icon

কলই রূপকথাঃ দুষ্টু বানর

Jumjournal

Last updated Mar 26th, 2020 icon 832

এক ছিলো বানর। সে ছিল ভারী দুষ্ট। ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলতে অথবা নষ্ট করে দিতে।

সেবার ছিলো শীতকাল। জুমক্ষেতে ছিলো অনেক ফসল। সেই বানরের ভয়ে গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে রওয়ানা হল ফসল তুলতে।

জুমে গিয়েই মেয়েরা দেখলো বানর জুমের ভালো বেগুনগুলো পেড়ে পেড়ে খাচ্ছে।

ওরা বানরের দিকে একটা কুকুরকে লেলিয়ে দিয়ে বললো – ‘যা -যা-দু-দু। বানর ভয়ে একটা বড় গাছে উঠে প্রাণ বাঁচাল বটে কিন্তু মনে মনে এর প্রতিশােধ নেবার ফন্দী আঁটতে লাগলো।

 মেয়েরা ফসল তুলতে তুলতে বেলা দুপুর হয়ে গেলে ওরা সকলে গামছা নিয়ে রওয়ানা হল ছড়ার দিকে। রিগনাই-রিছা ছড়ার পাশে রেখে রিতুকু (গামছ) পরে স্নান করতে নামলো।

মজা করে সবাই স্নান করছে। কুকুরটাও তখন গাছের ছায়ায় ঘুমোচ্ছ। সুযোগ বুঝে বানর গাছ থেকে নেমে এসে মেয়েদের সব জামাকাপড় নিয়ে আবার গাছের মগডালে উঠে বসে রইলো।

স্নান সেরে ইতিমধ্যে মেয়েরা ফিরে এসে জামাকাপড় না পেয়ে এদিক ওদিক খোঁজাখুজি করতে লাগলো।

মেয়েদের এই অবস্থা দেখে বানর গাছের ডাল ধরে দিলো একঝাঁকুনি।ওরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো বানরের কাছেই ওদের সব জামা কাপড় রয়েছে।

মেয়েরা এতো বড় গাছে উঠতে পারবেনা ভেবেই মনস্থির করলো বানরের কাছে জামাকাপড় চাইবে।

এর বদলে বানরকে কিছু বেগুন দিয়ে দেবে। এই ভেবেই সবচেয়ে বড় মেয়েটি বানরকে বললো – ও বানরদাদা আমাকে রিগনাই-রিছ দাও। দেখছো না আমারা আর কোননা জামা পড়ে নেই।”

“দুই বানর বললো “মই-য়ের একধাপ উঠে এসে আমাকে এক গন্ডা বেগুন দাও, তবেই রিগনাই-রিছা দেবো।”

বানরের কথামতো মেয়েটি একগন্ডা বেগুন দিলে বানর তাকে জামাকাপড় দিয়ে দিলো।

এরপর দ্বিতীয় মেয়েটি যখন তার রিগনাই-রিছা চাইলো তখন বানর বললো “দুগন্ডা বেগুন নিয়ে দুধাপ সিঁড়ি উঠে এসো তবেই তোমার কাপড় পাবে।

মেয়েটি বানরের কথামতো কাজ করে রিগনাই-রিছা নিয়ে এলো।

এভাবে এক এক সিঁড়ি এগিয়ে এক এক গন্ডা বেশী বেগুন দিয়ে ছটি মেয়ে তাদের জামাকাপড় নিয়ে এলো।

এখন রইলো বাকি সবচেয়ে ছোট মেয়েটি। সে-ই বানরকে কুকুর লেলিয়েছিলো।

বানর তাকে বললো, ‘সাতগন্ডা বেগুন নিয়ে সাতধাপ সিঁড়িউঠে এসো।”অনেক কষ্টে মেয়েটি সাতধাপ সিঁড়ি বেয়ে গাছের উপর উঠে গেল বানর কিন্তু বেগুন নিলোনা এবার।

সে মেয়েটিকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে গেল গাছের মগডালে। ভয়ে মেয়েটি চীৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলে গাছের নিচে থাকা অন্য মেয়েরাও কাদতে শুরু করলো।

এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে দেখে মেয়েরা সবাই বাড়ি ফিরে বড়দের সব কিছু জানালো। এবার বড়রা সবাই মেয়েটিকে খুজতে বেরোলো।

ইতিমধ্যে রাত হয়ে যাওয়ায় ওরা মেয়েটিকে খুঁজে পেলোনা। ততক্ষণে বানর মেয়েটিকে কাঁধে বয়ে গভীর বনের একটি বড় গাছে নিয়ে তুললো।

ওখানে ছিল বানরের ঘর। এবার বানর মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেললো। বানরের সঙ্গে কি মানুষ থাকতে পারে? মেয়েটি কান্নাকাটি শুরু করলো।

কিন্তু পালাতেও পারলোনা। এতো গভীর বন। রাস্তাঘাটও জানা নেই তার।

এমনি করেই দিন যায়। কয়েকবার মেয়েটি পালাতে চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। বানর ধরে ফেলেছে তাকে। কিছুদিন পর বানরের একটি ছেলে হয়।

তার নাম ততে। ছেলেও বড় হচ্ছে আর বৌ-বানরকে বললো দুরের গ্রাম থেকে বাসতুই (আমড়া) এনে দিতে।

বানর হাসতুই আনার জন্য রওয়ানা হতেই বানরের বৌ তৈরী হতে লাগলো পালিয়ে যাবার জন্য। বানরের জন্য তার মনে একটু মায়াও ছিল।

আবার ভাবলো, বানরের সঙ্গে কি মানুষ থাকতে পারে। এসব ভেবে তার চোখে এলো জল। সে উনুনে চাপানো ভাতের হাঁড়িকে বললো,

“ভাতের হাড়ি তুমি এমনি করে টগবগ করে ফুটতে থাকো”। ঘরের পোষা বেড়ালকে বললো, তুমিও মিউমিউ বলে ডাকতে থাকো।

 চাখাইখকে বললো, তুমিও এভাবে জল ঝরাতে থাকো। (চাখাইখ বাঁশের তৈরী মোচাকৃতি পাত্র)

 এবারে ততেকে কোলে নিয়ে বানরের বৌ-পিঠে ঝোলানো একটা লাঙ্গা আর হাতে নিলো একটি দা। তারপর বনের পথে রওয়ানা হল।

সন্ধ্যা হয় হয়। বানর বাড়ি ফিরে দেখে বৌ-ও নেই, ছেলেও নেই। এদিক ওদিক খুজে কোথাও বৌ আর ছেলেকে না পেয়ে অ-ততেমা, অ-ততেমা’ বলে ডাকাডাকি শুরু করলো।

কেউ জবাব দিলোনা, রাগে দুঃখে সে চীৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

তার দুঃখ দেখে ঘরের পােষ বেড়ালটা যেই কাছে এসে বসলাে সে বিড়ালটাকে মারলো এক ঘা। বিড়াল গেল মরে।

বৌ নেই ছেলে নেই। বিড়াল ও মরে গেল। এবার বিড়ালের চামড়া দিয়েই সে বানালো একটি বাদ্যযন্ত্র। নাম তার দং-দরং।

দং-দরং বাজতে বাজাতেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লে বৌ আর ছেলের খোঁজে। সঙ্গে সঙ্গে গাইতে লাগলো

অ দনি দং দরং দনি দং অতে অনি ততেমা বিয়াং থাংজালং? (ও দনি দং দরং দনি দং আমার ততের মা কোথায় গেল?)।

বন-জঙ্গল পেরিয়ে বানর যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এবার এলো একটা জুমক্ষেতের পাশে। জুমে কাজ করছিলো চাষীরা। ওরা ওকে জিজ্ঞেস করলে কি গাইছো তুমি?

বানর বললো—ওর বৌ-আর ছেলের কথা শুনে। ওরা বললো এ পথেই একটি মেয়েকে ছেলে কোলে করে যেতে দেখেছে।

বানর এই পথ ধরেই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পৌছুলল। দূর থেকে বাবাকে দেখেই ছেলে ততে বলে উঠলো ।

 ‘মা-মা-দেখো বাবা এসেছে। মা বললো, দূর ওটা তো একটা বানর। বোকা হেলে ওটা তোর বাবা নয়। এদিকে বানর ঘরের দাওয়ার উঠে এলো।

ততের দাদু আর দিদিমা ‘এসো জামাই -এসো জামাই’ বলে বানরকে খুব আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে গেল।

জামাই এসেছে বলে রাতে সবাই মিলে খুব হৈ চৈ আনন্দ করে খাওয়া-দাওয়া করলো। মাচার ঘরে বিছানা পেতেছে বানরের স্ত্রী। বিছানায় এসে ঘুমোলো বানর।

বিছানায় পাশে ছিল একটা বড় গর্ত। বানর তা দেখেনি। বানরের বৌ এসে বানরকে সেই গর্তের পাশেই শুইয়ে দিলো। ছেলেকে মাঝখানে রেখে নিজেও শুয়ে পড়লো।

বানর ঘুমিয়ে পড়লো। বৌ কিন্তু ঘুমোলো না। যেই ঘুমের ঘোরে বানরের নাক ডাকতে শুরু করলো বৌ তাকে বললো’ ও-ততের বাবা, একটু সরে শোও- ছেলে তাতে যে চাপা পড়বে।

 দ-দ’ বলতে বলতে বানর যেই একটু সরে গেল অমনি বৌ আবার বললো ও ততের বাবা আরো একটু সরো। এবারে বানর যেই আরো একটু সরে গেল, ব্যস পড়ে গেল সেই গর্তের ভেতর।

ওখানে ছিল এক হাঁটু কাদা। মাচার নিচে ছিল একপাল শুয়োর। কাদায় পড়ে বানর আর উঠতে পারলোনা।

এরই মধ্যে শুয়োরেরা বানরটাকে মেরে ফেললো। আর ততের মা বানরের হাত থেকে রক্ষা পেলো।

তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা

প্রসঙ্গঃ
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply