মারমা লোককাহিনী: লজ্জাবতী গাছের গল্প

Jumjournal
Last updated May 16th, 2020

1602

featured image

পুরাতন কালে এক রাজ্যে রাজার এক সুন্দর পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

সন্তানের বয়োবৃদ্ধি হতে লাগলে একদিন রানী রাজাকে বললেন, “মহারাজ, আমাদের সন্তান তো বড় হয়ে যাচ্ছে।

একদিন তাকে এ রাজ্য শাসন করতে হবে। আমরা ক’দিনইবা বেঁচে থাকবো। আমরা মরে যাবার পর তাকে কে দেখবে?

তাকে তো তখন আপন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা একাকী রাজ্য শাসন করতে হবে ; নিজ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

আত্মীয়স্বজনেরও কেউ নিজের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করবে না। তার জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করা কি আমাদের কর্তব্য নয়?”

রাজা জবাবে বললেন, “রানী, প্রিয়তমা! আমিও তো তা-ই ভাবি।

কিন্তু পুত্র আমাদের একটি মাত্র। পরের কাছে বড় হয়ে গেলেও আমাদের কাছে সে আজও কচি।

বছরের পর বছর আমাদের ভালবাসা, আদর-যত্ন থেকে সে বঞ্চিত হবে। এভাবে সে কেমন করে বাঁচবে–এ মায়াজাল কেমন করে ছিন্ন করি ?”

“মহারাজ, পৃথিবীতে নিজের সন্তানকে একটি হোক দুটি হোক আর অনেক হোক ভালবাসা থেকে ভাগ করতে পারে এমন মা-বাবা কখনো হয় না।

কিন্তু নিজের সন্তানের জীবন ধ্বংস করে যাওয়া কি রকম ভালবাসা মহারাজ?

সন্তানকে ভালবাসে বলেই তো মা-বাবা। তাই আর বিলম্ব নয় মহারাজ, আমাদের সন্তানকে ঋষির নিকট দিয়ে আসুন।”

 একদিন রাজা ভূত্যদের ডেকে পুত্রের জন্য তিন বছরকালের খাদ্য ও বস্ত্র সামগ্রী এবং তিনশ সৈন্য ও তাদের পাথেয় সামগ্রী প্রস্তুত করতে আদেশ দিলেন।

পরদিন সকালে রাজকীয় পোশাকে পুত্র মাতার নিকট বিদায় নিতে আসল। রানী আশীর্বাদ করলেন।

রাজা পুত্রকে নিয়ে শুভ্ৰহস্তীতে চড়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ঋষির নিকট রওনা হলেন। সেদিন রাতে তাঁরা বিহারে পৌঁছালেন।

সবাই রাত্রের ভোজন সেরে বিহারের একটি কুটিরে রাত কাটালেন।

পরদিন সকালে রাজা ঋষির নিকট গিয়ে প্রার্থনা করলেন, “ভান্তে! এ ছেলে আমার পুত্র। একে আপনার নিকট অর্পণ করছি।

একে আপনি সাহিত্য, শিল্প বিদ্যা, শাসন বিদ্যা, ধন বিদ্যা, যুদ্ধ বিদ্যা প্রভৃতিতে পারদর্শী করবেন। আপনি এ পুত্র-কে গ্রহণ করুন।”

ঋষি বললেন, “সুপুত্র মহারাজ, আমি আপনার পুত্রকে গ্রহণ করলাম। আপনি নিশ্চিন্তে আপনার রাজ্যে ফিরে যেতে পারেন।”

রাজা রাজ্যে ফিরে আসলেন। রানীকে সেই সব কথা জানালেন এবং ধন্য হলেন।

ঋষি রাজপুত্রকে বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী করলেন। এক সময় রাজপুত্রকে ফেরত পাঠানোর জন্য সময় এলো।

একদিন ঋষি রাজপুত্রকে ডেকে বললেন, “পুত্র, তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাবার সময় এসেছে। তুমি রাজ্যে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে পার।”

রাজপুত্র এক রাতে বাড়ি ফিরে যাবার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করল। পরদিন ভোরে ঋষির নিকট গিয়ে একটি মূল্যবান হীরা গুরুদক্ষিণা হিসাবে দান করে বিদায়ের প্রার্থনা করল ।

ঋষি রাজপুত্রকে নিকটে এনে একটি তলোয়ার, পাঁচশটি তীরসহ একটি ধনুক দিলেন। এক মেয়েকে ডেকে রাজপুত্রকে বললেন, “পুত্র, এ কন্যাকে আমি এক গ্রাম হতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।

সে আমার সঙ্গে বিশ বছর যাবৎ আছে। সেও নানান বিদ্যায় পারদর্শী এবং গত তিন বছর যাবৎ তোমাকে ও সাহায্য করেছে।

তুমি ওকে নিয়ে যাও। সে বিভিন্ন কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।” তারপর দুজনেই বিদায় নিয়ে রাজ্যের দিকে রওনা হল।

যেতে যেতে রাজপুত্ররা এক গভীর বনে এসে পৌঁছাল। সে দিন আকাশ ছিল মেঘ শূন্য। প্রখর রোদ, সূর্য মধ্যাকাশে জ্বলজ্বল করছে।

পথে হাঁটতে হাঁটতে কন্যার দু’পায়ের পাতা ঘায়ে পূর্ণ হল। রাজপুত্র কন্যাকে পিঠে নিয়ে চলতে লাগল। এক সময় রাজপুত্র ক্লান্ত হয়ে এক গাছের ছায়ায় বসে পড়ল।

এমন সময় কন্যা চিৎকার দিয়ে বলল, “রাজপুত্র , প্রিয়তম! এক বন্য হস্তী আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আপনি তাকে তীরের আঘাতে হত্যা করুন, না হয় আমরা মারা পড়ব।” ‘

রাজপুত্র হস্তীকে তীর দিয়ে মেরে ফেলল। আবার, রাজপুত্র কন্যাটিকে পিঠে নিয়ে চলল।

ঐ বনে ছিল পাঁচশ ডাকাতের দল। রাজপুত্ররা ডাকাতদলের সামনে পড়ে গেল। রাজপুত্রের তীরের আঘাতে চারশ নিরানব্বই জন ডাকাত মরে গেল।

শেষে রইল ডাকাত দলের নেতা। রাজপুত্রের তীরও শেষ হয়ে গেল। ডাকাত নেতা রাজপুত্রকে জাপটে ধরল। দু’জনের মধ্যে কুস্তি হল।

ডাকাত ছিল শক্তিশালী আর তলোয়ারটি ছিল কন্যার হাতে। রাজপুত্র নীচে পড়ে গেল। রাজপুত্র কন্যাকে বলল, “কন্যা, প্রিয়তমা! আমাকে তলোয়ারটি দাও।”

ডাকাতটি ছিল সুন্দর। কন্যা ডাকাতের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখল। কন্যা ভুলের পরিসীমা হারিয়ে ফেলল।

অতএব, রাজপুত্রকে তলোয়ারের ধারাল দিক্ ধরতে দিল। এ সুযোগ নিয়ে ডাকাত রাজপুত্রকে হত্যা করল।

তারপর কন্যা ডাকাতকে বলল, “ডাকাত সুপুরুষ, আপনাকে আমি সাহায্য করেছি, আমাকে নিয়ে চলুন। আমি আপনার স্ত্রী হব।”

রাজপুত্রের ছিন্নভিন্ন দেহ পথে পড়ে থাকল। ডাকাত কন্যাকে নিয়ে চলল। কন্যা ডাকাতের পিছে পিছে চলল।

ডাকাত মনে মনে ভাবল, “এ মহিলার স্বামী রাজপুত্র, আমি তো একজন ডাকাত। মহিলাটি কেমন করে আমাকে ভালবাসতে পারে, অসম্ভব।

বিশ্বাসঘাতকরা শত্রুর চেয়ে ভয়ঙ্কর। এদের কাছে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়া ভাল, ভাসবাসা যায় না।”

যেতে যেতে তারা বন্যা নদে এসে পৌছাল। বন্যা নদ এ কারণে যে এ নদের পানি সবসময় ঘোলাটে আর বন্যার মত থৈ থৈ স্রোত থাকত।

ডাকাত কন্যাকে ধোকা দেয়ার জন্য বলল, “কন্যা, নদে বিশাল পানি। তোমার গয়না-গাটি, কাপড়-চোপড়গুলো খুলে দাও, আমি ওপারে রেখে আসব ।”

কন্যা ডাকাতকে সব খুলে দিল। ডাকাত সবগুলো নিয়ে নদীতে নেমে বসে বসে সাঁতার কেটে ঐ পাড়ে উঠে পালিয়ে গেল।

কন্যা মৃত রাজপুত্রকে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে কাঁদতে থাকল।

ইন্দ্ররাজ রাজপুত্রদের দুঃখ লক্ষ্য করে পৃথিবীতে তিন দেবপুত্রকে নিয়ে নেমে আসল ।

ইন্দ্ররাজ মাছের রূপ ধারণ করল, আর এক দেবপুত্রকে মাংসখন্ড, একজনকে চিল ও অপরজনকে শিয়ালের রূপ ধারণ করাল।

শেয়াল এক খন্ড মাংস নিয়ে ঝোপ থেকে বের হয়ে এসে কন্যার অদূরে খাওয়ার ভান করল।

আকাশে চিল উড়ে ঘুরপাক খেতে থাকল। এমন সময় একটি বড় মাছ নদীর পাড়ে উঠল। শেয়ালটি মাছ খাওয়ার লোভে মাছের দিকে দৌড়ে যেতেই চিলটি মাংস খন্ডটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, আর মাছটিও নদীতে নেমে গেল।

শেয়াল আবার ফিরে এসে দেখল মাংস খন্ডটিও নেই। শেষে শেয়ালটি মাংস খন্ডের জায়গায় শুকতে শুকতে হাঁপিয়ে বসে পড়ল।

– এ দৃশ্য দেখে কন্যা শেয়ালকে বলল, “ওরে বোকা শেয়াল, তোমার মাংস খন্ডটি কত ভাল ছিল। মাছের লোভে সব হারালে। এখন বুঝলে তো মজাটা!”

শেয়াল কন্যাকে বলল, “ওরে কন্যা, আমি মাংস খন্ডটি হারালেও আরও অনেক মাংস খুঁজে নিতে পারব। কিন্তু তোমার ঐ রাজপুত্রটিকে তো আর খুঁজে পাবে না। সে তোমাকে ভালবাসত, তোমার বেদনা বুঝত।”

কন্যা লজ্জায় ও দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে মরে গেল। ইন্দ্ররাজ রাজপুত্রকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে তুলল।

রাজপুত্র উঠে দেখতে পেল কন্যার মৃতদেহ আর অপরিচিত চারজন লোক।

রাজপুত্র ইন্দ্ররাজের কাছ থেকে সব ঘটনা জেনে নিল। সেখানেই কন্যাকে কবর দিয়ে রাজ্যে ফিরে গেল।

আবার যখন এক বছর পর রাজপুত্র শিকারে বের হল, কন্যার কবরস্থানে গেল।

দেখতে পেল, এক প্রকার লতা জাতীয় গাছে কবরটি ভরে গেছে, সেগুলো কোন কিছুর স্পর্শে নুয়ে। পড়ে। তখন থেকে লজ্জাবতী গাছের বিস্তার ঘটল।

লেখক: টহ-ওয়ে

চিত্রটি এঁকেছেনঃ তন্ময় চাকমা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা