গুর্খা জাতির আদ্যোপান্ত

Jumjournal
Last updated Sep 8th, 2021

1006

featured image

গুর্খা জাতির বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে স্বীকৃত ভিন্ন ভাষাভাষী ১১টি পাহাড়ি জনগােষ্ঠী ছাড়াও গুর্খা, অহমিয়া বা আসাম ও সাঁওতাল নামে আরাে ৩টি ক্ষুদ্র জনগােষ্ঠী দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে।

এর মধ্যে গুর্খা জনগােষ্ঠীর লােকেরা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অন্তর্গত মাঝেরবস্তি, আসামবস্তি, জেল রোড, কন্ট্রাক্টর পাড়া প্রভৃতি এলাকায় বাস করে। বান্দরবান জেলায়ও ৪/৫টি গুর্খা পরিবার রয়েছে। সরকারি আদমশুমারিতে গুর্খা জনগােষ্ঠীর লােকসংখ্যার উল্লেখ নেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে গুর্খাদের সম্ভাব্য জনসংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও বাংলাদেশের ঢাকা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলায় অনেক গুর্খা বসবাস করে। এসব গুর্খা চা শ্রমিক, বিভিন্ন টেক্সটাইল মিলে চাকরি, উপকূল অঞ্চলে মৎস্যজীবী, দিনমজুরি ইত্যাদি পেশায় জড়িত রয়েছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কয়েক আগে এদেশে তাদের বসতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কারণে তাদের মধ্যে পারস্পরিক যােগাযােগ ও সংযােগ অত্যন্ত সীমিত। ফলে তাদের মধ্যে অনেকে জাতিগত পরিচয় ও স্বকীয় সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে বা অনেকে ফেলতে বসেছে।

গুর্খাদের মূল জনগােষ্ঠী বাস করে প্রতিবেশী নেপাল ও ভারতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে গুর্খাল্যান্ড নামে গুর্খা জনগােষ্ঠীর জন্য শাসিত জেলা পরিষদ ময়েছে। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গুর্খা রেজিমেন্টের সাহসিকতা ও শক্তিমত্তার জন্য যােদ্ধা জাতি হিসেবে গুর্খারা খ্যাতি লাভ করে।

গুর্খা সেনাদের অটুট মনােবল, আনুগত্য, আত্মনির্ভরশীলতা, শারীরিক সামর্থ্য, নমনীয়তা, ২শ-পরায়ণতা, দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করার ক্ষমতা, অদম্যতা এবং সামরিক দক্ষতা বিশেষভাবে প্রশংসা লাভ করে। সমতল অঞ্চলে বসবাসকারী গুর্খাদের জনসংখ্যা সম্পর্কে কোনাে নির্ভরযােগ্য তথ্য নেই। তবে গুর্খাদের অনেকে সমতল অঞ্চলের গুর্খাদের মােট জনসংখ্যা ২০ হাজারের মতাে হতে পারে না বলে মনে করেন।

সংখ্যার স্বল্পতা ও উপযুক্ত সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার অভাবে পার্বত্য জেলাগুলােতে গুর্খারা ধীরে ধীরে তাদের ভাষা-সংস্কৃতিজাতীয় পরিচিতি হারিয়ে ফেলছে। বিশেষত শিক্ষার অভাবের কারণে তারা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলিত ও সুযােগ-সুবিধা বঞ্চিত বলা যায়। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পছন্দমতাে স্বজাতীয় পাত্র বা পাত্রীর অভাবে গুর্খারা অন্যান্য জাতির সাথে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হচ্ছে। গুর্খাদের মধ্যে যে সব গুর্খা পরিবার শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল তাদের কেউ কেউ পাড়ি জমাচ্ছেন তাদের পূর্বপুরুষের দেশ নেপালে।

গুর্খা জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি

গুর্খা জাতির উৎপত্তি নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন গাের্খা নামক স্থানের নামানুসারে গুর্খাদের নামকরণ করা হয়েছে। আসলে বিষয়টি সঠিক নয়। প্রকৃত পক্ষে গুর্খাদের নামানুসারেই গাের্খা নামক স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। গুর্খারা তাদের নাম গ্রহণ করে ৮ম শতাব্দীর বার আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ গুরু গােরকনাথ থেকে।

কথিত আছে রাজস্থানের রাজপুত্র কিশাের বাপ্পা রাওয়াল ওরফে রাজকুমার কালভােজ/সৈলাদিশ, মেওয়ার রাজবংশের স্থপতি এক গহীন জঙ্গলে শিকারকালীন গুরু গােরকনাথকে ধ্যানমগ্ন দেখতে পান। গুরু গােরকনাথের প্রতি ভক্তির কারণে বাপ্পা রাওয়াল তার সেবায় রত হন।

ধ্যান ভাঙার পর গুরু গােরকনাথ বাপ্পা রাওযালকে দেখতে পান ও তা ভক্তির কারণে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং খুশি হয়ে বাপ্পা রাওয়াকে খুকরি (ঐতিহ্যবাহী গুৰ্খা ছুরি) প্রদান করেন। তিনি এই মর্মে ভবিষ্যত আশীর্বাদ প্রদান করেন যে, এখন থেকে বাপ্পা রাওয়াল এবং তার বংশ ও অনুসারীরা তার শিষ্য ও গুর্খা নামে পরিচিত হবে এবং তাদের বীরত্বগাথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

পরবর্তীতে গুর্খরা বর্তমান নেপালের পূর্বাংশের একটি স্থান দখল করে ও তাদের গুরুর নামানুসারে উক্ত স্থানের নামকরণ করে গোর্খা। অতপর বা দখল করে নেয় অন্যান্য স্থান যা বর্তমানে নেপাল হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে গোরখা নেপালের ৭০টি জেলার একটি।

১৭৫৭ সনে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা বিজয়ের পর ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে আরাে ভিতরে বেশ করতে থাকে। তারা চট্টগ্রামে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পর পার্বত্য আসাম তথা কার্পাস মহল এবং তারও পূর্বের লুসাই হিলের উপর দৃষ্টি দেয়। এ অঞ্চলটি তখন অপরাপর ক্ষুদ্র জাতি ও কুকি/লুসাই আদিবাসীদের আবাসভূমি ছিল।

ব্রিটিশরা অপরাপর জাতিদের বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হলেও তারা সাইদের বশ্যতা স্বীকারে বেগ পেতে থাকে। তাদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়। পাহাড় জঙ্গলে যুদ্ধ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে শত শত ব্রিটিশ সৈন্য মারা যেতে থাকে। লুসাই আদিবাসীরা তখন তুলনামূলকভাবে হিংস্র প্রকৃতির ছিল। তাদের দ্বারা বহু ব্রিটিশ নাগরিক ও স্থানীয় অপরাপর আদিবাসী/অধিবাসীদের মৃত্যু ও অপহরণের কারণে ব্রিটিশরা তাদের উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিল।

দুর্গম পাহাড়-পর্বতময় এই জনপদের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশরা ছিল অসহায়। এমন অবস্থায় কৌশল হিসেবে তখন বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নেপাল-ভারত থেকে ২য় গুর্খা রেজিমেন্টকে লুসাই বিদ্রোহ দমনের জন্য এই এলাকায় নিয়ে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন তার “এ ফ্লাই ওন দ্য হুইল” বইটিতে লিখেছেন, কর্নেল ম্যাকফার্সনের নেতৃত্বে ১৮৭১ সনে ২য় গুর্খা রেজিমেন্টের সেনারা পার্বত্য এলাকায় আসে।

তারা প্রকৃতিগতভাবে অসীম সাহসী, দুর্ধর্ষ, একগুয়ে ও প্রশিক্ষিত গুর্খা সেনাদের লেলিয়ে দিল লুসাই বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে। জানা যায় প্রশিক্ষিত গুর্খাদের অসীম সাহস, দুর্ধর্ষ তৎপরতা ও যুদ্ধ কৌশলের সামনে লুসাইরা তাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে ও সন্ধি/বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়।

ব্রিটিশরা পরবর্তীতে গুর্খাদের পার্বত্য এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযােগ করে দেয়। অনেকে স্থানীয় অপরাপর আদিবাসী বিশেষ করে আরাকানি/মারমা নারীদের সাথে বাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ও স্থায়ীভাবে থেকে যায়। ব্রিটিশরা লুসাইদের বিশ্বাস করতে পারতাে না।

সে কারণে তারা লুসাই রাজ্য তথা মিজোরাম এলাকা ও মং রাজার এলাকার মাঝামাঝি মাইনী ভ্যালি নামক স্থানে নেপাল থেকে গুর্খাদের এনে বসতি প্রদান করে, যাতে দুধর্ষ গুর্খাদের কলােনী ডিঙিয়ে লুসাইরা মং রাজার রাজ্যে লুটপাট করতে না পারে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে ব্রিটিশরা মাইনী ভ্যালিকে বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ও এলাকাটি স্থানীয় চিফদের আওতামুক্ত রাখে। উক্ত বিধিতে এলাকাটি সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এখানে একটি কথা বলা প্রয়ােজন, আর তা হলাে ব্রিটিশরা তাদের তাদের গুর্খা যত্রতত্র ব্যবহার করে লাভবান হলেও সেই গুর্খা সেনাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য তারা কোনাে কিছুই করেনি যা পার্বত্য খাটের দুর্ভাগ্যজনক।

গুর্খারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। গুর্খাদের অনেক যুবক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়। তারা সম্মুখ সমরে অসম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এ যুদ্ধে অনেক গুর্খা মুক্তিযােদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ গুর্খা মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে লাল বাহাদুর ছেত্রী, শান্তি বাহাদুর রায়, তেজ বাহাদুর ছেত্রী ও জেমস বাহাদুর ছেত্রীর নাম বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য। মুক্তিযােদ্ধা তেজ বাহাদুর ছেত্রী কুষ্টিয়ায় এবং মুক্তিযােদ্ধা জেমস বাহাদুর ছেত্রী চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে আত্মত্যাগ করেন।

গুর্খা যোদ্ধা
ঐতিহাসিক গুর্খা যোদ্ধা

গুর্খা জাতির সামাজিক সংগঠন

গুর্খাদের গােত্র

গুর্খাদের ২৪টি প্রধান গােষ্ঠীর নাম জানা যায়। যেমন : লিম্বু, লোবা, মগর, মানজি, মানং, মাতােয়ালি, ছেত্রী, মুগল, মুশর, মুসলমান, নেওয়ার, ফরি, রায়, রাজবংশী, রাজি, রাউত, শারকি, সাতার, শেরপা, সুরেল, তামাং, ঠাকালি, ঠাকুর, থামি, ঠারু ইত্যাদি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী গুর্খাদের মধ্যে কেবলমাত্র মানজি (মাজি), নেওয়ার রায়, শারকি, থাপা, ছেত্রী, গুরুং, লামা ইত্যাদি মােট ৮টি গােষ্ঠীর লােক রয়েছে।

মানজির মূল গােষ্ঠী হচ্ছে ঠারু। মানজি গােষ্ঠীর অন্যান্য সমগােত্রের নাম হচ্ছে ক্ষত্রিয়, কানফাটা, কাচিলা, খারাল, খাওয়াস, খাস, খান, খুনাহা, কৌশিয়া, গাচ্চাধর, চিতােয়ানিয়া, চৌধুরী, যােগী, দাঙ্গাউরিয়া, তরফদার, থাে দানােয়ার, দাঙ্গোরা, পরিহার, বার্দিয়া, বান্যা, ভান্তে, বান্তর, বােকসা, ভােলে মাজাউরা, মারদানিয়া, মহন্ত, মহাততা, মরাঙ্গিয়া, রাজটিয়া, রাজঘরিয়া, রাজহত্যা রানা, রাজা, রাউতার, লাম্পুচ্চুয়া, লালপুরিয়া, বিশ্বাস, সরদার, সুনাহা, সােলরিয়া, হেমজলিয়া, হলদালিয়া। প্রত্যেক গােষ্ঠীরই এমন গােত্র ও উপ-গােত্র রয়েছে।

গুর্খাদের পরিবারের ধরন

গুর্খা জনগােষ্ঠীর মধ্যে যৌথ ও একক পরিবার প্রথা বিদ্যমান। সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিয়ের পর অনেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে ছােট্ট সংসার গড়ে তােলে। তবে আলাদা হলেও বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশােনার দায়িত্ব পালন করে সন্তানরা।

একক পরিবারে স্বামীই হলাে পরিবারের কর্তা ও সকল অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়ােজনের ক্ষেত্রে পরিবার প্রধানের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উৎসব পার্বণ প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে পরিবারের কর্তাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

গুর্খাদের ব্যক্তির জীবনচক্র

গুর্খাদের জন্ম

গুর্খা সমাজে ছেলেশিশুর কদর বেশি। গর্ভবতী মা পরিবারে বিশেষ আদর যত্ন পেয়ে থাকে। পরিবারে নতুন সন্তানের আগমন বার্তা জানাজানি হলে মিষ্টিমুখ করানাে হয়। সাধারণত মায়ের স্বজনদের মধ্যে কারাে দ্বারা সন্তান প্রসব নাে হয়। পারিবারিকভাবে শিশু জনের পর ধাত্রী ও বয়ােজ্যেষ্ঠ সহকারীদের মদ ও কাপড়-চোপড় দিয়ে শিশুর বাবা ও মাকে মাফ চাইতে হয়, জন্মদানের সময় তারা মায়ের পা সহ অন্যান্য অঙ্গ ছুঁয়েছে।

তার ক্ষমা চাইতে এই বিধান গুর্খা সমাজে বয়ােজেষ্ঠদের অত্যন্ত সম্মান করা হয়ে থাকে। অন্যান্য জনগােষ্ঠীর ন্যায় গুর্খা সমাজে পুত্রসন্তানের কদর বেশি। গুর্খা সমাজে শিশুরা আর দশটা শিশুদের মতােই বড় হয়। অভিভাবকের অবস্থাভেদে শিশুদের শিক্ষাজীবন পরিচালিত হয়।

তবে আর্থিক দৈন্যতার কারণে উচ্চশিক্ষা গুর্খাদের মধ্যে, ফলে তাদের মধ্যে শিক্ষার হার অন্যান্য আদিবাসীর তুলনায় অ সাধারণত ১৩ বছরে ব্রাহ্মণ গােত্রের গুর্খা শিশু পৈতা ধারণ করে, তখন না জাতির কারাে ছোঁয়া খেতে পারে না। সাধারণত তারা নিরামিষ ভােজন থাকে; বৌদ্ধরা বৌদ্ধরীতি অনুসারে শ্রমণ হয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে একটি নির্দিষ্ট সময় জন্য সন্ন্যাস ব্রত পালন করে থাকে। বিবাহযােগ্য হলে অভিভাবকরা তাদের সক নিদের বিবাহ দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।

গুর্খা সন্তানের নামকরণ অনুষ্ঠান: সন্তানের নামকরণ করার জন্য গুখ পরিবারে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়ে থাকে। সেদিন নিকট আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শীর আগমন ঘটে সম্ভব হলে পূর্বে ব্রাহ্মণ দিয়ে নামের আদ্যাক্ষর নির্ণয় করা হয়।

নাম নির্ণয়ের জন্য ছােট ছােট তেলের প্রদীপ (ধেবরি) বানানাে হয়। প্রত্যেকে যার যার দেয়া নামের জন্য এক একটি বেরিকে বাছাই করে। ধেবরিগুলি একসাথে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অতপর অতিথিদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করা হয়। সারারাত জেগে প্রদীপগুলিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যে প্রদীপটি সবার শেষে নিভে সেই প্রদীপের নামটি গ্রহণ করা হয়। সব চাইতে দীর্ঘসময় ধরে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপটি বাছাই করা হয় সন্তানের দীর্ঘ জীবনের প্রতীক হিসেবে। এ অনুষ্ঠান এখনাে গুর্খাদের মধ্যে প্রচলিত।

গুর্খাদের ভার্চুয়ানি অনুষ্ঠান: সন্তানের বয়স ৫/৬ মাস হলেই তাকে ভাত খাওয়ানাের প্রস্তুতি নেয়া হয়। মধু ভাত, পায়েস ইত্যাদি ও সবজি, ডিম, মাংসের স্যুপ ইত্যাদি সকল পদ বাসায় রান্না করা হয়। অতপর শিশুর পিতা মাতা শিশুকে কোলে নিয়ে বসে, উপস্থিত মুরব্বিরা প্রার্থনা ও আশীর্বাদ সহকারে সকলে একে একে শিশুর মুখে পছন্দমত আইটেম ছুঁইয়ে দেয়।

শিশু তার পছন্দের আইটেম এ পদ্ধতিে খুঁজে পায়, পিতা-মাতা ও তার সন্তানের রুচি সম্পর্কে অবহিত হয়। অতপর অতিথিদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করা হয়। আর্থিকভাবে সক্ষম গুর্খা পরিবারে এখনাে এ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

গুর্খাদের বিবাহ

সাধারণত অভিভাবকের মাধ্যমে গুর্খাদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়ে থাকে। সামাজিক বিধান অনুসারে সহনীয় গােত্রের মধ্যে সম্পর্ক হয়ে থাকে। ইদানীং সংস্কার মানা হয় না। পাত্র-পাত্রীর আর্থিক ও শিক্ষাগত যােগ্যতা বিবেচনায় অসহনীয় পাত্র-পাত্রীর মধ্যেও বিবাহ হয়। বিবাহের প্রস্তাব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামের মুখ্যা/প্রধান/হেডম্যানের ভূমিকা প্রাধান্য পায়।

প্রস্তাব পাকা হলে বর পক্ষ কনের অন্য কাপড় ও চিহ্নরূপ আংটি বা অন্য কোনাে অলংকার নিয়ে কনে পক্ষের বাসায় গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেশ করে, কনে পক্ষ প্রস্তাব গ্রহণ করে ও সাধ্যমত অতিথিদের আপ্যায়ন করে।

বিবাহের দিন বর ও কনেকে উপবাস থাকতে হয়। সাথে যিনি কন্যাদান করবেন তাকেও উপবাস থাকতে হয়। কন্যাদান করার জন্য রক্ত সম্পর্কের বাবা, মা, ভাই, মামা এদের মধ্যে একজনকে উপস্থিত থাকতে হয়।

ব্রাহ্মণ, নেপালি ভাষায় উপাধ্যায় বাউন, মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে বর (জুয়াঁই) ও কনে (সুয়াসনি)-কে বিবাহ করিয়ে থাকেন। অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে ৩৩ কোটি দেবতাকে সাক্ষী করে বিবাহ করা হয়। অন্যদিকে মাতােয়ালী/নিম্ন শ্রেণীর সাধারণ গুর্খারা সমাজের বয়ােজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে মালা বদল ও বর কর্তৃক কনেকে কপালে সিঁদুর পরিয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে থাকেন। বিয়ের দিন গ্রামের সকলকে সাধ্যমতাে আপ্যায়ন করা হয়।

সনাতন ধর্মাবলম্বী ছেত্রী বা অন্যান্যরা ব্রাহ্মণ দ্বারা এবং বৌদ্ধ ধর্মের নেওয়ার, থাপা, মগর, গুরুং, লিম্বু গােষ্ঠীর লােকেরা ভিক্ষু দিয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে। এক সময় গুদের মধ্যে গােত্র বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট ছিল। তখনকার দিনে বিবাহে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য গােত্র ভিত্তিক রান্নার ব্যবস্থা করা হতাে। রান্নার সামগ্রী, ডেকচি, স্থান, বাবুর্চি সবই আলাদা আলাদা থাকতাে। তবে বর্তমানে সে সব সংস্কার উঠে যাচ্ছে।

গুর্খা সমাজে রক্ত সম্পর্কের কারাে সাথে বিবাহ নিষেধ। এর অন্যথা হলে পাত্র-পাত্রী ও অভিভাবকদের প্রায়শ্চিত্ত/পবিত্র—যাকে গুর্খা ভাষায় ‘নৌরান’ বলা হয়—তা করতে হয়। অনেকের মাথা মুণ্ডন করা, নির্দিষ্ট দিনের জন্য গ্রামের বাইরে/ এক কাপড়ে বা এক ঘরে হয়ে থাকা ইত্যাদি শাস্তি ভােগ করতে হয়। এসবই গ্রামের প্রধান/মুখ্যা ও সমাজপতিরা নির্ধারণ করেন।

গুর্খাদের মৃত্যু

জীবনাবসানে গুর্খাদের দাহ করে সক্কার করা হয়। তবে দাঁত উঠে নাই এমন শিশুর মৃত্যু হলে তাকে দাহ করা হয় না, মাটিতে সমাহিত করা হয়। নারী পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে মৃতদেহ চিতায় ২ স্তরের লাকড়ির উপর রাখা হয় ও দেহের উপর ৩ স্তরের লাকড়ি সাজানাে হয় তবে আজকাল এ রীতি মানা হয় না।

তখন ৫/৭ স্তরের লাকড়ি সাজিয়ে তার উপর দেহ স্থাপন করতে দেখা যায়। অতপর মৃতের রক্ত সম্পর্কের নিকট আত্মীয় স্নান করে মাটির পাত্র ভর্তি পানি কাধে নিয়ে চিতাকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করে, প্রদক্ষিণকালীন লােহা বা শক্ত কিছু দিয়ে মাটির পত্রটি পেছন থেকে ছিদ্র করে দেয়া হয়।

অতপর প্রদক্ষিণকারী সর্বপ্রথমে চিতায় আগুন সংযােগ করে তার পর পরই উপস্থিত সকলে যার যার হাতে থাকা জ্বলন্ত লাকড়ি চিতায় নিক্ষেপ করে। চিতায় সাধারণত আম গাছের লাকড়ি ব্যবহার করে হয়, অনেকে সামর্থ্য ভেদে চন্দন কাঠও ব্যবহার করে থাকেন।

গুখারা বর্তমানে চাকমা ও বােমাং সার্কেলে বসবাস করছে। সেহেতু প্রথাগত যে কোনাে বিষয়ে সার্কেল চিফদের কাছে তারা শরণাপন্ন হয়। ইতােপূর্বে ১০২ নং রাঙ্গাপানি মৌজার হেডম্যান মৃত যােগেন্দ্র লাল দেওয়ানের সুপারিশে গুর্খাদের প্রথাগত বিচারাদি সম্পাদনের জন্য চাকমা চিফ কর্তৃক গুর্খা কার্বারী নিয়ােগ করা হয়, তন্মধ্যে মাঝেরবস্তির মৃত শ্ৰী গর্বে লাল থাপা অন্যতম।

এ ছাড়া রাজা ননিলাক্ষ রায়ের আমলে গুর্খা কার্বারীর নাম ছিল শ্ৰী ধনরাজ গুরুং। তিনি গর্জনতলী এলাকায় বসবাস করতেন। তদানীন্তন চাকমা রাজা ননিলাক্ষ রায় ও রাজা ত্রিদিব রায়ের আমলে গুর্খাদের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

কিন্তু বর্তমানে গুর্খাদের কোনাে কার্বারী নিয়ােগ দেয়া হয় না। বর্তমানে গুর্খাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার স্থায়ী আদিবাসী বলেই স্বয়ং চাকমা চিফ মানতে চান না। বর্তমানে গুর্খাদের মধ্যে থেকে কোনাে কার্বারী নিয়ােগপ্রাপ্ত না থাকায় গুর্খা সমাজে প্রথাগত ও সামাজিক যে কোনাে সমস্যা তাদের মধ্যে মুরব্বি বা বয়ােজ্যেষ্ঠদের দ্বারা সমাধান হয়ে থাকে। গুর্খারা তাদের জন্য গুর্খা কার্বারী নিয়ােগের দাবি জানিয়ে আসছে।

গুর্খা জাতির অর্থনৈতিক সংগঠন

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অধিকাংশ গুর্খা পরিবার দৈন্যতার মধ্যে দিনযাপন করে আসছে। গুর্খারা সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বর্তমান দিনের প্রতিকূল পরিবেশের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। ভােগদখলীয় জমিজমার রেজিস্ট্রেশনপূর্বক দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা ছিল সম্পূর্ণ অসচেতন।

একসময় রাঙ্গামাটির আদিগন্ত জংলা জমি সবই তালে মনে করে স্থানীয় হেডম্যানের প্রদর্শিত এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে তারা ফল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করেছিল। কিন্তু ১৯৬০-৬২ সালে কাপ্তাই এ নির্মাণের ফলে তাদের সেই সুখের দিনগুলাে হারিয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদের উত্তাল জলরাশিতে।

তাদের একমাত্র অবলম্বন আবাদি জমি ও বসতভিটা কাপ্তাই হৃদের অথৈ জলে ডুবে গেছে। অন্যান্য উদ্বাস্তু জনগােষ্ঠীর মতাে তারাও যথাযথ পুনর্বাসন পায়নি। যে জমিগুলো হারিয়েছে সে জমিগুলাের পরিবর্তে তারা কোনাে জাবন্দোবস্তি পায়নি।

বাধ্য হয়েই নামমাত্র পাওয়া ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে মতাে ঘরবাড়ি তুলে রাঙ্গামাটি শহরে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে খুজে বিভিন্ন মিল-কারখানায় দারােয়ান অথবা চাপরাশির চাকরি। আবার অনেকে হিসেবে যােগ দিয়েছে তখনকার সময়ে গড়ে ওঠা চা বাগানগুলােতে।

গুর্খারা শহর এলাকায় বাস করে বিধায় তাদের কোনাে আবাদযােগ্য জমি নেই। বলা যায় কৃষি চাষের সাথে তাদের তেমন একটা সম্পর্ক নেই। অশিক্ষা ও অদূরদর্শিতার কারণে তাদের অধিকাংশ বসতভিটা সরকারি রেজিস্ট্রিভুক্ত নয়।

জমি-জমা রেজিস্ট্রিকরণের ক্ষেত্রে সরকারি অফিসের বিমাতাসুলভ আচরণের সম্মুখীন হয় তারা। বর্তমানে বসবাসের জন্য অনেকের অল্প-স্বল্প জমিজমা থাকলেও বসত ঘরের অবস্থা জরাজীর্ণ! রােদবৃষ্টিকে নিত্যসঙ্গী করে তারা কোনােরকমে বেঁচে আছে সুদিনের প্রত্যাশায়।

সাধারণ গুর্খাদের বর্তমান পেশা দিনমজুরি। পুঁজির অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদেরকে তেমন একটা দেখা যায় না। শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর গুর্খাদের অন্যতম অবলম্বন কায়িক পরিশ্রম। একসময় গুর্খারা শূকর পালন এবং মদ তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতাে। কিন্তু বর্তমান সেসব পেশারও অনুকূল পরিবেশ নেই।

পরিবর্তিত পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের কারণে, বিশেষত পর্যাপ্ত খােলা জায়গা না থাকার কারণে শূকর পালন বন্ধ হয়ে গেছে। মদ তৈরি ও বিক্রি করাতেও এখন আইনি নানা সমস্যার মুখােমুখি হতে হয়।

সরকারি নানা আইন-কানুনের বেড়াজালে গুর্খাদের উভয় পেশাই আজ হুমকির সম্মুখীন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে মদ চোলাই ও মদের বহুবিধ ব্যবহার অনুমােদিত রয়েছে।

গুর্খাদের উত্তরাধিকার প্রথা সাধারণভাবে বাঙালি হিন্দুদের মতােই। পুত্র সন্তানরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত। তবে মা-বাবা ইচ্ছে করলে কন্যা সন্তানদের সম্পত্তির ভাগ দিতে পারেন। বর্তমানকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা কন্যাসন্তানদেরও সম্পত্তি অংশ দিয়ে থাকেন।

গুর্খাদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্কুলের শিক্ষক। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের মধ্য থেকে এখনাে বিসিএস ক্যাডারের কোনাে কর্মকর্তা নেই। এছাড়া পুলিশ বাহিনীতে কিছু সংখ্যক গুর্খা চাকরি নিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মৃত শ্ৰী বুদ্ধিমান ছেত্রী; তিনি ছিলেন তৎকালীন ইপিআর আর গতমানে বিডিআরের সুবেদার মেজর। আরও উল্লেখযােগ্য পুলিশ ইন্সপেক্টর মৃত চন্দ্র কুমার শারকি, পুলিশ ইন্সপেক্টর (অব.) অজিত বাহাদুর ছেত্রী, বর্তমানে মরত উপজেলা আনসার ভিডিপি প্রশিক্ষক দীপক বাহাদুর প্রমুখ। তবে চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের পার্বত্য এলাকার আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

গুর্খা জাতির ধর্মীয় অবস্থা

গুর্খাদের ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খারা সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মে অনুসারী। গুর্খাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর লােকেরা বিভক্ত, যােগী গােষ্ঠীর লােকেরা কৃভক্ত আর ছেত্রী গোষ্ঠীর লােকেরা রামভক্ত! সনাতনী গুর্খারা পূজা করার সময় সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকে। বৌদ্ধরা পালি মন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। সনাতন ও বৌদ্ধ উভয় ধরে. গুর্খাদের বিশ্বাস অত্যন্ত গভীর! শুধু তাই নয়, সনাতনী গুর্খারা গৌতম বুদ্ধকে নারায়ণের অবতার রূপে মান্য করে।

গুর্খাদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রীশ্রী কালী পূজা, দিওয়ালী (ভাইটিকা), শ্রীশ্রী দূর্গা পূজা (দশই) ও শ্রীশ্রী শিব পূজা এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি। শ্রীশ্রী কালী মায়ের পুজো হয় মােট ২ দিন। প্রথম দিন ধেউসি, ২য় দিন ভইলাে।

পাড়ার সকল যুবকযুবতী এই দিনে সন্ধ্যার পর দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মা কালীর গুণগান ও আশীর্বাদ বা মঙ্গল কামনা করে থাকে। তারা বিভিন্ন সাজগােজ করে হাতে বাদ্যযন্ত্র তথা মাদলের সুরে জয় পতাকা হাতে নাচতে নাচতে দলনেতা গাইতে থাকে – “আয়াে হামিরু (আমরা এসেছি)।” সকলে বলে উঠে-“ধেউসিরে।” দলনেতা আবার বলে-“দাজুকো ঠাউমা (দাদার বাসাতে)।” সকলে বলে-“ধেউসিরে।” দলনেতা আবার বলে-‘দিউয়ালি রাতমা সকলে বলে-“ধেউসিরে।” দলনেতা পুনরায় বলে-“দিনছকে দিন না।” সকলে বলে-“ধেউসিরে।” দলনেতা বলে-“এক বােতল রকসি (এক বােতল মদ)।” সকলে একইভাবে বলে “ধেউসিরে।” দলনেতা তখন বলে- “একশ রুপিয়া ধেউসিরে” ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছন্দে ছন্দে বলার কারণে সেখানকার পরিবেশে এক মাদকতার সৃষ্টি হয়। অতপর ঘরের মালিক তার সাধ্যমত আগত দলকে আপ্যায়িত করে। যাওয়ার সময় তা আবার একইভাবে গৃহকর্তাকে আশীর্বাদ দিয়ে থাকে।

সময়ের ব্যবধানে এসব আজ হারাতে বসেছে। এখন গুর্খাদের সাথে অপরাপর জাতির ছেলে-মেয়েদের দিওয়ালী রাতে ভুল উচ্চারণে নেপালি কথামালা ও তাদের সরল উচ্ছলতা অনেক গুর্খাকে উজ্জীবিত করে তারা ফিরে যায় সেই দিনগুলােতে যখন এ পার্বত্য জনপদ তাদের আদিপুরুদের পদচারণায় মুখরিত ছিল।

ভাবনার সাগরে হারিয়ে যায় তারা, আর ভাবে, তাদের আদি পুরুষগণের সহজ সরল জীবন জীবিকা ও অসচেতনতার কারণে এই তাদের উত্তরসূরিরা আজ অবহেলিত, সুযােগ-বঞ্চিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খারা প্রতিবছর শ্রীশ্রী সংসারী মায়ের তথা গঙ্গা মায়ের পূজো করে থাকে। সাধারণত এপ্রিল মাসের পূর্বে গ্রামের সর্বস্তরের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য পশুবলীর মাধ্যমে এ পুপো করা হয়। গ্রামের সকলের সাধ্যমত প্রদেয় অর্থ ও ভােজ্য সামগ্রী দিয়ে প্রসাদ রান্না করে পুজো করা হয় ও পুজো শেষে গ্রামের সকলে (মহিলা ছাড়া) প্রসাদ গ্রহণ করে আগামী দিনের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে থাকে।

বর্তমানে এই আচার অনুষ্ঠানে গ্রামের তথা জেলরােড, মাঝেরবস্তি ও আসামবস্তির সকল সম্প্রদায়ের ভক্তবৃন্দদের যােগ দিতে দেখা যায়। পুজোর জন্য উৎসর্গ করা পশুকে খড়গ দিয়ে এক কোপে কাটতে হয়। যদি এক কোপে ধর হতে মাথা বিচ্ছিন্ন না হয় তবে পুজোয় ত্রুটি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয় ও অমঙ্গলের আশঙ্কা করা হয়।

গুর্খাদের সংস্কার

ক. খাওয়া দাওয়া করার সময় কেউ তাকিয়ে থাকলে এবং খাওয়ার পর পেট ব্যথা ও পায়খানা শুরু হলে অনেকে বলে থাকে নজর লেগেছে। ছােট্ট শিশুকে দেখে কেউ কোলে নিয়ে বললাে—বাহ্ বেশ সুন্দর তাে! যেই না বলা পর দিনই যদি শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা কারাের সুন্দর মুখশ্রী দেখে কেউ বলে—তােমার চেহারা যা সুন্দর, তার পরদিনই লােকটির মুখে ব্রণ ওঠা আরম্ভ হয়ে যায়; তাহলে এটা হলাে নজর লাগা।

এসব ক্ষেত্রে গুর্খারা নজর ফেলার আয়ােজন করে। বোঁটাসহ ৭টি লাল শুকনা মরিচ হাতে নিয়ে একদমে নজর লাগা শিশুর মাথা হতে পা পর্যন্ত ছুঁইয়ে সাতবার মন্ত্র পড়ে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিতে হয়। স্বাভাবিক মরিচ পােড়ার গন্ধের চাইতে যদি কম গন্ধ লাগে তবে বুঝতে হবে কাজ হয়েছে।

খ. পাড়ায় রাতে বা দিনে যদি কুকুর সুর করে ডাকে বা কাঁদে তবে পাড়ায় অমঙ্গল আশঙ্কা করা হয়। কাক ও কুকুরের আচরণের প্রতি লক্ষ রেখে ভবিষ্যত গণনা করার বিষয়টি গুর্খা সমাজে প্রচলিতসে কারণে আগেকার দিনে কাক ও কুকুরের পুজো করা হতাে বলে জানা যায়।

গ. গুর্খা সমাজে গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ। গাই গরুর দুধকে মাতৃদুগ্ধের সাথে তুলনা করে গুর্খারা গরুকে মান্য করে থাকে।

ঘ. গুর্খারা কাপড় শুকানাের দড়ির নিচ দিয়ে আসা যাওয়া করে না। পৈতাধারী গুর্খারা স্বগােত্রীয় ছাড়া অন্য কারাে ছোঁয়া খেতে ও পড়তে পারে না। ঘর থেকে বেরােনাের সময় কোনাে কিছুতে ধাক্কা লাগলে বা বাধা পেলে যাত্রা স্থগিত করা হয়। মেয়েদের পায়ের পাতা সমান হলে অপয়া বলে ধরে নেয়া হয়।

ঙ. বিষুর আগে আম, কাঁঠাল খেলে অকল্যাণ হয়।

গুর্খা জাতির সামাজিক উৎসব

গুর্খাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চৈতে দশই (বিষু) উৎসব। এছাড়া বাচ্চার নামকরণ অনুষ্ঠান, ভাতটুয়ানি উৎসব ইত্যাদি উৎসবও সামাজিক উৎসবের মতাে ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।

গুর্খাদের চৈতে দশই (বিষু)

নাম দিয়েই বােঝানাে হয়েছে পর্বটি চৈত্র মাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। চৈত্র মাসের শেষ দিনে এ সামাজিক উৎসবটি গুর্খারা পালন করে থাকে। এ দিনে গুর্খারা সারা বছরের ভালাে-মন্দ কৃত কর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্ত (নৌরান) কষে থাকে। তারা সেদিন আমিষ ভােজন থেকে বিরত থাকে। নিরামিষ খাদ্য খেয়ে থাকে।

উৎসবের পূর্ব দিনে তারা সকালে ফুল দিয়ে যার যার গৃহসজ্জা করে থাকে, সে দিনটিকে বলা হয় ফুল বিষু। সে দিন গুর্খারা সকালবেলা স্নান করে পবিত্র হয়ে গুরুজনদেন প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে থাকে। কেউ কেউ গুরুজনদের স্নান করিয়ে দেয়, পা ধুইয়ে দেয়। সেদিনে গুর্খারা কোনাে অবস্থাতেই কারাে সাথে খারাপ ব্যবহার করে না।

প্রতিবেশীদের নিজ গৃহে আমন্ত্রণ জানিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। সকলের প্রতি মৈত্রী ভাবনা করে। এর পরের দিন নতুন বছরের প্রথম দিনে পরিবারের সকলের জন্য ভালাে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়, আনন্দ ফুর্তির আয়ােজন করা হয়। তারা বিশ্বাস করে বছরের প্রথম দিনটি যদি ভালাে কাটে তবে সারা বছরটাই ভালাে কাটবে। এখনাে এ উৎসবটি পালন করা হয়।

গুর্খা ভাষা ও বর্ণমালা

গুর্খাদের ভাষাকে নেপালি ভাষাও বলা হয়। নেপালি ভাষা ইন্দো-এরিয়ান ভাষা পরিবারভুক্ত। নেপাল, ভুটান, বার্মা ও ভারতে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখের মতো লােক নেপালি ভাষায় কথা বলে। নেপালি ভাষাকে আগেকার দিনে ‘খাস কুরা’ ভাষা নামে বলা হতাে যা ত্রয়ােদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে খাসা রাজ্যের (বর্তমানে নেপাল) ভাষা হিসেবে বিবেচিত।

নেপালি ভাষা দেবনাগরী বর্ণমালায় লেখা হয়। দেবনাগরী বর্ণমালা একাদশ শতাব্দীতে ব্রক্ষ্মী লিপি থেকে উৎপত্তি ঘটেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকার গুর্খারা পরস্পরের সাথে নেপালি ভাষায় কথা বলে থাকে। গুর্খারা দেবনাগরী বর্ণমালা ব্যবহার করে। তবে সংখ্যার স্বল্পতা ও চর্চার অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের মধ্যে উক্ত বর্ণমালা ব্যবহার হয় না। গুর্খা ভাষায় গান, কবিতা ও সাহিত্য চর্চা করা হলেও তা লিখিত রূপ হলে করা হয় বাংলা বর্ণমালা।

দেবনাগরী বর্ণমালা ব্যবহারের কোনাে চেষ্টা-চরিত্র করা হয়নি বললেই চলে। তবে দেবনাগরী বর্ণমালা জানে এরকম কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ লােক গুর্খাদের মধ্যে রয়েছে। অনুরূপভাবে নেপালি ভাষা ব্যাবহারও গুর্খারা দিন দিন হারিয়ে ফেলছে।

ইতােপূর্বে গুর্খা অহমিয়াদের অত্র এলাকায় হয় সংখ্যাধিক্যের কারণে উভয় জাতির ভাষার প্রভাবে শুদ্ধ বাংলা, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মিলিয়ে একটি জগাখিচুরী ভাষার উদ্ভব ঘটে। যেমন :

বাংলা
ভাত খেয়েছ?
কোথায় যাবে?
এদিকে এসাে।
গতকাল রাতে ঘুম হয়নি।

নেপালি
ভাত খাইছে?
কুন্দি যাইব?
ইন্দি আয়।
কালকা ঘুম ন হইছে।

এখানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মতাে ‘ন খাই’, ‘ন যাই’ নিয়মটি উল্লেখযােগ্য। তাছাড়া বাংলায় কালকে অর্থাৎ আগামী কাল বােঝাতে বলা হয়েছে কালকা যা শুধুমাত্র আকার একারের পার্থক্য।

ভাষাটি বর্তমানেও মাঝেরবস্তি, আসামবস্তি, গর্জনতলী এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গুর্খারা নিজেদের মধ্যে নেপালি ভাষায় কথা বলে থাকে। যেমন :

বাংলা
আপনার নাম কি?
তােমার নাম কি?

নেপালি
তঁপাই কো নাম কে হাে?
তিমরাে নাম কে হাে?

বাংলার মতাে এখানেও আপনি তুমি রয়েছে। ভাত খেয়েছেন? মাম খাকছ? ভাত খেয়েছ? মাম খায়? এখানে বাংলার মতাে খেয়েছেন, খেয়েছে বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে বাংলা ভাষার প্রভাবে এই কথ্য ভাষাটিও মিশ্র বলা চলে। তবে আশার কথা হচ্ছে যেহেতু বাংলা এবং নেপালি ভাষা একই ভাষা পরিবারভুক্ত, সে কারণে শব্দ এবং ব্যাকরণজনিত সামঞ্জস্যতার কারণে নেপাল থেকে আগত নেপালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে আলাপচারিতা করতে পারে।

গুর্খা জাতির লােক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য

গুর্খা রূপকথা ও লােককাহিনী

গুর্খাদের রূপকথা অনেকাংশে আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পৃক্ত। কথিত আছে, গুর্খারা আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ গুরু গােরকনাথের শিষ্য। গুরু গােরকনাথ ছিলেন সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তখনকার দিনে আধ্যাত্মিক শক্তির বহুল চর্চা ছিল গুর্খা সমাজে। কথায় কথায় যার যন্ত্র চালাচালি ছিল নিত্য ব্যাপার।

মন্ত্রশক্তির ব্যবহার করে তারা ইচ্ছা গলে বাঘ, ভাল্লুক হতে পারতাে। কিন্তু কেউ কাউকে তাদের স্ব স্ব বিদ্যার বিষয়ে জানাতো না। এমন কি চারবারের কাউবেই এ বিষয়ে জানাতে পারতাে না। কারণ বিষয়টি জানাজানি হলে সেই আধ্যাত্মিক শক্তি আপনা আপনি চলে যেতাে।

একদিন এমন এক গুর্খার পরিবারে তার স্ত্রী বায়না ধরলাে হরিণের মাংস খাওয়া জন্য। অগত্যা স্ত্রীর কথা রাখার জন্য সেই গুর্খা ভাবলাে একটি হরিণ মেরে নিয়ে আসবে। সে গোপনে মন্ত্র গড়ে একমুঠো চাউল ও একটি পাত্রে অল্প পানি নিয়ে তার স্ত্রীকে বললাে- ‘রাতে বাসার কাছে একটি বাঘ একটি হরিণ মেরে নিয়ে আসবে তখন তুমি সেই বাঘের গায়ে এই চাউল আর এই পানিটুকু ছিটিয়ে দিও, ভয় পেওনা সেই বাঘ তােমার কোনাে ক্ষতি করবে না। পারবে তাে? স্ত্রী বললাে—পারবে।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সেই গুর্খা বললাে-“আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।” সেই মন্ত্র শক্তিধারী গুর্খা বাড়ির পেছনে গিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করা মাত্র ধীরে ধীরে এক বিশাল বাঘেপরিণত হয়ে গেল। আর একলাফে জঙ্গলে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর একটি বিশাল হরিণ মেরে মুখে করে তার বাড়ির কাছে এসে ঘরের দরজায় রেখে বাঘের আওয়াজ করে ভাবতে লাগলাে। তার স্ত্রী বাঘের আওয়াজ পেয়ে ভয়ে দরজা বন্ধ করে চুপ করে লুকিয়ে রইল। বাঘের গােঙানির শব্দে তার আধমরা অবস্থা। সে বিশ্বাস করতে পারল না যে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী বাঘ হয়ে তাকে আহবান জানাচ্ছে যাতে সে সেই মন্ত্র পড়া চাউল ও পানি তার গায়ে ছুড়ে দেয়।

এভাবে সারারাত বাঘরূপী গুর্খা, বাঘের গোঙানির শব্দে তার স্ত্রীকে ডাকলাে; কিন্তু হায় তার স্ত্রী ভয়ে তার স্বামীর নির্দেশ কোনােভাবেই পালন করতে পারলাে না। অবশেষে ভােরের আলাে ফুটে ওঠার আগেই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাঘ জঙ্গলে হারিয়ে গেল।

সে আর কোনােদিন মানুষের রূপ ধারণ করতে পারলাে না। তার স্ত্রী তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠলাে। ভােরে ঘরে দরজা খুলে দেখলাে একটি মরা হরিণ ঘরের সামনে পড়ে আছে। তার আর বুঝতে বাকি রইলাে না।

তখন সে মাথার চুল ছিড়তে লাগলাে আর নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসােস করতে লাগলাে। সে ভাবলাে যদি সে হরিণের মাংস খাওয়ার ভাই বায়না না ধরতাে তাহলে তার স্বামী বাঘ হয়ে হরিণ মারতে বনে যেত না, আম যদি তার স্বামীর কথায় বিশ্বাস রেখে ভয় না করে সেই মন্ত্র পড়া চাউল ও বাঘের উপর ছিটিয়ে দিত তা হলে তার স্বামী বাঘ হয়ে বনে হারিয়ে যেতো।

আশপাশের প্রতিবেশীরা সকলে ঘটনা জানার পর তাকে গালাগালি করতে লাগল। এভাবে অনেক নব তন্ত্রবিদ্যাধারী বিদ্যা পরীক্ষা করতে গিয়ে নিপেরা বা প্রতিপক্ষকে বাঘে পরিণত করে অপরিণত বিদ্যার কারণে পুনরায় স্বরূপে ফিরে আসতে পারেনি।

কথিত আছে, নেপাল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বহু বাঘ শিকারি মৃত বাঘের শরীরে লিঙ্গ ভেদে মানুষ ব্যবহার করে এমন কিছু চিহ্ন পেয়েছিলেন যারা দ্বারা এই রূপকথার সত্যতা মেলে। বিশেষ করে নিজের পরিবারের সদস্যদের পরই তারা এসব বিদ্যা পরীক্ষা করতাে জানাজানি হওয়ার জন্য।

এই রূপকথায় স্ত্রীদের অতি উচ্চাভিলাষী না হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সাথে সাথে নিজ স্বামীর উপর অগাধ বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

গুর্খাদের নাচ ও গান

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খারা নাচ, গান, শিল্পচর্চা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত পারদর্শী। বাংলাদেশ বেতার রাঙ্গামাটি হতে গুর্খা ভাষায় গান প্রচার হয়ে থাকে। নাট্য চর্চা গুর্খাদের মধ্যে নেই তবে নৃত্যচর্চায় গুর্খারা এগিয়ে। যে কোনাে অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের মধ্যে গুর্খাদের নৃত্যানুষ্ঠান দর্শকশ্রোতাদের অধিকতর আনন্দ দিয়ে থাকে।

তারা জন্মগতভাবেই শিল্প-সংগীত-নৃত্যের প্রতি আকৃষ্ট। রাঙ্গামাটিতে মঞ্জু রানী গুর্খা, মনােজ বাহাদুর, দিলীপ বাহাদুর, পংকজ বাহাদুর, প্রদীপ বাহাদুর লালে, হিমাদ্রী বাহাদুর, তনুশ্রী মানজি, শেলী থাপা ও বান্দরবানে অরুন শারকি প্রমুখ শিল্পীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তন্মধ্যে অরুণ শারকির ছেলে অর্জুন শারকি এটিএন বাংলার প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযােগিতায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছিল।

গুর্খাদের নিজস্ব ভাষায় ও বর্ণে সাহিত্যচর্চার মতাে পরিবেশ এখনাে গড়ে ওঠেনি। আদিবাসী গুর্খা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ্রীমতি মঞ্জুরানী গুর্খা, শুখাদের অধিকার ও বিবিধ সমস্যার বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখে আসছেন। এছাড়া বাংলা অক্ষরে ২/৪টি গুর্খা গান, কবিতা লেখা হয় এবং সেসব উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকাশনায় ও স্থানীয় ২/১টি প্রকাশনায় প্রকাশ হয়ে থাকে। কেউ কেউ নেপালি/গুর্খা ভাষায় গানও রচনা করে থাকেন।

জনগােষ্ঠীর সংস্কৃতি বিকাশে গুর্খা সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী গঠিত হয়েছে। এই সংস্থা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ সংস্থার উল্লেখযােগ্য সফল কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রতি বছরে অনুষ্ঠিত বিজু র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সফল অংশগ্রহন ও গুর্খা শিল্পীদের দক্ষ পারফরমার হিসেবে গড়ে তােলার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান। রাঙামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট গুর্খা জনগােষ্ঠীর উপর আজ অবধি কোনাে বই প্রকাশ করেনি।

গুর্খাদের প্রবাদ প্রবচন

গুর্খা সমাজে প্রবাদ প্রবচনের বহুল প্রচলন রয়েছে। কিছু কিছু প্রবাদ প্রবচন ভিন্ন আঙ্গিকে অন্য সমাজেও দেখা যায়। বাংলা অনুবাদসহ নিয়ে প্রবাদ প্রব উদাহরণ দেয়া গেল-

গুর্খা প্রবাদ প্রবচনবাংলা অনুবাদ
কোসকো কে কো ধান্দা,
ঘর জুঁয়াই কো খানে কো ধান্দা
গাঢ় মা ছয়না লাত্তা, যানু মাঙছ কলকাত্তা

না ঘরকা না ঘাটকা
ছড়া হুনে কয়লে কয়লে কন্দনি

বাইরা বাইরা নয় নয়া সুট
ভিতরো ভিতরো ভুইমা সুত
কার কি ধান্দা, ঘর জামািই এর
শুধু খাওয়ার ধান্দা
গায়ে পরনের কাপড় নাই,
যেতে চায় কোলকাতায়
না ঘরের না ঘাটের
বাটনে পয়লে পয়লে ছেলে কখন হবে
ছিক নাই কোমরের সুতা পাকাচ্ছে আগে আগে
বাইরে নতুন কাপড় পরে, আর ঘরের
ভিতরে মাটিতে শোয়।

গুর্খাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার

গুর্খাদের পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারাদি ঐতিহ্যমণ্ডিত। কিন্তু কালের আবর্তে এসব ঐতিহ্যবাহী পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারাদির ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশের প্রচলিত পােশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় গুর্খারা হাতে বােনা কাপড় ব্যবহার করতাে।

গুর্খা বা নেপালি টুপি গুর্খাদের পরিচিতির নিদর্শন। ঐতিহ্যবাহী পােশাকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গােত্রের ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের পােশাক রয়েছে। গুর্খা নারীদের মুজেত্র (মস্তকবন্ধনী), পছউরি (ওড়না), চোলাে (ব্লাউজ), হেমবাড়ি (বক্ষবন্ধনী), ফরিয়া (শাড়ি), পটুকা (কোমর বন্ধনী) ইতাদি পােশাক তৈরি করা হয় রঙবেরঙের নানা কারুকার্য ও ডিজাইন দিয়ে। পুরুষদের নিকট দৌরাসুরা (পায়জামা), ফতুয়া, ইস্টকোর্ট ইত্যাদি বেশ আকর্ষণীয়।

গুর্খাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রের মধ্যে আগেকার দিনে নিম্ন গােত্রের গুর্খারা মাটির পাত্র ব্যবহার করতাে, উচ্চবর্ণের গুর্খারা ব্যবহার করতাে কাসা, পিতলের তৈজসপত্র।

গুর্খাদের খাদ্যাভ্যাস

গুন্দ্রুক ও ছিনকি, মূলা দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ খাদ্য, যা গুর্খাদের নিকট অতি প্রিয়। গুর্খা সমাজে মদ একটি অত্যাবশ্যকীয় পানীয়; যা জন্মে, বিবাহে ও মৃত্যুতে অপরিহার্য। গুর্খারা মদকে বলে রকসি। মাংসের মধ্যে শূকরের মাংস সাধারণ খাদের প্রিয়। তবে উচ্চবর্ণের অনেকে শূকরের মাংস খায় না, এমনকি অনেকে মুরগির মাংসও খায় না।

গুর্খাদের খেলাধুলা

গুর্খাদের মধ্যে গুলি ডাণ্ডা, গুলালি (মটেংরা-মাটির মার্বেল), কবাডি, ষােলগুটি, থরকি (পাশা); কৌড়ি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী খেলা, যা তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

ক. গুলি ডাণ্ডা : বাংলায় বলা যেতে পারে ডাংগুলি খেলা।
খ. গুলালি : এটিকে চাকমা ভাষায় বাদল বলা হয়ে থাকে। মার্বেল আকৃতির মাটি দিয়ে তৈরি ও আগুনে পুড়িয়ে বানানাে গুলি (মটেংরা) এ গুলালি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুর উপর ছােড়া হয়। এভাবে প্রতিযােগিতা হতাে বিশেষ করে আগেকার দিনে। এটি আসলে একটি শিকার যন্ত্র।
গ. কবাডি : এ খেলাটি বাংলার কাবাডি খেলার মতাে। গুর্খা জনগােষ্ঠীর মধ্যে এ খেলাটি বেশ জনপ্রিয়।
ঘ. ষােলগুটি : গ্রামে সাধারণত অলস দুপুরে গাছের ছায়ায় মাটিতে ২ পক্ষের ৮টি করে ছােট ছােট গর্ত করা হয়। সেই গর্তে ১৬টি গুটি সাজিয়ে এই খেলা খেলা হয়। এই খেলাটি চাকমাসহ অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মধ্যে খেলতে দেখা যায়।
ঙ. থরকি (পাশা) : খেলাটি অনেক পুরানাে। হিন্দু রাজা/জমিদারদের মাঝে এ খেলাটি প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে খেলাটি গুর্খাদের মাঝে প্রচলন ঘটে। খেলাটি অনেকাংশে লুডু খেলার কাছাকাছি।
চ. কৌড়ি : এ খেলাটিকে বাংলায় কড়ি খেলা বলা হয়। ৪টি কৌড়ি নিয়ে এ খেলাটি খেলা হয়। দুই জনের অধিক অংশগ্রহণকারী এ খেলাটি খেলতে পারে। দান ফেলার পর ২টি কড়ি পরস্পর আঘাত করাতে পারলে ১ পয়েন্ট পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতি খেলায় ২ পয়েন্ট। তবে যদি দান ফেলার পর ৪টি কড়ি উল্টে থাকে তবে প্রতিটি কড়ি ৪ পয়েন্ট। কড়ি ফেলার সাথে সাথে উল্টে থাকা কড়ি যে আগে নিতে পারে সে তত পয়েন্ট অর্জন করে। বেশি পয়েন্টধারী খেলায় বিজয়ী হয়।

গুর্খা জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা

পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খারা শিক্ষাদীক্ষায় এখনাে পিছিয়ে রয়েছে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে গুর্খাদের মধ্যে অশিক্ষা প্রবলভাবে বিরাজ করছে। গুর্খারা শহর এলাকায় বসবাস করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেকটা প্রদীপের নিচে মত তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত।

গুর্খা সমাজে শিক্ষার হার কী রকম সে রকম কোনাে সরকারি বা বেসরকারি কোনাে তথ্য জানা নেই। তবে অনুমান করা হয় যে, তাদের শিক্ষার হার বড়জোর ১৫% হতে পারে। তবে আশায় কথা যে, গুর্খাদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা ইদানীং বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানাের আগ্রহ বর্তমানে উল্লেখযােগ্য পরিমাণে লক্ষ করা যাচ্ছে।

গুর্খাদের মধ্যে ইদানীং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা লক্ষণীয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক চেয়াম্যান শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা মহােদয়ের কল্যাণে উচ্চশিক্ষায় কোটা প্রাপ্তির কারণে কিছু কিছু গুর্খা ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযােগ পাচ্ছে।

এই প্রবন্ধের লেখকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিসংখ্যান চালিয়ে জানা গেছে যে, তাদের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রধারী আছেন ১১ জন যাদের মধ্যে বান্দরবান থেকে নির্বাচিত একজন জাতীয় সংসদ সদস্য রয়েছেন।

এর মধ্যে এমবিএ ডিগ্রিধারী দুজন ব্যক্তি ব্যাংকে চাকরিরত স্নাতক ডিগ্রিধারী রয়েছেন ৭ জন যাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্কুলের শিক্ষক এমবিবিএস পাশ করা চিকিৎসক আছেন একজন। এছাড়া একজন এমবিবিএস কোর্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী একজন ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করছেন।

বর্তমানে কিছু গু ছেলেমেয়ে কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের মধ্য থেকে এখনাে বিসিএস ক্যাডারের কোনাে কর্মকর্তা নেই।

উল্লেখ্য যে, উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউএনভিপি কর্তৃক যে অস্ট্রেলিয়ান স্কলারশিপ দেয়া হয় সেখানে এখনাে কোনাে গুর্খা শিক্ষার্থী সুযােগ লাভ করেনি। চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের পার্বত্য এলাকার আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ইউএনডিপির বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পেও গুর্খা জনগােষ্ঠী থেকে কেউ চাকরি লাভ করেনি।

গুর্খা নারীর অবস্থা

গুর্খা সমাজে নারীদের সম্মান করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে ধর্মীয় দিক থেকে গুর্খাদের আরাধ্য শ্রীশ্রী মা দুর্গা তথা মহামায়ার মতাে গুর্খা সমাজে নারীকে দেখা হয়। তবে সামাজিকভাবে গুর্খা নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার। নারী হিসেবে সন্তান লালনপালন, ঘরসংসার দেখাশােনার কাজ করতে হয়।

কিন্তু সমাজে এসব কাজের কোনাে স্বীকৃতি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খা নারী তথা পার্বত্য আদিবাসী নারীদের সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে নানা সামাজিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের চাকরি করা সমাজে ভালাে চোখে দেখা হয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তােলে গুর্খা নারীদের চাকরি ও বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে।

সাধারণ গুর্খাদের মধ্যে ঘরসংসার ভরণপােষণের জন্য মদ তৈরি ও বিক্রি করার কাজও নারীদের করতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবারে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।

অন্যান্য সমাজের মতাে গুর্খা সমাজেও এখনাে সুক্ষ্মভাবে কন্যা সন্তানের প্রতি সামাজিক বৈষম্য রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। পুত্র সন্তান জন্ম হলে আনন্দ উৎসবের আয়ােজন করা হলেও কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে তা করা হয় না। তবে আশার কথা বর্তমানে গুর্খা সমাজে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার বেশি।

তা সমাজে সাধারণভাবে সম্পত্তির উপর পুত্র সন্তানকে উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে পিতামাতারা সাধারণত তাদের সন্তানদের সমানভাবে সম্পত্তির ভাগ দিয়ে থাকে।

গুর্খা সমাজে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপােষণের অধিকারী হয়। একজন গুর্খা নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা উপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে।

বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট হতে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহিত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর নিকট হতে খােরপােষ লাভের অধিকারী করা হয়। বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে। আমার দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখে।

পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংসক হলে অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারীমান আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ লাভের অধিকারী হয়।

গুর্খা জাতির রাজনৈতিক সংগঠন

গুর্খা জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে। রাজনৈতিক সচেতন অভাবের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খাদের মধ্যে স্বজাতীয়তাবােধের অভাবও প্রকট। ফলে খাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও বিকাশ ঘটেনি।

স্বজাতীয়তাবােধে সংগঠিত ও উজ্জীবিত করার মতাে নেতা-নেতৃত্ব গুর্খা সমাজে গড়ে উঠেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের গুর্খারা সংখ্যায় স্বল্প হলেও একটি জনগােষ্ঠী হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে স্বাভাবিকভাবে গুর্খাদের মধ্যে কোনাে রাজনৈতিক প্রয়াস সংগঠিত হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে গুর্খা জনগােষ্ঠীর জন্য কোনাে সদস্যপদ সংরক্ষিত নেই।

গুর্খা জনগােষ্ঠী থেকে আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক কুলগুলােতেও অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। বান্দরবান জেলা থেকে আওয়ামী লীগের মনােনয়নে তা জনগােষ্ঠীর শ্রী বীর বাহাদুর জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেও তা বলা যায় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

তবে আশার কথা যে, গুর্খা জনগােষ্ঠার কিছু সংখ্যক ব্যক্তি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও এর অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়।

সার্বিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুর্খারা চরমভাবে অবহেলিত। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে গুর্খাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ শুধু অনিশ্চিত নয়, বাংলাদেশের এক নাগরিক হিসেবে গুর্খাদের মৌলিক অধিকারও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। পার্বত্য এলাকায় সকল জনগােষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও উন্নয়ন সুনিশ্চিতকরণ, ন্যায়ের – মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে গুর্খাদের স্বীকৃতি অত্যাবশ্যক। এটি গুর্খাদের প্রাণের দাবি। বর্ণিত আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনসমূহে একটি সংশােধনী এনে এটা করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।

টীকা

১. ‘এ ফ্লাই ওন দ্য হুইল’ ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন
২. ড. রাজেস গৌতম ও অশােক কে থাপা-মগর কর্তৃক লিখিত ট্রাইবাল এথনােগ্রাফি অফ নেপাল ভুলিইম-২
৩. Khas Kura

তথ্যসূত্র

১. লুইন, ক্যাপ্টেন টি এইচ, (চাকমা, অধ্যাপক হিরহিত অনূদিত), চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৬।
২. Dr. Rajesh Goutam and Ashoke K Thapa-Magar, Tribal Ethnography of Nepal vol. II.
৩. http://en, wikipedia.org/wiki/gorkha, and other related sites.
৪. Open Discussion with the following Local Aged Gurkha peoples-
a. Mr. Khole Bahadur Thapa, Manjhi Basti, Rangamati.
b. Mrs. Lila Devi Newar, Manjhi Basti, Rangamati.
c. Mrs. Putul Devi Chetri, Assambasti, Rangamati.
d. Mrs. Rubi Rani Rai, Manjhi Basti, Rangamati.
e. Mrs. Manju Rani Gurkha, Gurkha Cottege, Jail Road, Rangamati.

লেখকঃ মনােজ বাহাদুর মানজি

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা