আদিবাসী ওরাওঁ মুক্তিযোদ্ধা
908
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ওরাওঁ জাতির আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।
হোসেন ওরাওঁ
হোসেন ওঁরাও আদিবাসী ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজশাহীর গোদাগাড়ির দরিদ্র কৃষি শ্রমিক হোসেন ওরাওঁ মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
দেশে যুদ্ধ শুরু হলেও তিনি তখন বাড়িতে কৃষিকাজ করছিলেন। ১৯৬৪ সালের দারুশা রায়টের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, তখন তার পরিস্থিতিটা তাদের জন্য প্রায় একই রকম।
আশপাশের বাঙালি মুসলমানরা নানা রকম ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। পাকিস্তানিরা হিন্দুদেরও আগে আদিবাসীদের মারবে।
এছাড়া আদিবাসী ও হিন্দু গ্রামগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটছে।
দারুশা রায়ট যখন হয় তখন তিনি লাঙল চালান। বয়স ১৫/১৬ বছর। তাদের ইচরিপুর গ্রামে পাশের গ্রাম জয়পুরের মুসলমানরা এসে সব লুটপাট করে নিয়ে গেল।
ধান, পাট, গরু, ছাগল সব। তারা ভারতে চলে যায়। পরে আবার ফিরে আসে। কিন্তু অনেকেই তখন ভারতে থেকে গেল। রায়ট দারুশা থেকে শুরু হলো।
একে একে মুসলমানদের দ্বারা তাদের গ্রামগুলো আক্রান্ত হতে লাগল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে শুরু হলো। ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ভারত চলে গেল হোসেন ওরাওঁ। সামান্য কিছু ব্যবহার্য জিনিস সাথে নিয়ে পদ্মা পার হয়ে ভগবান গোলায় গিয়ে উঠে।
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় হলো। এখানকার লেখাপড়া জানা লোকেরা সাহায্যের জন্য ছুটাছুটি করল। রেশন কার্ড পেল। অনিশ্চিত জীবন।
এর মধ্যে একদিন সাগরাম মাঝি ও তার ছেলে ভোলা তাদের ক্যাম্পে এলেন। তারা বললেন, যুদ্ধে যেতে হবে। দেশ মুক্ত করতে হবে। মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হবে।
তারা বলল, চল যাই যুদ্ধ করতে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে। তাদের সাথে গেল ট্রেনিং নিতে। ওখানে ১৫ দিন পিটি ট্রেনিং ,লো।
ওখান থেকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে গেল শিলিগুড়ির পানি-নিয়া। এসএলআর, এলএমজি, স্টেনগান ইত্যাদি অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হলো।
আনুমানিক ২০ দিন ট্রেনিং চলল। ট্রেনিংয়ের পর মনে হলো, যুদ্ধ করার জন্য তীর-ধনুকের চাইতে আধুনিক অস্ত্রই ভালো।
তার নামে একটি এস.এল.আর ইস্যু হলো। ওখান থেকে তারা আসেন বাংলাদেশের পোড়াগ্রাম।
ওখানে প্রথম যুদ্ধে ২/৩ শত মুক্তিযোদ্ধা মিলে আক্রমণ করল পাক সেনাদের ক্যাম্প। আক্রমণ ব্যর্থ হলো। তারা পশ্চাদপসরণ করল।
ফিরে গিয়ে দেখল, চারজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে দেখল কমান্ডারসহ অন্য কারো আগ্রহ নাই।
তাদের সাথে হোসেনদের ঝগড়া হয়। তারা ২০ জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তুমুল ঝগড়া করে ঐদিনই তারা ভারতের লালগোলা চলে গেল।
ওখান থেকে তাদের অন্য কোম্পানিতে যুক্ত করা হলো। এরপর লালগোলা থেকে ঘরচাপা বর্ডার পার হয়ে তারা তানোর-মোহনপুর এলাকা হিট করল।
ঐ এলাকার লোকরা তাদের ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। তারা রাতে অপারেশনে যেত।
ভোর রাতে গ্রামের কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠতো। তারা তাদের ঘরের ভেতরে থাকার ও গোসল করার ব্যবস্থা করে দিত।
খাবার-দাবারের ব্যাপারেও যত্নবান ছিল। এ সময় তারা দৈনিক অপারেশনে যেত, বিশেষত রাজাকার-বিরোধী অপারেশন।
স্বাধীনতার ২ দিন আগে তারা তানোর থানা আক্রমণ করল। কয়েক কোম্পানি মিলে ৪/৫ শত মুক্তিযোদ্ধা থানা দখল করল।
দুজন পাক আর্মি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে। তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এ যুদ্ধে একজন আদিবাসী গুলিতে আহত হয়। পরবর্তীকালে সে ভারত চলে যায়।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন তানোরে ছিল হোসেন ওরাওঁ। খবর জানার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।
এসএলআর-এর সব গুলি খরচ করে আকাশের দিকে তাক করে। ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহী গেল।
তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হলো। বাড়ি ফিরে এল। ভারত থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এল। নতুন করে ঘর বাঁধল।
যুদ্ধ করেছে দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে একটা আনন্দ ছিল, জিতলে বেশি আনন্দ পেত। ভয় পেত না । মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এলাকার লোকরা বর্তমানে কিছু সম্মান দেয়।
স্থানীয় স্কুলের অনুষ্ঠানে ডাকে। চেয়ার দেয় বসতে। কোনো প্রোগ্রাম থাকলে উপজেলা থেকে চিঠি দিয়ে জানায়।
২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর উপজেলা থেকে চিঠি দিয়ে ডাকে। ভাতা পায় ৬ মাস পর পর।
নিজের জমি নাই। পাইট (কৃষি শ্রমিক) খাটে, দৈনিক ৮০ টাকা। স্ত্রী পায় ৬০ টাকা। সংসারে পাচজন লোক। সব সময় কাজ থাকে না। কোনোরকমে চলে। দৈনিক কাজ থাকলে অভাব থাকত না।
শুকাদ ওরাওঁ
শুকাদ ওরাওঁ আদিবাসী ওরাও সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি থানার গোগ্রাম। বর্তমানে একজন কৃষক।
নিজের ৩ বিঘা জমি আছে। তাছাড়া বর্গা চাষ করেন। ‘৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তখন নিজ গ্রামেই ছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীরা নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখাতে লাগল।
তাছাড়া, আদিবাসী জাতির অন্যরা ভারতে চলে যাচ্ছে। চৈত্র মাসের শেষের দিকে তারা শরণার্থী হিসেবে ভারত চলে গেল।
পুঁটলীতে চাল-ডাল হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে। তারা এ পাড়ার ৫০/৬০ জন ওরাওঁ। পদ্মা নদী পার হয়ে ভারতের ভগবান গোলায় উঠল। ওখানে প্রথমে একটা স্কুলে উঠল।
সাথে যা নিয়ে গিয়েছিল তাই খেতে লাগল। এরপর তাদের রেশন কার্ড হলো।
ক্যাম্প থেকে শুনল মুক্তিযুদ্ধে লোক নেয়া হচ্ছে। তখন শুকাদ আর বন্ধু নেপাল মিলে সিদ্ধান্ত নিল মুক্তিযুদ্ধে যাব।
ততদিনে অনেক আদিবাসী যুবক মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ তাদের জন্মভূমি, মায়ের সমান। দেশ মুক্ত করতে হবে।
মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হবে। যুদ্ধে নাম লেখাল। পাহাড়পুর ক্যাম্পে পিটি-প্যারেড চলল কয়েকদিন। পিটি-প্যারেড শেষে অস্ত্র ট্রেনিং শুরু করেছে।
এর মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। যুদ্ধে আর আসতে পারল না। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশে ফিরে এসে দুজন রাজাকার ধরেছিল, মারধর করে তাদের স্থানীয় দফাদারের হাতে তুলে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্থানীয় লোকজন সম্মান করে, মর্যাদা দেয়। তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেরা তাদের তেমন সম্মান দেয় না।
তারা হয়তো ভাবে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো লাভ হয় নি। আসলেই তারা তাদের জন্য ভালো কিছু করতে পারে নি।
মহাদেব মিনজি ওরাওঁ
মহাদেব মিনজি আদিবাসী ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা। মহাদেবের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার বাদমপুর গ্রামে। একাত্তর সালে মহাদেব কিশোর ছেলে।
পরিবারের সাথে ভারত চলে যায়। ভারতে গিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে উঠে। দেখল, যুবক-তরুণরা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে।
মনে স্বচ্ছ একটা ইচ্ছা হলো মুক্তিযুদ্ধে যাবার। প্রথমে নাম লেখাতে গেলে, তাকে ছোটো বলে নিতে চায় নি। পরে বয়স বাড়িয়ে বলল। তখন নিল।
ওখানে তাদের পিটিপ্যারেড হলো চারদিন। ওখান থেকে তাদের নিয়ে গেল মালঞ্চ। ওখানে অস্ত্র ট্রেনিং হলো ১ মাস ১৮ দিন। ওখান থেকে নেয়া হলো পাতিরাম।
সবার মধ্যে সে সবার চেয়ে ছোটে। তাই তাকে যুদ্ধে পাঠাত না। ক্যাম্পের বাজার আনা, রান্নার কাজে সহযোগিতার কাজ দেয়া হলো। সে আনন্দের সাথে তাই করত।
দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি চলে এল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এলাকায় তেমন কোনো সম্মান নাই। তবে সরকারি ভাতা পায়, এটা সরকারের দিক থেকে একটা সম্মান। সে গরিব মানুষ, ভাতাটা তার কিছু উপকারে লাগে।
পৌল চারোয়া তিগ্যা
পৌল চারোয়া তিগ্যা একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে উত্তর বাংলার আদিবাসীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত।
এছাড়াও তার আরো একটি পরিচয় রয়েছে, যা অনেকের কাছেই অজানা। এ পরিচয় হচ্ছে তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানী।
যদিও তিনি অস্ত্র নিয়ে সরাসরি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন নি। কিন্তু তিনি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে একজন সংগঠক হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য অপরিহার্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পৌল চারোয়া তিগ্যা ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি যান। সেখানে গিয়ে উঠেন রংধামালী শরণার্থী শিবিরে। উক্ত শিবিরে প্রায় ১৫/১৬ হাজার শরণার্থী ছিল।
এ সমস্ত শরণার্থীদের প্রায় সবাই পঞ্চগড়, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম এলাকার বাসিন্দা। শরণার্থী শিবিরে গিয়ে তিনি বসে থাকেন নি।
সেখানে তিনি যুক্ত হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন কাজে। তিনি শরণার্থী শিবিরে রেশন বিতরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
খাদ্যসামগ্রীসহ কাপড়চোপড়, ঔষধপত্র সরকারের কাছ থেকে নিয়ে তা শরণার্থীদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করেন।
শিশুদের মধ্যে শিশুখাদ্য ও ঔষধ বিতরণের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা সজাগ থাকতেন। কারণ ঐ সময় শিশুদের মধ্যে রোগবালাই বেশি দেখা দিতো।
তাই শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য পৌল চারোয়া তিগ্যা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ ঔষধপত্র দিয়ে।
কারিতাস ইন্ডিয়ার একজন কর্মকর্তা হিসেবে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানোর মনোভাব এবং অভিজ্ঞতা ছিল তার।
যার জন্য সেই অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে শরণার্শীদের সকল প্রকার সেবাদানে সীমাহীন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন তিনি।
শরণার্থী শিবিরে তিনি আরো একটি দায়িত্ব পালন করেছেন মৃত লাশ দাহ করার ক্ষেত্রে।
ঐ সময় কলেরাসহ বিভিন্ন মহামারী রোগে অসংখ্য লোক মৃত্যুবরণ করতো। সে সমস্ত মৃত লাশ দাহ করা ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার।
কিন্তু এই কঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একজন মানবতাবাদী সমাজকর্মী হিসেবে।
সে দুঃসময়ের অনেক স্মৃতিই এখনো তার মনে জেগে আছে। বিশেষ করে একবার হিন্দু বিধবা মহিলার মৃত লাশ দাহ করা নিয়ে বেশ জটিলতা দেখা দেয়। সে জটিলতা তিনি নিরসন করেন।
পৌল চারোয়া তিগ্যা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন এবং পাথরঘাটা মিশনের অধীন ঘাওড়া গ্রামের এক ওরাওঁ আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
এখানে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। পিতার নাম স্বর্গীয় নন্দ তিগ্যা। মাতার নাম স্বর্গীয় পালহো তিগ্যা। বিন্দুর মধ্যে যে সিন্ধুর গভীরতা নিহিত, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি।
তার পারিবারিক মান বিশ্লেষণের অবকাশ নেই। তবে এইটুকু বললে অত্যুক্তি হবে না যে, একটি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার বর্তমান অবস্থান।
আকাশ-ছোঁয়া স্বপ্নের মতোই। তবু এর মাঝে দাঁড়িয়ে একটি অনাগত সুন্দর সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন তিনি ছোটবেলা থেকেই।
ফুলের মতো তাঁর কচি মন দিনরাত ছটফট করতো কীভাবে মানুষের সুনাম অর্জন করবেন।
আর তাই একটি শক্ত ভিত্তি গড়ার লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প আর অসীম ধৈর্য নিয়ে তিনি তার জীবনযুদ্ধে যাত্রা শুরু করেন।
পৌল চারোয়া তিগ্যা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হলেন দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
তাঁর কিশোর মন তখন একাগ্র সাধনার জন্য বিচলিত হয়ে উঠল। পড়াশুনায় গভীর মনোযোগী ছিলেন।
ফলশ্রুতিতে খুব ভালো ফলাফল নিয়ে তিনি প্রতি বছর একটি করে ক্লাশের সীমানা অতিক্রম করতে থাকেন।
অতঃপর তিনি ১৯৬১ সালে উক্ত বিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগে এস.এস.সি. (ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষা পাস করেন।
ফলে তার আত্মবিশ্বাসের কোটরে নতুন শক্তি এবং উদ্দীপনা যোগ হলো। হৃদয়ে লালিত স্বপ্নগুলোর ক্ষেত্রে আরো বিস্তৃতি লাভ করে।
সফলতার সোনালি দীপ্তি মনের মণিকোঠায় উঁকি মারতে লাগল। অনেক সাহস নিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকার বিখ্যাত নটরডেম কলেজে।
সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হয়নি তার। একাগ্র সাধনা আর ঐকান্তিক নিষ্ঠার ফলস্বরূপ তিনি ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তার সফলতার ক্ষেত্রে আর একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো। একই কলেজে নতুন শিক্ষাবর্ষে পুনরায় অধ্যবসায় শুরু করেন।
১৯৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এখানেই জ্ঞান পিপাসু পৌল থেমে থাকেননি।
ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চত্বরে প্রবেশ করে তিনি পূর্বের ন্যায় সাধনায় অটল থাকলেন।
অতঃপর ১৯৬৮ সালে সমাজবিজ্ঞানে কৃতিত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সাফল্যের সোনার হরিণ তার হাতের মুঠোয় ধরা দেয়।
নিজেকে একটি ধাপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি সুনীল স্বচ্ছতা দেখতে পান। নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণের উদ্দীপনা মনের গহনে যেন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
দিগন্ত বিস্তৃত কর্মজীবন তাঁকে হাতছানি দেয়। কর্মজীবনের অনবরত আহ্বান পৌলকে বেশিদিন অবসর থাকতে দেয় নি।
১৯৬৯ সালে দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশীয় ঋণদান সমিতির অর্গানাইজার হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ ও কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না, কর্মক্ষেত্রেও তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করলেন।
অতিরিক্ত কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের ফলে ১৯৭৪ সালে তিনি কারিতাস, দিনাজপুর অঞ্চলের পরিচালক নিযুক্ত হন। তারপর দীর্ঘ সময়ের সীমানা পেরিয়ে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতার ফলে তিনি ১৯৮৩ সালে কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিযুক্ত হন।
দিন যত গড়াতে লাগল অভিজ্ঞতার নতুন মাত্রা তার জীবনে যোগ হতে লাগল। আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার জ্ঞান আর কৌশলতার ১৯৯০ সালে সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এসপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হন। এখানেও তিনি তার যোগ্যতা প্রমাণ করলেন।
এ সময়ে দীপশিখার উপদেষ্টা ফা. ক্লাউস তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হন এবং দীপশিখায় কাজ করার জন্য অনুরোধ জানান।
তিনি সম্মত হন এবং ১৯৯৪ সালে তিনি এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অদ্যাবধি তিনি এ সংস্থায় কর্মরত আছেন এবং অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে তিনি দীপশিখার সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন এই সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।
এভাবেই তিনি একটি সমাজ সেবামূলক পেশাকে বেছে নিয়ে এ দেশের সমাজ উন্নয়নের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছেন।
শুধু চাকরি নিয়েই তিনি বসে থাকেন নি। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের ফাকেও তিনি এ দেশের মেহনতি, গরিব ও অজ্ঞ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও চিন্তা করেছেন।
কীভাবে এ দেশের মানুষকে মহাজনী শাসন থেকে মুক্ত করা যায় এ বিষয়টি তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে।
অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি একটি উপায় বের করলেন এবং কারিতাসে থাকাকালীন ১৯৭৪ সালে এ দেশের গরিব মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়নের জন্যে তিনি দিনাজপুরে একটি ঋণদান সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
এ সময়ে স্বনির্ভরতা অর্জনে সারাদেশব্যাপী একটি ঢেউ উঠে। আর এই স্বনির্ভরতার আলোকে ১৯৮০ সালে কারিতাস দিনাজপুরে তিনি ‘পুওর ফান্ড’ নামে একটি তহবিল গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, যা বর্তমানে সমগ্র কারিতাসে বিদ্যমান।
মেহনতি মানুষের পাশাপাশি তিনি চিন্তা করেছেন এ দেশের কোমলমতি শিশুদের নিয়ে। অবহেলা, অনাদর আর শিক্ষার অভাবে বেড়ে ওঠা গরিব শিশুদের নিয়ে তিনি দিনরাত চিন্তা করেছেন।
কী উপায়ে শিশুদের তাদের ভিতর লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বিকশিত করে তোলা যায়। কীভাবে তাদেরকে শিক্ষার আলো দেয়া যায় ইত্যাদি প্রতিমুহূর্তে তার মনে পীড়া দিয়েছে।
এদের জন্যে কী করা যায় চিন্তা ও স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। অবশেষে তার স্বপ্নের আঙ্গিনায় বাস্তবতা এসে হামাগুড়ি দিল।
তিনি ফিডার স্কুল বা শিশুদের স্কুলমুখী করার লক্ষ্যে কারিতাস দিনাজপুরের মাধ্যমে শিশু স্কুল চালু করেন।
যা বর্তমানে সমগ্র কারিতাসসহ বহু সংস্থায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো পাচ্ছে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল গরিব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে স্কুলমুখী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
আজ তার এই সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি আজ সার্থক। শিশুদের জন্য তার এই অবদান অস্বীকার করা যায় না।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দেশের ইতিহাসে তার নাম প্রস্ফুটিত না হলেও হাজার হাজার কোমলমতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
এই সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে তিনি কেবল দীপশিখা, কিংবা কারিতাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি।
এদের পাশাপাশি তিনি আরও অনেক সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে এ দেশের সমাজ উন্নয়নের কাজে জড়িত রয়েছেন। যেমন:
* বিচিত্রা উন্নয়নের প্রতিষ্ঠাতার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন।
* তরঙ্গ এর নির্বাহী কমিটির সদস্য।
* বিজিএস-এর কোষাধ্যক্ষ ও জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।
* এসডিপি এর নির্বাহী কমিটির সদস্য।
* কুমিল্লা বিদ্যাপীঠ-এর নির্বাহী কমিটির সদস্য।
* ওরাওঁ আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী গঠন কর্মসূচির সভাপতি ইত্যাদি।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জিত দেশীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াও তার রয়েছে অনেক বৈদেশিক অভিজ্ঞতা।
বিভিন্ন দেশ সফরের অভিজ্ঞতা এবং সেখানকার বিভিন্ন মিটিং, সেমিনার, সমাবেশ, সিম্পোজিয়ামে যোগদানের অভিজ্ঞতা তার জ্ঞানভাণ্ডারে সুরক্ষিত রয়েছে।
এ সকল উন্নত দেশ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন এ দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে।
বহু উন্নত বিদেশী চিন্তাধারার সংযোগে এ দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছেন তিনি।
কারিতাসে থাকাকালীন ১৯৭৩ সালে লিডারশীপ ট্রেনিং-এর জন্য তিনি লন্ডন যান। এ অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে কাজে লাগান আমাদের দেশের সমাজ উন্নয়নের ধারায়।
১৯৮১ সালে তিনি নৃতত্ত্ব বিষয়ক ডিপ্লোমা এর জন্য নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়াশুনা করেন।
এটাও তার বিরাট সাফল্যের একধাপ। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে ট্রেনিং, কর্মশালা ও সেমিনারে যোগদানের জন্য বিভিন্ন দেশে যান।
যেমন- ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, হংকং, চীন, ফ্রান্স, জার্মানী, অষ্ট্রিয়া, নরওয়ে, ইটালি, ইংল্যান্ড, সিংগাপুর ডেনমার্ক, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা এবং আফ্রিকার ঘানাসহ আরো অনেক দেশ।
এদের মধ্যে অনেক দেশেই তিনি একের অধিকবার ভ্রমণ করেন। সুতরাং এতগুলো দেশের অর্জিত অভিজ্ঞতায় তার জ্ঞানভাণ্ডার আজ যথেষ্ট সম্পদশালী।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী এবং অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি পরিচিত সকলের প্রিয়পাত্র। অতি সহজেই তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন।
কাজে ডুবে থাকতেই তিনি সবচেয়ে পছন্দ করেন। তাঁর অবসর সময় কাটে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বই পড়ে।
মি. পৌল ১৯৭১ সালে ১৩ জানুয়ারি পিরিনা টপ-এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী একজন আদর্শ গৃহিণী। দুই সন্তানের পিতা পৌল।
তার এক ছেলে প্রদীপ ফ্রান্সিস তিগ্যা ও এক মেয়ে ইমেল্ডা স্নিগ্ধা (মনি) তিগ্যা। মেয়ে স্নিগ্ধা তিগ্যা পরিবেশ প্রকৌশল বিষয়ে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এবং ছেলে একই দেশের এডেলেইডে পড়াশুনা করেছেন।
সেদিক থেকে তিনি খুবই ভাগ্যবান। তার এই সাফল্যের সর্বাপেক্ষা প্রেরণা আর সার্বক্ষণিক সহযোগিতা তার দাদা ও মিশনারি পুরোহিতগণের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান।
তার এই সত্য সুন্দর মনোভাব প্রকাশে সৎ মনেরই পরিচয় বহন করে। তিনি তাঁদের সকলের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ।
পরিশেষে সার্বিক পর্যালোচনায় বলা যায়, তার অসামান্য অধ্যবসায় তাঁকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কী শিক্ষাক্ষেত্রে, কী কর্মক্ষেত্রে, কী সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপেই তিনি সমান সাফল্যের অধিকারী।
সমাজ তার এই সফলতায় উদ্দীপ্ত। শুধু শিক্ষা অর্জন করলেই একজন ব্যক্তি প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে না। শিক্ষার পাশাপাশি আরও অনেক গুণ থাকতে হয়, অনেক গুণ অর্জন করতে হয়।
তাহলেই একজন ব্যক্তি প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে। এ সংজ্ঞায় প্রতিটি গুণই পৌলের আছে। যার দ্বারা তিনি প্রকৃত শিক্ষার দাবিদার।
নতুন প্রজন্ম তার এই সফলতা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে বলে সুধী মহলের ধারণা।
একজন মানুষের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে সকল বৈশিষ্ট এর প্রতিটি গুণই তার মধ্যে আছে। সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রদূত।
তার প্রতিষ্ঠার দীপ্তি আমাদের জীবনকে করবে আরো উৎসাহিত এবং সংগ্রামমুখর। আমাদের সকলের কর্ম হোক দুঃস্থ মানুষের কল্যাণের জন্য দায় প্রত্যয় মুখর।
প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে তার মতো সমাজ সে আত্মবিশ্লেষণমূলক মনোবৃত্তি জাগ্রত হোক এটাই আমাদের সকলের কামনা।
বুদু লাকড়া
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক দুঃসাহসী বীর সেনানী বুদু লাকড়া। তিনি অনেকের কাছে বুদু সিং আবার অনেকের কাছে বুদু ওরাওঁ নামে পরিচিত।
আদিবাসী ওরাওঁ সমাজের এই কৃতী সন্তানের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যা আমাদের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বুদু লাকড়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর থানার বলদিপুকুর গ্রামে। এটি বগুড়া-রংপুর সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে।
বলদিপুকুর মূলত ওরাওঁ এলাকা, তারা কুড়ক ভাষায় কথা বলেন, আদিধর্ম সাওসার। মিঠাপুকুর থানার বলদিপুকুর, তাজনগর, মোমিনপুর এগুলো ওরাওঁ জনপদ।
বুদু লাকড়া বলদিপুকুর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করার সময় গনি নামের এক বাঙালি যুবকের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়।
গনি পরবর্তীকালে উকিল হয়েছিলেন। বুদুর পড়াশোনা হাইস্কুল পর্যন্ত। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়ে গনি উকিল মিঠাপুকুরে বাঙালি ওরাওঁ নির্বিশেষে প্রতিটি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে নৌকা মার্কার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
এসময় বুদু তার সাথী হন। সেই সুবাদে বুদুকে তিনি জানান যে রংপুরের কালেক্টরেট ময়দানে সভা করতে বঙ্গবন্ধু আসছেন এবং সেখানে সবাইকে যেতে হবে। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে রংপুর কালেক্টরেট ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য হাজার হাজার বাঙালির সঙ্গে আদিবাসী সমাজের লোকজনরাও একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।
বলদিপুকুর, তাজনগর, মোমিনপুর ও আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায় ১০০০ ওরাও নিয়ে বুদু সেই মিটিংয়ের উপস্থিত হন।
১৯৭০- এর নির্বাচনে বুদু লাকড়া নৌকা মার্কার পক্ষে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করেন। ফলে সবগুলো কেন্দ্রে ওরাওঁরা নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুর শহর আর তার আশপাশের গ্রামগুলোকে লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, বাউংকা, বল্লম হাতে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ।
তার কারণ পাঞ্জাবি সৈন্যরা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠা করেছে, ভেতরে বাঙালি সৈন্যরা বন্দি, তাদের বউ-বাচ্চারা নিরাপত্তাহীন।
রংপুর শহরের আশেপাশে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন অতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসেন।
সবচেয়ে মারমুখী ভূমিকা ছিল মিঠাপুকুর বদলীপকুর এলাকার আদিবাসী ওরাওঁদের।
বুদুর নেতৃত্বে হাজার হাজার ওরাওঁ নারীপুরুষ তাদের তীর, ধনুক, বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হন।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর সেখানে অবস্থানরত ব্রাউনিং মেশিনগান সজ্জিত গোটা দশেক সামরিক যান থেকে পাঁচ মিনিট ধরে চালানো হয়।
অবিরাম গুলিবর্ষণ। আদিকালের অস্ত্রপাতিসহ মানুষগুলো যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরারে মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। বাকিরা দিকবিদিক পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন।
পরবর্তীকালে বুদু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে সেখানেও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আপত্তি করে।
বুদু আদিবাসী হাতে অস্ত্র পেলে মিশে যেতে পারে ভারতের ওরাওঁদের সাথে। কিন্তু বুদুর প্রবল দেশপ্রেম এবং প্রচেষ্টার ফলে তাকে জলপাইগুড়ি জেলার মেটলি থানার মুরতি পাহাড়ের ওপরে প্রশিক্ষণ শিবির মুজিব ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
সেখানে বুদু পাঁচ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওরাওঁ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন।
তার মধ্যে ছিল পাকুড়পাড়া ব্রিজ ধ্বংস করা। এই ব্রিজ দিয়ে পাকবাহিনী সহজে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতো।
এই কারণে এই ব্রিজ ধ্বংস করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। এই অপারেশনে ৬ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
তারা হলেন আজিজার, মাহবুব, বাচ্ছ, জব্বার, সাজ্জাদ ও বুদু। এদের নেতৃত্বে ছিলেন জব্বার।
পরবর্তীকালে দশজন মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশেষ দল গঠন করা হয় বুদু ওরাওঁকে কমান্ডার করে। সীমান্ত এলাকায় নানা গেরিলা আভযানে এই দলটি অংশগ্রহণ করে।
প্রতি দুদিন পরপর সীমান্ত পার হয়ে এসে তাদের রিপোর্ট করতে হতো মেজর দরজির কাছে। শালবন অপারেশনে তারা বেশ কয়েকজন পাকবাহিনীকে হত্যা করে তাদের চাইনিজ রাইফেল দখল করেছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর বুদু ওরাওঁ এলাকার মেম্বার পদে নির্বাচিত হন। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন।
বুদুর ভাবনা ছিল দেশ স্বাধীন হলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ভেদাভেদ থাকবে না। ছোটজাত বড়োজাত বিভেদ থাকবে না।
ওরাওঁ বলে কেউ তাকে ঘৃণা করবে, তার ছোটা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করবে না। আদিবাসী মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, চিহ্নিত রাজাকার আলফাজ ফকির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
কিন্তু যুদ্ধের পর দেখা গেল প্রশাসনের সহযোগিতায় আলফাজ ফকির আবার তৎপর হয়ে উঠলো, আদিবাসীদের জমি গ্রাস হতে থাকলো।
স্বাধীনতার পর বুদু মেম্বার হলেন । কিন্তু তাকে দিয়ে করানো হতো চৌকিদারের কাজ, ফাইফরমায়েশের কাজ।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই দেশে থাকলে ‘ছোটলোক’ অপবাদ থেকে কোনোদিনও বেরুতে পারবেন না। শুধু অসম্মানই নয়। তার জমিজিরাত সহায়সম্পত্তি দখলের জন্য তাকে দেশছাড়া করার চক্রান্ত করে এলাকার দুষ্ট চক্র।
যার জন্য তিনি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই দেশের সন্তান হয়েও তিনি বহিরাগত। এই কষ্ট বুকে নিয়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
মনাই চন্দ্র খালকো
ওরাওঁ মুক্তিযোদ্ধা মনাই খালকো দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানায় ভারতের সীমান্তবর্তী ৭ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের চৌঘরিয়া গ্রামে বসবাস করেন।
পিতা সিতারাম খালকো। বিশ বছর বয়সে যুদ্ধে যাওয়া এই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ৩৭ বছর আগের জীবনের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। শেখ সাহেব সবাইকে যার যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছেন এবং ভারত সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করছে এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারত যান।
ভারতে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকাকালে সন্ধান পান ট্রেনিং ক্যাম্পের। দেরি না করে কয়েক দিনের মধ্যে সেখানকার ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন।
সেখান থেকে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য আরেকটি ক্যাম্পে গিয়ে ২৯ দিন বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ সেন্টার থেকে তাদের বর্ডারে পাঠিয়ে দেয়।
দিনাজপুরের বলাহার অপারেশন ক্যাম্পে যোগ দিয়ে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করে এবং দেশ স্বাধীন করে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাকিমপুর থানায় অস্ত্র জমা দেন। তারপর গ্রামে এসে কৃষিকাজ শুরু করেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর ১৯৯৬ পর্যন্ত তাদের জন্য কোনো সরকারই তেমন কিছু করে নি।
এরপর মাসিক কিছু ভাতা দেওয়া হয়। কখনো কখনো শীত বেশি হলে কম্বল কিংবা শীতবস্ত্র দেয়।
কিন্তু বর্তমানে দুর্মূল্যের বাজারে এ-ভাতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগে কৃষিকাজ করে সংসার চালানো যেত, কিন্তু সার-বীজ-ডিজেলের দাম বেশি এবং বিভিন্ন সংকট থাকায় আবাদ করতে পারছে না। দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন অনেকটাই ভুলতে বসেছে।
তাদের মতো গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা, বিশেষ করে যারা কষক, তাদের জন্য কিছু করা না হলে আগামীতে তাদের না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
প্রায় ৬০ বছর বয়সী সাহসী মনাই খালকো। পরের বাড়িতে কৃষিকাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন এই মুক্তিসেনানী।
পান নি কোনো সামাজিক মর্যাদা বা গুরুত্ব। আদিবাসী হওয়ায় প্রশাসনিক বিভিন্ন উৎসবে ডাক পান না বলেও জানান তিনি।
তবু তার প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আগামীতে বাস্তবায়ন হবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে।
জসপিন টপ্প
জসপিন টপ্পর পিতার নাম জহন টপ্প এবং মাতার নাম মার্গারেট এক্কা। বাবার পেশা ছিল কৃষিকাজ, মা গৃহিণী। পিতা-মাতার লেখাপড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে তারা তিন ভাই-বোনই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।
তার ভাইয়ের নাম নিকোলাস ট্রান ক্যাথরিন ট। ছেলেবেলা কেটেছে হিলিতে, হদিস গ্রামে। এলাকার পরিবেশ খুব সুন্দর ছিল, আশপাশের মানুষের সাথে ছিল সুসম্পর্ক।
সেখানে একই স্কুলে তারা তিন ভাইবোন পড়াশোনা করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার বয়স ছিল ১৫, তখন তিনি দিনাজপুরের কসবা মিশনে দশম শ্রেণীর ছাত্রী।
সবাই যুদ্ধে যাচ্ছে, কিশোরী মনে তারও স্বপ্ন জাগে দেশমাতৃকার জন্য ভূমিকা রাখার।
সীমান্তবর্তী কসবা মিশনের হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা হতো। তাদের সেবার জন্য যে সংখ্যক ডাক্তার-নার্সের প্রয়োজন ছিল তা পর্যাপ্ত ছিল না।
তখন সেখানে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জসপিন টপ্প। কিন্তু নিরাপত্তার প্রয়োজনে চার্চের ফাদার তাকে সাময়িকভাবে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
একদিন অতর্কিতভাবে হানাদার বাহিনী তাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তার বা-মা ধানের গোলার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন।
হানাদাররা তার বড় বোন ও বামাকে আলাদা কক্ষে আটকে রাখে এবং জসপিনকে আক্রমণ করে।
এসময় জসপিন তার বড় বোনের ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ”তোমরা আমার বাবার বয়সী, আমার জান নিয়ে নাও। আমার ক্ষতি করো না। অনেক আকুতির পর তিনি রক্ষা পান।
এরপর তিনি ফিরে যান মিশনে এবং মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস বিভিন্ন জায়গায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের সেবা দিয়ে তিনি সুস্থ করে তুলেছেন।
অস্ত্র হাতে লড়াই করতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার মাধ্যমে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন বলে তিনি গর্বিত। তবে দেশের অবস্থা এবং আদিবাসীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি খুশি নন।
জসপিন আক্ষেপ করে বলেন, দেশের জন্য আদিবাসীরা লড়াই করলো, অথচ আজ পর্যন্ত সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো না।
এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? জানি না মরার আগে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেখে যেতে পারবো কি-না?”
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দিনরাত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য ওষুধ দিয়ে সেবা দিতাম, বসে বসে দিন গুনতাম কবে দেশ স্বাধীন হবে।
হাত দিয়ে কতজন আহত যোদ্ধা আর খানদের হাতে নির্যাতিত নারীকে সারিয়ে তুলেছে সে-কথা মনে হলে দু’চোখ ভরে পানি আসে।
অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় এসেছে।
বেশিরভাগ মাথা ফেটে গেছে, হাতে-পায়ে কপালে আঘাত পেয়েছে। সেসব আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ব্যান্ডেজ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সেবার কথা কোনোদিন মূল্যায়িত হয় নি।
যুদ্ধের পর তার বিয়ে হয় ওরাওঁ যুবক বিনয় তিরকীর সাথে। কঠোর পরিশ্রম করে তিনি তার সংসার থেকে অভাব দূর করেছেন।
নিজ সমাজের নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন, যেটা আদিবাসী নারীদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত। এখনো তিনি তার এলাকায় ধাত্রী হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করে চলেছেন।
পিউস মিনজি
আদিবাসী সমাজের এক দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা পিউস মিনজি। তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের পাঁচ পুকুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রুহিয়ান মিনজি।
মুক্তিযোদ্ধা পিউস মিনজি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এ লেখাপড়ার পর তিনি কৃষিকাজে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২১ বছর।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পিউস মিনজিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। কীভাবে বাহিনীতে যোগদান করা যায় তার জন্য তিনি আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন।
এভাবে চেষ্টা করার পর তার যোগাযোগ হয় রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আলফ্রেণ্ড মিউজির সাথে।
তিনি পিউস মিনজিকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে নিয়ে যেতে রাজি হন। পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করে পিউস ভারত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে তার মা তাকে বলেছিলেন বাবা তুমি যাও, দেশের সবার অসুবিধা, দেশের কাজ একটু করো বাবা।
পিতা-মাতার অনুমতি পেয়ে পিউস মিনজি ভারত চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম উঠেন গংগারামপুরির রাজীপর মিশনে। সেখানে রাতে অবস্থান করে পরদিন সকাল আটটায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে যোগদান করেন।
সেখানে প্রশিক্ষণ শুরু হলো। প্রায় দুই মাস প্রশিক্ষণ হলো। ওখানে প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে যাওয়ায় পিউস মিনজিদের দলটির যাওয়ার কথা পানিঘাটায় কিন্তু সেখানে যাওয়া হয়নি।
কারণ তখন খানপুরে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধের সময় সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল পাকিস্তানিদের তুলনায় খুবই কম। তাই খানপুর থেকে সংবাদ পাঠালো আরো মুক্তিযোদ্ধা পাঠানোর জন্য।
সংবাদ পেয়ে তখন তাড়াতাড়ি একটি দল খানপুরে পাঠানো হয়। উক্ত দলে পিউস মিনজিও ছিলেন। খানপুরে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
সে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করে। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
খানপুর যুদ্ধের পর পিউস মিনজি অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘুঘুডাংগা যান। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে আবার এক যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সেখানে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই যুদ্ধ চলাকালেই দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হলে পিউস মিনজি দিনাজপুর চলে আসেন এবং সেখানে অস্ত্রশস্ত্র জমা দেন।
বিমল সিং ওরাওঁ
আদিবাসী ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার বীরনগর গ্রামে বাড়ি। ১৯৭১ সালে টগবগে তরুণ বিমল সিং ভও বর্তমানে দরিদ কষি শ্রমিক।
মক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। চারদিকে যোগাযোগ শুরু হলো পাকিস্তান সেনারা আদিবাসী এবং হিন্দুদের মারছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
দেশের মায়া ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাতে আমাদের পরিবারের সকলকে নি ভারত চলে গেলাম।
ওখানে গঙ্গারামপুর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলাম। শুনলাম, মুক্তিযুদ্ধে লোক নিচ্ছে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। শিলিগুড়িতে ট্রেনিং হলো। ট্রেনিং শেষে বিরল এলাকায় আমাকে পাঠানো হলো।
ঐ এলাকায় কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৬ ডিসেম্বর বিরল ছিলাম। পরে দিনাজপুরে অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি চলে এলাম।
ভারত থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এলাম। স্বাধীনতার পরে আর কোনো খোঁজ-খবর রাখি নি। নিজের কাজ শুরু করি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাজে কোনো সম্মান নেই। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম দেশ স্বাধীন করার জন্য।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।