আদিবাসীদের মাতৃভাষা প্রচলন ও চর্চাঃ সংকট ও সম্ভাবনা

Jumjournal
Last updated Sep 1st, 2021

2831

featured image

ভুমিকাঃ

একটি রূপক গল্প দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যায়। ‘বলিরাম’ আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একজন ছাত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। তার মা-বাবা জুম চাষের শত ব্যস্ত তার মাঝেও সন্তানকে আগ্রহ দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়।

লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখায়। সেও পরম আগ্রহে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যেত। যদিও ক্লাশের পড়াগুলো বুঝতে ভারি কষ্ট হয় তার, বলা যায় অধিকাংশই সে বোঝে না। তবুও সীমাহীন আগ্রহ নিয়ে তোতা পাখির মত পড়ে যায় স্কুলের পড়া। তারপরও একদিন বিপত্তি ঘটল।

স্কুলে যে শিক্ষক পড়া নিচ্ছিলেন তিনি কোন বাঙ্গালি শিক্ষক নন, আদিবাসী জনগোষ্ঠীরই একজন শিক্ষক। বলিরামকে তিনি প্রশ্ন করলেন, বলতো আমাদের মাতৃভাষার নাম কি? বলিরাম অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর উত্তর দিল ‘আমাদের মাতৃভাষার নাম  ককবরক্।’ তার উত্তর শুনে আদিবাসী শিক্ষকের সন্তুষ্ট হবার কথা ছিল।

কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তাহার মনে পড়ল ছোটবেলায় তিনিও একই প্রশ্নের উত্তর দিতে একই ভুল করেছিলেন। শাস্তি পেয়ে নিজের উত্তর শুধরে নিয়েছিলেন। তার ছাত্রও লেখাপড়ার প্রতি অবহেলার কারণে এরকম সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে কোনদিন ভুল না করে তার জন্য উত্তর শুধরে দিলেন বেত দিয়ে পিটিয়ে, কঠোর শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে।

বলিরাম অশ্রুসিক্ত চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার শিক্ষকের দিকে। ককবরক্ই তো ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা, সে তো সঠিক উত্তরই দিয়েছে। তারপরও তাকে শাস্তি পেতে হলো? তবে কি তার মাতৃভাষা ককবরক্ নয়? এ রকম হাজারো প্রশ্ন তার মনে এসে ভীড় জমাতে লাগল। কিন্তু সে কোন সদুত্তরই পেলনা।

এত সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর যে এত কঠিন হবে, বলিরাম কি সেদিন বুঝতে পেরেছিল? বলাবাহুল্য, তার শিক্ষকের শুধরে দেয়া উত্তর হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে বলিরাম স্কুল থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল।

Save our language by Jimi Chakma

পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ শিশুকেই এভাবে স্কুল থেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম মূলত বাংলাভাষী শিশুদের জন্য রচিত এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়বস্তু মুসলিম সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল নিয়ে বিরচিত হওয়ায় বাঙ্গালি মুসলিম শিশুদের জন্যই তা উপযোগী। তারপরও বিভিন্ন জরিপ ও পরিসংখ্যান রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ১ম শ্রেণী থেকেই শতকরা অন্তত ৩০ জন শিশু স্কুল ত্যাগ করে।

এতে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠের বিষয়বস্তু ও পাঠদান পদ্ধতি শিশুর মনকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। সুতরাং মাতৃভাষা বাদ দিয়ে সংস্কৃতি বিবর্জিত শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী শিশুদের অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়। এ কারণবশত বিশ্বের মৃতপ্রায় অন্যান্য ভাষার মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহের ভাষাও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার ভাষাগত সমস্যার কারণে শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। যার অনিবার্য ফলাফল হিসেবে প্রভাব পড়েছে আদিবাসী সংস্কৃতির উপর।

কেননা শিক্ষাই হল সংস্কৃতির আদি উৎসভূমি। মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হলে শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার বিষয়বস্তু আরো সহজ ও বোধগম্য হত। এই কারণে আদিবাসীদের শিক্ষা জীবনে মাতৃভাষার প্রচলন ও চর্চা অত্যধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিঃ জন্ম ও বিকাশ

বেঁচে থাকার সংগ্রামে ক্রমান্বয়ে মানুষ সংস্কৃতি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সংস্কৃতি শব্দের অন্যতম অর্থই হল বেঁচে থাকার রীতিনীতি, যার মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকার পথগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। সংস্কৃতির এই রীতিনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল।  এমনও দেখা যায় যে, একজনের জীবনকালেই সংস্কৃতির ধারা দ্রুতলয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে অথচ জৈবিক অভিযোজনের জন্য অনেক প্রয়োজন অনেক পুরুষের সময়কাল।

পরিবর্তিত জীবনধারার সঙ্গে সমতালে এগিয়ে যাবার চেষ্টায় মানুষ তাই সংস্কৃতির অনুশীলনকেই প্রধান উপচার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। জৈবিক অভিযোজনকে নয়। যেহেতু সাংস্কৃতিক রীতিনীতিগুলো মানুষকে শিখে নিতে হয় সেহেতু জৈবিক উত্তরাধিকারের মাধ্যমে মানুষ তা আয়ত্ত করে না।

এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে বা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এর প্রচলনের জন্য একটা নির্দিষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থিরীকৃত করার প্রয়োজন দেখা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে বোঝানো হচ্ছে, কিভাবে এক ধরনের রীতিনীতি বা আচার ব্যবহারের সাথে পরস্পরকে পরিচিত করে তোলা যায়, কি করে নিজস্ব ধ্যান ধারণার সাথে অন্যকে পরিচিত করে তোলা যায় এবং কি করেই বা অন্যের ধ্যান ধারণা ও চিন্তা জগতের সঙ্গে নিজে পরিচিত হতে পারে।

কতগুলো নির্ধারিত সংকেত বা ইঙ্গিতের সাহায্যে জীবজগতে একে অন্যের ভাবধারার সাথে পরিচিত হয়। এই সংকেত যা শব্দগত বা শুধু ইঙ্গিত বা ইশারায় হতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ তার ভাষার সাহায্যে জটিলতম চিন্তাধারা প্রকাশে যেমন সক্ষম হয় এবং প্রয়োজনে পুনঃ পুনঃ সে একই অভিব্যক্তি ক্রমান্বয়ে প্রকাশ এবং অনবরত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এনে নতুন করে প্রকাশ করতে পারে।

মানুষের ভাষা, যা তার যোগাযোগ পদ্ধতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, তার তিনটি মৌলিক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

প্রথমত, মানুষের ভাষা সীমিত সংখ্যক ধ্বনির মাধ্যমে হাজারো রকমের বস্তু ও অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে সমর্থ। পৃথিবীতে খুব কম ভাষাই রয়েছে যেখানে সর্বমোট ব্যবহৃত ধ্বনির সংখ্যা পঞ্চাশের উপরে।

অথচ মাত্র কয়েকটি ধ্বনিকে বিভিন্নভাবে একত্রিত করে হাজারো রকমের বস্তু ও অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ প্রকাশ করে চলেছে। বিভিন্ন ধ্বনির যথারীতি একত্রীকরণের মাধ্যমে যেভাবে আমরা বিভিন্ন মানুষ একই বস্তু বা অভিজ্ঞতাকে বা অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারি তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। যেমনঃ

ত নাং কি? (চাকমা) নাক্ নাম জালে? (মারমা) নিনি বুমং তামা (ত্রিপুরা) প্রভৃতির অর্থ হল বাংলা তোমার নাম কি? এর অতিরিক্ত কিছুই নয়। শব্দ যেন বস্তুর প্রতীক, কিন্তু প্রতীক শব্দ যেন ঐ বস্তুর রূপ নয়। এই যে শব্দকে প্রতীক থেকে স্বতন্ত্র করা তা শুধুমাত্র মানুষের ভাষাতেই সম্ভব।

Kokborok – Mother Tongue of Tripura, Image: Bangla Tribune

মানুষের ভাষার এই বিশেষ ক্ষমতাই মানুষের ভাষাকে অসীম শক্তির অধিকারী তুলেছে। বিভিন্ন ধ্বনিকে যুক্ত করে অনবরতই আমরা নিত্য নতুন শব্দ তৈরী করে চলেছি। নিত্য নতুন প্রতীকের জন্ম দিচ্ছি আর প্রত্যেকটি প্রতীককে অর্থময় করে তুলেছি।

দ্বিতীয়ত, মানুষের ভাষা যে শুধু কর্মক্ষম তাই নয়। এর জন্ম ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন। শব্দ ও ধ্বনিকে একত্রে করে নতুন অর্থময় শব্দে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মানুষকে বিশেষ বেগ পেতে হয় না, যদিও পূর্বে সেই শব্দ ও ধ্বনি সে কোনদিন শোনেনি। যে কোন ভাষাভাষী লোক এমনিভাবে তাদের ভাষায় অসংখ্য বাক্য অনবরত তৈরী করে যেতে পারে।

মানুষের ভাষার এ জন্ম ক্ষমতা ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এক নমনীয় যন্ত্রে পরিণত করেছে, যে যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই আমরা নিত্য নতুন সংবাদের আদান প্রদান করতে সমর্থ হই।

তৃতীয়ত, মানুষের ভাষা নিজস্ব পরিবেশের বাইরের সংবাদকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। অতীতে যা একদিন ঘটেছিল, আমরা তা যেমন করে প্রকাশ করতে পারি ভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে যা কল্পনামূলক বা যা হয়ত নাও ঘটতে পারে।

তেমন ঘটনাও আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি। মানুষের ভাষার এই স্থান পরিবর্তন (Displacement) ক্ষমতার বলেই আমরা বস্তুনিরপেক্ষ বিমূর্ত বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারি, অন্যান্য প্রাণী যা পারে না।

মানুষের ভাষার এই তিন বিশেষত্ব যাকে আমরা বলতে পারি প্রচলিত রীতি বা অনুশীলন ক্ষমতা (Conventionality), জন্ম ক্ষমতা (Productivity) ও স্থান পরিবর্তন ক্ষমতা (Displacement)  যা মানুষকে নিত্য নতুন পরিকল্পনা করতে শেখায়, ভালো-মন্দ নির্ধারণ করতে শেখায় আর সর্বোপরি মানুষকে দেয় সমন্বয় সাধন করার এক ক্ষমতা যা দিয়ে সে নিজেকে একটি স্থির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিংবা প্রয়োজনে নতুন পথের যাত্রী হয়ে যাতে পারে।

আর মানুষের এ ভাষাই মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। জীবনের অভিজ্ঞতাকে ভাষায় অনুবাদ করা বা রূপ দিয়ে মানুষ জ্ঞানের এক ভাণ্ডার তৈরী করে যা পরবর্তীকালের মানুষের জন্য রেখে দিতে পারে। তাই মানুষের সংস্কৃতি বিকাশের বিশেষ অবলম্বন ও বৈশিষ্ট্য।

প্রতিটি ভাষাই কতগুলো নির্দিষ্ট ধ্বনির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, এই ধ্বনির সংখ্যা প্রত্যেক ভাষাতেই সীমিত এবং এই ধ্বনির পূর্বে নির্ধারিত রীতি অনুসারে ও সমন্বয়ে শব্দ, বাক্যংশ, বাক্য গড়ে ওঠে। প্রত্যেক ভাষাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ঐ ভাষাভাষীদের প্রাকৃতিক ও সামাজিক অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবেশকে প্রকাশের যোগ্যতা রাখে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে সেই পরিবর্তিত পরিবেশকে প্রকাশ করার জন্য প্রত্যেক ভাষাই অনবরত নিত্য নতুন শব্দ আবিষ্কার ও একত্রীকরণের যোগ্যতা রাখে। যে কোন পরিবেশের বর্ণনার জন্য এবং পরিবেশের রূপ বা শ্রেণী নির্ধারণের জন্য যে শব্দাবলীর প্রয়োজন, তা প্রত্যেক ভাষায় প্রয়োজনানুযায়ী রয়েছে। বস্তুনিরপেক্ষ চিন্তা করার ক্ষমতা প্রত্যেক ভাষাতেই বিদ্যমান। কোন ভাষাই শুধুমাত্র ব্যক্তি বিশেষ বা বস্তু বিশেষের প্রকাশের বাহন রূপে সীমাবদ্ধ নয় এবং এদিকে বিচার করলে বলা যায় কোন ভাষাই তুলনামূলকভাবে অন্য ভাষা থেকে নিকৃষ্ট বা অনুন্নত নয়, প্রত্যেক ভাষায়ই সেই ভাষাভাষীদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী

আদিবাসীরা হচ্ছে অনেক দেশেরই প্রথম বসতি স্থাপনকারী বা মূল অধিবাসী। পৃথিবীর ৫টি মহাদেশের ৭০টি দেশে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ একাংশ প্রায় ১৫০ মিলিয়ন আদিবাসী বসবাস করে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে। যেমন – বাংলাদেশ, মায়ানমার, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড। প্রায় ৩০ মিলিয়ন আদিবাসী বাস করে ল্যাটিন আমেরিকায়। বলিভিয়া, গুয়াতেমালা ও পেরুর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী হচ্ছে আদিবাসী জনগণ। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার বিস্তৃতির সময় অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হয়েছে এবং তাদের ভূমি বেদখল করা হয় জোর করে।

Khumi – Mother Tongue of Khumi, Image: Bangla Tribune

আদিবাসীদের রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভূমিসংলগ্ন জীবিকা, ধর্ম এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো। কিছু কিছু ধারণ করে ঐতিহ্যগত জীবন পদ্ধতি। তারা মূলত নিজেদের মৌলিক পরিচিতিটাকে বজায় রাখতে চায়। কিন্তু নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও আদিবাসীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ।

অনেক ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্য, দারিদ্রতা, স্বাস্থ্যহীনতা, বেকারত্ব প্রভৃতির শিকার। তাদের ভূমি ও সম্পদ, বনায়ন, খনি, বাঁধ, সড়ক নির্মাণ, রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন, পারমাণবিক পরীক্ষা, সেচ প্রকল্প প্রভৃতি ক্ষতিকারক উন্নয়ন কাজের কারণে আজ হুমকির সম্মূখীন।

সারাবিশ্ব জুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ ভূমি ও জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আদিবাসীদের এই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

১৯৮২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় একটি Working Group on Indigenous Population (WGIP) নমনীয়তা ও উন্মুক্তকরণের স্বার্থে জাতিসংঘ আদিবাসীর কোন ধরাবাঁধা সংজ্ঞা নিরূপণ করেনি। তবে দিক নির্দেশনা হিসেবে Jose martinez Cobo-র তৈরী সংজ্ঞাটি WGIP ব্যবহার করে। Martinez Cobo-র মতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলঃ

(১) যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় বসবাসের একটি ঔতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে।

(২) ঐ ভৌগোলিক সীমারেখার অভ্যন্তরে ক্ষমতাশালী অন্য অংশের তুলনায় স্বতন্ত্র (distinct) বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।

(৩) সমাজের আধিপত্য অংশ।

(৪) তাদের সাংস্কৃতিক বিন্যাস, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী, তাদের ভৌগোলিক সীমারেখায় জনগোষ্ঠী হিসেবে ধারাবাহিক অস্তিত্ব সংরক্ষণ করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে হস্তান্তর করতে দৃঢ় সংকল্প।

Jose martinez Cobo-র সংজ্ঞা অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, খুমী ও খেয়াং এই ১১টি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী (Indigenous) জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবিধানিক বা সরকারীভাবে আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও অধিকার স্বীকৃত নয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত ১৯০০ সালের শাসনবিধিতে এদেরকে Indigenous Hillman বা আদিবাসী পাহাড়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।  ১৯৯৫ সালের ১২ নম্বর আইনেও একই স্বীকৃতি মেলে।

এছাড়া বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংগঠনের মুখপত্র ‘সংহতি’-র বিভিন্ন সংখ্যায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাণীগুলোতে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকৃত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ভাষা ও বর্ণমালা

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভাষা প্রচলন ও চর্চা নিয়ে এ আলোচনায় ভাষা ও বর্ণমালার অবতাড়না অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মূলত এখানকার আদিবাসীদের চেহারা, সামাজিক আচার আচরণ, রীতিনীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, মানবিক গড়ন প্রভৃতি মিল থাকলেও তাদের ভাষা এক নয়।

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীরা মঙ্গোলীয় হলেও তাদের ভাষা ইন্দো-এরিয়ান পরিবারভূক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে খিয়াং জনগোষ্ঠী ছাড়া সবাই তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে।

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা একই বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে, যা ‘চাকমা বর্ণমালা’ হিসেবে পরিচিত। মারমা ও চাক’রা একই ধরনের বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে, যা ‘মারমা বর্ণমালা’ হিসেবে পরিচিত।

বম, লুসাই ও পাংখোয়ারা রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে। ম্রো জনগোষ্ঠী ‘ম্রো চাহ্ চা’ নামে একটি বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে, আবার যারা খৃস্টান ধর্মাবলম্বী তারা ব্যবহার করেন রোমান বর্ণমালা।

পার্বত্য অঞ্চলের খুমীরা ম্রো বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে। তবে মায়ানমারে রোমান বর্ণমালা থেকে বর্ণ নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা যায়। ত্রিপুরা বৈদ্যদের মধ্যে কিছু কিছু চাকমা ও মারমা বর্ণমালা ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে বাংলা ও রোমান বর্ণমালা থেকে বর্ণ নিয়ে পৃথক দুটি বর্ণমালা রয়েছে।

ভাষা পরিবার ভাষা
অ) ইন্দো-এরিয়ান দল ১) চাকমা ২) তঞ্চঙ্গ্যা
আ) টিবেটো- বার্মান দল
ক) বার্মা-আরাকান উপদল ১) মারমা
খ) ককবরক্ উপদল ১) ত্রিপুরা
গ)কুকি-চিন উপদল
১) লুসাই ২) পাংখোয়া ৩) বম ৪) খিয়াং ৫) খুমী ৬) ম্রো ৭)চাক

সূত্রঃ Sugata Chakma: The Tribal Language of CHT ও সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শিক্ষা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও আদিবাসীদের প্রত্যাশা

২১ শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তে রাঙানো অমর একুশে বিশ্ব ইতিহাসের পরিমণ্ডলে এক নতুন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।

নতুন সহস্রাব্দ থেকে উনিশ বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলন বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা প্রীতি ও অন্তরঙ্গ চেতনায় এক নতুন ব্যঞ্জনা ও মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।

গত ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সংস্থার ৩০ তম সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয় ‘১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্নত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।’ প্রস্তাবটি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই তা উপস্থিত সকল সদস্যের সর্বসম্মতিক্রমে সাদরে গৃহীত হয়।

ইউনেস্কোর এ সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আত্নত্যাগের সংগ্রাম যেমন বিশ্ব-স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি বাঙ্গালি জাতিসত্তার গণ্ডিকে অতিক্রম করে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষী বা জাতিসত্তার মাতৃভাষার প্রতি পরম মর্যাদা প্রকাশ করছে।

ইউনেস্কো মনে করে মাতৃভাষা প্রসারের লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষা প্রক্রিয়ার ধারণা সমুন্নত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে এধরণের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সহিঞ্চু ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

Marma – Mother Tongue of Marma, Image: Bangla Tribune

একুশে ফেব্রুয়ারী ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পক্ষান্তরে গোটা বিশ্বের সকল মাতৃভাষারই স্বীকৃতি। এই দিবস হয়ে উঠুক সারা বিশ্বে একচেটিয়া ভাষার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আড়ালে জাতিগত শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে শোষিত জাতি ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসমূহের সম্মিলিত প্রতিরোধ দিবস।

বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত কিন্তু এই দিবসের সার্থকতা তখনই আসবে যখন বাংলাদেশের অনগ্রসর আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা সংস্কৃতিকে যথার্থ স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। কেননা মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান ও চিন্তন বিন্যাসের অভাবে সমাজে মৌলিক চিন্তা ও সৃজনশীলতার স্রোত সৃষ্টি হতে পারে না।

ভাষাগত পরাধীনতা মানুষের মৌলিক চিন্তাকে বিকশিত হতে দেয় না। তাই মনের মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা, মৌলিক অনুসন্ধিৎসার উপলব্ধি ও সৃজনশীলতা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার কোন বিকল্প হতে পারে না।

প্রতিটি জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান হল তার মাতৃভাষা। বাংলাদেশে প্রচলিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় একক ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি আদিবাসীদের বহু ভাষা-সংস্কৃতির ভাবধারার সূচনা হোক, এটাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আদিবাসীদের প্রত্যাশা।

আদিবাসীদের ভাষাগত অধিকার ও আইনগত ভিত্তি

ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার আগেও আদিবাসীদের মাতৃভাষার অধিকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদগুলোতে স্বীকৃত হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে ৫ই জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ৪০তম অধিবেশনে ১০৭ নং কনভেনশনে আদিবাসী ও উপজাতি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি করে।

উক্ত কনভেনশন এর ২৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে শিক্ষা দান করতে হবে, কিংবা যেখানে এটা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে তাদের সমগোত্রীয়দের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত ভাষায় শিক্ষা দান করতে হবে।’ আবার ২৩(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মাতৃভাষা বা আদিবাসী ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা কিংবা দেশের একটি অফিসিয়াল ভাষায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র ‘খ’ খন্ডের ৩৩ নং ধারার (খ) এ বলা হয়েছে, ‘পরিষদের (পার্বত্য জেলা পরিষদ) কার্যাবলীর ৩ নম্বরে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সংযোজন করা হবেঃ ১) বৃত্তিমূলক শিক্ষা ২) মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ও ৩) মাধ্যমিক শিক্ষা।’

চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের পার্বত্য জেলা পরিষদ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাঙ্গামাটি/খাগড়াছড়ি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ৩৬ (ঠ) ধারায় ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে’ আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’ এর ৩০ নং ধারায় উলেখ রয়েছে, ‘যেসব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ঐ ধরনের  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার সংস্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত করা ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সাথে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’

১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত International Covenant on Civil and Political Rights এর ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যেসব রাষ্ট্রে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় বা ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু বাস করেন, সেখানে ঐসব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির মানুষেরা ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগতভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজেদের ধর্ম অনুসরণ করা ও প্রচারের অধিকার নিরঙ্কুশ ভাবে ভোগ করবে।’ এ সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ প্রভৃতির আলোকে এখন প্রয়োজন হচ্ছে আদিবাসীদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলন ও চর্চা করার ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া।

আদিবাসীদের মাতৃভাষা প্রচলন ও চর্চাঃ সংকট ও সম্ভাবনা

যুগে যুগে ভাষাগত বৈরিতা ও জাতিগত বৈরিতা মানব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক উন্নত ও স্বাধীন দেশেও ভাষার সংঘাত রয়েছে। যেমন – কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসীর দ্বন্দ্ব। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

ভাষা বৈরিতার পাশাপাশি জাতিগত বৈরিতাও দেখা যায়। যার কারণে সংখ্যাগুরু ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর চাপে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরা নিজেদের বড় বিপন্ন মনে করছে বর্তমানে। রাষ্ট্রের ত্রুটিপূর্ণ ভাষা পরিকল্পনা নীতি অনেক সময় সুফল বয়ে আনে না। একটি ভাষাকে আইনের জোরে অন্য ভাষাগুলির উপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে নাজেহাল হতে হয়েছে বহু সংস্কৃতিকে।

ভাষাগত দ্বন্দ্ব সংঘাত অনেক সময় জটিল করে তোলে মূলত একই। এদের Bawm Bu Bulbu নামক অক্ষর জ্ঞানের বই রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র খিয়াং জনগোষ্ঠীরই ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। এক্ষেত্রে বর্ণনাত্নক ভাষাতত্ত্বের (Descriptive linguistics) সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

এই বর্ণনাত্নক ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় প্রথমেই কোন ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলোকে  চিহ্নিত করে কিভাবে ধ্বনিগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়, সেই রীতিগুলো খুঁজে বের করা হয়। এরপর বর্ণনাত্নক ভাষাতত্ত্বের দ্বারা আন্তর্জাতিক বর্ণমালার (International phonetic Alphabet IPA) সাহায্যে ভাষার ব্যবহৃত ধ্বনিগুলোকে লিপিবদ্ধ করা হয়।

এই IPA তৈরি করেছে ভাষাতত্ত্ববিদরা, যার দ্বারা পৃথিবীর যেকোন ভাষাকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্ত জনগোষ্ঠীর এখনো ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই, তাদের ক্ষেত্রে IPA এর মাধ্যমে প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটগুলো (রাঙ্গামাটি/খাগড়াছড়ি/বান্দরবান) প্রতিষ্ঠিত হবার পর আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত কার্যক্রম কিছুটা গতিশীল হলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম আরো বেশি জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশিষ্ট লেখক ও মারমা ভাষা প্রশিক্ষক ক্যশৈপ্রু মারমা ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহারের জন্য কয়েকটি প্রয়োগক্ষেত্র চিহ্নিত করেছিলেন।

(১) মারমা সাহিত্য, মারমা অনুবাদ সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে।

(২) গণশিক্ষা, গণসংযোগ, গণস্বাস্থ্য, নিউজ বুলেটিন সম্প্রচারের ক্ষেত্রে।

(৩) ধর্মানুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় নির্বাচন, সাংগঠনিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে।

(৪) মারমা সামাজিক ও প্রথাগত আইনকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ।

(৫) মারমা মাতৃভাষা শিক্ষা, চর্চা ও বিকাশের কার্যক্রমে।

(৬) ব্যানার, সাইনবোর্ড, পত্রালাপ, বার্তা প্রেরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে।

(৭) আঞ্চলিক মারমা ভাষাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষার সঙ্গে মৈত্রী সেতুবন্ধন গড়ার ক্ষেত্রে।

(৮) মারমা সামাজিক ক্রীড়ানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।

(৯) সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণে , কুসংস্কার দূরীকরণে, নীতি-নৈতিকতাবোধ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি কর্মে।

(১০) মারমা অক্ষর জ্ঞান ভিত্তিক ওয়াল ম্যাগ, লিটল ম্যাগ, ম্যাগাজিন প্রকাশনা ও মারমা ভাষার গবেষণা কর্মে।

(১১) মারমা সমাজ ও পরিবারে অক্ষরজ্ঞান প্রয়োগ কর্মে।

(১২) অধুনা কম্পিউটারে মারমা ফ্রন্ট সংযুক্ত হওয়ায় ঐ কম্পিউটারকে ব্যবহার।

(১৩) মারমা শিশু-শিক্ষা ও মারমা ভাষা শিক্ষার কার্যক্রমে, প্রভৃতি।

উল্লেখ্য যে, মারমা ভাষা ও বর্ণমালা প্রয়োগের জন্য যে ক্ষেত্রগুলো চিনহিত করা হয়েছে সেগুলো শুধুমাত্র মারমা ভাষার জন্য প্রযোজ্য নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল আদিবাসীদের জন্যই এ ক্ষেত্রগুলো প্রযোজ্য।

Mro – Mother Tongue of Mro, Image: Bangla Tribune

শেষ কথা

আলোচনার শুরুতে আমরা একটি গল্পের অবতাড়না করেছিলাম। গল্পে আদিবাসী শিশু বলিরামকে তার শিক্ষক মাতৃভাষার নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। বলিরাম সঠিক উত্তর দেবার পরও তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল এবং তার শিক্ষকের প্রদান করা শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে স্কুল থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু বলিরামের মত আর কোন আদিবাসী শিশুকে যে এভাবে স্কুল থেকে পালিয়ে বাঁচতে না হয়, তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভাষা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচলন করা হোক এবং সেই ভাষাগুলো যাতে পরিপূর্ণভাবে  বিকাশ হতে পারে তার জন্যে অনুকূল বাস্তবতা তৈরি করা হোক। এবং এটাই হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

সুপারিশ

১) আন্তর্জাতিক সনদগুলোর আলোকে আদিবাসী ভাষাগুলোকে রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করা। এ লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় লবি ও ক্যাম্পেইন জোরদার করা।

২) গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমস্ত আইন, ঘোষণা, দলিল প্রভৃতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভাষায় প্রকাশ করা।

৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের যাবতীয় চুক্তি, আইন ও দলিলপত্রাদি আদিবাসীদের ভাষায় প্রকাশ করা।

৪) পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের বিভিন্ন সভায় প্রত্যেক নিজ নিজ মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা করা ও দোভাষীর মাধ্যমে সেগুলি তর্জমা করা।

৫) পার্বত্য চট্টগ্রামের অফিস আদালতে আদিবাসীদের ভাষায় কাজ পরিচালনা করা, প্রয়োজনে অনুবাদের ব্যবস্থা করা।

৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র একটি শিক্ষাবোর্ড গঠন করে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দ্বিভাষিক (Bilingual) ও বহুভাষিক (Multilingual) পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা এবং শিক্ষকদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ লক্ষ্যে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা।

৭) আদিবাসীদের সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, সৃষ্টিশীল কর্মক্ষেত্র, গণস্বাস্থ্য, গণসংযোগ, নিউজ বুলেটিন সম্প্রচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি, রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক ও প্রথাগত আইন সংরক্ষণ-উন্নয়ন, মাতৃভাষা চর্চা ও বিকাশের কর্মক্ষেত্রে, ব্যানার তৈরী, সাইনবোর্ড তৈরী, পত্রালাপ, বার্তাপ্রেরণ, ক্রীড়ানুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ, কুসংস্কার দূরীকরণ, নীতি, নৈতিকতার মূল্যবোধ সৃষ্টি, অক্ষরজ্ঞান ভিত্তিক প্রকাশনা ওয়াল ম্যাগ/লিটল ম্যাগ/ম্যাগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদিবাসীদের ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহার করা।

৮) জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান চালু ও সম্প্রসারণ করা।

৯) উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট এর আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা।

১০) যে সমস্ত জনগোষ্ঠীর ভাষার লিখিত রূপ নেই তাদের ক্ষেত্রে লিখিত রূপ তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং এ লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা।

১১) আদিবাসী ভাষার অভিধান তৈরি করা এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বইপত্র আদিবাসীদের ভাষায় অনুবাদ করা।


তথ্যসূত্র

১) বাঙালীর জাতীয়তাবাদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ২০০০, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিং, ১১৪। মতিঝিল বা/এ, পোষ্ট বক্স-২৫১১,ঢাকা-১০০০

২) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে আদিবাসী ভাষা প্রয়োগ সম্ভাবনা-সুখেশবর চাকমা, আমাঙ, ২০০৩ সম্পাদক রনেল চাঙমা,জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক), রাঙ্গামাটি।

৩) Making Local Languanges count. By Peter Mwaura. Guardian August 21, 2003.

৪) EDUCATION The mother tongue dilemma: UNESCO

৫) What Do You Lose When You Lose Language? : Joshua Fishman, November 16, 1994.

সহায়ক রচনাবলী

৬) উপজাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি – ভাষা বিষয়ক সেমিনার সংকলনঃ ১৯৯৯-২০০১ঃ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, পার্বত্য জেলা পরিষদ, বান্দরবান।

৭) এই পৃথিবীর মানুষ-এ কে এম আমিনুল ইসলামঃ বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১৯৮৫

৮) AMANI KOK-2002 Hill Tracts NGO Forum; রাজবাড়ী রোড, রাঙ্গামাটি।

৯) সংহতি, ২০০৩ বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাড়ী-৩, রোড ২৫/এ বনানী, ঢাকা, বাংলাদেশ।

১০) চেদনা ২০০৪; মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা; বি. এম. এস. সি. কেন্দ্রীয় কমিটি।

এইচটি এন. এফ. জাক, কাপেং ও কেয়ার বাংলাদেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০০৫ উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধ।


লেখকঃ মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা, মংসিংঞো ও সুখেশ্বর চাকমা

তথ্যসূত্রঃ জুম লিটারেচার ইয়ং সোসাইটি। মাওরুম অপরাজেয় ভাষা সংকলন মার্চ ২০০৬

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা