খিয়াং লোককাহিনী: কংখোনূপঃ খুই (ঘুঘু পাখির গল্প)
1018
সে অনেক দিন আগের কথা। রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনার এক কোণে ছোট্ট একটাশিমের মাচায় বাস করতো এক যুগল ঘুঘু পাখি। ঘুঘুদের ছিলো ছোট্ট দুটি ছানা।
প্রতিদিন ওই ঘুঘু যুগল ছানা দুটির খাদ্য সংগ্রহের জন্য মাঠ-ঘাট-তেপান্তর চষে বেড়াতো। সন্ধ্যা হলে খাবার নিয়ে ফিরে তা পরম যত্নে ছানা দুটিকে খাওয়াতো।
রাণী তা দেখতে পেলেন। ঘুঘু পাখির এই মমতাবোধ রাণীকে যেন অনেক অনেক দূর থেকে আহ্বান করলো। রাণী মনের দিক দিয়েও ছিলেন চিত্তবতী।
প্রতিদিন চেয়ে দেখতেন ঘুঘু দুটির দিনযাপনের প্রণালী। সন্তান প্রীতির এই অফুরন্ত মমতাঐশ্বর্যই প্রতি মুহূর্তে রাণীর মনকে ভরিয়ে দিতো।
পূর্ণ অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যে একদিন রাণী দেখতে পেলেন, মা ঘুঘুটি আর নেই। এখন পুরুষ ঘুঘু একা একাই খাদ্য সংগ্রহ করে ছানা দুটিকে খাওয়ায়।
এভাবে সপ্তাহ খানেক কেটে যাওয়ার পর রাণী আবার দেখতে পেলেন, ওই একা পুরুষ ঘুঘুর সাথে আরেকটি নতুন মা ঘুঘু এসেছে।
রাণী বুঝলেন, পুরনো মা ঘুঘুটিকে নিশ্চয় কোন “খাটাশ” (এক ধরনের শিকারী বাজপাখি) ধরে নিয়ে ফলে পুরুষ ঘুঘু আরেকটি নতুন মা ঘুঘুকে নিয়েই জুটি গড়েছে। দিন যায় মাস পেরোয়। ঘুঘু দুটি খাদ্য সংগ্রহ করে রীতিমতো ছানা দুটিকে খাওয়ায়।
একদিন ঘটলো এক বিপত্তি। নতুন মা ঘুঘুটি পুরুষ ঘুঘুর অনুপস্থিতিতে ছানা দুটিকে ঠোকরাতে শুরু করে। পুরুষ ঘুঘু আসতে দেখলেই আবার স্বাভাবিক হয়ে আদর-যত্ন করতে থাকে।
এমনি করেই দিন দিন নতুন মা ঘুঘুটির অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চললো ছানা দুটির উপর। একসময় ঠোকরাতে ঠোকরাতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করে নতুন মা ঘুঘুটি।
অকালে মাহারা এই ঘুঘু ছানা দু’টির করুণ মৃত্যু দেখে রাণী মনে খুব ব্যথা পেলেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজের অজান্তেই রাণীর চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে উঠলো।
ঘুঘু ছানার এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাণী খুঁজে পেলেন বাস্তব জীবনে মা-হারা সন্তানের করুণ প্রতিচ্ছবি। ভাবলেন আমার জীবনেও তো দুটি মাত্র সন্তান।
এ অবস্থায় হঠাৎ আমিও যদি ওই মা ঘুঘুটির মতো মারা যায় তাহলে আমার সন্তান দুটির জীবনেও ওই ঘুঘু ছানার মতো একই পরিণতি নেমে আসবে।
নানা ভাবনায় রাণীর মনটা ফিকে হয়ে উঠলো। অমনি প্রাসাদের অন্দরমহলে চলে গিয়ে অসুস্থের মতো শুয়ে পড়লেন।
আর দাসী-বাদীদের ডেকে বললেন, “তোমাদের মহারাজ যদি শিকার থেকে ফিরে আসেন তাহলে বলবে আমি অসুস্থ। আমাকে যেন না ডাকে” দাসী-বাদীদের এই বলে রাণী আপদমস্তক কাপড় মুড়ে শুয়ে পড়লেন।
এদিকে বিরাট সৈন্য-সামন্ত বহর নিয়ে রাজা শিকার থেকে ফিরলেন। প্রাসাদে ঢুকতেই চিরাচরিত নিয়মে তার সহধর্মিনী রাণীকে ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু রাণীর কোন সাড়া-শব্দ নেই।
একটানা কয়েকবার ডাকার পর রাণীর দাসী-বাদী উপস্থিত হয়ে রাজাকে বলল, “মহারাজ, রাণী মাতা অসুস্থ। তাই আমাদের বলে গেছেন তাকে যেন কেউ না ডাকে”।
শুনে রাজার মাথায় যেন বাজ পড়লো। অমনি ছুটলেন রাণীর অন্দর মহলে। রাণীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, “প্রিয়তমা, তোমার কি হয়েছে ? জবাবে রাণী বললেন, “মহারাজ, তোমার সহধর্মিনী জীবনে আমি তোমার কাছে কিছু চাইনি এবং চাওয়ার প্রয়োজনই ছিলো না।
তবে এই মন্তরে আমার একটি কিছু চাওয়া খুব প্রয়োজন বৈকি! তা তোমাকে পূর্ণ করতে হবে। না হয় এই শোয়া অবস্থায় আমার জীবন বিসর্জন করবো”।
রাজা বললেন, “একি বলছো প্রিয়তমা ? জীবনে কোনদিনও তোমার এতটুকু অপূর্ণ রাখিনি। ধনসম্পদ, লোকলস্কর সবই তো তোমার সেবায় নিয়োজিত রেখেছি।
তারপরও এমন কি অপূর্ণতা তোমার যা আমার উপর নির্ভর হয়ে আছে, এসব কিছুই বুঝতে পারছিনে”। রাণী বললেন, “সত্যিই বলছি ধনসম্পদ, লোকলস্কর এসবের কিছু আমার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু আমার একটা দাবী পালন করার প্রতিজ্ঞা” ।
রাজা বললেন, “এটা এমন কি জিনিষ হলো প্রিয়তমা ? জীবন দিয়ে হলেও আমি তোমার দাবী পর্ণ করবো। তুমি নির্ভয়ে বললা।”
রাণী তখন বললেন, “বিধাতার অমোঘ নিয়মে যদি কোনদিন তোমার আগে আমার মৃত্যুও হয় তাহলে তুমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করবে না, এ প্রতিজ্ঞাটা শুধু আজ আমাকে দিতে হবে। রাজা বললেন, “অলুক্ষণে কি যে বলো জানি না।
ছি! ছি! তোমার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাবো কেন? হাতিন সত্যি প্রতিজ্ঞা দিলাম,করবোনা!করবোনা! করবো না!” রাণী ততক্ষণে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক হলেন।
এদিকে বহতানদীর মতো দিন গড়িয়ে আসে মাস, মাস গড়িয়ে আসে বৎসর। এভাবে দুটি বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর নির্মম বিধিবিধান রাণীর জীবনে কৃষ্ণ-সন্ধ্যা নিয়ে এলো।
নিবু নিবু জীবন প্রদীপ। অন্তিম শয়নে শায়িত রাণী তার দুই কুমারকে প্রিয়তম স্বামীর হাতে সঁপে দিয়ে পরপারে পাড়ি দিলেন। একদিন মন্ত্রিবর্গ প্রজাসাধারণ রাজাকে আরেকটি বিয়ে করার জন্য ছেকে ধরলো। কিন্তু রাজা তাতে রাজী হলেন না।
অনেক বুঝালো মন্ত্রী ও প্রজারা। এর মধ্যে রাজার সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন এক বৃদ্ধ মন্ত্রী রাজাকে বললো, “মহারাজ, বস্তুতঃ পৃথিবীটা যুগল দিয়ে গড়া। যেমন আলো-আঁধার, দিন-রাত, ঝড়-বাতাস, নারী-পুরুষ ইত্যাদি।
সুতরাং একা অপরিপূরক হয়ে কেউ বাস করতে পারেনা এবং বাস করতে চাইলেও করা যায় না। এটা পৃথিবীর শাশ্বত নিয়ম। আজ এখানে এত বড়ো রাজ্য, রাজপ্রসাদ রাণীবিহীন কিছুতেই শোভা পায়না।
অন্তত আমার এই বুড়ো বয়সের অনুরোধটা রক্ষার্থে বিয়ে করে আমার তথা রাজ্যের সমস্ত প্রজাসাধারণকে সুখী করবেন।” রাজা আর না করতে পারলেন না। আবার বিয়ে করলেন।
এদিকে রাজ্যে নতুন রাণীর বরণ অনুষ্ঠানে রাজ্যের সমস্ত ধনী-গরীব, আমির-ওমরাহ, ফকিরমিসকিন সবাই খুশীতে মাতোয়ারা। মন্ত্রিবর্গ সৈন্য-সামন্তরাও রাজার ধন্য ধন্য রব তুললো চারিদিকে। কিন্তু কোন রবই উঠলো না মা-হারা হতভাগা কুমার দু’টির জীবনে। কেবলই উঠলো দুঃখের ঘোর অমানিশা।
দিন দিন নতুন রাণী সতীনের ছেলে দু’টির ওপর অসহ্য হয়ে উঠলেন। বিভিন্ন রকম ফ এঁটে কুমারদ্বয়কে জব্দ করার প্রক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। তাদের যে-কোন বিষয়ই যেন তো বিষ।
সতীনের এই দুই ছেলেকে রাজ্যছাড়া করতে কিংবা মেরে ফেলতে পারলেই তিন একদিন সুযোগ বুঝে উপস্থিত হলো দু’রাজ কুমারের লাটিম খেলার আসরে।
দু’রাজকুমার তখন লাটিম খেলছিলো। রাজপ্রসাদের আঙ্গিনায় এক প্রান্তে যৌবন ও কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো দুই কুমারের রূপ-যৌবন, জ্ঞান-বুদ্ধি সবই যেন উপচে পড়েছিলো।
তাদের ওই রূপের কাছে চন্দ্রসূর্য পর্যন্ত হার মানতো। তাদের খেলাচ্ছলে নতুন রাণী ছোট রাজকুমারের একটা লাটিম পায়ের তলায় চাপা দিয়ে রাখলেন। অমনি ছোট রাজকুমার নতুন মায়ের পা থেকে লাটিম ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো।
আর বললো, “মা এসব কি হচ্ছে । আমার লাটিমটা দিয়ে দাও। নইলে আমার ভাইয়ার কাছে খেলায় আমি হেরে যাবো”। বড় রাজকুমারও বলল, “মা, একটু দিয়ে দাও না। এখন আমাদের হারজিতের খেলা চলছে। নইলে খেলা সব মাটি হবে”।
কিন্তু না, রাণীর সিদ্ধান্ত হিমালয়ের মতো অটল। শুধু তার একটাই জবাব, “কিছুতেই না”। তখন বড় কুমার রাণীর পেছন দিক থেকে একটু ধাক্কা দিতেই ছোট কুমার লাটিম হাতে ভৌ দৌড়লাগালো।
অমনি রাণীও চিৎকার জুড়ে প্রাসাদের কর্মচারীদের এক জায়গায় জড়ো করলেন। বললেন, “দেখ দেখ, কি বিশ্রী কান্ড! সতীনের দুই ছেলে আমার ইজ্জত হরণ করতে বসেছে। আমি এর বিচার চাই।
মহারাজ শিকার থেকে ফিরলে বুঝে নেবো আমাকে কি তার দুই কুমার দ্বারা বেইজ্জত করাতে এই প্রাসাদে ঠাঁই দিয়েছিলেন”? এ দিকে দুই কুমারের মুখে আর কোন কথাই সরছিলো না। শুধু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো প্রাসাদের এক কোণে।
রাজা শিকার থেকে ফিরলেন। রাণী সব ঘটনা জানালেন। তখন রাজা রাগ, ক্ষোভ ও অপমানে একাকার হয়ে গেলেন। মুহুর্তের জন্য দেরী না করে জল্লাদকে আদেশ করলেন কুমার দু’টিকে কেটে তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পরদিন সকালে মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করতে।
জল্লাদ দু’কুমারকে শৃঙখলে বন্দি করে বাকি রাত্রিটার জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করলো। জল্লাদের দুই কুমারের জন্য প্রাণটা খুব কেঁদে উঠলো। খড়গ হাতে কিভাবে এই সোনার টুকরো রাজকুমারদের হত্যা করবে।
তার দীর্ঘ চাকুরী জীবনে এমন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি কখনও হয়নি। আদেশ পেয়ে জীবনভর অনেক মানুষকে খুন করেছে এই নির্দয় ঘাতকটি। খুন যার পেশা; আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই হত্যা করার জন্য উল্লাসে ফেটে পড়তো।
আজ কিনা করুণায় চুপসে এতটুকু হয়ে গেলো। বড়ই অদ্ভুত নিয়তির খেলা। জল্লাদ বিন্ন হয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো।
বাসায় স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলো কিভাবে বাঁচানো যায় এই দু’রাজকুমারকে। স্ত্রীও বললো, “সারাজীবন তো অনেক মানুষকে খুন করেছে, এবার মুনিবের ছেলেদের ছেড়ে দিয়ে একটু পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। এখন এই দুই কুমারকে ছেড়ে দাও। ওরা রাজ্য ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাক।”
জল্লাদ বললো, “কিন্তু এভাবে ছেড়ে দেয়ার কথা মহারাজ যদি জানতে পারেন তাহলে। আমার গর্দানও রক্ষে নেই। এখন কি করতে পারি বলো প্রিয়তমা”? স্ত্রী বললো, “অতসব কিছু বুঝি না একটা উপায় খুঁজে বের করো”।
জল্লাদ বললো,“হ্যাঁ! উপায় থাকত যদি কাল প্রভাতে মহারাজকে বুকের তাজা রক্ত দিতে না হতো! এখন রক্ত পাই কোথায়? স্ত্রী বললো, “তা কোন ব্যাপার নয়। জান যাক প্রাণ যাক, ওদের বুকের রক্ত বলে একটা বকরী কেটে রক্ত নিয়ে যাও মহারাজের কাছে। মহারাজ রাগের চোটে সত্যিই তা বিশ্বাস করবেন”।
স্ত্রীর এই উপস্থিত বুদ্ধি পেয়ে জল্লাদ খুশী হলো নির্জন রাতে কারাগারের ফটক খুলে দুই রাজকুমারকে মুক্ত করে দিয়ে বললো, “বাবারা, তোমরা পালিয়ে যাও এই রাজ্য ছেড়ে। আমি তোমাদের ছেড়ে দিলাম। জীবনে কোনদিন যদি সৃষ্টিকর্তা তোমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখে, সেদিনই দেখা হবে এই অধম পাপিষ্ঠ গোলামের সাথে”।
যমদূতের এই করুণায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা দু’রাজকুমার তখন জল্লাদের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তারপর রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য দ’রাজত উদ্দেশ্যহীন রওয়ানা দিলো।
রাতদিন বিরামহীন হেঁটে যেতে যেতে খিদে পেলে ফলমূল খেয়েই ক্ষুধার জ্বালা নিবার করতে লাগলো। যে রাজকুমাররা রাজভোগ খেতে খেতে বড় হয়েছে আজ তাদের পরম খাদা বৃক্ষের ফলমূল।
তবু সেদিকে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। সামনে একটাই পথ…….বাঁচা-মরার প্রশ।
এভাবে যেতে যেতে অনেক ক্রোশ পেরিয়ে আরেকটি রাজ্যে এসে পৌঁছলো তারা। সেখানে একটা বিরাট অশ্বথ গাছের নীচে আশ্রয় পাতলো দু’জনেই।
ছোট রাজকুমার বড় রাজকুমারকে বললো, “ভাইয়া, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও”। তখন বড় রাজকুমার ছোট রাজকুমারকে গাছের নীচে শুইয়ে নিজে জেগে জেগে পাহারা দিলো। ইতিমধ্যে সে দেশের রাজা মারা গেছেন।
রাজার স্ত্রী-পুত্র কেউ ছিলো না। শুধু এক পরমা রূপসী রাজকুমারী। বর্তমানে শূন্য অবস্থায় রাজসিংহাসন পড়ে রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রেরাজার স্থলাভিষিক্ত হবার কেউ নেই: তাই সে দেশের রেওয়াজ অনুসারে সাব্যস্ত হলো রাজার একমাত্র প্রিয় শ্বেত হস্তী (লাদানাসাং) যাকে ভাবী রাজা হিসেবে বরণ করে নেবে সে-ই হবে সে রাজ্যের রাজা এবং তাকেই এই পরমা রূপসী রাজকুমারীর সাথে বিয়ে দেয়া হবে। তখন রাজার ওই প্রিয় শ্বেত হস্তীকে ছেড়ে দেওয়া হলো।
শ্বেত হস্তীকে ছেড়ে দিতেই হস্তীটি কোথাও না থেমে লোকালয় ছেড়ে ওই অশ্বথ গাছের দিকে চলে আসলো। সেখানে হতভাগা দুই রাজকুমার আশ্রয় পেতেছিলো।
হস্তীটি আসা মাত্রই দেরী না করে ছোট ভাইয়ের পাহারারত বড় রাজকুমারকে টেনে পিঠে তুলে নিলো। তারপর নাচতে নাচতে রাজধানীর দিকে ছুটলো।
আচমকা বড় রাজকুমারকে যখন শ্বেত হস্তিটি তুলে নিলো তখন বড় রাজকুমার তার ছোট ঘুমন্ত রাজকুমারের জন্য কেঁদে কেঁদে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলো, “ভগবান, ঘুমন্ত আমার ছোট রাজকুমারকে তোমার হেফাজতে রেখে গেলাম।
হস্তীটি আমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানেই যদি আমার মরণও হয় তাহলে আমার ছোট রাজকুমারের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ হয়েই যেন হয়”।
তারপর বড় রাজুকুমার তার ছোট ঘুমন্ত রাজকুমারকে একটা কিছু ধারণা দিতে তাকে যে পথ দিয়ে হস্তীটি নিয়ে যাচ্ছে সে পথ দিয়ে তার যাওয়ার চিহ্ন স্বরূপ গায়ের সমস্ত কাপড় খুলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে শুরু করল।
কাপড় যখন শেষ হলো আঙ্গুল কেটে রক্ত ফেলতে শুরু করলো। এদিকে হস্তীটি তাকে নিয়ে যখন রাজ্যের রাজধানীতে গিয়ে পৌছলো তখন রাজ্যের সমস্ত প্রজা, মন্ত্রিবর্গ, সৈন্য-সামন্ত আনন্দে উদ্বেলিত হলো এবং প্রয়াত রাজার প্রিয় শ্বেত হস্তীটিকে সাধুবাদ জানাতে লাগলো।
রাজ্যের সবার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক যেন উপচে পড়ার উপক্রম। বড় রাজকুমারের গুণকীর্তন ও রূপ বর্ণনা সে রাজ্যবাসীদের মুখে মুখে শোভা হয়ে ফিরতে লাগলো।
মহাধুমধামে আঁকজমকে রাজকীয় কায়দায় রাজকুমারীর সাথে বিয়েসহ সে রাজ্যের নতুন রাজারূপে যখন দায়িত্ব পেলো তখন তার ছোট রাজকুমারকে সন্ধানের জন্য তার রাজ্যের চারিদিকে সৈন্য-সামন্ত পাঠাতে শুরু করলো।
এ দিকে বড় রাজকুমারকে যখন শ্বেত হস্তী নিয়ে গেল তার পর পরই ছোট রাজকুমানে ঘুম ভাঙ্গলো । ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখলো, হায় ! তার প্রাণপ্রিয় বড় রাজকুমার আর নে কোথায় কে নিয়ে গেছে।
সর্বহারা দুঃখী ছোট রাজকুমারের কান্না আর আর্তচিৎকার সেখানকার পরিবেশ মুহুর্তের জন্য ভারী হয়ে উঠলো। আর ডানা ভাঙ্গা পতঙ্গের মতো দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তার দৃষ্টি গোচর হলো বড় কুমারের ফেলে যাওয়া সেই ছোট্ট ছোট্ট কাপড়ের টুকরো।
তখন সেটাকে অনুসরণ করতে যেয়ে অনেক দূরে গিয়ে আবার দেখলো ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। এভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করতে করতে একসময় সব শেষ হলো।
তখন ছোট রাজকুমার বুঝলো তার বড় রাজকুমার বুঝি আর প্রাণে বেঁচে নেই। নিশ্চয় বাঘ বা ভাল্লুক আক্রমণ করে নিয়ে গেছে। এই জনমের মতো তার বড় রাজকুমারের সাথে আর দেখা হলোনা।
ভাবতেই ছোট রাজকুমার আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। এখন তার ভয়-ভীতি, জীবন-মরণ সব কোথায় যেন চলে গেছে। শুধু মুখে “ভাইয়া! ভাইয়া!” নাম জপ। পাগলের ন্যায় গন্তব্যহীন ছুটতে ছুটতে যে দিকে তার দুচোখ যায় সেদিকেই এভাবে অনেক ক্রোশ অনেক দূর পাড়ি দেয়ার পর সে রাজ্যর রাজধানীতে এসে পৌঁছালো।
সেখানে রাজ্যের সৈন্যরা গুপ্তচর ভেবে তাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করলো। বন্দি অবস্থায় ছোট রাজকুমারের দিন কারাগারে কাটতে লাগলো। সেখানেও শুধু তার মুখে একটাই জপ “ভাইয়া! ভাইয়া”!
এভাবে বন্দি বেশে কারাগারে অনেকদিন কেটে গেলো ছোট রাজকুমারের। ইতিমধ্যে একদিন এই কারাগারের পাশ দিয়ে হেঁটে রাণী কোথাও যাচ্ছিল। তখন রাণীর কর্ণগোচর হলো “ভাইয়া! ভাইয়া”! জপ।
অমনি উৎসুক হয়ে কারাগারে দিকে দৃষ্টি ফেলতেই রাণী দেখলো, কি অপূর্ব সুন্দর কয়েদি এক যুবক চোখ বুজে মুখে শুধু “ভাইয়া! ভাইয়া”! বলেই জপে যাচ্ছে।
রাণী তখন প্রাসাদে ফিরে গিয়ে সব ঘটনা রাজাকে জানালো। শুনে ভাই-হারা রাজার ভগ্ন হৃদয়টা করুণ হয়ে উঠলো। মুহুর্তের জন্য দেরী না করে রাজা আদেশ করলো বন্দি কয়েদি যুবককে তড়িৎ রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে।
রাজার এই আদেশ পেয়ে আজ্ঞাবহ সিপাহীর দল ছুটে গিয়ে বন্দি ছোট রাজকুমারকে মুক্ত করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসল। রাজা দেখে চিনতে পারলো, কয়েদি যুবকটি আর কেউ নয় সে তার অতি আদরের ছোট রাজকুমার।
তখন রাজার অতদিনের চৌচির শোকার্ত হৃদয়টা হাহাকারের মতো বেজে উঠলো। অমনি বিদ্যুৎচমকের মতো তার ছোট রাজকুমারকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
ততক্ষণে ছোট রাজকুমারেরও ভাই-হারা শোকার্ত হৃদয়টা ফেটে উঠে কান্নায় পরিণত হলো। এভাবে দুই রাজকুমার অনেকক্ষণ পরপ্রকে নিবিড় আলিঙ্গনে পরম ধন প্রাপ্তির মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
তারপর রাজা তার হারানো ভাইয়ের সাথে পুনর্মিলিত হওয়ার আনন্দে তার সমস্ত রাজ্যে সাতদিন ব্যাপি আনন্দের দিন হিসেবে ঘোষণা করলো। এভাবে মিলেমিশে আনন্দ ভরপুর দুই রাজকুমার সেই রাজ্যের অধিপতি হয়ে তাদের দিন কাটাতে লাগলো।
এভাবে অনেকদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন বড়রাজকুমার স্বপ্নে দেখলো তার নিজ রাজ্য, সৈন্য, সামন্ত ও তার বৃদ্ধ বাবা তাদের শোকে পথহীন কোন সুদূর বনের ভেতর দিয়ে আর্তচিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে।
এতে প্রাসাদের বড় বড় শূন্য কক্ষগুলোর সকল দরজা আছড়ে পড়ে ভীষণ বেদনায় আর্তনাদ করতে লাগলো। একটি বিকট বুক ফাটা কান্নায় বড় রাজকুমার জেগে উঠে নিজেকে তার সুবর্ণ স্বর্ণালী খাটের উপর ঘর্মাক্ত কলেবরে দেখতে পেলো।
ততক্ষণে তার প্রিয়তম স্ত্রী রাজকুমারীও জেগে উঠে বড় রাজকুমারের পা জড়িয়ে ধরে সকরুণ জানতে চাইলো, “প্রিয়তম, আমি কি কোন দিন অন্যায় করেছি? কষ্ট দিয়েছি?
নিজের অজান্তেই যদিও বা দিয়ে থাকি তাহলে আমায় শাস্তি দাও। কেন অমন করে কাঁদছো? কি হয়েছে তোমার? বলো প্রিয়তম”। তখন বড় রাজকুমার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলো।
আর বললো, “প্রিয়তমা, তুমি আমার সাথে যাও, বা না-ই যাও আমি আমার ছোট রাজকুমারকে নিয়ে নিজ রাজ্যে চলে যাচ্ছি। এতদিনে বাবা কোথায় কেমন আছে নাকি মরেই গেছে জানিনা।
আজ আমার খুব কষ্ট হয় আর একটি মুহুর্ত থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না এখানে”। রাজকুমারী বললো, “সে কেমন কথা হলো প্রিয়তম। তুমিই আমার জীবন, মরণ, সুখ-দুঃখের অংশভাগী। তোমাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজপথে যদি ভিক্ষেও করতে হয় তাও প্রস্তুত। আমিও যাবো তোমার সাথে।
বড়রাজকুমার তার রাজ্যের সমস্ত দায়-দায়িত্ব রাজকার্য পরিচালনা সবই প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করলো। তারপর তার ছোট রাজকুমার ও স্ত্রী রাজকুমারীসহ একটা পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে সে রাজ্য ছেড়ে নিজ রাজ্যে এসে পৌঁছালো।
যখন নিজ রাজ্যে এসে পৌছালো বড় রাজকুমার তখন তার এক বার্তাবাহককে অনুমতি চেয়ে বাবার কাছে পাঠালো। এদিকে রাজা তার দুই রাজকুমারকে মৃত্যু দন্ডাদেশ দেয়ায় অনেকদিন পর নিজের চরম ভুল বুঝতে পারলেন।
আর ততোদিনে তার প্রয়াত বড় রাণীর থিতিয়ে যাওয়া সেই স্মৃতি উত্তাল হয়ে উঠলো। পুত্র শোকে রাজা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলের ন্যায়।
আর যে জল্লাদের উপর তার দু’রাজ কুমারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ন্যস্ত ছিলো সে জল্লাদকেও রাজা ডেকে পাঠালেন। জল্লাদের উপর ভিত্তিহীনভাবে পুত্র হত্যার কৈফিয়ত চাইতে শুরু করলেন।
নিরূপায় জল্লাদ রাজাকে জানালো, “মহারাজ, আপনার দুই রাজকুমারকে হত্যা করা হয়নি। রক্ত আপনি ঠিকই পেয়েছেন, কিন্তু তাছিলো একটা বকরীর।
বকরী কেটে রক্তের ব্যবস্থা করেই দুই রাজকুমারকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জানিনা সে দুই রাজকুমার এখন প্রাণে বেঁচে আছে কিনা”। জল্লাদের মুখে এ কথা শুনে রাজার মনটা ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দে নেচে উঠলো।
তারপর জল্লাদকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে গুণে দিয়ে বিদায় করলেন। আর সেদিন থেকে পুত্রশোকে তপ্ত রাজা একরাশ ধূসর মরু সাহারার যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে তার দুই রাজকুমারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ঠিক তখনই দুই রাজকুমারের পাঠানো বার্তাবাহক রাজাকে প্রণাম জানিয়ে দুই রাজকুমারের রাজ্যে ফিরে আসার সংবাদ জানালো। শুনে রাজার মনটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো।
তার এতদিনের সন্তানহারা শোকার্ত হৃদয়টা যেন বৃষ্টির মমতায় আজ নতুন প্রাণের সজীবতা পেলো। রাজ্যের সমস্তসৈন্য-সামন্তকে আদেশ করলেন তার দু’কুমার ও পুত্রবধূকে যেন রাজকীয় মর্যাদায় প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়।
রাজার এই আদেশ পেয়ে বিরাট সৈন্য বহর কামানের মুহুর্মুহু ধ্বনি তুলে ছুটলো। দু’রাজকুমার ও রাজপুত্রবধূ বাদকদের বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্রের সুরের মূর্হনায় প্রাসাদে এসে পৌছলো।
এদিকে দু’রাজকুমার তাদের বৃদ্ধ বাবাকে দেখা মাত্রই ছুটে গিয়ে বাবার দু’পায়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তার সাথে ঘটে যাওয়া জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টগুলো ও গল্পের মতো একে অপরকে শোনাতে লাগলো।
এভাবে মিলনের আনন্দ ভরপুর রাজপ্রাসাদের পরিবেশটা অনেকক্ষণ ধরে ভূতুড়ে অবস্থায় পরিণত ছিলো তারপর একসময় পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ রাজা তার দ্বিতীয় রাণীটিকে কেটে দুটুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দিলেন।
সাথে সাথে তার রাজ্যের ভাবী রাজা হিসেবে তার দু’পুত্রকে ঘোষণা করে নিজেও গেরুয়া পড়ে সন্যাসির বেশে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গভীর বনে চলে গেলেন। সেখানেই নির্বাসিত হয়ে তার বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
লেখকঃ ক্য সা মং খেয়াং
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।