অস্তিত্বের জমিন যখন লুটেরাদের দখলে
1411
আদিবাসীদের ভূমি লুটেরারা দখল করে নিয়েছে, নিচ্ছে – এটা কোনো নতুন খবর নয়। জোর করে, ঠকিয়ে বা অন্য কোনভাবে আদিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করার ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই ঘটছে, ঘটে আসছে, বহু দশক; আসলে বহু শতাব্দী ধরে।
আসল খবর হল, লুটেরারা শুধু আদিবাসীদের ভূমি দখল করেই বসে নেই, তারা কেড়ে নিচ্ছে আরেক ধরণের জমিন–পরিচয়ের জমিন।
এই প্রবণতার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল, এদেশে বিভিন্ন মহলে জোর গলায় বলা হচ্ছে, “উপজাতীয়রা আদিবাসী নয়, বহিরাগত। এদেশে আমরা, বাঙালিরাই, রয়েছি হাজার বছর ধরে। আমরাই এখানকার আসল আদিবাসী।”
লক্ষ্যণীয় যে, বিশ বছর আগেও ‘আদিবাসী’ পরিচয় নিয়ে এই কাড়াকাড়ি অভাবনীয় ছিল, কারণ তখন শব্দটা বোঝাত ‘আদিম’।
কিন্তু কালক্রমে যখন ‘আদিবাসী’ হয়ে দাঁড়াল ‘ইনডিজেনাস পিপল’-এর প্রতিশব্দ, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় প্রতিশ্রুত কিছু অধিকারের বাহন, এর পেছনে দৌড়াতে শুরু করল অনেকে, আবার অনেকে শুরু করল এটিকে দাবিয়ে রাখার, মুছে ফেলার বা কেড়ে নেওয়ার জোর তৎপরতা, যার অংশ হিসেবে সাম্প্রতিককালে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস (আগস্ট ৯) ঘিরে তুঙ্গে উঠতে দেখা গেছে আদিবাসী-বিরোধী প্রচারণা।
উল্লিখিত তৎপরতা ও প্রচারণা কেন চালানো হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বেশি মাথা খাটানোর দরকার নেই। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের ভিত্তিতে যারা কিছু অধিকার দাবি করছে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়, তাদের সেই পরিচয় ও দাবি যদি নাকচ করে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের জিম্মায় যেটুকু ভূমি এখনও রয়েছে – মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে তা গিলে ফেলা যাবে অনায়াসে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই গিলে খাওয়ার জন্য কারা মুখিয়ে আছে? উত্তরে মোটা দাগে বলা যায়, এরা হচ্ছে সেই শ্রেণির অংশ যারা দেশজুড়ে ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে অনেক কিছুই; খাসজমি, নদী, খাল, বিল, হাওর, বন অনেক কিছু।
স্বাধীনতার পর গত চার দশকের মধ্যে ব্যাপক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে যেসব শ্রেণি ও গোষ্ঠী, আদিবাসীদের ভূমি দখলকারীরা তাদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে।
দেশের অন্যত্র যেমন, তেমনি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়ও ভূমিদস্যুরা তাদের দৌরাত্ন্য কায়েম করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায়। তবে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে একটা মৌলিক পার্থক্য বিশেষভাবে বিবেচ্য; তা হল, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে খোদ রাষ্ট্রই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে অবতীর্ণ হয়েছে ভূমিদস্যুর ভূমিকায়।
যেমন, ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম সীমান্তে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটা সীমানা টেনে বলল, “তোমরা যারা ‘পাহাড়ি উপজাতি’ [ব্রিটিশদের উদ্ভাবিত বর্গ] রয়েছ, এই সীমানার পূর্ব পাশে [ব্রিটিশ শাসনের আওতায় নিয়ে আসা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামের নতুন জেলায়] জুমচাষ চালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু পশ্চিমের পাহাড়গুলোতে আর নয়”, তখন তা ছিল সীতাকুণ্ডের মতো পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত জুমিয়া কৃষকদের জীবিকার ভিত্তি কেড়ে নেওয়া।
পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের চৌহদ্দির ভেতর এক চতুর্থাংশ ভূমিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র চিহ্নিত করেছিল ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ হিসেবে, যেখানে আইন করে পাহাড়িদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। সেই আইন (ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া অন্য অনেক কিছুর মতো) এখনও বলবৎ আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে আলোচনা চালিয়ে গেলে আমরা দেখব, সেখানে শুরুতে লাঙল চাষের প্রচলন একেবারেই ছিল না, কারণ একদিকে সমতলের (বাঙালি) কৃষকদের বসতি স্থাপনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, অন্যদিকে পাহাড়িদের প্রায় সবাই ছিল জুমচাষী।
তবে ব্রিটিশদের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পাহাড়িদের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ কর্ণফুলির উপত্যকাসহ অন্যত্র লাঙল দিয়ে চাষ করার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে।
ঠিক এ অবস্থায় ১৯৬০-এর দশকের প্রথমার্ধে তুলে নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতল অঞ্চলের কৃষকদের বসতি স্থাপনের উপর ব্রিটিশ আমলের বিধিনিষেধ।
আর একই সময়ে চালু হয় কাপ্তাই বাঁধ, যা ডুবিয়ে দেয় গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪০ শতাংশ প্রথম শ্রেণির কৃষিজমি এবং উদ্বাস্তু করে এক লাখ মানুষকে, যাদের অনেকে প্রতিশ্রুত পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ কোনোটার দেখা পায়নি।
ফলে অনেকে দেশান্তরীও হয়। একদিকে কাপ্তাই বাঁধের ধাক্কা, আরেকদিকে বাঙালি কৃষকদের ক্রমবর্ধমান স্রোত – এগুলির সঙ্গে কীভাবে সামাল দেবে পাহাড়ি সমাজের নেতৃবৃন্দ সেটা বুঝে উঠতে না উঠতেই ১৯৭০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ শুরু হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হাজার হাজার বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এনে বসিয়ে দেওয়ার কাজ, যারা ব্যবহৃত হয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর আদিবাসী-বৈরী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার নীলনকশা বাস্তবায়নের ক্রীড়নক হিসেবে।
এই নীলনকশার মূলে ছিল, রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির উপর শাসকগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন।
এ ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে স্থানীয় পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে একটা সমঝোতা হলেও যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয় তা হল, চুক্তির যে ক্ষেত্রগুলোতে গত দেড় দশকে সামান্যতম অগ্রগতি হয়নি তার অন্যতম হচ্ছে ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি।
এ লক্ষ্যে যে কমিশন গঠিত হয়েছে তা এখনও কার্যকরই হয়নি। তাই চুক্তির ফলে কোনো পাহাড়ি পরিবার তাদের হারানো ভূমি ফেরত পেয়েছে, এ রকম একটি নজিরও এখনও তৈরি হয়নি।
অন্যদিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাহাড়িরা এখনও উৎখাত হয়ে চলছে তাদের জিম্মায় থাকা জুমচাষের ভূমি থেকে শুরু করে তাদের গ্রাম ও বসতভিটা থেকেও।
প্রেক্ষাপট বা মাত্রায় ভিন্নতা থাকলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অন্যত্রও রাখাইন অধ্যুষিত উপকূলীয় এলাকা থেকে শুরু করে সিলেটের পাহাড়ি এলাকা, রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমি বা মধুপুরের গড় অঞ্চল – সবখানে আদিবাসীদের জিম্মায় থাকা ভূমি নানাভাবে তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে, যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে যে কোনো আলোচনায় তাদের ‘ভূমি’র প্রশ্নটাই সবসময় বড় হয়ে দেখা দেয়। তবে ভূমি হারানো আসলে আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র।
এর মূল কারণ নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পরিচয়ের জমিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া, ছেঁটে ফেলা বা মুছে দেওয়ার মধ্যে। ব্রিটিশরা আদিবাসীদের পরিচয়ের সীমানা বেঁধে দিয়েছিল কিছু প্রত্যয় দিয়ে – যেমন ‘আদিম’ ও ‘উপজাতি’- যেগুলো এখনও বহাল রয়েছে।
উত্তর-ঔপনিবেশিককালে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা, নতুন জাতীয় পরিচয় নির্মাণের প্রেক্ষিতে। যখন পাকিস্তানকে দেখা হয় মুসলমানের রাষ্ট্র হিসেবে বা বাংলাদেশ হয়ে ওঠে শুধু বাঙালির, তখন এদেশের আদিবাসীরা হয়ে যায় প্রান্তিক, এমনকি অদৃশ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতীয়তা ও বাংলা ভাষাকে যখন সাংবিধানিকভাবে করা হয় রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একক ভিত্তিভূমি, তখন তা করা হয়েছিল বাঙালি ছাড়া অন্যদের স্বতন্ত্র পরিচয় নাকচ করেই।
পরবর্তীকালে জাতীয় পরিচয় ও সংবিধান নিয়ে অনেক টানাহেঁচড়া হয়েছে, কিন্তু তা মূলত আবর্তিত হয়েছে এদেশের ‘সংখ্যাগুরু’ জনগণের পরিচয়ের দুটি প্রধান যে মাত্রা – বাঙালি ও মুসলমান – সেগুলির আপেক্ষিক গুরুত্বের প্রশ্ন ঘিরে।
সেখানে আদিবাসীদের পরিচয়ের প্রসঙ্গ সেভাবে ওঠেনি কখনও এবং তাদের সবসময় ‘জাতি’ ধারণার মূল মঞ্চ থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে ‘অনগ্রসর’দের কাতারে, নিচের দিকে থাকা ‘উপ-জাতি’ নামের একটা বেড়া দেওয়া জায়গায়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি’ নামে যে নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে, তা করা হয়েছে এই আসন-বিন্যাস অপরিবর্তিত রেখেই।
বলা হয়েছে, রাষ্ট্র উল্লিখিত জনগোষ্ঠীর ‘আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’; কিন্তু ভূমির সঙ্গে তাদের প্রথাগত সম্পর্ক সেই সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের অংশ কিনা, এ ব্যাপারে সংবিধানে কোনো দিকনির্দেশনা নেই!
প্রকৃতপক্ষে, যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে দেখা হয় ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট বাঙালি জাতির সংগ্রাম’ হিসেবে এবং বলা হয় যে বাংলাদেশের জনগণ ‘জাতি হিসাবে বাঙালি’ নামে পরিচিত হবে, তখন আদিবাসীরা জাতীয় মানসে অদৃশ্য, অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। এদিক থেকে দেখলে “উপজাতীয়রা নয়, বাঙালিরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী”– এই বক্তব্য অনেকটা বাহুল্যই হয়ে যায়।
যাদের অস্তিত্বই নেই, তারা আদিবাসী কি না, সে প্রশ্নই তো অবান্তর! উপজাতীয়রা ‘আদিবাসী’ কি না, প্রশ্নটি প্রথম জনসমক্ষে আসে মূলত ১৯৯৩ সালে, যা ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’, যার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, “এদেশের উপজাতীয়রা আসলে বহিরাগত, কাজেই বর্ষটি সরকারিভাবে পালনের কোনো প্রয়োজন নেই”।
যাহোক, জাতিসংঘ ঘোষিত বর্ষের সূত্রেই ‘ইনডিজেনাস পিপল’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘আদিবাসী’র ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় এদেশে। তবে ‘আদিবাসী’ বলতে যেহেতু ‘আদিম’ বোঝাত, ‘ইনডিজেনাস’ অর্থে এটিকে চালু করা ঠিক হবে কিনা, এ নিয়ে শুরুতে খোদ আদিবাসীদের মধ্যেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।
শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে আসে যে, আদিবাসী শব্দটির নেতিবাচক ব্যঞ্জনা থাকলেও এ নামে অভিহিত মানুষেরা নিজেরাই যদি এ পরিচয়কে সগৌরবে ধারণ করেন এবং ‘ইনডিজেনাস’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন, তবে তা তাদের দাবি আদায়ে সহায়ক হতে পারে।
এই প্রেক্ষিতে শুরুতে বাংলা ‘আদিবাসী’ শব্দটা নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু কীভাবে যেন সম্প্রতি সেখানে এটিকে বিপজ্জনক, ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য হুমকি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে যে বিষয়কে অবস্থান উল্টে ফেলার মতো মনে হয় তা হল, ১৯৯৩ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এবং পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসার পরও, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের নেতৃবৃন্দ ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করতেন নির্দ্বিধায় এবং ‘আদিবাসী বর্ষ’ থেকে শুরু করে ১৯৯৫ সালে সূচিত ‘আদিবাসী দিবস’ প্রভৃতি উপলক্ষে আদিবাসীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বহু বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়েছেন।
তাঁদের দল ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার বছর পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যে ‘আদিবাসী’ শব্দটা থেকে দূরত্ব বজায় রাখার প্রবণতা জনসমক্ষে দৃষ্টিগোচর হতে থাকে এবং ২০১১ সালে এসে সেটা আরও প্রকাশ্য রূপ নেয়।
এক্ষেত্রে নতুন যে মাত্রা সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ছিল তা হল, আদিবাসী-বিরোধী কথাবার্তা আগে যেখানে স্থূলভাবে উচ্চারিত হত ভূমিদস্যুবান্ধব পক্ষসমূহের সম্মুখ বা মধ্যমসারির প্রতিনিধিদের মুখে, সেগুলো ক্রমশ শোনা যেতে থাকে পরিশীলিত ও গণতন্ত্রমনা বলে বিবেচিত অনেক লোকজনের মুখেও, যাদের মধ্যে অধ্যাপক থেকে শুরু করে সাংবাদিক, আমলা, মন্ত্রী অনেকেই রয়েছেন।
তবে আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক ডিগবাজি মনে হলেও, এতে আসলে মৌলিক কোনো অবস্থানগত পরিবর্তন হয়তো কাজ করছে না।
বরং মনে হয়, এদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই মূলত ‘আদিম’ অর্থেই ‘আদিবাসী’ শব্দটা ব্যবহার করতেন বা এখনও করেন। এ অবস্থায় বিভিন্ন লেখালেখি ও সভা, সেমিনারের মাধ্যমে যখন শব্দটার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিবেচ্য অধিকার ও রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসতে থাকে, তখন অনেকের টনক নড়ে।
এ ধরণের ক্ষেত্রে যা হয়, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, জাতীয় স্বার্থ ইত্যাদির কথা বলে এবং ‘উপজাতীয়’দের প্রতি বাঙালি সমাজের উপরমহলে বিদ্যমান অজ্ঞতা ও উচ্চম্মন্যতার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেটলার’ হিসেবে পরিচিত ও তাদের সমশ্রেণির মানুষদের মধ্যে সঞ্চারিত বিদ্বেষ, ভীতি ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে লুটেরা শ্রেণির প্রতিনিধিরা আদিবাসী পরিচয়ের দাবি উল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে।
‘উপজাতীয়রা বাংলাদেশের আদিবাসী নয়’– এই প্রচারণা যারা চালাচ্ছেন, তারা অবশ্য একভাবে নিজেদের অজ্ঞতা, মূঢ়তা ও ঔদ্ধত্যই সবার সামনে তুলে ধরছেন। প্রথমত, ‘আদিবাসী’ (ইনডিজেনাস) ধারণাটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেখানে কারা কবে কোত্থেকে এসেছিল, সেটি মুখ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, ‘উপজাতীয়’ ও ‘আদিবাসী’ পদ দুইটি আইএলও কনভেনশন ১০৭ (যা বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেছে) ও ১৬৯ (যা বাংলাদেশ ‘বিবেচনা করবে’ বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে)-এ পাশাপাশিই রয়েছে, যেগুলোতে উভয় নামে অভিহিত জনগোষ্ঠীদের জন্যই একই ধরনের সুরক্ষার কথাই বলা হয়েছে।
কাজেই যদি তর্কের খাতিরেও মেনে নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয়, তার মানে এই নয় যে আন্তর্জাতিক আইনে সমর্থনযোগ্য তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে গেল।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কণ্ঠে যখন লুটেরা শ্রেণির প্রতিনিধিদের মুখে উচ্চারিত আদিবাসী-বিরোধী বর্ণবাদী বক্তব্যই সম্পাদিত আকারে শোনা যায়, তখন সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় রাষ্ট্র কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে।
যারা নিজেদের মনে করেন ‘জাতীয় স্বার্থ’, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’ ইত্যাদির অভিভাবক, তারা বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন। অবশ্য আদিবাসী ধারণার বিরোধীরা সবাই যে এদেশের লুটেরা শ্রেণির হয়ে কথা বলেন তা নয়।
বরং এমন অনেকে আছেন, যারা এদেশের সব শ্রেণির শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িতদের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন, যাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতায় আদিবাসীদের সংকটও গুরুত্ব পায়।
তবে তাদের একাংশ আবার ‘আদিবাসী’ ধারণাকে দেখেন সন্দেহের চোখে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের একটি হাতিয়ার হিসেবে। অন্যদিকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এদেশের আদিবাসী জনগণ যেভাবে সামন্ত শাসন, শোষণ ও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেসবকে তারা দেখেন বৃহত্তর একটি শ্রেণি সংগ্রামের বয়ানের অংশ হিসেবে।
উভয় ক্ষেত্রেই তাদের ধারণায় আংশিক সত্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু একটা জায়গায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয়; সেটা হল, আদিবাসী সমাজের মানুষদের যে নিজস্ব বিচার, বুদ্ধি রয়েছে, তারা যে স্রেফ ঔপনিবেশিক চিত্রায়নের সহজ-সরল-শিশুতুল্য ‘আদিম (সাম্যবাদী)’ মানুষ নয় এবং জাতিসংঘে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি যে পশ্চিমাদের কোনো দাক্ষিণ্য নয়, বরং বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্দোলন, সংগ্রামের ফসল, এসব বাস্তবতা খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
অন্যদিকে, যদি আমরা আদিবাসী সমাজের নেতৃবৃন্দ তথা আদিবাসী অধিকারের প্রবক্তাদের দিকে নজর দিই তাহলে দেখতে পাব, তাদের কর্মকাণ্ড অনেকাংশে সীমিত রয়েছে উন্নয়ন ডিসকোর্সের গণ্ডিতে।
ফলে রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন এমন অনেক বিষয় পর্যবসিত হচ্ছে প্রকল্পভিত্তিক বিভিন্ন খণ্ডিত উদ্যোগে। অধিকন্তু, তারা ‘আদিবাসী’ ধারণার ব্যাপকতর আবেদন সেভাবে তুলে ধরতে পারছেন না।
এ ধারণা যে শুধুমাত্রা দেশের জনগণের একটা ‘ক্ষুদ্র’ অংশের বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে বা গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আগামী পঞ্চাশ বা একশ’ বছর পরে কী হবে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত, এ জাতীয় বিষয় খুব একটা সামনে আসছে না।
এসব সীমাবদ্ধতার ফলে আদিবাসী অধিকারের পক্ষের বক্তব্য ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিপক্ষ লুটেরা গোষ্ঠীর পাতা বিতর্কের ফাঁদে, যেখানে অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার কাজে ব্যয় হচ্ছে অনেকের মনোযোগ ও মূল্যবান সময়।
এই অবস্থার অবসানের জন্য আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নকে নতুন আঙ্গিকে দেখা দরকার।
তাদের সংকটের মূলে প্রধান যে প্রবণতা দায়ী ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণা প্রভাবিত মনন দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের পরিচয় নির্মাণের সমস্যা সেটাকে মোকাবেলা করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে পরিচয়ের জমিন লুটেরাদের দখলমুক্ত করার কাজটা করতে হবে বিভিন্ন পরিসরে, বিভিন্ন কোণ থেকে।
এসব কাজ করতে হবে ‘আদিবাসী দিবস’ জাতীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে, চিন্তা ও তৎপরতার প্রাত্যহিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে। এমনিতেও জাতিসংঘ ঘোষিত দ্বিতীয় আদিবাসী দশক চলছে এখনও যা শেষ হবে আগামী বছর।
কাজেই দিবস উদযাপন নয়, বরং দুই দশকের অর্জন কী, আগামী দুই দশকের লক্ষ্য কী হতে পারে, এ ধরণের প্রশ্নের দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
শুধু দুই দশক বা পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো সীমিত ভৌগোলিক পরিসর নয়, বরং পুরো একবিংশ শতাব্দী এবং পুরো পৃথিবী হয়ে উঠুক আদিবাসীদের চিন্তার ক্ষেত্র এবং তাদের নিজেদের বা তাদের পক্ষে চালানো বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পটভূমি।
লেখক: প্রশান্ত ত্রিপুরা
স্বতন্ত্র গবেষক ও লেখক (সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি)
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।