সেং ভালাং – এক সাহসী আদিবাসীর আত্মকথন
1259
দিদি, আপনি কিন্তু আমাদের পুঞ্জিতে অবশ্যই আসবেন। শুধু একটা ফোন করবেন যে আপনি আসছেন। আমি গাড়ি পাঠাবো। না না আমার নিজের গাড়ি নয়, ভাড়ার গাড়ি। বহুকাল আগে আমদানি করা রংচটা জীপ গাড়িগুলো দেখেছেন নিশ্চয়ই। সেই মরচে ধরা, রংচটা চার চাকার যানগুলো, যেগুলো বহুকাল আগেই বিকল হয়ে মিউজিয়ামে থাকার কথা, এখনো বীরদর্পে চষে বেড়ায় আমাদের ভাঙ্গাচোরা রাস্তায়।
গাড়ি শ্রীমঙ্গল শহরতলী ছেড়ে আসলে পথে পড়বে দেশী-বিদেশী কোম্পানির শত শত একরের মনোরম চা বাগান। সেই চা বাগানের সৌন্দর্যে মিশে রয়েছে শত বছরের শোষণ-লাঞ্ছনা, রক্ত-ঘামে ভেজা চা শ্রমিকের আর্তনাদ। সেই যে কবে ব্রিটিশরা চায়ের প্রচলন ঘটিয়েছিল এই উপমহাদেশে। ব্রিটিশ শেষে পাকিস্তান। পাকিস্তান শেষে বাংলাদেশ। তবু যেন চা শ্রমিকের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়েই চলেছে চা বাগানের সবুজের প্রতিটি বিন্দুতে। এই শোষণের কারখানার মাঝখান দিয়ে কিছু পথ চলার পর শুরু হবে খানা-খন্দে ভরা উঁচু নিচু পাহাড়ি কাঁচা রাস্তার। যদি বর্ষাকালে আসেন মনে হবে নিশ্চয় এই রাস্তা ট্রাক্টর দিয়ে চষে প্রস্তুত করা হয়েছে ধান রোপণ করার জন্য। হ্যাঁ, আধুনিক ফোর হুইলার গাড়ি বা কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা মান্ধাতা আমলের জীপ গাড়িগুলো ছাড়া কোন চার চাকার যান দিয়ে আমাদের এই রাস্তা অতিক্রম করে আমাদের পুঞ্জিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সরকার বাহাদুর আমাদের এই রাস্তার দিকে কোনদিন চোখ মেলে তাকাননি কিংবা হতে পারে চোখ মেলে তাকানোর আগেই আমাদের প্রতিবেশী নাহার টি এস্টেট-এর মালিকের চোখ ধাঁধানো অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
আমাদের সেই বিখ্যাত রাস্তার খানা-খন্দ, চড়াই-উৎরাই শেষ করতে পারলে আপনি পৌঁছে যাবেন নাহার চা বাগানের শেষ টিলাটিতে। এরপর কয়েক মিনিটের পায়ে চলা রাস্তা। তারপরই আমাদের প্রিয় আসলম (নাহার – ১) পুঞ্জি। ছোট্ট একটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত এটি। আপনি যখন পুঞ্জির সবুজের মাঝখান দিয়ে হাঁটবেন তখন আপনার মনে জমে থাকা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাগুলো দূর হওয়া শুরু করবে। পৌরসভা-সিটি কর্পোরেশনের সুবিধা-বঞ্চিত আমাদের ঝা-তকতকে পুঞ্জির মাঝখানে এসে পৌঁছলে আপনার ক্লান্তি শেষ হয়ে এলো বলে, আর ঠিক তখনি আপনাকে দেখে ছুটে আসবে পুঞ্জির ছোট ছোট খাসি শিশুরা। তাঁরা জানে আপনি আসবেন। আপনার প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। আপনাকে আমাদের পুঞ্জিতে স্বাগতম।
আমার নাম ডিবারমিন। আপনি হয়তো আমাকে নাও চিনতে পারেন। আপনার মত নাম, যশ, খ্যাতি, বিদ্যা কিংবা ধন কোনটাই আমার নেই। আপনার মত ক্ষমতাবান, বিত্তবান বা পরিচিত আমি নই। কিন্তু পুঞ্জির প্রতিটা মানুষ আমাকে চেনে, জানে, মানে। তাঁরা আমাকে ভালোবাসে। এমনকি ছোট্ট শিশু আমেশা কিংবা সোফিও। এই পুঞ্জির মানুষ শুধু নয়, পুঞ্জির প্রতিটি পানের লতা, প্রতিটি গাছ আমার আত্মীয়, পরম প্রিয়জন।
যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন আমরা এখানে কত বছর ধরে আছি বা এই পুঞ্জির বয়স কত তা আমি বলতে পারব না। আমি যা জানি তা হল এই পুঞ্জিতে আমার জন্ম। এই পুঞ্জির আলো-হাওয়া-জলে আমি ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। আমার যা কিছু অর্জন, যা কিছু প্রাপ্তি, তা এই পুঞ্জিকে ঘিরে। আমার পূর্বপুরুষ-নারীরা এখানে ছিলেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তাঁরা ঠিক কবে কোথা থেকে এসেছিলেন তার ইতিহাস কেউ লিখে রাখেনি, একমাত্র আমাদের পরম আত্মীয় পানলতা, সবুজ বৃক্ষরা ছাড়া। কখনো সেই প্রয়োজন বোধ আমরা করিনি।
আমাদের পুঞ্জির পানজুমের সীমানা যেখানে শেষ, সেখানে বাংলাদেশ-ভারতের সীমানার একটা পিলার। তার কয়েকশ গজ দূরে কাঁটাতারের বেড়া। আর তার ঠিক পাশেই রয়েছে বিএসএফ-এর এক ছাউনি। রাতে আমাদের বিদ্যুতহীন পুঞ্জি থেকে সেই ছাউনিটাকে বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করতে দেখা যায়। আমার পুর্বপুরুষেরা যখন এখানে বসবাস করতে শুরু করেন তখন সীমানা ছিল না, কাঁটাতাঁরের বেড়া ছিল না, প্রয়োজন পড়েনি সীমান্ত প্রহরীর। আমাদের আশেপাশের এই পাহাড়গুলোতে এক সময় ছিল সবুজ বন। তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা মুক্তভাবে এই পাহাড় ওই পাহাড় পরিষ্কার করে পান চাষ করতেন, ফল-ফলাদি আর সবজি ফলাতেন। একটানা ১০-১২ বছর একটা পাহাড়ে পান চাষ করলে পানজুমের উর্বরতা কমে যায়। তাই তাঁরা একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পানজুমের স্থান পরিবর্তন করতেন। তবে তাঁরা প্রয়োজনের বেশি কখনো এই বনের ক্ষতি করেননি, প্রকৃতিকে শোষণ করেন নি।
আমাদের সেই নির্ঝঞ্ঝাট ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য কখনো দলিল-কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়নি। “আধুনিক” রাষ্ট্র সৃষ্টির বহু আগে থেকেই আমাদের নিজস্ব প্রথাগত ভূমি ব্যাবস্থাপনা ছিল, ছিল প্রথাগত আইন। ব্রিটিশদের দ্বারা দলিল, ভূমির খাজনা, তথা ভূমির ব্যাবস্থাপনা বা প্রশাসন চালু করার বহু আগে থেকেই আমাদের প্রথাগত নেতাদের নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে জমির বিলি-বন্টন হত, জমির ব্যাবহার হত। কমবেশি সহজ-সরলই ছিল ভূমির এই ব্যাবস্থাপনা । ভালমন্দেই কাটছিল আমাদের দিন।
এক সময় ১৯৮৪ সাল এল। আমি তখন ছোট। আমাদের পড়শি নাহার টি এস্টেট-এর মালিকেরা আমাদের কাছে এসে আমাদের পুঞ্জির জমির মালিকানা দাবী করল। হাতে জমির কাগজপত্র। তাঁরা বলল, তোমরা যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে আমাদের সাথে ইজারার চুক্তি স্বাক্ষর করে এখানে থাকতে হবে। তাঁরা এও বলল যে, সেই বাবদ বাৎসরিক একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হবে নতুবা পুঞ্জি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাঁদের এসব কান্ড দেখে পুঞ্জির সবাই থ। আমরা সহজ-সরল আদিবাসী জীবন যাপনের অনেক মন্ত্র জানতাম, আদিবাসী অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান ধারণ করতাম ঠিকই কিন্তু “আধুনিক” রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন-কানুন-দলিলের মারপ্যাঁচের ব্যাবস্থার সাথে পরিচিত ছিলাম না। আমরা বুঝতেই পারিনি বাপ-ঠাকুরদাদের আমলের জমিটি কখন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে, দলিল বানিয়ে চা বাগানের মালিকেরা জমির মালিকানা দখলে নিয়েছে। প্রবল রাষ্ট্রের কলকারাখানায় প্রস্তুতকৃত কিছু কাগজপত্র আমাদের রাতারাতি ভূমিহীনে পরিণত করেছে।
তো অনেক ভাবনা-চিন্তা করে আমরা চা-বাগানের মালিকের সাথে সাব-লীজের চুক্তি সাক্ষর করলাম। আমাদের লেখাপড়া না জানার সুযোগে চা বাগানের মালিক পক্ষ চুক্তিতে অনেক বিষয় তাঁদের মনমতো করে লিখলেন, ভুল তথ্য অন্তর্ভুক্ত করলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হল আমরা চা বাগানের শ্রমিক। লেখা হল চা বাগানে কাজ করার সুযোগ দানের পাশাপাশি আমাদের পান চাষ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
প্রথম বার ১০ বছরের জন্য চুক্তি হল। এর পরের বার ৫। তার পরের বার ৭ বছরের চুক্তি। এভাবে বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তি সাক্ষর করলাম আমরা। চুক্তির অংশ হিসেবে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে লাগলাম নাহার চা বাগানের কর্তৃপক্ষকে। প্রতি বার চুক্তি হয় আর অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। আমরা সর্বশেষ বাৎসরিক ২০ লক্ষের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। এভাবে অন্তত দু’বেলা-দু’মুঠো খাবার খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার মত অবস্থা নিয়ে আমরা চলছিলাম।
২০০৭ সাল এলে চা বাগানের মালিকানা পরিবর্তন হল। আগের মালিক শামসুন নাহারের বদলে আসলেন ফরিদা সারোয়ার। মালিকানা পরিবর্তনের সাথে দেখা দিতে লাগলো নতুন নতুন সমস্যা। তাঁরা আমাদের গাছ কেটে বিক্রির যোগাড়-যন্তর করতে লাগলেন। টেন্ডার আহবান করলেন। সেলিম টিম্বার নামের এক প্রতিষ্ঠান জিতে নিল টেন্ডার। ঠিক হল ১.৫ কোটি টাকার বিনিময়ে পুঞ্জির ভেতরের, পানজুমের ও আশেপাশের প্রায় ৪,০০০ গাছ কেটে নিয়ে যাবে তাঁরা। তাঁরা এমনকি বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে গেল গাছ কাটার। আর এদিকে এসবের কিছুই জানতাম না আমরা । আমরা বুঝতে পারলাম না কখন আমাদের পরম আত্মীয় গাছগুলো অর্থের বিনিময়ে হাতবদল হয়ে গিয়েছে।
২০০৮ সালের শুরুর দিকে তাঁরা গাছ কাটতে এল। তাঁরা বিচার করলো না আমরা গাছের উপর কী পরিমাণ নির্ভরশীল। তাঁরা বুঝতে চাইল না আমাদের জীবন-জীবিকা টিকে আছে এইসব বৃক্ষ-পানলতার উপরে। আমরা বাঁধা দিতে চাইলাম। তাঁরা শুনল না। তাঁরা কাগজ দেখাল – গাছ কাটার পারমিট। দ্রুত কেটে নিল প্রায় ১,২০০ গাছ।
এর মধ্যে আমরা আমাদের প্রিয় গাছগুলোকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা-তদবির চালিয়ে গেলাম। অনেকে এগিয়ে আসলেন। পাশে দাঁড়ালেন। আদিবাসী বন্ধুরা, বাঙ্গালি বন্ধুরা। বিশেষ করে যারা অধিকার নিয়ে কাজ করেন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা এগিয়ে আসলেন। আমরা হাই কোর্টে মামলা করলাম। অবশেষে আমাদের সম্মিলিত চেষ্টার জয় হল। হাই কোর্ট রায় দিলেন আর কোন গাছ কাটা যাবে না। আর যে ১,২০০ গাছ কাটা হয়েছে সেগুলো কিছু করা যাবে না। পরিস্থিতি কিছুদিন শান্ত থাকল।
কিন্তু বৃক্ষ-বনগ্রাসীরা চুপ থাকলেন না। ভেতরে ভেতরে আমাদের গাছগুলো লুটে নেয়ার নানান ষড়যন্ত্র আর ছল-ছাতুরির আশ্রয় নিতে লাগলেন। ২০১০ সালের শুরুর দিকে তাঁরা কোর্ট থেকে একটা অনুমতি বের করে নিয়ে আসলেন কাটা ১,২০০ গাছ নিয়ে যাওয়ার। তবে কোর্টের সেই নির্দেশ অনুযায়ী টিকে থাকা গাছগুলো আগে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই বৃক্ষ-বনগ্রাসীর দল আবারো অনুমতি পেল গাছ কাটার। এবার শুধু আসলম (নাহার ১) পুঞ্জি নয়, পাশের কাইলিন (নাহার ২) পুঞ্জি থেকেও গাছ কাটার অনুমতির ব্যবস্থা করে ফেলল। আগের ১,২০০ গাছসহ কেটে নিলে সর্বমোট ৩,৫০০ এর অধিক গাছ। আমরা আবারো চেষ্টা চালালাম। কোর্ট আবারো রায় দিল আমাদের পক্ষে। কোর্ট বলল অবশিষ্ট ৪৫০টি গাছ আর কাটা যাবে না। যদি কাটতে হয় তাহলে নাহার চা বাগানের অভ্যন্তরের গাছ কাটা যাবে যাতে বন ও পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে।
কোর্ট কেসে পরাজয়ের পর চা বাগানের মালিকপক্ষের লোকজন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে লেগে পড়লেন। এবার আমাদের তাড়ানোর জন্য অন্য ধরণের ফন্দি বের করলেন। তার মধ্যে ছিল নানা ধরনের ভীতি প্রদর্শন, হুমকি ও হয়রানি। সাথে ছিল প্রলোভন। এক পর্যায়ে ২০১২ সালের দিকে আমাদের মান্ত্রি, আমাদের পুঞ্জির প্রধান, সেই ষড়যন্ত্রের জালে পা দিলেন। চা বাগানের লোকজনে কাছে বিক্রি হয়ে গেলেন ৫০ লাখ টাকায়। যার হাতে ছিল পুঞ্জির নেতৃত্ব, যার নামে পুঞ্জির নাম, যিনি ছিলেন আমাদের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল, সেই তিনিই অর্থের লালসার শিকার হয়ে চিরতরে পুঞ্জি ছেড়ে চলে গেলেন। ফেলে গেলেন অসহায় পুঞ্জিবাসীকে।
সেই সঙ্কটের মুহূর্তে আমাকেই নিতে হল পুঞ্জির নেতৃত্বের ভার। আমাকে হতে হল মান্ত্রি – পুঞ্জির প্রধান, খাসিদের প্রথাগত নেতা, যার হাতে ন্যস্ত পুঞ্জির প্রশাসনের ভার। আমি অনেক ভাবনা-চিন্তা করে একক নেতৃত্বের দিকে না গিয়ে যৌথ নেতৃত্বের দিকে গেলাম। পুঞ্জিবাসীর সাথে পরামর্শ করে আমি সহ ৭ সদস্যের একটি কমিটি বানালাম পুঞ্জির বিষয়-আশয় দেখভালের জন্য। সেই থেকে আমাদের এই ৭ জনের নেতৃত্বেই চলে পুঞ্জির সকল বিষয়। এভাবে ভালোমন্দে আরও কিছু সময় গড়াল।
২০১৪ সালের ৩০ মে’র স্বাভাবিক এক সকাল। ঋতুর পরিক্রমায় তখন গ্রীষ্মকাল চলছে। তাই স্বভাবতই ভোর থেকেই তাপমাত্রা একটু বেশি। আমরা পুঞ্জির পুরুষেরা ভোরে খাওয়া-দাওয়া সেরে পানজুমে। নারীরা রান্নাবান্না শেষে যে যার গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত। বেলা ১২:০০ টার দিকে ২৫০-৩০০ জনের একদল লোক এল। হাতে ঘর তৈরির সরঞ্জাম, লাঠিসোটা আর ধারাল অস্ত্র। দলে নাহার চা বাগানের কিছু শ্রমিকের পাশাপাশি ভাড়াটে অনেক মানুষ। নেতৃত্বে নাহার চা বাগানের ম্যানেজার আর তাঁর নিকটস্থ কিছু অফিসার। এসেই পুঞ্জির এলাকার ভেতরে তাঁরা একটা কাঁচা ঘর তৈরির কাজ শুরু করে দিল। উদ্দেশ্য পুঞ্জির জমি দখল। তাঁদের কার্যক্রম দেখে পুঞ্জির নারীরা আর অল্প বয়স্ক কয়েকজন তরুণ প্রতিবাদ করলেন। দখলদাররা কথা শুনলো না। প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হল। তাঁরা হামলা করে বসলো। আহত হলেন পুঞ্জির চার সাহসী নারী।
এর মধ্যে হামলার খবর পৌঁছে গেছে পানজুমে। আমরা পুরুষেরা এক মুহূর্ত দেরি না করে চলে এলাম ঘটনাস্থলে। পুরুষদের একসাথে আসতে দেখে দখলদারেরা ভড়কে গেল। সামান্য পিছু হটে আবার এগোনোর চেষ্টা করলো। আমরা আরো এগুলাম। আমাদের মনে দৃপ্ত প্রত্যয় আমাদের পুঞ্জি আমাদের রক্ষা করতেই হবে। এই পুঞ্জি আমাদের মায়ের মত। মায়ের উপর এত বড় জুলুম কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না। এ যাবত বহু বার পুঞ্জির উপর, আমাদের লোকজনের উপর অত্যাচার-হয়রানি সহ্য করেছি, আর নয়। আমরা দলবেঁধে এগোতেই দখলদারেরা পড়িমরি করে দৌড় দিতে লাগল। পুঞ্জির টিলার ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে চা বাগানের টিলার ওপরের দিকে ছুটতে লাগলো। পালানোর সময় একজন চা শ্রমিক তাল সামলাতে না পেরে একটু খাদের মত জায়গায় আছড়ে পড়লো। তাঁর দুর্ভাগ্য, সেখানে ছিল একটা পাথর। মাথা পাথরে বাড়ি লেগে তিনি আহত হয়ে পড়ে রইলেন। তাঁকে পরে থাকতে দেখে চা বাগানের এক কর্মকর্তা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দয়া ভিক্ষা করলেন। আমরা অনুমতি দিয়ে বললাম তাঁকে নিয়ে গিয়ে ঠিকমত চিকিৎসা করাতে।
কিন্তু সেই হতভাগা চা শ্রমিকের দুর্ভাগ্য, আমাদের দুর্ভাগ্য। দুদিন পর তাঁর মৃত্যু হল। অর্থহীন এক মৃত্যু। বহু বছরের শোষণ-অপমান যেন তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল না। সে জীবন দিল তাঁর শ্রমশোষণের কারখানা চা বাগানের তরে। জানি না তাঁর পরিবার-পরিবাররা কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তাঁর জীবনের দাম যেন কিছু পয়সা। কিন্তু পয়সা দিয়ে কি জীবন কেনা যায়? পয়সা দিয়ে কি হারানো জীবন ফেরত পাওয়া যায়?
আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হল। মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে। ১৮ জনের নামের উল্লেখ করা হল, আর বাকি ১০ জন অজ্ঞাত। মামলার ১ নম্বর আসামী হিসেবে অবধারিতভাবে আমার নাম এল। পুলিশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হল হতভাগা চা শ্রমিক ভাইটির মাথায় আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার দুদিন পর আবার আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হল। হয়রানির মামলা। অভিযোগে বলা হল আমরা নাহার চা বাগানের ২,০০০ চা গাছ কেটেছি। যেই আমরা বহুকাল ধরে গাছদের যত্ন নিই, বন রক্ষা করি, গাছ বাঁচানোর জন্য এত কিছু করি, সেই আমাদের বিরুদ্ধে করা হল গাছ কাটার মামলা। পরিহাস বোধহয় একেই বলে।
আমরা আমাদের পুঞ্জি দল বেঁধে পাহারা দিতে লাগলাম। বিশেষত রাতে। একবার যখন হামলা হয়েছে, হামলা আরও হতে পারে। তাই এই পূর্বপ্রস্তুতি। এখানে প্রধান ভূমিকা রাখলেন নারীরা। পুরুষদের মাথার উপরে ঝুলছে মার্ডার কেস। যে কোন মুহূর্তে এসে তুলে নিয়ে যাবে পুলিশ। তাই ব্যাপারটা কিছুটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকা নিরাপদ না। আমরা থাকতে লাগলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। আশপাশের ঝাড়-জঙ্গলে। ব্যাপারটা জানাজানি হতে আমাদের পাশের কাইলিন (নাহার-২) ও লংলিয়ান ইত্যাদি পুঞ্জির খাসি ভাইবোনেরা এগিয়ে এলেন। তাঁরাও দল বেঁধে পুঞ্জির নারীদের সাথে পাহারায় যোগ দিলেন যেন কোন অঘটন ঘটার আগেই প্রতিরোধ করা যায়।
ঘটনাটা সারা দেশে জানাজানি হয়ে গেল। আমাদের বন্ধুরা আমাদের কাছে ছুটে এলেন, পাশে দাঁড়ালেন। বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন, দেশের বিবেকবান অধিকার কর্মীরা আওয়াজ তুললেন আমাদের অধিকারের পক্ষে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ হল, মিছিল হল, মানববন্ধন হল। অধিকারকর্মীরা, গুণিজনেরা, সাংবাদিকেরা ঢাকা থেকে, মৌলভীবাজার থেকে ছুটে আসলেন। আমাদের সাথে দেখা করলেন। কথা বললেন বাগানের কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে। তাঁরা ঢাকায় ফিরে গিয়ে আমাদের দুর্দশা নিয়ে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করলেন। বহু পত্রপত্রিকা প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। তাঁরা দেশ-বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলেন আমাদের দুর্দশার কথা, লড়াই-সংগ্রামের কথা।
এর এদিকে চা বাগানের মালিকপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে অবরোধ ঘোষণা করলেন। পুঞ্জি থেকে শ্রীমঙ্গল তথা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মূলত একটাই রাস্তা – সেই বিখ্যাত রাস্তা যেটা দিয়ে আপনি আসবেন আমাদের পুঞ্জিতে। রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হল। আমাদের বাজার যাওয়া প্রায় বন্ধ, স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিকেয় উঠতে লাগল। মেয়েরা ঠিকমত ঘোরাফেরা করতে পারে না। আমাদের জীবিকার একমাত্র সম্বল পান বিক্রি করতেও প্রচণ্ড অসুবিধা হতে লাগল। কারণ ব্যাপারীদেরও আসতে হয় চা বাগানের বুক চিরে আসা রাস্তাটি দিয়ে। আমাদের স্বাভাবিক-শান্ত-সরল জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেল। আমরা না পারি ঠিকমত আয়-উপার্জন করতে, না পারি বাজার সদাই করতে, না পারি চলাফেরা করতে। আশেপাশের পুঞ্জির মানুষেরা আমাদের সাহায্য করার এগিয়ে না এলে কী যে হত কে জানে। এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল।
আমাদের এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে অধিকার কর্মী বন্ধুরা, সাংবাদিক বন্ধুরা আমাদের বিষয়টা নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করেছেন। তাঁরা সাহায্য করেছেন প্রতিনিয়ত দেশের ও দেশের বাইরের মানুষদের আমাদের করুণ কাহিনী জানাতে, জনমত গঠন করতে। আর আমরাও আমাদের লড়াই জারি রেখেছিলাম, বিশেষ করে আদালতের ভেতরের লড়াইটা। একটা সময় পরে আমরা অভিযুক্তরা আদালতে আত্মসমর্পণ করা শুরু করলাম। প্রতিবার কয়েকজন করে। জামিনের আবেদন করলাম। কয়েকজন পেল কিন্তু বেশিরভাগ পেলাম না। জেলে খাটলাম বেশ কমাস। তারপর জামিন পেলাম। এর মাঝে ২,০০০ চা গাছ কাটার মামলার নিষ্পত্তি হল। আমরা জয়যুক্ত হলাম। তবে হত্যা মামলা এখনো চলছে। তাই আমাদের আদালতের ভেতরের লড়াই-সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।
এর মাঝে নাহার চা বাগানের মালিকানা আরও একবার হাত বদল হয়েছে। যারা নতুন এসেছেন তাঁরাও আমাদের খেদানোর ষড়যন্ত্র চালু রেখেছেন। যুক্ত হয়েছে ষড়যন্ত্রের নতুন নতুন পদ্ধতি। আর আগেকার যে কোন সময়ের মতই তাঁদের সাথে রয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের প্রতিনিধিদের একাংশের মদত। তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টায় এই তো ২০১৬ সালের ৯ জুন আমরা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পেলাম এক উচ্ছেদ নোটিশ যেখানে আমাদের বলা হল আমরা “অবৈধ দখলদার”, তাই পরবর্তী ১২ জুনের মধ্যে আমাদেরকে আমাদের পুঞ্জি ছেড়ে চলে যেতে হবে। অন্যথায় আমাদের উচ্ছেদ করা হবে। আমরা আবারো প্রতিবাদ জানালাম। আমাদের বন্ধুরা প্রতিবাদ জানালেন। সাথে চলল আইনি লড়াই। অবশেষে সিলেট জেলার বিভাগীয় কমিশনার সেই নোটিশের বিপরীতে একটা স্থগিতাদেশ দিলেন। ইদানীং শুনছি আরেকটা ঝামেলা এসে যুক্ত হয়েছে। সরকারদলীয় স্থানীয় এক নেতা নাকি মাহী টি এস্টেট নামে ৬১১.৬৫ একরের এক চা বাগান করার অনুমতি পেয়েছেন। তার মধ্যে পাশের কাইলিন (নাহার-১), নিরালা আর চালিতাছড়া পুঞ্জির পাশাপাশি আমাদের পুঞ্জির কিছু জায়গাও নাকি পড়েছে। এভাবে বোধহয় যত দিন যাবে তত আমাদের আদিবাসীদের পুঞ্জিগুলো উচ্ছেদ করে জবরদখল করার নানান ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে।
আমি একটা কথায় বিশ্বাস করি – জন্ম যখন হয়েছে তখন মরতে হবেই। তাই লড়াই চালিয়ে আমি ভীত নই। আমার পুঞ্জির বোনেরা-ভাইয়েরা ভীত না। আমাদের পুঞ্জির মানুষেরা জানেন তাঁদের পাশে আদিবাসি-বাঙ্গালি, দেশি-বিদেশী বহু বিবেকবান ব্যক্তি, সংগঠন রয়েছেন। তাঁরাও আমাদের সাথে লড়াই-সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
আমরা এ যাবত যেভাবে লড়াই করেছি তা সব সময়ই আইনিভাবে, ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে। আমাদের অধিকারের স্বার্থে আমরা দেশের আইনের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে আদালতে গিয়েছি। ন্যায়পরায়ণতা আমাদের লড়াইয়ের শক্তির অন্যতম উৎস। কয়েক বছর আগে চা বাগানের কর্তৃপক্ষ আমাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বলেছিলেন আমি যাতে পুঞ্জি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। আমি গ্রহণ করিনি। আমার কাছে পুঞ্জি, পুঞ্জির মানুষেরা, পুঞ্জির গাছেরা, পুঞ্জির পানের লতারা আগে। তারপর আমার জীবন, আমার বিলাসিতা। এই পুঞ্জির সবকিছুর সাথে জড়িত আছে আমার অস্তিত্ব। পুঞ্জির প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি মাটির কণা যদি টিকে থাকে তবেই আমি টিকে থাকবো, বেঁচে থাকবো।
এই ন্যায় যুদ্ধে আমাদের শক্তি, আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে আছেন পুঞ্জির নারীরা। অতি কঠিন তাঁদের জীবন। আমাদের নারীরা প্রতিদিন লড়াই করেন পুরুষদের চেয়েও বেশি। তাঁরা প্রতিদিন গৃহস্থালী সামলান, রান্নাবান্না করেন, সন্তান প্রতিপালনসহ কত কিছু করেন তার ইয়াত্তা নেই। তাঁরা দেখাশোনা করেন পুঞ্জির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ – পান বাছাই, বাঁধাই ও বিক্রির কাজগুলো। আমরা পুরুষরা এখনো এখানে একটা সংগঠন দাঁড় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু আমাদের নারীরা তাঁদের শত ব্যস্ততার মাঝেও একটা সংগঠন গড়ে তুলেছেন সেং ভালাং নামে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “সবার ভালোর জন্য”।
পুঞ্জির নারীদের সুরে সুরে আমার জীবনের দর্শনও সবার ভালো করা। পুঞ্জির নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ – সবার ভালো করা আমার জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। পুঞ্জির আশেপাশের মানুষদের, এমনকি চা বাগানের মালিক-কর্মচারী-শ্রমিক, যারা আমাদের ক্ষতি করতে চান, উচ্ছেদ করতে চান, তাঁদের কল্যাণও আমি চাই। আমি চাই আমাদের সুসময়ের-দুঃসময়ের বন্ধুরা যেন সবসময় ভাল থাকে। আর চাই দেশের নিপীড়িত আদিবাসী, শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণ।
আমার স্বপ্ন হল আমাদের সন্তানেরা একদিন সুশিক্ষিত হবে, উচ্চশিক্ষিত হবে। তবে তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ভুলে যাবে না। আমরা চেষ্টা করি আমাদের ছেলেমেয়েদের সেই শিক্ষা দিতে। আমাদের ছেলেমেয়েদের যারা শহরে গিয়ে পড়াশোনা করে তারা ছুটিতে বাড়ি আসলে তাদের আমরা সময় করে পরিচিত করাই আমাদের প্রথাগত আইনের সাথে, আদিবাসী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে। তাদের চিনিয়ে দিই কোন সিজনে পানের পাতা কেমন হবে, কিভাবে পানের লতা পরিষ্কার করতে হবে, পান সংগ্রহ করতে হবে। আর শিখিয়ে দেই সেই সংগৃহীত পান কিভাবে পরিষ্কার করতে হবে, বাছতে হবে, বাঁধাই করতে হবে, দাম নির্ধারণ করতে হবে। আমি মনে করি এভাবেই টিকে থাকবে আমাদের জীবন-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, লক্ষ বছর বেঁচে থাকবে পাহাড়-নদী-বন। তবেই হবে আপনার-আমার-আমাদের সবার কল্যাণ।
তো দিদি কবে আসছেন আমাদের পুঞ্জিতে?
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।