মাতাই তুয়ারি (মাতাই পুখির): কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাস

Jumjournal
Last updated Dec 4th, 2019

1068

featured image

মাতাই তুয়ারি (মাতাই পুখির): কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাস

(নোট: এই লেখায় আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোন প্রতিফলন নেই। লেখাটিতে স্মরণাতীত কাল থেকে প্রচলিত একটি লোকবিশ্বাসের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।)

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সদর উপজেলাস্থ নুনছড়ি মৌজায় অবস্থিত সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ৭০০ ফুট উপরে প্রায় সাড়ে ৫ একর জায়গা জুড়ে বিদ্যমান প্রাকৃতিক হ্রদ মাতাই তুয়ারি বা মাতাই পুখির বাংলাভাষি ও পর্যটকদের কাছে হ্রদটি দেবতার পুকুর নামে অধিক পরিচিত।

পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে থাকা এই পবিত্র জলাশয়টি দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় হাজার ফুট এবং প্রস্থে ছয়শত ফুট। এই প্রাকৃতিক জলাশয়টির গভীরতা নিয়ে রয়েছে নানা লোখশ্রুতি।

কথিত আছে, রেবতী রঞ্জন নামের জনৈক হিন্দু ভদ্রলোক স্থানীয় লোকদের সাহায্যে বাঁশের ভেলায় চড়ে এই হ্রদের মাঝখানের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেন।

কিন্তু দড়ি তল পর্যন্ত ঠেকাতে পারেননি। বরং ভেলাসহ ডুবে যায় যায় অবস্থা হওয়াতে একটা ছাগল মানত করে গভীরতা নির্ণয়ের চেষ্টা ত্যাগ করেন।

এই প্রাকৃতিক হ্রদকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে নানা লোককাহিনী।

সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রকৃতি পূজারি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির বিশ্বাস অলৌকিক কোন শক্তির প্রভাব রয়েছে বলেই হ্রদটি উঁচু একটি পাহাড়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং এই হ্রদের জল কখনও শুকোয় না।

অনেকের বিশ্বাস, স্বয়ং জল দেবতা স্থানীয় গ্রামবাসীদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য এই হৃদ সৃষ্টি করেছেন। তাই স্থানীয়দের কাছে এটি আর্শীবাদস্বরূপ।

হ্রদের চারিদিকে ঘন বন ও মালভূমি দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এই হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে এর উচ্চতা অনুভব করা যায় না।

প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা তীর্থযাত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষের সমাগম ঘটে এই হ্রদে।

ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, এই হ্রদে স্নান করলে এবং নানা মানত করলে মনোবাসনা পূরণ হয় এবং নানা রোগ ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়া যায়। ত্রিপুরাদের কাছে হ্রদটি একটি তীর্থস্থান।

অনেকের ধারণা, পুরাকালে এই হ্রদটি স্বয়ং দেব- দেবীরা রক্ষণাবেক্ষন করতো এবং সবসময় পাহারা দিয়ে রাখতো।

বিবাহসহ সামাজিক বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নের জন্য এই হ্রদের পাড়ে এসে পবিত্র মন নিয়ে প্রার্থনা করলে সোনার বাসন-কোষন পানির উপর ভেসে উঠতো।

সামাজিক কাজ সম্পন্ন করে গ্রামবাসীরা আবারও সেই সোনার বাসন- কোষন ফিরিয়ে দিত।

কোন এক অসৎ গ্রামবাসীরা শপথ ভঙ্গ করে হিসেব মতে বাসন ফিরিয়ে না দেওয়ার পর থেকে দেবতারা রুষ্ট হয় এবং আর গ্রামবাসীদের বাসন কোষন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বলে কথিত রয়েছে।

অন্য এক প্রচলিত বিশ্বাস মতে, পুরাকালে এই পাহাড়ে পাশাপাশি দুইটি ত্রিপুরা লোকালয় ছিল; উদয় কারবারি পাড়া ও ধন্য কারবারি পাড়া।

উদয় কারবারি পাড়ার জনৈক বাসিন্দা একসময় এই পাহাড়ে জুমচাষের উদ্যোগ নেন। এই সময় তাকে স্বপ্নাদেশ দেওয়া হয় এই পাহাড়ে জুম চাষ না করার জন্য।

কিন্তু জুমিয়া ব্যক্তিটি সেই স্বপ্নাদেশ আমলে না নিয়ে জুম চাষ করেন। স্বপ্নে বারবার তাকে নিষেধ করা হয়।

শেষে যখন জুমের ফসল তোলার সময় আসলো, তখন তিনি আবারও স্বপ্নাদ্দিষ্ট হলেন।

তখন তাকে নরবলি দিয়ে তবেই জুমের ফসল কাটার জন্য আদেশ দেওয়া হয় এবং নরবলি দিলে জুমের ফসলের পাশাপাশি আরও কিছু ধনলাভ করবেন বলেও স্বপ্নে জানানো হয়।

কিন্তু এই শর্ত পূরণ করা জুমিয়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর কিছুদিন পর এক অমাবস্যার রাতে সেখানে এক প্রলয়ংকরী ভূ-কম্পন দেখা দেয়।

সকালে উঠে সকলে দেখতে পায়, সেখানে জুমের পরিবর্তে বিরাট এক জলাশয়।

ত্রিপুরা লোককথা
ত্রিপুরা লোককথা

অন্য এক প্রচলিত লোকশ্রুতি ঘিরে রয়েছে ধন্য কারবারির এক ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে। জানা যায়, ধন্য কারবারির ষোড়শী কন্যা একদিন কলসী কাঁখে একাকিনী ভরদুপুরে জল তুলতে গিয়ে দেখতে পায় জলাশয়টি পুরো জলশূন্য হয়ে রয়েছে এবং গভীর খাদে জলাশয়টির মাঝ বরাবর দুইটি সিন্দুক রোদে ঝকমক করছে।

সে কৌতুহলবসে পাড়ায় গিয়ে তার মা-বাবাকে বিষয়টি বলে। কিন্তু সকলে এসে দেখতে পায় জলাশয়টি আগের মতোই জলে ভরা।

এরপর থেকে কারবারির কন্যা প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখতে থাকে, কোন এক সুন্দরী দেবী তাকে তাঁর সাথে যাওয়ার ডাকছেন।

বারবার দেবীর আদেশ পেয়ে ষোড়শী কন্যা একদিন সুবাসিত তেল মেখে, বুনো ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে খোঁপা সাজিয়ে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হ্রদের জলে নেমে যায়।

পাড়াবাসীরা অবাক হয়ে দেখলো, মুহুর্তে এক পরীর মতো পরমা সুন্দরী নারী এসে তাকে কোলে করে জলাশয়ের মাঝখানে চলে গেলেন।

জল যেন তখন দু’ভাগ হয়ে তাদের রাস্তা করে দিল। অশ্রুসজল চোখে গ্রামবাসী সকলে এই দৃশ্য অবলোকন করলো।

এই জলাশয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটি ঘটনা লোকমূখে এখনও প্রচলিত। দিনটি ছিল ১৯৭৯ সালের চৈত্র সংক্রান্তির দিন।

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির সময় এখানে মেলা বসে। পূন্যার্থীরা সমবেত হয় মনোবাসনা জানিয়ে নানা পূজো অর্চনা করার জন্যে।

সবে পূজো আচার শেষ হয়েছে, অমনি জলাশয়ের মাঝ বরাবর জল সশব্দে নেচে উঠে।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক পরমা সুন্দরী জলকন্যা জলের উপর কোমর পর্যন্ত ভেসে উঠে এবং মুহুর্তে আবার জলে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই সময় উপস্থিত সকলে এই দৃশ্য অবলোকন করে।

আরো একটি জনশ্রুতি মতে, সেখানে এক বিধবা নারী বাস করতেন। একদিন গ্রামের শেষ প্রান্তের বটগাছের কোঠর হতে মস্তবড় এক অজগর সাপ পেয়ে গ্রামবাসী সকলে মহাভোজে মেতে উঠে।

মহাভোজকালে তারা দরিদ্র বিধবাকে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে যায়। রাতে দরিদ্র বিধবার স্বপ্নে এক দেবতা এসে তাকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলে। কারণ শেষ রাতে এই গ্রামে একটি অঘটন ঘটবে।

দেবতার আদেশ অনুযায়ী বুড়ি গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ভোর রাতে তিনি বিকট আওয়াজের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। সকালে গিয়ে দেখেন পুরো গ্রাম একটি সরোবরে পরিণত হয়েছে।

সকল গ্রামবাসী নিদ্রামগ্ন অবস্থায় এই সরোবরে মিলিয়ে যায়। হ্রদটিকে দেখলে সত্যিই কোন বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট একটি জলাধারের মতো মনে হয়।

সাম্প্রতিক সময়ের একটি অবিশ্বাস্য কাহিনী এখন বেশ জনপ্রিয়। সম্ভবত ২০১২ সালের বৈসুর সময় রাঙামাটির কিছু ত্রিপুরা পরিবার এই তুয়ারিতে বেড়াতে এসেছিল।

তাদের সাথে কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েও ছিল। তাদের মধ্যেকার এক ছেলে মাতাই পুখির ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রচারমূলক সাইনবোর্ডে জলাশয়ে ‘মুখ কুলি করে পানি না ফেলা’র অনুরোধ দেখে দুষ্টুমি করে কুলি করে মুখের পানি জলাশয়ে ফেলে দেয় এবং স্নানের সময় প্রস্রাব করে দেয় (সংগত কারণে নাম প্রকাশ করা হলো না)।

রাতে বাড়ি ফিরে ছেলেটির গায়ে প্রচন্ড জ্বর আসে এবং ফুসকার মতো এক ধরণের এলার্জি দেখা দেয়। ছেলেটির মা বিষয়টি জানতে পেরে মাতাই তুয়ারিতে পূজো দেওয়ার মানত করে ছেলেটির অসুখ ভালো হয়ে যায়।


লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

তথ্যসূত্রঃ ব্লগ লিঙ্ক 

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা