পার্বত্য চট্টগ্রামঃ আদিবাসী কবি ও কবিতা
2936
এ সময়ের সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোচনায় ইংরেজি পোস্ট শব্দটি বাংলায় উত্তর বা পরবর্তী সময়ের অর্থদ্যোতক হিসেবে দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমনঃ বহুল উচ্চারিত পোস্ট মডার্নিজমেরই আধুনিকোত্তর বা উত্তর আধুনিকতা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই পোস্ট মডার্নিজমেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম পোস্ট কলোনিয়ালিজম বা উত্তর উপনিবেশিকতা। বলা হচ্ছে, পোস্ট শব্দটি সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান–ধারনা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। যার বিগলিত অর্থ হচ্ছে খুঁটি, যা ইতোমধ্যে পোঁতা হয়ে গেছে। যেখান থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। যেমন: পোস্ট অফিস বা পোস্টাল ব্যবস্থা। যার আরো সম্প্রসারিত মানে হচ্ছে খুঁটি পুঁতে ফেলার পর্যবেক্ষণ শুরু।
অর্থাৎ যা অবধারিত বা পরিবর্তন সাপেক্ষে নয় বিশ্বাস জন্মে গেছে বহুদিন আগে থেকে, তাকে গভীরভাবে বিশ্লেষন করা। স্মরণ করতে হয়, আজকের বাংলা ভূখন্ডসহ সমগ্র ভারত উপমহাদেশ ১৭৫৭ থেকে বিশ শতকের ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীন একটি উপনিবেশিক কালখন্ডে সময় অতিবাহিত করেছে। অতএব ‘৪৭ এর স্বাধীনতা– উত্তর ভারত প্রবেশ করেছে উত্তর–উপনিবেশিক বা পোস্ট কলোনিয়াল সমাজে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ বা তৎকালের পুর্ব পাকিস্তান সময়ধারার অনিবার্যতা থেকে পিছিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে এ ভূখন্ড তখন জড়িয়ে পড়ে নব্য উপনিবেশবাদী শাসন শোষণের জালে। যা থেকে এ ভূখন্ড ও তার জনমানুষের মুক্তি ঘটে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী হবার পর। অতএব, বলা যায় বাংলাদেশের উত্তর উপনিবেশিক সময়টা চেতন কি অচেতনে এখন পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিকতা তার মজ্জাগত স্বভাবের কারনেই ভূমিজ জীবনের সবর্ত্র জবর দখল কায়েম করে, পরস্পরতা চিন্তাশৃঙ্খলা ভেঙে দেয়, অতীতকে মুছে ফেলে সে জায়গায় শাসক কর্তৃক নির্ধারিত ইতিহাসের বীজ বপন করে। পাশাপাশি তার বিজ্ঞান–প্রযুক্তি ও নিত্যনতুন পণ্যসামগ্রী শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে বাজার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এভাবে বহির্জাগতিক সামগ্রিক আদিপত্য সম্পন্ন করার সমান্তরালে মনোজগতে গড়ে তোলে উপনিবেশিক প্রভু ও তার রূপসমুগ্ধ এক শ্রেণী।
যারা বিপুল স্তাবক রক্তে ও বর্ণে ভূমিজ হয়েও আচার আচরণের বেগানা, লোকায়ত সমাজবিন্যাস থেকে আলাদা, দূরবর্তী। এরপরও কলোনিয়াল উপস্থিতির দাপটে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত স্থানিক জীবনধারা, চিন্মায় ও আধ্যাত্বিক ধ্যান ধারনার জগৎটি কখনো থেমে থাকে না। ব্যাহত হয়, বদলে যায় কখনো কখনো, ভাঙচুর চলে, পাশাপাশি জেগে থাকে প্রকাশ্য ও পরোক্ষ দ্বন্দ্ব ও বিরোধক।
উপনিবেশিক সংস্কৃতির রাজনীতির চৌকস অবলম্বন বা পদ্ধতি। এখন, এই উত্তর উপনিবেশিক কালপর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক প্রত্যয়গুলো থেকে উপনিবেশের কালিমা ও কলস্কচিহ্ন গুলো মুছে ফেলার পরামর্শ নিয়ে এসেছে। এ কালিমা যেমন মূলধারার বাঙালি সমাজে বিদ্যমান, তেমনি এদেশে সুদুর অতীতকাল থেকে বসবাসরত আদিবাসী উভয়েরই রয়েছে স্বতন্ত্র লোকয়ত সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, গৌরব করার মতো সুকুমার সম্পদ।
পরিপূরকতার এই দিকটি প্রায়শ তলিয়ে দেখা হয় না, বরং উভয়েই পূর্বস্মৃতির কদাকার অভ্যাসগুলোতে জড়িয়ে পড়ে। বৈচিত্র্যহীন পুনবাবৃত্তি চলতেই থাকে। এতে দূরত্ব বাড়ে পরস্পরে। অথচ এ কালের জিজ্ঞাসা ও দৃষ্টিভঙ্গি ঐ দূরত্বের বিরুদ্ধেই তার অবস্থান ঘোষণা করেছে।
জীবন যাপনের আনন্দের মধ্যে সম্প্রীতির পরিসর গড়ে তোলাই কবিতার কাজ; কবিতাই পারে আজকের সমাজের পচনের দিকগুলো সঠিকভাবে ধরিয়ে দিতে। এভাবে পথ চিনে চলতে চলতে আদিবাসী কবিদের কাছেও অলক্ষ্যে পৌঁছেছে সমন্বয়ের সুর। জুমিয় (জুমচাষী) জীবনের সঙ্গে কনক্রিটের শ্রমিকের ঐক্যের কথা। প্রকৃতপক্ষে উত্তর উপনিবেশক সাহিত্য সমন্বয় ও সমীকরণের কথাই বলতে চায়, বলছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক্য অচ্ছেদ্য। মূলত মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির সন্তান। সে অর্থে মানুষের সব ধরণের কর্মযজ্ঞে প্রকৃতির রয়েছে নিঃশব্দ অবদান, স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। প্রকৃতির ছায়ায়, কোলে মানুষের জন্ম, বেড়ে-ওঠা, পরিণতি ও পরিসমাপ্তি। মানুষের সার্বিক জৈবক্রিয়ায় প্রকৃতির এই যে অবস্থান, তার সৌন্দর্যতাত্বিক প্রকাশ ঘটে সুকুমার শিল্পকলায়; যেখানে সাহিত্যে তমিলি অধিষ্ঠান। মানবিক সৃজনশীলতার এই পর্বে সহজ অনেক সময় জটিল, জটিল অনেক সময় সহজতররূপে প্রকাশিত হয়। শেষোক্ত বৈশিষ্ট্যটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গীতিকবিতায় বিশেষভবে লক্ষণীয়।
কিন্ত রাজনৈতিক ও গবেষণাধর্মী প্রথাগত লেখালেখি বাদ দিলে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী, ১১ জাতিসত্তার সৃজনীসাহিত্যে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের বর্ণাঢ্য ও জৌলুসময় উপস্থিতি সবার আগে চোখে পড়ে। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অরণ্য ও ঝোপঝাড়ের সমবায়ে গড়ে উঠেছে। এখানে চলমান নগরায়ণের যৎসামান্য ছোয়া লাগলেও অধিকাংশ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি তাদের প্রকৃতি লালিত ঐতিহ্যবাহী ও পরস্পরাগত জীবনধারাকে বহন করে চলেছে আজো। সুতরাং এ জীবনের প্রতিভাস তাদের গীতিগুচ্ছ ও কবিতায় খুব স্বাভাবিক দাবীতেই অস্তিত্ববান। বলাবাহুল্য, অস্তিত্বের এই সৌন্দর্য এখানকার প্রাকৃতিক বাস্তবতার অভিন্ন প্রকাশক, দ্যোতক ও উদ্দীপক।
চাকমা কবি ও কবিতা
ষোড়শ শতকে, অন্যমতে আঠারো শতকের চাকমা আদিবাসী কবি শিবচরণ থেকে একদম একালের তরুণ কবি সুগম চাকমা, নির্মল কান্তি চাকমা, পিরফর চাকমা, মুক্তা চাকমা, নতুনময় চাকমার সদানন্দ প্রকৃতির স্বচ্ছ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করি। যেমন, কবি শিবচরণ চাকমা লোকভাষায় প্রকৃতির কথা বলেছেন;
উজানি ছড়া লামনি ধার।
ন এল সিরিস্তি জলৎকার।
জল উবুরে গোর্জ্যে থল।
গোঝেনে বানেল জীবসকল।
(উজান থেকে স্রোত নিয়ে বয়ে যায়। ছিল না কিছুই শুধু জল ছিল; জলের ওপর একদিন স্থলের সৃষ্টি হলো – পরম গোসাই এভাবে জীবজগৎ সৃষ্টি করলেন।)
পৃথিবী সৃষ্টির গোড়ায় জলের যে ভূমিকার কথা শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থগুলোর পাতায় পাই – এ ছবি তার সঙ্গে সমার্থক। একে ধর্ম প্রভাবজাত প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ ও বলা যেতে পারে। বিগত বিশ শতকের সত্তর দশকের চাকমা কবি চিত্রমোহন চাকমার একটি কবিতা এ রকমঃ
সূর্যটা চলছে অস্তাচলে – সাদা মেঘগুলো বিপরীতে
শংকায় ভাসছে আকাশে আকাশে-
মনে হয় প্রদীপ্ত মুখটা তার কতদিন দেখিনি এ চরাচরে….
বসে আছি শুভলঙ নদীর কিনারে;
ভেজা কাপড়ে জুমিয়া কত নারী তুলছিল জল,
কেউবা পিছল খেয়ে কেঁদেছে অনেকক্ষণ-
তারই বেদনার রঙ ছড়ালো কি আজ এই
সুর্যাস্তের লালিমায়?
বুনো কত পাখি আসে আর যায়
সবুজ পাতায় মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে গান গায়;
দূর বিকেলের ঝিঙে ফুলগুলো
ফুটে আছে ম্যাচাঙে উৎকর্ণ হয়ে যেন-
কার পায়ের শব্দের প্রতীক্ষায়।
গায়ের রূপসী বধু, কোলাহলপ্রিয় যুবক- যুবতী
ঘাটে আসে-
ভিড় করে হাসে ওরা:
তখন আশাটা জাগে খুব আমি যেন-
আলোকিত পিলসুজ!
ঐ একই দশকে জীবনের নানা অনুষঙ্গ সাড়ম্বরে চাকমা কবিতায় পল্লবিত হয়ে ওঠে। যারা পার্বত্য রাঙামাটিতে এই নতুন শৈলী সংযোজন করলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ সমিত রায়, সলিল রায়, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, সুহৃদ চাকমা, সুগদ চাকমা, কবিতা চাকমা প্রমুখ। লক্ষণীয় বিষয়, আধুনিক কবিতার ফ্রেমের ভেতর যে চরম আত্মগত মানুষগুলোকে সচরাচর দেখা যায়, চাকমা কবিতায় সেই বিচ্ছিন্ন সত্তাটি খুব একটা উপস্থিত নেই।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের ফ্ল্যর মাল বা ক্লেদজ কুসুম কাব্যটিকে যদি সামগ্রিকভাবে দুনিয়ার আধুনিক কাব্যাবলির জনপ্রিয়তা বলে মনে মান্য করা হয়, তাহলে তীব্রতার সঙ্গে ঐ চূড়ান্ত আত্মতাকে আধুনিক কাব্যের কুললক্ষণ বলে শনাক্ত করতে হয়।
অবশ্য একালের বিভিন্ন ধীমান বিশ্লেষকের নানা দিকের প্রবল আলোকপাতে এখন আর বিষয়টিকে শুধুই ব্যক্তিতা, শুধুই বৈপরিতা, শুধুই জটিলতা, নিঃসঙ্গতা বা কুন্ডলিত জীবনের দ্যোতক বলে না মানলেও চলে।
খোলা চোখে দেখলে বোঝা যায়, আধুনিকতার বিরাট ক্যানভাসের ভেতর নানা প্রান্তিক জীবনের গন্ধ-স্পর্শ ও অনুভূতি মিশে আছে। যে অনুষঙ্গগুলোতে সমাজের সংহতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে এড়িয়ে অথবা তাদের গায়ে গুরুত্বহীনতার তকমা এঁটে দিয়ে আধিপত্য ও ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিদ্বন্ধী মানসিকতা থেকে ওঠে আসা সর্বব্যাপী শূন্যতা- উদ্বেগ ও যন্ত্রণাকে মহীয়ান করা হয়েছে এবং সে সময়ের প্রায় একক মুদ্রণ বাণিজ্যের ফজিলতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারের সুব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়েছিল।
এসবের প্রতিষ্ঠিত গ্যাঁড়াকলে আটকে গিয়ে চেতনার নবীনত্ব সন্ধানীরা দীর্ঘদিন হাঁসফাঁস করেছেন। সঙ্গে এই থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন। বিশেষ বিশেষ ভূ-খন্ড ও সেখানকার কালখন্ডকে বিশেষ দর্পে দর্পনে দেখে দেখে বিভাজন নির্মাণ ও শাসনক্রিয়া চালানোর ব্যাপারটা এখন আর ভাব-বিলাসিতার পর্যায়ে নেই।
ফ্রাসোয়া লিওতার, মিশেল ফুকো ও তাদের অনুসারী এ কালের নতুন চিন্তকরা এটিকে বেশ ভালভাবেই পোস্ট মর্টেম করেছেন। আধুনিকতার পেরোনো নবকালপর্ব পোষ্ট কলোনিয়াল বা উত্তর উপনিবেশিক সময়ের ব্যাখ্যা দিয়ে এ সময়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও মুখাবয়বটি তাঁরা স্বচ্ছতর ও খোলসা করে দিয়েছেন।
এখন তাই দীর্ঘ অবহেলার আস্তরণে ঢাকা পড়েছিল, তাকে রত্নপাথরবিশারদদের নিষ্ঠায় তুলে আনা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে। এদিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সংস্কৃতি ও সাহিত্যকর্মকে অবলোকন করা যায়। এভাবে দেখে ভূমিজ সংস্কৃতি ও জীবনধারা চাকমা কবিতায় অনায়াসে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে জীবন-অনুষঙ্গের লোকায়ত উদ্ভাবন সমূহ।
এখানে এখনো জটিলতা অতিক্রমী মনের মাধুরি মেশানো রোমান্টিক আবহটি বেশ সতেজ, চঞ্চল, ঘনিষ্ঠ ও সংরাগময়। এ অনুধাবন কবির একান্ত নিজস্ব হয়েও মানুষী অনুভবের চিরায়তিকতার সহগামী। যেমনঃ
মেয়েটার নাম রাখলাম: লুকোচুরি
ফোটালো সে ফুল-মনের ময়ুরী;
বাড়ে, দিন দিন সে কখন বড় হয়
মনের ভেতরে একা-একা কথা কয়;
দখিনা বাতাস এলে
দোলে সুবাসে-সুবাসে হেসে খেলে;
পাপড়ির বুক মেলে দিয়ে হাসে
হৃদয়ে আমার শান্তি আসে;
এ সুঘ্রাণ তার স্বভাবের অন্তর্গত
চাই থাকুক সে চিরকাল গন্ধ বিতরণরত…..
[দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা; ১৯৪৯-৯৬]
অন্যদিকে সুহৃদ চাকমার (১৯৫৮-৮৮) কবিতায় চলাচল করতে দেখি নিঃসঙ্গতার রাঙতা- মোড়ানো (খরস্রোত) পাহাড়ি ঝিরির সুদূরপিয়াসী এক মাঝিকে। একটি বিকাশপ্রবণ ব্যক্তিসত্তার সংশয়ী দোলাচলে এ কবিকে অনন্য বৈশিষ্ট্রে ভাসতে দেখি। যদ্দুর জানা যায়, সুহৃদ চাকমা আশির দশকে পার্বত্য রাজনীতির অভ্যন্তরণীর জিঘাংসার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। ইতোমধ্যে প্রবল সাংঘঠনিকতা জুম ঈথেটিকস কাউন্সিল নামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সুনামের অধিকারী সংগঠনটির গোড়াপত্তরনকারীদের তিনি অন্যতম। একই সঙ্গে তার সৃজনশীর সত্তার পরিচয়বাহী কাব্যগ্রন্থ বার্গী (১৯৮৭) তার বাক্যিক উপস্থিতিতে বাঙময় করে রেখেছে চাকমা আদিবাসী সমাজে। এ কাব্যের একটি কবিতাঃ
মন গাঙের গহিন -স্রোতে ভাসতে- ভাসতে
একদিন ভাবিঃ স্বপ্নের কুহকী বেঠা বওয়া – বওয়ি থেকে ছুটি নেবো;
স্বপ্ন প্রসাদের সিড়ি ভেঙ্গে
সবুজাভ মন্ত্র জপতে- জপতে মনে হয়-
এই বুঝি ফেরার সময় হলো- অথচ পরক্ষণেই
অগলগ পাখির বিলাপে টের পাই:
আসলে স্ত্রী- পুত্রের মায়া থেকে বিযুক্ত উদ্বাস্ত আমি এক!
স্মৃতির স্বর্ণালি জাল ছিড়ে ফিরে আসি শেষে,
গাঙের নির্জন -স্রোতে-
সুপরিচিত বৈঠায় আবারো আমার হাত রাখি;
তারপর ক্রশম হারিয়ে যাই-
দূরে- বহুদূরে-
অগলগ: চাকমা ভাষায় পার্বত্য অঞ্চলে সুপরিচিত বুনোপাখি।
চল্লিশের দশকে চাকমা কবিতা (১৯৪৫) প্রকাশ ও সম্পাদনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট্য চারুশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান (১৯১১-৫৫) চাকমা সাহিত্যে যে প্রবাহের সূচনা করেছিলেন, বলা যায়, তাই স্রোতোবহ হয়ে ওঠে উল্লিখিত কবিদের হাতে।
মারমা কবি ও কবিতা
বাংলাদেশের আদিবাসীরা বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সংখ্যায় ক্ষুদ্র জাতির কবিরা খুব সংগত কারণেই তাদের মাতৃভাষায় লেখালেখি করবার প্রবল আগ্রহবোধ করেন। এটা বোঝা যায় বিভিন্ন সময়ে, উপলক্ষ্যে প্রকাশিত তাদের ছোট ছোট প্রকাশনাগুলোর ওপর নজর ফেললে। আদিবাসী উচ্চারণের বাংলা হরফে এসব কবিতা বা গদ্য ছাপা হলেও পাশাপাশি একেবারে নিজস্ব নিটোল বাংলা ভাষায়ও তাদের অজস্র মৌলিক কবিতা বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত হচ্ছে।
এসব কবিতায় সমকালীন জীবনের নানান আকৃতি, রূপাবয়ব, মুখশ্রী ও মুখোশ, নানা প্রশ্ন ও সদুত্তর না পাওয়া বেদনা যেমন রয়েছে, তেমনি চোখে পড়ে নিবিড় সারল্যমন্ডিত জীবনের সবুজ শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতিঘন হয় চেতনাও। এসব এসেছে জীবনধারার অনিবার্য বাস্তবতা থেকে; যে বাস্তবতা হরিৎ অরণ্যশাসিত জনপদের একান্ত নিজস্ব। যদিও এখন তা নানাভাবে বিপন্নপ্রায় ক্রমেই ধরাছোঁয়ার বাইরেই চলে যাচ্ছে এবং মনে হয়, কোনো একদিন যদি পার্বত্য অঞ্চল সম্পূর্ণ অরণ্যশূন্য হয়ে পড়ে, তারপরও, ওখানকার আদিবাসী কবিদের হাতে অরণ্য ও পাড়া প্রশস্তির কবিতাই রচিত হবে বেশ। কারণ পাওয়ার আনন্দের চেয়ে হারানোর বেদনা যে দুর্নিবার।
বাস্তবতাকে এড়িয়ে নস্টালজিক বা অতীতচারিতার গভীর ও সংবেদীঅনুধ্যানে পৃথিবীর বহুভাষায় অমর ও চিরস্থায়ী কাব্য, কথাসাহিত্য কি স্মৃতিচারণ রচিত হয়েছে। ইদ্দিশ ভাষার একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি হিসেবে কথাসাহিত্যক আইজাক বাসিভিস সিংগার তাঁর ‘শোশা’ উপন্যাসটি রচনা করেন। তাতে তার জীবনের বাস্তব ঘটনাবলির চাইতে গুরুত্ব পেয়েছে অতীতে যাপিত ইদ্দিশ ভাষাভাষী মানুষের নস্টালজিক চেতনা।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও একই ব্যাপার ঘটেছে। সিদ্ধাচার্যগন তাদের দুর্র্বিসহ বর্তমানকে এড়াতে নানা রুপক ও উপমার আশ্রয় নিয়ে অতীতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথাই তাদের বলেছেন নানাভাবে, ভঙ্গিতে। আবার বিপরীত চিত্রও আছে। যা পরবর্তীকালে মানুষের রসবোধে নিষিক্ত হয়ে আছে অসাধারন সৃজনকুশল বা কথাসাহিত্যের আবেদন নিয়ে।
আসলে অরন্য ও পাহাড়ের অনস্বীকার্য ব্যঞ্জনাটি একধরনের স্বত:স্ফূর্ত উত্তরাধিকার – যা অনিবার্য স্ফুটিত হয়েছে পাহাড়ের কবিদের লেখনীতে, তাদের চেতনার জুমঘরে। অনুভব করা যায় এটি শুধু পার্বত্য – অঞ্চলের কবি –শিল্পীদের বেলায়ই সত্য, অন্যত্র নয় এমনটি ভাবার কারন নেই। জলাভুমির কবি, মরুভুর কবি, তুন্দ্রা কি উষর ভুগোলের কবি প্রত্যেকের বেলায়ই ওই পরিপাশ ও অতীত চেতনা তার সৃজনশীলতার সৈকতে আছড়ে পড়ে। এ এক বিধিলিপি যেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকজন মারমা কবির সংগে আলাপচারিতা, সেই সুত্রে তাদের ওই কবিদের প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষার আলোয় আলোকিত। নানা কৌকি ও রৈখিক অভিজ্ঞতায় তাদের চেতনার ভন্ডার সমৃদ্ধ। তারা শিক্ষায় তনিক বা জীবিকার নানা অনুরোধে বিভিন্ন বিপরীত ও বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দীর্ঘ সময় নগর ও নগর মানুষের সাহচর্যে কাটিয়েছেন। নাগরিক আচার আচরণ ও নাগরিক বাচনসমুহ রপ্ত করেছেন। সময়ের নানা বাকে, নানা স্রোতে নিজেদের মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
অথচ তাদের গভীর মনোনিবেশী কাজটাতে কবিতার ছায়া এসে পড়ছে দূর অরন্যের কুহেলিকার, শৈশব কৈশোরের পার্বত্য আবহের। কৌম সমাজের ভালবাসার কথা, মৈত্রীর বারতা স্বপ্নের সৌরভ ইত্যাদি এসে দখল করে নিচ্ছে মনের জায়গাজমি।
কবি ক্যশৈপ্রু, উ চ হ্লা, মংক্যশোয়েনু নেভী, চথুই ফ্রু, মংসিংঞো কিংবা খাগড়াছড়ির উশ্যেপ্রু মারমার কবিতায় স্বভাবসম্মত পরিচর্যা বেশ বলিষ্ঠ সরলতা ও গীতলতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কবি উ চ হ্লা প্রকৃতি ও মানুষের কথা উত্থাপন করেছেন তার কবিতায় একটু অন্যভাবে:
মাঠের ওই কবি আমাদের জীবন বাঁচায়,
রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সে ফষল ফলায়-
তাদের কল্যাণ হোক, নত হই,
প্রার্থনা জানাই।
এসো আমাদের চিরায়ত ললিতকলার সংস্কার করি
এসো ক্যাপ্যা, রোদু, নৃত্যগীত রক্ষা করি
প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মী দেশগড়ার বিরাট ব্রতে
স্বপ্ন রুয়ে যায় সমৃদ্ধির।
ক্যাপা : মারমা গীতিকবিতা; মারমা সমাজের ঐতিহ্যগত পুথিপাঠ। লক্ষনীয়, মারমা কাপ্যা শব্দদি বাংলা কাব্য শব্দের খুব কাছাকাছি। অর্থও প্রায় এক।
প্রথাগত মারমা গীতকবিতায় ধারা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন মংক্যশোয়েনু নেভী আর মংসিংঞো । গত শতাব্দির আশি ও চলমান শতকের শূন্য দশকের কাব্যজাতক ওরা । নেভী পছন্দ করেন তার ঐতিহ্যগত ধারাক্রমের ভেতর বসবাস করতে আর মংসিংঞো ওই ধারাবাহিকতায় নব্যসময়ের ওয চড় লেগেছে, পলেস্তরার যে অংশটুকু খসে পড়ছে বেগানা, নোনা হওয়ার স্পর্শে, সেদিকটায় সতর্ক নজর রাখেন। নেভী ভাবেন, তার আদিবাসী ভাষাটাকে সুরক্ষা দিতে পারলে নতুন একটা চিন্তা, নতুন একটি দিগন্তের খোজ পাওয়া যাবে:
এবার আমাকে উচ্চারন করতে দাও
জাইত, মারমা লাংগা আর পাংখু
শব্দসমুহের প্রমিত বাণী;
ফাল্গুনের দাবদাহে এখানে খোলস ফেটে জন্ম নেবে
এটি নতুন ভাষাভঙ্গি
নতুন বর্নমালায় এখানে লিখিত হবে
অনাদিকালের কাপ্যা : রোদু, রাগাইন, জাতকপিটক
বিনির্মিত হবে এখানে নতুন ব্যঞ্জনায়…….
জাইত: মারমা গীতিনাট্য; লাঙ্গা: লোকসংগীত; পাংখূ: অনেকটা বাংলাদেশের প্রচলিত যাত্রার মতো গীতপ্রধান নাট্যকর্ম
মংসিংঞো স্বাতন্ত্র্যমতিন্ডত তরুন কবিকন্ঠ। ভ্রুকুটি – কুটিল রাজনীতি আর সামাজিক বাস্তবতা তার ওঠে আসে একটি ভাবাবেগের হঠাৎ উদ্ভাসনের মতো। যেখানে কবির তার কবিতায় মতো। যেখানে কবির মর্মযাতনার চাপা রেশটি অনুভববেদ্যতার বাইরে থাকে না আর পাঠকের। সভ্যতার পবিত্র পাগল নামের কবিতায় মংসিংঞো বলেন:
স্বপ্নের ফসলে দু:স্বপ্নের সহস্র পাখি ঝাক
জেঁকে বসে জুমখেতে-
চিরহরিৎ বনের বাঁশ কেটে – কেটে
ভেলা সাজিয়েছে
সভ্যতার পবিত্র পাগল ।
দড়ি – ফাঁস লাগিয়ে বাশের ভেলা
টেনে নিয়ে যায় নদীর উজানে।
প্রতিকুল স্রোতে জাতিস্মর এক চাষা
চেতনায় চিরায়ু চেরাগ হাতে
ইতিহাসের মুখাবয়বে একে দিল একটি আকৃতি :
অগ্নিতপ্ত সোনালি ধারনা ছিল যার মধ্যে…………….
অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত তরুন উদ্দেশ্যপ্রুর অনুভতিও স্বপ্নকাতরতাময়। পুরাকালিন পার্বত্য জনপদের সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ ও দিনগুলো আবার ফিরে আসুক, এ তার চাওয়া:
আজো আমি চেয়ে আছি স্বপ্নের প্রান্তরে
চেতনায় নতুনের মুগ্ধতার গান গাই ;
কংরই পাখির সুরে নেচে ওঠে প্রান-
আমার অস্তিত্ব ফিরে পাবো একদিন ।
জুমখেতে মুখরতা ছড়িয়ে পড়বে আবার
মুক্ত পাখি উড়বে আকাশের ঢালে-ঢালে;
পাহাড়ি বিশোরী ছুটে যাবে ঝিরি – ঝরনায়
সজীবতা ফিরে আসবে নতুন করে।
জুমিয়া নারীর সন্তান বীরদর্পে ফসল ফলিয়ে
জীবনকে গড়বে নিজের মতো করে-
পাহাড়ের শান্তিময় পদধ্বনি আবার শুনতে পাবো
নবরঙে জীবন গড়ার প্রস্তুতিতে।
ত্রিপুরা কবি ও কবিতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ত্রিপুরাদের মুল আবাসস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং আশপাশে। তেরো’শ চৌষট্টি বছর (৫৮৫ -১৯৪৯) পর্যন্ত স্বাধীন – সার্বভৌম রাজ্য ছিল এটি। ভারতভাগের পর ১৯৪৯ সালে ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ত্রিপুরায় স্বাতন্ত্র্য লোপ পায়। তখন থেকেই কিছু সংখ্যক ত্রিপুরা বর্তমান বাংলাদেশ ভুখন্ডে বসবাস করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের সংখ্যা এখন প্রায় লক্ষাধিক।
ত্রিপুরা সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপুর্ন বাংলাদেশি সংস্কৃতির একটি অংশ। ককবরক ছিল সেকালের ত্রিপুরা রাজ্যর সরকারি ভাষা। এ সমৃদ্ধ ককবরকে রচিত হয়েছে পৌরানিক কাব্য, জীবনচরিত, বিস্তর লোককাহিনী।
ত্রিপুরার মহারাজাগন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। স্বাধীন ত্রিপুরার শেষ দিককার দুই মহারাজ রাধাকিশোর মানিক্য (১৮৯৬-১৯০৯) ও বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য (১৯০৯-১৯২৩) কবি রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) বিশেষ সমঝদার ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মতো জীবনধারাও গড়ে উঠেছে যাযাবর জুমিয়া সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের ভেতর। ককবরক ভাষায় যার নাম হাচুক। এই হাচুক জীবনে ত্রিপুরাসমাজ বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় বসতভিটা ছেড়ে সপরিবার গাইরিঙ (জুমঘর) গিয়ে বসবাস করে।
ছয় মাসের মতো এখানে অবস্থানকালে তাদের মধ্যে ফুর্তি পায় সৃজনশীলতার আনুকূল্য। সে সময় পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে সুর। রচিত হয় কাব্য, নানা সুখ-দু:খের গাথা, কিংবদন্তি। ত্রিপুরা কৌমজীবনের এ অনুষংগগুলি বাক্সময় করেছিলেন প্রয়াত সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ও আরো অনেক ত্রিপুরা কবি ও শিল্পী সাহিত্যক তাদের রচিত গান ও কবিতায়।
ত্রিপুরা সমাজের বর্ষীয়ান কবি বরেন ত্রিপুরা। পঞ্চাশ দশক থেকে ককবরক ও বাংলা ভাষায় নিরন্তর লেখালিখি করে আসছেন। ত্রিপুরা লেখকসমাজে কাচাক-ছা ছদ্মনামে সবিশেষ পরিচিতি তার। জীবনযাপনের একেবারে আটপৌর দিকগুলো তার কবিতায় খুব বর্নাঢ্যভাবে উপস্থিত হয়।
অন্য অনেক নারী থেকে প্রিয়তমার আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে একটি কবিতায় তিনি তার বর্ণনা দিচ্ছেন:
প্রিয়তমা আমার রূপে ও গুণে দেবীর সমান-
পান-আকৃতির সুন্দর মুখাবয়বে দুই
পুরুষ্টু যমজ ঠোট;
কানের লতিতে শিমফুলের অপুর্ব দুল,
শসাবিচির মতন শুভ্র দাতে
নি:শব্দের মনকাড়া হাসি;
ওর মটরশিমের মতো সুপষ্ট আঙুুলগুলো
আমাকে টানতো খুব;
বোলতোর মতো চিকন কোমরে রিনাইখগ্রি-
কালো পাড়জুড়ে যার রুপোর চেইন
যখন হাটতো-ভারি নিতম্বের ওপর নাচতো,
ওর জানুছোয়া খোলাচুলে খোঁপা বেঁধে
যখন গুজতো
খুমপৈ ফুলের সজীবতা-
আলোয়-কালোয় শুরু হতো হৃদয়ে – হৃদয়ে কোলাহল।
রিনইখগ্রি : কুমারী মেয়েদের অধোবাস; খুমপৈ : রক্তাভ বুনোফুল
কবি মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা লেখালিখি করেছেন ষাট দশক থেকে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কামারকুট ছড়ায় তার বাড়ি। বাংলাদেশ বেতার – চট্টগ্রামে অনুমোদনেপ্রাপ্ত প্রথম ত্রিপুরা গায়েন। উল্লিখিত জেলার মাটিরাঙা কলেজে তিনি সমাজবিঞ্জান পড়ান। প্রচ্ছন্ন উপমা প্রয়োগে তার কবিতা অনন্য এক দীপ্তি লাভ করে:
পাহাড়ের ঝোপে
বাশে দোলা লতায়-পাতায়
আঙিনার ঝাড়ের ভেতর
ফুটেছে একটি ফুল দক্ষিণের নরম বাতাসে
মৌমাছির দল
এখানে মদিরাময় ঘ্রানে ছুটে আসে,
মাতোয়ারা হয় জুমিয়া যুবতী
খুব খুশিতে খোপায় গুজে প্রস্ফুটিত খুমবার
কেউ কেউ সাজি ভরে
মন্দিরের বেদিতলে রেখে আসে ওকে;
রম্য সুরভিত কুসুমিকা, দেখো-
মানুষ রাখেনি ব্যবধান কোনো
তোমার আর দেবতার মধ্যে!
প্রভাংশু ত্রিপুরা আলোচ্য জনগোষ্ঠির একজন মান্য একজন মান্য বুদ্ধিজীবী। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়িতে মদন কারবারি পাড়ায় জন্ম। ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরা সংস্কৃতির ওপর বেশ কয়েকটি প্রকশনা রয়েছে তার-ত্রিপুরা জাতির লোকসংগীত (২০০১), ত্রিপুরা জাতি ও সংস্কৃতি (২০০২), খাড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস (২০০৬)। গেল শতকের আশির দশকে আইতারামা (শুকতারা) নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছে তার সম্পাদনায়। সত্তর দশক থেকে লেখালেখিতে নিবেদিত। তার একটি কবিতা:
ঐ পাহাড়ের এক চিলতে বাঁকে
টানা-টানা চোখ যে- মেয়েটি থাকে
শরীরের হলুদ আভায়
আমাকে ভাবায়
তার খোপার দোপাটি বিকেলে পড়লো লুটে
লুটোপুটি কোথাকার হাওয়া এলো ছুটে
জুমপোড়া মাটি পাড়ি দিতে দিতে
কাকে যেনো খোজে গোপন-সম্বিতে
এ সময় বারবার
আমার ভেতর জাগে সংগীতের বারোয়ার
ওই মেয়েটার জন্যে
হারিয়েছে সব-এই জনারন্যে……
দীনময় রোয়াজা আশির দশকের কবি। জন্ম খাগড়াছড়ি বাঙালকাঠি গ্রামে। বাংলাদেশ বেতার –চট্টগ্রামে ত্রিপুরা গানের নিয়মিত শিল্পী। বিদ্যামান সামাজিক অবস্থান থেকে তিনি উত্তরনকামী। একটি সুন্দর দিন, প্রানবস্ত সময়ের জন্যে তার হৃদয় উন্নুখ। একটি কবিতায় দীনময় রোয়াজা বলেছেন:
জাগো পাহাড়ের যুবক-যবতী;
বৈরী বৃষ্টি? তবু চলো বাইরে – অনেক
পথ পাড়ি দিতে হবে
পাহাড় স্থবির-আমরা তো নই
ভবিষ্যতের হাওয়ায় করি চলাচল;
চেয়ে দেখো, ভারি চতুর সময় বয়ে যায়-
দীপ্ত তেজে এসো সামনে এগোই………………
(সত্যসাং) ত্রিপুরা দশকের হিসেবে নব্বইয়ের কবি। পার্বত্য বান্দরবান জেলায় বসবাস। স্থানীয় কাগজে কবিত, গান লেখেন। পাহাড়ের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তিকামী এ তরুন আগামীর প্রত্যাশা করেন। দুর্গম পথ, মেঘাচ্ছন্ন দিন পেরিয়ে আকাশের সান্নিধ্য পেতে চান:
দুর্গম পথেই আমাদের যেতে হবে
তারপরই আকাশ, অনেক খোলা মাঠ,
দুয়োরে দাড়িয়ে থাকা রাঙা সুপ্রভাত।
সংকুচিত স্বপ্নের পাপড়িগুলো
আমাদের ডাকছে-
সজল হাসির ফোয়ারায়
আজ সকল ফুলের গতর ভাসিয়ে দেবো, এসো !
বাজুক এখানে নাচে-নাচে সকলের বুকে প্রেম আর প্রীতির সানাই!
তঞ্চঙ্গ্যা কবি ও কবিতাঃ
তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া সংস্কৃতির অন্যতম অংশীদার। এ- অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জুমিয়া সমাজ চাকমাদের ভাষা ও ধর্মীয় কিছু কৃত্যের সংগে সমিলতা থাকায় অনেকে ওদের চাকমা বা চাকমা সমাজের অন্তর্ভুক্ত একটি শাখা বলে ভুল করেন। বলা চলে ধারনাটি বাংলাদেশ বেশ চালুই হয়ে গেছে। অথচ তঞ্চঙ্গ্যাদের দাবি তারা সম্পুর্ন আলাদা নৃত্তাত্তি¦ক সত্তা। সুদুরকালে বর্তমান মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত আরাকানদের একটি প্রাচীন ভুখন্ডের নাম ছিল দান্যাওয়অদি। আধিপত্যে তারা ওই দান্যাওয়াদি থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমান টেকনাফ- আলিকদমের তৈনছড়ি নামক জায়গায় বসতি গড়ে তোলে। তৈনছড়ির বাসিন্দা:
এ অর্থৈ তাদের নামের সঙ্গে শব্দটির অপভ্রংশ তঞ্চঙ্গ্যা যুক্ত বলে মনে করা হয়। দীর্ঘদিনের লালিত ঐ সংকট, পারিপার্শ্বিকতার দোলাচল, আপন-পর অনুভতির বৃত্তে এদের জীবনধারা বলয়িত গানে সহজিয়া ধারার প্রতিফলিত হয়েছে।
এ সময়ের তঞ্চঙ্গ্যা কবিদের লেখাজোকায় কখনো – সখনো বিষয়টির কাঁপা কাঁপা উপস্থিত দৃষ্টি এড়ায় না সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে; যৌবনের প্রতি টান, সুদুরের পিপাসা, জীবনে পাওয়া না পাওয়ার কষ্ট, সমকালবোধ এইসব অনুষঙ্গ। খুব সহজ ভাষায় তাদের সমাজের আবেগ-আকাঙখার প্রতিনিধিত্ব করেন তঞ্চঙ্গ্যা কবিরা।
(শ্রীবীরা) কুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রবীণ কবি। পার্বত্য জীবন, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যর নানা প্রসংগ নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন লেখালেখি করছেন। তার কবিতায় সমকালীন পার্বত্য সমাজের নানা রৈখিক ভাঙাগড়া, পরিবর্তন ও দন্দের ছবি ওঠে আসে:
মনোরম নিসর্গ শোভিত রাঙামাটির আকাঁবাঁকা পথে-
হাটতে গেলেই সারাবেলায় দেখা হবে জুমিয়া ললনার সাথে।
সালোয়ার- কামিজ পরিহিতা, কাঁধ ওড়না, ঘরে বোনা রাঙা খাদি,
চকিত – চঞ্চল ভীরু হলেও তার চাহনিতে যেন সে বড় আশাবাদী।
প্রত্যন্ত গ্রামের জম্মবি, প্রতিযোগিতায় নেমেছে শহুরে মেয়ের সাথে-
জুমে ফসর ফলে না আর বাঁচবার জন্য সম্বল নেই যে তার হাতে।
পিতামাতা,ভাইবোনেরা এখনো রয়েছে পাহাড়ের জুমঘরে-
টাকা নিয়ে ফিরবে জুম্মবি, দিবারাত্রি তারই প্রতীক্ষা করে।
এনজিও চালক ও অন্য অফিসের কর্তা আশা দিয়েছিল তারে চাকরি দিতে-
আশায় বুক বেঁধে বারংবার যোগাযোগ রেখেছিল তাদের সাথে।
চলনে- বলনে- চাহনিতে তার ফেলে আসা চম্পকনগরের কারুকাজ,
আশ্চর্য হলেও সত্যি- তার দেহে এখন আধুনিক চলচ্চিত্রের নায়িকার সাজ।
ইন্টারভিউর দিনেই জানল জুম্ববি তার দেহ ফিটনেসের আরো হবে পরীক্ষা,
চাকরি হলেই কাজের মাঝে তাকে হতে হবে ঠিক সিনেমার নায়িকা।
মর্ডার্ণ স্টাইলে কর্তারা তার দেহলাবণ্য নিয়ে করছে কিসের ইংগিত।
জুম্মবি তো বুঝতেই পারে যত অফিসে হয়েছে ইন্টারভিউ, সবখানে ঐ একই সংগীত।
কত কিছু হারিয়েছে জুম্ববি- জুম, জমি, সুন্দর বনাঞ্চল-
কোন মতে টিকিয়ে রেখেছে এই দেহমন- যা তার একমাত্র সম্বল-
যে দেহের ধমনিতে জুম্ম বিপ্লবীশোণিত প্রবাহিত হচ্ছে অবিরাম,
যে দেহ বাঁচাবার জন্য জুম্ববি রাতদিন করছে কঠোর সংগ্রাম,
সে দেহের শালীনতা, মর্যাদার বিনিময়ে চাকরি আর অর্থ কোনমতে কাম্য নয়-
এ চেতনায় উদ্ধুদ্ধ জুম্ববি, ইন্টারভিউর দিনেই ডিসিশন লয়-
সালোয়ার- কামিজের আড়ালে লুকানো জুম্ম জাতীয়তাবাদের সুতীক্ষ্ম ছুরিকা
কর্তাদের বুকে নিক্ষেপ করে জুম্মবি বারবার করিল আত্মরক্ষা!!
(তাই) চাকরি আর হলো না তার কোথাও, না এনজিওতে, না সরকারি অফিসৈ-
এখনো হাটে জুম্মবি, রাঙামাটির আকাবাকা পথে বিপ্লবী- বিদ্রোহী নায়িকার সাজে!!
(জুম্মবি): জুমভুমিতে কাজ করে যে নারী
লগ্নকুমার তঞ্চঙ্গ্যা কবিতায় স্থানিক বিষয় ও জীবনধারাকে মূল উপজীব্য করে একটি পরিসর গড়ে তোলার সাধনায় নিরত। পার্বত্য রাঙামাটি জেলায় কর্মরত লগ্নকুমার স্থানীয কাগজে লেখালেখি করেন তঞ্চঙ্গ্যা ও বাংলা উভয় ভাষাতেই। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা থেকে অনুবাদকৃত তার একটি কবিতা:
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদরের নদী কর্ণফুলি-
উচুনিচি পাহাড়িয়া পথ, ঝাড়- জংগল পেরিয়ে
ছুটে চলে সাগরের দিকে;
তারি পাশে বুলিভিদার নামের পাহাড়ের নিচে
যুগ-যুগ ধরে আমাদের প্রাণের বসতি।
সেই দিনগুলোতে এখানে চারপাশে ভরপেট খেয়েদেয়ে
শান্ত জীবনযাপন করতো জুমিয়ারা;
হাওয়ায়- হাওয়ায় ভেসে বেড়াতো ভালোবাসার
উভাগীত, ধুধুক, বাঁশি ও হেঙ্গরঙের সুর;
জুমের সুগন্ধি ফুল কানে গুঁজে যুবক- যুবতিরা
এখানে নাচতো, হাসতো আনন্দে; এখন সেদিনগুলো আর খুজে পাই না কোথাও!
জুমিয়া: জুমভুমিতে কাজ করে যারা- নারীপুরষ উভয় অর্থে; উভাগীত: গীতিকবিতার সুর- চারণ গায়কেরা যে সুরে গান করে; ধুধুক: জুমখেতের বন্যাপশু তাড়ানো রজন্যে কাঠের তৈরি বাজনাবিশেষ; হেঙ্গরঙ্গ : সুতো ও বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি এক ধরনের সুরেলা বাদ্য।
অজয় তঞ্চঙ্গ্যা’র কবিতায় এক ধরনের চাপা বিষন্নতা ভর করে থাকে।স্থান বা স্বভুমি থেকে দূরে কোথাও সরে যাবার আশংকা কাজ করে তার জাগর সত্তায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অজয় তঞ্চঙ্গ্যা’র একটি কবিতা:
এই স্থান ছেড়ে আমি যদি চলে যাই দুরে
তবু কী করে তোমাকে বুলে যাবো!
সুখদুঃখে তোমার মনের মাঝে লুকিয়ে থাকবো নিরিবিলি;
তুমি কান্না করোনা অমন-
মনে কষ্ট রেখো না মনবী!
গ্রীষ্মে যতি তেষ্টা পায় বড়
আমার নামটি মনে করো; পাবে শান্তির একটু মেঘাচ্ছন্ন জল-
বুকে সান্তনার হাওয়া এসে লাগবে
অনেকটা পথ পেরিয়ে;
দূর থেকে ভাববো: জুমিয়া ফুলের মালায় সেজেছো সুন্দর বনস্থলি!
*মনবী: প্রিয়তমা
দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বগোত্রের পশ্চাৎপদতার বেদনা তাকে কুরে- কুরে খায়। অরণ্য আর পাহাড়ি জীবনের প্রতি সনাতনী বা প্রথাগত অনুরাগ ও পিছুটান সত্ত্বেও দীপংকর চান আরো, আরো সামনের জগতের স্রোতধারায় শামিল হতে। যেমন একটি কবিতায় তিনি বলছেন:
শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরুলো-
অচেতন তবু ঘুরছি পাহাড়ে, অরণ্যভুমিতে;
কিসের নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থাকি নিজেই জানিনা-
সময়ের স্রোত কতোভাবে বয়ে গেল জানি নে হিসেব তার;
সভ্যতার দিব্যস্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে সৌন্দর্য্য
অথচ পশ্চাতে আমি: যেনো অনাসৃষ্টি;
কতো ফুল ঝরে গেল সৌরভে- সৌরভে
আমি শুধু রয়ে গেছি সুগন্ধিবিহীন;
বুনোমাটি আর পোড়াবনের মায়াবি টানে,
যাযাবরের মতো ঘুরছি
যখন সকলে ব্যস্ত সুদুর মঙ্গলে ঘর বাঁধবার স্বপ্নে।
তরণ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা স্বাপ্নিক। গদ্যপদ্য লেখালেখির পাশে তঞ্চঙ্গ্যা নবীন সাহিত্যব্রতীদের নিয়ে পহর জাঙাল (আলোকিত পথ) নামে একটি ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন। তঞ্চঙ্গ্যা ও বাংলাভাষী কবি- চিন্তকদের সমকালিন ভাবনাচিন্তা এতে মুদ্রিত হয়। কাগজটির এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কর্মধনের কবিতার খানিকটা আস্বাদ নিতে তার রচিত দুটি কবিতা পড়া যাক:
জোসনা রাত হাঁটছি একা একা
পাহাড়ের পিচঢালা পথে;
হৃদয়াকাশে নিশীত সূর্য
মাঝে- মধ্যে মোরগের ডাক
জানান দেয় একা যেয়ো না কোথাও;
আর খেকশেয়ালদের ডাক
জানিয়ে দেয় ভয় পেয়োনা-
আমরাও জেগে আছি ধরিত্রির মাঝে।
পাহাড় আমার হৃদয়, আমি যখন জীবনরৌদ্রে
দুরন্ত কাঠবেড়ালির ছানার মতো
পাহাড়ের এপার- ওপার
হাজার মাইল বেগে দৌড়ে তৃষ্ণার্ত হই
আমার তৃষ্ণা মেটায় সরার স্বচ্ছ পানি,
ছায়ার মতো সে আমাকে আগলে রাখে আর আমি তার
কোলে মাথা রেখে স্বপ্নে- স্বপ্নে চলে যাই স্বর্গরাজ্যে
যেখানে দাদা- দাদির বাস বহু আগে থেকে।
আমি এই সবার রাজ্যে
তৃষ্ণা মেটাতে চাই অনন্তকাল ধরে
বহুকাল, বহুদিন…
*সরা: পাহাড়ের বুকচিরে বয়ে- যাওয়া ছোট জলধারা
সুবাস তঞ্চঙ্গ্যার কবিতায় তার জাতিসত্তার অনুভুতি ভাষা পেয়েছে। সংহতি আর সম্মিলনের মাধ্যমে অবহেলাকে জয় করার কথা উচ্চারিত হয়েছে:
আমরা তঞ্চঙ্গ্যা, ক্ষুদ্রজাতি
বাইরে জানিয়ে দেই: আমরা নবীন প্রাণ;
এই উদ্যোগে সকলে এসো জেগে উঠি- অস্ত্র নয়
শিক্ষার মোহন মন্ত্রে; এই তো এখন শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।
নিপীড়িত যারা, অবহেলিত বঞ্চিত-
এসো ওদের সপক্ষে সকলের হৃদয়ে জাগাই ভালবাসা;
গেছে কতো ঝড়, ব্যাকুল আঘাত সময়ে- সময়ে
তার সবি আজ করতলে নিয়ে দাঁড়াই সম্মুখে;
আমরা নতুন, এ জাতির কর্ণধার;
আমরা তঞ্চঙ্গ্যা -ক্ষুদ্রজাতি!
ম্রো কবি ও কবিতা
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম ক্ষুদ্রজাতিসত্তা ম্রো বা মুরং। শুধু পার্বত্য বান্দরবানেই সুদীর্ঘকাল থেকে এদের বসবাস। ১৯৯৫ সালে ম্রো সোশাল কাউন্সিল পরিচালিত জরিপ মতে এ অঞ্চলে ম্রো জনসংখ্যা এখন ৫৯৭৪৮। খুব স্বলপসংখ্যাক ম্রো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। হাতেগোনা জনাকয়কে মাত্র সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশী। এরা হলেন: সিং ইয়ং ম্রো, মেনলং ম্রো, ইয়ংরিং ম্রো, মেনাক্রাত ম্রো, যোহনম্রো প্রমুখ। এদের মধ্যে সবচে উল্লেখযোগ্য সিং ইয়ং ম্রো। ম্রোইতিহাস- ঐতিহ্য ও সমকালিন বিষয়আশয় নিয়ে তার বেশ কিছু প্রবন্ধ, কবিতা ও স্মৃতিচারণা স্থানীয় কাগজ ও লিটন ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার দুটি কবিতা তুলে ধরা হলো:
১.
এখানে বনাবৃত ঝরনার কলধ্বনি
অপরুপে ঘুমায় বিনিদ্র তন্দ্রালোকে;
আকাশচুম্বী বৃক্ষরাজি, মৃত্তিকা, অরণ্য,
জেগে থাকে আনন্দে চন্দ্রালোকে।
দূর পাহাড়ের সীমান্ত অপার যেীবনে
ডাকে পিছু স্মৃতির মণিকোঠায়;
রঙিন প্রজাপতিরা ডানা মেলে
নিয়ে যাবে আমাকে কোন দূর অজানায়।
মন হারিয়ে যায়, প্রাণ জুড়িয়ে যায়
অরণ্যের অজানা অর্কিডের সুবাসে।
উড়ে যেতে চায় মন নীলিমায় গগনে
চৈতি বসন্তের মৃদ্রু বাতাসে।
জ্যৈষ্ঠমাসে পেখম মেলে বনময়ুর
বৃষ্টির আহবান জানায়-
বর্ষা আগমনের বার্তা।
অপরুপরুপে সাজে নিসর্গ,অঘ্রাণে
সাজে জুমপাহাড়।
মেতে ওঠে নবান্নোৎসব অরণ্য জনপদে;
জুমঘরে ধান শুকোয় ষোড়ষী-
গুণগুন গান গায উদ্দাম রৌদ্রে।
আঁধারে দীপ্তি মেলে অলস জোনাকিরা-
নেচে বেড়ায় কার্তিকের পূর্ণিমায়।
নিভৃতে জোসনার চাঁদোয়া তলে
শস্যভরা জুমপাহাড় নিরবে ঘুমায়।
২.
মাঘী পূর্ণিমার কনকনে শীতে-
কুয়াশায় অবগাহন করে চিম্বুক পাহাড়,
জেগে থাকে সারাক্ষন
নিঃশব্দে ইয়াংবং হুঙ
চিম্বুকের পাদদেশে সাতংপাড়া গ্রামে
প্রাণবাদী চিয়াসদ পই করে আয়োজন।
যুবকরা প্লুঙ বাজায় নানা ব্যঞ্জনায়-
তরুণীরা নেচে যায় চিয়ারুম ঘুরে ঘুরে;
(অরস) জোসনায় বিদায় নেয় চাঁদ,
উষার ঋজুরেখা দেখা দেয় পুবাকাশে,
গরুর অশুভ সংকেত বেজে ওঠে ক্ষনে- ক্ষনে—
বল্লমে গৃহকর্তা গরুকে খোঁচায়;
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত….
প্লুঙ- এর সুরে সুরে উত্তাল লয়ে,
নর্তকীরা নেচে যায়,
এমনি করে কেটে যায়
অভিশপ্ত রজনী-
সমাপ্ত হয় চিয়াসদ পই অমনি।
*ইয়াংবংহুঙ: চিম্বক পাহাড়, চিয়াসদ পই: ম্রোদের গোহত্যা অনুষ্ঠান প্লুঙ: ম্রো সমাজে প্রচলিত নানামাত্রিক সুরেলা বাঁশি; চিয়ারুম: গরুর জন্যে তৈরি করা বিশেষ ধরনের খাচা বা পিঞ্জর।
এভাবে পাহাড়ের কবিদের হাতে সৃজনশীলতার যে সুন্দর দুর্গ নির্মিত হচ্ছে নিরবে নিভৃতে, তা যেন আরো প্রশস্ত সড়কের খোঁজ পায়, সে উদ্যোগ এখন দরকার।
সংগ্রহঃ অরণ্যের সুভাষিত ফুল (আদিবাসী কবিতার নির্বাচিত সংকলন), লেখকঃ হাফিজ রশিদ খান ।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।