শিক্ষা আইন, আদিবাসীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও ঝুলন্ত একটি রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞ
1512
শিক্ষা আইন, আদিবাসীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও ঝুলন্ত একটি রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞ
ড. কুদরত এ খুদা থেকে শুরু করে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর হাত ধরে আমাদের সর্বশেষ প্রাপ্তি হলো ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ও ২০১৩ সালে প্রণীত খসড়া শিক্ষা আইন।
বাংলাদেশের শিক্ষা সংক্রান্ত সর্বশেষ অগ্রগতি হলো এই খসড়া শিক্ষা আইন যা সংসদে চুড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রস্তাবনা ও প্রারম্ভিক বাদ দিয়ে এই আইনে মোট পাঁচটি অধ্যায়ের অধীনে ৬৫টি ধারা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
প্রারম্ভিকের তিনটি ধারায় সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন, সংজ্ঞা ও আইনের প্রাধান্য বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে মূলত প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় বিধানাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে যেসব বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, নিরাপদ ও শিশুবান্ধব শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং এবতেদায়ি শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি, শিশুর ভর্তি নিশ্চিতকরণে বিদ্যালয়ের কর্তব্য, প্রাক-বৃত্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও এবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক নির্বাচন, প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পরিষদ, অভিভাবক-শিক্ষক পরিষদ গঠন এবংপ্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রশাসন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শিক্ষার বিধানাবলি সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের ধারাগুলোর মধ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, শিক্ষার সুযোগ হতে বঞ্চিত সকল নারী-পুরুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন।
তৃতীয় অধ্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয় বিধানাবলি সন্নিবেশ করা হয়েছে, যার মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর, মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার ধারাসমূহ (সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা), মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ও স্বীকৃতি, মাধ্যমিক/দাখিল স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের কর্তব্য, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক নির্বাচন, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রক্ষিণ, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবক-শিক্ষক পরিষদ গঠন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
চতুর্থ অধ্যায়ে উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত বিধানাবলি যেমন- উচ্চ শিক্ষার স্তর, মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি ও কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের যোগ্যতা, প্রকৌশল শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, চিকিৎসা শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, নিবন্ধন, স্বীকৃতি গ্রহণ ও পরিচালনা, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষক নিয়োগ, উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।
‘বিবিধ বিষয়াবলী’ শিরোনামে পঞ্চম অধ্যায়ে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা, ক্রীড়া ও শারিরীক শিক্ষা, স্কাউট ও গার্ল-গাইড, বাংলা ভাষায় পাঠদান, শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা, নেতৃত্ব সৃষ্টি, জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণ, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা, অভিভাবক ও পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্য, শিক্ষকদের কর্তব্য এবং অধিকার ও মর্যাদা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন/ জাতীয়করণ, এমপিও প্রদান ও পরিচলনা, বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ স্থগিত, কর্তন ও বাতিলকরণ, শিক্ষায় অর্থায়ন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্তব্য, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন, স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব-কর্তব্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা, আইনের কার্যকারিতা, রহিতকরণ ও হেফাজতকরণ এবং বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত। আইনের শেষ পাতা তফসিল ১-এর আওতায় ‘অপরাধ ও শাস্তি’ শিরোনামে আইন অমান্যের ক্ষেত্রে আরোপিত দন্ডসমূহ এবং অপরাধের বিচার ও আমলযোগ্যতা বিষয়ে আইনের বিধানাবলি উল্লেখ করা হয়েছে।
এই আইনে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে চার স্তরবিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছেÑ প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা।
প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ থেকে ৬ বছর।৬ বছর বয়স থেকে শুরু হবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা।
প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি হবে মাধ্যমিক শিক্ষা। এরপর উচ্চশিক্ষার স্তর।
গাইড, নোটবই এবং প্রাইভেট-টিউশনি ও কোচিং ব্যবসা বন্ধ করাসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে।
আইনের বিভিন্ন ধারা লংঘনের ক্ষেত্রে ধার্য করা হয়েছে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ পর্যন্ত জরিমানা এবং ৬ মাস থেকে ১ বছর জেল অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান।
এই আইনের বিভিন্ন ধারায় আদিবাসী (সরকারি পরিভাষায় যাদেরেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে) শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন বিধানের কথা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে।
প্রাথমিক স্তরে স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা, এই শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক তৈরি, পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর অবদানের স্বীকৃতি, নমনীয় শিক্ষা পঞ্জিকা, পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর অনুমোদন নিয়ে স্থানীয়ভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি বিষয় এই খসড়া আইনে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
খসড়া আইনটি প্রণীত হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দিয়ে জনমত চাওয়া হয়েছিল।
সেই প্রেক্ষিতে তিন পার্বত্য জেলার শিক্ষা সম্পর্কিত কাজে সম্পৃক্ত উন্নয়ন সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তিন পার্বত্য জেলায় পরামর্শ সভায় মিলিত হয়ে কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন।
পাশাপাশি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদও তাদের মতামত পাঠিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮-এর বিধান (ধারা ৫৩) অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এখানকার অধিবাসীদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের একমাত্র মন্ত্রণালয় যা বিশেষ এলাকার নামে এবং ঐ এলাকার সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত।
তাই কেন্দ্রীয় যে কোন মন্ত্রণালয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়কেপাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু এই আইন প্রণয়নের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে কি না তা-ও আমাদের জানা নেই।
আমাদের প্রেরিত কিছু কিছু সুপারিশ চুড়ান্ত খসড়ায় সন্নিবেশ করা হয়েছে দেখে আমরা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও এই আইন খসড়া করার কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
সংসদে উঠার আগে এসব বিধানের উপর কাঁচি না পড়লেই কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কর্মযজ্ঞ অন্তিমে গিয়ে সফলতা লাভ করবে বলে আশা করা যায়।
শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিক্ষা অধিকারকর্মী ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর ফোরাম গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ট রাশেদা কে চৌধুরী এই আইনের খসড়া প্রণীত হওয়ার পরপর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি অনলাইন পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘এই শিক্ষা আইনে দেশের মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। আইনটি পর্যালোচনার দাবি রাখে।’
পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেসব সুপারিশ দিয়েছিলেন তার মধ্য হতে কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় চুড়ান্ত খসড়ায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিষয়টি হয়তো কর্তৃপক্ষ আবারও বিবেচনা করে দেখতে পারেন। এসব গুরুত্বপূর্ন বিষয় সন্নিবেশ করা না হলে সত্যিকার অর্থে জনগণের শিক্ষার অধিকারের ন্যূনতমও এই আইন দ্বারা সংরক্ষন ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
যেসব বিষয়এই চুড়ান্ত খসড়ায় আমলে আনা হয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে বাদ পড়ে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি-
আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভাষা উন্নয়ন ও তদ্সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্দ্দিষ্ট কোন কেন্দ্রীয় বিশেষায়িত সংস্থা নেই।
তাই কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সংস্থা বা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। এই ইনস্টিটিউট আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি বিশেষায়িত শাখা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণে অবদান রাখা, গবেষণা সহায়তা, প্রকাশনা, ‘ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ইন এথনিক ল্যাংগুয়েজেজ’ কোর্স পরিচালনা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
পাঠ্যপুস্তকে কোন জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ভুলভাবে বা বিকৃতভাবে তুলে ধরা হলে ঐ জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকারক প্রভাব সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের উপর পড়বে এবং যা সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিরও পরিপন্থী এবং মৌলিক অধিকারসমূহের সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
তাই, উপরোক্ত ভ্রান্তিসমূহ পরিহারের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জাতিসমূহেরসমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্যবিষয় সম্পৃক্তকরণের সুবিধার্থে আদিবাসী জাতিসমূহের মধ্য হতে লেখক, গবেষক ও পাঠদানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
সরকারি অনুমোদন ও আর্থি সহায়তাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষা নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে প্রাথমিক খসড়া (২০১৩)-এর ১৩(৩) উপধারায় একটি বিধান ছিল।
পার্বত্য জেলাগুলোর বেলায় প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যাবলি যেহেতু পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নিকট হস্তান্তরিত বিভাগ সেহেতু এই শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের কাজ এই তিন জেলার বেলায় জেলা পরিষদগুলোই ভূমিকা পালন করতে পারে মর্মে একটি সুপারিশ আমরা করেছিলাম।
কিন্তু চুড়ান্ত খসড়ায় এটিও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের খসড়ায় এই উপধারাটি ১৩(২) আকারে পূর্বের চেহারাতেই রয়েছে।
১৯৮৯ সালে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো গঠিত হওয়ার পর থেকেই তিন পার্বত্য জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এই পরিষদগুলোই করে আসছে। তাই আইনের দ্বৈততা পরিহারের সুবিধার্থে এই উপধারাটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
পৃথিবীর নানা দেশে সুযোগ বঞ্চিত জনগোষ্ঠির জন্য শিক্ষা ও চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশেও নারী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসীদের জন্য (উপজাতি কোটা নামে) এই কোটা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে।
খসড়া আইনের কয়েকটি ধারায় (ধারা ২২ গ/৬) বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও আদিবাসী শিশুদের জন্য বিশেষ করে বৃত্তিমূলক, কারিগরী ও উচ্চ শিক্ষায় কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে (ধারা ৩৬/৪) আধুনিক এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের পদপেক্ষ নেওয়ার জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
আদিবাসীদের প্রচলিত চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির উপরও গবেষণাকর্ম পরিচালনাসহ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নেওয়া সুযোগ থাকলেও এই বিষয়ে দেওয়া আমাদের মতামত আমলে নেওয়া হয়নি।
অথচ আদিবাসী সমাজে প্রকৃতি হতে আহরিত সম্পদ ও চিরায়ত জ্ঞান ব্যবস্থাভিত্তিক বহু চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য সহায়ক হতে পারতো।
কৃষি শিক্ষা ও আইন শিক্ষার ক্ষেত্রেও আদিবাসী জ্ঞানব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, যা এই আইনে আমলে নেওয়া হয়নি।
খসড়া আইনের (২০১৩) দু’টো জায়গায় আমরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ অন্যান্য সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকারক বা পরিপন্থী বা কোন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞামূলক একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে (ধারা ২২/৪) তা আমলে নেওয়া হলেও কোন এক অজানা কারণে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে (ধারা ৪২/২) তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আইনের এই ফোঁকর দিয়ে দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের সমাজ, সংস্কৃতি, অস্তিত্ব ও বিশ্বাসের জন্য ক্ষতিকারক নানা কর্মকান্ড উচ্চ শিক্ষা স্তরের পাঠ্য বিষয়গুলোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশংকা থেকে গেলো।
যেমনটি আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে দেখে আসছিলাম, যা ২০১৩ সাল হতে কিছুটা সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ একটি বহু সংস্কৃতি, বহু জাতিগোষ্ঠি ও বহু ভাষাসমৃদ্ধ বৈচিত্রময় দেশ। এদেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী বাঙ্গালী ছাড়াও প্রায় অর্ধশতাধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লোকজন স্মরণাতীতকাল ধরে আপন কৃষ্টি, ভাষা, অস্তিত্ব ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে বসবাস করে আসছে।
এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাঙ্গালী সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কার্যক্রমের উপর বিধিনিষেধের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলে এসব জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবিধানের পরিপন্থী (২৩ ক)।
তাই, এই ধারায় বাঙ্গালী সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্যান্য জাতিস্বত্বার সংস্কৃতির বিষয়টি উল্লেখ করা হলে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সমান মর্যাদায় টিকে থাকার সুযোগ পাবে।
পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিকৃতভাবে উপস্থাপন হওয়া থেকে রেহায় পাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো আইনে এসব বিধি-বিধান অন্তর্ভুক্তিই কি শেষ কথা? আইনে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হলেই কি আদিবাসীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত হয়ে যাবে? না।
চাই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে বহু ইতিবাচক আইন ও কৌশল থাকলেও সেসব আইন ও নীতি-কৌশল বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে নানা মত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অস্বাভাকি ধীরগতি এবং জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে গৃহিত আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের ক্ষেত্রে অযথা দীর্ঘসূত্রিতা রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞগুলোর ব্যাপারেআদিবাসীদের সন্দেহ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে উপস্থাপনযোগ্য উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত যথার্থ।
এ দু’টো উদ্যোগের মধ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত সরকারি কার্যক্রমে আমাদের নানাভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে, এমএলই ফোরাম হিসেবে, এনজিওকর্মী হিসেবে নানাভাবে এই কার্যক্রমের সাথে আমরা সম্পৃক্ত। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে একটি জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়, পরে একটি টেকনিক্যাল কমিটি ও একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ক কমিটিও গঠন করা হয়।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের আদিবাসীশিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক চলে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ২০১৩ সালের শেষার্ধ রাজনৈতিক টালমাতাল অবস্থায় কেটে যাওয়ায় একটি অজুহাত তৈরি হয়ে যায় এই কার্যক্রমের সূচনাকাল দীর্ঘায়িতকরনে।
২০১৪ সালে এই কার্যক্রমের সূচনাকারী আওয়ামীলীগ আবারও ক্ষমতায় আসে এবং স্বাভাবিকভাবে আদিবাসী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো আশায় বুক বাঁধতে থাকে এবার বুঝি খুব দ্রুতগতিতে চলবে এই কার্যক্রম।
কমিটির সভা হয় কয়েকটি, গঠিত হয় পাঁচটি আদিবাসী ভাষার লেখক-গবেষকদের নিয়ে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদ্রি ও মান্দি ভাষার ‘লেখক কমিটি’, যেখানে প্রতিটি ভাষার ন্যূনপক্ষে পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এই প্রক্রিয়া নানাভাবে সম্পৃক্ত করা হয়। কিন্তু গত ২৩ আগস্ট ২০১৪ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সৌরভ সিকদারের একটি লেখা আমাদের আশা-আকাঙ্খা আর উৎসাহকে যেন ছাইচাপা দিয়ে দেয়।
ঝুলে গেছে সরকারি এই কর্মযজ্ঞ ! অগ্রসর হচ্ছে না নানা কারণে। তাহলে উপায়? হ্যাঁ, উপায়তো খুঁজতেই হবে আমাদের। কেবল আইন প্রনয়ন ও গ্রহণ নয়, সেসব আইন, নীতি ও কৌশলের পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের দিকেও নিবিড়ভাবে নজর দিতে সরকারকে।
কো উদ্যোগ যেন এক-দুইজন কর্মকর্তার জন্য ঝুলে না যায় বা ভেস্তে না যায়। এতে বরং আমাদের এতোদিনের অর্জন ধূলোয় মিশে যাবে যদি দেশের এই আকারে ক্ষুদ্র হলেও গুরুত্বপূর্ন অংশের নাগরিকদের অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারে।
সহস্রাব্দ লক্ষ্যের দৌড়ে বাংলাদেশ এই উপমহাদেশের বহু দেশের চেয়ে এখনও এগিয়ে রয়েছে। এই দৌড়ে আমরা যদি এগিয়েই থাকতে চাই তাহলে সচেতনভাবেই আমাদের কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে যেতে হবে অব্যাহতভাবে।
না হলে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো কচ্ছপের মতো গন্তব্যে পৌঁছে যাবে তাদের গন্তব্যে। আর এতটুকু অসতর্কতার জন্য খরগোসের মতো পিছিয়ে পড়বো আমরা।
লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
তথ্যসূত্রঃ
১. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০
২. শিক্ষা আইন (খসড়া) ২০১৩
৩. শিক্ষা আইন (চুড়ান্ত খসড়া) ২০১৪
৪. নতুনবার্তা.কম ; ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
৫. দৈনিক যুগান্তর; ১৫ আগস্ট ২০১৩
৬. দৈনিক প্রথম আলো; ২৩ আগস্ট ২০১৪
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।