ককবরক গীতিকাব্য ‘পুন্দা তান্নাই’ উপাখ্যান : ত্রিপুরা লোকজীবনে ছন্দ ব্যবহারের নমুনা
1128
কথায় কথায় ছন্দের ব্যবহার কিংবা কাব্যময় ফোড়ন কাটা ত্রিপুরা লোকসমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে ভগ্নিপতির সাথে শ্যালক-শ্যালিকাদের কথোপকথন, বৌদির সাথে দেবর ননদদের আলোচনা কিংবা ঠাকুরদা-ঠাকুমাদের সাথে নাতি-নাতনিদের আসরে হামেশা শোনা যায় নান্দনিক ও অলংকারময় শব্দমালার বিনিময়। যুবক-যুবতির প্রথম পরিচয় অথবা প্রেম নিবেদনেও অনুরূপ ছন্দময় বাক্যবিনিময় লক্ষ করার মতো। অতি শোকময় কোন মুহূর্ততেও বিশেষ করে ত্রিপুরা নারীরা অতি সাবলিলতার সাথে নির্মাণ করতে পারে ছন্দের অট্টালিকা। জিজোক পুন্দা বা পুন্দা তান্নাই উপাখ্যান ত্রিপুরা ভাষা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এই গীতিকাব্যের পরতে পরতে সাজানো ছন্দের কারুকাজ যে কোন রসিকজনকে স্পন্দিত করে।
লালমতি বাংলাদেশের ককবরক সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা। যে নামটি ঘুরে ফিরে উঠে আসে ত্রিপুরা প্রেমিক- প্রেমিকার গানের ছন্দে কিংবা গভীর রাতে উনুনের পাশে বিনিময় হওয়া হেঁয়ালিতে। আধুনিক বহু ককবরক গানেও এই নামটি বারে বারে ফিরে এসেছে। আহা মরি কোন সৌন্দর্য লালমতির ছিল না। তার গায়ের রং ছিল শ্যামলা। তাই ছোটকালে যখন তা দাদু তাকে খাদি দিয়ে পিঠে বেঁধে নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বের হতেন, তখন গ্রামবাসী অনেকেই দুষ্টুমি করে বলতো, ‘এতো কুচকুচে কালো নাতনিকে কোলে-পিঠে করে বাহাদুরি করার কি আছে? কেউ তো তাকে বিয়েও করবে না।’ তা শুনে লালমতির দাদু বলতেন, ‘আমার ছোট্ট দিদিমণিকে তোমরা এভাবে বলো না। আমি তাকে আর্শীবাদ করছি, সে এমন এক স্বামী পাবে, যার থাকবে অসীম ক্ষমতা- অতিমানবীয় শক্তি।’ লালমতির কল্পিত স্বামীর এই ক্ষমতার ‘অসীমতা’ তার দাদুও ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তাই বলেছিলেন, ‘তার এমন ক্ষমতা হবে যে কিনা শিং ছাড়াই গুঁতো মারতে সক্ষম এবং ডানা ছাড়াই উড়তে সক্ষম।’ তাঁর এই বাণী সবার কাছে একভাবে যায়নি। যৌবনে লালমতিকে মনে মনে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য গ্রামের অনেক যুবক প্রয়োজনে মরতেও প্রস্তুত থাকলেও কোন যুবকই তাই প্রস্তাব দিতে সাহস পেতো না। অনেক যুবক প্রস্তাব করার জন্য এগিয়ে এসেও মনের কথা বলতে সাহস পেতো না। এক যুবক প্রস্তাব দিতে গেলে অন্যরা দূর থেকে উদগ্রিব হয়ে তাকিয়ে থাকতো কী বলে দেখার জন্য। সেই রকমই এক সুদর্শন যুবক হেমন্ত একদিন লালমতির সামনে এসে দাঁড়ায়। ছন্দে ছন্দে বিনিময় হয় হেঁয়ালি- প্রেমময় শব্দমালা।
ববই লালমতি খানাদি আংলাই ন’ন লাই মানগালাক নুচু বাক্য ন’ খাইলাংখা করং-করই বাই খাইমানাই কারাং করই বাই বিরমানাই অ-বতয় চালাছে নুং মাননাই আংলাই ববইয়া লখিয়ৈ করং করই-ব’ খাইমানয়া কারাং করই-ব’ বিরমানয়া আংব’ নন’ লাই লামাঁয়া!হেমন্ত বলে, হে প্রিয়তমা লালমতি শোন। তোমাকে বিয়ে করি এ সাধ্যি আমার নেই। তোমার দাদু তোমার স্বামী হওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা বাতলে দিয়েছেন, তার একটিও আমার নেই। আমি না পারি উড়তে, না আছে আমার অতিমানবীয় শক্তি।
খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতকে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ (শাসনকাল ১৩৩৮-১৩৪৯) চট্টগ্রাম দখল করার সমসাময়িক সময়ে এই অঞ্চলটি ফকির দরবেশদের আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। পুন্দা তান্নাই উপাখ্যানটির ঘটনাপ্রবাহ বিচারে এই গীতিকাব্যের কাহিনিটি এই সময়কালেরই কোন এক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
প্রেমিক হেমন্তের শংকিত প্রেম নিবেদনের উত্তরে লালমতি বলেছিল-
হ-রে দাদায়া লখিয়ৈ আন’ হিনয় নুং অংজাকখায় আনি কক খুকসা খানাদি- নুংবা চালা-সাজালা অংজাগৈ বুদ্দি হারান’ তা অংদি। দেশে বেরায়ৈ নায়ৈ ফুং স-ব’ গুন কুরুং রুতুকদি বিসি চিনৈ নুং বেরাইনি বাসুক রাং নাংনাই নুং সাদি বাসুক রি নাংনাই নুং সাদি ত-ব দেশের ন’ বেরায়ৈ হানি গুন্ ন’ নুং সুরুংদিহে প্রিয় প্রেমিক আমার। তুমি তো পুরুষ মানুষ। তোমার এতো ভেঙ্গে পড়া কি সাজে? যদি সত্যি আমায় ভালোবেসে থাকো, তাহলে দেশ বিদেশ ঘুরে হলেও এমন গুণ তুমি শিখে এসো। যাতে অসাধ্য অনেক কিছুই তুমি সাধন করতে পারো। বরং তার জন্য যদি কোন অর্থকড়ির প্রয়োজন হয়, তাহলে তা-ই বলো। আমি সংস্থান করবো।
রাজার সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার মানিক দর্প নারানের ছেলে পাড়ার আরেক যুবক সুমন্ত। লালমতিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু লালমতি কিছুতেই তাকে সহ্য করতে পারে না। তবুও সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে লালমতিকে তার মনের কথা বলতেই হবে। কথাগুলো বলেই ফেলবে ঠিক করে লালমতির কাছে আসার সময় আড়াল থেকে হেমন্ত আর লালমতির কথোপকথন শুনে ফেলে সুমন্ত। তাই, তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিয়ে সে গুণ শিখার জন্য পরদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কামার, কুমার, যুগি, বারৈ, তিলি, বামন ইত্যাদি জাতির এলাকায় ঘুরে ঘুরে সুমন্ত এমন এক দরবেশের আশ্রমে গিয়ে পৌঁছে। যেখানে সে মন্ত্র শিখে অতিমানবীয় গুণ অর্জন করে।
এদিকে হেমন্তও বেরিয়েছে মন্ত্র শেখার অভিযানে। নানা গ্রাম আর শহর ঘুরে হেমন্ত এক দরবেশের আখড়ায় গিয়ে উপস্থিত হয়। ফকির প্রথমে তাকে একটি কালোবই দেন। হেমন্ত বারোটি মাস ধরে কালো বই পড়ে কোন ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়। ফকির একে একে তিনটি বই তাকে পড়তে দেন। এভাবে তিন বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করে পড়তে থাকে হেমন্ত। এক সময় দেখা গেল, সারাদিন বিরামহীন মন্ত্রের বই পড়ার পর রাতে হঠাৎ তার শরীরের আকার আকৃতি পাল্টে যায়। পশুর মতো চেহারা হয়ে যায়। হেমন্ত ফকিরকে গিয়ে বলে, আপনার তিনটি বই পড়ার পর রাতে আমার রূপ পশুর মতো হয়ে যাচ্ছে। এখন কি উপায় হবে? ফকিরের আরো একটি বই নিয়ে আরো এক বছর অধ্যয়ন করে হেমন্ত। কিন্তু পশুর রূপ তার পরিবর্তন হয় না। ডানা ছাড়া উড়তে পারে না। তবে শিং ছাড়াই গুঁতো মারতে পারে। ফকির নির্দেশে হেমন্ত মা দূর্গার বন্দনা করলে মা দূর্গা তাকে আশীর্বাদ করেন, তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন মানবীয় কোন অস্ত্র দিয়ে কেউ কোনরূপ ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে বারোটি বছর অতিক্রম করতে পারলে হেমন্ত অতিমানবীয় গুণ পাবে। তখন পৃথিবীর কোন শক্তিই আর পরাস্ত করতে পারবে না।
হেমন্ত লালমতির স্বপ্নে দেখা দিয়ে তার দুর্দশার কথা বলে এবং তাকে কিনে আনার জন্য অনুরোধ করে। লালমতি তার ভগ্নিপতিকে হাটে গিয়ে পশুরূপী প্রেমিককে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করে। তার ভগ্নিপতি নানা বাজার ঘুরে কাঙ্খিত ছাগলের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।
লালমতি একদিন স্বপ্নে দেখে, স্বচ্ছ একটি জলাশয়ে ছোট্ট মাছগুলি খেলা করছে। পাশের একটি লটকন গাছে অনেকগুলো লটকন ধরেছে। লালমতি তার স্বপ্নের কথা দাদুকে গিয়ে বলে। দাদু তাকে বলেন, তোমার একটি সুখবর আসছে। পুরনো একটি দোকান থেকে রূপোর আংটি কিনে আঙুলে পরলে তোমার সুদিন আসবে। দাদু লালমতিকে আংটির দোকানে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়। দাদুর নির্দেশনা অনুসারে পাহাড়, ছড়া, খাদ, জমি, উপত্যকা, মুলি বাঁশের ঝাড়, বুড়ো বটগাছ, লিচু, সুপারি ও নারিকেল গাছের সারি, নানা গ্রাম পেড়িয়ে বারো দোকানের মাঝখানে তেরো পাড়ার ভিতরে শংকর স্বর্নকারের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয় লালমতি। পথে পথে আংটির দোকানে যাওয়ার পথ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আংটির মাহাত্ম্য শুনে বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লার নারীরা লালমতির সাথে যোগ দেয়। স্বর্নকারকে তিনি সত্যি আংটি বানান কিনা জানতে চাইলে তিনি হ্যাঁ বোধক উত্তর দেন। অমনি লালমতির সাথে আসা সব নারী-পুরুষ আংটি কিনতে শুরু করে। লালমতি একটি আংটি নিয়ে দাম দিতে চাইলে স্বর্নকার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে- ‘বাবা ঠাকুরদার আমল থেকে বানানো সকল আংটি আজ তোমার কারণে মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে গেল। শেষ আংটিটি তুমি কিনতে চেয়েছো। এই আংটির দাম আমি নিতে পারবো না। ’ বিনামূল্যে অচেনা এক স্বর্নকারের কাছ থেকে আংটি নিলে লোকে দুর্নাম করবে বলে লালমতি জানালে স্বর্নকার বলে, তুমি তো আর বিনামূল্যে চাওনি। আমিই দিচ্ছি। মনে করো আমি তোমার দাদা।’ অগত্যা লালমতি আংটিটি বিনামূল্যে গ্রহণ করে।
স্বপ্নাদেশ অনুসারে লালমতি তার প্রেমিককে কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে। ছাগলটি সারাদিন গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। রাতে ঘরে বন্দি থাকে। দেড় মাস এভাবে চলার পর হঠাৎ ছাগলটি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আজ কারোর ফুলের বাগান নষ্ট করলো তো কাল কারোর ফুলের কলি খেয়ে ফেলে। আরেকদিন কারোর ঘরের খুঁটি ভেঙে ফেলে অথবা উঠোনের ঘেরা ভেঙে দেয়। গ্রামবাসীরা লালমতিকে তার ছাগল বেঁধে রাখার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু সারাদিন ঘরে বন্দি করে রাখলে ছাগলটি কি খাবে? তাই লালমতি কোনমতেই ছাগলটিকে বেঁধে রাখে না। এতে ছাগলের বেপরোয়া ভাব দিন দিন বাড়তে থাকে। কখনো জ্বালানি কাঠ খুঁজতে যাওয়া নারীদের ঝুড়িতে গিয়ে গুঁতো মারে, কখনো বাঁশ কাটতে যাওয়া যুবকদের পিছনে তাড়া করে। শিশুরা উঠোনে খেলা করলে সেখানে গিয়ে ভয় দেখায়। নারীরা কলাপাতা কাটতে গেলে সব পাতা গিয়ে খেয়ে ফেলে। গ্রামবাসীরা লালমতির ছাগলের বিরুদ্ধে গ্রাম প্রধানের কাছে নালিশ দেয়। কিন্তু লালমতি নানা যুক্তি দিয়ে পার পেয়ে যায়।
এক রাতে লালমতির বৌদি দেখে ফেলে, লালমতির ছাগলটা দিব্যি হেমন্তের রূপ ধরে লালমতির সাথে বসে প্রেমালাপ করছে। লালমতির বৌদি বিষয়টিকে গ্রামের কয়েকজনকে বলে। গ্রামবাসীরাও গোপনে গিয়ে তাদের এই গোপন অভিসারের দৃশ্য দেখে আসে। এদিকে দিনের বেলা ছাগলটির উপদ্রব দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জুমে আর কোন সবজি অবশিষ্ট থাকলো না। ফুল বাগানে রইলো না কোন ফুল। শিশুরা ভয়ে খেলা করতে পারলো না উঠোনে। নারীরা যেতে পারলো না তাদের দৈনন্দিন কাজে। পুরুষরা ভয়ে ঘরে বন্দি থাকলো। গ্রামের সকলে মিলে রোয়াজার (গ্রামের প্রধান) নিকট আবার আপত্তি জানালো। রোয়াজা বিচার করে লালমতিকে সাত টাকা জরিমানা করলো। সে রাতে লালমতি আবার তার প্রেমিকের সাথে দেখা করে। পশুরূপী প্রেমিক হেমন্তকে সাতকথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হেমন্ত অকপটে স্বীকার করে, যখন সে পশুর রূপে ফিরে যায়, তখন মানবজীবনের কোনকিছুই তার মনে থাকে না। তাই তার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। সে দিনের বেলায় তাকে বেঁধে রাখার জন্য লালমতিকে অনুরোধ করে এবং তার সাথে সাথে থাকতে বলে। লালমতি পাশে থাকলে হেমন্ত শান্ত থাকে। কিন্তু লালমতি দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যস্ততার কারণে চোখের আড়াল হলেই হেমন্তের পশুত্ব শুরু হয়ে যায়।
গ্রামের লোকেরা এবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। এবার তারা আর রোয়াজা বা মুরচই-এর কাছে নয়, স্বয়ং রাজার কাছে গিয়ে নালিশ জানালো। এ যাবৎ ছাগলটি কি কি ক্ষতি সাধন করেছে, সব বয়ান লিখে তারা রাজার কাছে জমা দিল। রাজা সকল স্বাক্ষী প্রমান বিচার করে রাজ্যের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হলেও ছাগলটাকে ধরে আনার জন্য হুকুম দিলেন। রাজার হুকুম পেয়ে তাঁর সৈন্যবাহিনী বিশাল হাতির পাল ও ঘোরসওয়ারের দল নিয়ে উজানের দিকে কাঁচাপুর থেকে ভাটির উজিপুর পর্যন্ত ঘেরাও করে ছাগলটিকে ধরার জন্য যুদ্ধের আয়োজন করলো। এই কাজে এলাকার আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলকে অংশগ্রহণ করার জন্য হুকুম জারি করা হলো। গ্রামবাসী ও রাজার সৈন্যরা চারিদিক থেকে ঘিরে ছাগলটাকে হাতের দা, বর্শা, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে আক্রমন শুরু করলে ছাগলটি তার শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করে তেড়ে আসে। ফলে মাটি, আকাশ, বাতাস নড়ে উঠলো, মেঘের গর্জনের মতো আওয়াজ হতে লাগলো, হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া ধ্বংস হলো। আক্রমনকারীরা দিকবিদিক হারিয়ে পালাতে লাগলো। প্রানে বেঁচে যারা পালাতে সক্ষম হলো, তারা রাজার কাছে গিয়ে তাদের দুদর্শার কথা জানালো। রাজা এবার আরো বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রমন চালানোর জন্য হুকুম দিলেন। এবার রাজার সুদক্ষ সেনা নায়করা যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ছাগল শিকারের অভিযানে নামলো। তারা অগ্রবর্তী সৈন্যদের পাঠিয়ে লালমতিকে খবর দিল সে যাতে তার ছাগলটাকে ছেড়ে না দেয়। তাই শুনে ছাগলের গলা জড়িয়ে ধরে লালমতি কাঁদতে থাকে-
বিয়ৈ তনানি রুংয়াবা বারি উমায়া খুম খাকচা নুখুই দুখিনি জুকমালাই আংবো মানলিয়া দিন খাকচা পশু হিনৈদে দাদায়ই নুংলাই মকলবাই নুলাংজাক নুংলাই খাপাংবাই সিলাংজাক নন অংজাকদৈ অংজাকয়া যত মায়ানো নুংলাংখা গোঁসাই রাজানি সামুংলাই সইন্য এরাওগই হলই দং রকখা অংনানি করইখা বসর বালরগৈ মাতংয়া মাসে বালরগৈ মাতংয়া ননো তবইয়ৈ ফাইকালাই যত সুতুরু বাচাজাক তাখুক গাম করই খুকসাবাই কাইসা সায়াফুং সাথগো কাইসা হিনয়াফুং হিনথগো রাজা হাউলদার সকফাইদং রাজা জমাদার সকফাইদং খামা সাইচিদক বের রদং সাকা লাখাদক বের রদংআমার বর চাওয়াটাই হয়তো বা ভুল ছিল। দেব দেবির কাছে হয়তো আমি ঠিকভাবে আর্শীবাদ চাইতে ব্যর্থ হয়েছি। যতই পশু হও তুমি। নিজের চোখেই তো সবকিছু দেখে গেলে। তোমাকে রক্ষা করার জন্য কতকিছু করেছি আমি। একটি দিনও ভালো করে কাটাতে পারিনি। রাজার কারবার তুমি দেখেছো। তোমাকে ধরার জন্য সৈন্য পাঠাচ্ছে। চারিদিকে শত্রুর দল ঘিরে ফেলেছে। আমার নেই কোন ভালো ভাই বোন, যারা আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। শত্রুরা লাখে লাখে সমবেত হচ্ছে।
লালমতির বিলাপ শেষ হতে না হতে যুদ্ধের দামা বেজে উঠলো। চারিদিক থেকে রাজার সৈন্যদল তাদেরকে ঘিরে ফেললো। তারা লালমতিকে ছাগলের গলা ছেড়ে উঠে আসার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। লালমতি চরম দুদর্শাগ্রস্ত স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে আগলে থাকলো। রাজার সেনাপতির আদেশে লালমতির আত্মীয় পরিজনরা তাকে ধরে সেখান থেকে নিয়ে আসলে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম চারিদিক থেকে কামানসহ নানা মারনাস্ত্র বসিয়ে গুলি চালানো হলো। এবারও রাজার সৈন্যরা ব্যর্থ হলো।
ককবরক সাহিত্যে দ্বিতীয় নায়িকা রাইবতি। কাংখং বুড়ার আদুরে কন্যা। ছাগলটিকে ধরা বাব বধ করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে রাজা চারিদিকে ঢোল পেটানোর জন্য ঢুলি পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউই ঢোল ধরে না। রাজ্যময় ঘুরে ঢোল পিটিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত ঢুলিরা রাত কাটানোর জন্য রাইবতিদের গ্রামের রোয়াজার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সন্ধ্যায় একজন আগন্তুকও তাদের সাথে এসে যোগ দেয়। রাতে দুই ঢুলি আর আগন্তুক মিলে রাইবতিদের ঘরে বেড়াতে যায়। রাইবতির বাবা কাংখং বুড়া আগন্তুকের কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থ করেন। ত্রিপুরা সামাজিক প্রথা ও বিধি অনুসারে আগন্তুক যুবকের সাথে রাইবতির বিয়ে সম্পন্ন হলো। তারা একসাথে জুমে যেতে লাগলো। বনের নানা সবজি ও জ্বালানি কাঠ একসাথে আহরণ করতে লাগলো। ছড়ায় গিয়ে মাছ ধরতে লাগলো আর পাখি শিকার করতে লাগলো। আগন্তুকের সাথে রাইবতির বিয়ে ঢুলিরা মানতে পারেনি। তাই তারা গোপনে তার পরিচয় জানার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। একসময় ঢুলি দুইজন সংগোপনে রাইবতি ও তার মায়ের কথোপকথন শুনতে পেল। রাইবতি বলছে, সে তার স্বামীকে জুমে পাখি শিকার করার সময় পাখিদের সাথে উড়ে উড়ে মেঘের আড়াল পর্যন্ত উঠে যেতে দেখেছে। আগন্তুক যুবকটি আর কেউ নয়। মন্ত্র শেখার জন্য দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়া সুমন্ত। তা শুনে ঢুলিরা রাজাকে জানালো। রাজা বিস্তারিত শোনার পর দুই ঢুলিকে আবার রাইবতিদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। পরের দিন গ্রামবাসীরা মিলে ‘কামি মাই খুলুম’ পূজা অর্থাৎ শস্য দেবির পূজা আয়োজন করে সুমন্তকে সেখানে যেন ‘তানসরাই’ বা ‘কসাই’-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাও বলে দিলেন।
রাজার আদেশ অনুযায়ী রোয়াজার বাড়িতে পূজোর আয়োজন করা হলো। ভোজনপর্ব শুরু হলে মদ্য ও আহারাদি গ্রহণের জন্য অতিথিদের অনুরোধ করার ফাঁকে রোয়াজা কৌশলে ছাগলের উৎপাতের কথা সকলের সামনে আলোচনা শুরু করেন এং ছাগলটিকে কেউ বশ করতে অথবা বধ করতে পারলে রাজার অর্ধেক রাজ্য, অঢেল অর্থ ও অর্ধেক ধনম্পদ তাকে দেওয়া হবে বলে জানান। মদ্যপানের ফলে কিছুটা সম্বিৎ হারানো কাংখং বুড়া বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে তার জামাতার অতিমানবীয় ক্ষমতার কথা ফাঁস করে ফেলেন এবং তাকে দিয়ে এই বাজি ধরার প্রত্যয় করেন। কাংখং বুড়ার জামাতাকে পরখ করে দেখার জন্য রোয়াজা একটি শর্ত দেন। শর্ত অনুসারে চোখের নিমেষে তার জামাতাকে গ্রামের সকলের মাচাং থেকে একটি টুকরো বাঁশ নিয়ে আসতে বলা হয়। তৎক্ষনাৎ চোখের পলকেই গ্রামের সকল ঘরের মাচাং থেকে বাঁশের নমুনা কেটে এনে দিল সুমন্ত। ডানা ছাড়াই তাকে উড়ে যেতে দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে গেল। কারোর মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। নিমন্ত্রন খেতে আসা অতিথিরা ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ ভয় পেয়ে গেল। কেউ অনেকক্ষন ঘোরের মধ্যে থাকলো। কেউ না খেয়ে ভয়ে পালিয়ে গেল, কেউ অর্ধেক খেয়ে আর খেতে পারলো না। রাইবতি তার স্বামীকে অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোর জন্য উস্কে দেওয়ায় তার বাবাকে বৎসনা করতে লাগলো-
পুর্বে য়াফাংগ আং সাজাক আরাই অংগন আং সিজাক ফায়া ফাবুরা কাইসাবো আনি ককমুংনো খানায়া নকগো মই ফনসা মাচাখাই নকগো চক খাপসা মানুংখাই সায়া ককমুংনো সালাংগ হিঁয়া ককমুংনো হিঁলাংগ মিঁয়া ফাইমানি চামিরি তামা পুন্দানো রমজাকনাইএমন কিছু ঘটবে তাতো আমি আগেই জানতাম। বুড়ো মানুষের কোন জ্ঞান বুদ্ধি আর নেই। এক ফোঁটা মদ মুখে পড়লেই হাজারো প্যাঁচাল শুরু করে। কালই তো তার নতুন জামাই এখানে আসলো। আর তাকে কিনা পাঠানো হবে অসুর বধ করতে? সুমন্ত তার স্ত্রীকে সান্তনা দিয়ে বলে, এতো দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ছাগলটিকে বধ করতে যাচ্ছি ঠিক। আমার নিজের শক্তি দিয়েই আমি তাকে বধ করবো। শ্বশুর বাবা কথা দিয়ে ফেলেছেন। তাই তাঁর বাক্য রক্ষা করার জন্য হলেও আমাকে এই লড়াইয়ে জিততে হবে। রাজা যাবতীয় প্রস্তুতিসহ অজবধ করার জন্য সুমন্তকে নির্দেশ দিলেন।
সংবাদটি শুনেই লালমতি গভীর রাতে তার প্রেমিককে আসন্ন বিপদের কথা জানায়। সকাল হলেই হেমন্তকে বধ করার জন্য দক্ষ একজন অতিমানবীয় বীর আসবে। হেমন্ত লালমতিকে সান্তনা দিয়ে বলে, দোষ কারোর নয়। বিধিতে হয়তো এমনই লেখা ছিল। আমি যদি পুর্নাঙ্গ মন্ত্র শিখে আসতে পারতাম, তাহলে আজ এই দশা হতো না। অথবা এতো তাড়াতাড়ি ফিরে না এসে আমি যদি ফকিরের দেশে থেকে যেতাম, তাহলে আমার কেউ ক্ষতি করতে পারতো না এবং আমি অসীম ক্ষমতা নিয়ে দেশে ফিরতাম।
লালমতি নিজের মনকে সান্তনা দেওয়ার জন্য ভোরের মোরগটিকে একটু দেরিতে ডাকার জন্য অনুরোধ করে। যেন সকালটা একটু দেরিতে আসে।
দগই তা কুচুই তকজালা দগই কুচুইঅ হিনকালাই বাইলিং কুচুইবাই মাই রনাই লংবাই কুচুইবাই তই রনাই‘এতো সহসা ডাক দিও না প্রিয় মোরগ আমার। তুমি যদি সকাল সকাল ডাকো, তাহলে আমার বিপদ দ্রুত কাছে চলে আসবে। আমার কথা না শুনলে তোমায় আমি ভালো কুলোয় খাবার দেবো না, ভালো থালায় পানি দেবো না।’ এভাবে কখন যেন রাত কেটে যায়। সকাল হয়ে সূর্যের তাপ ধীরে ধীরে প্রখর হতে থাকে। তার সাথে সাথে রাজার সৈন্যরা লালমতির বাড়ি ঘিরে ফেলতে থাকে। অপরাহ্ন সময়ে সুমন্ত বীরবেশে আশি মণ ওজনের একটি খড়গ কাঁধে নিয়ে লালমতির উঠোনে এসে হাজির হয়। সে লালমতিকে ছাগলরূপী তার প্রেমিককে তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। লালমতি বলে-
আনি পুন্দানো তানমানি নিনি নুখুইবো তানজাকথং বিনি নুখুংনি নুং ফাইয়ই তাংগই চানানি আসাবা আসা বিফলো থাংলাংথংআমার প্রেমিককে তুমি যেভাবে বধ করবে, তোমার স্ত্রীকেও ঠিক সেভাবে কেউ বধ করবে। দূর দেশ থেকে সুখে সংসার করার আশায় তুমি এখানে এসেছো। তোমার সে আশা কখনোই পূরণ হবে না।
শাপ-শাপান্ত করার পরও লালমতির শেষ রক্ষা হয় না। লালমতির সমস্ত পরিধেয় ও গয়না সামগ্রী জোর করে নিয়ে নেয় সুমন্ত। কিন্তু সেই পুরনো দোকান থেকে ক্রয় করা আংটিটি সন্ধান সে পায় না। কামানের মুখেও লালমতি আংটিটি বের করে দিতে নারাজ। এই আংটি পাওয়া না গেলে ছাগল বধ করা সম্ভব হবে না। রাজার গণক পন্ডিতরা সর্বজ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করে নানা সূত্র দিয়েও আংটি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। পরে তারা রাজার সৈন্যদের ডেকে জানতে চায় লালমতির ঘরের ভিতর কি কি ধরণের আসবাবপত্র আছে। পন্ডিতদের নির্দেশনা অনুসারে সৈন্যরা লালমতির রূপোর পালংকের একটি পায়ায় একটি ছিদ্রে সংরক্ষিত আংটিটি খুঁজে পায়। এই খোঁজাখুঁজির ফাঁকে লালমতি তার ছাগলকে ছেড়ে দেয়। সুমন্ত শহর-গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজে ছাগলে খোঁজ পায় কিন্তু তান্ত্রিক উপায় ছাড়া তাকে ঘায়েল করার কোন উপায় না দেখে বারোই গ্রামের তান্ত্রিকসিদ্ধ এক পরিবারের সহযোগিতা চায়। বারোই পরিবার চারটি পানের পাতা নিয়ে মন্ত্রপুত করে সুমন্তের হাতে তুলে দেয়। সুমন্ত লালমতির পোশাক-পরিচ্ছদ ও গয়নাগুলো পরে, রূপোর আংটিটি সাথে নিয়ে লালমতির রূপ ধরে মন্ত্রপুত পান হাতে নিয়ে ছলনা করে ছাগলটিকে ডাকতে ডাকতে চললো। ছলনায় বিমোহিত হয়ে প্রেমিকার রূপ নেওয়া তার শত্রু সুমন্তকে সত্যি সত্যি লালমতি ভেবে হেমন্ত তার হাতের মন্ত্রপুত পানপাতা খেয়ে ফেলে। পানপাতা খাওয়ার সাথে সাথেই হেমন্তের দেহের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একে একে অবশ হতে থাকে এবং সে সুমন্তের হাতে বন্দি হয়ে পড়ে আর ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
লালমতি এখন উদ্ভ্রান্ত এক যুবতি বিধবা। এলোচুলে প্রলাপ বকে চলে সে। স্বামীর মৃত্যুশোকে ব্যাকুল লালমতি ছন্দের জাল বুনে যেভাবে তার প্রলাপগুলো বকে চলে তা খুবই হৃদয়বিদারক। তার এই কান্না শুনে আকাশ-বাতাস প্রকৃত অর্থেই ভারি হয়ে ওঠে।
খতি তাঅংদি দাদায়ই নুংলাই থুইমানি দিনোলাই কুচুক তকলিংসিং তক অংগই চুমুই তকাসুক অংফুগ চুমুই বেসেরো নুং হাবই চুমুই খা রগৈ চুরুইদি নুখুই দুখিনি জকমালাই নুংবাই তংমানি জাগানো জাগা য়াক বগই কাবোনো খুমুই হিলকসা নুং অংগই বফাং খা-রগই চুরুইদি নুংবাই হেমমানি লামানো লামা আচগই কাবোনোএলোচুলে কড়া রোদ পড়লে অথবা আকাশে কালো মেঘ জমে উঠলে এভাবে প্রলাপ বকে চলে নারীটি। প্রলাপে সে বলে, ‘মনে দুঃখ নিও না দাদা! তোমার মরনের পরে দূর আকাশে মেঘমালা খেলা করলে চিল হয়ে তুমি মেঘের ভিতর থেকে সর্বশক্তি দিয়ে ডেকে যেও। বিরহী দুখি বধু আমি, তোমার সাথে যেখানটায় বসে আমরা প্রেমালাপ করতাম, সেসব জায়গায় আমি হাত বুলিয়ে কাঁদবো। অথবা বিরহী উল্লুকটি হয়ে জোরগলায় আমায় ডাক দিও। তোমার সাথে যেসব পথে আমরা একসাথে হেঁটেছি, সেসব পথে বসে আমি কাঁদবো।’ সে যেন চিরচেনা ত্রিপুরা লোকসমাজের বিরহী বধুদের প্রকৃত প্রতিনিধি। যে ভালোবাসতে জানে। বিরহের কান্নায় ভাসতে জানে। অন্যকেও ভাসাতে জানে। মরনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিপদশংকুল প্রেমিককে বুকে আগলে রাখতে জানে। জয়তু লালমতি!
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।