একটি মাঠ, দুইটি গোলক ও একটি গোলকধাঁধা – আদিবাসী দিবসের ভাবনা
640
আদিবাসী দিবসের ভাবনা*
মাঠ
যে মাঠের কথা বলছি, তার অস্তিত্ব এখন মূলত স্মৃতিতেই। আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশ কেটেছে সেই মাঠে।
তরুণ বয়সেও বিভিন্ন অবকাশে প্রিয়জনদের সাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছি সেখানে। আমি বলছি খাগড়াছড়ির যে গ্রামে আমার জন্ম, সেই খাগড়াপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া মাঠের কথা। আমার স্মৃতিতে অক্ষয় থাকা এই মাঠে একসময় পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলত নিয়মিত।
আমি নিজেও খেলেছি অসংখ্যবার। কিন্তু এখন সেখানে ফুটবল খেলার সুযোগ আর নেই। কারণ মাঠটা অক্ষত নেই আর।
ওটার এক পাশে আছে প্রয়াত বাবা-মাসহ গ্রামবাসীদের উদ্যোগে শুরু করা একটা প্রাইমারি স্কুল –
যেখানে আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল – যেটি সরকারি হওয়ার পর এর দ্বিতল ভবনের চৌহদ্দির মধ্যে চলে যায় মাঠের একটা অংশ,
যেখানটায় গাছের ডাল বা বাঁশ দিয়ে বানানো গোলপোস্টে আমরা অনেকেই অনেক গোল দিয়েছি।
স্কুলের পাশে একটা ক্লাবঘর ও একটা কমিউনিটি সেন্টারও এখন মাঠের বেশ কিছু জায়গা নিয়ে নিয়েছে, যেখান থেকে এক কালে অনেক কর্ণার কিক নিয়েছি আমরা।
আর মাঠের পশ্চিম সীমানা আগে যেখানে ছিল, তার উপর দিয়ে এখন চলে গেছে পৌরসভার একটি রাস্তা,
যার পাশেই মাঠের মধ্য-পশ্চিম ভাগ জুড়ে এখন একটি স্থানীয় সমিতির ভবন।
আর আমার স্মৃতিময় মাঠের যে অংশটা এখনো ফাঁকা আছে, সেখানে বিশেষ উপলক্ষে বিনোদনমূলক খেলাধূলা বা মঞ্চ বানিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয় এখনো,
তবে ফুটবল খেলা হয় না। একেতো যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা আর নেই, তার উপর নূতন প্রজন্মের মধ্যে ফুটবল পাগল মানুষের হার খুব বেশি বলে মনে হয় না।
১ম গোলক
আমার মানসপটে যে দুইটি গোলকের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, তার একটি হল ফুটবল। স্মৃতিতে মিশে থাকা এই বস্তু, ছোটবেলার খেলার মাঠ –
এসব আমার চিন্তায় ঘুরপাক খেতে থাকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস ২০১৩ উপলক্ষে আগাম আয়োজিত পাহাড় বনাম সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটা প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিতে গিয়ে।
পাহাড়ি বয়োজ্যোষ্ঠ দলের পক্ষে মাঠে নামার পর কিছু সময়ের জন্য বয়স ভুলে ছোটাছুটি করেছিলাম বায়ুভর্তি একটি গোলকের পেছনে,
যেমনটা ঢাকায় বা বিদেশে পড়ালেখা করার সময় খাগড়াপুরে অবকাশ যাপনে গেলে প্রিয়জনদের সাথে বেশ নিয়মিতই করতাম আজ থেকে দুই তিন দশক আগে, বা তারো আগে যখন খাগড়াপুরে বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করতাম।
খাগড়াপুরে খুব ছোট বয়সে প্রথম যে বলগুলো নিয়ে আমরা খেলতাম, সেগুলো গাছে ধরত। আমি বলছি জাম্বুরার কথা।
আমাদের স্কুলের পাশেই একটা জাম্বুরা গাছ ছিল, এবং যখন স্কুলে বা পাড়ায় কোন ফুটবল ছিল না, আমরা সেখান থেকে ফল পেড়ে নিয়ে খেলতাম।
এরপর প্রথম যখন সবাই মিলে চাঁদা তুলে একটা ফুটবল কিনেছিলাম – তখন আমি হয়তবা টুতে পড়তাম – আমার মত বয়সের ছেলেদের মধ্যে রীতিমত একটা উৎসবের ধুম পড়ে গিয়েছিল।
সেই বল একদিন হঠাৎ করে ফেটে গেল – উপরের চামড়ার আবরণে সেলাই খুলে গিয়েছিল এক জায়গায়,
এবং সেখানে কেউ একজন লাথি মারার সময় তার পায়ের নখ লেগে ব্লাডার ফেটে গিয়েছিল জোর আওয়াজ করে – যে ঘটনা ছিল পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
মনে পড়ে, কেউ কেউ তখন বলে বেড়াচ্ছিল, বলটি ফাটার সময় নাকি তারা আগুনের একটা হল্কা উড়ে যেতে দেখেছিল!
আমার বিশ্বাস, ফুটবলের পেছনে দৌঁড়িয়ে ছোটবেলায় অনেক সময় কাটিয়েছেন, এমন অনেকেরই এ ধরনের নানান মজার স্মৃতি আছে।
তবে স্মৃতিগুলো যতটা না ফুটবল নামক বস্তুটার, তার চাইতেও বেশি তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সম্পর্ক ও সামাজিক অভিজ্ঞতার।
একদিকে বন্ধুত্ব, আরেকদিকে প্রতিযোগিতা। আমাদের বেলায় প্রতিযোগিতার একটা ভেদরেখা ছিল গ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া খাগড়াছড়ি নামের ছোট ছড়া,
যার একপাশে ছিল গোলাবাড়ি এবং আরেক পাশে পেরাছড়া নামের দুটি আলাদা মৌজা।
এই এককের প্রশাসনিক ও সামাজিক গুরুত্ব বড়দের কাছে তখনো নিশ্চয় ছিল, যে কারণে তা ছোটদের খেলায় ঢুকে পড়েছিল।
যাহোক, এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে ফুটবলকে আমরা দেখতে পারি স্থানিক সমাজের, বা কমিউনিটির, স্মারক ও প্রতীক হিসাবে।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পেছনে ফেলে আসা একটা সময়ের কথা, যখন ‘কমিউনিটি’ শব্দটা আমরা হয়ত জানতাম না, কিন্তু তার বাঁধনেই টানা ছিল আমাদের চেনা জগতের অনেকখানি সীমানা।
২য় গোলক
দ্বিতীয় যে গোলকের কথা আমি ভাবছি, তা আপনার আমার – সব মানুষের – বাসস্থান, এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমাদের সবার ঠিকানা।
আমি বলছি পৃথিবী নামক গ্রহের কথা, যেখানে চেপে বর্তমানে সাতশ কোটি মানুষ, এবং সৃষ্টির অপরাপর সকল জীব, ভেসে চলছে মহাশূন্যে।
অবশ্য পৃথিবী যে গোল, এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে সৌরমন্ডলের অংশ হিসাবে মহাশূন্যে ছুটে চলছে, এই বিষয়টাতো মানুষ বুঝতে শিখেছে এই সেদিন।
তারপরও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের কাছে ব্যাপারটা হয়ত এখনো অজানা বা দুর্বোধ্য।
নিজের বেলায় আমার মনে পড়ে, ক্লাস সিক্সে ওঠার পর একদিন যখন আমাদের ভূগোল বা বিজ্ঞানের শিক্ষক ব্ল্যাক বোর্ডে একটা গোল বৃত্ত এঁকে দেখিয়েছিলেন, পৃথিবীটা গোল,
এবং আমরা থাকি সেই গোলকের পৃষ্ঠদেশে, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বড়দের অজ্ঞতা দেখে।
স্পষ্ট মনে আছে, আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, গোলকের নীচের দিকে যারা বা যা কিছু আছে, পড়ে যাবে না?
এই সামান্য বিষয়টা যে শিক্ষকের মাথায় আসে নি, তা ভেবে আমি অবাক হয়েছিলাম এবং মনে মনে ঠিক করেছিলাম, বড় হয়ে প্রমাণ করব যে পৃথিবী গোল হতে পারে না!
যাহোক, আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ফুটবল ম্যাচ খেলার পর একদিকে যেমন খাগড়াপুরের ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম,
তেমনি একটা পর্যায়ে আমার চিন্তায় সমগ্র পৃথিবীও ধরা দিতে শুরু করেছিল। আমার মনে হতে থাকে,
‘আদিবাসী’ ধারণার আবেদন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হলে গ্রামের পরিসর থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পর্যায় – সকল বলয়েই এটিকে অর্থবহ করে তুলতে হবে,
যাতে করে চাইলে যে কেউ কোনো না কোনো এক স্তরে নিজেকে খুঁজে পাবে আদিবাসী ধারণার মধ্যে। কথাটা খোলাসা করার আগে একটু বলে নেই শিরোনামে উল্লেখ করা গোলকধাঁধার কথা।
গোলকধাঁধা
যে গোলকধাঁধার কথা আমি বলছি, তা মূলত রাজনীতির, যার আবার দুটি দিক রয়েছে – এক দিকে কায়েমি স্বার্থের রাজনীতি ও নগ্ন ক্ষমতার আস্ফালন,
আরেক দিকে শব্দের রাজনীতি, যার সাথে মিশে আছে সংস্কৃতি ও ইতিহাস নির্মাণের বিবিধ ধারার অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব।
‘আদিবাসী’ বলতে যাদের আমরা বোঝাচ্ছি, তাদেরকে প্রান্তিক ও অধস্তন, এমনকি নিশ্চিহ্ন, করার প্রক্রিয়া চলে আসছে বিভিন্ন ভাবে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে –
কখনো অস্ত্রের জোরে, কখনোবা কলমের খোঁচায়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্রেফ জনস্রোতের তোড়ে।
ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তের মুখে আদিবাসীদের কেউবা পালিয়ে বেড়িয়েছে দীর্ঘকাল, আবার কেউবা রুখে দাঁড়িয়েছে যখন যতটুকু পেরেছে, কিন্তু তাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয় নি।
এই সংগ্রাম একদিকে হল তাদের টিকে থাকার মূল সম্বল যে ভূমি, তার যেটুকু এখনো তাদের জিম্মায় আছে, তা ধরে রাখার।
আরেক দিকে রয়েছে আত্মপরিচয়ের সংকট মোকাবেলা – যে সংকটের মূলে ছিল, রয়েছে, উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় তাদেরকে বাদ দেওয়া।
এসব সংকট থেকে উত্তরণের অংশ হিসাবে এদেশের আদিবাসীরা দুই দশক আগে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে প্রণীত ‘ইনডিজেনাস পিপল’ ধারণার ছাতার নীচে।
১৯৯৩ সালকে যখন জাতিসংঘ International Year of the World’s Indigenous People হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিল,
এদেশের আদিবাসীরা অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ও আগ্রহের সাথে তা পালনের উদ্যোগ নিয়েছিল।
কাগজে কলমে বাংলাদেশ তখন ‘স্বৈরাচার মুক্ত’ হয়েছে, তাই আদিবাসীদের অনেকের মধ্যে একটা প্রত্যাশা ছিল যে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার বর্ষটি উদযাপনে এগিয়ে আসবে। বাস্তবে তা হয় নি।
এমতাবস্থায় তৎকালীন বিরোধী দলের সাংসদ ছিলেন এবং বর্তমান সরকারে প্রতিমন্ত্রী পদে আসীন রয়েছেন,
এমন দু’জন বিশিষ্ট আদিবাসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ উদযাপন’ উপলক্ষে ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯৩ তারিখে ঢাকায় আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে আমি লিখেছিলাম,
“বাংলাদেশে জাতিসংঘ ঘোষিত বর্ষটি উদযাপনের কোন সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয় নি, এই যুক্তিতে যে এদেশে কোন indigenous জনগোষ্ঠী নেই।
কিন্তু একজন গারো, সাঁওতাল বা ম্রোর কাছে এই সরকারি ব্যাখ্যা তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
এতদিন তাকে আদিবাসী আখ্যায় ভূষিত করে হেয় করা হয়েছে। আর আজ যখন সে এই পরিচয়কে সগৌরবে ধারণ করে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলতে চাইছে, তখন তার সরকার তাকে বলছে, সে নিজেকে indigenous বলে দাবী করতে পারে না।”
তো, ১৯৯৩ থেকে দুই দশক ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে যখন সাম্প্রতিক কালে ফিরে আসি, কি দেখি আমরা?
আমরা দেখি ২০১১ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের একটি সভায় ডেকে এনে বলছেন,
পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতীয়’ (tribal)-দের ethnic minority বলা যেতে পারে, কিন্তু তাদের indigenous বলা যাবে না।
যে সরকারকে আদিবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে ভাবা হত, তার একজন প্রতিনিধির মুখে দুই দশক আগের বস্তাপঁচা যুক্তি নূতন করে শুনতে হবে,
তা অনেকের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত, হতাশাব্যঞ্জক ও বিভ্রান্তিকর। অনেকেই মেলাতে পারছিলেন না, যখন সরকারে রয়েছেন চারজন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার আদিবাসী সাংসদ,
এবং সরকার প্রধান পদে রয়েছেন এমন একজন জননেত্রী যিনি ১৯৯৩ সালে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসাবে,
এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও, বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে বাণী দিয়েছিলেন,
তখন কি করে আবার নূতন করে একটি পুরানো রেকর্ড বাজানো হয় যে ‘উপজাতীয়রা এদেশের আদিবাসী নয়’?
এ লেখা লিখতে বসার পর ফেসবুকে একটা খবর চোখে পড়ল, বান্দরবানে নাকি একটা লিফলেট বিলি করা হচ্ছে এই মর্মে যে,
“পাহাড়িরা না, বাঙালিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী,” যা অনেকটা দু’বছর আগে দেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণারই প্রতিধ্বনি!
এই অবস্থা নিঃসন্দেহে পরিহাসমূলক, সেসাথে গভীর রকমের হতাশাব্যঞ্জকও – ঘুরে ফিরে একটা নিরর্থক বিতর্কের গোলকধাঁধায় আটকে আছে এদেশের অনেক মানুষ।
আদিবাসী ধারণা নিয়ে নূতন ভাবনার তাগিদ
বিভিন্ন কারণে সাম্প্রতিক কালে ‘আদিবাসী’ ধারণা নিয়ে নূতন করে ভাবছি আমি। এবং এটা নূতন করে উপলব্ধি করছি, যে,
এই ধারণার মর্মার্থকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে, এবং এটি নিয়ে প্রচলিত বিভ্রান্তির নিরসন করতে না পারলে, যে লক্ষ্যে এটি আমরা ব্যবহার করছি তা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে।
আদিবাসী ধারণার মর্মার্থ ও আবেদন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হলে গ্রামের পরিসর থেকে শুরু করের বৈশ্বিক পর্যায় –
সকল ক্ষেত্রেই এটিকে এমনভাবে অর্থবহ করে তুলতে হবে যাতে চাইলে যে কেউ কোন না কোন এক স্তরে নিজেকে খুঁজে পাবে আদিবাসী ধারণার মধ্যে। এটি মোটেও কঠিন নয়।
আদিবাসী ধারণা যে আপেক্ষিক, স্থান-কাল-প্রেক্ষিত নির্ভর, তা নূতন কোন কথা নয়। এ প্রসঙ্গে আমি ১৯৯৩ সালেই লিখেছিলাম:
“স্থান ও কালের সীমানা কিভাবে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে কোন প্রেক্ষিতে কাদের আমরা indigenous বলতে পারি।
আমরা যদি সুদূর প্রাগৈতিহাসিক অতীতে চলে যাই তাহলে indigenous কথাটি অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
সেক্ষেত্রে বড়জোর এটুকু বলা যায় যে, সব মানুষই এই পৃথিবীর indigenous বাসিন্দা, অর্থাৎ আমরা কেউ স্বর্গ বা ভিন গ্রহ থেকে আসা কারও বংশধর নই,
বরং আমাদের সবারই রয়েছে অভিন্ন এক [আদি] উৎস [যা রয়েছে] এই পৃথিবীর বুকেই কোথাও, খুব সম্ভব আফ্রিকায়।”
এসব কথা বলার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় সুনির্দিষ্ট কিছু ভৌগোলিক এলাকার প্রেক্ষিতে কোন জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসাবে শনাক্ত করা অসম্ভব, বা তা করা ঠিক হবে না।
তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, স্থানিক ও জাতীয় পর্যায়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের সীমানা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতটাও সব সময় মাথায় রাখতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, আদিবাসীদের অস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে যে গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যত জড়িয়ে আছে, এবং মানুষ হিসাবে যে আমরা সবাই এক – সবাই পৃথিবীর আদিবাসী – সে উপলব্ধিকে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে।
অবশ্য সচরাচর খুব কম মানুষই পুরো পৃথিবীকে নিজের মনে করে। তেমন মনে করার উপলক্ষ বা কারণও খুব একটা ঘটে না।
পৃথিবীর সব মানুষই কম বেশি ব্যস্ত যে যার মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে – যার নেই সে তা খুঁজে বেড়ায়, আর যাদের আছে তার দিন চলে যায় তা সামলে রাখতে।
এর বাইরে সামষ্টিকভাবে বেশির ভাগ মানুষ বড় জোর নিজ নিজ ‘দেশ’ নিয়ে মাথা ঘামায়, যার মাত্রা ও সীমানায় আবার হেরফের দেখা যায় স্থান-কাল-পাত্র ভেদে।
যেমন, বাংলাদেশীদের অনেকের কাছে এই ‘দেশ’ বলতে এখনো নিজেদের গ্রাম বা জেলা, বা বড় জোর সমগ্র বাংলাদেশ।
কিন্তু গোটা পৃথিবীকে ‘দেশ’ হিসাবে বিবেচনা করার মত কোন বাস্তব কারণ বা পটভূমি সেভাবে তৈরি হয় নি কোথাও।
আসলে কি নেই? যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান বিশ্বায়নের গতিপ্রকৃতি, সমস্যা, সম্ভবানা ইত্যাদি নিয়ে ভাবি,
তাহলে পুরো গ্রহ, বা আমাদের সবার ‘ধরিত্রী মাতা’ নিয়ে যে এ বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের মাথা ঘামানো দরকার, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।এ প্রসঙ্গে বিশ বছর আগেই যেমনটা লিখেছিলাম,
“প্রগতির যে ধারণা পাশ্চাত্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল, তারই শিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা।
কিন্তু এই প্রগতির সীমা ও বিপদ আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাজনের অরণ্যভূমি নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথে সেখানকার আদিবাসীরা যেমন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মূল হয়ে যাচ্ছে, তেমন গোটা বিশ্বের পরিবেশগত ভারসাম্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।”
এ ধরনের উপলব্ধির আলোকেই বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্মৃতির শেকড় আর স্বপ্নের মহাকাশের যোগসূত্র হিসাবে আদিবাসী ধারণা
ফুটবল আর পৃথিবী – দুটো গোলক নিয়েই মানুষ কাড়াকাড়ি করে। একটার বেলায় গোলকের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা তা করি, আরেকটার বেলায় গোলকের গায়ে চড়ে।
ফুটবলের বেলায় আমরা জানি, কিছু নিয়ম মেনে চললে খেলা কতটা উপভোগ্য হতে পারে, এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্ধুত্ব কত দৃঢ় হতে পারে।
আর ফুটবল যারা ভালবাসে, তারা ওটিতে লাথি মারে প্রয়োজনে, কিন্তু খেলা শেষে বল তুলে নেয় বুকের কাছে।
ছোটবেলায় আমাদের কেনা প্রথম বল যখন ফেটে গিয়েছিল আমাদের অসচেতনতায়, আমরা সবাই খুব মন খারাপ করেছিলাম। অন্যদিকে এই পৃথিবী – ধরণী – আমাদের মা।
আমরা মানব সন্তানরা তার গায়ে চড়ে খেলা করছি, তাকে লাথি মারছি, আর নিজেরা ঝগড়া করছি, কিন্তু সবাই কিছু নিয়ম মেনে না চললে যে রুগ্ন মায়ের অকাল মৃত্যু আমরা ডেকে আনব,
এই উপলব্ধির আলোকে এখন আমাদের সচেতন হতে হবে। উল্লেখ্য, এমন সচেতনতা কিন্তু সহজাতভাবেই মিশে আছে অনেক আদিবাসী সংস্কৃতির গভীরে।
কাজেই আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষা করা, তাদের সংস্কৃতি থেকে শিক্ষা নেওয়া, খুব জরুরি।
চীন বা ভারতের মত দেশ, বা এমন কি বাংলাদেশ, যখন বিশ্ববাসীকে বলে, “আমরা সবাই আদিবাসী, কাজেই আলাদা করে কাউকে আদিবাসী নাম দিয়ে তাদের অধিকার সুরক্ষার কোন দরকার নেই”,
আর হাঁটতে থাকে ঔপনিবেশিক মননের ইউরোপীয়দের দেখানো পথে, তখন আমাদের বুঝতে হবে, ধরিত্রী মাতার সামনে সমূহ বিপদ।
আর কেউ না বুঝুক, আদিবাসীরা তা বোঝে, কারণ মায়ের সাথে তাদের নাড়ির টান এখনো আছে। মাকে রক্ষায় তারাই এগিয়ে এসেছে, আসতে থাকবে, সবার আগে।
শেষ করব আমার স্মৃতির মাঠ যেখানে আছে, সেই খাগড়াপুর গ্রাম বা খাগড়াছড়ি শহর এখন আমার কাছে কি অর্থ বহন করে, তা নিয়ে আমার একটা সাম্প্রতিক উপলব্ধির কথা উল্লেখ করে।
সেটা আমি তুলে ধরেছিলাম এ বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে পোস্ট করা খাগড়াছড়ির একটা পুরানো ছবি ও তার উপর লেখা কিছু কথা দিয়ে।
সেখানে যেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি – পাঠকরা নিশ্চয় আমার সাথে একমত হবেন – কখনো যদি মানুষ মহাশূন্যে পাড়ি দেয়, তখন নিশ্চয় পুরো পৃথিবীকেই তার নিজের বাড়ি মনে হবে।
মহাশূন্যে আমরা বাস্তবে সহসা যাই বা না যাই, আমাদের কল্পনায়, আমাদের স্বপ্নে, এখনই চলে যেতে পারি,
যেমনটা গতবছর সান্তুআতে আমি লিখেছিলাম ‘ত্রিপুরাদের মধ্যে কে প্রথম মঙ্গলগ্রহে যাবে?’ নামের একটা রচনায়।
পাঠক, আপনি যদি ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান চেতনার কোন না কোন স্তরে, আপনি স্বপ্ন দেখছেনতো নূতন কক্ষপথে বিচরণের?
Wansukdi nokha sakao kagwi, phainai jorao thangwi. Samung tangdi hago achugwi, tabok! <<<চিন্তা করুন আকাশে উঠে, আগামীতে গিয়ে। কাজ করুন মাটিতে বসে, এখন!>>> ~~Think globally, act locally! Think ahead, act now!~~~
* খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত ‘সান্তুআ জার্নাল’-এর বিশ্ব আদিবাসী দিবস ২০১৩ সংখ্যার জন্য লেখা ‘একটি মাঠ, দুইটি গোলক ও একটি গোলকধাঁধা: আদিবাসী দিবসের ভাবনা’ শিরোনামের একটি রচনার সংক্ষেপিত রূপ।
লেখক : Prashanta Tripura
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।