গারো উপকথা: ক্ষেত পাহারা
1037
এক অবস্থাপন্ন কৃষকের এক দাস ছিল।
কৃষকটি সর্বদা তার প্রতি সদয় ব্যবহার করত। এবার ক্ষেতে বুনো শুকরের উৎপাত আরম্ভ হলে সে তাকে বলল:
“তুমি ক্ষেত পাহারা দিতে যাও।”
দাসটি খাওয়া দাওয়ার পর রাতে “বোরং” (ক্ষেত পাহারা দিবার জন্য তৈরী উচু মাচাং এর উপরে তৈরী ঘর) এ চলে গেল।
চারিদিক নিঝুম, শুধু রাত জাগা কোন পাখী মাঝে মাঝে একে উঠ, দুর থেকে নাম না জানা বুনো ফুলের মৃদু সুবাস বাতাসে ভেসে এসে মনটাকে উদাস করে দিচ্ছে।
বাঁশী বাজিয়ে গান গেয়ে মাঝ রাত পর্যন্ত সে কাটিয়ে দিল।
এক সময়ে বোরংএ অদ্ভুদ শব্দ শুনে সে পাকিয়ে দেখে – কাঠ বিড়ালীর বাসার মত মাথা, ধারালো পেছন বিশিষ্ট কি যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বুকে অবস্থিত তার দুই চোখ আগুনের মত জ্বলছে। বাজখাই গলায় সে বলল:
“হাই, মশা (স্ত্রীর মামা), আমরা লড়াই করি।” তাকে দেখেই লোকটির অজ্ঞান অবস্থা, সে কেবল কাপতে লাগল, কোন জবাব দিতে পারল না।
“কার শক্তি বেশী আমরা তাই পরীক্ষা করে দেখি, এসো।”
লোকই মিন মিন করে বলল;
“আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, আজ আমাকে মাফ কর। কাল লড়ব।”
“ঠিক আছে, ফাঁকি দিওনা, কিন্তু, কাল লড়তে হবে।”
ভয়ে সে বাকী রাতটুকু জেগে কাটালো। ভোরে বাড়ী গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে তার মনিব বলল:
“কি হয়েছে, অসুখ নাকি?”
“অসুস্থতার জন্য ভোর বেলা ক্ষেত থেকে চলে এসেছি।”
রাত্রির কোন ঘটনাই সে প্রকাশ করল না। দিনের বেলায় সুস্থ মানুষের মত ঘুরে বেড়াতে দেখে মনিব সন্ধ্যাবেলায় তাকে ক্ষেত পাহারা দেবার কথা বলল। সে জবাব দিল:
“আমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি, কাল যাব।”
ক্ষেত তো আর অরক্ষিত অবস্থায় রাখা যায় না, মনিব একটা তলোয়ার নিয়ে বোরাংএ শুতে চলে গেল। মাঝ রাতে তেমনি আওয়াজ করে সে এল।
“গতকাল তুমি কথা দিয়েছিলে, আজ লড়তেই হবে।”
ভয়ে মনিবটি কথা বলতে পারলনা, শুধু ভাবল:
হয়তো গতকাল আমার দাস লড়াই এর কথা দিয়ে থাকতে পারে, তাই জন্য ফন্দি করে আমাকে পাঠিয়েছে। এখন এ তো আমাকে ছাড়বেন, কি করি?
শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বলল: “গতকাল লাড়াই এর কথা যে বলেছিল সে আমি নই, আমার দাস।
সে অসুস্থ হওয়াতে আজ আমি এসেছি, লড়াই এর ব্যাপার আমি কিছুই জানিনা, আমাকে তুমি মাফ কর। আগামীকাল আমি তাকেই পাঠিয়ে দেব, তুমি তার সাথেই লড়াই করো।”
“সে সব আমি জানিনা, মোট কথা লড়তে হবে। উঠ, নতুবা আমি তোমাকে চিবিয়ে খাব।”
বেচারা মনিব অনিচ্ছা সত্বেও বোরাং এর নীচে নেমে এল।
আমরা কিভাবে লড়ব-মাথা দিয়ে গুতাগুতি, না পেছন দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করব?”
তার গা থেকে সমানে আগুনের হল্কা বার হচ্ছিল।
মনিব শুধু বলল: “পেছন দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করব।”
“কে আগে ধাক্কা দেবে?”
“তুমি আগে ধাক্কা দেও, আমি তোমাকে ফিরাবো।”
“তা হলে তুমি ধাক্কা ফিরাও, আমি সামনে কিছু দুর দৌড়ে গিয়ে পিছু ফিরে তোমাকে ধাক্কা দেব, প্রস্তুত হও”
সে সামনে কিছুদুর দৌড়ে গেলে মনিবটি গ্রামের দিকে পিছু ছুটতে লাগল। ধাক্কা দেবার এ যে সে তার দিকে পিছু ফিরে দৌড়ে এল তখন সে তার তলোয়ারটা পেছন বরাবর ধরে রাখল। আর সঙ্গে সঙ্গে সেটা সজোরে তার পেছনে ঢুকে গেল।
“আইআঃ! তুমি লাঠিটা পেতে রাখলে যে!! এবার কিন্তু এমন করলে হবে না!!!”
যতবায় সে মনিবটির কাছে এল আগুনের উত্তাপে তার শরীর ঝলসে যেতে লাগল।
এইভাবে বার বার সে সামনে দৌড়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকে ধাক্কা দিতে লাগল। আর মনিবটি ও ক্রমান্বয়ে পিছু ছুটতে ছুটতে গ্রামের কাছাকাছি সরে আসতে লাগল।
প্রতিবারই সে তলোয়ার দিয়ে খোঁচা দিতে দিতে তার পেছনটাকে ভিন্ন ভিন্ন করে দিতে লাগল।
অবশেষে মনিব যখন গ্রামে তার বাড়ীর কাছে পৌছালো সঙ্গে সঙ্গে ভোর হয়ে গেল। তখন সে বলল :
“আজ চলি, আগামী কাল লড়াই হবে।”
মনিবটি বাড়ী পৌঁছে তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের রাত্রির সব ঘটনা বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাণত্যাগ করল। গোসল করাতে গিয়ে দেখা গেল, তার সারা শরীর পুড়ে কালো কয়লা হয়ে গিয়েছে।
লেখক: কথক ও ধরণ সিং সাংমা, তুরা, গারো হিলস্
চিত্রায়নঃ তনময় চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।