কালের দর্পনে ককবরকের লিখিত চর্চা : এপার-ওপারের কিছু তথ্য-উপাত্ত

Jumjournal
Last updated Dec 21st, 2020

818

featured image

ককবরকে লিখিত সাহিত্য চর্চার ইতিহাস নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা অভিমত। ত্রিপুরার রাজপরিবার ও প্রজাসাধারণের ভাষা থেকে এই ভাষাটি ধীরে ধীরে বাংলার প্রবল প্রতাপের কাছে পরাজয় বরণ করে এবং নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত হয়।

পরে ভারতের স্বাধীনতার দুই বছর পর ১৯৪৯ সালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাথে স্বাধীন ত্রিপুরার সংযুক্তি হয়। এই সংযুত্তির প্রায় তিন দশক পর ১৯৭৯ সালে ‘ককবরক’ ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৯৪ সালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ককবরক সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা হয়, ২০০৩ সালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ট্রাইবেল ল্যাংগুয়েজ-এর অধীনে পর্ণাঙ্গ ডিপ্লোমা কোর্সে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে ককবরকের উন্নয়ন বহুদূর এগিয়েছে।

এই ভাষাটি তাজা সাধারণ্যের মৌখিক ভাষা থেকে লিখিত সাহিত্যের ভাষা এবং শেষে স্কুলে পঠন-পাঠন ও ডিগ্রী অর্জনের ভাষায় পরিণত হয়েছে। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ককবরক বিভাগ নামের আলাদা একটি বিভাগ এখন চলমান রয়েছে, যা এই ভাষার অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত পরিচর্যা করে চলেছে।

ককবরক-এর লিখিত সাহিত্যের বিবর্তনকে মােটামুটি চারটি পর্বে বিভাজন করা যায়-
১) আইচুকপাং বা আলাে-আঁধারির যুগ (খ্রিস্টীয় প্রথম শতক হতে রাজমালা),
২) ফ্রুং-আইসিরি বা প্রথম আলাের যুগ,
৩) সালকাসৗকাং বা সূর্যোদয়ের যুগ,
৪) সাল কৗস্রাং বা প্রাক-আধুনিক যুগ এবং
৫) তাবকনি সাল বা আধুনিক যুগ।

১) আইচুকপাং বা আলাে-আঁধারির যুগ

ককবরক লিখিত সাহিত্যের আলাে-আঁধারি পর্বটির সীমা সহজে নির্ণয় করা যায় না। এই পর্বটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতক হতে রাজমালা রচনাকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয় উপমহাদেশে বােডাে সভ্যতার শুরু যদি খ্রিস্ট-জন্মের কিছুকাল পূর্বে হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভাষায় লেখালেখির পর্বটি খ্রিস্ট-জন্মের শুরু থেকেই আরম্ভ হয়ে থাকতে পারে।

এই সময়কাল মােটামুটি মধ্যযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। কলমা নামের এই ভাষার একটি নিজস্ব লিপি ছিল বলেও বিভিন্ন লেখার সূত্রে জানা যায়। তবে এই লিপির কোন নমূনা অদ্যাবধি আবিস্কৃত না হওয়ায় এ ব্যাপারে হলফ করে কিছু বলা সম্ভব নয়।

এই আইচুকপাং বা আলাে-আঁধারি যুগের যেসব মৃদু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তার মধ্যে কলমা হরফে লেখা ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস বা বংশলিপির কথা প্রায়ই উলেখ করা হয়। ‘রাজরত্নাকর’ নামের ত্রিপুরা রাজাদের কাহিনীনির্ভর একটি গ্রন্থওকলমা লিপিতে রচিত হয়েছিল বলেও বিভিন্ন লেখালেখিতে উল্লেখ করা হয়।

এই দুই ধরনের কোন গ্রন্থের কপি এখনও আবিস্কৃত হয়নি। ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’ গ্রন্থটিও এই সময়ে কলমা লিপিতে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই মূল গ্রন্থের কোন হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই গ্রন্থটিই প্রথমে সংস্কৃতে এবং পরে মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের আমলে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়।

মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের আমলে (১৪৫৮-৬৫) রাজমালাকে সংস্কৃত হতে বাংলায় অনুবাদ করার সময় সংস্কৃত, বাংলা ও ককবরকে সুপন্ডিত দুলু নারাণ বা দুর্লভেন্দ্র নারায়ণ ব্রাহ্মণ সহােদরকে সহযােগিতা করেছিলেন এবং তখন সংস্কৃত হতে, বাংলা করার সাথে সাথে ককবরকে এক কপি তর্জমা করে রেখেছিলেন বলে নানা উৎস হতে জানা যায়।

সংস্কৃত, ককবরক এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতি ও ভাষা পরিবেশ সম্পর্কে পন্ডিত সহােদরের সম্যক ধারণা না থাকায় দুলু নারাণকে এই কাজে নিয়ােগ করা হয়েছিল। ত্রিপুরার মহারাজাদের অতিশয় বাংলা প্রীতির কারণে বাংলায় অনুদিত কপিটি সযত্নে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা হলেও ককবরক কপিটি আর আলাের মুখ দেখেনি বা সচেতনভাবেই তা নষ্ট করা হয়ে থাকতে পারে।

রাজমালার এই ককবরক কপিটি আবিষ্কৃত হলে তা হতাে ককবরক লিখিত সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন (শ্যামাচরণ ত্রিপুরা)। এই বাংলায় অনুদিত বা রচিত রাজমালাতেই উল্লেখ করা হয় যে, গ্রন্থটি পূর্বে স্থানীয় ত্রিপুরা ভাষায় লেখা হয়েছিল।

পরে সেই সময়কার পারিপার্শ্বিকতা বিচারে অধিকতর সভ্য সমাজের ভাষা বিবেচনা করে তা বাংলায় বা রাজমালার পরিভাষামতে ‘সু-ভাষায়’ অনুবাদ করা হয়। রাজমালার দ্বিতীয় খন্ডের ধর্ম মাণিক্য পর্বের ৬ নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে-

‘পূর্বে রাজমালা ছিল ত্রিপুর ভাষাতে
পয়ার গাঁথিল সব সকলে বুঝিতে
সু-ভাষাতে ধর্মরাজে রাজমালা কৈল
রাজমালা বলিয়া লােকেতে হৈল।’

ককবরক লিখিত রূপের প্রয়াস হিসেবে দুর্গাপ্রসাদ নারাণ কর্তৃক মহেন্দ্র মাণিক্যের (১৭১৩-১৪) জীবনী ও চতুর্দশ দেবতার পূজার্চ্চনা বিষয়ক মন্ত্রাদি ককবরকে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। পান্ডুলিপিটি একসময় সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও কোন এক গুঢ় কারণে তা এখন দুষ্প্রাপ্য।

২) ফুং-আইসিরি বা প্রথম আলাের যুগ

আলাে-আঁধারি পথ পাড়ি দিয়ে ককবরকের প্রথম প্রহরটি শুরু কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর রাধা মােহণ দেববর্মন ‘ককবরকমা’ নামের একটি ককবরক ব্যাকরণ রচনা করেন। এছাড়া আইনজীবি দৌলত আহম্মদও সমসাময়িক কালে ‘ককবরমা অং ত্রৈপুর ব্যাকরণ।’

নানা তথ্যসূত্রে দৌলত আহম্মদের গ্রন্থের প্রকাশকাল প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়েছিল ১৩০৭ বঙ্গাব্দ। তাই ধরে নেওয়া হতাে এই বইটি রাধামােহন ঠাকুরের বই হতে তিন বছর পরে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুরনাে পুঁথির সংগ্রহশালাসূত্রে সম্প্রতি জানা গেছে যে, দৌলত আহম্মদের লেখা বইটি ১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল, যা খ্রিস্টীয় সন গণনায় ১৮৯৭ হবে।

ঠাকুর রাধামােহন দেববর্মন ১৯০৬ সালে ‘ত্রৈপুর কথামালা’ নামের ককবরক-বাংলা-ইংরেজী ত্রিভাষিক অনুবাদগ্রন্থ এবং ১৯০৭ সালে ত্রিপুর ভাষাভিধান রচনা করেন। কিন্তু এসব উদ্যোগেরও আগে ককবরকে লেখালেখির তথ্য নানা অফিসিয়াল ও বিভিন্ন পদের ভ্রমণ নথিতে পাওয়া যায়।

১৮৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে যুবরাজ রাধাকিশাের দেববর্মা কর্তৃক ককবরকের অভিধান রচনার কথা জানা যায়। তৎকালীন ত্রিপুরায় অবস্থানকারী ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্ট মিঃ টি, ই, কক্সহেড-এর প্রশাসনিক প্রতিবেদনে (নং ১৩৪ তাং- ২৬ জুন ১৮৭৬) এই তথ্যটি রয়েছে।

সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- The yubrai has moreover, at my suggestion, set about the compilation of a Tipperah vocabulary. He is perfectly acquainted with the vernacular of the hill people, and I am in hopes that the result of his undertaking will have some scientific interest. মিঃ সি, ডব্লিউ বল্টনের প্রতিবেদনেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে, The yubaraj is still engaged in the compilation of a Tipperah. Bengali Dictionary and lately he has become a member of the ASIATIC SOCIETY of Bengal.

প্রায় একই সময়ে জে. ডি. এন্ডারসনও ককবরক-বাংলা-চাকমা অভিধানের পান্ডুলিপি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তা প্রকাশিত হয়নি, যা বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়।

তার কিছুকাল পরে বড় ঠাকুর সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন ‘য়েসিয়ার খাগরা’ নামের একটি বিয়ােগান্তক ককবরক লােকগীতি স্বরলিপিসহ লিখে। তাঁর সংকলিত ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়।

কবি দৌলত আহম্মদ-এর আরেক কীর্তি ককবরক কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৮৮০ সালের দিকে, তাঁর যৌবনে। কিন্তু বইটির একটি কপি তাঁর জনৈক নিকটাত্মীয়ের কাছে সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও তার কোন কপি এখন আর পাওয়া যায় না। এই কপিটা পাওয়া গেলে ককবরক লিখিত রূপের আরেক দিক উন্মােচিত হতাে।

৩) সালকাসৗকাং বা সূর্যোদয়ের যুগ

ককবরক লিখিত সাহিত্যের সূর্যোদয়ের যুগে ককবরকের ছােট্ট বীজ অঙ্কুরিত হয়ে তার শাখা প্রশাখা প্রসারিত করতে থাকে। ধর্ম থেকে রাজনীতি, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, ছড়া থেকে উপন্যাস, অনুবাদ থেকে মহাকাব্য সকল বিষয় ককবরক সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠতে থাকে এই পরে।

বাংলাদেশে ককবরকে লেখালেখির প্রকাশিত নিদর্শন হলাে উনিশশত চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে সাধক খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা কর্তৃক রচিত ককবরক আধ্যাত্মিক সংগীত। তাঁর লেখা ৩৩টি আধ্যাত্মিক ককবরক সংগীত নিয়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘ত্রিপুরা খা-কাচাংমা খুম্বার বই’ নামের এই গানের বই প্রকাশিত হয়।

এই গানের বইটিকে বাংলাদেশে ককবরকের লিখিতরূপের সূচনালগ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়। এরপর থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই ককবরকে লেখালেখি চর্চা করতে থা ত্রিপুরা জাতির সাধু ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় ককবরক চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন বহুদিন আগে থেকে। আশির দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ত্রিপুরাদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বৈসু উপলক্ষে নানা সাময়িকী প্রকাশ করতে থাকে। যা স্বল্প পরিসরে হলেও নিজের ভাষায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর ত্রিপুরা জনশিক্ষা সমিতি গঠিত হলে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সুধম্বা দেববর্মার সম্পাদনায় প্রথম ককবরক ম্যাগাজিন ‘কৗতাল কথমা প্রকাশিত হয় । সুধম্বা দেববর্মার লেখা ‘হাচুক খুরিঅ’ ককবরকে লিখিত প্রথম উপন্যাস, যা ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ককবরক সাহিত্য সভা ও সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

এর আগে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘দি বাইবেল সােসাইটি অব ইন্ডিয়া কর্তৃক অনুদিত খৃস্ট ধর্মীয় গ্রন্থ ‘সমাই কৗতাল’, যা বিংশ শতকের অন্যতম প্রধান অনুবাদকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছড়াসহ সাহিত্যকর্মের মধ্যে সুধন্য দেববর্মার উপন্যাস ‘চেথুয়াং’, ককবরক ছড়া সংগ্রহ ‘ফুনুকমা, দশরথ দেববর্মা অনুদিত গান্ধিজীর বাণী ‘গান্ধিজী ককলাম’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এই সময়কালে বংশী ঠাকুর নামে বহুল পরিচিত অমরেন্দ্র দেবৰ্মা ছিলেন একজন জনপ্রিয় লেখক। হুলি’র গানগুলাে ককবরকে অনুবাদ করে তিনি সকলের প্রশংসা কুড়ান। বিশেষ করে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু ককবরক কবিতা রচনা করেন। ‘ককতাং কুলুই’ নামের একটি ককবরক ব্যাকরণও তিনি রচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ককতাং’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ লেখেন এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সুরুংমা য়াখিলি’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন।

মহেন্দ্র দেববর্মা ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘চেরাই সুরুংমা’ নামের পাঠ্যবই রচনা করেন। অজিত বন্ধু দেববর্মা ১৯৬৩ সালে ‘কক-সুরুংমা’ (বাগসা এবং বাগনৈ) রচনা করেন এবং ১৯৬৭ সালে ‘ককরবাম’ বা ককবরক অভিধান প্রণয়ন করেন। ককবরক সাহিত্য সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক অলিন্দ্রলাল ত্রিপুরা বহু নাটক রচনা করেন, যার মধ্যে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘লামানি হমচাং’ অন্যতম, যা বিভিন্ন মঞ্চে প্রদর্শিত হয়।

পঞ্চাশের দশকে সােনাচরণ দেববর্মা বহু ককবরক সংগীত রচনা করেন। ‘ফিরগই ফাইদি’ তাঁর সংগীত সংকলনসমূহের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও রাজ্য শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক তাঁর ‘ভারতনি পাঞ্চালি’, ‘রামায়ণ কচারজাক’ ও ‘য়াপ্রি কৗতাল’ নামের কিছু বই প্রকাশিত হয়।

১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের সাহিত্যিক বরেন ত্রিপুরার সম্পাদনায় ‘অজানা পাহাড়ী সুর” প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত ককবরক গান, খুশী কৃষ্ণ সন্ন্যাসী ও রতনমণি সন্ন্যাসীর লেখা জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গান এবং বরেন ত্রিপুরার নিজের লেখা কিছু গান মিলে মােট ২৫টি গান এই বইয়ে সন্নিবেশ করা হয়েছে।

ককবরক লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিশেষ ভূমিকা উল্লেখ করা মতাে। ১৯৬৭ সালে বীর চন্দ্র দেববর্মা ত্রিপুরা ককবরক উন্নয়ন পরিষদ এবং অলিন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও শৈলেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ‘ত্রিপুরা ককবরক সাহিত্য সভা ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭২ সালে ত্রিপুরা ককবরক উন্নয়ন পিরষদ কর্তৃক ‘ত্রিপরা ককবরক ভাষার লিখিত রূপে উত্তরণ’ নামের একটি প্রকাশনা বের করা হয়। ত্রিপুরা ককবরক সাহিত্য সভা কর্তৃক১৯৬৭ সালে ‍‘ত্রিপুরা সংহিতা’ নামের একটি দর্শনশাস্ত্র প্রকাশ করা হয় এবং ১৯৭৩ সালে ত্রিপরা ব্যাপ্টিস্ট লিটারেচার সােসাইটি কর্তৃক ‘স্রুংসামা’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়।

সত্তরের দশকের অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে বুদুরায়-এর সতেরটি ককবরক গানের সংকলন ‘খানি রৗচাপমং’ দশরথ দেববর্মার ১৯৭৭ সালে রােমণ হরফে লেখা ‘ককবরক সীরুং’ এবং ১৯৭৮ সালে মনােরঞ্জন দেববর্মা রচিত ‘বুবার’ অন্যতম। ‘লামা’ সাহিত্য পত্রিকায় শ্যামলাল দেববর্মার ‘তংথাই নাইতংমানি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতাে।

১৯৭৭ সালে রাঙামাটি থেকে সুরেশ ত্রিপুরার সম্পাদনায় এগারজন গীতিকারের বারটি গানের সংকলণ ‘বজন’ প্রকাশিত হয়। বইয়ে ককবরক গানগুলাে বাংলা অনুবাদও দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরা উপজাতীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ থেকে খুশী কৃষ্ণ সন্ন্যাসী ওরফে বলংরায় সাধুর জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গানের সংকলন ‘ত্রিপুরা খাকাচাংমা খুষার বই’-এর দ্বিতীয় প্রকাশিত হয়।

এই সংকলনের সমসাময়িক কালে শংকর চন্দ্র ত্রিপুরা কর্তৃক বলংরায় সাধুর আধ্যাত্মিক গানের দ্বিতীয় সংকলন ‘প্রাণ কাচাংমা’ চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাই থেকে প্রকাশিত হয়। একই বছরে সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সম্পাদনায় চিত্ত রঞ্জন ত্রিপুরা কর্তৃক ককবরকে অনুদিত শ্রী মদ্ভাগবত গীতা ত্রিপুরা উপজাতীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে কোন এক অনির্ণিত প্রাচীন সময়ে ঘটে যাওয়া কাহিনী সম্বলিত একটি জনপ্রিয় গীতিকাব্য। সংকলন ‘পুন্দা তান্নায় বা জিজোক পুন্দা’। বরেন ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত এই গীতিকাব্যের কাহিনী বর্ণনা করেছেন সেই সময়ের জনপ্রিয় লােক গায়েন শশী কুমার ত্রিপুরা।

আশির দশকটি ছিল মূলত ককবরক লিখিত সাহিত্যের জোয়ার। এ সময় সৃষ্টির জোয়ারে যেন উত্তাল হয়ে ওঠে ককবরক সাহিত্য জগত। ১৯৮০ সালে শান্তিময় চক্রবর্তীর ‘ত্রিপুরানি কেরেং কথমা’ প্রকাশিত হয়।

১৯৮৩ সালে নরেশ চন্দ্র দেববর্মা ও শ্যামলাল দেববর্মার সম্পাদনায় ‘ককবরক ককলব বাঁচাব’, শান্তিময় চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘কগতাং-ককলব বৗতাং’ ও ‘মুকতৈ’, ১৯৮৪ সালে নন্দ কুমার দেববর্মার ‘সিমালুং সাকাঅ হলংনি খুম’, মহেন্দ্র দেববর্মার ‘লুকু সচামা রৗচাবমুং’। ১৯৮০ সালে রাঙামাটির সাকনি কক প্রচার সংসদ থেকে রঘুনাথ ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘তেরাং তৈ কালাই’। ১৯৮১ সালে বরেন ত্রিপুরার সম্পাদনায় ত্রিপুরা উপজাতীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ প্রকাশ করে ‘পুব-ই-রাবাইনি সাল’।

এপার-ওপারের লেখকদের লেখায় সাজানাে এই প্রকাশনাটিতে ককবরকের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ, ছড়া, গল্প ইত্যাদিও সন্নিবেশ করা হয়েছে। একই বছর ‘সাকনি কক প্রচার সংসদ’ কক সুরােংদি নামের ককবরক বাংলা ও চাকমা ভাষার বাক্য সংকলন প্রকাশ করে। ১৯৮৪ সালে রাঙ্গামাটিস্থ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট থেকে জাফার আহমাদ হানাফীর সম্পাদনায় ত্রিপুরা ভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ প্রকাশিত হয়।

বইটির পান্ডুলিপি প্রণয় করেছেন বাংলাদেশের ককবরণ অতিত্যের দুই দিকপাল বরেন ত্রিপুরা ও প্রয়াত সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। ১৯৮৫ সালে রাঙামাটিস্থ ত্রিপুরা উপজাতি ছাত্র কল্যাণ সংঘ থেকে অরুনেন্দু ত্রিপুরা ও জীবন রােয়াজা’র সম্পাদনায় বের হয় নববর্ষ সংকলন গ্যাখ্রাই।

একই বছর তজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা সাধু কর্তৃক আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচারণামূলক বই কথেয়া প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে প্রভাংশু ত্রিপুরা সম্পাদনা করেন ককবরোক ও আইতারামা। শ্যামলাল দেববর্মা ১৯৮৪ সালে ১২টি ছােটগল্পের সংকলন দুনদুরুকমা এবং ১৯৮৭ সালে আদং সম্পাদনা করেন।

১৯৮৭ সালে বিনয় দেববর্মার সম্পাদনায় ককবরক চারটি গল্পের সংকলন নাখীরাই এবং ১৯৮৯ সালে হরিপদ দেববর্মার সম্পাদনায় আটটি গল্পের সংকলন এলেমনি বিবি প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে ‘হা কৗচাক ও ১৯৮৮ সালে ‘নীং হামজাকমা রীয়া’ প্রকাশিত হয়।

১৯৮৬ সালে সুধন্যা ত্রিপুরার ‘আংবাই কৗখ্রাং তৈনি খরাং’ ও ‘রৗচাপমুং’ প্রকাশিত হয়। এই সময় ত্রিপুরার জনপ্রিয় কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর হাপিং গাইরিংগ চিবুকসা রিংগ(১৯৮৭),কলমতৈ কিসি মৗখাং ওবলং কৗখ্রাং প্রকাশিত হয়।

১৯৮৮ সালে বিনয় দেববর্মার সনেট ককংরগ, নরেন্দ্র দেববর্মার ‘কুকিলা নীং তৗমানি আসৗক পুং’, অলিন্দ্রলাল ত্রিপুরার ‘হরনি বর বা সাংত্রাম পাঞ্চালি’, নন্দ কুমার দেববর্মার ‘বলংনি বৗসাজৗকসং মৗসাঅ’ এবং শ্যামলাল দেববর্মার ‘ককবরক গণসংগীত প্রকাশিত হয়।

এই সময়কালের অনুবাদকর্মগুলাের মধ্যে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত শ্যামলাল দেববর্মার ‘নক আরিনি কথমা’ ও ‘ককবরকবাই রবীন্দ্রনাথ, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত নন্দ কুমার দেববর্মার ‘ককবরক গীতা ও নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার ‘তাখুমসা বদল’ ইত্যাদি অন্যতম।

এই সময়কালের উল্লেখযােগ্য পত্রিকার মধ্যে ত্রিপুরা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের ‘লামা’, ককবরক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদের ‘চাতি’ এবং ত্রিপুরা রাজ্য ককবরক সাহিত্য সভার ‘দাদু’ অন্যতম।

১৯৮৯ সালে রাঙামাটিস্থ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট থেকে সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সম্পাদনায় ত্রিপুরা ভাষা বা ককবরক ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে কুঞ্জমণি ত্রিপুরার সম্পাদনায় বের হয় ইয়াপ্রি।

৪) সাল কৗস্রাং বা প্রাক-আধুনিক যুগ

আশির দশকে সাহিত্য সৃষ্টির প্রবল জোয়ার-ভাটায় পরিশােধিত হয়ে ককবরক যেন আধুনিক যুগের অথৈ সরােবরে অবগাহনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অনেকে এই পর্বকে ককবরকের বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে আখ্যা দেন।

ককবরক সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা এই সময়ে আরাে পরিপক্কতা লাভ করতে থাকে। ককবরক তাই হুকুমু মিশনের মুখপত্র চেতুয়াং নিয়মিত প্রকাশ হতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে ইয়াপ্রি’র দ্বিতীয় সংখ্যা সম্পাদনা করেন সুপর্ণ দেববর্মন (মঞ্জু)।

এই বছর সান্তুআ নামের একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রশান্ত ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের ককবরকভাষিদের প্রথম এই সাহিত্য পত্রিকা পরবর্তীতে সান্তুআ জার্নাল নামে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে এই সাহিত্য পত্রিকাটি মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই পর্বের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নগেন্দ্র জমাতিয়ার বিলােনিয়া ১৯৯৪, সুনীল দেববর্মার মকল বীসকাংগ (১৯৯৪), বলংনি খুম (১৯৯৬) ও বিয়াল (১৯৯৭), রবীন্দ্র কিশাের দেববর্মার ককবরক ককমা বা ককবরক ব্যাকরণ (১৯৯৪), বিজয় দেববর্মা, নাফুরায় জমাতিয়া ও রবীন্দ্র কিশাের দেববর্মার সৗকালজৗকমা (১৯৯৮) এবং নাফুরায় জমাতিয়া ও অশােক দেববর্মার নাইথক (১৯৯৮) অন্যতম।

কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল চন্দ্রমণি দেববর্মার হিমালয়নি বেদেক বুপ্রা (১৯৯১) ও লাভ-ইজম (১৯৯৫), খাজুয়াল জমাতিয়ার ‘দলাম বাই ককবরক বাউল’ (১৯৯২), ককবরক তাই হুকুমু মিশনের ‘খুই বাররৗরৗক’ (১৯৯৫), কুমুদ রঞ্জন দেববর্মার য়াখারাই’ (১৯৯৬), সুধন্য ত্রিপুরার ‘নন রিখা খুম্পুই’ (১৯৯৭), বিকাশরায় দেববর্মার ‘বলং মুফুনজাক য়াকবাই(১৯৯৮), বিজয় দেববর্মার ‘লংতরাইনি একলব্য’ (১৯৯৮) এবং চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর হলং কক সাঅ বলং বিসিংগ (১৯৯৫) ও লক চেয়াং লক (১৯৯৯) ও ইত্যাদি।

অন্যদিকে বাংলাদেশেও উল্লেখযােগ্য কিছু সাহিত্যকর্ম এই সময়ে দেখা যায়, যার মধ্যে প্রশান্ত ত্রিপুরা ও শক্তিপদ ত্রিপুরা সম্পাদিত সান্তুআ (১৯৯২), সান্তুআ জার্নাল (১৯৯২, ১৯৯৩), গীতা দেববর্মন সম্পাদিত বানৌক (১৯৯৩), দীপ কুমার ত্রিপুরা সম্পাদিত পনাই (১৯৯৪), প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা সম্পাদিত বিচক (১৯৯৪), মথুরা ত্রিপুরা সম্পাদিত হামকরাই (১৯৯৫, ১৯৯৭, ১৯৯৮, ১৯৯৯), বিপ্লব কান্তি ত্রিপুরা সম্পাদিত য়ামুক (১৯৯৭), ব্রজ কিশাের ত্রিপুরা ও মথুরা ত্রিপুরা সম্পাদিত বরক হদানি কক (১৯৯৭), মিলন জ্যোতি ত্রিপুরা সম্পাদিত হ-মাচাং (১৯৯৯) ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

এই পর্বে উল্লেখযােগ্য অনেক অনুবাদকর্ম সম্পাদিত হয়। তার মধ্যে নগেন্দ্র দেববর্মার ‘কমলা কান্তনি দপ্তর’ (১৯৯২), অন্নপ্রসাদ জমাতিয়ার ‘মাংনি উানসুকথানি গীতা’ (১৯৯৭), ত্রিপুরা ব্যাপ্টিস্ট খ্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন প্রকাশিত জে.বি. দেববর্মাকৃত প্রভূ যিশুর শংসাগীতি ‘লবমুং বৗচাপ’, কৃষ্ণধন জমাতিয়ার ‘কৗরাক কথমা’ (১৯৯৫) অন্যতম।

অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ককবরক তাই হুকুমু মিশনের রােমান সৈইথাইবাই ককবরক সৈনা রাইদা (১৯৯৪), বিনয় দেববর্মার ককবরক ককমা (১৯৯৪), আর. কে. দেববর্মার ককবরক ককমা (১৯৯৪), বিনয় দেববর্মার ‘এ্যাংলাে-ককবরক অভিধান’ (১৯৯৬), ককবরক তাই হুকুমু মিশনের ‘ফুনুকমুং’ (১৯৯৪), বিনয় দেববর্মার ককবরকনি রাংচাক-রিচাক (১৯৯৪), সুকান্ত দেববর্মার গান্ধিজী (১৯৯৫), নিতাই আচার্যর ককবরকনি ককরক কিসা (১৯৯৬), বিমল দেববর্মার সাচলাং জরানি ইমাংনি খুম্পুই (১৯৯৭), রবীন্দ্র কিশাের দেববর্মার ককবরক সিখুম (১৯৯৭), বি.আর, দেববর্মাবলং মুফুনজাক য়াকবাই (১৯৯৭), হুকুমু মিশনের ককবরকবাই মুং ফারজাদি(১৯৯৪, ১৯৯৯), নাফুরাই জমাতিয়ার নাইথক (১৯৯৮), ককবরকনি লেখামুং রাইদা (১৯৯৯), এন. সি. দেববর্মার র‌্যাপিডেক্স ককবরক কোর্স (১৯৯৯), সিবি দেববর্মার হিলি (১৯৯৪), ডা. নীলমণি দেববর্মনের বেমার তাই বিনি হামরিমং (১৯৯৯) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

৫) তাবকনি সাল বা আধুনিক যুগ

এই সাহিত্যকর্মের পদাঙ্ক অনুসরণ করে একবিংশ শতকে শুরু হয় ককবরক সাহিত্যে নতুন জোয়ার। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় বিনয় দেববর্মার এ্যাংলাে-ককবরক-বাংলা অভিধান।

ককবরক তাই হুকুমু মিশন কর্তৃক প্রণীত এই অভিধানটি মূলত লেখক কর্তৃক ১৯৯৬ সালে প্রণীত ত্রিভাষিক অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণ।

এই সময়ে প্রকাশিত হয় সুনীল দেববর্মার বুসু (২০০০), হরিপদ দেববর্মার জলাই তকপুপু (২০০০), স্নেহময় রায় চৌধুরীর চেয়াং তলাঅ (২০০০), বিশ্ব কুমার দেববর্মার অস্থিরগ (২০০০)।

কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে সুধন্যা ত্রিপুরার জাদুনি খরাং (২০০০), চন্দ্রকান্ত মুড়াসিংএর পিনদি উতৈ পিন (২০০০) ও রুফাইনি বুদুক আনি নগ (২০০২), নন্দ কুমার দেববর্মার। আনি গানাঅ আং ও আনি রৗচাবমূং (২০০০), কুঞ্জ বিহারী দেববর্মার সিনিজাক কৗরীই বুমুল (২০০০), শ্যামল দেববর্মার ককথাইরগ থৗংগ বনবনিয়া (২০০০), সােনা চরণ দেববর্মার সানা। মুচুংগ সাজাকয়া ককরক (২০০২), অলিন্দ্র লাল ত্রিপুরার হাপংনি ককলব (২০১২) অন্যতম।

২০০১ সালে চন্দ্ৰবালা দেববর্মার ড. বি. আর. আম্বেদকর গ্রন্থটি প্রকাশ করে ককবরক তাই হুকুমু মিশন। ২০০২ সালে ককবরক তাই হুকুমু মিশন আরাে একটি যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম সম্পন্ন করে।

এই বছর মিশন আর কে দেববর্মা কর্তৃক অনুদিত ত্রিপুরার ইতিহাস রাজমালার ককবরক সংস্করন তৈনি লাইবুমা প্রকাশ করে। এই বছর থাংফ্লাইনি বিথিলৗং নামের একটি বরক ভেষজ ওষুধ বিষয়ক একটি বইও প্রকাশিত হয়।

২০০২ সালে বিনয় দেববর্মা আম্রকসা নামের একটি ছােটগল্পের বই বের করেন। এছাড়া রেবতী দেববর্মার ২০০২ সালে প্রকাশিত হলংবেসেরনি খুম এবং ২০০৩ সালে অতুল দেববর্মার তকসা তিয়ারি প্রকাশিত হয়।

অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের বিজয় দেববর্মা সম্পাদিত নখাইসা কেরং কথমা (২০১১), অনিল কুমার দেববর্মা অনুদিত যিশুনি তংদাল (২০০০), জাক পুনেন লিখিত গ্রন্থ থেকে কবরকে অনুদিত খরকসা ফলানি অজামা (২০০১), রুহি দেববর্মা ও সােনাচরণ দেববর্মার। খুক (২০০১), বি আর দেববর্মার চংপ্রেং মাখ্রাই বই (২০০১) ইত্যাদি অন্যতম।

বাংলাদেশের মিলন জ্যোতি ত্রিপুরা সম্পাদিত সাময়িকী ওয়াকরাই (২০০০), প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা সম্পাদিত গাঁ/ গঙ্গা তলিয়ে থাঁমানি (২০০৫), মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার ককবরক ককথাই খুক (২০০২), আমানি কক- ককবরক প্রাইমার ১ (২০০৭), আমানি কব- ককবরক প্রাইমার ২ (২০০৭), আমানি কক- ককবরক প্রাইমার ৩ (২০০৭), রােমান সুইথাইবাই ককবরক সুইনাই রাইদা (২০০৭) ও ককবরক ককথাই (২০১১), মুকুল কান্তি ত্রিপুরা সম্পাদিত খাচংমা (২০১২) ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

ককবরকের হরফ ইস্যু : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

দৌলত আহম্মদ এবং ঠাকর রাধা মােহণ দেববর্মনের ১৯০০ সালে রচিত বইগুলােকে ককবরক লিখিত রূপের বই আকারে প্রকাশিত নিদর্শন ধরে নিয়ে ২০০০ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উদযাপন করা হয়।

সেই উৎসবে যােগদানের জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানাে হলে, দেশের ত্রিপুরা অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ রেস্ট হাউস মিলনায়তনে ২০ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ও অন্যান্য ত্রিপুরা সংগঠনগুলাের উদ্যোগে এক কর্মশালা আয়ােজন করা হয়।

এই কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫০ উর্ধবয়সের অংশগ্রহণকারী ছিলেন ৮ জন, ৩৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের অংশগ্রহণকারী ৯ জন এবং অনুর্ধ ৩৫ বছর বয়সের অংশগ্রহণকারী ছিলেন ২৪ জন উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালার গুরুত্বপর্ণ সিদ্ধান্তগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে-

– উপস্থিত সুধিজনদের সর্বসম্মতিক্রমে ককবরক লেখার জন্য রােমান হরফ ব্যবহার করা।
– বাংলাদেশে ককবরকের কমপক্ষে ১২টি উপভাষা রয়েছে, লিখিত চর্চার ক্ষেত্রে যেসব উপভাষার শব্দের বানানগত সুবিধা রয়েছে, সেসব শব্দ ব্যবহার করা।
– অন্যভাষী হতে ঋণকৃত শব্দগুলাের পরিবর্তে যেসব উপভাষায় ককবরকের মৌলিক শব্দ রয়েছে, সেসব উপভাষা হতে শব্দ আহরণ করে সেগুলােকে মূল শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা।
– একটি ককবরক শব্দকোষ বা অভিধান প্রণয়ন করা।
– ককবরকের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে ককবরকে পড়ালেখার অধিকারের জন্য সরকারের নিকট বিভিন্ন কার্যকর উপায়ে দাবি উত্থাপন করা।
– বানানরীতির ক্ষেত্রে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত রােমান হরফ লেখার পদ্ধতির সাহায্য গ্রহণ করা।

এরপর ২০০২, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে আয়ােজিত বিভিন্ন মতবিনিময় সভা, কর্মশালা ও সেমিনারে একই বিষয় বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

এসব সভায় রােমান হরফ গ্রহণের যুক্তি হিসেবে বলা হয়বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও ভারতের আসাম ও মিজোরাম রাজ্য, নেপালের বিভিন্ন জেলা ও মায়ানমারে ককবরকভাষীদের বসবাস রয়েছে।

তাই সকলের আলহামতাে ও আত্মিক চেতনা ও সামাজিক সংযােগ অব্যাহত রাখার স্বার্থে সাধারণভাবে সমান হরফেই ককবরক লেখালেখির চর্চা করা হবে। নতুন কোন হরফ উদ্ভাবন বিষয়ে বলা হয়, নতুন বর্ণ তৈরি করে প্রচলন করা সময়সাপেক্ষ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ককবরকভাষিদের ঐকমত্যেরও ব্যাপার।

তাই নতুন লিপি ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে চর্চা করলেও ষ্ঠানিকভাবে তা প্রচলন করা ভাচত হবে না। এছাড়াও প্রমিত বানানরীতি প্রচলনের জন্য ককবরকের লিখিত চর্চাকে উৎসাহিত করা, প্রকাশনা, ওয়েবসাইট ইত্যাদির মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা, ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশের উদ্যোগকে উৎসাহিত করার ব্যাপারেও আলােচনা হয়।

ককবরকের লিখিত ব্যবহার বিষয়ে সামাজিকভাবেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ককবরকে লেখার প্রতিযােগিতার আয়ােজন, সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তি উদ্যোগসহ বিভিন্নভাবে দাবি উত্থাপন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, বাংলাদেশে বিদ্যমান ককবরকের সকল উপভাষার কথা মাথায় রেখে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা সামগ্রী প্রস্তুতকরণ এবং এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারেও এসব সভা সেমিনারে সিদ্ধান্ত হয়।

এসব সভা সেমিনারে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের ত্রিপুরা প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। ত্রিপুরা সংগঠনগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভিন্ন শাখা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভিন্ন শাখা, রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশন, ককবরক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, য়ামুক নাট্য গােষ্ঠীসহ কিছু উন্নয়ন সংগঠন যেমন- তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, হিলি হােমস ও খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি অংশ নেয়।

বর্তমানে ককবরকে একক অভিধান রচনার উদ্যোগ চলমান রয়েছে। যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এই অভিধান প্রণয়ন করা হবে, যার ডিজিটাল সংস্করণও ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

ককবরক-বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়নের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্তগুলাের অন্যতম হলাে-

– ত্রিপুরা রাজ্যে প্রণীত বিভিন্ন অভিধান এবং প্রয়াত সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা প্রণীত অভিধানকে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা।
– অভিধানটি একটি একক অভিধান হবে, যেখানে সকল দফার উপভাষা সন্নিবেশ করা হবে।
– প্রতিটি দফার প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করে বা সংশ্লিষ্ট দফার সাথে আলােচনা করে শব্দগুলাে সংগ্রহ ও সংকলন করা হবে।
– অভিধান রচনার জন্য গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি কর্তৃক ভাষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সংগঠন সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (এসআইএল)-এর সাথে যােগাযােগ করে সহায়তা গ্রহণ।
– অভিধানটি প্রণয়নের জন্য সিমেনটিক ক্যাটাগরি অনুসারে শব্দ সংকলন করা হবে। সিমেনটিক ক্যাটাগরিতে ৯টি ডােমেইন থাকে, যার মধ্যে ৮টি সুনির্দিষ্ট ডােমেইন এবং নবমটি হলাে ব্যাকরণিক বিবরণ।
– অভিধানটি আগামী ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।
– অভিধানের লক্ষিত ব্যবহারকারী হবেন সাধারণ জনগণ, লেখক-সাহিত্যিক অথবা শিক্ষার্থী।
– পুস্তকাকারে প্রকাশের পাশাপাশি অভিধানটির একটি ডিজিটাল সংস্করণ ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হবে।
– অভিধানটি প্রণয়ন সম্পন্ন করার জন্য সুনির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করা হবে (৯টি নির্ধারিত সিমেন্টিক ক্যাটাগরি অনুসারে শব্দ সংগ্রহ, শব্দার্থকরণ ও শব্দ বিশ্লেষণ, শব্দ সংজ্ঞায়ন বাক্যাংশ ও বৈয়াকরণিক বিশ্লেষণ, চূড়ান্ত সম্পাদনা এবং পুস্তকাকারে ও ইন্টারনেটে ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ)।

তথ্যসূত্র :

১. ককবরমা- হাচুকনি খরাং।
২. সান্তআ জার্নাল
৩. বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও ককবরক রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর বিভিন্ন আয়ােজিত সভা ও কর্মশালার প্রতিবেদন।
৪. ককবরক তাই হুকুমু মিশন-এর ওয়েবসাইট
৫. Wikipedia, the free encyclopedia

লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।

তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা