আদিবাসীত্বের রাজনীতি এবং ভূমি ও পরিচয়ের স্বীকৃতির জন্য জুম্মদের সংগ্রাম
1427
জুম্ম জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের স্বীকৃতি নিয়ে রাজনীতি
২০১১ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ১০ম অধিবেশনে বাংলাদেশ মিশনের প্রথম সভাপতি ইকবাল আহমেদ বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই।
তার এই বিবৃতি ছিল ঐ উক্ত স্থায়ী ফোরামের একজন বিশেষ দূতের দ্বারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিস্থিতির উপর পেশ করা একটি প্রতিবেদনের পাল্টা জবাব।
সে বছর আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের প্রচারণা দলের (advocacy group) কাজ সমন্বয়ের জন্য উক্ত স্থায়ী ফোরামের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলাম।
আমাদের কাজ ছিল ১৯৯৭ সালে সরকার এবং সংগ্রামী জুম্মদের মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সমর্থন আদায় করা, যার মাধ্যমে (চুক্তি) বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলমান সশস্ত্র যুদ্ধের অবসান হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সবচেয়ে বিতর্কিত তিনটি অংশ – জুম্ম এবং সেটলারদের মধ্যে ভূমি নিয়ে চলমান দ্বন্ধের সমাধান, সেনাবাহিনী কর্তৃক এ অঞ্চল দখল ও জুম্মদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন – অনিষ্পত্তিত রয়ে গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে চরম অনাগ্রহ সম্মুখীন হওয়ায় এবং তাঁদের বেশিরভাগ জাতীয় প্রচারণা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় জুম্ম সক্রিয় কর্মীদের (activist) এক অংশ পাহাড়ে সামরিক দখলদারিত্ব বন্ধ, আদিবাসী জুম্মদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া ও জুম্মদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন দিতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগের জন্য আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আদিবাসী গোষ্ঠীর সংগঠন ও দাতা রাষ্ট্রসমূহের কাছে আবেদন করেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আফ্রিকান এবং এশিয়ান কনটেক্সটে ‘’আদিবাসী’’ পদটির (term) ব্যবহার নিয়ে সর্বপ্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়াটি এসেছিল স্বয়ং স্থায়ী ফোরাম থেকেই — জাতিসংঘের বিশিষ্ট দূত মিকেল আলফনসো মার্টিনেজের (Miquel Alfnonso Martinez) কাছ থেকে।
তিনি ১৯৯৯ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজিনাস পপুলেশনের (WGIP) একটি প্রতিবেদনে বলেন, আফ্রিকা এবং এশিয়ার উত্তর-ঔপনিবেশিক অবস্থায় “আদিবাসী জনগোষ্ঠী’’ পদটি (term) ব্যবহারযোগ্য নয়।
মার্টিনেজ (Martinez) জেনেভার ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজিনাস পপুলেশনের (WGIP) ভারতীয় আদিবাসী প্রতিনিধিদের দাবির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন এশিয়ান বা আফ্রিকান পরিস্থিতিতে “আদিবাসী জনগোষ্ঠী” পদটি ব্যবহারযোগ্য নয়।
তিনি আরো বলেন, উত্তর-ঔপনিবেশিক আফ্রিকা ও এশিয়ার আদি-বাসিন্দা জনগোষ্ঠীগুলো/ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো/ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীসমূহ . . . জাতিসংঘের প্রসঙ্গানুসারে (context) নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করতে পারে না।
ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজিনাস পপুলেশনের (WGIP) আদিবাসী প্রতিনিধিরা নামটির ব্যবহার নিয়ে সংস্কৃতিমূলক যুক্তির মাধ্যমে এই বিবৃতির প্রতিবাদ করেন এবং তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে পুরো বিশ্বের সক্রিয় কর্মীরা (activist) বহুজাতিক সক্রিয়তার (transnational activism) মধ্য দিয়ে ন্যায় বিচার অর্জনের জন্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এই পদটির ব্যবহার করেন — যেখানে তাঁরা যেই জাতি-রাষ্ট্রের (nation-state) অংশ সেটি তাঁদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে জাতির ‘পর (others)’ হিসেবে প্রান্তিক করে রেখেছে।
বাংলাদেশে “আদিবাসী” শব্দটি সরকারি কাগজপত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কিন্তু যখনই জুম্মরা এবং দেশের অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহ সক্রিয় কর্মীদের (activists) বহুজাতিক সক্রিয়তায় (transnational activism) অংশগ্রহণের মাধ্যমে অধিকার আদায়ে সুবিধা (leverage) অর্জন করলো তখনই সরকার এই পদটির (term) ব্যবহার বাদ দিল এবং দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন এটি একটি “অপ্রকৃত নাম বা নামের ভুল প্রয়োগ (misnomer)” ছিল।
এমনকি কিছু কিছু বিদ্বজ্জনদের (scholars) মধ্যেও এই নামের ব্যবহার নিয়ে বির্তক আছে।
তবে ২০১১ সালে “আদিবাসী” পদটি ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকারের অস্বীকৃতি বহুজাতিক দাতা অর্থায়িত এজেন্ডাগুলোর মাধ্যমেও চালিত হয়েছিল।
২০১১ সালে বিশেষ দূতের (special rapporteur) প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা (উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ১০ম ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় এটি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী অন্যতম দেশ)।
প্রথম সচিব তাঁর বক্তব্যে এইসব সুপারিশের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন এবং বলেছিলেন যে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী ছিল না, তাই বিশেষ দূত জাতিসংঘের কাছে এরকম সুপারিশ করতে পারে না।
এই অনুবন্ধে আমি রাষ্ট্র কর্তৃক আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর পরিচয়ের স্বীকৃতি নিয়ে যে বির্তক এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো তুলে ধরবো।
কিন্তু এই পদ (terminology) এবং এই পদের ব্যবহার নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা আমার উদ্দেশ্যে নয়।
আমি স্বীকার করছি এই বির্তকগুলো আছে ও চলছে এবং আমি পদ (terminology) ও বর্গীকরণ (categorisation) নিয়ে বিতর্কগুলোকে আলোচ্য সূচনা (point of departure) হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের জুম্মরা কিভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণের সম্মুখীন হয় সে বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো।
তাঁরা এমন একটি জাতি-রাষ্ট্রের (nation-state) অধীনে বসবাস করেন যেখানে তাঁরা ইউরোপিয়ান উপনিবেশকারীদের দ্বারা সংঘটিত একই রকমের নির্যাতনের শিকার।
যেমনঃ জোরপূর্বক ভূমি দখল, দৈনন্দিন নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শন, নজরদারি, সামরিক জবর দখল, এমনকি সংস্কৃতিক আত্তীকরণ (cultural assimilation) এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণের অপচেষ্টা।
বর্গ পরিচয় শনাক্তকরণ নিয়ে বির্তকটি রাষ্ট্র কর্তৃক সহিংসতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠীয় প্রান্তিকীকরণের পরিস্থিতিগত রাজনীতির আলোচনা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এবং সহিংসতা ও নিপীড়ন স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্যর্থ হয়।
যখন অপরিহার্যিত পরিচয় গঠন, ক্ষমতার সম্পর্কগুলোকে (power relations) অস্পষ্ট করে তোলে এবং দেশ জুড়ে জুম্ম জনগোষ্ঠী এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঙালির জাতীয় কল্পনায় (national imagination) সমান অংশীদার হতে ব্যর্থ হয় তখন তাঁরা পুরো পৃথিবী জুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর সাথে বহুজাতিক সংহতির স্থান (transnational solidarity spaces) তৈরি করে নিতে “আদিবাসী” অথবা “ইন্ডিজিনাস” পরিচয় বাছাই করেন, যদিও এটি আসলে তাঁরা যেই সহিংসতা এবং প্রান্তিকীকরণের সম্মুখীন হয় তার সর্বসমাধান (catch-all solution) নয়।
কার্যসিদ্ধি ও সংহতির জন্য সমষ্টিগত রাজনৈতিক একাত্মতা গঠন
১৯৭০ সালের দিকে পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি কৌশল হিসেবে “জুম্ম” পরিচয়টিকে ধারণ করে।
যখন ১৯৯৭ সালে ভারত তার নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিদ্রোহীদের কাছ থেকে তার সহযোগিতা সরিয়ে নেয় এবং তার চাপে পার্বত্য চুক্তি সাক্ষরিত হয়, তখন জুম্মদের একটি অংশ শীঘ্রই কৌশল হিসেবে একটি ব্যাপকতর বহুজাতিক আদিবাসী জনগোষ্ঠির আন্দোলনকে গ্রহণ করে নেয়।
জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৯৯৫-২০০৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথম আন্তর্জাতিক দশক বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রগুলোর সাথে একই সংগ্রামে লিপ্ত আদিবাসীদের সাথে বহুজাতিক বন্ধন (transnational ties) শক্তিশালী করার মাধ্যমে তাঁদের উদ্দেশ্য অর্জনে সাহায্য করেছিল।
এই “আদিবাসী” পদটিকে (term) নিয়ে বিদ্বজ্জনদের (scholars) সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলো (critique) আসে নব্যউদারনৈতিক শাসন মানসিকতাকে নিয়ে (neoliberal governmentality) সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোর (critique) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
এই বিদ্বজ্জনরা উল্লেখ করেন যে, জুম্মরা স্বীকৃতি খুঁজতে গিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে পৌঁছেছেন যে সরকারগুলোর নিজেদেরই আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের উপরে উপনিবেশায়নের ইতিহাস রয়েছে এবং তাদের আরও রয়েছে উপনিবেশিক ইতিহাস ও বর্তমান সেটলার উপনিবেশায়ন (settler colonisation) মুছে ফেলার জন্য উত্তর-ঔপনিবেশিক (postcolonial) রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য (political agenda)।
সুমন (Sumon) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, “আদিবাসী জনগোষ্ঠী” হিসেবে স্বীকৃতির আলোচনাটি (discourse) এনজিও-চালিত (NGO-driven) উদ্দেশ্য (agenda) থেকে এসেছে, যেটি বিকশিত হতে শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে।
সে সময় অনেক সক্রিয় কর্মী (activist) যাঁরা শুরুতে আদিবাসী/ইন্ডিজিনাস নামটি ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক ছিলেন তাঁরাও প্রজেক্টের প্রস্তাবনায় এই শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন।
একইভাবে জন আর বোয়েন (John R. Bowen) যুক্তি দেখিয়েছেন যে “আদিবাসী জনগোষ্ঠী”– র মতো সার্বজনীন ধারণায় এক ধরণের প্রতিনিধিত্বমূলক সংকট রয়েছে — কারণ যেহেতু এই বর্গ পরিচয়ের স্বীকৃতির বেশিরভাগ সমর্থকই এনজিও নেতৃত্বাধীন কর্মী (NGO-led activists)।
যদিও কোন একটি জনগোষ্ঠীর আত্ম-পরিচয় ট্রাইবাল বা আদিবাসী হিসেবে ‘“প্রাকৃতিক কিংবা অবশ্যম্ভাবী” নয়, তবে তানিয়া লি (Tania Li) মনে করেন না যে এই ধরণের পদ (term) কেবলমাত্র “উদ্ভাবিত, গৃহীত কিংবা আরোপিত”।
ইন্দোনেশিয়ার একনায়কতন্ত্র এবং একই রকমভাবে বাংলাদেশ সরকারের মত অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে লি মনে করেন, “এই ধরনের অবস্থান ঐতিহাসিক সেডিমেন্টেড প্র্যাকটিস (sedimented practices), দৃশ্যপট এবং অর্থের ভাণ্ডারকে ব্যবহার করে এবং নির্দিষ্ট প্যাটার্নের বিবাদ ও সংগ্রামের উত্থান ঘটায়।”
বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে, তাঁদের অবস্থান এমন একটি রাষ্ট্রের বিপক্ষে যে রাষ্ট্র তাঁদের ভূমি কেড়ে নিয়ে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ঘটিয়ে এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত দায়মুক্তির মাধ্যমে অন্যদেরকে এ ধরণের কাজে লেলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
ব্যাংত জি. কার্লসন (Bengt G. Karlsson) যিনি এই বর্গীকরণ/শেণীভুক্তকরণের খুবই কড়া সমালোচক যুক্তি দেন, ভারতের আদিবাসী সক্রিয় কর্মীদের (activists) ক্ষেত্রে এই ধারণাটি ইতোমধ্যে সেখানে আছে এবং তাঁদেরকে অগ্রাহ্য না করে জনগণের দাবির সাথে যুক্ত হওয়া খুবই জরুরি।
তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট লোকরা (concerned people) নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারবে কি পারবে না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া নৃবিজ্ঞানীদের জন্য সমস্যাযুক্ত।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লাইলুফার ইয়াসমিন (Lailufar Yasmin) দেখান, ১৯৭১ পরবর্তী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বাংলাদেশের অ-বাঙালি আদিবাসীদের জায়গা-ভিত্তিক পরিচয়ের দাবিকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রচেষ্টা চালায় এবং সরকারি জাতীয় বাঙালি পরিচয়ের গঠন “রাষ্ট্রের বিপরীতে সংখ্যালঘু আদিবাসী জাতিসত্ত্বা — দ্বারা প্রযুক্ত অবস্থানগত ক্ষমতা (positional power)” — এর উদাহরণ।
১৯৭২ সালে যখন প্রথম সংবিধান রচিত হয় তখন বাঙালি ব্যতিত অন্য কাউকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
২০১১ সালের জুন মাসে সংসদ কর্তৃক বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় যেখানে বলা হয়েছে “… বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে এবং বাংলাদেশের নাগরিক বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হবে।”
পাহাড়ে বসবাসরত ১২ টি ভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাঙালি নয় এবং এই ঘোষণার মাধ্যমে মূলত তাঁদেরকে দেশের অ-নাগরিক হিসেবে পরিণত করা হয়েছে।
সেটলার ঔপনিবেশিক বসতিতে বিদ্যমান বহু বিষয়ও পাহাড়ে উপস্থিত রয়েছে।
আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার বিষয়টি এসেছে কিছু দল থেকে যে দলগুলো রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ এবং প্রান্তিকীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে।
আর এই সংগ্রাম শুরু হয় সংবিধান থেকেই যেখানে শুধুমাত্র বাঙালি এবং মুসলিমদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বাকি জনগোষ্ঠীদেরকে “সংখ্যালঘু” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং দেশের সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
সংবিধানে এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতির কারণে জুম্ম জনগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
নাম পরিচয় নিয়ে এসব দ্বন্ধের মূলে অন্তর্নিহিত রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি এবং এই দাবিটি এসেছে দশকের পর দশক ধরে গণ-সহিংসতা, সামরিক দখল, ভূমি হারানো, বৈষম্যমূলক নীতি, সামাজিক প্রান্তিকীকরণ এবং রাষ্ট্রের আধিপত্যের কারণে।
দুর্ভাগ্যক্রমে সর্বদা শক্তিশালী গোষ্ঠীসমূহ নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে যা প্রায়সময়ই আন্দোলনরত মানুষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়।
তবে তাই বলে আন্দোলনকে বিধিঅসম্মত বলা যায় না।
অনেকের মতে এই স্বীকৃতি দাবির জন্য সমস্বর শোনা যায় না।
তবে কোন আন্দোলনে প্রত্যকেই মতপার্থক্য ছাড়া একসাথে কাজ করবে এটা আশা করা অনেকটা ঔপনিবেশিক অত্যাবশ্যকীয়তাকরণের (colonial essentialisation) মতো — কোন একটি গোষ্ঠীর স্বীকৃতি আদায়ের পদ্ধতিতে তাঁদের নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।
আন্দোলনে তাঁদের সবার একটি সসর্বজনীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে — তা হচ্ছে যাঁদেরকে রাষ্ট্রের পর (others) হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁদের উপরে রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো।
এটি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশের দীর্ঘ ইতিহাস, সম্পদের শোষণ এবং রাষ্ট্র-পরিচালিত সন্ত্রাস যা জুম্মদেরকে এবং তাঁদের সহিংস বিদ্রোহকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তাঁদের একে অপরের বিরুদ্ধে এবং তাঁদের মধ্যকার অসহায় মানুষদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে।
জুম্মরা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যিত হওয়ার আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধীনে দশক ধরে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্টদের রাজনীতি জুম্মদেরকে কেবল রাষ্ট্রের “পর (others)” হিসেবে পরিণত করেনি বরং রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষককৃত মিডিয়া প্রচারের (state-sponsorde media campaign) মাধ্যমে জুম্মদেরকে বিশ্বাসঘাতক ও সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে।
আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটিই কর্তৃত্ববাদ এবং রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যানের রূপ নিয়েছে।
সরকার পক্ষের যুক্তিমতে, আইএলও (ILO) অনুযায়ী “আদিবাসী” পদমর্যাদার সাথে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার যুক্ত আছে যেটি বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ভূমির সামাজিক অধিকারের অভিপ্রায় লালন করতে পারে।
তবে বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কা আদতে ভিত্তিহীন যেহেতু সশস্ত্র সংগ্রামের সময় কিংবা তার পরবর্তীতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশী সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে কেবল আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আগ্রহী হয়েছে।
১৯৭১ সালে জুম্ম জনগোষ্ঠীর অনেক লোকজন মুক্তিবাহিনীতে শুধুমাত্র যোগদান করেননি বরং অনেকেই তাঁদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতে যোগদান করা থেকেও প্রত্যাখ্যিত হয়েছিল।
যখন ১৯৭২ সালে এম এন লারমা এবং অন্যান্য জুম্মরা সংসদে গিয়ে নতুন দেশের সংবিধানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইনী স্বীকৃতির দাবি জানান তখনও এই প্রত্যাখ্যান চলমান ছিল।
এম এন লারমা সংসদে যেই চার দফা দাবির ইশতেহার জমা দিয়েছিলেন সেখানে জুম্মদের ভূমি অধিকার রক্ষার জন্য দেশের সংবিধানের অধীনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়েছিল।
এই সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রত্যাখ্যানই আসলে জুম্মদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য খেপিয়ে তোলে।
জুম্মরা যে ধরণের স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিল এবং সরকার যা দিতে রাজি হয়েছিল সেটির মধ্যস্থল(middle ground) হিসেবে শান্তিচুক্তি হয়েছিল।
এই চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসনের একটি অনুরূপতা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল।
জুম্মরা যাতে তাঁদের পূর্বপুরুষের জমির উপর সামাজিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে জুম্মরা দাবি করেছেন জুম্মদের জন্য ভূমি কমিশন আইনটি ত্রুটিপূর্ণ এবং এটি বাঙালি সেটলারদের আনুকূল্যে ছিল।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আইএলও (ILO) কনভেনশন ১০৭ অনুসমর্থন (ratify) করেছে যেটি আদিবাসীদের পরিচয় ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আবারও জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচয় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করা হয়।
ভূমি কমিশনের অকার্যকারিতা এবং দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়টি বিগত দশক ধরে জুম্ম সক্রিয় কর্মীদের কাছে বিবাদের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক প্রচারণা এই দুটি বিষয়কে ঘিরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
উত্তর-উপনিবেশিক প্রসঙ্গে (context) উপনিবেশকারী-উপনিবেশিত আলোচনা (discourse)
যদিও বেশিরভাগ বাঙালি বিদ্বজ্জনরা (scholars) পাহাড়ের প্রসঙ্গে “উপনিবেশায়ন” পদটি (refrain) ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলেও জুম্ম বিদ্বজ্জনরা সেখানকার পরিস্থিতিকে “বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং সেটলারদের দ্বারা সহিংস উপনিবেশায়ন” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এই বহিরাগত স্থানান্তরের ফলস্বরূপ ধর্ষণ এবং অপহরণের কথা উল্লেখ করে কবিতা চাকমা (Kabita Chakma) এবং গ্ল্যান হিল (Glen Hill) দেখিয়েছেন যে বিশেষ করে আদিবাসী মহিলাদেরকে পাহাড়ের এই উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় টার্গেট করা হচ্ছে।
তাঁরা (কবিতা চাকমা এবং গ্ল্যান হিল) প্রাক-উপনিবেশিক (pre-colonial), উপনিবেশিক অবস্থা এবং উত্তর উপনিবেশিক ইতিহাসে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচালিত স্থানান্তর (transmigration) প্রোগ্রামের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমিতে বসতি স্থাপনের জন্য ৪০০,০০০ এর অধিক বাঙালিকে আনয়ন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গণহত্যা এবং আদিবাসী মহিলাদের উদ্দেশ্যমূলক ধর্ষণ ও অপহরণ, সশস্ত্র বাহিনীর অব্যাহত অভিযান এবং নজরদারি — একটি উপনিবেশ পরবর্তী দেশে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাযোগ্য এক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশায়নের ঘটনা তৈরি করে।
মার্টিনেজ (Martinez) এবং অন্যান্য বিদ্বজ্জনরা (scholars) যাঁরা দাবি করেন যে আদিবাসীরা উত্তর উপনিবেশ অবস্থায় এই ক্যাটাগরিতে স্বীকৃতির দাবি করতে পারে না, তাঁরা এই দেশগুলোতে আদিবাসীরা যে এখনও উত্তর উপনিবেশিক দেশগুলিতে উপনিবেশায়ন পরিস্থিতির শিকার তা বুঝতে ব্যর্থ হন —— যেখানে ইউরোপীয়ান উপনিবেশকারীদের বিদায়ের পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত উত্তর উপনিবেশ দেশগুলি দীর্ঘকাল ধরে নিজেদেরকে উপনিবেশিক কর্তার অবস্থানে নিয়ে গেছে।
মাহমুদ মামদানি (Mahmood Mamdani) “… উপনিবেশবাদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনীতির সম্পর্কের মধ্যে সমস্যায়নের” জন্য নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধানের যুক্তি দেখিয়েছেন।
তাঁর ধারণাগত যুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অগণিত সহিংসতাকে ব্যাখ্যা করে তুলে ধরতে সহায়তা করে।
তিনি লিখেছেন যে সহিংসতা সংঘটনকারীরা নিজেদের বিরুদ্ধে ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা অন্যান্য বর্গের প্রেক্ষিতে ‘শত্রুকে’ নির্মাণ করে এবং সংজ্ঞায়িত করে।
তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে উপনিবেশবাদের ভয়াবহতা “গণহত্যা প্রবণতায়” পর্যবসিত করে — যা উত্তর-উপনিবেশিক জাতি-রাষ্ট্রে অব্যাহত সহিংসতা চক্র বোঝার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বোচ্চ সহিংসতার শিকার এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোর আদিবাসীরা।
তাঁদের কাছে উপনিবেশকারীর চেহারা বদলে গেছে, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
লুইথুই (Luithui) দেখিয়েছেন, মার্টিনেজ (Martinez) উপনিবেশায়নের লবণ-জলের সরল তত্ত্বেকে (theory of salt-water ccolonisation) সমর্থন দেন।
তত্ত্বটির অর্থ হচ্ছে উপনিবেশায়ন শুধু তখনই ঘটেছিল যখন উপনিবেশকারীরা জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য উপমহাদেশ থেকে এসেছিল তখন।
ঠিক যেমনটা ইউরোপীয়ানদের আমেরিকা দখলের ক্ষেত্রে কিংবা উদাহারণস্বরুপ অস্ট্রলিয়ার কথা বলা যায়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে অনেক এশীয় রাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে — যা তাঁদের দেশের আদিবাসীদের বা যাঁরা নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করে সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে — এই অবস্থানকে মার্টিনেজ তার সমীক্ষায় সমর্থন করে।
নির্দিষ্ট পরিচয়ের বর্গ থেকে পরিস্থিতিগত রাজনীতিতে স্থানান্তর
দেশের প্রথম সংবিধানে প্রতিফলিত বাংলাদেশ সরকারের আধিপত্যবাদী নীতিমালার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যখন পরিচয়গত রাজনীতি দেখা দেয় এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নীতি আরো নির্মম হয়ে উঠতে থাকে তখন বেশিরভাগ বিতর্ক নামগত পরিচয় এবং বহুজাতিক (transnational) পরিচয়ের রাজনীতিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
যদিও আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয়গত স্বীকৃতির বিষয়টি যে বহুজাতিক আদিবাসী রাজনীতির অংশ — সেটিকে ঘিরে যে যুক্তি সৃষ্টি হয়েছে তার অবশ্যই আইনি ভিত্তি রয়েছে।
তবে আদিবাসী পদটিকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের ফলে বিতর্কটিকে কেবল আদিবাসীদের জীবনকে প্রভাবিস্তারকারী মূল বিষয়গুলো থেকে দূরে সরিয়ে নেয়নি বরং এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রের অব্যাহত অধীনকরণ প্রক্রিয়াকেও শক্তিশালী করে তোলে।
মূল লেখিকাঃ হানা শামস আহমেদ, কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পিএইচডির শিক্ষার্থী এবং আন্তর্জাতিক সিএইচটি কমিশনের একজন প্রাক্তন সমন্বয়ক।
— ভাষান্তরকারীঃ রেশমী চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।