আমাদের আদিবাসী ভাষাগুলোর বর্তমান অবস্থা
1891
পুরো পৃথিবীতে আনুমানিক ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী আছে, যারা ৯০টি দেশ জুড়ে বসবাস করে,সাত হাজারের চেয়েও বেশি সংখ্যক ভাষায় কথা বলে এবং পাঁচ হাজার ধরণের বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
ভাষা, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্য, ঐতিহ্যগত জ্ঞান, মেধা সম্পদ (Intellectual Property) – এই সমাহার একটি জাতির সাংস্কৃতিক অখন্ডতাকে বৃদ্ধি করে। ভাষা হচ্ছে এই মিশ্রণটির চাকা, যেটি কিনা সাংস্কৃতিক অখন্ডতাকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়াটিতে যদি কোন ভাঙ্গন ঘটে তবে সেটি অসংখ্য ভাষা এবং সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটাবে।
যাইহোক,প্রতি দুই সপ্তাহে, একটি করে আদিবাসী ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে, যা কিনা আদিবাসীদের সংস্কৃতি এবং জ্ঞান ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
অতঃপর আদিবাসী ভাষার এই সংকটপূর্ণ ক্ষতির কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘ ২০১৯ সালকে আদিবাসী ভাষার আন্তর্জাতিক বছর (IYIL ২০১৯) হিসেবে ঘোষণা করেছে যা কিনা শুধুমাত্র আদিবাসী ভাষাভাষী মানুষদের উপকারেই আসবেনা বরং একই সাথে আদিবাসীদের ভাষা আমাদের বিশ্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেই ব্যাপারে সকলকে অবগত করবে।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫৪টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজন বসবাস করে।
যাইহোক, জাতীয় কমিটি ৫০টি আদিবাসী সম্প্রদায়কে “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০” এর গেজেটে তালিকাভুক্ত করার জন্যে সুপারিশ করে।
এই সুপারিশের ভিত্তিতে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই আইনের সংশোধন করে এবং ২৭ টির এর পরিবর্তে ৫০টি আদিবাসী সম্প্রদায়কে তালিকাভুক্ত করে।
সেই ৫০টি আদিবাসী সম্প্রদায় সমূহ হলো:
বম(Bawm), বর্মন(Barman), বাগদি(Bagdi), বনাই(Banai), বড়ইক(Baraik), বেদিয়া(Bedia), ভিল(Bhil), ভূমিজ(Bhumij), ভূইমালী(Bhuimali), চাক(Chak), চাকমা(Chakma), ডালু(Dalu), গারো(Garo), গোরাইত(Gorait), গুর্খা(Gurkha), গঞ্জু(Ganju), হোদি(Hodi), হো(Ho), হাজং(Hajong), কোচ(Koch), কোল(Kole), খাসি(Khasi), খিয়াং(Khyang), খুমি (Khumi), কুর্মি মাহাতো (Kurmi Mahato) , কোদা (Koda), কোড়া (Kora), খড়িয়া(Kharia), খারোয়ার(Kharwar), লোহার (Lohar), লুসাই(Lusai), মনিপুরী(Monipuri), মারমা(Marma), মালপাহারী / পাহাড়ী (Malpahari/Pahari), মুন্ডা (Munda), ম্রো(Mro), মালো / ঘাসিমালো (Malo/Ghasimalo), মহালি (Mahali), মুশোর (Mushor), ওঁরাও (Oraon), পাত্রো (Patro), পাংখুয়া(Pangkhua), রাজোয়ার (Rajowar), রাখাইন (Rakhaine), সাঁওতাল (Santal), সাবার(Sabar), তঞ্চংগ্যা (Tanchangya), ত্রিপুরা (Tripua) , তেলি (Teli) এবং তুরি (Turi)।
এই সম্প্রদায়গুলোর প্রত্যেকটিরই নিজস্ব আলাদা আলাদা ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জ্ঞান ইত্যাদি রয়েছে।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলা ছাড়াও আরো ৩৭টি ভাষায় (বাংলাদেশের নানান ভাষা ২০১৪) কথা বলে।
যথাযথ আদমশুমারি করা হলে কথ্য ভাষার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেক সম্প্রদায় রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব ভাষায় এখন আর কথা বলে না এবং আরো অনেক সম্প্রদায় রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বললেও সেইসব ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুখের ভাষাগুলো প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যার কারণে এসব ভাষার বর্ণমালার চর্চা এবং সংরক্ষণ করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাথে কাপেং ফাউন্ডেশন (Kapaeeng Foundation) নির্দিষ্ট ১০টি অঞ্চলকে লক্ষ্য রেখে “সামাজিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সকল মানুষের সামনে সুবিচার এবং উন্নয়নে পথ খুলে দেওয়া” এই স্লোগানে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার আওতায় সামগ্রিক ৫০টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে উপরের উল্লেখিত ২৫টি জনগোষ্ঠীকে আনা হয়েছে।
এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে সম্প্রদায়গুলোর ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা এটার সাথে সম্মত হয়েছে যে তাদের ভাষা ঝুঁকির মুখে রয়েছে, ৪ শতাংশ সম্মত হয়েছে যে তাদের ভাষা সংকটপূর্ণভাবে বিপন্ন এবং বাকি ৪ শতাংশ সম্মত হয়েছে যে তাদের ভাষা ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না।
সরকারের সাম্প্রতিক নেওয়া আদিবাসী নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়দের জন্যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান দেওয়ার উদ্যোগকে সবাই সাদরে স্বাগত জানিয়েছে, যদিও আরো বেশি সংখ্যক শিশুকে এর আওতার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সেইসাথে এর মধ্যে বাকি জনগোষ্ঠীগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
তবে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় আদিবাসী ভাষাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যাপারে সরকার এখনও পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
তদুপরি, উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় আদিবাসীদের ভাষাকে প্রমিতকরণের ব্যাপারে শিক্ষানীতি ২০১০ এ কোন মাপকাঠি উল্লেখ করা হয়নি।
শুধুমাত্র ভূমি-সংক্রান্ত এবং সামাজিক সমস্যাগুলো আদিবাসী সম্প্রদায়দের হতাশার পিছনের একমাত্র কারণ নয় বরং সেই সাথে তারা তাদের নিজদের ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্যেও উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে।
একটি সম্প্রদায়ের কাছে তাদের নিজের ভাষা হচ্ছে বাড়ির ছাদের মতোন যার নিচে তারা তাদের মানসিক আশ্রয় খুঁজে, যেখানে তাদের ভিটামাটি, এবং যেখানে তারা একটি পরিবার হিসাবে জীবনযাপন করে। সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এখনও আদিবাসী ভাষাসমূহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।
UNDRIP এর ১৩ (১) অনুচ্ছেদে আদিবাসীদের তাদের নিজেদের ভাষাকে পুনরূজ্জীবন, ব্যবহার, বিকাশ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাদের ভাষাকে প্রেরণ করার অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে সারা বিশ্ব এই দিনটিকে পালন করে আসছে।
এই ঘোষণাটি বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের) প্রতি শ্রদ্ধা নিদর্শন স্বরূপ প্রদান করা হয়েছিলো। যদিওবা, এদেশের আদিবাসী মানুষের নিজ ভাষার অধিকারকে এখনো পুরোপুরিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এই সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশের সরকারকে আদিবাসীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতি, ভাষা ও শিক্ষার অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
খোকন স্যুটেন মুর্মু কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়ক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের (জাপা) কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং বাংলাদেশ আদিবাসী গণফোরামের (BIFP) জাতীয় কমিটির সদস্য।
অনুবাদকঃ Saptorshi Dewan
মূললেখাঃ https://www.thedailystar.net/opinion/news/state-our-indigenous-languages-1783657
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।