ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা ককবরক : একটি সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল
4015
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অধিকারী জনজাতিসমূহের মধ্যে অন্যতম। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা ককবরক।
ঐতিহাসিক বিচারে এই ভাষাটি চীনা-তিব্বতীয় বা ভোট-চীনীয় বা সিনো-টিবেটান ভাষার অন্তর্গত। ভাষা বিশ্লেষকদের মতে সিনো-টিবেটান ভাষার তিনটি মূল শাখা রয়েছে। যেমন- (ক) চীনীয় (Chinese), (২) থাই (Thai) এবং (৩) ভোট-বর্মী (Tibeto-Burmese)।
ভাষাবিদ কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী মহোদয় আবার সিনো-টিবেটান ভাষার দুইটি মূল শাখার কথা উল্লেখ করেছেন- (১) ভোট-বর্মী (Tibeto-Burmese) ও (২) শ্যাম-চীনীয় (Siamese-Chinese)।
ভোট-বর্মী শাখাটি বার্মা, তিব্বত, আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। এই শাখার অসংখ্য উপ-ভাষা রয়েছে।
এর মধ্যে হিমালয়ান গ্রুপ, উত্তর আসাম গ্রুপ, তিব্বতী গ্রুপ, আসাম-বর্মী গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত। আসাম-বর্মী গ্রুপের অধীনে রয়েছে বোডো-নাগা, মিকির, বর্মী-কুকিচীন গ্রুপ।
বোডো-নাগা ভাষাগোত্রের বোডো ভাষা আবার কালের বিবর্তনে নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে; যেমন- আধুনিক বোডো, ককবরক, দিমাসা, কোচ, মেচ, চুটিয়া, রাভা, হাজং, গারো ইত্যাদি।
শব্দভান্ডার ও ব্যাকরণের দিক থেকে ককবরক অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা। এটি বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম রাজ্যভাষা।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমনকাহিনীতে সপ্তম শতকে এই উপমহাদেশে ‘বর’ নামের একটি জনগোষ্ঠির রাজত্বের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
ইতিহাসের পথপরিক্রমায় কোন এক ‘বর’ রাজপুত্র তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র (তৈয়ুং), গঙ্গা (সেংগ্রংমা) ও বরাক (বরক তৈমা) নদীর মোহনায় এসে রাজ্য পত্তন করেছিলেন।
ত্রিপুরাদের ভাষা ককবরকে নদীর মোহনাকে তৈবপ্রা বা তৈপ্রা বলায় একসময় এই জনগোষ্ঠির নাম তৈপ্রা থেকে ত্রিপুরায় পরিনত হয়।
পরে এই জনগোষ্ঠি উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্যাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যার নামও ত্রিপুরা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বৃটিশ দলিলপত্রে এই রাজ্যের নাম টিপেরা (Tipperah) লেখা হয়। তবে সাহিত্য ও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থে ‘ত্রিপুরা’ নামেই বেশি প্রচলিত।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মায়ানমারসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ককবরকভাষী জনগণের বসবাস রয়েছে বলে জানা যায়। সরকারি সূত্র অনুসারে বাংলাদেশে এই জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় এক লক্ষাধিক।
জনসংখ্যার দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি। দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির তুলনায় ত্রিপুরাই একমাত্র জাতিগোষ্ঠি, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও দেশের বিভিন্ন জেলায় বসবাস করছে।
তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ঢাকা, রাজবাড়ী, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠির বসবাস চোখে পড়ে।
ককবরক- মানুষের ভাষা, বরক জনগোষ্ঠির ভাষা। সাধারণ অর্থে ‘কক’ অর্থ ‘ভাষা’ এবং ‘বরক’ অর্থ ‘মানুষ’ বোঝালেও ‘ককবরক’ মানে বরকদের ভাষাকেই বোঝানো হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ককবরকভাষী জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ বলে ধারণা করা হয়।
পূর্বে ‘কলমা’ নামের একটি বিশেষ হরফে ককবরকে লেখা হতো বলে জানা যায়। ত্রিপুরা মহারাজাদের বংশানুক্রমিক পরিচয় নিয়ে লেখা ‘রাজরত্নাকর’ নামের পুস্তকটি দুর্লভেন্দ্র চন্তাই নামের একজন পুরোহিত কর্তৃক কলমা হরফে লেখা হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বরাতে জানা যায়।
পরে শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর পন্ডিতদ্বয়ের মাধ্যমে এটি সংস্কৃত ও বাংলায় অনুবাদ করা হয়।
প্রায় ৫০০০ বছর ধরে ১৮৪ জন স্বাধীন মহারাজা বিরতিহীনভাবে ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ত্রিপুরা যতই আধুনিক হয়েছে, ততই সেখানকার আদি অধিবাসীদের ভাষা ককরবক চরম অবহেলার শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের প্রেক্ষাপটে ১৯ শতকের শেষার্ধে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬) তাঁর মাতৃভাষা ককবরকের পরিবর্তে বাংলাকে রাজকার্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন বা গ্রহণ করেন।
ফলে সাধারণ্যের ভাষা ককবরকের চুড়ান্ত বিপর্যয় তরান্বিত হয়।
আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বময় সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের মাতৃভাষা ককবরকের লিখিতরূপ দানের প্রক্রিয়াতে হরফ নিয়ে রশি টানাটানি দীর্ঘকাল ধরে চলমান থাকলেও বাংলা ও রোমান উভয় লিপিতেই এ ভাষার লেখক, গবেষকগণ লেখালেখি করে যাচ্ছেন।
আমার ব্যক্তিগত মত হল, যে কোন লিপিতেই ককবরক লেখা যেতে পারে। রাজনৈতিকগণ যেকোন দৃষ্টিতে দেখুন না কেন লেখকের স্বাচ্ছন্দ্যতার উপরই নির্ভর করে তিনি কোন লিপিতে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে চান।
এ বিষয়ে ভাষা গবেষক ড. ফ্রাঁসিস জেকুইসন লিখেছেন- From a linguistic point-of-view, the script is not much important, because a language lives when it is spoken. You may write Kokborok with the Bengali script if you feel like it, or with the Roman script if you find it better, or any other script you may like.
বাংলাদেশে ককবরক লেখার জন্য লিপি নির্বাচনের কোন বিতর্ক নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত ত্রিপুরাদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ এ ব্যাপারে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার লক্ষ্যে ২০০১ ও ২০০৩ সালে পৃথক পৃথকভাবে কর্মশালার আয়োজন করে।
এই কর্মশালায় বহু ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের পর সিদ্ধান্ত হয় যে, রোমান হরফেই ককবরক লেখালেখি করা হবে।
এই সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হিসেবে ককবরক উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়।
যা পরবর্তীতে ককবরক রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামের একটি সহযোগী সংগঠনের রূপ লাভ করে। এই ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে কর্মশালা করে রোমান লিপিতে ককবরক লেখার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাষাবিদ, ভাষা বিষয়ক বিশেষায়িত সংস্থা ও ব্যক্তিদের সহায়তাও নেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে খাগড়াপুরস্থ জাবারাং রিসোর্স সেন্টারে আয়োজিত কর্মশালায় ককবরক লেখার জন্য সুনির্দ্দিষ্ট পদ্ধতি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
ককবরকের ধ্বনি (Tone)
ভাষা গবেষক ড. ফ্রাঁসিস জেকুইসন ককবরক লেখার জন্য ৬ টি স্বরধ্বনি ই, এ, অৗ (উ এবং ও-এর মাঝামাঝি উচ্চারণ), আ, অ, উ (এখানে ইংরেজি এ + আই যুক্ত করে ‘আই’ এবং ডব্লিউ + আই যুক্ত করে ‘ঐ’ দুটি ‘যুক্ত-স্বরধ্বনি’ বা ‘ডিপথাং’-এর কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন) এবং ২০ টি ব্যঞ্জনধ্বনি ম, ন, ং, ব, গ, প, ত, ফ, থ, খ, জ, চ, স, র, ল, হ, য়, ওয়া এবং দুইটি নিম্ন ও উচ্চস্বরের কথা উল্লেখ করেছেন।
রোমান হরফে লেখার ক্ষেত্রে ককবরকে নিম্ন স্বর ও উচ্চস্বরের ধ্বনি বোঝানোর জন্য উচ্চস্বরের ক্ষেত্রে নিম্নস্বর ধ্বনির শেষে একটি এইচ (h) বসানো হয়। যেমন-
চা (cha)- সঠিক (correct), চা (chah)- খাওয়া (to eat)
লাই (lai)- সহজ (easy), লাই (laih)- অতিক্রম করা (to cross)
ককবরক লেখার জন্য রোমান লিপির ভাওয়েল-এর ব্যবহার
I, i ইংরেজীতে Ink (ইঙ্ক) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Isri, Iskul – যার অর্থ ইংরেজীতে The Queen, The School এবং বাংলায় রানী, বিদ্যালয়।
E, e ইংরেজীতে Emperor (এম্পেরর) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Er, Ter – যার অর্থ ইংরেজীতে To increase, Festival এবং বাংলায় বৃদ্ধি পাওয়া, উৎসব।
W, w এটি একটি সেমি-ভাওয়েল অক্ষর। ইংরেজীতে (U)Wake (ওয়েক) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Rwng, Twi – যার অর্থ ইংরেজীতে To learn, Water এবং বাংলায় শেখা, পানি।
অন্যভাবেও ব্যবহার হয়, যখন Watwi (ওয়াতৈ) লিখতে হয়। তখন এটি সেমি কনসোনেন্ট-এর মতো হয়ে যায়।
বাংলায় যারা ককবরক লেখালেখি করেন, তাঁরা ককবরকের এই বিশেষ ধ্বনি প্রকাশের জন্য বিশেষ একটি স্বরচিহ্ন (ৗ) ব্যবহার করেন, যা বাংলায় সাধারণত পৃথকভাবে ব্যবহৃত হয় না।
এই ধ্বনিটি ও এবং উ-এর মাঝামাঝি। রৗং, নৗং ইত্যাদি লেখার ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হয়। স্বরচিহ্নটি সাধারণত বাংলা ঔ-কার (ে ৗ) লেখার জন্য এ-কার (ে )-এর সাথে যৌথভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
A, a ইংরেজীতে Apple (আপল) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Apha, Ama – যার অর্থ ইংরেজীতে My Father, My Mother এবং বাংলায় বাবা, মা।
O, o ইংরেজীতে Oblige (অবলাইজ) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Ok, Nok – যার অর্থ ইংরেজীতে The Belly, The House এবং বাংলায় পেট, বাড়ি।
U, u ইংরেজীতে Utgard (উটগার্ড) লিখতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়। ককবরক উদাহরণ হতে পারে Ul, Chuchu – যার অর্থ ইংরেজীতে Behind, The Grandfather এবং বাংলায় পেছনে, ঠাকুরদা।
বিশেষ বর্ণসমূহ (Special Characters)
â (আঁ) ê (এঁ) î (ইঁ) ô (অঁ) û (উঁ)
ভাষা বিশেষজ্ঞ জন ক্লিফটনের সাথে একটি কর্মশালায় নাসিক্য ধ্বনি প্রকাশের ক্ষেত্রে রোমানের কোন অক্ষর নির্বাচন করা যায় এ ব্যাপারে পরামর্শ করা হয়।
এ ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত রোমান লিপির অনুরূপ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। বিস্তারিত আলোচনার পর কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ককবরকের লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষকরা স্বরবর্ণের (ভাওয়েল) উপরে টুপির মতো দেখতে একটি চিহ্ন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
নাসিকা ব্যবহার করে উচ্চারণ করতে হয়, এমন শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ ভাওয়েল ব্যবহার করা হয়। যেমন- âtha (আঁথা)- উচ্ছিষ্ট, êsai (এঁসাই)- বাঁশের তৈরি বেড়া বিশেষ, î (ইঁ)- হ্যাঁ, ô ô (অঁ অঁ)- ওহ্ তাই নাকি, ûmo (উঁ-ম)- ঐটা।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই রীতিতে নাসিকা ধ্বনি প্রকাশে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। সাধারণ নিয়মে লিখেও নাসিক্য ধ্বনি প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন- antha (আঁথা, আন্থা নয়)- উচ্ছিষ্ট, ensai (এঁসাই, এনসাই নয়)- বাঁশের তৈরি বেড়া বিশেষ, in (ইঁ, ইন নয়)- হ্যাঁ, on on (অঁ অঁ, অন অন নয়)- ওহ্ তাই নাকি, unmo (উঁ-ম, উনম নয়)- ঐটা।
এ প্রসঙ্গে আমি ফ্রেন্স ভাষায় ব্যবহৃত কিছু শব্দের উদাহরণ দিতে পারি। যেমন- ইংরেজী বা রোমান হরফে তারা Nepoleon লিখলেও তা ‘নেপোলিয়ন’ না হয়ে উচ্চারিত হয় ‘নেপোলিওঁ’, অন্যদিকে Restuarant লেখা হলেও তার উচ্চারণ ‘রেস্টাউরান্ট’ না হয়ে উচ্চারিত হয় ‘রেস্তোরাঁ’।
যুক্ত বর্ণসমূহ (Conjoint Letter)
Ch (চ) Kh (খ) Ng (ঙ/ং) Ph (ফ) Th (থ)
C (সি)-কে বর্ণমালার তালিকায় আলাদা করে দেখানো হলেও এটি স্বাধীন বর্ণ নয়। চ উচ্চারণের ক্ষেত্রে এইচ-এর সাথে সি এর ব্যবহার করা হয়। যেমন- Chuchu (চুচু)।
খ ধ্বনি প্রকাশের জন্য K (কে) এবং H (এইচ) বর্ণদ্বয়ের সমন্বয়ে লেখা হয়। যেমন- Khitong (খিতং)।
F (এফ)-এর কোন বিশেষ প্রয়োজন ককবরকে প্রয়োজন না হওয়ায় P (পি) এবং H (এইচ) বর্ণদ্বয়ের সমন্বয়ে ‘ফ’ জাতীয় উচ্চারণের শব্দ গঠন করা হয়। যেমন- Apha (আফা)।
ককবরকে শব্দগঠন (Morphology)
গঠনগত দিক থেকে ককবরকের শব্দ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত; যেমন- ১) মৌলিক শব্দ, ২) সাধিত শব্দ
১) মৌলিক শব্দ: ককবরকের যেসব শব্দ বিশ্লেষণ করা যায় না বা ভেঙে আলাদা করা যায় না সেগুলোকে মৌলিক শব্দ বলা যেতে পারে। যেমন: থাং- যাওয়া, ফাই- আসা, বরক- জাতি, বরক- মানুষ, কতর- বড়ো, কতই- কনিষ্ঠ, করই- নাই ইত্যাদি
ককবরক মৌলিক শব্দ গঠনের প্রাথমিক উপায় হলো বর্ণের সাথে বর্ণ সংযুুক্ত করা। যেমন:
থা+ং = থাং
ফা+ই = ফাই
ব+র+ক = বরক
ক+ত+র = কতর
ক+ত+ই = কতই
ক+র+ই = করই
রোমান লিপিতেও অনুরূপভাবে শব্দের সাথে শব্দ সংযুক্ত করে ককবরকের মৌলিক শব্দ গঠন করা যায়। যেমন:
Th+a+n+g = Thang
Ph+a+i= Phai
B+o+r+o+k= Borok
K+o+t+o+r= Kotor
K+o+t+o+i= Kotoi
K+o+r+o+i= Koroi
২) সাধিত শব্দ: ককবরকের যেসব শব্দকে বিশ্লেষন করা যায় এবং বিশ্লেষন করলে আলাদা অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায়, সেগুলোকে সাধিত শব্দ (Compound Word) বলে। সাধারণত কোন মৌলিক ককবরক শব্দের সাথে ব্যাকরণিক উপদান যুক্ত করে সাধিত শব্দ গঠন করা হয়। ককবরক শব্দের অর্থ-বৈচিত্র সাধিত করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে শব্দের রূপ-রূপান্তর সম্পন্ন করা হয়। ব্যবহারিক প্রয়োজনে নানা অর্থে ব্যবহারোপযোগী করে কোন শব্দ বা শব্দাংশের সাথে অন্য শব্দ বা শব্দাংশের সম্মিলনে নতুন শব্দ গঠন করা হয়।
যেমন:
নাই+থক = নাইথক- সুন্দর (Beautiful)
Nai+thok = Naithok
(‘নাই’ মানে দেখা আর ‘থক’ মানে সুস্বাদু বা মজার মিলে ‘নাইথক’ হয়েছে, যার সরাসরি বাংলা রূপ হয় ‘দেখতে ভালো’ বা দেখতে মজার ইংরেজীতে ‘Good looking’)
বাখা+কতর = বাখাকতর- সাহসী (Brave)
Bakha+kotor = Bakhakotor
(‘বাখা’ মানে মন আর ‘কতর’ মানে বিশাল বা বড়ো মিলে ‘বাখাকতর’ হয়েছে, সরাসরি বাংলা রূপ হয় ‘বিশাল মন’ বা ইংরেজীতে ‘Big heart’)
ককবরক একটি সমৃদ্ধ ভাষা। এটি বিশ্বের অন্যান্য সমৃদ্ধ ভাষার মতো একই সাথে গতিশীল। প্রতিনিয়ত অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির উপাদান হতে ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণ ও বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ভাষা অগ্রসর হচ্ছে।
তাই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দ্বারা সমৃদ্ধ হচ্ছে ককবরকের রত্নভান্ডার। ককবরকের শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বা শব্দগঠন প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত উদাহরণ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
ক) প্রত্যয়যোগে শব্দগঠন: ককবরকের কোন শব্দ বা ধাতুর শেষে প্রত্যয় (Suffix) যুক্ত হয়ে এরূপ ককবরক শব্দ গঠিত হয় বা সৃষ্টি হয়। যেমন:
Ham+ya = Hamya
হাম+য়া= হাময়া- খারাপ- Bad
Surung+nai = Surungnai
সুরুং+নাই= সুরুংনাই- শিক্ষার্থী- Learner
Nok+sing+o = Noksingo
নক+সিং+গ = নকসিংগ- ঘরের ভিতর- Inside the house
Ro+nai = Ronai
র+নাই = রনাই- দিবে/ দিব- Will give
La+kha = Lakha
লা+খা = লাখা- নেওয়া হয়েছে- Has/ have taken
খ) উপসর্গযোগে শব্দগঠন: ককবরকের কোন শব্দের আগে উপসর্গ (Prefix) যুক্ত করে কোন নতুন অর্থবোধক শব্দ গঠন করা যায়। যেমন-
মা+ রগো = মারগো- দিতে হয়
Ma+rogo = Marogo- Have to give
ব+ফা = বফা- তার বাবা
Bo+pha = Bopha- Someone’s father
কা+থাং = কাথাং- জ্যান্ত
Ka+thang = Kathang- Alive
কু+মুন = কুমুন- পাকা
Ku+mun = Kumun- Ripped
বা+থাই = বাথাই- ফল
Ba+thai = Bathai- Fruit
গ) আত্মীকৃত শব্দ: ককবরকে কিছু আত্মীকৃত শব্দ রয়েছে, যেগুলো বিদেশী বা প্রতিবেশী শব্দ হলেও ককবরেক এসে নিজের মতো করে স্থান করে নিয়েছে এবং ককবরক শব্দের মতো করেই ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন-
Gerok- to roll
গেরক- গড়াগড়ি খাওয়া
Gerok+o = Gerogo- Being rolled
গেরক+অ = গেরগো- গড়াগড়ি খায়
Godona- neck
গদনা- গর্দান (ঘাড়)
Tebil- Table
তেবিল- টেবিল (এটি ইংরেজী থেকে আসা শব্দ হলেও বাংলার উপর দিয়ে পরিক্রমা করে আসার ফলে এটির উচ্চারণ ইংরেজী টেবল থেকে বাংলা টেবিল-এর আদলে ককবরকের উচ্চারণ ‘তেবিল’-এ এসে পর্যবসিত হয়েছে)।
ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণের সংযোগে ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবর্তন
K (ক) এবং P (প)- এর উচ্চারণ শব্দ গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যথাক্রমে G (গ) ও B (ব) উচ্চারণ হয়। নিচের কিছু উদাহরণ দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে-
Paithak (পাইথাক)- শেষ প্রান্ত- Last.
Paithak + o – Pathago (পাইথা-গ)- শেষ প্রান্তে- In the last.
Kok (কক)- ভাষা- Language.
Kok + o – Kogo (ক-গ)- ভাষায় In language.
Koklop (ককলপ)- কবিতা- Poem.
Koklop + o – Koklobo (ককল-ব)- কবিতায় In poem.
Khaklap (খাকলাপ)- বুক- Chest.
Khaklap + o – Khaklabo (খাকলা-ব)- বুকে- In the chest.
ককবরক পদবিন্যাস (Syntax)
একটি সরল বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে ককবরকে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়া এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। যেমন-
কর্তা/ Subject কর্ম/ Object ক্রিয়া/ Verb
Ang mai chahgo
আং মাই চাগো
I rice eat
আমি ভাত খাই
Bo koklop suio
ব ককলপ সুইঅ
S/he poem writes
সে কবিতা লেখে
কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়াকে ককবরক বিশারদরা নানাভাবে নামকরণ করেছেন। ককবরক ব্যাকরণ নিয়ে লেখালেখি করেন এমন কৃতি ভাষাবিদদের মধ্যে ঠাকুর রাধামোহন দেববর্মন, দশরথ দেববর্মা ও ডাঃ সুধাংশু বিকাশ সাহার নাম সবিশেষ উল্লেযোগ্য।
ককবরক স্কলার নরেশচন্দ্র দেববর্মা মহোদয় তাঁর ককবরক ব্যাকরণ তৗয়ৗই কিসিসা উানসকমুঙ প্রবন্ধে এই তিনজনের কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া, বিশেষ্য ও বিশেষণ-এর নামকরণ বিষয়ে তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন। উদাহরণটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
লেখকের নাম কর্তা কর্ম ক্রিয়া বিশেষ্য বিশেষণ
রাধামোহন ঠাকুর অক্রা সামুঙ অঙথুঙ ছাক গরন
দশরথ দেব খৗলায়ফাঙ খৗলায়জাকমা খৗলাংমা মুঙ মুঙ খিলিমা
ডাঃ সুধাংশু সাহা খৗলায়ফাঙ তাঙজাকমা খৗলায়মা মুঙ খিলিমা
উপরের তুলনামূলক বিশ্লেষনে উল্লেখিত তিনজন লেখকের সব শব্দই একে অপরের সমার্থ শব্দের মতো। তাই যে কোন একটিকে স্টান্ডার্ড হিসেবে বেছে নিয়ে ককবরক ব্যাকরণ লেখার কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।
ককবরক গণনা পদ্ধতি
ককবরক লেখামুং রাইদা বা পণনা পদ্ধতি খুবই সমৃদ্ধ। ককবরকের মৌলিক গণনা রীতি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
সংখ্যা বাংলা গণনা Kokborok ককবরক
১ এক sa সা
২ দুই nwi নৈ
৩ তিন tham থাম
৪ চার brwi ব্রৈ
৫ পাঁচ ba বা
৬ ছয় dok দক
৭ সাত sini সিনি
৮ আট char চার
৯ নয় chuku চুকু
১০ দশ chi চি
২০ বিশ nwichi(khol)নৈচি (খল)
১০০ একশত ra রা
১০১ একশত এক sara sa সারা সা
২০০ দুইশত nwira নৈরা
১,০০০ এক হাজার sai সাই
২,০০০ দুই হাজার nwi sai নৈ সাই
১০,০০০ দশ হাজার chisai চি সাই
২০,০০০ বিশ হাজার nwichi sai নৈচি সাই
১০০,০০০ এক লক্ষ rasai রাসাই
২০০,০০০ দুই লক্ষ nwi rasai নৈ রাসাই
১০,০০,০০০ দশ লক্ষ chirasai চিরাসাই
২০,০০,০০০ বিশ লক্ষ nwichi rasai নৈচিরাসাই
১০,০০০,০০০ এক কোটি rwjak রৗজাক
২০,০০০,০০০ দুই কোটি nwi rwjak নৈ রৗজাক
ককবরক গণনা পদ্ধতিতে একটি চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। এটিকে শ্রেণিবিভাজিত গণনা পদ্ধতি বলা যেতে পারে। কারণ যে ব্যক্তি, বস্তু বা জিনিষের গণনা করা হয়, তার ধরণ অনুসারে গণনা পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। যেমন-
বাংলা ককবরক গণনা পদ্ধতি
মানুষ বরক/কাই খরকসা, খরকনৈ, খরকথাম
বা কাইসা, কাইনৈ, কাইথাম
পাতা জাতীয় কাং/লাই কাংসা, কাংনৈ, কাংথাম
বা লাইসা, লাইনৈ, লাইথাম
ডিম বৗতৈ/ বুতুই তৈসা, তৈনৈ, তৈথাম
ফল বৗথাই/ বাথাই থাইসা, থাইনৈ, থাইথাম
দড়ি তুং/ তৗং তুংসা, তুংনৈ, তুংথাম
বা তৗংসা, তৗংনৈ, তৗংথাম
গাছ, বাঁশ বা লাঠি জাতীয়
(কাটা অবস্থায়) কং কংসা, কংনৈ, কংথাম
গোল জাতীয় বুদুল দুলসা, দুলনৈ, দুলথাম
তরল জাতীয় থপ থপসা, থপনৈ, থপথাম
প্রাণী মাং মাসা, মাকনৈ, মাকথাম
গাছ, বাঁশ (দাঁড়ানো
অবস্থায়) বফাং ফাংসা, ফাংনৈ, ফাংথাম
পিঠা/বিস্কুট জাতীয় বেলেপ লেপসা, লেপনৈ, লেপথাম
সময় জরা রাংসা, রাংনৈ, রাংথাম
টাকা রাং/ খক খকসা, খকনৈ, খকথাম
গাড়ি, বাড়ি জাতীয় খং/ খুং খুংসা, খুংনৈ, খুংথাম
দানা জাতীয় কল কলসা, কলনৈ, কলথাম
ভাষা কক খুকসা, খুকনৈ, খুকথাম
পদক্ষেপ য়াকপাই দাঁইসা, দাঁইনৈ, দাঁইথাম
বা য়াকপাইসা, য়াকপাইনৈ, য়াকপাইথাম
ককবরকে লিখিত চর্চার বিবর্তন : বাংলাদেশ ও ভারত প্রেক্ষিত
ককবরক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ভারত ও বাংলাদেশের প্রেক্ষিত আলাদা করে আলোচনার কোন অবকাশ থাকে না। তাই এই আলোচনায় দুই পারের তথ্য একসাথেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ককবরক-এর লিখিত সাহিত্যের বিবর্তনকে মোটামুটি চারটি পর্বে বিভাজন করা যায়- ১) আইচুকপাং বা আলো-আঁধারির যুগ (খৃস্টীয় প্রথম শতক হতে রাজমালা), ২) ফ্রুং-আইসিরি বা প্রথম আলোর যুগ, ৩) সালকাসৗকাং বা সূর্যোদয়ের যুগ, ৪) সাল কৗস্রাং বা প্রাক-আধুনিক যুগ এবং ৫) তাবকনি সাল বা আধুনিক যুগ।
১) আইচুকপাং বা আলো-আঁধারির যুগ
ককবরক লিখিত সাহিত্যের আলো-আঁধারি পর্বটির সীমা সহজে নির্ণয় করা যায় না। এই পর্বটি খৃস্টীয় প্রথম শতক হতে রাজমালা রচনাকাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারতীয় উপমহাদেশে বোডো সভ্যতার শুরু যদি খৃস্ট-জন্মের কিছুকাল পূর্বে হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভাষায় লেখালেখির পর্বটি খৃস্ট-জন্মের শুরু থেকেই আরম্ভ হয়ে থাকতে পারে।
এই সময়কাল মোটামুটি মধ্যযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। কলমা নামের এই ভাষার একটি নিজস্ব লিপি ছিল বলেও বিভিন্ন লেখার সূত্রে জানা যায়। তবে এই লিপির কোন নমূনা অদ্যাবধি আবিস্কৃত না হওয়ায় এ ব্যাপারে হলফ করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
এই আইচুকপাং বা আলো-আঁধারি যুগের যেসব মৃদু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তার মধ্যে কলমা হরফে লেখা ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস বা বংশলিপির কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়।
‘রাজরত্নাকর’ নামের ত্রিপুরা রাজাদের কাহিণীনির্ভর একটি গ্রন্থও কলমা লিপিতে রচিত হয়েছিল বলেও বিভিন্ন লেখালেখিতে উল্লেখ করা হয়। এই দুই ধরণের কোন গ্রন্থের কপি এখনও আবিস্কৃত হয়নি।
ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’ গ্রন্থটিও এই সময়ে কলমা লিপিতে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই মূল গ্রন্থের কোন হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এই গ্রন্থটিই প্রথমে সংস্কৃতে এবং পরে মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের আমলে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়।
মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের আমলে (১৪৫৮-৬৫) রাজমালাকে সংস্কৃত হতে বাংলায় অনুবাদ করার সময় সংস্কৃত, বাংলা ও ককবরকে সুপন্ডিত দুলু নারাণ বা দুর্লভেন্দ্র নারায়ণ ব্রাহ্মণ সহোদরকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং তখন সংস্কৃত হতে বাংলা করার সাথে সাথে ককবরকে এক কপি তর্জমা করে রেখেছিলেন বলে নানা উৎস হতে জানা যায়।
সংস্কৃত, ককবরক এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতি ও ভাষাপরিবেশ সম্পর্কে পন্ডিত সহোদরের সম্যক দারণা না থাকায় দুলু নারাণকে এই কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল।
ত্রিপুরার মহারাজাদের অতিশয় বাংলাপ্রীতির কারণে বাংলায় অনুদিত কপিটি সযত্নে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা হলেও ককবরক কপিটি আর আলোর মুখ দেখেনি বা সচেতনভাবেই তা নষ্ট করা হয়ে থাকতে পারে।
রাজমালার এই ককবরক কপিটি আবিস্কৃত হলে তা হতো ককবরক লিখিত সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীণ নিদর্শন (শ্যামাচরণ ত্রিপুরা)।
এই বাংলায় অনুদিত বা রচিত রাজমালাতেই উল্লেখ করা হয় যে, গ্রন্থটি পূর্বে স্থানীয় ত্রিপুর ভাষায় লেখা হয়েছিল।
পরে সেই সময়কার পারিপার্শ্বিকতা বিচারে অধিকতর সভ্য সমাজের ভাষা বিবেচনা করে তা বাংলায় বা রাজমালার পরিভাষামতে ‘সু-ভাষায়’ অনুবাদ করা হয়।
রাজমালার দ্বিতীয় খন্ডের ধর্ম মাণিক্য পর্বের ৬ নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে-
‘পূর্বে রাজমালা ছিল ত্রিপুর ভাষাতে পয়ার গাঁথিল সব সকলে বুঝিতে সু-ভাষাতে ধর্মরাজে রাজমালা কৈল রাজমালা বলিয়া লোকেতে হৈল।’ককবরক লিখিত রূপের প্রয়াস হিসেবে দুর্গাপ্রসাদ নারাণ কর্তৃক মহেন্দ্র মাণিক্যের (১৭১৩-১৪) জীবনী ও চতুর্দ্দশ দেবতার পূজার্চ্চনা বিষয়ক মন্ত্রাদি ককবরকে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। পান্ডুলিপিটি একসময় সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও কোন এক গুঢ় কারণে তা এখন দুস্প্রাপ্য।
২) ফ্রুং-আইসিরি বা প্রথম আলোর যুগ
আলো-আঁধারি পথ পাড়ি দিয়ে ককবরকের প্রথম প্রহরটি শুরু কিছু গুরুত্বপূর্ন সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। ১৯০০ খৃস্টাব্দে ঠাকুর রাধা মোহণ দেববর্মন ‘ককবরকমা’ নামের একটি ককবরক ব্যাকরণ রচনা করেন।
এছাড়া আইনজীবি দৌলত আহম্মদও সমসাময়িক কালে ‘ককবরমা অং ত্রৈপুর ব্যাকরণ’। নানা তথ্যসূত্রে দৌলত আহম্মদের গ্রন্থের প্রকাশকাল প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়েছিল ১৩০৭ বঙ্গাব্দ।
তাই ধরে নেওয়া হতো এই বইটি রাধামোহন ঠাকুরের বই হতে তিন বছর পরে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুরনো পুঁথির সংগ্রহশালাসূত্রে সম্প্রতি জানা গেছে যে, দৌলত আহম্মদের লেখা বইটি ১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল, যা খৃস্টীয় সন গণনায় ১৮৯৭ হবে।
ঠাকুর রাধামোহন দেববর্মন ১৯০৬ সালে ‘ত্রৈপুর কথামালা’ নামের ককবরক-বাংলা-ইংরেজী ত্রিভাষিক অনুবাদগ্রন্থ, ১৯০৭ সালে ‘ত্রৈপুর ভাষাভিধান’, ১৯১৭ সালে ‘ত্রৈপুর ভাষাভিধান’ এবং ১৯১৯ সালে ‘ত্রৈপুর লোক গাথার সংকলন ও ত্রৈপুর কথামালা’ রচনা করেন।
কিন্তু এসব উদ্যোগেরও আগে ককবরকে লেখালেখির তথ্য নানা অফিসিয়াল ও বিভিন্ন পর্যটকদের ভ্রমণ নথিতে পাওয়া যায়। ১৮৭৫-৭৬ খ্রীষ্টাব্দের দিকে যুবরাজ রাধাকিশোর দেববর্মা কর্তৃক ককবরকের অভিধান রচনার কথা জানা যায়।
তৎকালীন ত্রিপুরায় অবস্থানকারী ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্ট মি: টি.ই. কক্সহেড-এর প্রশাসনিক প্রতিবেদনে (নং ১৩৪ তাং- ২৬ জুন ১৮৭৬) এই তথ্যটি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- The yubraj has moreover, at my suggestion, set about the compilation of a Tipperah vocabulary. He is perfectly acquainted with the vernacular of the hill people, and I am in hopes that the result of his undertaking will have some scientific interest. মি: সি. ডাব্লু বল্টনের প্রতিবেদনেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে, The yubaraj is stillengaged in the compilation of a Tipperah-Bengali Dictionary and lately he has become a member of the ASIATIC SOCIETY of Bengal.
প্রায় একই সময়ে জে ডি এন্ডারসনও ককবরক-বাংলা-চাকমা অভিধানের পান্ডুলিপি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তা প্রকাশিত হয়নি, যা বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়।
তার কিছুকাল পরে বড়ঠাকুর সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন ‘য়েসিয়ার খাগরা’ নামের একটি বিয়োগান্তক ককবরক লোকগীতি স্বরলিপিসহ লিখে তাঁর সংকলিত ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়।
কবি দৌলত আহম্মদ-এর আরেক কীর্তি ককবরক কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৮৮০ সালের দিকে, তাঁর যৌবনে।
কিন্তু বইটির একটি কপি তাঁর নিকটাত্মীয়ের কাছে সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও তার কোন কপি এখন আর পাওয়া যায় না। এই কপিটা পাওয়া গেলে ককবরক লিখিত রূপের আরেক দিক উন্মোচিত হতো।
৩) সালকাসৗকাং বা সূর্যোদয়ের যুগ
ককবরক লিখিত সাহিত্যের সূর্যোদয়ের যুগে ককবরকের ছোট্ট বীজ অঙ্কুরিত হয়ে তার শাখা প্রশাখা প্রসারিত করতে থাকে। ধর্ম থেকে রাজনীতি, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, ছড়া থেকে উপন্যাস, অনুবাদ থেকে মহাকাব্য সকল বিষয় ককবরক সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠতে থাকে এই পর্বে।
বাংলাদেশে ককবরকে লেখালেখির প্রকাশিত নিদর্শন হলো উনিশশত চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে সাধক খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা কর্তৃক রচিত ককবরক আধ্যাত্মিক সংগীত।
তাঁর লেখা ৩৩ টি আধ্যাত্মিক ককবরক সংগীত নিয়ে ১৯৪২ সালে ‘ত্রিপুরা খা-কাচাংমা খুম্বার বই’ নামের এই গানের বইটি প্রকাশিত হয়।
এই গানের বইটিকে বাংলাদেশে ককবরকের লিখিতরূপের সূচনালগ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়। এরপর থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই ককবরকে লেখালেখি চর্চা করতে থাকেন।
ত্রিপুরা জাতির সাধু ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় ককবরক চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন বহুদিন আগে থেকে।
আশির দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ত্রিপুরাদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বৈসু উপলক্ষে নানা সাময়িকী প্রকাশ করতে থাকে। যা স্বল্প পরিসরে হলেও নিজের ভাষায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ত্রিপুরা জনশিক্ষা সমিতি গঠিত হলে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সুধন্বা দেববর্মার সম্পাদনায় প্রথম ককবরক ম্যাগাজিন ‘কৗতাল কথমা’ প্রকাশিত হয়।
১৯৪৮ সালে প্রভাত চন্দ্র রায় সম্পাদনা করেন ‘চিনি হা’ পত্রিকা, ১৯৫০ সালে ধীরেন কৃষ্ণ দেববর্মা প্রকাশ করেন ‘খুম্পুই বারুরুক’, ১৯৫৩ সালে বংশী ঠাকুর রচনা করেন ‘ককতাং কুলুই’, ১৯৫৪ সালে সুধন্বা দেববর্মা’র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ত্রিপুরা ককতুন’, সুধীর কৃষ্ণ দেববর্মা’র ‘ককতাং’, ১৯৫৬ সালে সুধন্বা দেববর্মা’র ‘চেথুয়াং’, ১৯৫৭ সালে সুধীরকৃষ্ণ দেববর্মা’র ‘সৗরংমা য়াখিলি’, ১৯৫৮ সালে মহেন্দ্র দেববর্মা’র ‘চেরাই সৗরুংমা’, ১৯৫৯ সালে জিতেন ঠাকুরের ‘ককবরক সৗরুংমা’, সোনাচরণ দেববর্মা’র ‘ফিরগৗই ফাইদি’, মহেন্দ্র দেববর্মা’র ‘কাল্লুল’, কুমুদ রঞ্জন দেববর্মা’র ‘ভারতনি কথমা’, ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা সরকারের শিক্ষা দপ্তর হতে ‘ত্রিপুরানি কেরেঙ কথমা’ ও ‘ভারতনি পাঞ্চালি’ নামে দুটো বই প্রকাশিত হয় এবং অজিতবন্ধু দেববর্মা’র ‘ককসৗরুঙমা’ও এই বছরে প্রকাশিত হয়।
সুধন্বা দেববর্মার লেখা ‘হাচুক খুরিঅ’ ককবরকে লিখিত প্রথম উপন্যাস, যা ১৯৮৭ সালে ককবরক সাহিত্য সভা ও সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
এর আগে ১৯৭৬ সালে দি বাইবেল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া কর্তৃক অনুদিত খৃস্ট ধর্মীয় গ্রন্থ ‘স্মাই কৗতাল’, যা বিংশ শতকের অন্যতম প্রধান অনুবাদকর্ম হিসেবে স্বীকৃত।
এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছড়াসহ সাহিত্যকর্মের মধ্যে সুধন্বা দেববর্মার উপন্যাস ‘চেথুয়াং’, ককবরক ছড়া সংগ্রহ ‘ফুনুকমা’, দশরথ দেববর্মা অনুদিত গান্ধিজীর বাণী ‘গান্ধিজী ককলাম’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
অজিত বন্ধু দেববর্মা ১৯৬৭ সালে ‘ককরবাম’ বা ককবরক অভিধান প্রণয়ন করেন। ককবরক সাহিত্য সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক অলিন্দ্রলাল ত্রিপুরা বহু নাটক রচনা করেন, যার মধ্যে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘লামানি হমচাং’ অন্যতম, যা বিভিন্ন মঞ্চে প্রদর্শিত হয়।
পঞ্চাশের দশকে সোনাচরণ দেববর্মা বহু ককবরক সংগীত রচনা করেন। ‘ফিরগই ফাইদি’ তাঁর সংগীত সংকলনসমূহের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়াও রাজ্য শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক তাঁর ‘ভারতনি পাঞ্চালি’, ‘রামায়ণ কচারজাক’ ও ‘য়াপ্রি কৗতাল’ নামের কিছু বই প্রকাশিত হয়।
ককবরক লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিশেষ ভুমিকা উল্লেখ করা মতো।
১৯৬৭ সালে বীর চন্দ্র দেববর্মা ‘ত্রিপুরা ককবরক উন্নয়ন পরিষদ’ এবং অলিন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও শৈলেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ‘ত্রিপুরা ককবরক সাহিত্য সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭২ সালে ত্রিপুরা ককবরক উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক ‘ত্রিপুরা ককবরক ভাষার লিখিত রূপে উত্তরণ’ নামের একটি প্রকাশনা বের করা হয়।
ত্রিপুরা ককবরক সাহিত্য সভা কর্তৃক ১৯৬৭ সালে ‘ত্রিপুরা সংহিতা’ নামের একটি দর্শনশাস্ত্র প্রকাশ করা হয় এবং ১৯৭৩ সালে ত্রিপুরা ব্যাপ্টিস্ট লিটারেচার সোসাইটি কর্তৃক ‘স্রুংসামা’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়।
সত্তরের দশকের অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে বুদুরায়-এর সতেরটি ককবরক গানের সংকলন ‘খানি রৗচাপমুং’, দশরথ দেববর্মার ১৯৭৭ সালে রোমাণ হরফে লেখা ‘ককবরক সৗরুং’ এবং ১৯৭৮ সালে মনোরঞ্জন দেববর্মা রচিত ‘বুবার’ অন্যতম।
‘লামা’ সাহিত্য পত্রিকায় শ্যামলাল দেববর্মার ‘তংথাই নাইতুংমানি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো।
শ্যামলাল দেববর্মা ১৯৮৪ সালে ১২টি ছোটগল্পের সংকলন ‘দুনদুরুকমা’ এবং ১৯৮৭ সালে ‘আদং’ সম্পাদনা করেন।
১৯৮৭ সালে বিনয় দেববর্মার সম্পাদনায় ককবরক চারটি গল্পের সংকলন ‘নাখৗরাই’ এবং ১৯৮৯ সালে হরিপদ দেববর্মার সম্পাদনায় আটটি গল্পের সংকলন ‘এলেমনি বিবি’ প্রকাশিত হয়।
আশির দশকটি ছিল মূলত ককবরক লিখিত সাহিত্যের জোয়ার। এ সময় সৃষ্টির জোয়ারে যেন উত্তাল হয়ে ওঠে ককবরক সাহিত্য জগত।
১৯৮০ সালে শান্তিময় চক্রবর্তীর ‘ত্রিপুরানি কেরেং কথমা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে নরেশ চন্দ্র দেববর্মা ও শ্যামলাল দেববর্মার সম্পাদনায় ‘ককবরক ককলব বৗচাব’, শান্তিময় চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘কগতাং-ককলব বৗতাং’ ও ‘মুকতৈ’, নরেন্দ্র দেববর্মা’র নাটক ‘নবার দামসানি কথমা’, ১৯৮৪ সালে ‘নন্দ কুমার দেববর্মার ‘সিমালুং সাকাঅ হলংনি খুম’, মহেন্দ্র দেববর্মার ‘লুকু সচামা রৗচাবমুং’, নরেন্দ্র দেববর্মা’র নাটক ‘থাপলানি সিন্দুর’।
১৯৮৩ সালে ‘হা কৗচাক’ ও ১৯৮৮ সালে ‘নৗং হামজাকমা রৗয়া’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৫ সালে নরেন্দ্র দেববর্মা’র নাটক ‘পাইথাকনি ককতুন’, মহেন্দ্র দেববর্মা’র ভাষা শিক্ষার বই ‘ককবরকনি কক উানজুই’, শ্যামলাল দেববর্মা’র নাটক ‘আয়নানি মৗখাঙ’, গল্পের বই ‘চবাকায়সানি উল’ প্রকাশিত হয়।
১৯৮৬ সালে সুধন্য ত্রিপুরার ‘আংবাই কৗখ্রাং তৈনি খরাং’ ও ‘রৗচাপমুং’ প্রকামিত হয়। ত্রিপুরার জনপ্রিয় কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর ‘হাপিং গাইরিংগ চিবুকসা রিংগ’ ও ‘কলমতৈ কিসি মৗখাং’ কাব্যগ্রন্থ এবং ১৯৮৭ সালে ‘বলং কৗখ্রাং’ প্রকাশিত হয়।
১৯৮৮ সালে বিনয় দেববর্মার ‘সনেট ককতাংরগ’, নরেন্দ্র দেববর্মার ‘কুকিলা নৗং তৗমানি আসৗক পুং’, অলিন্দ্রলাল ত্রিপুরার ‘হরনি বর বা সাংত্রাম পাঞ্চালি’, নন্দ কুমার দেববর্মার ‘বলংনি বৗসাজৗকসং মৗসাঅ’ এবং শ্যামলাল দেববর্মার ‘ককবরক গণসংগীত’, নরেন্দ্র দেববর্মা’র নাটক ‘মৗনাকনি চাতি’ প্রকাশিত হয়।
এই সময়কালের অনুবাদকর্মগুলোর মধ্যে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত শ্যামলাল দেববর্মার ‘নক আরিনি কথমা’ ও ‘ককবরকবাই রবীন্দ্রনাথ’, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত নন্দ কুমার দেববর্মার ‘ককবরক গীতা’ ও নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার ‘তাখুমসা বদল’ ইত্যাদি অন্যতম।
এই সময়কালের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ও সাহিত্য ম্যাগাজিনের মধ্যে ত্রিপুরা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের ‘লামা’, ককবরক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদের ‘চাতি’, শ্যামলাল দেববর্মা সম্পাদিত ‘আইতরমা’, সুনীল দেববর্মা’র ‘জরা’, চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর হাচুকনি খরাং, কমলিয়া দেববর্মা’র ‘আইদরপ’, বিকাশরায় দেববর্মা’র ‘চেথুয়াঙ’, নিতাই আচার্য্য’র ‘ইয়াখৗরায়’, বুধরায় জমাতিয়া’র ‘খাকামুঙ’, রাজকুমার দেববর্মা’র ‘সিঙলি’ এবং ত্রিপুরা রাজ্য ককবরক সাহিত্য সভার ‘দাংদু’ অন্যতম।
৪) সাল কৗস্রাং বা প্রাক-আধুনিক যুগ
আশির দশকে সাহিত্য সৃষ্টির প্রবল জোয়ার-ভাটায় পরিশোধিত হয়ে ককবরক যেন আধুনিক যুগের অথৈ সরোবরে অবগাহনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
অনেকে এই পর্বকে ককবরকের বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে আখ্যা দেন। ককবরক সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা এই সময়ে আরো পরিক্কতা লাভ করতে থাকে।
১৯৯১ সালে ‘সান্তুআ’ নামের একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রশান্ত ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম এই সাহিত্য পত্রিকা পরবর্তীতে ‘সান্তুআ জার্নাল’ নামে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।
বর্তমানে এই সাহিত্য পত্রিকাটি মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই পর্বের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নগেন্দ্র জমাতিয়ার ‘বিলোনিয়া ১৯৯৪’, সুনীল দেববর্মার ‘মকল বৗসকাংগ’ (১৯৯৪), ‘বলংনি খুম’ (১৯৯৬) ও ‘বিয়াল’ (১৯৯৭), বিজয় দেববর্মা, নাফুরায় জমাতিয়া ও রবীন্দ্র কিশোর দেববর্মার ‘সৗকালজৗকমা’ (১৯৯৮) এবং নাফুরায় জমাতিয়া ও অশোক দেববর্মার ‘নাইথক’ (১৯৯৮) অন্যতম।
কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চন্দ্রমণি দেববর্মার ‘হিমালয়নি বেদেক বুপ্রা’ (১৯৯১) ও ‘লাভ-ইজম’ (১৯৯৫), খাজুয়াল জমাতিয়ার ‘দর্মলাম বাই ককবরক বাউল’ (১৯৯২), ককবরক তাই হুকুমু মিশনের ‘খুম্পুই বাররৗরৗক’ (১৯৯৫), কুমুদ রঞ্জন দেববর্মার ‘য়াখারাই’ (১৯৯৬), সুধন্যা ত্রিপুরার ‘নন রিখা খুম্পুই’ (১৯৯৭), বিকাশরায় দেববর্মার ‘বলং মুফুনজাক য়াকবাই’ (১৯৯৮), বিজয় দেববর্মার ‘লংতরাইনি একলব্য’ (১৯৯৮) এবং চন্দ্র কান্ত মুড়াসিং-এর ‘লক চেথুয়াং লক’ (১৯৯৯) ও ‘পিনদি উাতৈ পিন’ (১৯৯৯) ইত্যাদি।
এই পর্বে উল্লেখযোগ্য অনেক অনুবাদকর্ম সম্পাদিত হয়। তার মধ্যে নগেন্দ্র দেববর্মার ‘কমলা কান্তনি দপ্তর’ (১৯৯২), অন্নপ্রসাদ জমাতিয়ার ‘মাংনি উানসুকথানি গীতা’ (১৯৯৭), ত্রিপুরা ব্যাপ্টিস্ট খ্রিশ্চিয়ান ইউনিয়নের প্রভূ যিশুর শংসাগীতি ‘লবমুং বৗচাপ’, কৃষ্ণধন জমাতিয়ার ‘কৗরাক কথমা’ (১৯৯৫), বিনয় দেববর্মার ‘এ্যাংলো-ককবরক অভিধান’ (১৯৯৬), ককবরক তাই হুকুমু মিশনের ‘ফুনুকমুং’ (১৯৯৪), বিনয় দেববর্মার ‘ককবরকনি রাংচাক-রিচাক’ (১৯৯৪), সুকান্ত দেববর্মার ‘গান্ধিজী’ (১৯৯৫), নিতাই আচার্যর ‘ককবরকনি ককরক কিসা’ (১৯৯৬), বিমল দেববর্মার ‘সাচলাং জরানি ইমাংনি খুম্পুই’ (১৯৯৭), রবীন্দ্র কিশোর দেববর্মার ‘ককবরক সিখুম’ (১৯৯৭), ডা. নীলমণি দেববর্মনের ‘বেমার তাই বিনি হামরিমুং’ (১৯৯৯) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫) তাবকনি সাল বা আধুনিক যুগ
এই সাহিত্যকর্মের পদাঙ্ক অনুসরণ করে একবিংশ শতকে শুরু হয় ককবরক সাহিত্যে নতুন জোয়ার। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় বিনয় দেববর্মার ‘এ্যাংলো-ককবরক-বাংলা অভিধান’।
ককবরক তাই হুকুমু মিশন কর্তৃক প্রণীত এই অভিধানটি মূলত লেখক কর্তৃক ১৯৯৬ সালে প্রণীত ত্রিভাষিক অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণ।
সুনীল দেববর্মার ‘বুসু’ ২০০০, হরিপদ দেববর্মার ‘জলাই তকপুপু’ ২০০০, স্নেহময় রায় চৌধুরীর ‘চেথুয়াং তলাঅ’ ২০০০, বিশ্ব কুমার দেববর্মার ‘অস্থিরগ’ ২০০০।
কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুধন্য ত্রিপুরার ‘জাদুনি খরাং’ ২০০০, নন্দ কুমার দেববর্মার আনি গানাঅ আং ও আনি রৗচাবমুং ২০০০, কুঞ্জ বিহারী দেববর্মার ‘সিনিজাক কৗরৗই বুমুল’ ২০০০, শ্যামল দেববর্মার ‘ককথাইরগ থৗংগ বনবনিয়া’ ২০০০ অন্যতম।
২০০১ সালে চন্দ্রবালা দেববর্মার ‘ড. বি আর আম্বেদকর’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে ককবরক তাই হুকুমু মিশন। ২০০২ সালে ককবরক তাই হুকুমু মিশন আরো একটি যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম সম্পন্ন করে।
এই বছর মিশন আর কে দেববর্মা কর্তৃক অনুদিত ত্রিপুরার ইতিহাস রাজমালার ককবরক সংস্করণ ‘তৈপ্রানি লাইবুমা’ প্রকাশ করে। এই বছর ‘থাংফ্লাইনি বিথিলৗং’ নামের একটি বরক ভেষজ ওষুধ বিষয়ক একটি বইও প্রকাশিত হয়।
২০০২ সালে বিনয় দেববর্মা ‘য়াম্রকসা’ নামের একটি ছোটগল্পের বই বের করেন। এছাড়া রেবতী দেববর্মার ২০০২ সালে প্রকাশিত হল ‘বেসেরনি খুম’ এবং ২০০৪ সালে ককবরক তাই হুকুম মিশনের ‘তকসা তিয়ারি’ প্রকাশিত হয়।
২০০২ সালে সোনা চরণ দেববর্মার ‘সানা মুচুংগ সাজাকয়া ককরক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই লেখায় উল্লেখিত বইপুস্তকের সম্পূর্ন নয়।
এ কারণে বহু মূল্যবান অনেক বই পুস্তক ম্যাগাজিন পত্রিকা বাদ পড়ে যেতেই পারে। তাই পাঠকমহল যদি সেসব বাদ পড়া বই পুস্তক বা পত্র-পত্রিকার নমুনা এই লেখকের সাথে শেয়ার করেন, তাহলে এই লেখাটি পূর্নাঙ্গ রূপ লাভ করতে পারে।
ভবিষ্যত ভাবনা ও উপসংহার
কোন জাতির সংস্কৃতির মূল ধারক হলো সে জাতির মাতৃভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমেই লালিত হয় তার স্বপ্ন, সাধ, আশা, আকাঙ্খা, আনন্দ, বেদনা ও জীবন-জীবিকা।
মাতৃভাষার যথার্থ বিকাশ না ঘটিয়ে কোন জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন তরান্বিত করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠির মাতৃভাষা ককবরকের সার্বিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি এই জাতিগোষ্ঠির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
এই ভাষার সামগ্রিক বিকাশে নিম্নোক্ত উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
কোন ভাষা সংরক্ষনের সহজতর উপায় হচ্ছে, সে ভাষায় প্রচলিত অলিখিত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা।
কারণ, একটি জাতিগোষ্ঠির ভাষা লিখিত রূপ করার প্রাক্কালে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, সেটি হলো লোকজ গান, ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচনসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ, যেগুলো সাধারণত মুখে মুখে প্রচলিত।
তাই, ককবরক বা ত্রিপুরাদের ভাষার সামগ্রিক বিকাশ তরান্বিত করার জন্য প্রথমে এই জাতিগোষ্ঠির লোকসমাজে প্রচলিত নানা অলিখিত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা।
কোন ভাষার উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম উপায় হলো সেই ভাষার লিখিত রূপকে পৃষ্ঠপোষন করা। ককবরকের সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থে তাই এই ভাষায় একটি সমৃদ্ধ অভিধান রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
একাডেমিক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ত্রিপুরাদের ভাষা ককবরকে একটি অভিধান রচনা ও প্রকাশ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোন ভাষার পূর্নাঙ্গ বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়।
তাই, সরকারের আর্থিক আনুকুল্যে ত্রিপুরাদের ভাষা ককবরক-এর বিকাশ তরান্বিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট-এর অধীনে একটি জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির ভাষার পাশাপাশি ককবরকের উন্নয়নের রূপরেখা এই পরিকল্পনায় সন্নিবেশ করা যেতে পারে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-এর মাধ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ইনস্টিটিউটকে আরো কার্যকর করার জন্য সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করে এসব জাতিগোষ্ঠির ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশ জোরদার করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, এসব ইনস্টিটিউটে একটি শক্তিশালী গবেষণা সেল গঠনের বিধান থাকলেও কার্যকর কোন মৌলিক গবেষণাকর্ম পরিলক্ষিত হয় না।
তাই সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার পাশাপাশি ভাষা বিষয়ে বিশেষায়িত গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করার জন্যও এসব ইনস্টিটিউটকে বিশেষভাবে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
পার্বত্য জেলাগুলোর ক্ষেত্রে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ভাষা ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে নানামুখি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা।
কিন্তু ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে এসব পরিষদের সুনির্দ্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয় না।
তাই, সরকারিভাবেই বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ কার্যাবলী বাস্তবায়নে সহায়তা করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে যথাযথ সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১. য়াখৗতৗং, ককবরক সৗয়মৗঙ চেঙমানি বিসি রাসা পুঙমা রৗগৗই ককবরক তের-২০০০ নি মুকুমুবৗলাই, চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং (সম্পাঃ), আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত।
২. Kokborok- a Promising Tribal Language of North-East India, Kumud Kundu Choudhury, January 2007, Agartala, Tripura, India
৩. পুব-ই-রাবাইনি সাল (পূব-দিগন্তের সূর্য), বরেণ ত্রিপুরা (সম্পাঃ), ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ, জুলাই ১৯৮১, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
৪. ককবরমা- হাচুকনি খরাং
৫. সান্তুআ জার্নাল
৬. বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও ককবরক রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর বিভিন্ন আয়োজিত সভা ও কর্মশালার প্রতিবেদন
৭. ককবরক তাই হুকুমু মিশন-এর ওয়েবসাইট
৮. Wikipedia, the free encyclopedia
৯. KOK-BOROK, A SHORT ANALYSIS- Dr. Francois Jacquesson
লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।