মতামত সাধারণত প্রাধান্য পেতে দেখা যায়।

বিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকাও, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, গণ্যমান্য ব্যক্তি তথা হেডম্যান কার্বারীসহ পুরুষের প্রতিনিধিত্ব থাকে বেশি।

বহুবিবাহ: মারমা সমাজের একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারেন, তবে একজন পুরুষ একই সাথে ঠিক কতজন স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন, এরূপ কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত প্রথাগত আইনে উল্লিখিত নেই।

একজন বিবাহিত মারমা পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় যে সমস্ত কারণে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন, ত হলো —

– স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে;

– স্ত্রী কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে;

– স্ত্রী স্বামী সহবাসে অক্ষম বা শারীরিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলে;

– স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে;

– স্ত্রী যদি দীর্ঘদিন কোনো অপরাধে কারাগারে বা স্বামীর অমতে দেশান্তরে বা পিত্রালয়ে থাকেন; এবং

– স্ত্রী যদি ব্যভিচার বা পরকীয়াতে লিপ্ত হয়ে সামাজিক বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন।

কিন্তু উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যতীতই একজন মারমা পুরুষ বহুবিবাহ করতে পারেন।

সেক্ষেত্রে বিবাহিত পুরুষের বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়।

তবে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে তার প্রথম সংসারের সকল অস্থাবর সম্পদসহ বসতভিটা প্রথম স্ত্রীকেই দিতে হয়।

এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানরা পিতার স্থাবর সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের উত্তরাধিকারী হয়।

অন্যদিকে, উল্লিখিত কারণে বা কোনো অবস্থায়ই একজন বিবাহিত নারী বিবাহবিচ্ছেদ ব্যতীত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারেন না।

স্ত্রী বড়োজোর বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন কতে পারেন বা বিচ্ছেদের অধিকার পান। কেবল বিধবা বা বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারেন।

মিশ্র বিয়ে: কোনো মারমা নারী যদি কোনো ভিন্ন জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষকে বিয়ে করেন, তাহলে সমাজ কখনো তাকে মেনে নেয় না।

অপরদিকে কোনো মারমা পুরুষ যদি কোনো ভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের নারীকে বিয়ে করেন, তাহলে সমান সেই নারীকে সহজেই গ্রহণ করে।

যদিও এ ধরনের মিশ্র বিয়ে মারমাদের মধ্যে সংখ্যায় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

বিধবা বিবাহ: মারমা সমাজে বিধবা বিবাহের অনুমোদন আছে।

স্বামীর মৃত্যুর পর একজন বিধবা পুনরায় বিয়ে করলে মৃত/পূর্বের স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকার হারান।

বিধবার পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ে কার্যক্রমটি অবশ্যই নিজ পিতা বা ভাইয়ের বাড়ি থেকে সম্পন্ন করতে হয়।

বিবাহ-বিচ্ছেদ : মারমা সমাজে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ কারণ/ক্ষেত্র রয়েছে।

তবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদের ফলে প্রায়শই নারী ন্যায়বিচার ও ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন।

যে সকল ক্ষেত্রে একজন মারমা স্বামী বা স্ত্রী সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারেন, তা নিম্নরূপ –

– স্বামী যদি স্ত্রী সহবাসে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হন কিংবা স্ত্রী যদি গর্ভধারণে অক্ষম হন, তাহলে স্বামী বা স্ত্রী যেকোনো একজন বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারেন;

– স্বামী বা স্ত্রী কেউ একজন দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকলে, গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে থাকলে, মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে, সংক্রামক ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে যেকোনো একপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ছাড়াছাড়ি বা সুরকাগজ প্রদান করতে পারেন;

– স্বামী যদি গৃহীজীবন ত্যাগ করে ধর্মীয় পুরোহিত বা বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যান এবং স্ত্রী যদি ‘সাধুমা’ (বৌদ্ধ ধর্মীয় সেবিকা) হন, তাহলে যেকোনো পক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পাদন করতে পারেন;

– স্বামী যদি স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তবে প্রথম স্ত্রী সতিনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মতি জানিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারেন;

– স্বামী যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হন, স্ত্রীকে অযথা উৎপীড়ন করেন, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করেন, অহেতুক সন্দেহ করেন, তাহলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন;

– স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ না-দিলে, স্ত্রীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন;

– স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে বা বনিবনা না-হলে উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।

উল্লিখিত কারণসমূহের ফলে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার জন্মালেও মারমা সমাজের বাস্তব চিত্র ভিন্ন; যেমন, স্ত্রী গর্ভধারণ বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে স্বামী সাধারণত দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন বা স্ত্রীকে তালাক দেন।

কিন্তু স্বামী যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন, তাহলে স্ত্রী সাধারণত স্বামীকে তালাক দেন না বরং অনেক ক্ষেত্রে দত্তক গ্রহণ করেন।

অথচ কেবল গর্ভধারণে অক্ষমতা নয়, এমনকি পুত্রসন্তান জন্ম দিতে না-পারার অপরাধেও কোনো কোনো মারমা পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

স্বামীর একাধিক বিয়ে, অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা, স্ত্রীর প্রতি শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরনারীতে আসক্তি, ভরণপোষণ না-দেয়, ইত্যাদি কারণে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর বিচ্ছেদ চাওয়ার বিধান থাকলেও সমাজের নিরাপত্তাহীনত, আর্থিক দৈন্য, সহায় সম্বল না-থাকার কারণে অনেক নারী স্বামীকে ছেড়ে যেতে চান না, অনেক ক্ষেত্রে সতিনের সাথে সা করতে বাধ্য হন।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেবল শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারীদের স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের দাবিতে সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা যায়।

পুরষধিপত্যপূর্ণ মারমা সমাজে একজন পুরুষের পক্ষে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়া যততা সহজ, একজন মারমা নারীর পক্ষে স্বামীকে তালাক দেয়া ততটা সহজ নয়।

উল্লিখিত বিশেষ কারণগুলো ছাড়াও কোনো কারণে কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে কেবল স্বামীর নির্দেশ মেনে না-চলা বা স্বামীর অবাধ্য হবার অজুহাতেও স্ত্রীকে তালা দিতে পারেন।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী ও সন্তানকে ভরণপোষণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ও দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়, যাতে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে বাধ্য হন। কোনো পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে কয়েকজন লোকের (সাক্ষীর) স্বাক্ষরযুক্ত তালাকনামা স্ত্রীর বরাবরে সম্পাদন করে দিলেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়, যদি স্ত্রী তা মেনে নেন।

অন্যদিকে, একজন স্ত্রী যেকোনো কারণে তার স্বামীকে তালাক দিতে চাইলে অবশ্যই সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় এবং স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়ার কারণ প্রমাণ করতে হয়।

উত্তরাধিকার: পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী মারমা জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার প্রথার ক্ষেত্রে সার্কেল ভেদে নিয়ম নীতির কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়।

বোমাং সার্কেলে বসবাসরত মারমাদের বেলায় একরকম এবং মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমাদের বেলায় অন্যরকম রীতি ও প্রথার ভিত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়ে থাকে।

বোমাং সার্কেলের মারমা উত্তরাধিকার আইন মায়ানমারে প্রচলিত ‘সামুহাদা বিচ্ছেদানি’ রীতির অনুসারী।

– বোমাং সার্কেলের অন্তর্গত মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র, স্ত্রী, কন্যা সকলেই মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও কন্যারা মৃতের স্থাবর সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশের উত্তরাধিকারী হয়। পুত্ররা মৃতের সম্পত্তির তিন চতুর্থাংশের উত্তরাধিকারী হয়।

– বোমাং সার্কেলের মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির যদি দ্বিতীয় স্ত্রী থাকে, তাহলে প্রচলিত সামাজিক প্রথা অনুযায়ী মৃতের সম্পত্তিতে প্রথম স্ত্রীর সন্তানরা মূল স্থাবর সম্পত্তির চার সপ্তমাংশ ও দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানরা তিন সপ্তমাংশ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে;

– মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে পুত্রসন্তানরাই পিতার সম্পত্তির একমাত্র আইনগত উত্তরাধিকারী।

পুত্রসন্তান থাকলে কন্যাসন্তান ও স্ত্রী, মৃত পিতা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন না।

তবে পিতা বা স্বামীর জীবদ্দশায় কন্যা। বা স্ত্রীকে দান বা উইল মূলে সম্পত্তি দিয়ে গেলে কন্যা বা স্ত্রী পিতা বা স্বামীর সৎ লাভ করতে পারেন;

– বোমাং, মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির সদি পুত্রসন্তান থাকে, তাহলে স্ত্রী ও কন্যারা মৃতের স্থাবর সম্পত্তিতে সামান্য হারে আইনগত উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করে।

– স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী তার মৃত স্ত্রীর যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।

– উত্তরাধিকারযোগ্য পদ ও পদবির ক্ষেত্রে মারমা সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিজ ঔরসজাত পুত্র, কন্যা বা স্ত্রী লাভ করেন।

বোমাং সার্কেলের ক্ষেত্রে বোমাং রাজপরিবারের পিতৃমাতৃকুলের সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বোমাং সার্কেল চীফ হতে পারেন;

– মং সার্কেলের ক্ষেত্রে মং চীফের ঔরসজাত পুত্র মং সার্কেল চীফ পদের আইনগত উত্তরাধিকার হন, দত্তক পুত্র-কন্যাদের বেলায় তা প্রযোজ্য হয় না।

ঔরসজাত পুত্রকন্যার অবর্তমানে পৈতৃক সূত্রের রক্তসম্পৰ্কীয় কোনো যোগ্য ব্যক্তি চীফ হন না। হেডম্যান, কার্বারি, রোয়াজা নিয়োগের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র যোগ্য হলে তাকে অগ্রাধিকার দেবার রীতি প্রচলিত আছে;

– মৃত পিতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠপুত্র ও মৃত মাতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠকন্যা লাভ করেন;

– মারমা উত্তরাধিকার নীতি অনুযায়ী মাতার স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র ও কন্যাসন্তানরা হারাহারিভাবে ভাগ পায় ।

আদিবাসী মারমা জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকারপ্রথা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসী নারীদের তুলনায় মারমা নারীরা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছেন।

বোমাং সার্কেলে বসবাসরত মারমা নারীরা পুরুষের পাশাপাশি পৈতৃক ও স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন, যদিও তা পুরুষের সমান অংশে নয়।

প্রথানুযায়ী মারমা পুরুষ নারীর চেয়ে তিনগুণ বেশি পান। কোনো মারমা পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে সেখানে প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানরা বেশি অংশ পান।

আবার মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা নারীরা চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা নারীদের মতোই অধিকারবঞ্চিত। তারাও পুরুষের উপস্থিতিমাত্রই (পুত্র/ভাইয়ের বর্তমানে) পৈতৃক ও স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত।

কেবল পুত্র না-থাকলেই কন্যা বা স্ত্রীরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।

তবে মারমা নারীরা/কন্যারা মায়ের সম্পত্তি পুত্রদের/ভাইদের সাথে সমান অংশে লাভ করেন।


তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (সুস্মিতা চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা