আদিবাসী কোচ মুক্তিযোদ্ধা

Jumjournal
Last updated Oct 4th, 2020

1064

featured image

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গারো জাতির আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।

মজেন্দ্র কোচ

মজেন্দ্র কোচ শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার রংটিয়া গ্রামের সন্তান। তার পিতার নাম শ্রী অরবিন্দ্রনাথ কোচ।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মজেন্দ্র কোচ ২২/২৩ বছরের যুবক ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজেন্দ্র কোচ ১৯৭১ সালের মে মাসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কর্নেল তাহেরের ১১ নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন।

তার এফএফ নং-১৬০১০ এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বাংলাদেশের সনদ নং-৮৭৮০৪।

যুদ্ধশেষে অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে মজেন্দ্র কোচ সংসারের কাজে লিপ্ত হন। তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন কৃষিকাজ।

নিজের জমি নেই তাই তিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। তার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সামান্য দিনমজুরী করে যে টাকা পান তা দিয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন।

সুধাংশু কোচ

আদিবাসী কোচ সমাজের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুধাংশু কোচ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সুধাংশু কোচ শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার শালচড়া গ্রামের সন্তান। তার পিতার নাম বিনোদ চন্দ্র কোচ।

১৯৭১ সালে সুধাংশু কোচের বয়স ছিল ২১/২২ বছর। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি মে মাসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১১ নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। তার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তাহের । মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার এফ এফ নং-১৫৯৭৮।

মুক্তিযুদ্ধের শেষে তিনি অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে পারিবারিক কাজে নিয়োজিত হন। নিজের কোন জমিজিরাত না থাকাতে তিনি অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতেন।

বয়সের কারণে একপর্যায়ে আর কাজ করতে পারেন না। তাই পরবর্তীকালে ভিক্ষা করে সংসার চালাতে হয়।

রাধাকান্ত কোচ

আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাধাকান্ত কোচ। ১৯৭১ সালে তিনি ভাওয়াল কলেজের ছাত্র ছিলেন।

তখন তিনি গাজীপুর সদরের সমরাস্ত্র কারখানা সংলগ্ন কোচ সম্প্রদায় অধ্যুষিত হাতিয়াবহ গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে লজিং থাকতেন।

১৯ মার্চের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯ মার্চের পর সমরাস্ত্র কারখানা পাক আর্মি পুনরায় দখল করে নেয়।

অভিনব কায়দায় পাক আর্মি সমরাস্ত্র কারখানার দখল নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গাড়ির সামনে অস্ত্রের মুখে বাঙালি সৈন্যদের বসিয়ে এবং গাড়িতে বাংলাদেশেী পতাকা উড়িয়ে সৈন্য দল আসতে থাকে।

এভাবে পাক আর্মি সমরাস্ত্র কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে শত শত বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে সমরাস্ত্র কারখানা দখল করে নেয়।

২৪ মার্চ হাতিয়াবহ গ্রামের অনেক লোক বাঙালি সৈন্য নিধনের এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।

২৫ মার্চের পর পাকবাহিনী রাধাকান্ত কোচের বড় ভাইয়ের শ্বশুরকে হত্যা করে। এরপর তার বৌদি তাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার অনুরোধ করেন।

অতঃপর মা-বাবা ও বৌদির উৎসাহে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকেন।

ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও কালিয়াকৈর-শ্রীপুর এলাকার সাংসদ শামসুল হকের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিংগারদীঘির মোবারক হোসেন এলাকায় আসেন।

মোবারক হোসেন এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছেন। তার কাছে ভারতের প্রশিক্ষণের বিস্তারিত সংবাদ শোনেন।

তিনি ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রাধাকান্ত ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। বাংলা ভাদ্র মাসের শেষের দিকে মাত্র ৩৩ টাকা সম্বল করে মোবারক হোসেনের কাছ থেকে রাস্তার ম্যাপ ও মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়পত্র নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

কাপাসিয়া পৌছার পর মুক্তিযোদ্ধারা ধরে ফলে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ছাড়া পান। পায়ে হেঁটে ও নৌকাযোগে আখাউড়া রান্তে পৌঁছেন।

সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় রাজাকার দল আক্রমণ করে। অতঃপর অনেক কষ্টে তারা ভারত পৌছেন।

আগরতলা হাপানিয়া ক্যাম্পে কয়েকদিন থাকার পর গকুলনগর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যোগ দেন।

এই ক্যাম্পে ১৫-১৬ দিন প্রশিক্ষণের পর শুধুমাত্র গ্রেনেড দিয়ে দেশে পাঠানো হতো। কিন্তু রাধাকান্তের দল ওই প্রশিক্ষণে সন্তুষ্ট হতে পারলো না।

এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংসদ শামসুল হক এবং এমপিএ ছফির উদ্দিন গোকুলনগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে এলে গাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা আরো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য দাবি জানান।

তাদের সহায়তায় গাজীপুরের ওইসব মুক্তিযোদ্ধাকে লেম্বুচুড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জয়দেবপুরের আ ক ম মোজাম্মেল হক স্টোরের দায়িত্ব পালন করতেন।

লেম্বুচুড়া ক্যাম্পে রাধাকান্ত ২২ দিন রাইফেল, স্টেনগান, এলএমজি, এসএলআর, মাইন ইত্যাদি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ২-৩ দিন পর রোজার ঈদের পরদিন হ্যাজামার ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়ে গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর এলাকার ১৮০ জনের দলকে কমান্ডার আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে অপারেশনের জন্য দেশের ভেতর পাঠানো হয়।

দেশে প্রবেশ করে রাধাকান্ত সিংগারদীঘির মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীপুর ও কাপাসিয়া এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।

তার সহযোদ্ধারা ছিলেন- নুরুল ইসলাম, আলাল উদ্দিন, আফাজ উদ্দিন, ইদ্রিস মিয়াসহ আরো অনেকে। যাদের নাম মনে নেই।

রাধাকান্ত অনেক যুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। এসব যুদ্ধের মধ্যে কাপাসিয়া ঘোলাঘাট রেল ব্রিজের যুদ্ধ, শ্রীপুরের কেওয়া, মাওনা লবন্দ ব্রিজ, মাওনা কাওরাইদ বাজার, ইজ্জতপুর রেলব্রিজ এলাকার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

এসব যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ঘোলাঘাট রেল ব্রিজে পাক বাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে শ্রীপুরের প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।

পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্রিজের দুই পাশে দুদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেয়। তাদের দায়িত্ব ছিল রেলব্রিজ উঠিয়ে ফেলা, যাতে শ্রীপুর থেকে ঘোলাঘাটের দিকে পাকসেনারা যেতে না পারে।

রাধাকান্তের দল সিদ্ধান্ত মোতাবেক অপারেশন শুরু করে। রাধাকান্তসহ কয়েকজন ব্রিজের অদূরে এক বাড়ির রান্নাঘরে পজিশন নিয়ে ব্রিজের পাহারায় নিয়োজিত পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে পাকসেনাকে হত্যা করেন।

কিন্তু অপরদিকে অবস্থান নেয়া যারা তাদের দায়িত্ব পালনে একটু ভুল করে । এই সুযোগের সংবাদ পেয়ে কাওরাইদ থেকে পাকবাহিনী ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভারী অস্ত্র ছিল। পাল্টা আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ক্যাম্পে ফেরার পথে তারা সংবাদ পান এক গর্ভবতী মহিলাকে রাজাকার দল ধরে নিয়ে গেছে।

রাজাকারদের অত্যাচারে মহিলা একটি মৃত সন্তান প্রসব করে। মহিলার আত্মীয়-স্বজন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকারদের অত্যাচারের বিচার চায়।

রাধাকান্তের দল রাজাকারদের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করেন। একদিন রাতে রাজাকার দল কোন এক বাড়িতে অবস্থান করছিল।

১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা বাড়িটি ঘেরাও করে। রাধাকান্ত জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন ঘরের কোনায় এক পাশে অস্ত্র রেখে রাজাকার দল মুড়ি খাওয়ায় ব্যস্ত, ঘরের দরজা খোলা।

রাধাকান্ত নিজে স্টেনগান তাক করে দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করেন। অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা তড়িঘড়ি রাজাকারদের অস্ত্র সরিয়ে নেন।

আর বাইরে সব মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। ঘরে রাজাকারদের সঙ্গে পুলিশও ছিল। ৮ জন রাজাকার ও ৫ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করে। ৮টি রাইফেল উদ্ধার হয়।

মাওনা লবন্দ ব্রিজের যুদ্ধে কমান্ডার মোবারক হোসেনের দল ছাড়াও অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।

এই যুদ্ধে মাওনার আমীর হামজার দলও অংশ নিয়েছিল। ভালুকা থেকে শতাধিক পাকসেনা আসার সংবাদে বিকালের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা লবন্দ ব্রিজের পাশে অবস্থান নেন।

সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। রাতের আঁধারে কে কোথায় পজিশন নিয়েছে তা অজানা। চারদিক থেকে শুধু গুলি আর গুলি।

পেটে ক্ষুধা, খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তবু মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ। পড়েনি, দেহমনে তারা ছিল সতেজ।

মধ্যরাতের দিকে হঠাৎ পাকসেনারা যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করে।

মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেছিল পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করবে। ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু পাল্টা গুলির কোন শব্দ নেই।

কোথাও কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে দেখে পাকবাহিনী পলায়ন করেছে। পরে সংবাদ পাওয়া যায় রাতেই পাকবাহিনী শ্রীপুরের দিকে পালিয়ে গেছে।

এ সংবাদ পেয়ে পাকসেনাদের নিধন করতে না পেরে রাধাকান্তের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আশপাশের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধারা সারাদিন রাত অভুক্ত ও অনিদ্রায় কাতর হয়ে পড়ে। পাশে এক বাড়িতে কিছু মুক্তিযোদ্ধার খাওয়ার আয়োজন করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা দল কেবল ভাত খেতে বসেছে ঠিক ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা পর পাহারাদার সাইকেল নিয়ে হাজির। দূর থেকেই সে হাঁফাতে হাঁফাতে চিৎকার করে বলছে, কয়েকজন পাকসেনা পশ্চিম দিক থেকে ক্যাম্পের দিকে আসছে।

খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দিকে দৌড়ানো শুরু করে। রাধাকান্ত ও সহযোদ্ধা আফাজ উদ্দিন সংবাদবাহকের সাইকেলটি নিয়ে ক্যাম্পের দিকে বাতাসের বেগে ছুটতে থাকে।

কিছুদুর যাওয়ার পর সাইকেল নষ্ট হয়ে গেলে মাওনা বাজারে সাইকেল রেখে দুজন দৌড় শুরু করেন।

রাস্তায় আরো ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। দৌড়ে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান কাওরান বাজার নামক স্থানে আসেন।

রাস্তার পূর্ব পাশে এক বাড়িতে ঘরের ভেতর রাধাকান্ত-আফাজ পজিশন নেন। অন্যরা রাস্তার দক্ষিণ পাশে পজিশন নেন।

পাকসেনারা কাছাকাছি আসতেই রাধাকান্ত তাদের লক্ষ্য করে প্রথম গুলি ছোঁড়েন। পেটে গুলি লেগে এক পাকসেনা বেহুশ হয়ে পড়ে যায়। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে।

আত্মরক্ষার্থে পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর সব পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে।

ইজ্জতপুর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন শহীদ হন। রাধাকান্তের দল সমরাস্ত্র কারখানা আক্রমণের জন্য কয়েকবার পরিকল্পনা করে।

রাধাকান্ত নিজে সমরাস্ত্র কারখানা এলাকার বাসিন্দা হওয়াতে তিনি অপারেশনের জন্য কয়েকবার সমরাস্ত্র কারখানা এলাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরিপ করেন। কিন্তু পরে অপারেশনটি করা সম্ভব হয়নি।

অনাহারে, অর্ধাহারে, অদ্রিায় এভাবে যুদ্ধ করতে করতে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। বিজয় দিবসের দিন রাধাকান্ত ছিলেন সিংলাপাড়া ফরেস্ট অফিসে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। যুদ্ধ শেষে তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র জমা দেন।

মুক্তিযোদ্ধা রাধাকান্ত কোচের জন্ম ১ মার্চ ১৯৫১ সালে। পৈতৃক নিবাস গাজীপুর জেলাধীন শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংগারদীঘি গ্রামে।

বর্তমানে তিনি গাজীপুর সদরের হাতিয়াবহ গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তার পিতার নাম দলচান কোচ, মাতা-কলাবতী রানী, ১৯৬৯ সালে গাজীপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।

কলেজ ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীকালে আর লেখাপড়া করেননি। তিনি পেশা হিসেবে কাঠমিস্ত্রির কাজ বেছে নেন।

১৯৭৮ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী বাসন্তী দেবী একজন গৃহিণী। তাদের কোন সন্তানাদি নেই। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এখনো তিনি কাঠমিস্ত্রি হিসেবে জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরসেনানী রাধাকান্ত কোচ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পেরে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।

এ নিয়ে তার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই, নেই কোন অভিযোগ। তার শেষ ইচ্ছা তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ মাটিতে দেখে যেতে চান।

এ দেশে তার শেষ ইচ্ছেটা কি আদৌ পূরণ হবে?

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী

গোপাল চন্দ্র বর্মণ

কোচ আদিবাসী সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র বর্মণ। ১৯৭১ সালে তিনি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ২৫ মার্চের পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।

আশ্রয় শিবির থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে নাম তালিকাভুক্ত করেন। সেখান থেকে তারা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রথম যুদ্ধের কলাকৌশল ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন।

ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে পার্শ্ববর্তী গ্রামের ডাক্তার ওয়াজউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে ফিরে আসেন।

কয়েকদিন অবস্থানের পর কোম্পানি কমান্ডার ইলিয়াস চৌধুরীর নেতৃত্বে বাঘমারা, সিলেট সীমান্ত এলাকায় অপারেশন শুরু করেন।

পাকবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য খাদ্য ও গোলাবারুদ নিয়ে তারা ৭ দিনের জন্য গারো এলাকায় আশ্রয় নেন। কিন্তু হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পাক বাহিনী আসার মিথ্যা সংবাদ প্রচার হয়ে যায়।

তিনদিন পর সেখান থেকে ধর্মপাশা/মদন এলাকায় চলে যান। কেন্দুয়া/মদন এলাকার একটি ব্রিজে ২০ জন রাজাকার টহলরত ছিল। তাদের আটক করার জন্য ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।

হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে তারা রেকি করার জন্য লোক পাঠান। সংবাদ আসে রাজাকাররা এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ৩/৪টি রাইফেলে একই সঙ্গে গুলি ছুড়ছে।

মুক্তিযোদ্ধারা এসেপ, কাটাপা, কভারিং, ফায়ারিং এই ৪টি দলে ভাগ হয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। তাদের সম্বল মাত্র ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র।

এক পর্যায়ে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এদিকে রাত শেষ হয়ে গেলে একজন লোক সংবাদ দেন গ্রামে ২ জন রাজাকার ধরা পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তিন মাইল দৌড়িয়ে আরো দুজন রাজাকারকে ধরে ফেলেন।

এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এখানে ৮ জন রাজাকার আটক হয় এবং ১২টি রাইফেল উদ্ধার হয়।

সহযোদ্ধা মুজিবুর রহমান রাজাকারদের মেরে ফেলতে চাইলে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দেন। মুজিবুর রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজাকারদের শরীর কামড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেন।

এখান থেকে গোপাল বর্মণ ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে গফরগাঁও আসেন। গফরগাঁও এসে ৪ জন ডাকাত ধরেন। এলাকাবাসী ডাকাতদের মেরে ফেলেন। গফরগাঁও থেকে ১৬ জনের দল নিয়ে তিনি ভালুকা আসেন।

পথিমধ্যে বাইলাভাতজোড় এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অন্যান্য গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নেন।

এখানে কাচিনায় ডাক্তার শমসেরসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পর্যাপ্ত গোলাবারুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হেরে যান।

তারা ডাক্তার শমসেরের লাশ নিয়ে রাতেই পালিয়ে কাচিনা চলে আসেন। সেখান থেকে আফসার বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ভালুকা আসেন। এরপর মলি-কবাড়িতে অবস্থান নেন।

৮ ডিসেম্বর ভালুকা থানা আক্রমণ করে ভালুকা মুক্ত করেন। যুদ্ধের পর ময়মনসিংহ শহরে অস্ত্র জমা দেন।

স্বাধীনতার পর তিনি পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আর লেখাপড়া হয়নি। পৈতৃক গৃহস্থালি কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৫ বছর পূর্বে তিনি নিজ এলাকায় শিশুদের শিক্ষার জন্য একটি স্কুলের গোড়াপত্তন করেন।

তিনি নিজ বাড়িতে একটি ঘরে বিনা বেতনে শিশুদের শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। অনেক চেষ্টার পর বর্তমানে সেখানে একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

গোপাল বর্মণের বড় ছেলে এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গোপাল বর্মণের বর্তমান বয়স প্রায় ৫৯ বছর। তার পিতা মৃত রাজেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, মাতা সুন্দরী দেবী।

স্থায়ী নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার বাগাজান গ্রামে। তিনি ১৯৭৯ সালে বিয়ে করেন, স্ত্রী কামিনী রানী একজন গৃহিণী।

বর্তমানে তিনি ৩ ছেলে ২ মেয়ের পিতা। পৈতৃক সম্পত্তি কিছু আছে। গৃহস্থালি কৃষি কাজের ওপর নির্ভর করে সংসার চলছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে না দেখে তিনি দুঃখ বোধ করেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের কাজে সামান্য অবদান রাখতে পেরে তিনি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন।

প্রমোদ বর্মণ

কোচ আদিবাসী সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রমোদ চন্দ্র বর্মণ। তিনি কোচ আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭১ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ভালুকা মলিকবাড়িতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আফসার উদ্দিন আহমেদ পাক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

স্থানীয় ছাত্র যুবকরা তার সঙ্গে যোগ দেন। প্রমোদ বর্মণও আফসার সাহেবের দলে যোগ দেন। ২৫ মার্চের পর আফসার সাহেব যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

এ এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

সেনাবাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য পালিয়ে এসে আফসার বাহিনীতে যোগ দেন। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকেরা বেসামরিক ছাত্র/যুবকদের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রমোদ বর্মণ মলিকবাড়িতে স্থাপিত আফসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এপ্রিল/মে মাসে ১০/১৫ দিন যুদ্ধের কৌশল ও অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন।

এরপর তিনি কোম্পানি কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার গ্রপে ছিলেন ছামাদ, উমেদ আলী, আলী আকবরসহ স্থানীয় কাচিনা ও হালুয়াঘাটের মুক্তিযোদ্ধারা।

তিনি আফসার সাহেবের সঙ্গেই বেশি থাকতেন। গ্রুপে কমান্ডার প্রমোদ বর্মণ তার দল নিয়ে সখিপুর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, ত্রিশাল থানার বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন।

এসব এলাকায় তারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। অনেক সময় তারা এলাকা ঘুরে পাক সৈন্যদের ও রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন।

প্রমোদ বর্মণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে তাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ত্রিশাল আমলিতলায় রাজাকারদের সঙ্গে আফসারউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

যুদ্ধে মমতা নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে প্রায় ৩০ জন রাজাকার মারা যায়।

প্রায় ৪০ জন রাজাকারকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। কালিয়াকৈর এলাকায় তারা ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের শালদহপাড়া ব্রিজ ধ্বংস করেন।

এই এলাকায় প্রায় ২০ দিন অবস্থান করেন। তৎকালীন কালিয়াকৈর থানা ভবনে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।

কালিয়াকৈর থানা আক্রমণ করে তারা প্রায় ৮০ জন পাকসেনা ও রাজাকারকে হত্যা করেন এবং ৫ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে ধরে নিয়ে যান।

১৬ ডিসেম্বর তারা ত্রিশাল থানা অক্রমণ করেন। ক্যাম্পের শতাধিক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। অত্যাচারী রাজাকারদের মেরে ফেলা হয় আর অন্যদের কান কেটে দেয়া হয়।

যুদ্ধ শেষে ময়মনসিংহ শহরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে অস্ত্র জমা দেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন।

এরপর আর লেখাপড়া হয়নি। পৈতৃক গৃহস্থালির কাজ শুরু করেন। পৈতৃক জমিজমা কিছু রয়েছে।

প্রমোদ বর্মণের বর্তমান বয়স প্রায় ৬০ বছর। তার পিতার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, মাতা রাজসনী বর্মণী। স্থায়ী নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায়।

তিনি ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন। তিনি ১ পুত্র ও ১ কন্যাসন্তানের জনক। বর্তমানে তিনি একটি মিশনারী স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

যতীন চন্দ্র বর্মণ

আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যতীন চন্দ্র বর্মণ। ১৯৭১ সালে তিনি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ২৫ মার্চের পর আফসার বাহিনীর সঙ্গে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন।

কিছুদিন পর আফসার বাহিনীর সদস্য ছাত্র/যুবকদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জন্য ভারতে চলে যান। ভারত সীমান্তের মানিকচর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।

সেখান থেকে ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করেন। কয়েকদিন পর তাদের তোরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে তাদের মহেন্দ্রগঞ্জ কালাইপাড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

সেখানে ২২ দিন অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের কলাকৌশল প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ দেশে প্রবেশ করেন।

তারা বকশীগঞ্জ, কামালপুর, জামালপুর, নান্দিনা এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দেন। যুদ্ধ করতে করতে তাদের দল ময়মনসিংহ শহরে পৌছানোর পর দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বর তাদের দল ময়মনসিংহ শহরেই ছিল। বিজয়ের সুবাদে সকল মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে মেতে ওঠেন।

স্বাধীনের পর তিন বছর পুলিশ বিভাগে চাকরি করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বদলি হওয়ার কারণে পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। বাড়িতে এসে গৃহস্থালির কাজ শুরু করেন।

যতীন চন্দ্র বর্মণের বর্তমান বয়স ৫৫ বছর। তার পিতা মৃত উপেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ ও মাতা সাবিত্রী দেবী।

স্থায়ী নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার আংগাপাড়া গ্রামে। তিনি ১৯৬৫ সালে বাল্য বিয়ের শিকার হন। বর্তমানে তাদের ৩ ছেলে ৩ মেয়ে রয়েছে। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।

শুধু পৈতৃক ভিটেবাড়ি আছে। তাদের শত একর সম্পত্তি ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে জবরদখল করে রেখেছে প্রভাবশালী মহল।

তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পান। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে এ সম্মানী ভাতা দিয়ে কিছুই হয় না।

লক্ষীন্দর চন্দ্র বর্মণ

আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা লক্ষীন্দর চন্দ্র বর্মণ। ১৯৭১ সালে তিনি কৃষিকাজ করতেন। ২৫ মার্চের পর তাদের এলাকায় আফসারউদ্দিন সাহেব প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

অন্যদের সঙ্গে তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তীকালে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান।

সেখানে ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য নাম লেখান। কয়েকদিন অবস্থানের পর মহেন্দ্রগঞ্জ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ২২ দিন প্রশিক্ষণ নেন।

প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ দেশে প্রবেশ করেন। বকশীগঞ্জ, কামারপুর, জামালপুর, নান্দিনা এলাকায় যুদ্ধ করতে করতে ময়মনসিংহ শহরে আসেন।

তার সহযোদ্ধা ছিলেন যতীন চন্দ্র বর্ষণ। যুদ্ধ শেষে তারা ময়মনসিংহে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি চলে আসেন। পুনরায় তিনি কৃষিকাজ শুরু করেন।

লক্ষীন্দর বর্মণের বর্তমান বয়স প্রায় ৭০ বছর। তার পিতার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, মাতা বাণী রানী। স্থায়ী নিবাস ময়মনসিংহ জেলায় ভালুকা উপজেলার আংলারপাড়া গ্রামে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তিনি বিয়ে করেন। ১ সন্তান রেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে তার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।

পৈতৃক ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পান না। অনেক কষ্টে তার সংসার চলছে।

সুরেশ চন্দ্র বর্মণ

আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরেশ চন্দ্র বর্মণ। ১৯৭১ সালে তিনি বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করতেন।

২৫ মার্চের পর ভালুকার কৃতী সন্তান আফসারউদ্দিন আহমেদ মলি-কবাড়ি এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।

এলাকার উৎসাহী ছাত্র-যুবক আফসার সাহেবের বাহিনীতে যোগ দেন। আফসার সাহেব উৎসাহীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।

এপ্রিল মাসে সুরেশ বর্মণ আফসার বাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম তিনি সিগন্যাল গ্রুপে কাজ করতে থাকেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আফসার বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ডালুয়া কেমুখার বাড়িতে যুদ্ধের কলাকৌশল ও অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন।

মালি-কবাড়ি/ডালুয়া তখন মুক্ত এলাকা ছিল। বাংলা আশ্বিন মাসে হঠাৎ একদিন তিনি পাক সৈন্যদের কাছে ধরা পড়েন।

মুক্তিযোদ্ধারা তখন ডালুয়া হেডকোয়ার্টারে ছিলেন। দুপুরে খাবার সময় সংবাদ আসে পাক সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করছে।

সবাই খাবার ফেলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। তিনি দলছুট হয়ে অন্যদিকে চলে যান। রাস্তায় পাক সৈন্যরা তাকে সন্দেহবশত আটক করে।

ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সুযোগ বুঝে তিনি পাকসেনাদের হাত থেকে পালিয়ে আসেন। এই ঘটনার পর আফসার সাহেব তাকে অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার নির্দেশ দেন।

পোড়াবাড়ি, ভালকা, ত্রিশাল এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। দিনরাত ২৪ ঘন্টা যে কোন সময় অপারেশন করতে হতো।

তিনি হেডকোয়ার্টারে আফসারউদ্দিন সাহেবের অধীনে সরাসরি কাজ করতেন। আফসারউদ্দিনের নির্দেশে যে কোন গ্রুপের সঙ্গে অপারেশনে যেতে হতো।

তিনি ২৫-৩০টি সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে পাকসেনারা ময়মনসিংহ এলাকা থেকে পালানো শুরু করে।

পলায়নপর পাকসেনাদের পিছু ধাওয়া করে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত চলে যান। সেখান থেকে ভালুকা ফিরে আসেন। ৮ ডিসেম্বর ভালুকা মুক্ত হয়।

১৬ ডিসেম্বর তিনি ভালুকা ছিলেন। যুদ্ধের পর ময়মনসিংহ শহরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মামসিং প্রমুখের উপস্থিতিতে অস্ত্র জমা দেন।

সেদিন আফসার ব্যাটালিয়নের সাড়ে চার হাজার অস্ত্র জমা দেয়া হয়। সুরেশ চন্দ্র বর্মণের বর্তমান বয়স প্রায় ৭৫ বছর। তার পিতা যুগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, মাতা পার্বতী বর্মণী।

স্থায়ী নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার আংগারপাড়া গ্রামে। তিনি লেখাপড়া জানেন না। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পূর্বেই তিনি বিয়ে করেন। নববধূকে রেখেই যুদ্ধে যান।

স্বাধীনতার পর পুনরায় গৃহস্থালির কাজ শুরু করেন। তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে একা বসবাস করেন।

আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। নিজস্ব জমিজমা কিছুই নেই। বন বিভাগের জমিতে বাস করেন। দীর্ঘদিন থেকে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু অবস্থায় অসুস্থ জীবনযাপন করছেন।

আয়ের কোন পথ নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসিক ৫০০ টাকা হারে সম্মানী ভাতা পান। অর্থাভাবে নিজের চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

এখন তিনি খুবই অসহায়ভাবে বেঁচে আছেন। কিন্তু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই দুরবস্থা দেখার কেউ নেই।

নীলকণ্ঠ সরকার

আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নীলকণ্ঠ সরকার। ১৯৭১ সালে তিনি গৃহস্থালির কাজ করতেন।

২৫ মার্চের পর স্থানীয় আফসার বাহনীর লোকদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তোরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন।

তিনি মতে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রথম ব্যাচ। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে মবেশ করে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।

তার সহযোদ্ধা ছিলেন ওয়াহাব,সামাদ মেকার, সামসুদ্দিন, হামজা প্রমুখ। তাদের দলে ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

নীলকণ্ঠ সরকারের বর্তমান বয়স প্রায় ৬০ বছর। তার পিতার নাম মদন মোহন সরকার, মাতার নাম কামিনী বালা দেবী।

ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ডাকাতিয়া গ্রামে তিনি বসবাস করছেন। তিনি লেখাপড়া জানেন, সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন।

তিনি ৫ পুত্র সন্তানের জনক। বর্তমানে তিনি স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। তার কথা এখন বোঝা যায় না।

৫/৬ বছর পূর্বে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি পঙ্গু হয়ে গেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। শুধুমাত্র সামান্য পৈতৃক ভিটেবাড়ি ছাড়া অন্য কোন জমিজমা নেই।

ছেলেরা যে যার মত থাকে। তার নিজস্ব কোন আয়-রোজগার নেই। অর্থাভাবে ঠিকমত চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

মাসিক ৫০০ টাকা হারে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতার ওপর তার জীবন বেঁচে আছে।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা