কেমন হবে করোনা পরবর্তী পৃথিবী? লিখেছেন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি
1553
ইউভাল নোয়াহ হারারি (জন্ম ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ এবং হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়, জেরুজালেমের ইতিহাস বিভাগের পূর্ণকালীন অধ্যাপক।
তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বহুলবিক্রিত বই স্যাপিয়েন্স: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউমানকাইন্ড (২০১৪), হোমো ডিউস: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টুমোরো (২০১৬) এবং টুয়েন্টিওয়ান লেসন্স ফর দ্য টুয়েন্টিফাস্ট সেঞ্চুরি (২০১৮)-এর লেখক। তার লেখার বিষয়বস্তু স্বাধীন ইচ্ছা, চেতনা ও বুদ্ধিমত্তা।
করোনা ঝড় একসময়ে থেমে যাবে কিন্তু করোনা প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপ অনাগত দিনগুলোতে আমাদের জীবনযাত্রা খোলনলচে পাল্টে দেবে।
মনুষ্য সম্প্রদায় বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সম্ভবত আমাদের প্রজন্ম ইতিপূর্বে এতবড় সংকটে পড়ে নাই।
সাধারণ মানুষ এবং দেশের সরকার ব্যবস্থা আগামী কয়েক সপ্তাহে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর চেহারা কেমন হবে।
যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন সেটা শুধু যে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা পাল্টে দেবে তা নয় বরং আমূল বদলে যাবে অর্থনীতি, বদলে যাবে রাজনীতির চিরচেনা চরিত্র, বদলে যাবে এতদিনের লালিত সংস্কৃতি।
আমাদেরকে অবশ্যই দ্রুত এবং সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সাথে আমলে নিতে হবে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কী হবে।
যখন সম্ভাব্য বিকল্প থেকে কোন একটা সিদ্ধান্ত নেবো তখন নিজেদেরকেই জিজ্ঞেস করতে হবে কীভাবে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলা শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, জিজ্ঞেস করতে হবে করোনা পরবর্তী কেমন পৃথিবীতে আমরা বাস করতে যাচ্ছি।
অবশ্যই করোনাতংক আমরা এক সময়ে জয় করে ফেলবো, মনুষ্য প্রজাতিও বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে, আমদের বেশীরভাগ বন্ধু স্বজনও বেঁচেই থাকবে বলা যায়, কিন্তু আমরা বাস করতে যাচ্ছি একটা নতুন পৃথিবীতে।
জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করতে স্বল্পমেয়াদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপই হয়ত নির্ধারণ করে ফেলতে পারে জীবনের গতিপথ।
এটাই জরুরী অবস্থার চরিত্র, যা একবার ঘটে তা জেঁকে বসে জীবনের তরে, ইতিহাসের পাতাকে ত্বরান্বিত করে ভবিষ্যতের জন্য।
স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে হয়ত সময় লাগত বছরের পর বছর সেই সিদ্ধান্তই যাপিত জীবন হয়ে যাবে কিছু ঘণ্টার মধ্যে।
পরীক্ষাধীন বা অপরিপক্ব এমনকি ভয়ানক প্রযুক্তি চলে আসতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে। কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে দেখা যাক কী হয় এই মনোভাবের ঝুঁকি আরও ভয়ানক, সুতরাং সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
আমাদের সমস্ত সমাজটা হয়ে যাচ্ছে সামাজিক গবেষণার গিনিপিগ। কী হবে যখন সব মানুষ বাসায় বসে কাজ করবে এবং যোগাযোগ সেরে নেবে দূর থেকে অনলাইনে? কী ঘটতে পারে যদি সব স্কুল আর ইউনিভার্সিটি অনলাইনে চলে যায়?
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সরকার, ব্যবসায়ী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ত এমন পরীক্ষামূলক প্রস্তাবে কখনো রাজি হ’তো না কিন্তু এখন তো স্বাভাবিক সময় নয়।
এই সংকটের সময়ে আমদের সামনে দুটি বিকল্প খোলা আছে। প্রথমত সর্বেসর্বা একনায়ক সরকারের সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং নাগরিকের ক্ষমতায়ন অথবা জাতিকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বৈশ্বিক সাম্যের সাথে একাত্ব করা।
শরীরের অভ্যন্তরে নজরদারিঃ
করোনা ভাইরাসের মহামারী থামাতে পুরো জনগোষ্ঠীকে কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হবে। দুইটি উপায়ে এটা অর্জন করা সম্ভব। একটা উপায় হচ্ছে সরকার জনগণের উপর নজরদারি করবে, যদি কোন নাগরিক আইনভঙ্গ করে তবে সে শাস্তি ভোগ করবে।
আজকের দিনে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রযুক্তি সবমানুষকে সবসময় নজরদারির আওতায় আনতে সম্ভব করে দিচ্ছে।
৫০ বছর আগে কেজিবি ২৪ ঘণ্টা ২৪০ মিলিয়ন মানুষকে নজরদারি করতে পারত না, কেজিবি সব মানুষের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা কল্পনাও করত না।
কেজিবিকে গোয়েন্দা এজেন্টের প্রাপ্ত তথ্য এবং তার বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করতে হ’তো এবং তদুপরি সমস্ত নাগরিকের উপর নজরদারি করার গোয়েন্দা নিয়োগ দেয়াও কেজিবি’র পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কিন্তু বর্তমানে সরকার সর্বত্র এবং সর্বব্যাপী (ঈশ্বরের মত) সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে রেখে এবং শক্তিশালী অ্যালগোরিদমের উপর নির্ভর করতে পারে, ফলে তাকে আর রক্ত মাংসের সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হচ্ছে না।
[ he Colosseum in Rome, Piazza Beato Roberto in Pescara © Graziano Panfili]
করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলা করতে কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই নতুন নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবস্থা নিয়োগ করেছে, তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ চীন।
চীনের নাগরিকদের স্মার্ট ফোন তদারকি করার কারণে আর লাখে লাখে ফেস রিকগনিশন ক্যামেরার নজরদারি ফলে মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের শারীরিক অবস্থা, শরীরের তাপমাত্রা সরকারকে জানিয়ে দিচ্ছে।
ফলে চীন সরকার অতিদ্রুত করোনা ভাইরাসের সন্দেহভাজন সংক্রামিত রোগীকে শনাক্ত করে ফেলছে, তাদের গতিবিধি দেখতে পাচ্ছে এবং চিহ্নিত করতে পারছে তার সংস্পর্শে আর কে কে এসেছে।
চীন বা দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ আশেপাশের সম্ভাব্য করোনাক্রান্ত রোগীর অবস্থান সম্পর্কে মোবাইল ফোনে সতর্ক বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এই আর্টিকেলের সমস্ত ছবি ওয়েবক্যামের মাধ্যমে ধারণ করা হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে ইতালির লক-ডাউন একটা শহর থেকে দেখানো হচ্ছে একটা নির্জন রাস্তা, ফুটে উঠেছে ভয়াবহতার চিত্র।
নজরদারির এতসব আধুনিক আয়োজন প্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন আর নতুন কিছু নয়।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ইজরায়েলের সিকিউরিটি এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছে সম্ভাব্য করোনা ভাইরাস বহনকারী খুঁজে বের করার জন্য এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যা স্বাভাবিক সময়ে সন্ত্রাসী শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সংসদীয় কমিটি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিপক্ষে রায় দিলে নেতানিয়াহু জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে প্রস্তাবনাটি অনুমোদন করিয়ে নেন।
আপনি হয়ত যুক্তি দেখাতে পারেন, এখানে নতুনত্ব কই, এরকমই হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার এবং কোম্পানিগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের চলাফেরার খোঁজখবর নিচ্ছে, গতিবিধির উপর নজরদারি করছে এবং রাজনীতি ও পণ্যের বাজার বানিয়ে রাখছে।
আমরা যদি সতর্ক না হই তবে, করোনা মহামারী মানুষকে নজরদারির ইতিহাসে গভীর চিহ্ন রেখে যাবে।
যেকোনো দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক সময়ে এরকম নজরদারি করলে তীব্র প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করলেও মহামারীর সময়ে তারা স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আগে তো বরং নজরদারি চলত শরীরের বাহ্যিক অবয়বে বা গতিবিধিতে, কিন্তু জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্র জেনে যাচ্ছে আমার শরীরের অভ্যন্তরের অবস্থা, হৃৎস্পন্দন কত বা রক্তচাপ কেমন।
যখন আপনি আপনার স্মার্ট-ফোনের স্ক্রিনে স্পর্শ করলেন আর একটা লিংকে ক্লিক করলেন, সরকার জানতে চাইলো ঠিক কী খোঁজার জন্য আপনি কোন লিংকে ক্লিক করেছিলেন।
কিন্তু করোনা ভাইরাসে মহামারীর কারণে সরকার এখন জানতে চাচ্ছে আপনার শরীরের তাপমাত্রা কত, রক্তচাপ কেমন।
জরুরী অবস্থার পুডিং
নজরদারির পরিবেশের মধ্যে কাজ করার অস্বস্তি হচ্ছে আমরা সবাই জানি নজরদারির মধ্যে আছি কিন্তু আমরা কেউ জানি না আমরা কতটা নজরদারির মধ্যে আছি।
সামনের দিনগুলোতে আরও নতুন কী নজরদারির সরঞ্জাম আসবে আমরা সেটাও জানি না। নজরদারি প্রযুক্তির আধুনিকায়নের গতি ছুটে চলছে রেসের ঘোড়ার মত।
১০ বছর আগেও বিজ্ঞানের যেসব কল্পকাহিনী ছিল আজ সেগুলো পুরনো খবর। আসুন ধরে নিই, একটা সরকার সেদেশের সব নাগরিকদের বলল একটা বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরতে।
ব্রেসলেট ২৪ ঘণ্টা মাপ রাখবে শরীরের তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন। সরকার অ্যালগোরিদমের সাহায্যে বিশ্লেষণ করছে সব নাগরিকের শারীরিক অবস্থা।
নাগরিক নিজে বুঝে ওঠার আগেই অ্যালগোরিদম সরকারকে বলে দেবে ওমুক নাগরিক অসুস্থ, অ্যালগোরিদম বলে দেবে অসুস্থ নাগরিক কোথায় আছে, কাদের সাথে আছে।
সরকার সহজেই করোনা সংক্রামিত নাগরিক এবং যাদের সাথে সে মিশেছিল তাদের সবাইকে আলাদা করতে পারবে, ফলে সরকার অতিদ্রুত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, এমনকি নির্মূল করতে পারবে।
এরকম ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারলে কিছুদিনের মধ্যে করোনা দমন সম্ভব, শুনতে কী দারুণ শোনাচ্ছে, তাই না?
স্বাস্থ্যসেবার এমন অসাধারণ সুবিধারও অন্ধকার দিক আছে। রাষ্ট্র নাগরিকদেরকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেয়ে যায়।
ধরে নিই, যদি আপনি জেনে যান, আমি সিএনএন ক্লিক না করে ফক্স নিউজ লিংকে ক্লিক করলাম, এতে হয়ত আপনি বুঝে ফেলছেন আমার রাজনৈতিক চিন্তা ও মনোভাব, এমনকি আপনি জেনে যাচ্ছেন আমার ব্যক্তিগত-তথ্য, ব্যক্তিত্ব, পছন্দ।
কিন্তু যদি কোন একটা ভিডিও ক্লিপ দেখার সময় আপনি আমার শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ এবং হৃৎস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করেন তবে আপনি জানতে পারবেন কিসে আমি হাসি, কেন আমি কাঁদি, কী আমাকে ভয়ানক রাগিয়ে দেয়।
মনে রাখতে হবে ক্ষোভ, আনন্দ, বিরক্তি, ভালবাসার মানসিক দিকগুলো জৈবিক বৈশিষ্ট্য তেমনি জ্বর বা সর্দিকাশিও শরীরের স্বাভাবিক ঘটনা।
যে প্রযুক্তি নাগরিকের কাশির সমস্যা আছে কিনা বুঝতে পারে, সেই একই প্রযুক্তি মানুষের হাসিও বুঝতে পারে।
কোম্পানিগুলো আর সরকার যদি আমাদের বায়োমেট্রিক তথ্য ভাণ্ডার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে, তাহলে রাষ্ট্র বা কোম্পানির মত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদেরকে এমনভাবে বুঝে ফেলবে, যেটা হয়ত আমরা নিজেরাও নিজেদেরকে এতটা চিনি না।
তারা আমাদের অনুভূতি অনুমান করেই ক্ষান্ত থাকবে না, তারা আমাদের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে ছাড়বে এবং আমাদের কাছে বিক্রি করবে যা তারা বিক্রি করতে চায়, হ’তে পারে পণ্য বা রাজনীতি।
বায়োমেট্রিক নজরদারির যুগে তথ্য চুরির জন্য ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা লিমিটেডের’ কত কম্পিউটার প্রকৌশলীর অবিরাম হ্যাকিং প্রচেষ্টাকে মনে হয় বরফ যুগের ঘটনা।
মনে করুন, ২০৩০ সালে উত্তর কোরিয়াতে প্রতিটি নাগরিককে বাধ্যতামূলক দিনে ২৪ ঘণ্টা একটা বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরতে হয়। মহান নেতার ভাষণের সময় ব্রেসলেট যদি বুঝতে পারে নাগরিক রেগে যাচ্ছে তাহলে সে শেষ।
Veduta della Casa Universitaria in Lodi © Graziano Panfili
গণস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের জরুরী অবস্থার জন্য বায়োমেট্রিক নজরদারি ব্যবস্থা সাময়িক চলতে পারে, জরুরী অবস্থা চলে গেলে নজরদারি তুলে দেয়া যায়।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার খারাপ দিক হচ্ছে সাময়িক সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় অনন্তকাল স্থায়ী হয়ে যায়। রাষ্ট্র বোঝায় ভবিষ্যতে পথে পথে আরও মহামারী ওঁতপেতে আছে।
আমার নিজের দেশ ইজরায়েলে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে, তখনো সাময়িক সময়ের জন্য সংবাদপত্রের উপর তদারকি, জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে একটা বিশেষ রেসিপি’তে পুডিং বানানো পর্যন্ত (আমি মোটেও মজা করছি না)।
ইজরায়েল বহুবছর আগেই স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেছে কিন্তু ইজরায়েল এখন পর্যন্ত সেই সাময়িক জরুরী অবস্থার সমাপ্তি ঘোষণা করে নাই। এমন আরও অনেক ছোট ছোট ‘সাময়িক’ পদক্ষেপ বাতিল করতে পারেনি। (নাগরিকদের উপর দয়া করে ২০১১ সালে ‘ইমারজেন্সি পুডিং ডিক্রি’ বিলুপ্ত করা হয়।)
এমনকি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও হাতের মুঠোয় বায়োমেট্রিক তথ্য ভাণ্ডার পেয়ে যাওয়া সরকার পুনরায় করোনা আক্রমণের ভয় দেখিয়ে অথবা আফ্রিকাতে এবছর ইবোলা নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন কারণ দেখিয়ে বায়োমেট্রিক নজরদারি চালিয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রধান আলোচ্য বিষয়। করোনা ভাইরাস মহামারী ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা, স্বাস্থ্য আর নজরদারি সরকার ও নাগরিকের মধ্যে সংঘাত ত্বরান্বিত করবে।
সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আর স্বাস্থ্যের মধ্যে বেছে নিতে বললে স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্য সুবিধাকেই তারা প্রাধান্য দেবে।
সাবান পুলিশ
সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা বেছে নেয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যার সূচনা, কারণ মানুষের সামনে এই ধরণের বেছে নেয়ার সুযোগই বানোয়াট এবং চতুরতা।
আমাদেরতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা দুটো একসঙ্গেই ভোগ করার অধিকার থাকা উচিৎ।
আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং করোনা মহামারী থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে আমাদের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারির করার প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারীতে পরিণত না হয়ে বরং জনতার হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করা উচিৎ।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে করোনা ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে কিছু সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে দক্ষিণ কোরিয়াতে, তাইওয়ানে এবং সিঙ্গাপুরে।
এই দেশগুলো সম্ভাব্য করোনা ভাইরাস সংক্রামিত নাগরিক শনাক্ত করতে ট্র্যাকিং অ্যাপ ব্যবহারের পাশাপাশি নির্ভর করেছে অতি-সতর্কতার সাথে রোগ পরীক্ষা করা, তারা সততার সাথে রোগের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং সর্বোপরি তাদেরকে সাহায্য করেছে আগ্রহী নাগরিক যারা সব তথ্য সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল।
নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী নীতিমালা মেনে চলানোর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা বা কঠোর শাস্তির বিধান করাই একমাত্র সমাধানের উপায় হতে পারে না।
যখন নাগরিকদেরকে বিগ ডাটার বৈজ্ঞানিক বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলা হয় এবং তারা যখন সরকারকে তাদের সম্পর্কিত তথ্য দেয়, তখন ঘাড়ের উপর বিগ ব্রাদারের নিঃশ্বাস উপেক্ষা করেই নাগরিকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সুন্দর কর্পোরেট কেতাদুরস্ত ড্রেস কোডের শিক্ষিত মূর্খ এবং আত্মসর্বস্ব জনগোষ্ঠীর তুলনায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং সচেতন জনগোষ্ঠী অনেক শক্তিশালী এবং কার্যকরী।
উদাহরণস্বরূপ, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রচলন মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটা বিপ্লবী উন্নয়ন।
খুব সাধারণ অভ্যাসটাই প্রতিবছর বাঁচিয়ে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। বর্তমানে সাবান দিয়ে হাত ধোয়াটাকে আমাদের চিরকালের অভ্যাস মনে হলেও এইতো মাত্র উনিশ শতকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার গুরুত্ব।
উনিশ শতকের আগে এমনকি ডাক্তার এবং নার্সরাও এক সার্জিকাল অপারেশন শেষ করে অন্য একটা সার্জিকাল অপারেশন শুরু করে দিতো সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে বা জীবাণুনাশক ব্যবহার না করেই।
বর্তমানে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন সাবান দিয়ে হাত ধোয়, সাবান যেকোনো পুলিশ বা সাবান দিয়ে হাত না ধুলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে এই ভয়ে নয় বরং তারা জানে হাত ধোয়ার উপকারিতা।
আমি সাবান দিয়ে হাত ধুই কারণ আমি জানি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার কথা। আমি জানি এই অতিক্ষুদ্র অণুজীব আমাদের শরীরে রোগ সৃষ্টির কারণ, সাথে আমি এটাও জানি সাবান দিয়ে হাত ধুলে জীবাণু চলে যায়।
কিন্তু এরকম সর্বজনীন সম্মতি আর সমর্থন অর্জন করতে হলে আপনার দরকার জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা।
মানুষকে বিজ্ঞানে বিশ্বাস করতে হয়, সরকারকে বিশ্বাস করতে হয়, গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করতে হয়।
গত কয়েক বছর ধরে অপরিণামদর্শী দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্র পরিচালকেরা রাজনৈতিক কারণে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নাগরিকদেরকে বিজ্ঞান-বিমুখ করে ফেলেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ চরম অব্যবস্থাপনায় পর্যবসিত হয়েছে এবং গণমাধ্যমকে বানিয়েছে হাতের পুতুল।
এখন এইসব দুর্নীতি-প্রবণ রাষ্ট্র পরিচালকেরা স্বৈরাচারের অবাধ ক্ষমতার মোহে আকৃষ্ট হ’তে পারে। বিতর্কের সূত্রপাত এখানে, জনগণকে বিশ্বাস করা যায় না, তারা সবসময় সঠিক কাজটা করতে পারবে এমন ভরসা নাই।
স্বাভাবিকভাবেই যে বিশ্বাস ভেঙেছে বছরের পর বছর ধরে, সেই বিশ্বাস রাতারাতি জোড়া লাগানো যায় না। কিন্তু আপদকালীন সময় আলাদা কথা। সংকটের সময় মন অতি দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে।
কারো হয়ত ভাইতে ভাইতে দা কুমড়া সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে কিন্তু জরুরী প্রয়োজনে ঠিকই বুঝতে পারে সম্পর্কের গভীরে রয়েছে আস্থা এবং পরম নির্ভরতা এবং তখনই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায়।
নজরদারির রাজত্ব কায়েমের থেকে, এখনো সময় আছে রাষ্ট্রের উচিৎ মানুষকে বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তোলা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কল্যাণমুখী করা এবং গণমাধ্যমকে মুক্ত করে দেয়া।
আমরা অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবো, কিন্তু প্রযুক্তি শুধু ব্যবহৃত হবে নাগরিকের ক্ষমতায়নের জন্য।
আমার শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ রাষ্ট্রকে জানাতে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত তথ্য যেন ঈশ্বরসম সর্বশক্তিমান স্বৈরাচারী সরকার সৃষ্টিতে ব্যবহৃত না হয়।
বরং নাগরিকের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহৃত হওয়া উচিৎ নাগরিকদের জন্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কাজে এবং এই কাজগুলোর বাস্তবায়নের সময় রাষ্ট্র যেন নাগরিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।
The Royal Palace of Caserta © Graziano Panfili
যখন আমি আমার শরীরের অবস্থা ২৪ ঘণ্টা দেখতে পারি তাহলে আমি নিজেই বুঝতে পারব আমি অন্য কারো স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ কিনা।
জানতে পারবো কোন অভ্যাস আমার শরীরে কেমন প্রভাব ফেলছে। যদি আমি করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে বিস্তারের নির্ভুল নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান জানতে পারি এবং বিশ্লেষণ করি তাহলে আমি বুঝতে পারব, সরকার আমাকে সত্য তথ্য দিচ্ছে কিনা এবং মহামারী প্রতিরোধে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোও দেখতে পাবো।
যখনই মানুষ রাষ্ট্রের নজরদারির কথা বলে, মনে রাখতে হবে একই নজরদারির প্রযুক্তি দিয়ে শুধু রাষ্ট্রই সে প্রতিটি মানুষকে তদারকি করছে তা নয় বরং প্রতিটি মানুষও সরকারকে পর্যবেক্ষণ করছে।
বিভিন্ন কারণে করোনা ভাইরাস নাগরিকদের সামনে একটা বিরাট পরীক্ষা। সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রত্যেককে বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং ডাক্তারদের উপর ভরসা করা উচিৎ।
বাদ দিতে হবে গায়েবী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মত মতবাদ এবং আত্মসর্বস্ব সর্বগ্রাসী রাজনীতিবিদ।
যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে ফেলি তাহলে আমরা আমাদের স্বাধীনতার মত অমূল্য রতনকে দূরে সরিয়ে দেয়ার দলিলে দস্তখত করে দিলাম। ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো, একমাত্র এটাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার কবচ ও কুণ্ডল।
আমাদের একটা বৈশ্বিক পরিকল্পনা দরকার
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পছন্দ হতে পারে জাতিগত-ভাবে একঘরে হয়ে থাকা অথবা বিশ্বের সব দেশের সাথে সংহতি প্রকাশ করা।
মহামারী নিজেই বিশ্ববাসীর জন্য একটা সংকট এবং মহামারির ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় এবং বৈশ্বিক সমস্যা সৃষ্টি করে। সমস্যাগুলোকে কার্যকরভাবে সমাধান করা সম্ভব শুধুমাত্র বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে।
সর্বপ্রথম এবং সর্বোপরি করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করতে হলে আমাদের সবাইকে বিশ্বব্যাপী তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকতে হবে।
ভাইরাসের থেকে মানুষের শক্তি এখানেই শক্তিশালী। চীনের করোনা ভাইরাস আমেরিকার করোনা ভাইরাসের কাছে মানুষকে সংক্রামিত করার উপায়, তথ্য, পরামর্শ আদানপ্রদান করতে পারে না।
কিন্তু চীন আমেরিকাকে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য মূল্যবান পরামর্শ দিতে পারবে।
আজ ভোরবেলায় ইতালিয়ান ডাক্তার মিলানের ল্যাবরেটরিতে যে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করলেন, সন্ধ্যায় হয়ত সেই ভ্যাক্সিন ব্যবহারে তেহরানে করোনা মুক্ত হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ।
যখন করোনা মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তখন যুক্তরাজ্য হয়ত কোরিয়া থেকে শিক্ষা নিতে পারে কারণ, কোরিয়া মাত্র একমাস আগে একই রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছিল।
কিন্তু এর জন্য দরকার সব দেশের বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা এবং আস্থা। আগামী দিনগুলোতে আমাদের প্রত্যেকেরই বিশ্বাস আনতে হবে বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর, বিশ্বাস আনতে হবে অভিজ্ঞ ডাক্তারের উপর সেই সাথে ত্যাগ করতে হবে গায়েবী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং বাতিল করে দিতে হবে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ।
দেশগুলোকে স্বেচ্ছায় তথ্য অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানে এগিয়ে আসতে হবে, আন্তরিকভাবে মহামারী নিরসনের উপায় খুঁজতে হবে, আস্থা রাখার মত নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকতে হবে, তথ্যের প্রবাহে কোন অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আছে কিনা দেখতে হবে।
আমাদের প্রয়োজন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করা এবং বিতরণের বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। বিশেষ করে দরকার করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার টেস্টিং কিট এবং কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার যন্ত্র।
আপাতত প্রতিটি দেশে স্থানীয়ভাবে করোনা চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করে তাই নিয়ে আত্মসুখের বিজ্ঞাপন প্রচার করার থেকে বরং বিশ্বের সব দেশের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে হবে এবং সেগুলো স্বচ্ছতার সাথে করোনা উপদ্রুত এলাকায় পৌঁছে দিতে হবে।
যুদ্ধের সময় যেভাবে দেশগুলো প্রধান প্রধান শিল্পখাতকে জাতীয়করণ করে তেমনি করোনার বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধে জরুরী উৎপাদন খাতকে মানবিক করা দরকার।
উন্নত দেশ কিন্তু করোনা হয়ত ততটা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েনি এমন দেশকে এগিয়ে আসতে হবে মহামারী আকারে করোনাক্রান্ত দরিদ্র দেশের সহযোগিতায়।
দেশগুলোর মাঝে আস্থা থাকা দরকার যদি কোন দেশের সাহায্যের প্রয়োজন হয় অন্যদেশগুলো যেন এগিয়ে আসে।
একইভাবে আমরা প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য চিকিৎসা উন্নয়নে বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে বিবেচনায় রাখতে পারি।
এখন পর্যন্ত যেদেশগুলো অপেক্ষাকৃত কম করোনাক্রান্ত সেসব দেশ ডাক্তার নার্স মহামারী আক্রান্ত দেশে সাহায্য পাঠাতে পারে।
এতে বিপদের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো হল আবার মহামূল্য অভিজ্ঞতাও অর্জন হল। ভবিষ্যতে যদি আবার মহামারী দেখা দেয় তখন তারা মহামারী নিরসনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে।
অর্থনৈতিক যুদ্ধেও বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর মাঝে পারস্পারিক সহযোগিতা অতীব প্রয়োজন।
যদি বিশ্বের অর্থনীতি এবং চাহিদা যোগানের সাপ্লাই চেইন বিচার করি আর যদি প্রতিটি সরকার অন্য দেশকে খারিজ করে দিয়ে নিজেই সবকিছু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চায় তাহলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং সংকট আরও গভীরে শিকড় বিস্তার করবে।
আমাদের বৈশ্বিক কর্ম পরিকল্পনা দরকার এবং এটা আমাদের খুব দ্রুত দরকার।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, রাষ্ট্রগুলো এমন সিদ্ধান্তে আসুক, সব ধরণের আন্তর্জাতিক চলাচল কয়েকমাসের জন্য নিষিদ্ধ।
যদিও এই সিদ্ধান্তের ফলে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, করোনার সাথে যুদ্ধ বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু জরুরী প্রয়োজনে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদেরকে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়, সুতরাং তাদের জন্য নিয়ম শিথিল করে দিতে হবে।
বিশ্বের সব দেশের মধ্যে চুক্তি হতে পারে জরুরী প্রয়োজনে কেউকে দেশের বাইরে যেতে হলে নিজ দেশ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নীরোগ প্রমাণিত হলেই কেবল তিনি ভ্রমণ করতে পারবেন।
যদি কোন দেশ নিশ্চিত হয় সতর্ক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের তল্লাশি পেরিয়ে তবেই একজন যাত্রী বিমানে উঠতে পারে তবে তাকে সেদেশে প্রবেশে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।,
The Duomo in Florence © Graziano Panfili
দুর্ভাগ্য বর্তমানের কোন দেশই এরকম সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে গ্রাস করেছে বহুমুখী অন্ধত্ব।
মনে হচ্ছে দেশগুলো নিতান্ত শিশু তাদেরকে পরিচালনা করার জন্য কোন বয়োজ্যেষ্ঠ নেই। কেউ আশা করে থাকতে পারে এক সপ্তাহ আগে বৈশ্বিক নেতাদের জরুরী বৈঠকে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
কিন্তু জি৭ নেতৃবৃন্দ এক সপ্তাহ আগে ভিডিও কনফারেন্স আয়োজন করতে পারলেও পরিকল্পনা মাফিক কোন কাজই শুরু করেনি।
অতীতের সব সংকটে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারীর সময় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতার ভূমিকা পালন করেছিলো।
কিন্তু বর্তমানের করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। করোনা আমদের সামনে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে গেল আমেরিকার মহত্ব ভবিষ্যতের মানবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
বর্তমান আমেরিকা প্রশাসন কাছের বন্ধুদের হারিয়েছে। যখন আমেরিকা ইইউ থেকে তার দেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দিলো তখন আমেরিকা দ্বিতীয়বার চিন্তাও করে দেখে নাই যে ইইউকে অগ্রিম সতর্ক বার্তা পাঠিয়ে দিলো।
এমনকি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ইইউ’র সাথে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করেনি।
এর মাঝেই জার্মানি গুজব ছড়িয়ে দিলো আমেরিকা জার্মান একটা ওষুধ কোম্পানিকে ১বিলিয়ন ডলার প্রস্তাব দিয়েছে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে, প্যাটেন্ট কিনে বিশ্বব্যাপী একচ্ছত্র ব্যবসা করবে।
এমনকি এখন যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন তার নীতিমালা পরিবর্তন করে, করোনা প্রতিহত করতে বিশ্বব্যাপী কর্মপন্থা নির্ধারণ করে গুটি কয়েক দেশও হয়ত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতা হিসেবে মেনে নেবে না।
কারণ যে নেতা সংকটের সময় দায়িত্ব নেয় না, কখনো নিজের ভুল স্বীকার করে না এবং অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে সাফল্যের সব কৃতিত্ব নিজে নেয়া অভ্যাসে পরিণত করে তাকে অন্যরা বিশ্বাস করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া শূন্যতা যদি অন্য দেশ পূরণ করতে না পারে তাহলে করোনা মহামারী ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
যদিও সমস্যা কোন সমস্যা নয়, সমাধান হলেই সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত। আমরা অবশ্যই আশা করি বর্তমান মহামারী থেকে আমরা শিক্ষা নেবো; বুঝতে পারবো পারস্পারিক হানাহানি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষ জাতির জন্য কত ভয়ানক, কত তীব্র।
মানুষকে এখন বেছে নিতে হবে। আমরা কি আমাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ক্রমাগত চালিয়ে যাবো? নাকি আমরা বৈশ্বিক শান্তি সংহতির পথ বেছে নেবো?
যদি আমরা সংঘাতের পথ বেছে নিই তাহলে মহামারী শুধু দীর্ঘস্থায়ীই হবে তা নয় বরং ভবিষ্যতে সমগ্র মানুষ প্রজাতির ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলবে।
যদি আমরা বৈশ্বিক সংহতির পথ বেছে নিই তাহলে করোনা মহামারী জয় করতে পারবো, এমনকি ভবিষ্যতে ২১ শতকেও যদি কোন মহামারী বা সংকট দেখা দেয় তাহলে মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বিপদ মোকাবিলা করতে পারবে।
অনুবাদঃ বিকাশ মজুমদার
তথ্যসূত্রঃ মুক্তমনা বাংলা ব্লগ
মূল প্রবন্ধ: Yuval Noah Harari: the world after coronavirus
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।