আদিবাসী জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক অধিকার ও বর্তমান অবস্থা
1287
ভূমিকা
সংস্কৃতি (culture) বলতে সাধারণত নাচ, গান, নাটক, কবিতা, কৌতুক, আবৃত্তি , চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য ইত্যাদিকে বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু সংস্কৃতি শব্দটি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। বস্তুত নাচ-গান-সাহিত্য থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার, খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন, ঘর-বাড়ি, পোষাক-পরিচ্ছদ, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা , দর্শন ইত্যাদি সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ।
আসলে বাস্তব ও মানসিক সমস্ত কৃতি বা সৃষ্টি নিয়েই সংস্কৃতি। প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফের মতে, ‘মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই- অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, ব্যবহারিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই তার সংস্কৃতি নিহিত থাকে।
সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিস্রত জীবনচেতনা। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর , শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।’
বলা যায় মানুষের গোটা জীবন প্রণালীটাই সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতির সাথে তার জীবনধারা, জীবিকা, উৎপাদন প্রণালী, উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্ক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
বাংলাদেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতি ছাড়াও ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীভূত বসবাস রয়েছে।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরুং, বম, লুসাই, পাংখো, খুমী, খিয়াং ও চাক ভিন্ন ভাষাভাষি এই এগারটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভিন্ন ভাষাভাষি এ সকল আদিবাসী জাতিসমূহ সমষ্টিগতভাবে ‘জুম’ নামে সমধিক পরিচিত।
এছাড়া রয়েছে গোর্খা, অহমিয়া ও সাঁওতাল জাতির কিছু লোক। এসব আদিবাসী জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্ম-ভাষা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নিয়ে এ অঞ্চলে বসবাস করে আনই তাদের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, সামাজিক রীতিনীতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, দৈহিক-মানসিক গঠন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রা ইত্যাদি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
বৈচিত্র্যময় অপরূপ প্রকতির মতই আদিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি সুন্দর ও বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যময় তাদের ভাষা, রীতি-নীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও উৎসবঅনুষ্ঠান বিশ্বায়নের প্রভাব, তথাকথিত আকাশ-সংস্কৃতি ও নানা অপসংস্কৃতির ছোবলে আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আজ চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে।
অপরদিকে তথাকথিত আধুনিকায়নের অপচেষ্টায় বিভিন্ন আদিবাসী জাতির স্বকীয় সংস্কৃতি বিবর্ণ হতে চলেছে। সংস্কৃতির সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আদিবাসীদের সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি বিপন্ন হতে চলেছে।
কোন কোন আদিবাসী জাতির সংস্কৃতি ও তাদের নাচ-গান, পোষাক পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য ও উৎসব ও তাদের মাতৃভাষা ধ্বংসপ্রায়। আদিবাসীদের এসব সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি ও তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, তাদের ভাষা ও সাহিত্য এবং তাদের উৎসব, প্রথা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন করা অত্যাবশ্যক।
আদিবাসীদের স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হলো আদিবাসীদের জাতিগত পরিচয় ও স্বাতন্ত্রতার প্রতীক। আদিবাসীদের এসব ঐতিহ্য, প্রথা, ভাষা ও কৃষ্টি তথা সংস্কৃতি এদেশের সংস্কৃতি ভাণ্ডারের অমূল্য রত্ন ও সম্পদ।
আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে তাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালন করে আসছে এবং পাশাপাশি এদেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তাকে তারা সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আজ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রবল আগ্রাসনে তথা বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে তাদের সেই ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লোকেরা আদিবাসীদের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব কম জানে। ফলে আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, রীতিপদ্ধতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকে।
নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতির অভাবের কারণে আদিবাসীদের সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। আদিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য হারাচ্ছে। হারাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি, রীতি-প্রথা, গান প্রভৃতি।
অনেক আদিবাসীদের দেয়া জায়গার নামও বাংলা নামে পরিবর্তন করা হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আদিবাসীরা এতই সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার যে, এমনকি হোটেলে রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত তাদেরকে খাবার দিতে চায় না।
জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্য-পুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত। পাঠ্যবইয়ে আদিবাসীদের সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অধিকার জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে এই মর্মে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে যে, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের কোনভাবেই অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে একীভূত করার ক্ষেত্রে চাপ দেওয়া যাবে না এবং জোর করে বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা যাবে না।
উক্ত ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, প্রথা ও ঐতিহ্য চর্চা এবং এগুলোকে আরও উন্নত করার অধিকার আদিবাসীদের রয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ২৭ নং অনুচ্ছেদে যেসব দেশে জাতিগত, ধর্মর্গত, অথবা ভাষাগত সংখ্যালঘু রয়েছে সেসব দেশে অনুরূপ।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য তাদের গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের সাথে সম্মিলিতভাবে নিজেদের সংস্কৃতি উপভোগ, নিজেদের ধর্ম ব্যক্ত ও অনুশীলন অথবা নিজেদের ভাষা ব্যবহার করার অধিকার অস্বীকার করা যাবে না।
বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত আরেকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি- আইএলও’র ১৯৫৭ সালের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী বিষয়ক ১০৭ নং কনভেনশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা এবং ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ১৬৯ নং কনভেনশনেও আদিবাসী জাতিসমূহের তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রথা এবং ঐতিহ্য মোতাবেক তাদের আত্মপরিচয় অথবা সদস্যপদ নির্ধারণের অধিকার রয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী সংস্কৃতিসহ মৌলিক মানবাধিকার স্বীকৃতি দিলেও দেশের অভ্যন্তরে কার্যত প্রতিনিয়ত উপেক্ষা ও লঙ্ঘন করে চলেছে।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশকের (২০০৫-২০১৪) কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে সমর্থন ও উৎসাহিতকরণ, আদিবাসীদের ভাষা এবং স্বাতন্ত্র পরিচিতি সংরক্ষণ ও প্রচলনের সুপারিশ করা হয়েছে যাতে লক্ষ্যার্জনে আদিবাসীদের নিজস্ব পদ্ধতি ও উপায় প্রয়োগ সম্পন্ন হতে পারে।
জাতিসংঘের কর্মপরিকল্পনায় সংস্কৃতি বিষয়ে আরও একটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে যে, যেসব কার্যক্রম ও উদ্যোগ আদিবাসীদের সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত তা আদিবাসীদের পরামর্শ, স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির নীতি অনুসারে পরিচালনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মউদ্যোগ হাতে নেয়ার পূর্বে আদিবাসীদের সাথে কোন পরামর্শ বা স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ করা হয়নি৷
আদিবাসী সংস্কৃতি এবং ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার
আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির সাথে ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ভূমি, বন ও প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে আদিবাসীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে।
বিশ্বের দেশে দেশে আদিবাসীরা ভূমিকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে। তাই ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চয়তা বিধানের উপর নির্ভর করে ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা ও ঐতিহ্যের অস্তিত্ব সংরক্ষণ।
যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আদিবাসী জুম্মদের ভূমির উপর অনন্য সামাজিক/সমষ্টিগত মালিকানা ব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী চাষ (যেমন জুম চাষ, পান চাষ) প্রথাগত আইন ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আদিবাসীদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক জীবনধারা।
রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত এসবের অধিকার উপেক্ষা বা লঘন করে চলেছে, যার অর্থ আদিবাসী সংস্কৃতি ধ্বংস সাধন। এদেশে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার এবং ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার সুরক্ষিত না থাকলে আদিবাসীদের সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও গতিধারা বিপন্ন হতে বাধ্য।
বংশ পরম্পরায় বসবাসরত ভূমির উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার অস্বীকার, বনবিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত বন ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জনসংখ্যা স্থানান্তর প্রকল্প, বহিরাগতদের নিকট জমি ইজারা প্রদান, সামরিক কাজে ভূমি অধিগ্রহণ, দিনাজপুরে কয়লা উত্তোলন, সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের মাধ্যমে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি উচেছদ, জোরপূর্বক ভূমি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে আদিবাসীদের তাদের পিতপুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাদের সংস্কৃতি নির্মূলীকরণের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধান না করে এবং পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে সরকার বর্তমানে বিজিবি, সামরিক বাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণ, সেনাবাহিনীর তথাকথিত পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন, রক্ষিত/সংরক্ষিত বন ঘোষণা, সেটেলার বাঙালিদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণের নামে ভূমি অধিগ্রহণ এবং বহিরাগত ব্যবসায়ী/প্রভাবশালী ব্যক্তি/ভূমিগ্রাসীদের ভূমি জবরদখলে মদদ ও সহায়তা দিয়ে চলেছে।
তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় ২১টি জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদ করে এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দখল করে বিজিবির ব্যাটেলিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের উদ্যোগ এবং রুমা উপজেলার পাইন্দু মৌজা ও পলি মৌজার পাইন্দ পাভা চান্দ পাড়া ও চাইপো পাড়ার প্রায় ৫০০ মারমা পরিবারকে উচ্ছেদ করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন, রোয়াংছড়ি উপজেলায় রামজাদি জায়গা দখল করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ; যার মধ্যে বাবুছড়ায় জুম্ম গ্রামবাসী ও বিজিবি-পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা সারাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দু’টি গ্রামের ৬৫টি জম্ম পরিবার উচ্ছেদ করে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের রুইলং গ্রামে। পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন; রুমা উপজেলায় বম অধিবাসী উচ্ছেদ করে আনিদ্য পর্যতন কেন্দ্র স্থাপন; বান্দরবান সদর উপজেলায় ডালে ম্রো পাড়া (জীবন নগর) কাপ্রু পাড়া (নীলগিরি), চিম্বুক ষোল মাইল, ওয়াই জংশন (বারো মাইল) ও কেওড়াতে পাহাড়ে ৬০০ একর জায়গা দখল করে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাঘাইছড়ির দ্বিটিলা এলাকায় ও গঙ্গারাম দোয়ারে প্রথাগত ভূমিতে বৌদ্ধ মূর্তি নির্মাণে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন বাধা দিয়ে চলেছে।
এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও জুম্মদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে লঙ্ঘন করে বনবিভাগ কর্তৃক বাচ্চা জেলায় ২০টি মৌজায় প্রায় ৫৩,০০০ একর মৌজা ভূমি সংরক্ষিত বন ঘোষণার মরিয়া ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।
নাইক্ষ্যংছড়িতে ২১টি চাক পরিবারকে উচেছদ করে বহিরাগত প্রভাবশালী কর্তৃক তাদের জায়গা-জমি জবরদখল ও কামিছড়া মৌজায় প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ কর্তৃর্ক ব্যাপক জুম ভূমি দখল; ত্রাস সৃষ্টি করে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে লামায় জুম্ম গ্রামবাসীর উপর বহিরাগত ভূমিদখলদারদের হামলা এবং লামা উপজেলার লুলেইন মৌজার ২৫০টি ম্রো পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি; লামায় জনৈক লাদেন গ্রুপ কর্তৃক ফাসাখালি ইউনিয়নের ৭৫টি ম্রো, ত্রিপুরা , মারমা ও স্থায়ী বাঙালি পরিবার উচ্ছেদ করে ১৭৫ একর জায়গা জবরদখল এবং আরও ২২১টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি; মুজিবুল হক গং কর্তৃক মারমা গ্রামবাসীর উপর হামলা চালিয়ে লামা উপজেলার রুপসী ইউনিয়নে প্রায় ৫০০ একর জায়গা দখলের অপচেষ্টা; রোয়াংছড়ি উপজেলায় একটি বহিরাগত বাঙালি কর্তৃক ৩৩টি মারমা পরিবারের রেকর্ডীয় জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বন্দোবস্তকরণ ও জবরদখলের অপচেষ্টা; আলিকদম উপজেলায় বদিউল আলম নামে জনৈক প্রভাবশালী কর্তৃক ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের প্রায় ১,০০০ একর রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জমি জবরদখল ইত্যাদি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যা রাষ্ট্রযন্ত্রের মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জবরদখলের ক্ষেত্রে মাৎস্যন্যায়ের অবস্থার চিত্র ফুটে উঠে।
এছাড়া কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় অস্থানীয়দের নিকট ১৬০৫টি রাবার প্লট ও হর্টিকালচার প্লট-এর বিপরীতে প্লটপ্রতি পঁচিশ একর করে ৪০,০৭৭ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নামে হাজার হাজার একর জমি সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই অধিগ্রহণের জন্য সশস্ত্র বাহিনী তথা সরকার পক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে।
ফলশ্রুতিতে জুম্ম অধিবাসীরা নিজ বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে এবং তাদের চিরায়ত জুম ভূমি হারিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সরকার একতরফাভাবে বনায়নের নামে ২,১৮,০০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
তন্মধ্যে কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় রয়েছে ৭২,০০০ একর জমি। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে সংখ্যালঘু ও সুযোগ বঞ্চিত খিয়াং জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে।
এসব ভূমির মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জুমচাষীদের প্রথাগত জুমভূমি। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদলীয় ভূমিও রয়েছে। এর ফলে শত শত জুম্ম অধিবাসী তাদের জুম ক্ষেত্র হারিয়ে ফেলছে এবং নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে, যা তাদের সংস্কৃতি ও জাতিগত অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে।
আদিবাসী সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের অধিকার
স্বকীয় সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও নিজস্ব জীবন প্রণালী ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু আদিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে জোর করে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে অঙ্গীভূত করানোর ষড়যন্ত্র চলছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একদিকে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে জাতিগত পরিচিতির স্বীকৃতি লাভের প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রত্যেক জাতির আত্মপরিচয়ের সহজাত অধিকারকে খর্ব করে সংবিধানে আদিবাসীদের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে অসম্মানজনক ও বিভ্রান্তিকর পরিচয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচিতি প্রদান করার মাধ্যমে ভিন্ন ভাষাভাষি ও ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী আদিবাসী জাতিসমূহকেও বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সর্বোপরি পূর্বের মতো ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও সংবিধানে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারগুলো সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
আদিবাসী সংস্কৃতি ও স্বশাসনে অধিকার
কোন জাতির আত্মপরিচয় রক্ষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও এর বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে অন্যতম অপরিহার্য শর্ত হলো সেই জাতির বা জনগোষ্ঠীর স্বশাসন বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনা করার ক্ষেত্রে স্বশাসন বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিকল্প নেই।
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতীত একটা জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসহ জাতীয় পরিচিতি সমুন্নত রাখা সম্ভব হতে পারে না। এজন্য আজ সারাবিশ্বে আদিবাসীদের স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রেখে তাদের ভবিষ্যৎ ও আত্মপরিচয় বিনির্মাণ করা তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে।
বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দেশের অন্যান্য নাগরিকদের মতো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে এবং উক্ত অধিকার বলে তাদের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে।
তারই আলোকে আদিবাসীদের আভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথ্য স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসমূহের জনসংখ্যার স্বল্পতা এবং প্রান্তিকতার প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে ও স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত নিশ্চিতকরণের প্রয়োজন থাকলেও সংবিধানে বা সংশ্লিষ্ট আইনে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই।
ফলত আদিবাসীদের প্রভাবিত করে এমন জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ণে তাদের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত-নির্ধারণের অধিকার প্রতি পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে আদিবাসী সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে এখনো সেই শাসনব্যবস্থার মজবুত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে উঠতে পারেনি।
বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট এখনো সকল ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
ফলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচিত আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ এখনো গঠিত হতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই বিশেষ শাসনব্যবস্থা যেখানে আদিবাসী জুম্ম ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব ও অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
সেই শাসনব্যবস্থার মজবুত ভিত্তি গড়ে না উঠার কারণে একদিকে যেমন আদিবাসী জুম্মসহ পার্বত্যবাসীর স্বশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অন্যদিকে এর ফলে এখানকার আদিবাসী জুম্ম জনগণের স্বকীয় সংস্কৃতিসহ জাতিগত পরিচিতি ও আবাসভূমির অস্তিত্ব চরম হুমকির মধ্যে বিরাজ করছে।
আদিবাসী জুম্ম সংস্কৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি
বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও তার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে সহায়ক বিভিন্ন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে জুম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
জুম্মদের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার বিধান করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছে যেগুলো জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতীয় পরিচিতির নিশ্চয়তা নিহিত রয়েছে। কিন্তু বিগত দেড় দশকেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় চরম এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে আদিবাসী জুম্মদের বন, ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সংস্কৃতির অধিকার যতটুকু স্বীকৃত হয়েছে তা আজ নানাভাবে পদদলিত করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক ও আদিবাসী সংস্কৃতি
মানবাধিকার বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনের সুপারিশমূলে ১৯৯৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৫-২০০৪ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে।
কিন্তু প্রথম দিকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট মাত্রায় এগিয়ে নেয়া সম্ভব না হওয়ায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১ জানুয়ারী ২০০৫ সালে রেজুলেশন ৫৯/১৭৪ গ্রহণ করে ২০০৫-২০১৪ সালকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে, যা এ বছর শেষ হতে চলেছে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশকের মল প্রতিদ্য বিষয় ছিল ‘কমউদ্যোগে ও মর্যাদায় অংশীদারিত্ব’ জাতিসংঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশকের কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে সমর্থন ও উৎসাহিতকরণ, আদিবাসীদের ভাষা এবং স্বাতন্ত্র পরিচিতি সংরক্ষণ ও প্রচলনের সুপারিশ করা হয়েছে যাতে লক্ষ্যার্জনে আদিবাসীদের নিজস্ব পদ্ধতি ও উপায় প্রয়োগ সম্পন্ন হতে পারে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযোগ্য কর্মউদ্যোগ যেটা বলা যেতে পারে তা হলো- ৩০ জুন ২০১১ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘২৩ক’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করে আদিবাসীদের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের বিধান করা।
উক্ত ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি। রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বিতর্ক বা ত্রুটি সত্ত্বেও এই ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটাই প্রথম যেখানে সংবিধানে আদিবাসীদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আদিবাসী জনগণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রদত্ত জাতিগত পরিচিতির অভিধাগুলো উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় ইত্যাদি গ্রহণ করেনি।
দ্বিতীয়ত উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের কেবলমাত্র অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। বস্তুত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।
আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সরকার সাথে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ভূমি অধিকার, সকল ক্ষেত্রে অর্থবহ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা এবং স্বাধীন ও পূর্ববহিত সম্মতির অধিকারসমূহ অবিচেছদ্যভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে।
এসব অধিকার ছাড়া পৃথক বা বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত হতে পারে না। তাই আদিবাসী সংগঠনগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদিবাসী জাতিসমূহের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি কার্যক্রম উল্লেখ করা যেতে পারে সেটা হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ প্রণয়ন করা। দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইন প্রণীত হয়েছে বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে।
উক্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনের তফসিলে ত্রুটিপূর্ণভাবে কেবলমাত্র ২৭টি জাতির নাম উল্লেখ রয়েছে। আদিবাসীদের মতে দেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে। ফলে প্রায় অর্ধেকাংশ আদিবাসী জাতি উক্ত তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।
বাদপড়া জাতিসমূহ নানাভাবে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কারণে গত ২০১১ সালের আদমশুমারীতে আদিবাসীদের প্রকৃত জনগণনা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি এবং বাদ পড়া জাতিসমূহ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগের উন্নয়ন সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
তবে সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদিবাসী জাতিসমূহের চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা নি:সন্দেহে ইতিবাচক বলা যেতে পারে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আদিবাসী ভাষাসমূহের জরিপ কার্যক্রম হাতে নেয়া।
তবে এই জরিপ কার্যক্রম কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে ও কোন কোন জাতির ভাষা নিয়ে পরিচালিত হবে তা এখনো আদিবাসীদের কাছে অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
দ্বিতীয় অন্তর্জাতিক আদিবাসী দশকের কর্মপরিকল্পনায় সংস্কৃতি বিষয়ে আরও একটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে যে, “যেসব কার্যক্রম ও উদ্যোগ আদিবাসীদের সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত তা আদিবাসীদের পরামর্শ, স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির নীতি অনুসারে পরিচালনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।”
কিন্তু সরকারের উল্লেখিত কর্মউদ্যোগ হাতে নেয়ার পূর্বে আদিবাসীদের সাথে সরকার কোন পরামর্শ বা স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি আদিবাসীদের সাথে কোন আশোচনা করেনি! এমনকি ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়নের সময়ও আদিবাসীদের সাথে কোন পরামর্শ অনুষ্ঠিত করা হয়নি।
কেবলমাত্র বর্তমানে চলমান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আদিবাসী জাতিসমূহের চিহ্নিতকরণের কার্যক্রমে আদিবাসী প্রতিনিধি ও আদিবাসী বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছে বলে জানা যায়।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশকের কর্মপরিকল্পনায় আরও উল্লেখ ছিল যে, আদিবাসীদের সংস্কৃতিক ব্যাপারে অআদিবাসীদের একগুঁয়ে ও নিকৃষ্ট ধারণা দূর করার রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ অনুরোধ করা হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে পাঠ্যবই থেকে আদিবাসীদের সম্পর্কে অসম্মান ও অপমানজনক বক্তব্য বাদ দেয়ার সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনে এই উদ্যোগ চূড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়নি।
আদিবাসীদের সংস্কৃতি বিষয়ে ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়া এবং মানবাধিকার বিষয়ে অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আগের যে কোন সময়ের তুলনায় আদিবাসী বিষয়ে বর্তমানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী বলে বলা যায়।
তবে এখনো কতিপয় গণমাধ্যম আদিবাসীদের বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদিবাসী বিষয়ে ব্যাপক ভুল ধারণা বিদ্যমান রয়েছে।
সুপারিশ
আদিবাসী সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যতার এমনি এক নাজুক অবস্থায় আদিবাসী জাতিসমূহের সংস্কৃতি তথা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উত্থাপন করা গেল
১। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৫৪ টির অধিক আদিবাসী জাতিসমূহের
জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
২। উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে নয়,
আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
৩। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশকল্পে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
৪। দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামে নয় বরং
‘আদিবাসী নামে আদিবাসী কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা ও এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং আদিবাসী সংস্কৃতির আদলে একাডেমির কার্যক্রম আরও মজবুত করা।
৫। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবিলম্বে যথাযথ বাস্তবায়ন করা ও এ লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।
লেখক: মঙ্গল কুমার চাকমা, লেখক ও প্রাবন্ধিক, রাঙ্গামাটি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।