তঞ্চঙ্গ্যা জাতির কয়েকজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব
733
রাজ কবি পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা
রাজ কবি শ্রী পমশাধন তঞ্চঙ্গ্যা সর্ব প্রথম বৌদ্ধ ধর্মের পুস্তক প্রকাশ করেন। রাইংখ্যাং নদীর তীরবর্তী হাজাছড়ি গ্রামে তার জন্ম হয়। আনুমানিক ১৮৯৮ ইং সনে।
তাঁর প্রথম ধর্মীয় কাব্য পুস্তক “ধৰ্মধবজ জাতক” প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ ইং সনে। এরপর ১৯৪৩ ইং সনের দিকে ”সত্য নারায়নের পাঁচালী” এরপর ”কর্মফল” প্রকাশিত হয়।
তিনি মিশ্রিত তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষায় রুত্তি বারমাস, আলস্যা মেলার কবিতা, বিয়াল্লিশর ভাতরাদ নামে তিনটি বারমাস ছাড়াও ‘চান্দোবী’ বারমাস নামে মূল পন্ডুলিপি রচনা করেছিলেন বলে তার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রী তরুণ চন্দ্রের নিকট শোনা যায়।
চাকমা রাজ ভূবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করে রাজসভায় তাঁকে সমাচীন করতেন।
তিনি সুচিকিৎসক হিসেবে মঘা শাস্ত্রে অভিজ্ঞ লোক ছিলেন। ভারত ও বার্মাও চিকিৎসায় তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
তিনি কবিরাজ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে আরও কতিপয় নাম করা তান্ত্রিক বা বৈদ্যের নাম উল্লেখ করার মত।
তন্মধ্যে নংফ বৈদ্য, তিতাকাজী বৈদ্য, শরৎ বৈদ্য, প্রভৃতি খুবই বিখ্যাত ছিলেন। তারা মারন, উচাটন, বশীকরন ও সম্মোহনী বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
এ ছাড়াও বৈদ্য হিসেবে কালাচান তঞ্চঙ্গ্যা, সিংহনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, রাঙ্যা তঞ্চঙ্গ্যা, মহেন্দ্র লাল তঞ্চঙ্গ্যা, লাল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও ভীমসেন তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
রাজ কবি পমশাধন তঞ্চঙ্গ্যার সমসাময়িককালে গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা নামে আরও একজন কবির নাম পাওয়া যায়। তিনি দৈন্যা গছার লোক ছিলেন বলে জানা যায়।
ক্যাঝুরী বারমাস, মুলি বারমাস, কলি যুগর বারমাস ও দ্বিমুখ্যা বারমাস নামে চারটি বারমাস তিনি রচনা করেছিলেন।
তঞ্চঙ্গ্যাদের শ্রেষ্ঠ বলি
শ্রেষ্ঠ বলিঃ তঞ্চঙ্গ্যা জাতির শ্রেষ্ঠ বলি ছিলেন লাল মুনি তঞ্চঙ্গ্যা। বৃটিশ সরকারের দশজন শক্তিশালী সৈনিকের সাথে তিনি এককভাবে দড়ি টানাটানি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে পুরস্কার লাভ করেন।
স্বনামধন্য কামিনী মোহন দেওয়ান কর্তৃক রাঙ্গামাটিতে এই আয়োজন করা হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট জানা যায়।
বলির মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির আরও একজনের নাম খাইত বলি। তিনি লাল মুনির আগে বলি নামে সুপরিচিত ছিলেন।
বলি মাত্রেই সাধারণতঃ অলস, গরীব ও শান্ত স্বভাবের হয়। তিনি একদিন জুমের টংঘরে রাখা পরের ধান ১৮ আড়ি (এক আড়ি = ১৬ সের অর্থাৎ ৭ মন ৮ সের) একাই বড় একটি পুক্যাসহ চুরি করে নিয়ে যান বলে কথিত আছে।
আলোকিত তঞ্চঙ্গ্যা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব চিত্রশিল্পী শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা
এই বরেণ্য চিত্রশিল্পী তাঁর একক প্রচেষ্টায় এবং অক্লান্ত এই বরণ পরিশ্রমের মাধ্যমে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে নিজ প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার গুণে রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তিনি বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। চিত্র শিল্প ক্ষেত্রে তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত জাতি গঠনে তাঁর অবদান অতুলনীয়।
গুণী চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর সৃজনশীল কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ইতিমধ্যে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে অনেক সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন।
সত্যিই তিনি একজন বিশ্বকর্মা। কীর্তিমান সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী চিত্রশিল্পীর মধ্যে তিনি অন্যতম এবং অগ্রগণ্য।
আলোকিত জাতি বিনির্মাণে অবদান রাখার জন্য জাতি তাঁকে চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। আমি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি এবং বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার জীবন ও মহকর্মের পরিচিতিঃ
জন্মঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ, ১৯৪১ইং রোজ শুক্রবার, দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ, পিতা: শিকল চান মহাজন, মাতা: তঙ্যাপরী তঞ্চঙ্গ্যা, স্ত্রী: হেনা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙামাটি সদর মহকুমা অন্তর্গত রাইংখ্যং নদীর পশ্চিম তীরবর্তী বিলাইছড়ি উপজেলা। ১২২নং কুতুবদিয়া মৌজার বড় পাড়া বড় রোয়া গ্রামে জন্ম।
পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকণিষ্ঠ।
উদ্বাস্থঃ ১৯৬০ইং কর্ণফুলি হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট (কাপ্তাই বাঁধ হয়) নির্মাণ হয়। ৫২ একর ১ম শ্রেণী ধানের জমিসহ অসংখ্য ঘর-বাড়ী পানিতে ডুবে যায়। ফলে বান্দরবান সদর মহকুমাধীন ৩৩৭নং বালাঘাটা মৌজায় পুনবসতি স্থাপন।
কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি প্রদর্শনী, উপলক্ষে বান্দরবানে একক চিত্র প্রদর্শনী ও পুরস্কৃত- ১৯৬৩ইং।
পত্নী বিয়োগ। আকস্মাৎ নেমে আসে কঠিন দুঃসময়- ১৯৬৮ইং।
চাকুরী- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর কার্যালয়ে জরিপ ও বন্দোবস্তী শাখার সরকারি আমিন- ১৯৬৯ইং।
চাকুরীকালে টাকা ঘুষ নেয়া কিংবা প্রলোভিত না করা ছিল প্রধান বিশেষত্ব। শত শত লোক ভূমি বন্দোবস্ত দিতে ৭/৮ বছর পার্বত্য জেলায় মফস্বল।
বাংলাদেশ পালি ও সংস্কৃতি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা অধীনে ত্রিপিটকের স সূত্রমধ্য ও সূত্র উপাধি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ- ১৯৭০ইং।
শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) কর্তৃক “বিশ্বকর্মা” প্রদান- ১৯৭৮ইং।
একক প্রচেষ্টায় ১৯৭৯ইং “রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী” প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যক্ষ। বলাবাহুল্য- ইহা তিন পার্বত্য জেলার সর্বপ্রথম চিত্রকলা বিষয়ক অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান।
ছাত্র-ছাত্রীরা চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় শতাধিক জাতীয় (ঢাকা), আন্তর্জাতিক ৩টি এবং ১টি জাতিসংঘের পুরস্কার লাভ করে কৃতিত্বে অগ্রগামী। স্থাপিত- ১৯৭৯ ইং।
বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে চিত্রকলায় অবদানের জন্য “সংবর্ধনা”। বঙ্গভবন, ঢাকা- ১লা জানুয়ারি, ১৯৮১ইং।
চারুকলা বিষয়ক পুস্তক “চিত্রা” প্রকাশনা- ১৯৮৬ইং।
সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন ও জেলার উচ্চ পর্যায়ে নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে চিত্রকলা এবং শিশু সংগঠক হিসেবে “সংবর্ধনা”- খাগড়াছড়ি- ১৯৮৮ইং।
চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় কর্তৃক চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য গুণীজন সংবর্ধনা”- ১৯৯০ইং।
“বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সমিতি” এর প্রথম সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” পুস্তক (মূল পাণ্ডুলিপি) বান্দরবান- ১৯৯৫ইং।
“তঞ্চঙ্গ্যা জাতি” ২য় সংখ্যা- ২০০০ইং।
তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গান “গীত পোই”- ২০০৪ইং।
”সদস্য”- জেলা পরিষদ, রাঙামাটি (নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার) ২০০৭ইং।
মোবাইল ফোন চালু। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডাঃ ফকরুদ্দীন আহমদ ও সরকারী পর্যায়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ সন্ত্রীক রাঙামাটি আগমন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল ফোন চালু করার জন্য প্রধান পত্নীর কাছে মৌখিকভাবে দাবী করা হলে তিনি সম্মত হন এবং প্রাতঃ বিশ দিনের মধ্যে মোবাইল ফোন পার্বত্য অঞ্চলে চালু করে দিয়ে দুরূহ কাজ সমাধা। যাদুঘর, রাঙামাটি। ফটো সহযোগিতায় সুপ্রিয় চাকমা, দৈনিক প্রথম আলো- ২৭শে মার্চ, ২০০৮ইং।
বিলাইছড়ি উপজেলাধীন ফারোয়া ভগা এলাকায় ইঁদুর বন্যায় ভীষম দর্ভিক্ষকালে নিজ হাতে ৪ লক্ষ টাকা ও ৫০০ শত কম্বল বিতরণ।
চিত্রকলা বিষয়ক পুস্তক “চারুকলা অনুশীলন”- ২০১১ইং।
জীবনী ও ‘আত্মচরিতাবলী” -২০১২ইং।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মনুগাঙ থেকে প্রকাশিত তঞ্চঙ্গে আনক্যে এক তোলোয়্যত্ বোজিবার ধারাজে “বিষু নিজেনি” সংকলনে রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা রচিত পুস্তক থেকে কিছু অংশ পুন: প্রকাশ- ২০১২ইং।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব ডঃ রণজিত কুমার বিশ্বাস কর্তৃক চিত্রকলা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে উচ্চ পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ক্ষুত্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, বান্দরবান- ২০১৫ইং।
শিল্পী ও লেখক হিসেবে ভারতের আসাম প্রদেশের গৌহাটি শহরে সংবর্ধনার জন্য আমন্ত্রণ- ২০১৪ইং।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার উচ্চ পর্যায়ে জেলা সরকারী ও বেসরকারী পদস্থ ব্যক্তির উপস্থিতিতে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী কর্তৃক চিত্রকলায় অভূতপূর্ব অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান। আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, রাঙামাটি- ২০১৬ইং।
তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গানের গীতিকার স্বীকৃতি। বাংলাদেশ বেতার, রাঙামাটি।
সরকারী/বেসরকারী/দাতা সংস্থার আর্থিক অনুদান ছাড়া বহু বাধার পর বাধা অতিক্রম এবং অভাবের মধ্যে পরিচালিত চারুকলা একাডেমীতে চিত্রকলা, সংগীত ও নৃত্য প্রশিক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি ব্যক্তিদের আগমনে রাঙামাটির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।
রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এ যাবত একাডেমীতে ১১ জন জেলা প্রশাসক এসেছিলেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, খুবই প্রশংসা লাভ করেছেন কিন্তু আর্থিক, উন্নতি ও সহায়তার অভাব ছিল।
১লা জুলাই ২০১১ বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা এর আয়োজনে দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে ৫ দিন ব্যাপী “চারুকলা প্রদর্শনী” অনুষ্ঠীত হয়। “রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী” ভবনে। এতে দেশের বিভিন্ন শিল্পী নাট্যব্যক্তিত্ব ছাড়াও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রদর্শনী উপলক্ষে চারশতের অধিক শিশুদের প্রতিযোগিতা হয়।
তিন পার্বত্য জেলায় সর্বপ্রথম চারুকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে । কিশোদের ৪০ বছর একটানা টিকে রাখা এই প্রতিষ্ঠানে চিত্রাংকন, সংগীত, নৃত্য চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী, দেশে-বিদেশে স শিক্ষা লাভ করছে।
”পূজনীয় ব্যক্তিকে পূজা করা, জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিকে সেবা করা, ও সম্মান করা উত্তম মঙ্গল।”
-তথাগত বুদ্ধ
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।