উপনিবেশিকতার জ্ঞান সৃষ্টি ও জাতিগত পরিচয় দানের রাজনীতি : পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে হুমায়ুন আজাদ পাঠ
959
সর্বপ্রথমে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমার এই নিদিষ্ট বিষয়ে কেন আগ্রহ তার ভূমিকা পাঠকের সুবিধার জন্য দেওয়া দরকার বলে মনে করছি ৷
হুমায়ুন আজাদের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম:সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা’ নামক ছোট্ট বইটি সম্ভবত অবশ্যপাঠ্য ও প্রিয় বই বিশেষত তাদের কাছে-যারা ব্লগ,
ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন- অফলাইন মাধ্যমে হিল ট্র্যাকসের পাহাড়ী/আদিবাসীদের (সরকার ও অনেক বাংগালীর মতে উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী)অধিকারের আন্দোলনের বিরুদ্ধে,
তাদের সমাজ কাঠামোর সমালোচনায় অন্যদিকে সেখানে বাংগালী বসতিকরণ- সেনাশাসনের পক্ষে লেখালেখি করে থাকেন ৷
যারা বাংলাদেশে একমাত্র বাংগালী জাতি ও বাংগালী জাতীয়তাবাদে(সেক্যুলার কিংবা মুসলিম বাংগালী জাতীয়তাবাদ) যে মতবাদে বিশ্বাস করেন না কেন হিলট্র্যাকস্ প্রসঙ্গ আলোচনায় তারাও হুমায়ুন আজাদের রেফারেন্স টানেন ৷
বইটি আমি পড়েছি অনেক বৎসর আগে, সুতরাং কি লেখা আছে সবগুলো মনে নেই ৷ তাই হন্য হয়ে খোঁজছিলাম আমার স্মৃতিকে একটু ঝালাই করার জন্য ৷
সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার সীমাহীন আগ্রহ কিভাবে দেশের অন্যতম প্রধান একজন প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধী লেখকের বই প্রতিক্রিয়াশীল লোকজনদের (অবশ্য এটা আমার একান্ত মন্তব্য ৷
আমাকেওতো কেউ কেউ এ ধরণের লেখার জন্য বলতে পারে অতি প্রতিক্রিয়াশীল একজন লোক!) প্রিয় হতে পারে ?
বইটি প্রগতিশীল অনেকেরও নিশ্চয় পছন্দের যদি তার স্বার্থ হিলট্র্যাকসে থাকে অথবা বইটি কারোর যদি হিলট্র্যাকস্ বিষয়ে পড়া প্রথম হয় এবং তিনি যদি ক্রিটিক্যাল না হন ৷
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বামপন্থি রাজনীতি করা যদি প্রগতিশীলতার অনেক সূচকের একটা সূচক হয় তাহলে একজন তুখোড় বামপন্থিকে চিনি
যিনি হুমায়ুন আজাদের হিল ট্র্যাকস্ সম্পর্কিত ঐ লেখা/বিশ্লষণকে হিল ট্র্যাকসের একজন অধিবাসী বাংগালী হিসেবে থাকার ও বিভিন্ন বই পড়ার অভিজ্ঞতায় সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করেন ৷
কিছু কারণে আমার পক্ষে হার্ডকপি বই সংগ্রহ করে পড়া দুষ্কর ৷ তাই ভরসা ইন্টারনেটে ফ্রি PDF বই খোঁজা, যদিও বিষয়টি আইনি ও নৈতিকতার পরিপন্থী ৷
অনেকদিন নেটে খোঁজাখোঁজির পর liberationwarbangladesh নামক ওয়েবসাইটে আমি আমার অতি কাংখিত বইটি পেলাম ৷
সেজন্য ঐ ওয়েবসাইটের জড়িত লোকদের অশেষ ধন্যবাদ ৷ যদিও এখানে আমার প্রশ্ন জেগেছিল, এখানে এই বইটি কেন? এটাতো কোন মুক্তিযুদ্ধের বই নয় ৷
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলার ভুখন্ডের এক অংশে জাতি ও তার সাথে জড়িত অধিকারবোধ নিয়ে প্রথমে সরকারের সাথে একদল জনগোষ্ঠীর বিরোধের সুত্রপাত,
পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যা মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা এখনো চলমান ও মীমাংসাহীন – তার উপর লেখা বই ৷
ও হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে একদল পাহাড়ীর অংশগ্রহন, অন্যদিকে কিছু এলিটদের বিরোধীতার সামান্য আলোচনা আছে হিল ট্র্যাকসের ঘটনাপঞ্জি হিসেবে ৷
কিন্তু তা অবশ্যই যথেষ্ঠ নয় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ই-লাইব্রেরী ধরণের সংগ্রহশালায় স্থান পেতে ৷ তাই অমুক্তিযুদ্ধের বই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় এমনি উদেশ্যবিহীনভাবে স্থান পাবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা ।
তবে এখানে আমার এই লেখার উদেশ্য কেন এই বইটি এই সংগ্রহশালায় এবং তার অন্তনির্হীত কার্যকারণ কি হতে পারে তার অনুসন্ধানে কোমর বেঁধে নামা নয় ৷
এখানে আমি হুমায়ুন আজাদের ঐ নির্দিষ্ট বইয়ের মধ্যে নিজেকে নিবিষ্ট রাখতে ও আমার অনাগত পাঠককে স্বাগত কিংবা ভাগত জানাতে চাই ৷
চলুন তাহলে মূল আলোচনার দিকে আগানো যাক ৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান হিংসার ঝর্ণাধারা –
বইটির প্রারম্ভিকায় হুমায়ুন আজাদের বক্তব্য এই রকম ‘ এই ছোটো বইটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার সমস্যা সম্পর্কে পাঠক পাবেন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচয়, যা উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে’ (আজাদ ১৯৯৭: ৯)৷
এই উক্তির মাধ্যমে লেখক আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর সৃষ্টিকর্মের সত্যতা কিংবা মূল্য সম্পর্কের ধারণা পাঠককে ধারণা দিতে চেয়েছেন ৷
এটা হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের একটা কৌশল বা প্রচারণা । যার প্রধান উদ্দেশ্য হতে পারে, এক; পাঠককে বইটিতে আকৃষ্ট করানো, দুই; লেখক যা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করেন তা তাঁর ভবিষ্যত পাঠককুলকে সুকৌশলে বিশ্বাস করানো- জাদু বিদ্যায় সম্মোহিত করানোর মতো ৷
আমার লেখার উদেশ্য হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগাম ও এর সমস্যা সম্পর্কে ছোট একটি বইয়ে দাবীকৃত ‘একটি পূণার্ঙ্গ পরিচয়’ কে অসম্পূর্ণ কিংবা উনার দাবিকৃত নিরপেক্ষতাকে পক্ষপাতমূলক লেখা – এই বলে সাব্যস্ত করে সমালোচনা করা নয় ।
সে দৃষ্টতাও আমার নে়ই। অন্যভাবে বললে, লেখাটির উদেশ্য হুমায়ুন আজাদের লেখা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ভুল বা সঠিক, বাস্তবতাবর্জিত কিংবা বাস্তবতা প্রতিফলিত-এগুলো দেখানো আমার আলোচনার প্রধান লক্ষ্য নয়।
আমার লক্ষ্য হচ্ছে তার ব্ই লেখার পিছনের পটভূমি ও লেখার পদ্ধতি, ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যে সময় সমাজ রাষ্ট্র জাতি শ্রেণীতে অবস্থান
তাঁর লেখায় সেগুলোর কোন প্রভাব আছে কিনা দেখা, পরিশেষে উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি থাকে তাহলে তার সৃষ্ট জ্ঞান কি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, কি উদেশ্য এর পিছনে থাকতে পারে তা খোঁজে দেখা ।
যেহেতু জাতিগতভাবে আমি একজন পাহাড়ী/ আদিবাসী, হিল ট্র্যাকসের চরম গোলযোগ সময়ে শৈশব পার করা একজন মানুষ-
সেহেতু আমাকে স্বীকার করতেই হবে হুমায়ুন আজাদের এই বইয়ের উপর আমার বিশ্লেষণ হবে হয়তো তাঁর নিজের দাবিকৃত নিরপেক্ষ বা অবজেক্টিভ লেখার বিপরীতে আমার জীবন অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধিতে জারিত সাবজেক্টিভ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ৷
আবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম, জাতিগত বিষয়ক এবং শক্তিমানের ক্ষমতাহীন জাতিগোষ্ঠীকে পরিচয় করানোর মধ্যে সুপ্ত রাজনীতি বিষয়ক কিছু পড়াশোনাও আমার পাথেয় হবে
এই যাত্রায় হুমায়ুন আজাদকে শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট বইয়ের উপর ভিত্তি করে জানার জন্য – তিনি আসলে কতটুক নিরপেক্ষ ছিলেন বা থাকতে পেরেছিলেন তাঁর নিজের বিশাল প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধী ভাবমূর্তির মধ্যে থেকে ।
দ্বিতীয়ত, মিশেল ফুকো নামক এক পন্ডিতের কোন বিষয়ের অধ্যায়ন বা বিশ্লেষণে ডিসকোর্স নামক পদ্ধতির ব্যবহারের আমার সামান্য পড়াশোনাকে আমি কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো ৷
ডিসকোর্স বলতে আমি এখানে কোন বিষয়ে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের উদেশ্য এবং এটার সাথে ক্ষমতার বা রাজনীতির কি সম্পর্ক থাকে তা বুঝাতে ব্যবহার করবো ৷
সাথে এডওয়ার্ড সাঈদ আরেক পন্ডিতের অরিয়েন্টালিজম (প্রাচ্যতত্ত্ব) নামক তত্ত্বের ব্যবহার ৷
ফয়েজ আলমের মতে, অরিয়েন্টালিজম হচ্ছে একটা লেখার-জ্ঞান চর্চার পদ্ধতি যেখানে পশ্চিমের লেখকরা নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে জ্ঞানের একটা কাঠামোর মধ্য থেকে প্রাচ্যকে নিয়ে গল্প উপন্যাস, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি লেখা বা প্রাচ্য সম্পর্কে অধ্যয়ন ও চর্চা করে থাকেন ৷
তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, ফুকোর ডিসকোর্স/জ্ঞানেরভাষ্য (জ্ঞানের উৎপত্তি), ব্যাখা ও ক্ষমতা তত্ত্বের ধারনা সাঈদকে সহায়তা করেছিলেন উপনিবেশের সাথে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভুমিকা খোঁজে দেখতে৷ তবে আলমের মতে,
অরিয়েন্টালিজম (প্রাচ্যতত্ত্ব) শুধু পূর্ব ও পশ্চিম এই সমীকরণে নয় বা ইউরোপিয়ান উপনিবেশের সময়কালে জ্ঞান চর্চার পদ্ধতিকে নয়,
এর পরবর্তী বিভিন্ন জায়গায় যেমন ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, ফিলিস্থিনে ইসরাইল, ভারত উপমহাদেশের দেশভাগের পরে পূর্বপাকিস্থানের প্রতি পশ্চিমপাকিস্থানের আচরন এরকম অনেক উদাহরনে প্রাচ্যতত্ত্বকে প্রয়োগ করা যায় ৷
সেই একই বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের পথ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি বাংলাদেশ তথা প্রান্তিকতার (peripheri) প্রতি কেন্দ্রের আচরনকে আমি হুমায়ুন আজাদের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ৷
বইটির তথ্যসংগ্রহ ও লেখার পটভূমি
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মধ্য থেকেও হুমায়ুন আজাদের কাছে দূর দ্বীপবাসিনীর মতো, যার রূপের বয়ান সে শুনেছে তৃতীয় কারোর মাধ্যমে,
তৃষ্ণার্ত হয়েছে তাকে দেখার কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী গন্ডগোল তাঁর ইচ্ছায় সেধেঁছে বাঁধ ৷ বিপরীত দিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম তাঁর কাছে কোন প্রেতপুরির গল্পও, যেটা দেশের মধ্য থেকেও ভয়ংকর নিষিদ্ধ এক অঞ্চল ।
সেখানে সেনাবাহিনী দেশের অন্য অংশের জনগণের জন্য অদৃশ্য এক দেওয়াল তুলে রেখেছে ৷
তাই মাঝেমধ্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে তিনি শুনেন- সেখানে তাঁর প্রিয় কিন্তু দুই জেনারেল ( জিয়া ও এরশাদ) এর দ্বারা কলংকিত হওয়া সেনাবাহিনীর কাহিনী
এবং তাদের সহযোগী পূর্ণবাসিত বাংগালীরা পাকিস্থানী কায়দায় ন্যাকারজনক নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ৷ এবং বিশ্বাসও করেছেন ঐ গল্প তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই।
গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য কারণ তখনো মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি জাগরুগ ।
এবং বাংলাদেশে দুই জেনারেলের আমলে সামরিক শাসনের কর্মকান্ডও মানুষকে ঐ গল্গে বিশ্বাস করাতে সহায়তা করেছে (আজাদ, ১৯৯৭:২৮-২৯) ৷
এই ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের পূর্বে ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের মূল্যায়ন ।
যে বইটি নিয়ে আমার আলোচলা, এটি হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর প্রথম লেখা নয় ।
তারও প্রায় একদশক আগে ‘রক্তাক্ত বিপন্ন পাহাড়’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর লেখকের ভাষায় ‘আবেগতাড়িত’ এক প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ নামে এক পত্রিকায় (পরে প্রবন্ধটি ‘নিবীড় নীলিমা’ বইয়ে সংযোজিত হয়)।
আশির দশকের শেষান্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর আবেগঘন লেখায় যা তিনি লিখেছিলেন, তা ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের অধিকারের পক্ষে ৷
তাই এই বইটি লেখার উদেশ্য হচ্ছে তাঁর পূর্ববতী খন্ডিত ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রবন্ধের বিপরীতে সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ লেখা বা বয়ান দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা ৷ অর্থাৎ তাঁর পূর্ববতী লেখাকে সংশোধনের প্রয়াস (আজাদ, ১৯৯৭:৯) ৷
প্রথমটাতে, প্রবন্ধে, লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন বিপ্লব চাকমা নামে এক পার্বত্যবাসীর দ্বারা ।
দ্বিতীয়টার,বই, লেখার উৎস সরকার ও সেনাবাহিনীর আমন্ত্রনে, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ও জিপে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখা ও জানা ।
সময়কাল ৯-১১ জুন ১৯৯৭ সাল অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তির (২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ ) সামান্য কয়েকমাস পূর্বে ভ্রমন ।
তবে সেনাবাহিনীর আয়োজনে ঐ সফরটি পার্বত্য চট্টগ্রামে হুমায়ুন আজাদের প্রথম পদার্পন নয় ।
তারও আগে তিন দশকের বেশি সময়ের পূর্বে তিনি গিয়েছিলেন সেখানে কিন্তু প্রকৃতির বা বৃষ্টি বাধসাধার কারনে চারদিন অবস্থানের পরেও লেখকের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু না দেখা ও জানা হয়নি ৷
তাই সরকার বা সেনাবাহিনীর আয়োজনে ঐ সফরটি ছিলো তাঁর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, একই সাথে সেখানকার মানুষ ও তিন দশকের বেশি জাতিগত সমস্যার অভিজ্ঞতা লাভের প্রথম সুযোগ (আজাদ ১৯৯৭: ৪০)৷
আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ পড়ে জানা যায়, সে সফরে ঢাকার বুদ্ধিজীবিরা দুইভাগে গিয়েছিলেন ।
একগ্রূপে ছিলেন আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, সিরাজুল ইসলাম সহ আরো কয়েকজন ।
তাঁদের যাত্রাপথ ছিল ঢাকা থেকে চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট, সেখান থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে হিলট্র্যাকসের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন ।
তবে সম্ভবত জেলাসদরে অবস্থান ও ঘুরাঘুরিতে সেনাবাহিনীর জিপই তাঁদের একমাত্র ভরসা ছিলো ।
আনিসুজ্জামানের বয়ানে জানা যায় যে-‘রাঙ্গামাটিতে (প্রশান্ত ত্রিপুরার মতে জায়গাটি হবে খাগড়াছড়ি, কারণ রাঙ্গামাটিতে রিক্সা চলেনা) আমি সামরিক বাহিনীর জিপে করে চলেছি ,
দেখি উল্টোদিক থেকে রিক্সায় আসছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক; আমার বিশেষ স্নেহভাজন প্রশান্ত ত্রিপুরা ৷ আমি জিপ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম ৷
একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে বললো ‘আপনি, সার !’ আমার মনে হলো জুলিয়াস নাটকে ব্রুটাসের ছুরিকাঘাতে আহত সিজারের উক্তি, তুমি ব্রুটাস, যেন আবার ধ্বনিত হলো ৷
প্রশান্তকে বললাম , ‘সার্কিট হাউজে আছি ৷ সন্ধ্যার পর এসো ৷ অনেক কথা আছে ৷
সামরিক বাহিনীর জিপে আমাকে দেখার পর হয়তো তার আর আমার কাছে আসতে ইচ্ছে হয়নি (আনিসুজ্জামান ২০১৫ :৫০১)৷
‘ তাই বলা যায় হুমায়ুন আজাদের বইটি লেখার তথ্যউপাত্ত মূলত: সেনাবাহিনীর দেওয়া; সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার-জিপে করে সেনাবাহিনীর চোখেই তিনি পার্বত্য দেখেছেন।
উপজাতির রূপকল্প : কবির নাকি বাঙ্গালী জাতির কল্পনা?
‘রক্তাক্ত বিপন্ন পাহাড়’ নামক পাহাড়ীদের স্বপক্ষে লেখা প্রবন্ধে, হুমায়ন আজাদ লিখেছেন ‘ওই অঞ্চলের কথা ভাবলেই দেখতে পাই পাহাড়, বাঁশঝাড়, শাল-কড়ই-কমলালেবুর বন,
বক্ষবাসহীন শুভ্রতরুণী, সরল শান্ত পুরুষ, নৃত্যগীত আর উৎসবে মদ্যপানের উল্লাস'(আজাদ ২০১০:৭৮)৷
কবি মনের কল্পনায় তিনি দেখেছেন- দেশের মধ্যে ‘আধুনিক সভ্যতা’ উপেক্ষা করে তাঁর ভাষায় উপজাতিরা ‘আদিমতা’য় চমৎকার জীবিনযাপন করে ৷
তাই বর্বর আধুনিকতার মুখোশে ক্লান্ত লেখকের মন সেই রোমান্টিক আদিম নৈসর্গিক জীবনের জন্য, তাকে ছুয়ে দেখার জন্য কি কাতর!
কবির কল্পনার কোন সীমা নেই, থাকা উচিতও নয় ৷ কিন্তু কোন সমাজ ব্যবস্থার কোন ছবি তিনি যদি আঁকেন তা হওয়া উচিত বাস্তবতার যতদূর কাছাকাছি ৷
তবে লেখকের মতে, এখানে তিনি খটখটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন বই তিনি লিখতে চাননি ৷ তিনি যা লিখেছেন তা হচ্ছে রাজনীতি আর সাহিত্যের মিশ্রন – রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহিত্য ৷
যেখানে তিনি নিজেই চালক তাঁর কল্পনার ঘোড়ার ৷ তাই পাহাড়ী নামক পুরো একটা জনগোষ্ঠী কবির রোমান্টিক কল্পনায় বর্তমান থেকে শব্দে –
কাব্যের ব্যঞ্জনায় সুদূর অতীত কিংবা পুরোপুরি কল্পনার জগতে রোমান্টিকতার হাহাকারে মূর্তমান হয়ে ওঠে ৷ অতীত ও বর্তমান, বাস্তব আর কল্পনা এখানে মিলেমিশে একাকার ৷
একইভাবে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা ‘ বইটিতে তিনি লিখছেন যে-
‘ক্যাম্পের শীর্ষে উঠে তাকালে সৌন্দর্যে বিবশ হয়ে আসে রক্তমাংস; প্রেমিক- প্রেমিকরা যেখানে উঠলে এক আলিঙ্গনেই এক ঋতু কাটিয়ে দিতে পারবে; …’ ।
কিন্তু আফসোস তাঁর – ‘ওই পাহাড়ে নেই কোন প্রেমিক প্রেমিকা, তারা সেখানে কখনো যেতে পারবে না ; – সীমানা পাড়া, সাজেক, ঘনমোড়, তানখইতং, সুবলং, বিলাইছড়ি, থানচির মতো অসাধারন দুর্গম সুন্দর স্বর্গে কোন প্রেমিক প্রেমিকা নেই,
আছে নিঃসঙ্গ তরুণেরা, যারা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে (আজাদ ১৯৯৭: ৩১)’৷ শেষ লাইনে কবি যেন তাঁর শব্দ-বাক্য–উপমা-উৎপ্রেক্ষায় রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষদের কথায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ৷
প্রশ্নজাগে কারা এই নিঃসঙ্গ তরুণদের দল ? এই উত্তরের পূর্বে চলুন আরো কিছু জিজ্ঞাসার ফয়সালা করি ৷ এই সব পাহাড় কি আসলেই জনবিরলহীন কোন দ্বীপ ?
পাহাড়ে বসত জাতিগোষ্ঠীতে কি কোন তরুন তরুনী নেই ? তাদের ভালবাসার মতো কোন মানবিক অনুভূতি নেই, গান নেই গল্প নেই হৃদয়ের ভাব আদান প্রদানে ?
ত্রিপুরাদের পুন্দা- লালমতি, চাকমাদের রাধামন -ধনপুদি সহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রেমের গল্পগুলো তিনি শুনেছেন কিনা জানিনা ৷ পাহাড়ে প্রতিটি শিশুই কি তাহলে ভালবাসাহীন মৈথুনে জন্মায় ?
নাহ লেখক এখানে তা বলতে চাননি ৷ তাঁর হৃদয়জুড়ে আসলে নিঃসঙ্গ আধুনিক যক্ষদের বেদনায় কাতর ৷
সে বেদনার হাহাকারের মেঘে ঢেকে যায় ঐখানকার অধিবাসী পাহাড়ী তরুণ তরুণীদের প্রেমবিরহের গল্প ও গান ৷
লেখকের কালবৈশাখীর ন্যায় দুর্বার আবেগের মেঘে ক্যাম্পের আশেপাশের সব জনপদ, ঐ জনপদে মানুষের দুঃখেবদনার গল্প হারিয়ে যায় কবির কল্পনা থেকে –তাঁর হৃদয়জুড়ে রয়ে যায় শুধু সৌন্দর্য লীলাভূমিতে নিঃসঙ্গ তরুনদের গল্প ৷
কারা সে তরুনদের দল ? এর পরবর্তী লাইনে মনোযোগ সহকারে পড়লে এর উত্তর পাওয়া যায় ।
হুমায়ুন আজাদের নির্বাসিত যক্ষরা – ‘সুদর্শন ও মেধাবী – ইংরেজি বলতেই তারা বেশি অভ্যস্ত, এটাই তাদের বিছিন্ন করে রাখে দেশবাসী থেকে ; আর সৈনিকেরা দক্ষ ৷
ক্যাম্পগুলোতে তাদের দুটিই প্রধান শত্রু : নি:সঙ্গতা ও মশা, শান্তিবাহিনী তাদের গৌণ শত্রু (আজাদ ১৯৯৭: ৩১) ৷’ প্রশ্ন হতে এটা কি শুধু কবির কল্পনা, নাকি তিনি যে সমাজ- জাতি -শ্রেণির প্রতিনিধি তার প্রতিচ্ছবি ?
আমার মনে হয়, দ্বিতীয়টি ৷ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তার রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজের পরমপরস্পরা যে লিখিত বা অলিখিত অর্জিত জ্ঞান আছে তিনি তার উপর ভিত্তি করে বইটি লিখেছেন ৷ তিনি সে জ্ঞানের চর্চা করেছেন মাত্র ৷
এভাবে দূর অতীত বা অস্তিত্বহীন কোন সময় বা সমাজকে বর্তমানের কোন সমাজের উপর আরোপ করেন ৷ সাঈদের প্রাচ্যবিদরা প্রাচ্য সম্পর্কে যে ছবি আঁকেন এই ছবি কি খুববেশি তফাত ?
প্রাচ্যতত্ত্ব ও হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদের মতে-
‘বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সমগ্র জনগনের মতোই পাহাড়ী জনগনকে আধুনিক গনতান্ত্রিক অধিকার সম্পন্ন স্বচ্ছল ও শিক্ষিত মানুষে পরিনত করা ; এবং তাদের দ্রুত সার্বিক উন্নতি সাধন ৷
তাদের আদিম সমাজ কাঠামোর মধ্যে সাধারন মানুষদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই; তাই ঐ সামন্ত সমাজ কাঠামো ভাঙ্গা দরকার (আজাদ ১৯৯৭: ৯)” ৷
পড়ে দেখলেই বুঝা যায় লেখক নিজেকে কোন জাতির -রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী (‘নিজ’ বাঙ্গালি জাতি) হিসেবে নিজকে শ্রেষ্ঠ-সভ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ‘অপর’ পাহাড়িদের তুলনায় ।
তাই নিজের দায়িত্বে ঠিক করতে চান পাহাড়িদের ভালোমন্দের ভবিষ্যত ! এখানে প্রাচ্যতত্ত্বের আলোচনা টানা যায় ।
প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের বিখ্যাত রচনাগুলি ঘেটে সাঈদ দেখান ওগুলোয় প্রাচ্য বরাবরই নিকৃষ্ট, অযোগ্য ও অসভ্য চিহ্নিত হয়েছে ; তার বিপরীতে পশ্চিম সবসময় উৎকৃষ্ট, সভ্য, যোগ্য ও সক্ষম ৷
এই শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টতার বোধ প্রাচ্যতত্ত্বের সৃষ্টি ৷ এই বোধ এক পর্যায়ে পশ্চিমের রাজনীতিবিদ, পর্যটক, সৈনিক, ব্যবসায়ী , লেখক – শিল্পীদের প্ররোচিত করেছে প্রাচ্যকে কব্জা করতে ৷
এই জ্ঞানের পরস্পরা একটি নিদিষ্ট মনোভাব থেকে সৃষ্ট ৷ এর মধ্য রয়েছে অপরের প্রতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার আকাংখা ৷ তাই প্রশ্ন এই ধরনের জ্ঞান কিভাবে নিরীহ নির্দোষ হয়(ফয়েজ ২০০৮ :১৩) ?
নিরপেক্ষতার ও পরিপূর্ণতার ব্যাপারতো পরে ৷ হুমায়ুন আজাদও প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের প্রতিনিধি মাত্র ।
অধিকন্তু তিনি উল্লেখ করেছেন-
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা স্বাধীনতা বা শ্বায়ত্বশাসনের সমস্যা নয় , প্রধান সমস্যা হচ্ছে ওই অঞ্চলের সামন্ত প্রভুরা সাধারন মানুষদের বিকশিত হতে দেয়নি, তাঁদেরকে দাসে পরিনত করে রেখেছে ১৯০০ সালের বিধিমালা দিয়ে (আজাদ ১৯৯৭: ৯-১০)৷ ‘
পড়ার পর কোন পাঠকের – যার পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই কিন্তু ব্রিটিশ সামন্ত প্রভু বা জমিদারকে সম্পর্কে যার ন্যুনতম ধারনা আছে- মনে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেই সামন্ত প্রভুদের কথায় সব’- এই জাতীয় শাসন চলছে সেখানে ৷
লেখক এভাবে দূর অতীত বা অস্তিত্বহীন কোন সময় বা সমাজকে বর্তমানের কোন সমাজের উপর আরোপ করেছেন ৷
স্বাধীনতা ও শ্বায়ত্বশাসনকেও একপাল্লায় ‘বা’ দিয়ে ব্যবহার করেছেন যেন এগুলো সমার্থক শব্দ ৷
কেন লেখককে পাহাড়ী সমাজ ব্যবস্থাকে দূর অতীতের কোন নিষ্ঠূর সামন্তীয় প্রথায় নিয়ে যেতে হয়েছলো, এই বয়ানের পিছনের কি রাজনীতি নিহিত – তা নিচের বাক্যে পরিস্কার অনুধাবন করা যায় ।
তাঁর যুক্তি- ‘পাহাড়ীরা তাঁদের দাবিগুলোকে গৃহীত ও বাঙলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চান, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী (আজাদ ১৯৯৭:৭)৷’
উপরোক্ত লেখায় বুঝা যায় হুমায়ুন আজাদের নিজস্ব অবস্থান, পাহাড়ীদের আন্দোলনের প্রতি তার সুস্পষ্ট বিপরীত অবস্থান ও তাকে সংবিধানের দোহাই দেওয়ার রাজনীতি ৷
একজন লেখক যিনি ধর্মীয় গ্রন্থের মতো সাধারণ্যে ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে মানব রচিত কোন সংবিধানের ভুলত্রুটি থাকলে তা সংশোধনের সমস্যা কোথায় ?
সংবিধান কি কোন ঈশ্বরের প্রেরিত বাণী যা অপরিবর্তনীয় ? সংবিধানে কোন নীতি-বিধি-ভাষায় যদি জাতিগত কোন বৈষম্য থাকে,
কোন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার যদি তার দেশের সংবিধানের exclude হয়ে থাকে তাহলে পরিবর্তন পরিমার্জনের মাধ্যমে সমতার একটা ব্যবস্থা করা যায় ৷
সংবিধানের প্রতি লেখকের অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তি কি ? এটা কি তাঁর হৃদয়ে লালিত্য ও সুপ্ত অন্ধ জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ ?
পাশের দেশ ভারত, দুরের দেশ সুইজারল্যান্ড, কানাডা এইরকম অনেক দেশে জাতিগত রাজনৈতিক বিরোধ বিভিন্ন রকম ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন বা স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে সমাধান করা হয় ৷
যদি তিনি মানব লিখিত সংবিধানকে এমনই অপরিবর্তনীয় ভেবে থাকেন তাহলে এটা কিভাবে তার প্রগতিশীলতা ও প্রথাবিরোধীতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় ৷ নাকি তিনি মেজরিটি মানুষের অর্থাৎ বাংগালী জনগোষ্ঠী চাওয়া ও স্বপ্নের প্রতি আস্থাশীল ?
যেটা কখনো আক্ষরিক কখনোবা বিকৃত গনতন্ত্রের উদাহরন হতে পারে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে শোষন ও অধিকার বঞ্চিত করার অভিপ্রায় থাকে৷
এটাকে হয়তোবা ইংরেজিতে বলে tyranny of majority বা সংখ্যাগুরুর স্বৈরশাসন ৷ এটা শুরু হয়েছিলো বাংলাদেশের সংবিধানে একমাত্র বাংলাভাষা, জাতি, বাংগালীর ইতিহাস ঐহিত্যকে স্বীকৃতির মাধ্যমে ৷
মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ ও তিক্ষিকার ফল হিসেবে প্রাপ্ত রাষ্ট্রে অন্য জাতিগোষ্ঠীকে একদিকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে অন্যদিকে তাদের ভিন্নতাকে হেয় ভেবে আহ্বান জনানো হয়েছে বাংগালীতে আত্তীকরন কিংবা মিশে যাওয়ার জন্য ৷
আলোচনা ও উপসংহার
হুমায়ন আজাদের এই লেখা হচ্ছে সেই ঐহিত্যবাহি প্রাচ্যতাত্ত্বকদের পথ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জ্ঞানের উৎপাদন ৷
একটা বিশেষ উদেশ্যে, অথবা একটা বিষয়ে পূর্ব ধারনাগত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে লেখা ৷ এটা হচ্ছে কোন বিশেষ বিষয়ে ”লঘু চিত্তের কল্পনা নয়, বরং তত্ত্ব ও চর্চার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি কাঠামো যার পেছনে রয়েছে প্রজন্মক্রমিক প্রচুর বিনিয়োগ (ফয়েজ ২০০৮:২০৫)৷
” এই বিনিয়োগ হচ্ছে কোন ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোন উপাদান যেমন সেনাবাহিনী ও তার বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের অর্থ- সময়-শ্রম -মেধার ইত্যাদির বিনিয়োগ ৷
কেউ যদি বান্দরবান যান, তাহলে দেখবেন চিটাগাং থেকে বান্দরবানের শহরে প্রবেশের রাস্তা মোড়ে, বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের সামনের ব্রীজে ,
চিম্বুকসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে যাওয়ার মোড়ে জোড়ায় জোড়ায় সুদৃশ্য পাহাড়ী / আদিবাসি ও বাংগালীর নারীপুরুষের ছবি টাঙ্গানো ,
প্রতিটি সাইনবোর্ড নীচে কোন জাতি বা উপজাতি ( বাংগালীদের ক্ষেত্রে জাতি , পাহাড়ীদের ক্ষেত্রে ঊপজাতি ) আর্মিদের বয়ানে একটা জাতিগত পরিচয় দেওয়ার উদাহরণ দেখতে পাবেন ৷
এভাবে অর্থ, জ্ঞান বা প্রদর্শনের বিনিয়োগের উদেশ্য কি নেহাত দেশের কোন জাতি/উপজাতি গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরা নাকি বিশেষ রাজনৈতিক উদেশ্য নিজেদের মতো করে ‘অন্য’ দের উপস্থাপন?
যার উদেশ্য প্রচারে প্রসার লাভ ও মিথ্যাকে সত্য পরিনত করার মিশন ৷ তিনি লিখেছেন যে, সরকার ও সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রণে আরো অনেক বুদ্ধিজীবির সমভিব্যাহারে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন ৷
‘সেনাশাসন থাকলে আমি এই আমন্ত্রণ অবহেলা করতাম (আজাদ, ১৯৯৭:৮) ”- অভিমত তাঁর ৷ কারন দেশে তখন তাঁর গণতান্ত্রিক সরকার ।
তবে তিনি যদি খোঁজ নিতেন তাঁর সফরকালেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন ছিলো; অপারেশন দাবানল ।
এখনো চলে অপারেশন উত্তরণ নামে । তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখন ছিলো ? নাকি তা ‘দেশ’ নামক শব্দের কোন বাহ্যিক বা মানস চিত্রে স্থান পায়না ?
ও হ্যাঁ,হুমায়ন আজাদ পার্বত্য চট্টগ্রামকে খোলে দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানিয়ছেন ৷
তাঁর মতে, এই ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ বানিয়ে রাখা সেনাবাহিনীর ইমেজই ক্ষতি করেছে বেশি -”শক্তিমান মাত্রই খলনায়ক, আর বিদ্রোহীরা পায় সব সহানুভতি, যদিও নৃশংসতায় তারাও অতুলনীয় ৷
শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতেছে সেনাবাহিনী, এবং হেরেছে প্রচারে .. (আজাদ, ১৯৯৭:৩০)” সে জন্য এই খোলে দেওয়ার যুক্তি ৷
অথার্ৎ সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, দেশি -বিদেশি গবেষক, মানবাধিকার কর্মী সবার সেনা নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ চলাচলের বাধার কথায় নিশ্চয় তিনি বুঝিয়েছেন ৷
এখানেই প্রশ্ন – তাহলে সরকার ও সেনাবাহিনী কেন এখনো সবার অবাধ চলাচলে প্রচন্ড ভয় পায়, কেন পার্বত্য অঞ্চলের বাইরের স্বাধীন গবেষক,
সাংবাদিক ও বিদেশীদের জন্য হিলট্র্যাকসকে নো এন্ট্রি জোন টাইপের করে রাখা হয় ? হুমায়ন আজাদ জীবিতকালে নিশ্চয় এই বিষয়গুলো দেখেছেন, বেঁচে থাকলে দেখতেন এবং চিন্তা করতেন তাঁর কথার প্যারাডক্সটা কোথায় ৷
সবোর্পরি, এই বই আমাদের সামনে হুমায়ুন আজাদের অন্ধ জাতিয়তাবাদ, জাতিত্যভিমান ও কলোনাইজেশনের অন্যতম এক উদাহরণ যেন উন্মোচন করে ।
তার সাথে বিভিন্ন আর্মি অফিসারের ইত্তেফাক, নয়াদিগন্ত, ইনকেলাব, দৈনিক পূর্বকোণসহ হাজারো অনলাইন পত্রিকায় একই দিনে প্রকাশিত হওয়া একই কলামের ভাষা ও তথ্যে খুব বেশি ফারাক নাই ৷
ভাবতে অবাক লাগে, একজন সংবেদনশীল লেখক কিভাবে কোন জনগোষ্ঠীর জন্য অপমান সূচক শব্দকে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন (‘উপজাতি’ শব্দে তিনি জানেন পাহাড়ীরা আহত বোধ করেন তবু তিনি তাদের জন্য ‘উপজাতি’ শব্দই বরাদ্দ করেছেন )
এবং কিভাবে নিজেকে উন্নত ও সভ্য জাতির আসনে নিজেকে বসিয়ে অন্যদের শাসন – খবরদারি ফলাতে চান ৷ এর উত্তর হচ্ছে প্রাচ্যতত্ত্বে ।
সাঈদের মতে – ‘উপনিবেশী আগ্রাসনের সাথে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ও জ্ঞান চর্চার নিবিড় সম্পর্ক ৷
বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা ও জ্ঞান চর্চা পশ্চিমাদের মনে প্রাচ্যকে নিকৃষ্টরূপে দেখায় ৷ প্রাচ্যকে কব্জা করতে ও বশ করতে প্ররোচনা যোগায় ৷
তাই সাঈদের মতে প্রাচ্যতত্ত্ব বা বিশেষ উদেশ্যে প্রাচ্যকে নিয়ে পশ্চিমাদের লেখা প্রাচ্যতত্ত্ব বা অরিয়েন্টালিজম হচ্ছে – জ্ঞান ও ক্ষমতার শয়তানী জোটের সবচেয়ে বড় নমূনা –
এই জন্য যে, এটা উপনিবেশকতা (colonialism), উপনিবেশিক শাসকদের কাজ ( colonial rulers ) কাজকে বৈধতা দানের জন্য একধরণের বর্ম হিসেবে কাজ করে’ (ফয়েজ ২০০৮: ১২)।
হুমায়ুন আজাদ হচ্ছেন সে ‘বক্তা মার্লো’ যিনি মুখে ‘মুখে সামাজ্র্যবাদের বিরোধিতা করে কিন্তু তার মনোভাব যুক্তির জাল বুনে আফ্রিকার স্বশাসনের বিরূদ্ধে (ফয়েজ ২০০৮:১৮) ৷
শেষান্তে, হুমায়ুন আজাদ যে জ্ঞানকাঠামো- মনোভঙ্গির উপর হিল ট্র্যাকস সম্পর্কে লিখেছেন তা আসলেই প্রাচ্যতত্ত্বেরই চর্চা ।
আমি মহামতি সাঈদের অরিয়েন্টালিজম তত্ত্ব মাথায় রেখে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে এই ধরনের জ্ঞান চর্চাকে বলবো ‘ট্রাইবালিজম’ আর যাঁরা এর চর্চা করেন তারা হচ্ছেন ‘ট্রাইবালিস্ট’ ৷
আমি মনে করি সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্বের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান শুধু পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের সম্পর্কের অধ্যয়নে নয়,
প্রাচ্যের মধ্যে একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একই গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োগ করা যায় ৷
দেখানো যায় ক্ষমতাসীন সরকার/ জনগোষ্ঠী কিভাবে একই উপনিবেশিক কায়দায় শাসন ও শোষন করে, তার জন্য সুপরিকল্পিত জ্ঞান সৃষ্টি ও তার প্রসারে সচেষ্ট হয় ৷
উদেশ্য- শাসন শোষণকে বৈধতা দেওয়া, শোষিতের কন্ঠরোধ ও শোষণের বিভিন্ন উপায় বের করা ৷
অরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে যেমন মিশনারী, পর্যটক, সৈনিক, সরকারি কর্মকতা, একাডেমিশিয়ান সহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন আছে , ট্রাইবালিস্টদের মধ্যেও তার ব্যতিক্রম নাই ৷
হুমায়ুন আজাদ তাদেরই একজন এবং অবশ্যই অতি উজ্জ্বলতম । এবং এই বইটি কেন উগ্র সাম্প্রদায়িক লোকদের এতো প্রিয় ?
এর উত্তর- হুমায়ুন আজাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি বা ব্র্যান্ড ৷ তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধীতার অন্যতম প্রতিভূ ৷
যার উক্তি বা লেখা অধিকাংশ প্রগতিশীল লোকেরা সত্য হিসেবে ধরে নেয় ৷ তাই যারা বাংলাদেশের উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন,
হিলট্র্যাকসের সরকার বা সেনাবাহিনীর ধমননীতিতে বিশ্বাস করেন, সেখানে সরকার ও সেনাবাহিনীর সুপরিকল্পিত উদেশ্যে বাংগালী পূর্নবাসনের নীতিতে বিভিন্ন যুত্তি তর্ক ও
তথ্যে জায়েজ করার চেষ্টা করেন হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্বাসের দিক দিয়ে বিপরীত মেরুতে থাকলেও শুধুমাত্র এই নিদিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তাঁর সর্বশেষ লেখা বই তাদের চিন্তাধারনাকে সাপোর্ট করেন ৷
এখানেই সেই রহস্যের উত্তর ৷ এটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরো দেখায় যে, প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধীতা এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হওয়া, উপনৈবিশক কায়দাকানুনকে সাপোর্ট করার মতো বৈপরীত্য লক্ষণও একসাথে সহাবস্থান করতে পারে ।
এবং সবচে বড়ো দূর্ভাগ্য যে, হুমায়ুন আজাদের সামনে কোন ‘প্রশান্ত’ ছিলোনা, যা আনিসুজ্জামানের ছিলো ; যা আনিসুজ্জামান কে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিলেন -আমি ব্রুটাস নাতো ?
তাই একই সফরে গিয়েও, একই যানবাহনে একই দৃশ্য দেখেও এবং একই ধরণের হিল ট্র্যাকস সম্পর্কে ব্রিফিং পেয়েও (আমার অনুমান) আনিসুজ্জামানের উপলব্ধি নিন্মরূপ-
‘নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের আদিবাসী বলার বিষয়ে আমাদের দেশে মতভেদ আছে, কে কে কখন দেশের কোন খন্ডে প্রবেশ করেছে, তা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে, আদম –
হাওয়াও পৃথিবীতে এসেছেন স্বর্গোদ্যান থেকে, আদিবাসী অর্থে কেবল বসতিস্থাপনের সন তারিখ বুঝায় না, তাদের কতকগুলি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে জোর দেওয়া হয় তার উপরে৷
আমরা পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালির স্বাধিকারের দাবি করেছি, তাদের পক্ষে যে দেশবাসীর যে অংশ বাঙ্গালী নয় তাদের নিজস্ব অধিকারের পক্ষালম্বন করা অবশ্যকর্তব্য ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রক্তপাত ঘটেছে, তা ঘটা উচিত ছিলোনা ৷
আশাকরি, আমরা এতদিনে বুঝতে পেরেছি যে, রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান কোথাও হয়নি, হতে পারেনা ৷
অতএব, আমাদের যে সমস্যা তার সমাধান খুঁজতে হবে সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে (আনিসুজ্জামান ২০১৫: ৪৯৮-৪৯৯ )’ ৷
(বি:দ্র:-এটি হিল ট্র্যাকসের উপর রচিত হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধ ও বইয়ের উপর ভিত্তি করে। এটার সাথে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম ও ব্যক্তিত্বকে মেলানো নিশ্চয় ঠিক হবেনা)
তথ্যসুত্র:
আজাদ,হুমায়ুন ১৯৯৭পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ৷
আজাদ, হুমায়ুন ২০১০,নিবিড় নীলিমা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ৷
আনিসুজ্জামান ২০১৫, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ৷
আলম, ফয়েজ ২০০৮, এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের নির্বাচিত রচনা,সংবেদ প্রকাশনা, ঢাকা ৷
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।