প্রথাগত আইনে আদিবাসী ম্রো নারীর অবস্থান

Jumjournal
Last updated Aug 20th, 2020

1869

featured image

উচু পাহাড়ে বসবাসে অভ্যস্ত আদিবাসীদের মধ্যে ম্রো জাতি অন্যতম। ম্রোদের জীবন জীবিকার সাথে পাহাড় বন তথা প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস জুমচাষ ও শিকার। ম্রোদের মুরং, ম্রু বা মুরুং নামেও অভিহিত করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জাতিসমূহের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে ম্রোরা হলো পঞ্চম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক সত্তর হাজার। ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত বোমাং সার্কেলের অন্তর্গত। ম্রোরা বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, কমা, লামা, থানচি, আলী কদম এবং রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ভাজাতলী মৌজায় বাস করে।

ম্রো জনগোষ্ঠী আদি থেকে প্রকৃতি পূজারী ও সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী। পরবর্তী সময়ে ম্রোরা বৌদ্ধ, ক্রামা ও খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হলেও তাদের প্রাচীন প্রথা ও রীতিনীতি চর্চার ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি।

গ্রামীণ ম্রো সমাজে এখনো দেব-দেবীর পূজা, মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ, ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রকৃতি পূজা ও পশুবলি প্রথা বিদ্যমান। পাড়া বা গ্রামের সুখ শান্তি ও মঙ্গল কামনায়, দুরারোগ্য ও সংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য এবং জুমে ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য ম্রোরা পশুবলি দিয়ে প্রকৃতি পূজা করে।

ম্রোদের সংস্কৃতির একটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে এসব পূজাপার্বণ ও পশুবলি প্রভাব। ক্রামা ধর্মাবলম্বী ম্রোদের গো-হত্যা উৎসব এবং উৎসবকে ঘিরে গো-হত্যা নৃত্য একটি অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান।

এসব অনুষ্ঠানে ম্রো পুরুষরা একাধিক নলিবিশিষ্ট পুং’ নামের এক ধরনের সুবেলা আওয়াজের বাঁশি বাজিয়ে নারী-পুরুষ মিলে নৃত্য করে। ম্রো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে।

বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত ম্রো জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারক ও প্রতিবিধানকারী হলেন বোমাং সার্কেল চিফ। চিফের অধীনে মৌজাভিত্তিক হেডম্যান এবং পাড়াভিত্তিক কার্বারি প্রাথমিক স্তরে সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে বিচার সালিশ করে থাকেন।

এই তিন স্তর বিশিষ্ট বিচারকাঠামো ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার বহু আগে থেকেই নিজেদের ঐতিহ্য, গোত্রগত বন্ধন ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পাড়াপ্রধান বা সামাজপতিরা যাবতীয় পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে আসছেন।

এসব প্রথা, রীতিনীতি দীর্ঘকাল যাবৎ ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি আনুগত্য থেকে উত আচার-অনুষ্ঠান, পূজাপার্বণ, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।

ম্রো জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থা পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো পিতৃতান্ত্রিক। গ্রাম/পাড়াপ্রধান বা সমাজপতি থেকে পরিবারের কর্তা পর্যন্ত সর্বত্র পুরুষের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। যেকোনো সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব, পূজাপার্বণ এবং সমাজের যেকোনো গুরুত্বপর্ণ সিদ্ধান্ত ম্রো পুরুষরাই নিয়ে থাকেন।

ম্রো জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ উভয়ে লম্বা চুল রাখে। লম্বা চুল তারা মাথার ওপরে ধোপ, করে রাখে। ফুল তাদের অত্যন্ত প্রিয়। তরুণ তরুণীরা মাথার খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখে। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী ম্রো পরিবারে প্রত্যেক শিশুকে কান ছিদ্র করতে হয়।

সাধারণত ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে যেকোনো শিশুর তিন বছর বয়স হলে ম্রো ভাষায় রুইপারাম’ বা কানে দ্রি করতে হয়। এ উপলক্ষে ১টি শূকর ১টি মোরগ ও ১ বোতল মদসহ পাড়াপ্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এ অনুষ্ঠানে একজন ওঝা বা বৈদ্য। নিমন্ত্রিতদের সামনে শিশুর কান ছিদ্র করেন।

পারিবারিক কাজ ছাড়াও ম্রো নারীদের পুরুষদের পাশাপাশি খেতে-খামারে প্রতিনিয়ত অনেক কঠিন কাজ করতে হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজকর্মে তাদের ডুবে থাকতে হয়।

মোরগের ডাকে তারা ঘুম থেকে উঠে রান্নার কাজে জড়িয়ে পড়েন। ম্রো সমাজে সাধারণত নারীদের ভূমিকা বেশি। তাদের স্বাধীনতাকে তেমন খর্বাকারে দেখা হয় না।

ম্রো সমাজে সাধারণত নারীরা পিতৃসম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন না। কারণ বিয়ে হলে নারীরা পরের ঘরে পরের গোষ্ঠীর লোক বলে বিবেচিত হন। ফলে তারা পিতার সম্পত্তি পান না।

কোনো ব্যক্তির যদি পুত্রসন্তান না থাকে অথবা যদি তিনি পুত্রসন্তানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তারপরও মেয়েরা পিতার সম্পত্তি লাভ করেন না। সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির পিতা সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন।

আর যদি পিতা না থাকেন তাহলে মৃত ব্যক্তির যেকোনো ভাই উত্তরাধিকার লাভ করেন। তবে স্বেচ্ছায় বা উইলের মাধ্যমে পিতা কন্যাসন্তানকে সম্পত্তি দিতে পারেন।

ম্রো সমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর পুনরায় বিয়ে করলে সেই নারী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। যদি কারো পুনঃবিবাহ করার অভিপ্রায় থাকে, তাহলে তাকে স্বামীর ঘর ও পরিবার থেকে সমস্ত সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করে প্রথমে বাপের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়।

তারপর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিবাহ করা যায়। এক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে যতজনই থাকুক, তিনি কোনোটার ওপরই অভিভাবকত্ব লাভ করতে পারেন না এবং স্বামীর সম্পত্তির কোনো অংশই দাবি করতে পারেন না।

আর যদি স্বামীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না-করে সন্তান-সন্ততি লালনপালনের দায়ভার নিয়ে সারাজীবন ওই বাড়িতেই থাকতে চান, তাহলে তিনি স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও ছেলেমেয়েদের অভিভাবকত্ব লাভ করেন।

সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। অনেক অনুষ্ঠান নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া উদযাপন সম্ভব হয় না; বিশেষ করে গো-হত্যা অনুষ্ঠান ও বিয়ের অনুষ্ঠান।

গো-হত্যা অনুষ্ঠান আয়োজনের সময় অনুষ্ঠান আয়োজকের স্ত্রীকে ’কিমরেং ইয়ামা’ বা গৃহদেবী রূপে দেখা হয়। গো-হত্যা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রাক্কালে অরণ্য থেকে কলাপাতা সংগ্রহ করে আনার সামাজিকভাবে স্বীকৃত দায়িত্ব যুবতীদের। গো-হত্যা অনুষ্ঠানের নৃত্যগীতেও নারীর অংশগ্রহণ লাগে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে কন্যার সাথে গ্রামের যুবতীরা যেতে বাধ্য থাকে। কন্যার একা শ্বশুরবাড়ি বা বরের বাড়িতে যাওয়া অবিধেয়। অনুষ্ঠান শেষে পুনরায় কন্যার সাথীদের সম্মান রূপ ফেরত পাঠাতে হয় এবং তাদের সম্মানী স্বরূপ গ্রত্যেককে ১টি রুপার মুদ্রা দেয় বিধিসম্মত।

বিয়ে

ম্রো জনগোষ্ঠীর কাছে বিয়ে এক জোড়া নরনারীর পবিত্র বন্ধন, যার মাধ্যমে বিবাহিত দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও সন্তান জন্মদানে বৈধতা লাভ করে। ম্রো সমাজে বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যা সংযম ও মাংতাং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ করা বাধ্যতামূলক।

বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর বয়সের কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। সাধারণত ছেলেদের শারীরিক গঠন দেখে আর মেয়েদের ঋতুস্রাব হলে বিয়ের বয়স হয়েছে বলে ধরা হয়।

বিয়ের ক্ষেত্রে ম্রো সমাজে কন্যার মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া হয় না। বিয়ে অবশ্যই বৈধ ও সম-সম্পর্ক এবং জাতীয়দের মধ্যে হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ সম্পর্কের যুবকের সাথে প্রেম করে পিতামাতার অজান্তে পালিয়ে বরের ঘরে বিয়ে হয়। তাতেও বাবা-মায়ের তেমন অসম্মতি থাকে না।

বিয়ের কথাবার্তায় মায়ের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। কনের মা বিয়েতে অমত হলে বিয়ে হয় না। ম্রো সমাজে রক্তসম্পর্ক ও গোত্রগত সম্পর্কের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষেত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ সেগুলো হলো :

  • একই গোত্রের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে;
  • আপন কাকাত, জেঠাত ভাইবোন ও নিজ গোত্রীয় ভাইবোনের মধ্যে;
  • মাসি, পিসি, কাকি, মামি, জেঠিমা সম্পর্কীয় নারীদের সঙ্গে;
  • ভ্রাতুপুত্র বা ভাগিনার বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে;
  • ছোট ভাইয়ের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে;
  • একই পিতার ঔরসে ভিন্ন মাতার সন্তানদের মধ্যে;
  • প্রথানুযায়ী ম্রোদের বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু গোত্রগত বিধি নিষেধ আছে। যেমন স্ত্রীর গোত্রের ছেলেরা স্বামীর গোত্রের মেয়েদের বিয়ে করতে পারে না। আবার ঙারুয়া গোত্রের বাটপো উপগোত্রে ছেলেরা বউ, কানরক, নাইচাহু গোত্রের মেয়েকে বিয়ে করে। কিন্তু খাটো উপগোত্রের মেয়েরা এসব ছেলেদের বিয়ে করতে পারে না।

ম্রো সমাজে বিয়ের পদ্ধতি দু‘ধরনের: যথা ধার্য বা সামাজিক বিয়ে এবং পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে।

ধার্য সামাজিক বিয়ে: অভিভাবকের সহমতে ম্রো সমাজে ধার্য বিয়ে বা সামাজিক বিয়ে হয়। এটি আবার দু’ধরনের হয়; যথা নিম ও পাকলা পুরকং নিমা। পালা পুরকং নিমাই হলো দিনের বেলায় বউ ঘরে তোলা। এ বিয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

নিমাং বিয়ের ক্ষেত্রে বরপক্ষ পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে বউ আনতে কনের বাড়ি যায় মোরগমুরগি উপঢৌকনসহ। কনেপক্ষ বরের বাড়িতে মদ, শূকর উপঢৌকন আনে। রীতি অনুসারে কনেগণ বাবদ ১০০টি রৌপ্য মুদ্রা অথবা এর পরিবর্তে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত নেপণ দিন হয়।

১০টি রৌপ্য মুদ্রা বা ২৫০০ টাকা কনের মায়ের ভান্য দুধের দাম হিসেবে দিতে হয়, ৫টি রৌপ্য মুদ্রা বা ১২৫০ টাকা কনের মামার আশীর্বাদ লাভের জন্য বরপক্ষকে দিতে হয়। এছাড়া বরপক্ষ থেকে উপঢৌকন বাবদ কনের বাবাকে ৩০টি বম, ১টি তীর, ১টি দা ও ১টি তলোয়ার দিতে হয়।

বরপক্ষের যতজন লোক বরযাত্রী হিসেবে আসে, তাদের প্রতে পরিবারকে ১টি বম ও ১টি মোরগ উপহার দিতে হয় ।

পাকলা পুরকং’ বিয়ের বউ আনতে যাবার রীতি অনেকটা নিমা বিয়ের মতো। তবে বউকে বরের বাড়ি নিয়ে যাবার সময় দুটি শূকর বধ করে নিয়ে যাওয়ার রীতি আছে।

উভয় বিয়ের ক্ষেত্রেই বংকম’ বা ‘মাংতাং’ অনুষ্ঠান পালন ও অতিথিকে মদ পরিবেশন করা বাধ্যতামূলক। একজন অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই বংকম বা মাংতাং অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় কনেকে তার আসীর গোত্রভুক্ত রাখা হয় এবং তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। তবে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ক্রামা ধর্মানুযায়ী আধুনিক ম্রো সমাজে বংকম ও মাংতং অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে: মো সমাজে প্রচলিত সামাজিক বিয়ের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক যুবতী ঘর ছেড়ে পালিয়ে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণ করলে তাকে ম্রো ভাষায় ওয়ার্মা/এয়াকমং বলে।

প্রণয়াসক্ত পলাতক যুবক পাড়ার যুবনেতাকে ১ বোতল মদ উপঢৌকন দিয়ে তার সম্মতি নেয়। যদি পলাতক যুবক নিষিদ্ধ সম্পর্কভুক্ত আত্মীয় (বিয়ের ক্ষেত্রে) না-হয়, তাহলে পরে স্বাভাবিকভাবে বংকম ও মাংতাং সম্পন্ন করা হয়।

কনেপণ: ম্রো সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন সকালে কনেপণ দেবার আসর বসে। বরপক্ষের দেয়া পণ সাধারণত কনের পিতা গ্রহণ করে থাকেন। যদি পিতা মারা যান, তাহলে কনের বড়ো ভাইয়ের ওপর পণ গ্রহণের দায়িত্ব অর্পিত হয়।

পৈদং (এক ধরনের খাবার টেবিল) এর ওপর ভাত ও মুরগির মাংস পরিবেশন করে বরের পিতা কনের পিতাকে পণ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। খাওয়া শেষ হলে বরের পিতা ১০০টি রুপার মুদ্রা, রুপার ৩টি মুদ্রার সমমূলোর ৩টি বম, কপার ২টি মুদ্রার সমমূল্যের ৩টি বম, ২টি দা, ১টি তিম (নিড়ানী), ১টি তীর, ১টি তলোয়ার কনের পিতাকে পণ হিসেবে প্রদান করেন।

অনুরূপভাবে সম্মান জানিয়ে ৪০ হাত দীর্ঘ একটি সাদা কাপড় (পাগড়ি হিসেবে ব্যবহারের জন্য) কনেপক্ষ থেকে বরের পিতাকে দেয়া হয়। এছাড়াও কনেপক্ষ থেকে আসা প্রত্যেক অতিথিকে সম্মানস্বরূপ একটি করে বল্লম দিতে হয়।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে বর গেলে বাম গ্রহণকারী অতিথিরা নতুন বরকে সম্মানস্বরূপ এক সের হারের শুটকি ও পাঁচ হাত দীর্ঘ এক টুকরা সাদা পাগড়ির কাপড় দেয়।

দাম্পত্য শপথ: বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন বর ও কনে একটি মুরগির বাচ্চাকে দুজনে মিলে গলা টিপে বধ করে। এ সময় দুজনে শপথ করে যে, ‘আজ থেকে আমরা একে অপরের সাথে একাত্ম হলাম। আমাদের আত্মা একাত্মায় পরিণত হোক। যদি কখনো একে অপরকে ছেড়ে যায়, তাহলে এ মুরগির বাচ্চার মৃত্যু যেভাবে হয়েছে, সেভাবে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করি।

উত্তরাধিকার

ম্রো সমাজে ‘বংকম’ ও ‘মাংতাং’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হয়। একজন ম্রো নারী বিয়ের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা উপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারেন।

বিয়ের পূর্বে অর্জিত কোনো সম্পত্তির ওপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হন অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ লাভের অধিকারী হন।

বিয়ের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপোষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারি-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখেন।

স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখেন। পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংশক হন অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হন, সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারি-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারী হন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর ৪৮ বিধিমতে সার্কেল চিফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে যে,

  • ম্রো সমাজের হেডম্যান/কার্বারি এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চিফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়;
  • ম্রো সমাজের সমাজপতি পদটিতে বংশানুক্রমিক হিসেবে জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্রাধিকার পান, যদিও উক্ত সমাজপতি পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি মতে স্বীকৃত নয়।

ম্রো সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস:

  • ম্রো পরিবারে মৃতের পুত্রসন্তানরা অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী। তার বা তাদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী ও কন্যা উত্তরাধিকারী হয়। স্ত্রী বলতে প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী, সন্তান বলতে ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকে বোঝায়। পুত্র বা কন্যার মৃত্যুজনিত কারণে পুত্রবধূ, মৃত কন্যার স্বামী এবং মৃতের পুত্র-কন্যার সন্তানরা আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়;
  • ম্রো পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্রসন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে কন্যাসন্তান মায়ের সাথে মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয় এবং কন্যাসন্তানরা মৃতের সম্পত্তিতে মায়ের সমান হারে সম্পত্তির ভাগ পায় । মৃতের কন্যাসন্তান বলতে ঔরসজাত কন্যা, দত্তক কন্যা সকলেই কন্যাসন্তানরূপে গণ্য হয়;
  • স্বামী-স্ত্রী : বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো একজনের মৃত্যুতে অপরজন উত্তরাধিকারী হন;
  • পিতা-মাতা : মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তানরূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছেন, সেই পিতা-মাতা মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হন;
  • রক্তসম্পর্কীয় : যে সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি, পিতা-মাতা কেউ যদি জীবিত না-থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভাতা, তার পুত্র-কন্যা তাদের অবর্তমানে বোন, বোনের পুত্র-কন্যারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;
  • মৃতের যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্য, পিতা, ভাই, বোন এবং ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নী এ সকল রক্তসম্পর্কীয় নাতি-নাতনি কেউ যদি জীবিত না-থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাজেঠা, তাদের অবর্তমানে কাকা/জেঠার পুত্র-কন্যা সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;
  • মৃত স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রী আইনগত উত্তরাধিকারী হন। তবে বিধবা স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকার হারিয়ে ফেলেন;
  • কন্যাসন্তানরা মৃত পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না, যদি না পিতা জীবদ্দশায় কন্যাসন্তানকে তার নিজ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দান বা উইল করে দেন। তবে পুত্রসন্তান না-থাকলে কন্যাসন্তানরা মৃত পিতার অর্ধেক স্থাবরঅস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়;
  • পুত্রসন্তানরা মৃত পিতা-মাতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে সমান হারে নিরঙ্কুশ মালিকানা পায় ও আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। তবে পিতা-মাতাকে আমৃত্যু লালনপালনকারী পুত্রসন্তানই সম্পত্তির বেশি অংশ পায়। মৃতের দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানেরা অনুরূপ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়;
  • মৃত ব্যক্তির পরিবারের কোনো সদস্য যদি জাতিচ্যুত হয়, তাহলে সে উত্তরাধিকার হারায়।

তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা