শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু

MUKUL KANTI TRIPURA
Last updated Aug 15th, 2020

1116

featured image

বাংলাদেশের পার্বত্য  চট্টগ্রাম ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একজন সর্বজন পরম পূজনীয় আধ্যাত্মিক মহাসাধক পুরুষ হিসেবে যিনি ত্রিপুরাসহ অন্যান্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখিয়ে মহামানব রূপে আবির্র্ভূত হয়েছিলেন তিনি হলেন শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা ওরফে বলংরায় সাধু।

সারি সারি পাহাড়, গহীণ অরণ্য, গতিময় ঝর্ণাধারা, জীববৈচিত্র্যের এই নৈস্বর্গিক রূপময়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের মহান পুরুষ শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা শুধুই আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ  ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক সাধক, বাংলাদেশের ককবরক সাহিত্যের পথিকৃৎ, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী বিদ্রোহী নেতা, লোক সঙ্গীত শিল্পী ও গীতিকার এবং দার্শনিক।

তিনি যেমনটি ককবরক ভাষায় লিখে গেছেন সাহিত্য তেমনি বাংলায়ও লিখে গেছেন গীতিকাব্য। তিনি বাংলা ও ককবরক ভাষায় আধ্যাত্ম জাগরণীমূলক ও ভক্তিমূলক যোগসঙ্গীত রচনা, সুর, গ্রন্থণা ও কন্ঠ দিয়ে সুমধুর সুরে গাইতেন এবং প্রচার করতেন ধর্মীয় বাণী।

তিনি নিজ মহিমায় সন্ন্যাসব্রতী হয়ে মহাসাধকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন পাহাড়, ঝর্ণা ও গহীণ অরণ্যের জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রামে।

তবে তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেননি। তিনি প্রচার করেছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা অধ্যূষিত বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন তীর্থস্থানে।

এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে এক তীর্থস্থান থেকে আরেক তীর্থস্থানে এবং এক আশ্রম থেকে আরেক আশ্রমে ঘুরে ঘুরে ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন তিনি।

তিনি এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে ঘুরে ঘুরে ধ্যাণে মগ্ন থেকেছেন দিনের পর দিন রাতের পর রাত মাসের পর মাস বছরের পর বছর। 

তাইতো তাঁর শিষ্যগণ তাঁকে ডেকেছেন বলংরায় নামে। ককবরক ভাষায় ‘বলং’ অর্থ ‘অরণ্য’ ।  অরণ্যে দীর্ঘসময় ধ্যান করেছেন বলেই তাঁকে এ নামে ডাকা হয়। তিনি বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আশ্রম ও  মন্দির।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু
শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু

পরম পূজনীয় শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় মহকুমার বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গাছবান ও বাঙ্গালকাটি মৌজার সীমানা পাহাড়ের উপর মানদুইলক্ষীফা পাড়ায় (মতান্তরে মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন কাপতলা ত্রিপুরা পাড়ায়) একটি মনোরম পরিবেশে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল ত্রিপুরা জাতির নাইতং দফার লীগা উপদফায় জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতার নাম শ্রী লক্ষীপদ ত্রিপুরা ও মাতার নাম শ্রীমতি সুরভী ত্রিপুরা। তাঁর পিতামহের নাম শ্রী ভানুরাম ত্রিপুরা ও পিতামহীর নাম শ্রীমতি ভানুমতি ত্রিপুরা। তাঁর প্রপিতামহের নাম ভাগ্যরাম ত্রিপুরা ও প্রপিতামহীর নাম ভাগ্যবতী ত্রিপুরা।

এখানে উল্লেখ্য, শ্রীমৎ গুরুর জন্মসাল সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কোথাও পেয়েছি ১৮৮৪ খ্রি. এবং কোথাও পেয়েছি ১৮৯৪ খ্রি.।

তাই আমি সাল নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ভর করেছি শ্রীমৎ গুরুর স্বয়ং পুত্র শ্রী গোপাল কৃষ্ণ ত্রিপুরা কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ এর উপর এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত শ্রীমৎ গুরুর একটি পাসপোর্ট পেয়েছি যেখানে ১৯৮০ সালে ভারত ভ্রমণের অনুমোদন রয়েছে ।

এই পাসপোর্টেও জন্মতারিখ পাওয়া যায় ১১ এপ্রিল, ১৮৯৪ খ্রি:।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত গবেষক শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরার ‘বাংলাদেশের ত্রিপুরা জাতির মানব সম্পদ’ গ্রন্থের জন্মসাল হিসেবে ১৮৯৪ খ্রি: সালের উল্লেখ পাওয়া যায়।

তাঁর ‘বাংলাদেশের ত্রিপুরা জাতির মানব সম্পদ’ গ্রন্থের ২৬ নং পৃষ্ঠায় শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার জন্মসাল নিয়ে উল্লেখ করেছেন নিন্মরূ:

“ঋষি খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় নামে সমাধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বর্তমান মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন গোমতী গ্রামে ১৩০৪ ত্রিপুরাব্দে বা ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে।”

তাঁর জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে মতান্তর। কোথাও পেয়েছি গোমতি গ্রাম, কোথাও কাপতলা ত্রিপুরা পাড়া আবার কোথাও পেয়েছি মানদুইলক্ষীফা পাড়া। মতান্তর থাকলেও কাপতলা ও মানদুইলক্ষীফা পাড়া দুটোই খুব কাছাকাছি একটি এলাকা।

প্রাথমিক জীবনে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন পাহাড়ের লোকালয়ে শহর জীবন থেকে অনেক দূরের একটি ত্রিপুরা গ্রামে যেখানে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সারি সারি পাহাড় যেন মিশে গেছে রাশি রাশি মেঘেদের দলে, আর কান পাতলেই বেজে উঠে ঝর্ণাধারার পাহাড়ী গানের সুমধুর ধ্বনি।

ছোটবেলা থেকেই ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ খুব বেশি ছিল তাঁর। পাশাপাশি ধর্মীয় নিয়ম কানুন পালনতো আছেই।

কখনো একাদশী পালন কখনো উপবাস থেকে পূজা পার্বনের মাধ্যমে প্রার্থনা এবং কখনোবা বড়জনদের সাথে ধর্মীয় আসরে অংশগ্রহণ যেন তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।

খুবই মিষ্টভাষী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার অমায়িক ব্যবহারে  সবাই মুগ্ধ । তাই এলাকার সকলের নিকট খুব অল্প বয়সেই তিনি খুব ¯েœহের পাত্র হয়ে উঠেন।

বাল্যকালে গ্রামের সবাই তাঁকে খুসী কৃষ্ণ ভক্ত নামেই ডাকতেন। পাহাড় জীবনে মদ একটি অপরিহার্য পানীয় হলেও তিনি তা পান করা থেকে বিরত থাকতেন। মাছ-মাংস অর্থাৎ আমীষ জাতীয় আহার গ্রহণেও বেশ অনীহা ছিল তাঁর।

তিনি ছোটকাল থেকেই বহু শাস্ত্র ও গ্রন্থ পাঠ করতেন এবং ধর্মীয় জ্ঞান লাভের চেষ্টা করতেন। ধর্মীয় ভাবনায় বিভোর খুসী কৃষ্ণ ছোটকাল থেকেই একটু উদাসীন ছিলেন। বোধহয় কোন কিছু জানার আগ্রহ তাকে বেশি বেশি ভাবতে শিখিয়েছিল।

যেন অনুসন্ধিৎসু মন বরাবরই কোন কিছুর সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে তাঁর। পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে সহজ সরলভাবে গড়ে উঠা খুসী কৃষ্ণ যুবক বয়সে আর বসে থাকতে পারলেন না। সন্ধান করতে লাগলেন সৎগুরুর। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে লাগলেন ধর্মীয় জ্ঞানের অন্বেষণে।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা প্রথম সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন শ্রীমৎ চিত্রসেন সাধুর (ফাতারচান)। কিন্তু তিনি তাঁর নিকট ধর্মের গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারেন নি বিধায় পুনরায় ঘুরে বেড়ান সৎ গুরুর সন্ধানে।

তিনি সৎগুরুর সন্ধানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গমণ করেছিলেন কিন্তু সেখানেও সৎগুরুর সন্ধান না মিললে তিনি গাছবান এলাকায় ফিরে আসেন এবং এখানে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ।

ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কোন এক শুভক্ষণে সাক্ষাৎ পান শ্রীমৎ রতœ মনি সাধুর। তিনি ফেনী নদী এলাকায় বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার রামশিরা গ্রামে শ্রীমৎ রতনমনি সাধুর সংস্পর্শে থেকে ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেন।

উল্লেখ্য, শ্রীমৎ রতœ মনি সাধু পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন রামগড় মহকুমা এবং বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার অযোধ্যা নগরস্থ দেওয়ান বাজার এলাকার রামসিরা নামক ত্রিপুরা গ্রামে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতার নাম নীল কমল রোয়াজা এবং মাতার নাম সিলাই লক্ষী ত্রিপুরা । তাঁর পিতামহের নাম রামদয়াল রোয়াজা । রতনমনি রোয়াজার পিতা ছিলেন গ্রামের একজন অচাইরিউং(ওঝা)। যিনি ত্রিপুরাদের বিভিন্ন পূজা-পার্বন সম্পন্ন করার সক্ষমতা রাখেন।  গ্রামবাসীর নিকট তিনি সাধু নামেও পরিচিত।

পিতার ন্যায় শ্রীমৎ রত্ন মনি সাধুও একজন শিব সাধক ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা সমাজের বিভিন্ন মাঙ্গলিক পূজা-পার্বন সম্পন্ন করতেন। একসময় তিনি তান্ত্রিক বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। এভাবে তিনি আধ্যাত্ম্যিক জ্ঞানার্জন করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় চেতনায় জাগ্রত করে তোলেন।

ভারতের উদীয়মান লেখক Dharinjoy Tripura তাঁর MUKUMU (A Selected Biography of  Heroes of Tripura) নামক ককবরক ভাষায় রচিত গ্রন্থের ১ নং পৃষ্ঠায়  শ্রীমৎ রতনমনি সাধু সম্পর্কে লিখেছেন-

“Rotnomoni tripura wngkha khoroksa sadhu. Bo tabukni bangladeshni Matiragani Amtoli amchaichaini Dewan Bazar koreo tongnai Ramsirani Tripura dophani nukhungo 1886 Engreji bisini Boisak talni tal nuksakango omthai thwi kwlaijakha hinwi kokhum mano.”

তিনি শ্রীমৎ রতন মনি সাধুর শিষ্যত্ব গ্রহণের সুযোগ পান। শিষ্যত্ব গ্রহণের কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পরই শ্রীমৎ রতন মনি সাধু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর এলাকায় সপরিবারে স্থানান্তরিত হলে শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরাও সপরিবারে ডুম্বুর তীর্থধামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তখনকার সময়ে তীর্থধাম ছিল গহীণ অরণ্য।

বন জঙ্গলে ঘেরা ঐ অঞ্চলটি জুম চাষের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। সেখানে গিয়ে পরিবারের নূন্যতম আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মিটানোর জন্য ধর্ম চর্চার পাশাপাশি শুরু করেন জুমচাষ। কিন্তু শ্রীমৎ গুরুর প্রতি গুরুভক্ত শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণের মন সর্বদা পড়েথাকতো গভীর চিন্তায় ।

তিনি ধর্মের অজানা অনেক বিষয় শ্রী গুরু রতন মনির নিকট থেকে জানার চেষ্টা করতেন। শ্রী গুরু রতনমনি ধীরে ধীরে প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান দান করতেন।

তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু থাকতো ওঁ, ব্রহ্মজ্ঞান, যোগসাধনা, ধ্যান, দেহতত্ত¡, হরিনাম ইত্যাদি। এভাবে তিনি আয়ত্ত¡ করে ফেলেন রামায়ন ও মহাভারতসহ বিভিন্ন ধর্মীয়গ্রন্থ।

শ্রীমৎ রতœ মনি সাধু মহাভারত রামায়ন পড়তেন এবং শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ তা ককবরক ভাষায় অনুবাদ করে শিষ্যদের শোনাতেন।

এভাবে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সময় তিনি দেখলেন বাংলায় লিখিত গ্রন্থগুলো পড়া ও বুঝা ডুম্বুর তীর্থধামের সাধারণ সহজ সরল রিয়াং দফার মানুষগুলোর পক্ষে খুব বেশি সহজ নয়।

তখন তিনি রচনা করা শুরু করলেন ককবরক ভাষায় ভক্তিমূলক গান।  ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেন ‘ত্রিপুরা রাচামুংখা কাচাংমা খুম্বার বই’।

এই গ্রন্থে ককবরক ভাষায় মোট ৩৩ টি গান রয়েছে। প্রত্যেকটি গান যেন ঈশ^র ও গুরুভক্তি এবং ধর্মের সীমাহীন জগতের অপূর্ব কথামালা।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা গুন গুন শব্দে গান করতেন সবসময়। গান তাঁর খুবই প্রিয়।  তিনি ককবরক ভাষায় ভক্তিমূলক গানগুলো রচনা করতেন এবং সেগুলো ছাপিয়ে সাধুসঙ্গের সবাইকে গাওয়াতেন।

নিজেও ডুবে থাকতেন গানের জগতে। কখনো গাইতেন স্বরচিত গান আর কখনোবা শ্রীমৎ গুরু রতন মনি সাধুর রচিত সুমধুর গান।  থাকতেন সবসময় হাসি খুশিতে। এমনি বনে বসতিতে ঘুরে বেড়ানো তার নেশা।

গুনগুন করে সুর বাঁজে, কখনও কোমরের কসির সঙ্গে গোঁজা ত্রিপুরী বাঁশীতে সুর তোলে। বাঁশের বাশিটা ওদের কাছে আনে প্রাণের সুরের স্পর্শ ।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা তাঁর গুরু শ্রীমৎ রতœ মনি সাধুর পরামর্শে রিয়াংদের মাঝে ধর্মের বাণী প্রচার করেন।  ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন এবং রিয়াংদের জীবনাচারের অনেক অংশই পাল্টে যায় শ্রী খুুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার আধ্যাত্মিক আলোচনার প্রভাবে।

তাঁরা অনুসরণ করেন শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরাকে তাঁর শিষ্যত্ত¡ গ্রহণের মাধ্যমে। হাজার হাজার রিয়াং পার্থিব জগৎ থেকে মুক্তি লাভের আশায় শিষ্যত্ত¡ গ্রহন করেন।

তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের শুধু ডুম্বুর তীর্থধামেই নয়, তিনি ঘুরে বেড়াতেন অমরপুর, উদয়পুর, বলোনিয়া, মনো ইত্যাদি জায়গায়। পৃথিবীর সমস্ত পাপ দূর করে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।

মারামারি, হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষ যেন ‘ওঁ’ নামের মাধ্যমে মোচন হয়ে যায় তার জন্য তিনি ‘ওঁ ’ এর প্রচার করেন এবং ‘হরি’ নামেরও প্রচার করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস অধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মহারাজার সৈবাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি।

মূলত, ত্রিপুরা মহারাজা শ্রীযুত বীর বিক্রম কিশোর দেববর্মা মাণিক্য এর শাসনামলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে রিয়াং অত্যাচারী সমাজপতি চৌধুরী ও রায় এবং ঠকবাজ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সাধু রতন মনির নেতৃত্বে সাধারণ রিয়াং প্রজারা যে বিদ্রোহ করেছিল তাই ইতিহাসে রিয়াং বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

রিয়াংদের প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী একজন রায় জীবিত থাকতে অন্য কোন রায় নিয়োগ প্রদান করা যায় না। একজন রায় মহারাজার অধীনস্ত একজন সামন্ত প্রভূর মতো ভূমিকা পালন করতেন।

তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের রিয়াং সমাজের সমাজপতি হিসেবে চৌধুরী দেবী সিং ত্রিপুরা মহারাজা কর্তৃক প্রদত্ত ‘রায়’ উপাধিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

কিন্তু বিলোনিয়া মহকুমার বগাফা অঞ্চল নিবাসী খগেন্দ্র চৌধুরী রিয়াং নামে একজন রিয়াং সমাজপতি তখন বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল।

ফলে তিনি নানা উপায় অবলম্বন করে চৌধুরী দেবী সিং রিয়াংকে উৎখাত করে মহারাজার দরবার থেকে ‘রায়’ উপাধি গ্রহণ করেন। অর্থাৎ তিনি রিয়াংদের প্রচলিত রীতিনীতি ভঙ্গ করেন। যা সাধারণ রিয়াং প্রজাগণ খুব সহজে মেনে নিতে পারেন নি।

উপরন্তু খগেন্দ্র চৌধুরী রাজ কর্মচারীদের উৎকোচ প্রদান করে রাজ সৈনদের জন্য সংগৃহীত ধান চালের সিংহভাগ নিজের  গোলায় মজুদ করে রাখেন।  এ খবর তখন দ্রুত প্রজা সাধারণের কানে চলে যায়।

তাছাড়া তৎকালীন সময়ে সারা বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় বিশ্বযুদ্ধে সৈন দিয়ে সহযোগীতা করার জন্য মহারাজার নির্দেশে ‘ত্রিপুরা রাজ্যরক্ষী বাহিনী চতুর্দশ দেবতার দল’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বগাফার সৈন্য সংগ্রহের দায়িত্ব খগেন্দ্র চৌধুরীর উপর ন্যস্ত করা হলে বহু যুবককে অনিচ্ছা সত্বেও জোর করে সৈন বিভাগে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়।

যুবকেরা সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনীহা প্রকাশ করলে খগেন্দ্র চৌধুরী রাজ্য রক্ষী বাহিনীতে সৈন বা স্বেচ্ছা সেবক সংগ্রহ করতে না পেরে সাধু রতন মনির প্রভাবকেই এর জন্য দায়ী করেন এবং সেভাবেই রাজ্য সরকারে অভিযোগ প্রেরণ করতে থাকেন। শুরু হয় দরিদ্র রিয়াংদের উপর নানা নির্যাতন ।

এমতাবস্থায় রিয়াং প্রজারা নিরুপায় হয়ে আধ্যাত্বিক ধর্মগুরু সাধু রতনমনি রোয়াজার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করলে রতনমনি কয়েকজন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খগেন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে বিরোধ মিমাংসা করার জন্য আলোচনায় বসতে অনুরোধ জানান।

এরূপ সমাজপতিদের অত্যাচার, ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম, সরকারী কর্মচারী ও থানার দারোগার অত্যাচার, মহাজনের সুদের দাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি সাধারণ রিয়াং প্রজাদের জনজীবনে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হতে দেখলে সাধু রতন মনি ও সাধু খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার সচেতন হৃদয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

তখন তারা এই প্রতারক ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম হ্রাস করাসহ রাজ বাহিনীর নির্যাতন থেকে রিয়াং শিষ্যদেরকে মুক্তি দেওয়া তথা তাদের জীবনে শান্তি ও সঠিক পথে ধর্মচর্চার পথ তৈরি করতে শুরু করলেন অহিংস উপায়ে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

সাধু রতœ মনি, সাধু খুসী কৃষ্ণ ও সাধুু চৈত্রসেনের অগণিত শিষ্য এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হলেন।

এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন শ্রীমৎ রতন মনি সাধু এবং তাঁর অধীনে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা সাধু, শ্রী চৈত্রসেন ত্রিপুরা ওরফে ফাতারচান, শ্রী রামবাবু চৌধুরী ওরফে রাম্বা চৌধুরী ও শ্রী গান্ধীসাধুসহ আরো অনেকেই।

বিদ্রোহের এক পর্যায়ে পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হন তাঁরা । কেননা মহারাজের আধুণিক অস্ত্র শস্ত্রের সাথে সাধারন সহজ সরল রিয়াংরা পেরে উঠবেনা এটিই স্বাভাবিক। সেখানে শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণের আর জায়গা হলো না।

তাঁরা সবাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো । এমনকি শ্রী রতœ মনি সাধু পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে আসার পরও রক্ষা পায়নি।

আর শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার পরিবার চলে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা কোথায় চলে গেলেন তাঁর খবর আর কেউ জানে না।

তবে এমনও কিংবদন্তি রয়েছে যে, শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা সাধুকে ধরার জন্য ত্রিপুরা মহারাজার সৈন্যরা তাঁর খুব কাছাকাছি ঘুরাফেরা করার পরও তাঁকে না দেখে আবার ফেরত চলে যায় বলে জানা যায়। তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক ধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম বলে কথিত রয়েছে।

রিয়াং বিদ্রোহী শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা সাধু কয়েকবছর জন সম্মুখে আসেননি। তিনি চলে যান গহীন অরণ্যে। মগ্ন থাকেন ধ্যানে। খুঁজতে থাকেন মুক্তির পথ।

তিনি শত বিপদের মধ্যেও ছাড়েননি রংবস্ত্র, ছাড়েননি রুদ্রাক্ষ, ছাড়েননি ওঁ। সমস্ত প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে যান ধর্মের বাণী নিয়ে।

তিনি দীর্ঘ বছর বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তপস্যা ও ধ্যান সাধনায় মগ্ন ছিলেন বলে তাঁকে তাঁর শিষ্যগন নামকরণ করেন বলংরায় সাধু নামে।

তিনি তখন থেকেই বলংরায় সাধু নামে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দীর্ঘ বছর বন জঙ্গলে সাধনা করার পর চলে  আসেন জনসম্মুখে।

তবে যেহেতু রিয়াং বিদ্রোহের সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ রয়েছে রাজ সৈন্য বাহিনীর উপর সেহেতু তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত জনসম্মুখে আসার চেষ্টা করেন।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার পর প্রথমে তাঁর নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন ১৯৪৬ সালের দিকে। এরপর জনসম্মুখে আসেন ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকেবর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মায়ুং বুকুং এলাকায় তাঁর জন্মস্থানে।

অর্থাৎ কাপতলা বলি আর মানদুইলক্ষীফা পাড়া বলি সবই পাশাপাশি এলাকা। আরেকটি পাশাপাশি গ্রামের নাম কাপসাকা। ঐ কাপসাকা গ্রামের পাশেই তিনি প্রথমে উপস্থিত হন।

তাঁকে প্রথমে সহযোগিতা করেছিলেন শ্রী কীর্তিবাহন ত্রিপুরার শ্বশুর কাপসাকা নিবাসী শ্রী ক্ষ্যান্ত কুমার ত্রিপুরা (কমলিফা)।

শ্রীমৎ গুরুর জন্য খাবার এর যোগান দেওয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত গ্রামের তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। পরে ধীরে ধীরে চলে আসেন গ্রামের লোকালয়ে।

কাপসাকা গ্রামে অনেকদিন থেকে গ্রামের মানুষকে হরিণামের দীক্ষা প্রদান করে সত্য ধর্ম পালনে উজ্জীবিত করেন। এরপর তিনি চলে যান তাঁর স্ত্রী সন্তানদের নিকট গাছবান নামক এলাকায়। সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন তিনি।

কিন্তু সন্ন্যাসী মন কি আর স্থির থাকে? তিনি বরাবরই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে ঘুওে ‘ওঁ’ এবং ‘হরিণাম’ এর প্রচার অব্যাহত রাখেন। গাছবানে কয়েকবছর পরিবারের সাথে থাকার পর ঘুরতে ঘুরতে চলে যান বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মের সঠিক ধর্ম দেশনা প্রদানের জন্য।

তিনি চলে যান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া অঞ্চলে। তিনি বিভিন্ন জায়গায় সাধুসঙ্গ করতেন।

একদিন তেমনিভাবেই হঠাৎ পৌঁছে যান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানা এলাকার নারায়ন হাটের পাশের্^ আনন্দপুরের ত্রিপুরা পাড়ায় (পশ্চিম পাহাড়)।

তিনি সেখানে অনেক মানুষকে ধর্মীয় জ্ঞান প্রদান করেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার জন্য সাহস যোগান।

তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রর্থণা সভার আয়োজন করেন। ১৯৫৩/৫৪ সালের দিকে তিনি আনন্দপুর নিবাসী শ্রীমতি অবতার লক্ষী ত্রিপুরা (ককরবী)  এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

আবারও আবদ্ধ হয়ে যান সংসারের মায়াজালে। সেখানে তিনি প্রায় ১৭ বছর অতিবাহিত করেন। কথিত আছে, শ্রীমতি অবতার লক্ষী ত্রিপুরার স্বামী মারা যাওয়ার পর খুবই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছিলেন তিনি।

তাই এই অবস্থা দেখে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শ্রীমতির সম্মতিতে শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা শ্রীমতি অবতার লক্ষী ত্রিপুরাকে বিবাহ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি পশ্চিম পাহাড়ে অবস্থানকালীন সময়েই তাঁর প্রথম স্ত্রী শ্রীমতি ধবলক্ষী ত্রিপুরা ১৯৫৮ সালের ১৭ই মার্চ পুত্র শ্রী অশ্বীনি কুমার ত্রিপুরার ঘরে  গোমতিতে ইহধ্যাম ত্যাগ করেন।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা যখন পশ্চিম পাহাড়ে ছিলেন তখন একজন শিষ্যকে খুব কাছে পেয়েছিলেন। নাম তাঁর শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা।

এখানে শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক এই কারণে যে তিনি ছিলেন শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম শিষ্য। যিনি এখনো গুরুর নাম প্রচারে ব্রতী হয়ে আছেন।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার আনন্দপুর গ্রামে শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা সাধুর জন্ম। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার পশ্চিমে প্রায় পনের কিলোমিটার দুরে অবস্থিত তাঁর এই গ্রামটি।

ত্রিপুরা অধ্যুষিত এই গ্রামে প্রায় এক শতাধিক পরিবার রয়েছে। গ্রাম বাসীদের মধ্যে অধিকাংশই জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

১৩৪১ বাংলা সন তথা ১৯৩৫ খ্রিস্টীয় সনের মাঘ মাসের রবিবার শুক্ল পক্ষের একাদশি তিথিতে শুভ লগ্নে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শ্রী রাখাল চন্দ্র ত্রিপুরা ও মাতার নাম শ্রীমতি দেবজানি ত্রিপুরা।

শ্রীমৎ বাহু চন্দ্র ত্রিপুরা নয় বছর বয়সে তাঁর মাকে হারানোর পর বহু কষ্টে দিনাতিপাত করেন। আবার মাত্র বার বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারালে কষ্টের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। শ্রীমৎ বাহু চন্দ্র ত্রিপুরারা মোট  পাঁচ ভাইবোন।

ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বারো বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে তিনি শোকের সাগরে পতিত হন। ফলে বহু কষ্টে  তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে বাল্যশিক্ষা পড়াশোনা করতেন।

মাঝে মাঝে ধর্মীয় গ্রন্থ গীতা মহাভারত পাঠ করে তিনি জ্ঞান তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করতেন। পরবর্তীতে শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুর সাক্ষাতে তিনি তাঁর শিষ্যত্ত¡ গ্রহণ করেন এবং গুরুর নির্দেশিত পথে তিনি সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন।

তিনি জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন গুরুর সান্নিধ্যে থেকে। শ্রীমৎ বাহু চন্দ্র সাধু তাঁর নিজের মাতৃভাষা ককবরকে বহু আধ্যাত্মিক গান রচনা ও সুর করেছেন। গানগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবাদিতে সুযোগ পেলেই তিনি পরিবেশনা করেন।

তিনি শুধু নিজের গান করেননি। তিনি তাঁর গুরু শ্রীমৎ বলংরায় সন্ন্যাসী ও পরম গুরু  মহারাজ শ্রীমৎ রতনমনি সন্ন্যাসীর বহু জনপ্রিয় গান সযতনে সংরক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করেন।

তিনি বর্তমানে মাটিরাঙ্গাস্থ ওয়াসু এলাকায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে গুরুর নাম প্রচারে রত রয়েছেন। শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা গুরুকে নিয়ে তাঁর ‘প্রান সুমচামা’ নামক গ্রন্থের ২ নং গানের প্রথম ৩ লাইন লিখেছেন-

“সকাং গুরু আপা আমা বকন খুলুমখাআন জরম রগৈ ইঁ হান ফুনুকখাদিখ্যা মন্ত্র রগৈ গুরু আবুর-ন চাংরখা।”

তিনি প্রথমেই তাঁর গুরু শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু ও তাঁর মাতা-পিতাকে স্মরণ করেন এবং তাঁদের প্রশংসাও করেন।

শ্রীমৎ বাহুচন্দ্র ত্রিপুরা সাধু

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এসে তিনি প্রথমে রামগড় এলাকার অর্থাৎ বর্তমান মাটিরাঙ্গা এলাকার তবলছড়িতে বসতি স্থাপন করেন।

সেখানেও তিনি বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার জনসাধারণকে হিন্দু ধর্মের সঠিক ধর্ম চর্চার পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি তবলছড়ি থাকাকালীন সময়ে সরচিত ককবরক ও বাংলা ভাষায় কিছু ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করে শিষ্যদের মাঝে বিলিয়ে দেন ।

তিনি ‘চৌত্রিশ পদাবলী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তখন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারী প্রকাশিত এই গ্রন্থের ‘২য় আরতি’ লেখায় তিনি পিতা মাতার প্রতি ভক্তির কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন-

“যোগ খুলুমখা মাঃ সুরবী নং আন  অগঃ তুইখা।ফাঃলক্ষী ধন জর্ম্ম রগই, ইং হান নং যুনুও খা।দশ মাস দশ দিন কাখা অঃ বিশিনি আখলই ফাইখা।মানি মেজা গর্জা চামান নি তৈ কুর গই আভুক রখা।তৈশা খুম তুইশা বালাই মুতুম শা, খলই খুঞ্জুর ফেরখা।আমা হাম জাকগই খুরীয় ভামই, কাবাকসো আর মুতুমখা।বালাই চিকনসা বব্বা মতুম সা ।কেতে নে কেশ্বের বর্ব্বান, বন হাম জাক গাই খলই কানমায়াবুশুন নুং গই কিরী খা।হাকারা মাই তং অকারা কৌতুং মাফাঃ ফরং গই রখা,ফুরুংনাই কৌন বাক্ষা করই বিরকন নং গই পালখা।অদম বলংরাই বাক্ষা খাছিয়া,গুরুশে মাতাই শিনি মানলিয়া, ছিনি নাই কৌন বাক্ষা কালিয়াভবেনি লামন কুফুংকা।। ইতি।”

এই আরতি ককবরক ভাষায় লিখিত। এই আরতিতে তিনি লিখেছেন তাঁর পিতা, মাতা ও গুরুর কথা। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন পিতা-মাতাই জগতের শ্রেষ্ঠ গুরু আর গুরু দেবতুল্য। তাই পিতা মাতা ও গুরুর সেবা একান্ত প্রয়োজন।

তিনি তাঁর ‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ নামক গ্রন্থেও মা-বাবা ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এ গ্রন্থের ৮ নং গানের প্রথম কলিতে লিখেছেন-

“গঙ্গা গয়া কাঁশী প্রয়াগ যতসাগ নাইদিমা পথিমা আপাস্বর্গ গুরু মাতায় কপাল তুংদি ।”

তিনি বলেছেন গঙ্গা গয়া কাশী খুঁজে দেখ সবই দেহেই রয়েছে। মা হলেন প্রতিমার মতো বাবা হলেন স্বর্গতুল্য আর গুরু হলেন দেবতা সুতরাং তাঁদের সবাইকে কপালে তুলে রেখো।

তিনি মাতা-পিতা ও গুরুদেবের প্রতি যেমন ভক্তির কথা বলেছেন তেমনি তাঁদের প্রতি সেবার কথাও বরেছেন। যেমন তাঁর প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান নামক গ্রন্থের ১১ নং গানে লিখেছেন-

“সেবাসে পরম ধন সেবাসে পরম বুদ্ধি সেবাভক্তিঠিক উংখালায় আয়নাতয়, পিজাগ নাইদি।”

তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, সেবাই হচ্ছে পরম ধন, সেবাই পরম বুদ্ধি আর সেবাভক্তি যদি ঠিক থাকে তবে আয়নার মতো পরিষ্কার দেখতে পাবে।

তিনি তবলছড়িতে থাকার সময়ও পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন এবং শিষ্যদের সৎ ধর্মের কথা শুনাতেন। এখানে থাককালীন সময়ে তিনি ভারতে সফর করেন এবং তাঁর শিষ্যদের খবর নেন।

সেখানে কিছু সময় অতিবাহিতের পর তাঁর পুত্র শ্রী যোগানন্দ ত্রিপুরা ভারতের শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুবরণ করলে তিনি মর্মাহত হন এবং নিজ বাড়িতে ছুটে আসেন।

এরপর তিনি ১৯৮২ সালের দিকে তবলছড়িস্থ লক্ষীপাড়ায় কয়েকবছর বসবাস করেন। সেখানেও তিনি সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌঁছে যান দীঘিনালা উপজেলার ৩২ নং কাটারুং মৌজার রাম রতন কার্বারী পাড়ায় । এই গ্রামটি ত্রিপুরাদের নিকট কাটারুং পাড়া হিসেবেই পরিচিত।

তিনি এই বড় কাটারুং পাড়ায় গিয়েছিলেন প্রায় ১৯৮৫ খ্রি: সালের দিকে। দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার উত্তরে একটি জঙ্গলাকীর্ন গ্রাম ছিল এটি।

তিনি গিয়ে বসতি ঘর তুললেন ঐ গ্রাম নিবাসী শ্রী উচিৎ কুমার ত্রিপুরার টিলার মাঝামাঝি স্থানে। যেখানে চারদিকে ভয়ংকর একটি পরিবেশ ছিল।

কয়েকজন শিষ্য ভয়ানক জঙ্গলে ঘর না বাঁধার পরামর্শ দিলে তিনি সবাইকে নির্ভয়ে থাকার উপদেশ দেন। তিনি সেখানে গিয়ে ধর্মের বাণী প্রচার করলেন।

দলে দলে গ্রামের অধিকাংশই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। স্ত্রী ও দুই নাতি নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। শিষ্যগণ যা এনে দিতেন তা নিয়ে তাঁর প্রতিদিনের আহার জুটতো। এভাবেই তিনি দিনাতিপাত করতে লাগলেন।

বন জঙ্গল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র কারণ হল নিরিবিলি পরিবেশে ধ্যানে মগ্ন থাকা। শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ বলংরায় সাধু তাই করলেন। রাত্রে ঘরের ভেতর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন আর দিনের বেলায় ঘরের বাইরে আশে পাশে পাওয়া যেত বাঘের পদচিহ্ন।

তখন শিষ্যরা জিজ্ঞেস করতেন “রাত্রে বাঘের মতো ভয়ংকর পশুর আনাঘোনায় থাকেন কিভাবে? ” তখন তিনি মুচকী হেসে উত্তর দিতেন “এই বাঘগুলো রাত্রে আমাকে পাহাড়া দেয়।” এই আজব কথা শুনে শিষ্যরা চমকে উঠতেন।

এই গ্রামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণু মন্দিরও কালী মন্দির। একে একে শ্রী উচিৎ কুমার ত্রিপুরা,  শ্রীমতি কুঞ্জরেখা ত্রিপুরা ও শ্রী রঞ্জন ত্রিপুরা সহ আরো অনেকেই শ্রীমৎ গুরুর নিকট থেকে ধর্মীয় নিয়ম কানুন ও রীতি নীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।

শিষ্যরা বিভিন্ন প্রণাম ও পূজা পার্বনের নিয়মাবলী সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। বেশ কয়েক বছর পর বড় কাটারুং পাড়ায় বসবাস করার পর তিনি চলে যান দীঘিনালা উপজেলারই কামাকুটছড়া এলাকার যোগেন্দ্র কার্বারী পাড়ায়।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু

সেখানেও তিনি কয়েকবছর অতিবাহিত করেন। সেখানে থাকাকালীন সময় ত্রিপুরা , বাঙ্গালী ও চাকমা জাতির অনেক লোকজন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সঠিক ধর্ম পালনের পথ খুঁজে পান।

সেখানেও তিনি আরেকজন শিষ্যের সন্ধান পান যিনি পরবর্তীতে আজীবন তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে ইহধ্যাম ত্যাগ করেছেন। 

তাঁর নাম শ্রীমৎ চিত্ত রঞ্জন ত্রিপুরা সাধু। শ্রীমৎ চিত্তরঞ্জন  সাধুর ত্রিপুরা ভাষায় অনুদিত ‘শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতা’ নামক গ্রন্থে গুরু বন্দনা নামে একটি গান লিখেছিলেন।

সেখানে তিনি শ্রীমৎ গুরু খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুকে উদ্দেশ্য করে গুরু বন্দনা করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থের ৩ নং পৃষ্ঠার প্রথম ৬ লাইনে উল্লেখ রয়েছে নিন্মরূপ:

“খুলুম্কা গুরু নিনি য়াপাই-নয়াপাইন রসিদি কপাল বকগন।আত্ম জ্ঞান রদি অজ্ঞান্ন রুকসিদিমুক্তিনি লামানো ফুরনুকসিদি আনোআংলাই মুংসা সিয়া রুতুকনি রুংলিয়াসবন সুংসিনি মুক্তিনি লামানো। ”

অর্থাৎ শ্রী চিত্তরঞ্জন ত্রিপুরা সাধু গুরু বন্দনায় গুরুকে প্রণাম জানিয়েছেন গুরুর পা ছুঁয়ে, গুরুর কপালে তোলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

তিনি বন্দনায় আত্মজ্ঞান খুঁঁজেছেন গুরুর নিকট আর অজ্ঞানকে দূর করার অনুরোধ জানিয়েছেন এবং খুঁজেছেন মুক্তির পথ। এভাবে কামাকুটছড়ায় তাঁর শিষ্যরা তাঁকে ঘিরে রচনা করেছেন বহু ভক্তিমূলক গান।

কামাকুটছড়ায় তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শ্রীমতি অবতারলক্ষী ত্রিপুরা ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করলে তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েন।

শোকাহত শ্রীমৎ গুরু ১৯৯২ সালে খাগড়াছড়ি সদরেরর চেঙ্গী ব্রীজ এলাকায় নাতনী শ্রীমতি শেফালিকা ত্রিপুরা ও নাতনীজামাই শ্রী অলিন্দ্র ত্রিপুরার ঘরে চলে আসেন অনেক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।

স্ত্রী বিয়োগের ক্ষত তাঁকে বারংবার নাড়া দিয়ে যায়। বেদনায় সিক্ত হৃদয়ে যেন পাহাড় ভেঙ্গে মাতায় পড়েছে তাঁর তবুও মনোবল ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তিনি  এবং পুনরায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েন।

তবে তিনি আর বেশিদিন থাকেন নি। চেঙ্গী ব্রীজ সংলগ্ন নাতনী জামাইয়ের বাড়িতে প্রায় ১ বছর অতিবাহিত করার পর পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন ও ভক্তবৃন্দকে রেখে ১৯৯৩ সালের ৮ জুন, ১৪০০ বাংলার ২৫ শে জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার সকাল ৮ টায় তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।

তবে তাঁর চলে যাওয়া শেষ বারের চলে যাওয়া নয়। তিনি সকলের নিকট এখনো পরম পূজনীয়। তিনি অন্ধকারের আলোকিত প্রদীপ। মেঘলা আকাশের দীপ্তমান সূর্য। তিনি বিপদগ্রস্থ হতাশায় নিমজ্জিত মানুষের মুক্তির অবলম্বন।

ধ্যানে, জ্ঞানে, মানে, মননে তিনি ছিলেন অতুলনীয় এক মহামানব। তাঁর দেখানো মুক্তির পথ অনুসরণ করলেই এখনো মুক্তি লাভ সুনিশ্চিত মনে করেন তাঁর শিষ্যগণ। স্মরণে রেখেছেন প্রাণ পুরুষ পরম পূজনীয় শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুকে।

বেঁচে থাক আজীবন কোটি মানুষের হৃদয়ে পরম পূজনীয় হয়ে, রইল এই প্রত্যাশা। সবশেষে গুরুর চরণে মাথানত করি, জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মুকুল কান্তি ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা