আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক কিছু ভাবনা

Jumjournal
Last updated Aug 31st, 2021

2209

featured image

১. পটভূমি

সংস্কৃতি বলতে অনেকে শুধু নাচ-গান-শিল্পকলার মত বিষয়াদিকেই বোঝেন। কিন্তু নৃবিজ্ঞানে শব্দটি ব্যাপকতর অর্থ বহন করে। অবশ্য একটা সময় ছিল – যেমন উনবিংশ শতাব্দীতে – যখন খোদ নৃবিজ্ঞানীরাই [যেমন টাইলর, মর্গান প্রমুখ]

[২] সংস্কৃতিকে নিচু থেকে উঁচু, বা আদিম থেকে সভ্য, এমন বিভিন্ন ধাপে সাজিয়ে বিচার করতেন।

তবে বিগত একশত বছরে এই দৃষ্টিভঙ্গী অনেকটাই পরিত্যক্ত হয়েছে নৃবিজ্ঞানে, যে জ্ঞানকান্ডে বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক মানদন্ডে ‘আদিম’ হিসেবে অভিহিত করার রেওয়াজ নেই।

[৩] অবশ্য আমাদের চারপাশে সংকীর্ণতর অর্থে সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ এখনো অহরহই দেখা যায় ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ জাতীয় কথায়, অথবা যখন আমরা ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে বলি, ‘অমুক একটি সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন’।

[৪] নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শুধু মঞ্চে পরিবেশিত নাচ-গান-নাটকই নয়, বরং সাধারণ মানুষদের বিভিন্ন প্রাত্যহিক কর্মকান্ডও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বটে, এবং সমাজে বসবাসকারী এমন কোনো ব্যক্তি হতে পারে না, যার সম্পর্কে বলা যাবে যে সে সংস্কৃতি-বিহীন পরিবারে জন্ম নিয়েছিল।

কিন্তু এসব হচ্ছে নৃবিজ্ঞানীদের কথা। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিপরীতে বৃহত্তর সমাজে তথা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির সংকীর্ণতর পাঠই এখনো আমরা বেশি করে দেখি।

উল্লিখিত প্রবণতাকে বিবেচনায় রেখে আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক কিছু ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে এই নিবন্ধের শুরুতেই ‘আদিবাসী’ শব্দটির একটি বিস্মৃতপ্রায় অর্থ বা ব্যঞ্জনার কথা উল্লেখ করা যাক।

বাংলাদেশে শব্দটিকে ঘিরে সাম্প্রতিককালে এত বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে যে [এ বিষয়ে বর্তমান ব্লগেই এই লেখকের একটি সার্বিক পর্যালোচনা রয়েছে: আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে: বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনর্নির্মাণের দুই দশক (১৯৯৩-২০১৩)],অনেকে ভুলেই গেছেন যে এককালে সাক্ষর শ্রেণীর বাংলাভাষীদের কাছে শব্দটার প্রধান অর্থ ছিল ‘আদিম’, যা এখনো বাজারে চালু যে কোনো প্রতিষ্ঠিত অভিধানের পাতা উল্টালেই চোখে পড়বে।

তবে বাংলাদেশে যাঁরা আদিবাসী পরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রয়াসের সাথে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে তেমন কেউ সচেতনভাবে ‘আদিম’ অর্থে শব্দটি আর ব্যবহার করেন না।

এই প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ বলতে আমরা ঠিক কি বুঝব – বিশেষ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি ধারণার সাথে আদিবাসী বর্গকে ঠিক কিভাবে মেলানো যাবে – এসব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে যায়।

বর্তমান নিবন্ধ হচ্ছে এ ধরনের কিছু প্রশ্নকে ঘিরে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সূচিত এই লেখকের কিছু আলাপকে এক জায়গায় নিয়ে আসার একটি প্রয়াস।

২. ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ বলতে আমরা কি বুঝব

সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১২ তারিখে আমি ফেসবুকে ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ প্রসঙ্গে একটা নোট প্রকাশ করেছিলাম, যেটির প্রেক্ষাপট ছিল চট্টগ্রাম নিবাসী শিল্পী জয়দেব রোয়াজার নিম্নোক্ত অনুরোধ:

চট্টগ্রামে অবস্থানরত কয়েকজন আদিবাসী চিত্রশিল্পী মিলে আমরা গ্রুপ এগজিবিশন করবো। সবাই ঠিক করেছে প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু থাকবে ‘আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি’।

আমার সমস্যা হলো , ‘আদিবাসী সংস্কৃতি কি?’ এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমি খুবই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি। যতই ভাবছি ততই জটিল মনে হচ্ছে।

… যদি আপনার হাতে সময় থাকে, এই বিষয়ে ছোট টীকার মত লিখা কি আমাদের দেয়া সম্ভব?  

যেটির সুত্র ধরে আমরা ছবি আকতে পারি?” উদ্ধৃত অনুরোধের সূত্র ধরে ফেসবুকে আমি যা লিখেছিলাম, তার উল্লেখযোগ্য অংশগুলি নিচে তুলে ধরা হল আবার। [জয়দেব রোয়াজার আঁকা একটি ছবি, যেটি নেওয়া হয়েছে তার ব্লগ থেকে, এবং তার অনুমতিক্রমে উল্লিখিত ফেসবুক নোটে অন্তর্ভুক্ত ছিল, এখানে আবার দেওয়া হল।]

জয়দেব রোয়াজার আঁকা একটি ছবি
জয়দেব রোয়াজার আঁকা একটি ছবি

আদিবাসী সংস্কৃতি কি? এটি একটি কঠিন প্রশ্ন, যা আকারে ছোট হলেও গুরুত্বের বিচারে  অনেক বড়। আর প্রশ্নটির বিষয়গত সীমানাও অনির্দিষ্ট কিন্তু সুদূরবিস্তৃত।

প্রথমত ‘আদিবাসী’ কথাটা কোন্ অর্থে ও কোন্ প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা বিবেচ্য।

দ্বিতীয়ত ‘সংস্কৃতি’ একটি বহুমাত্রিক ও বিশাল ব্যাপ্তি সম্পন্ন বিষয়, যাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখা যায়। কাজেই শুরুতেই সংশ্লিষ্ট ধারণাগত সীমানাগুলোর দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভাল।

অধুনা, মূলত আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অধিকার আদায়ের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা নিয়ে, আদিবাসী পরিচিতির ছাতার নিচে জড়ো হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনে কোণঠাঁসা হয়ে পড়া বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

 জনসংখ্যার বিচারে বিভিন্ন আকারের আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার বা ততোধিক সংখ্যক আদিবাসী জাতি ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সকল মহাদেশে।  

তাদের বসবাস  উত্তর মেরুবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্ত, হিমালয়ের সুউচ্চ পার্বত্য প্রদেশ থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের বহু দ্বীপ, নিরক্ষীয় অরণ্য থেকে বিশাল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি বা মরু অঞ্চল, শিল্পোন্নত বিশ্বের নগরাঞ্চল থেকে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ – সর্বত্র। 

কাজেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘আদিবাসী’ বর্গের আওতায় যে বিপুল জাতিগত-ভৌগোলিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমাহার রয়েছে, তাকে কোনো সরল ছকে বাঁধা যাবে না।

এই বিচারে বৈশ্বিক পরিসরে ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ বলে কিছু দাঁড় করানো প্রায় নিরর্থক। আমরা যদি শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই কথাটি ব্যবহার করি, তাতেও আমাদের কাজ খুব একটা সহজ হয় না।

প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী নামে পরিচিত (বা পরিচিত হতে ইচ্ছুক), এরকম শুধু একটা জাতির বেলায়ও যদি ধরি, সেক্ষেত্রেও একক, অবিভাজ্য ও নির্ভেজাল একটি সংস্কৃতির কথা বলা যাবে না।

যেমন, ‘গারো সংস্কৃতি’ কি, এ প্রশ্ন যদি দশজন গারোকে করি, দশ রকম না হোক, অন্তত পাঁচ রকম উত্তর আসবে, বিশেষ করে যদি উত্তরদাতাদের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে এলাকা, শিক্ষা, বয়স, পেশা, শ্রেণী ইত্যাদির দিক থেকে।

[৫] কাজেই সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ বলে স্থির-সুনির্দিষ্ট-শাশ্বত কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।

একটা সময় ছিল, যখন ভাবা হত যে আদিবাসী মানে ‘আদিম’, ‘বন্য’, ‘অসভ্য’ প্রভৃতি। এরকম ঔপনিবেশিক মানসিকতা এখন প্রকাশ্যে তেমন দেখা যায় না, তবে অন্য বেশে তা কিন্তু এখনও বহাল তবিয়তেই জেঁকে বসে আছে অনেকের মগজে।

আদিবাসীরা হল প্রকৃতির সন্তান, তারা সহজ সরল, সহজাতভাবে সৎ ইত্যাদি – এ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী বিরলতো নয়ই, বরং শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।

আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এ জাতীয় ধ্যান-ধারণা আসলে পূর্বোল্লিখিত ঔপনিবেশিক মানসিকতারই ভিন্ন সংস্করণ, একই মুদ্রার উল্টো পিঠ।

কাজেই ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ কথার ব্যবহারে যদি আমাদের এ ধরনের কোন চেতনাগত ফাঁদে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা বাদ দেওয়াই ভাল।

শুরুতেই যেমনটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, আদিবাসী পরিচয়ের মূল তাৎপর্য নিহিত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার প্রান্তিক জাতিসমূহের অধিকার প্রতিষ্ঠার সামষ্টিক প্রয়াসের মধ্যে।

আধিপত্যকারী জাতিদের চাইতে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা ভিন্ন আত্মপরিচয়ের দাবিদার এ ধরনের জাতিরা যারা আদিবাসী পরিচয়ের আওতায় বহুকালের বঞ্চনার প্রতিকার চায়, এবং সেসাথে সুরক্ষা চায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন অধিকারের – যেমন ভূমির অধিকার, ভাষাগত  অধিকার ইত্যাদি – তাদের সংগ্রামের ছবি, তাদের আনন্দ-বেদনার রূপ এবং স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বয়ান  তুলে ধরার একটা শিরোনাম হিসেবে হয়ত ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ কথাটা ব্যবহার করা যেতে পারে।

পাশাপাশি আদিবাসী পরিচয়ের মাধ্যমে যদি আমরা বিশেষ কিছু মূল্যবোধের (যেমন সমতা, সহভাগিতা ও প্রকৃতিসংলগ্নতার আদর্শের) চর্চাকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য ছড়িয়ে দিতে চাই, তাহলে সেভাবেও আমরা আমাদের শিল্প ভাবনাকে সাজিয়ে নিতে পারি।

সংস্কৃতিকে বুঝতে বা তুলে ধরতে গেলে কি ধরনের বিষয় খেয়াল রাখা ভাল, এ সম্পর্কে  নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য কিছু বিষয় নিচে উল্লেখ করা হল।

প্রেক্ষাপট:  

সংস্কৃতির যে কোন উপাদানের মর্মার্থ বুঝতে গেলে আগে সেটির সার্বিক প্রেক্ষাপট জানতে হবে। 

আমরা কোনো আদিবাসী জাতির সংস্কৃতির কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরতে পারি, কিন্তু এগুলো কোন্‌ জায়গায় কাদের সামনে কি উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হচ্ছে, এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।[৬] 

উদ্ভাবিত ঐতিহ্য:  

ঐতিহ্যবাহী বলে আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই চালানো হয়, যেগুলো আসলে সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো বিশেষ চাহিদা মেটাতে [যেমন বিভিন্ন ধরনের ‘জাতীয়তা’ বা অন্য কোনো নবনির্মিত সামষ্টিক পরিচয় নির্মাণের অনুষঙ্গ বা মাধ্যম হিসেবে] উদ্ভাবিত হয়েছে।

 [৭] নাচগান, পোশাক, খাবার ইত্যাদির বেলায় এ প্রবণতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। [যেমন ওয়ানগালা উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে যে ‘জুম নৃত্য’ পরিবেশিত হয়, তা এক ধরনের উদ্ভাবিত ‘ঐতিহ্যবাহী নৃত্য’, যেটির সৃষ্টি হয়েছে ১৯৫০ সালে বাংলাদেশের মান্দিদের জন্য আইন করে জুমচাষ নিষিদ্ধ হওয়ার পর!

খোদ ওয়ানগালা উৎসবটাই – যেভাবে এটি বর্তমানে ঢাকায় উদ্‌যাপিত হয় – এক ধরনের উদ্ভাবিত ঐতিহ্য বটে, যে ব্যাপারে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজকেরাও সচেতন, এবং যা নিয়ে নানামুখী চিন্তা-ভাবনা ও তৎপরতা, আলোচনা ও বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।

এসব প্রবণতা বা পুরো ঐতিহ্য উদ্ভাবনের বিষয়টি কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়, বরং সমকালীন প্রেক্ষাপটে তা এক অর্থে অপরিহার্য বাস্তবতা, যে কথাটা প্রচ্ছন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছিলাম আমি ২৭-৯-১৫ তারিখে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার প্রাক্কালে দেওয়া ফেসবুক পোস্ট-এ]

নয়া ঐতিহ্য (২৭-৯-১৫ তারিখে লেখকের তোলা ছবি)
নয়া ঐতিহ্য (২৭-৯-১৫ তারিখে লেখকের তোলা ছবি)
জুম নৃত্যের একটি দৃশ্য। লেখকের তোলা ছবি, ২৭-৯-১৫
জুম নৃত্যের একটি দৃশ্য। লেখকের তোলা ছবি, ২৭-৯-১৫

শিল্প কিসের জন্য?: 

এটি কোনো নতুন প্রশ্ন নয়। শিল্প আর রাজনীতি সবসময় একই ধারায় চলে না, এবং সব ক্ষেত্রে তাদেরকে মেশানোও নিশ্চয় ঠিক না।

তবে প্রসঙ্গ যেখানে ‘আদিবাসী’, অর্থাৎ অধিকার-বঞ্চিত মানুষেরা, শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন অবশ্যই সামনে চলে আসে।

একজন শিল্পীর আঁকা ছবি কি নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া আদিবাসীদের সংকট মনে দাগ কাটার মত করে তুলে ধরতে পারবে? নাকি ছবিটা নিসর্গ চিত্র হিসেবে কোন ধনাঢ্য ভূমিদস্যুর বসার ঘর অলংকৃত করবে?  এ ধরনের প্রশ্ন অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

সংস্কৃতির স্থানীয় ধারক বাহকদের দৃষ্টিভঙ্গী:  

একজন বাইরের মানুষের কাছে যে বিষয়টি ভিন্নতার কারণে চোখে পড়তে পারে, স্থানীয়দের কাছে সেটা নেহাতই মামুলি কোনো বিষয় হতে পারে, এবং এর উল্টোটাও সত্য হতে পারে।

শিল্পীদের চিত্রায়নে জুমিয়া কৃষকদের উচ্ছল উল্লসিত রূপ ধরা পড়তে পারে, তবে বাস্তবের জুমিয়াদেরকে অনেক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে হয়, এবং ইদানিং তাদের কাজ করতে হয় অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে।

কাজেই জুমিয়া জীবনকেই যদি আমরা বিষয় করি, তারা নিজেদের জীবনকে কি চোখে দেখে, তা জানা থাকা ভাল।

সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা: 

সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির অনেক কিছুই পাল্টে যায়। যেমন, ঐতিহ্যগতভাবে ত্রিপুরা নারীদের পোশাক ‘রিনাই রিসা’ হলেও শহরাঞ্চলে বসবাসরত অনেকের কাছেই এগুলি এখন দৈনন্দিন পরিধেয়র তালিকায় নেই।

 এ কথা বিবেচনায় নিলে, ত্রিপুরা নারীদের ছবি আঁকতে গেলে তাদেরকে সব সময় ‘রিনাই রিসা’ পরানো অবস্থায় দেখাতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নিশ্চয় নেই।

কাজেই সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার কথা মনে রেখে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী ‘আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি’র চলমান বিভিন্ন ধারা, বহুবিধ রূপ শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলবে, এটাই প্রত্যাশিত।

৩. সরকারি সংগ্রহশালা কি হতে যাচ্ছে আদিবাসীদের ঐতিহ্যের শেষ গন্তব্য?

এই অংশের বক্তব্য সাজানো হয়েছে জুলাই ৮, ২০১৩ তারিখে শিল্পকলা একাডেমির একটা অনুষ্ঠানে একজন ‘বিশেষ অতিথি’ হিসেবে এই লেখকের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার আলোকে, যে কথা ঘটনার পরের দিন একটা ফেসবুক নোট আকারে প্রথম বলেছিলাম।

সেই নোটে যেমনটা উল্লেখ করেছিলাম, অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যখন উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হয়, আমাকে বলা হয়েছিল, আদিবাসীদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী উপকরণ নিয়ে একটা সংগ্রহশালা চালু করা হচ্ছে, তার উদ্বোধন হবে (ফোনদাতা ‘আদিবাসী’ শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন)। সাত পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম লিখিত কিছু না দেখেই।

কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখা গেল, ফিতা কেটে যে উদ্যোগের উদ্বোধন করা হচ্ছিল, ওটার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ঐতিহ্য সংগ্রহশালা’।

উল্লিখিত জায়গায় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটি মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না, কেননা ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি রাষ্ট্রীয় পরিসরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তারপরেও আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত একটা অনুষ্ঠানে ‘বিশেষ অতিথি’ হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে, কারণ এটি নিয়ে আরো অনেকের মত আমার নিজেরও যথেষ্ট আপত্তি ছিল।[৮]

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আদিবাসীদের স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের বঞ্চনা তথা এদেশের আধিপত্যশীল শ্রেণীর উন্নাসিক ও অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিভূ হিসেবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটিকে দেখতে শুরু করেছিলেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে।

এই প্রেক্ষাপটে উক্ত অনুষ্ঠানে যখন আমার কথা বলার সুযোগ হয়, নিজের বক্তব্যে আমি মূলত দু’টি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম, যার একটি ছিল ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটির ব্যবহার বিষয়ক, আর দ্বিতীয়টা ছিল ‘সংগ্রহশালা’য় সাংস্কৃতিক উপকরণ দেখানোর প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিয়ে।

‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদের ব্যবহারের প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ বিভাগের (নৃবিজ্ঞান নয়!) অধ্যাপকদের গর্ব করে বলতে শুনেছি, ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি নাকি তাঁদের অবদান, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই এ নিয়ে আত্নপ্রসাদ লাভের কিছু আছে কিনা।

বিশেষ করে ‘ক্ষুদ্র’ বিশেষণযোগে শব্দটির ঢালাও (এবং রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট) ব্যবহার সত্যিই অবমাননকর।

শিল্পকলা একাডেমির মত জায়গায়, যেখানে সংস্কৃতির নান্দনিক দিকগুলোকে তুলে ধরা হয়, সেখানে রং, ছন্দ ও সুরের বৈচিত্র্যময় বৈভবে ভরা আদিবাসীদের সংস্কৃতিসমূহ তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের যেসব ঐতিহ্যগত প্রবণতাসমূহ সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই আরাধ্য – প্রকৃতি সংলগ্নতা, সহভাগিতা ও সমতার আদর্শ – সেগুলোর প্রতি বেশি আলোকপাত করা হবে, তাই কাম্য।

এই প্রেক্ষাপটে সংখ্যাগত ‘ক্ষুদ্রতা’র পরিবর্তে তাদের সাংস্কৃতিক আদর্শের ‘উৎকৃষ্টতা’ কেন হবে না তাদের পরিচিতির মানদন্ড?

দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য ছিল সংক্ষেপে এই: সংগ্রহশালায় যেসব উপকরণ প্রদর্শিত হচ্ছে, হবে, সেগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের সার্বিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা, তাদের সংকট, সংগ্রাম – এসব কতটা ফুটে উঠছে, তা ভাববার বিষয়।

যাদের সংস্কৃতি দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে তারা যদি বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে থাকে, হারাতে থাকে তাদের ভূমি, তাহলে সংগ্রহশালায় কংকালের অংশবিশেষের মত কিছু নমুনা দেখানোর কোনো মানে আছে কি?

উদ্বোধিত ‘ঐতিহ্য সংগ্রহশালা’র নামে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র জায়গায় ‘আদিবাসী’ শব্দটা বসানো থাকলেও একথাই বলতাম।

৪. আদিবাসী সংস্কৃতির জমিন যখন রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় উপেক্ষিত

সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি’ বিষয়ক যে নূতন অনুচ্ছেদ (২৩ক) সংযোজিত হয়েছে, সেটিকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি উত্তর হিসেবে।

‘আদিবাসী’ শব্দটা না থাকলেও তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে যে সংবিধানে প্রথমবারের মত সরাসরি কিছু বলা হয়েছে, তা অবশ্যই একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। সংযোজিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

তবে এই সংযোজনীর তাৎপর্য ম্লান হয়ে যায় যখন প্রাসঙ্গিক কিছু বিপরীত প্রবণতা ও সীমাবদ্ধতা আমরা বিবেচনায় নেই।

যেমন, যখন জাতীয়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণকে অভিহিত করা হয় শুধুই ‘বাঙালী’ হিসেবে, অথবা বলা হয়, “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট … বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন,” তখন সংবিধানে যে জাতি-রাষ্ট্রের কল্পনা ফুটে ওঠে, তা একচ্ছত্রভাবে বাঙালিময়, যেখানে অন্য জাতিসমূহের কোনো স্বীকৃতি নেই।

সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে তাদের কথা যে নামেই থাকুক, এই অস্বীকৃতির বাস্তবতা তাতে পাল্টায় না।

এদিক থেকে সেখানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি থাকলেও কিছু এসে যেত না।

উল্লেখ্য, সংবিধানের মূল ২৩ অনুচ্ছেদ হল ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ বিষয়ক, যেখানে সংস্কৃতি ধারণাকে সীমিত পরিসরেই দেখা হয়েছে, যার আওতায় উল্লেখ করা হয়েছে ‘জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলা’র মত বিষয়।

তবে এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, সংযোজিত ২৩ক অনুচ্ছেদে ‘ভাষা’র প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য বহু ভাষা আছে, এই বাস্তবতা সংবিধানের কোথাও আমলে নেওয়া হয় নি।

একইভাবে আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি দাবির ক্ষেত্রে যে বিষয়টা অনেকের বিবেচনায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ – দেশের বিশেষ কিছু এলাকায় গড়ে ওঠা ভূমির সাথে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের বিশেষ ঐতিহাসিক সম্পর্ক – তাও সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয় নি।

উল্লেখ্য, ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী’দের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষ নজর কিন্তু সংবিধানে ২৩ক অনুচ্ছেদ সংযোজিত হওয়ার আগে থেকেই ছিল, যেমন, ২০১০ সালে প্রণীত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন এবং ২০০৬ সালের জাতীয় সংস্কৃতি নীতিতে।

প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে ‘আদিবাসী’ শব্দটা না থাকাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটিকে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করতে হবে, এমন একটি ভুল ব্যাখ্যা অনেকে মাঝে মধ্যে গণমাধ্যমে তুলে ধরলেও বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি আইনেই ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বলতে আদিবাসীদের বোঝানো হয়েছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০-এর ‘সংজ্ঞা’ অংশে (২(২) ধারায়) বলা হয়েছে,

“ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী” অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ।”

যাহোক, আমাদের জন্য যে বিষয়টা অধিকতর প্রাসঙ্গিক, তা হল, ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ প্রভৃতি নামের মাধ্যমে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে যে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাতে সবক্ষেত্রেই ‘সংস্কৃতি’ শব্দের সংকীর্ণ অর্থকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে;

সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দেখা হয়েছে এক ধরনের ‘আকর্ষণীয় বিষয়’ হিসেবে, যার যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে এসবকে পর্যটকদের কাছে ‘পণ্য’ হিসেবে তুলে ধরার চিন্তাও উঠে এসেছে জাতীয় সংস্কৃতি নীতি ও জাতীয় পর্যটন নীতিতে।

[৯] আদিবাসীদের যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের ভূমি ও ভাষার অধিকারের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে, তাদের সংস্কৃতির একটা খন্ডিত ও বাহ্যিক রূপকে বাজারজাত করার মতাদর্শিক প্রয়াসই আমরা রাষ্ট্রীয় পরিসরে লক্ষ্য করি, যে ধারা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে।

৫. উপসংহার

উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি, আদিবাসীদের রাষ্ট্র কি নামে ডাকছে, সেটি বড় কথা নয়।

তাদের ভাষা ও ভূমির অধিকারের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে তাদের সংস্কৃতির একটি বাহ্যিক ও খন্ডিত রূপের পৃষ্ঠপোষকতার উদ্যোগ চলে আসছে নানাভাবে, বিভিন্ন পরিসরে, বিশেষ করে বাজার ব্যবস্থার আলোকে।

এই প্রবণতারই অংশ আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে বিভিন্ন বর্ণাঢ্য রূপে নানান ধরনের মেলায় তুলে ধরা।

এই ধারা চলতে থাকলে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ক্রমশ আটকে পড়বে মেলা, মঞ্চ বা মিউজিয়ামের মত পরিসরে, অন্যদিকে তারা হারিয়ে ফেলছে, হারিয়ে ফেলতে থাকবে, তাদের ভাষা ও ভূমি – যেগুলি হল তাদের সংস্কৃতির প্রকৃত জমিন।

~~~

[১] সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫-তে বনানী বিদ্যানিকেতনে অনুষ্ঠিত ঢাকা ওয়ানগালা ২০১৫ উপলক্ষে প্রকাশিত একই শিরোনামের স্মরণিকায় এই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

লেখাটির কিছু অংশ (বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২ ও ৩) অন্য প্রেক্ষাপটে ও ভিন্ন আকারে আগেই প্রকাশিত হলেও সেগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে আসার পাশাপাশি নতুন কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা যোগ করেছি ঢাকা ওয়ানগালা ২০১৫-কে সামনে রেখে।

উল্লেখ্য, ঢাকায় ওয়ানগালা অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর দেখে আসছিলাম বেশ কয়েকবছর যাবত, কিন্তু কখনো এই উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় নি আগে।

কাজেই ওয়ানগালার আয়োজকদের একজন তথা স্মরণিকার প্রধান সম্পাদক পরাগ রিছিল যখন আমাকে তাঁদের অনুষ্ঠানে একজন বক্তা হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন, এবং একটি লেখাও চাইলেন আমার কাছে, দু ব্যাপারেই আমি রাজি হয়ে যাই সানন্দে।

পরাগ রিছিল ও তাঁর সতীর্থদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই লেখায় প্রকাশিত চিন্তাভাবনা তুলে ধরার উপলক্ষ এনে দেওয়ার জন্য।

উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানস্থলে দেওয়া আমার বক্তব্যেও এই লেখায় উত্থাপিত কিছু প্রসঙ্গ আমি নিয়ে এসেছিলাম, সেসাথে ওয়ানগালায় যোগ দিতে গিয়ে নজরে আসা বাড়তি কিছু পর্যবেক্ষণ বা ভাবনাও যোগ করেছিলাম।

বর্তমান ভাষ্যে এ ধরনের কিছু প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ ও তথ্যসূত্র যোগ করা হয়েছে টীকা আকারে, অথবা দু’একটি ক্ষেত্রে মূল নিবন্ধেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে [আয়ত বন্ধনীর ভেতরে রেখে]।

[২] উদাহরণ হিসেবে দেখুন: ১৮৭১ সালে প্রকাশিত Edward Tylor-এর Primitive Culture: Researches into the Development of Mythology, Philosophy, Religion, Art and Custom গ্রন্থটি [প্রকাশক John Murray, London] এবং ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত  Lewis Henry Morgan-এর Ancient Society Or Researches into the Lines of Human Progress from Savagery through Barbarism to Civilization গ্রন্থটি (প্রকাশক MacMillan & Co., London), যেটি বুলবন ওসমানের করা বাংলা অনুবাদে আদিম সমাজ নামে এখনো বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায়।

[৩] আদিম সমাজের ধারণার প্রবর্তন কিভাবে হল, এবং কেন এটিকে বাতিল করা দরকার, এ বিষয়ক একটি গ্রন্থ: Kuper, Adam (1988) The Invention of Primitive Society: Transformation of an Illusion. New York: Routledge

[৪] উদাহরণ হিসেবে গুগল অনুসন্ধান থেকে পাওয়া একটি নমুনা এখানে দেওয়া হল। দৈনিক সমকালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সন্ধানে শিরোনামের একটি লেখায় বলা হয়েছে, “আপাতদৃষ্টিতে এই দুই কবি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ। … একজন সুপরিচিত, অভিজাত, সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারের সন্তান…।”

[৫] মূল নোটে ‘গারো’দের জায়গায় ‘ত্রিপুরা’দের রয়েছে। আর সেখানে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, একই জাতির সংস্কৃতির মধ্যেও যে বৈচিত্র্য থাকে, এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মৃনাল কান্তি ত্রিপুরা।

[৬] লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যেমন Text ও context-এর সম্পর্কের উপর পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, তেমনি সংস্কৃতির প্রাত্যহিক বিভিন্ন উপাদানকেও ‘টেক্সট’ হিসেবে দেখার একটা রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল ক্লিফোর্ড গিয়ার্জের মত নৃবিজ্ঞানীদের কাজে, যে প্রেক্ষাপটেও ‘কন্‌টেক্সট’ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

[৭] ‘উদ্ভাবিত ঐতিহ্য’ বিষয়ে একটি বহুলপঠিত গ্রন্থ হল মার্ক্সবাদী ঘরানার ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Eric Hobsbawm ও তাঁর সহযোগী Terrance Ranger-সম্পাদিত The Invention of Tradition, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, Cambridge University Press থেকে।

[৮]উদাহরণ হিসেবে দেখুন, বর্তমান ব্লগে প্রকাশিত অরণ্য থেকে অন্তর্জালে, রাঙা মাটির পথ থেকে রাজপথে শিরোনামের একটি নিবন্ধের শেষাংশ, অথবা আইনুন নাহারের সাথে এই লেখকের সহলিখিত ও প্রথম আলোতে ৬-৮-২০১৩ তারিখে প্রকাশিত ক্ষুদ্ররা নগণ্য থাকবে, না অগ্রগণ্য হবে? নামের একটি লেখা।

[৯] ওয়ানগালা উদ্‌যাপন উপলক্ষে ২৭-৯-১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেওয়া সংস্কৃতি মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই এসব কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছিল।

ঘটনাক্রমে সেদিন আবার ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস, যে বিষয়টা উল্লেখ করার পর আমি আমার বক্তব্যে বাংলাদেশের বর্তমান (২০০৯ সালে প্রণীত) জাতীয় পর্যটন নীতিমালার অংশবিশেষ পড়িয়ে শুনিয়েছিলাম, যেখানে লেখা আছে:

“সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল ও হাওড়ে অসংখ্য বিরল জীবজন্তুর জীব-বৈচিত্র, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান, … দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমাহার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন–যাত্রা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী বাংলার লোকশিল্প, …গ্রামবাংলার সমাজ ব্যবস্থার আবহমানরূপ, দেশীয় খাবার ইত্যাদি বিশ্বে পর্যটকদের অত্যন্ত আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।”

লেখকঃ প্রশান্ত ত্রিপুরা

মুললেখাঃ https://ptripura1.wordpress.com/2015/10/03/adibashi_culture/

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা