icon

খুমি জনগোষ্ঠীর বিবাহ (আইয়ুলানা)

Jumjournal

Last updated Jan 18th, 2020 icon 862

বিবাহের (আইয়ুলানা) সংজ্ঞা: আদিবাসী খুমি সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। তবে জাঁকজমকপূর্ণ খাওয়া-দাওয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে সামাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে ‘আইয়ুলানা’ কিখেনা/ফাইলো খেনা বা বিবাহ অনুষ্ঠান হয়। খুমি সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘আইয়ুলানা পই’।

এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত খুমি দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। উপরোক্ত রীতি অনুসরণ ব্যতীত খুমি সমাজে নর-নারীর জৈবিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয় বিধায় অবৈধ বলে গণ্য হয়।

সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠানের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা:

বিবাহ রীতি: পাত্রের বাবা নিজ গোত্রের গণ্যমান্য কয়েকজনকে নিয়ে একটি মুরগি, এক বোতল মদ ও একটি বল্লমসহ পাত্রীপক্ষের পাড়ায় বা গ্রামে পৌঁছে রাতের বেলায় একজন ঘটকের সাহায্যে পাত্রীর বাবার কাছে মুরগী ও মদ উপঢৌকন হিসেবে পাঠায়।

পাত্রীর অভিভাবক প্রস্তাবে তবে সম্মত হলে উভয়পক্ষ পানাহারের আসরে বসে বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা করে। পরদিন সকালে উভয়পক্ষ বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে। সকালে উভয়পক্ষের মধ্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত হলে পাত্রপক্ষ থেকে আনা বল্লমটি দিতে হয় প্রতীকি চিহ্ন হিসেবে।

পাত্রীপক্ষ সম্মত না হলে, পাত্রপক্ষ বল্লমটি ফেরত নিয়ে যায়। বিয়েতে সম্মত হলে পাত্রীপক্ষ ১০০টি রৌপ্য মুদ্রা বা বর্তমানে এর সমপরিমাণ অর্থ, বিজোড় সংখ্যক যেমন ১৯টি মোরগ-মুরগী ও ১৩টি বল্লম কণে পণ হিসেবে দাবী করে পাত্রপক্ষের কাছে।

কণে পনের ১০টি রৌপ্য মুদ্রা হলো মায়ের দুধের দাম, ১০টি রৌপ্য মুদ্রা হলো ভাইয়ের এবং ১০টি রৌপ্য মুদ্রা হলো দাদীর জন্য, পাত্রীপক্ষ থেকেও পাত্রের জন্য মাথার পাগড়ী আর শূকর উপঢৌকন দেয়া হয়।

কনের বাড়ীতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় পানীয় পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে মোরগের জিহবা দিয়ে পরীক্ষা করে নবদম্পতির শুভাশুভ যাচাই করা হয়।

পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষের মধ্যে তিন দফা খাওয়াদাওয়া ও পানীয় পরিবেশন করে আপ্যায়নের মাধ্যমেই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠানে কনের মামাকে পৃথকভাবে মুরগী রান্না করে সর্বপ্রথম খাওয়াতে হয়।

কনেপক্ষের অতিথিদের জন্য মুরগীর মাংস এবং বরপক্ষের অতিথিদের জন্য শূকরের মাংস পরিবেশন করা বাধ্যতামূলক। এর অন্যথা হলে জরিমানা দিতে হয়। ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খুমি পাত্র-পাত্রীর ধার্য বিবাহ সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।

না-বো-জা-নাঃ খুমিদের নিয়মানুসারে পাড়ায় কোনো যুবক নতুন বউ নিয়ে আসলে বা বিবাহ করলে পরের দিন তাদের পরিবারে কাজ করা বন্ধ থাকে। সেই বন্ধের দিনকে বলা হয় ‘না-বো-জা-না’।

কনে বাড়ির কদর : খুমি সমাজে কনের বাপের বাড়ীর কোনো অতিথি (বয়সে প্রবীণ) জামাই বাড়িতে বেড়াতে গেলে তাকে অবশ্যই রীতি অনুযায়ী এক কেজি পরিমাণের শুটকি মাছ নিয়ে যেতে হয়।

জামাই বাড়ির পক্ষ থেকেও মোরগ রান্না করে কনের বাড়ির অতিথিকে আপ্যায়ন করতে হয়। কনের বাপের বাড়ির আত্মীয়দের আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে যে মোরগ বা মুরগীর মাংস রান্না করা হয় তা পরিবেশনের পর অবশিষ্ট মাংস জামাই বাড়ির কেউ আর খেতে পারে না।

বিশেষ করে কনে বাড়ির অতিথি যতক্ষণ জামাই বাড়িতে অবস্থান করেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা নয়ই। এক রাত অবস্থানের পর কনে বাড়ির অতিথি চলে যাবার সময় তার জন্য রান্না করা মাংস অতিথিকে দিয়ে দেওয়া হয়।

বিবাহের যোগ্যতা: খুমি সমাজে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকার যোগ্যতা বা বয়সের মাপকাঠি না থাকলেও

সাধারণতঃ ১২ বছর পূর্ণ হলে শারীরিক গঠন দেখে পাত্র-পাত্রীর বিবাহের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় । খুমি সমাজে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও বিবাহ হতে পারে, যদি পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকে। অবশ্য বাল্য বিবাহের প্রচলন নেই।

যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ সকল আইনে অপরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সনের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ২ (ক) ও ২ (খ) ধারায় শিশু ও বালক বলতে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং নারী হলে ১৮ বছরের কম বুঝাবে।

খুমি জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত কম বয়সের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের বিদ্যমান আদালতে যদি কোনো কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং প্রমাণিত হয় যে, বিবাহিত পক্ষগণ নাবালক; তাহলে খূমি সামাজিক প্রথামতে নাবালকের বিবাহ কার্য সমাজসিদ্ধ হলেও তার কোনো প্রকার আইনগত বৈধতা থাকবে না, বরঞ্চ তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

খুমি সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কঃ খুমি জনগোষ্ঠীর মোট ৩২টি গোত্র আছে। তাদের সমাজে একই গোত্রের পাত্র-পাত্রীর বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ধরণের নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় বিবাহিত দম্পতিকে সমাজচ্যুত করে পাড়া থেকে বের করে দেয়া হয়।

বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপনের কতিপয় অনুসরণীয়/পালনীয় রীতিনীতি:

(ক) সাধারণভাবে একজন খুমি পুরুষ একজন খুমি মহিলাকে বিবাহ করে।

(খ) পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত হতে হয়।

(গ) পাত্র-পাত্রীকে রক্ত সম্পর্কজনিত আত্মীয়তার বিধি নিষেধমেনে বিয়ে করতে হয়।

(ঘ) পাত্র-পাত্রীকে সাবালকত্ব অর্জন করতে হয়।

(ঙ) পাত্র-পাত্রীকে জোড়া বন্ধন ‘আইয়ুলানা পই’ সম্পন্ন করতে হয়।

বিবাহের প্রকারভেদঃ খুমি সমাজের সচরাচর দুই প্রকার বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছেঃ

(ক) সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ এবং (খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ। সমাজে বিধবা বিবাহ ও অনুমোদিত। বহু বিবাহ ও অনুমোদিত হলেও সমাজে তেমন প্রবণতা নেই।

আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিশ্র বিবাহের কিছু প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সামাজিক বীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে খুমি সমাজ তা অনুমোদন করে না। রক্ত সম্পৰ্কীয় বিবাহ নিষিদ্ধ দম্পতিকে সমাজচ্যুত করা হয় ।

সামাজিক নিয়মিত বিবাহ (আইয়ুলানা পই): খুমি সমাজে সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ (আইয়ুলানা পই) পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকদের মতামত বা সম্মতি নিতে হয়। ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠান এতে বাধ্যতামূলক।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ সমাজে প্রচলিত রীতি ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করে বিবাহিত একজন খুমি যুবক (পুরুষ) এবং একজন যুবতী (মহিলা) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা খুমি সমাজের প্রথা অনুযায়ী সমাজসিদ্ধ। বিবাহিত দম্পতির দৈহিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে বৈধ সন্তান ও পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়।

স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বিবাহিত দম্পতির একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্ত্রী তার স্বামীর ভরনপোষণ ও সামাজিক মর্যাদা পায় এবং স্ত্রী তার স্বামীর পারিবারিক পদবীর অধিকারী হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (স্পতুলায়না): প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক-যুবতী উভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরের মননমিলনে নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে অনিয়মিত বিবাহ সম্পন্ন করে। খুমি সমাজে অনিয়মিত বিবাহের প্রচলন রয়েছে। সমাজে এ ধরণের বিবাহকে ‘স্পতুলায়না’ বলা হয়।

(ক) খুমি পুরুষ ও মহিলা উভয়ে পরস্পরের সম্মতিতে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর সমাজে ফিরে এসে বিবাহের ক্ষেত্রে গোত্রগত নিষিদ্ধ সম্পর্ক না থাকলে সামাজিক আদালত বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে তাদের বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করে।

(খ) অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে খুমি সমাজে একই ধর্মাবলম্বী ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে ও বিবাহের প্রচলন আছে। কিন্তু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সাথে কোনো খুমির বিবাহ হলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়।

অপরদিকে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর একই ধর্মাবলম্বীর সাথে কোনো খুমির বিবাহ হলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্ত্রীকে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের গোত্রভূক্ত করা হয়। এ ধরণের মিশ্র বিবাহের ক্ষেত্রে ভিন্ন জনগোষ্ঠী হতে আগত কনেকে খুমি সমাজের ধর্মভূক্ত ও গোত্রের পদবী ধারণ করতে হয়।

কোর্ট ম্যারেজঃ কোর্ট ম্যারেজ মূলতঃ আদালতের কোনো প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক খুমি সমাজে ইদানীং পরিবারের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্ছুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক-এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনত স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলা চলে প্রাচীনকালের মনোমিলনে পলায়ন বিবাহের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে কোর্ট ম্যারেজ, যদিও এটি নিছক একটি শপথনামা মাত্র।

তাই এ বিবাহ অলঙ্ঘনীয়ও নয়। তবে বিবাহিত পাত্র-পাত্রী এক্ষেত্রে সাবালক হলেও বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় হলে সম্পাদিত কোর্ট ম্যারেজ সমাজের কাছে বৈধ হয় না। সর্বোপরি এ ধরণের কোর্ট ম্যারেজ প্রথাসিদ্ধ নয়, তা অসামাজিক বিবাহ।

ব্যাখ্যা: মূলতঃ কোর্টে কোনো বিবাহ হয় না। পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত পাত্র-পাত্রীকে স্বেচ্ছায় কোর্টে আসার পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। পরে কোর্টে এসে উভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে এই প্রকার Love Marriage এর সমর্থনে একটি শপথ সম্বলিত বিবৃতি Affidavit দেয় এবং এভাবে বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করে। কার্যতঃ এই প্রকার শপথ সম্বলিত বিবৃতি অর্থাৎ এফিডেবিটের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রণয়ঘটিত বিবাহগুলো উভয়পক্ষের অভিভাবকদের অসম্মতিতে হয়ে থাকে। এরূপ বিবাহিত দম্পতি বিবাহের অব্যবহিত পরেই কোর্টে গিয়ে তাদের বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করতে হয়, যাতে যে কোনোপক্ষের অভিভাবকদের উদ্যোগে থানায় অথবা কোর্টে তাদের বিরুদ্দে কোনো মামলা দায়ের হলে এই দলিল তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়ক হয়”। (সূত্র- হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান)

প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে খুমি যুবক, যুবতীরা কোর্টে আসার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। কোর্টে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আমরা পরস্পরকে বিবাহ করলাম মর্মে বিবৃতি ( হলফনামা) সম্পাদন করে দেয় ।

অর্থাৎ তারা কোর্টেই একে অপরকে বিয়ের ঘোষণা দেয় মাত্র। কোর্টে আসার আগে বিয়ে করে না । আগেই বলা হয়েছে যে, কোর্টে কোনো বিয়ে হয় না। কোর্টে পূর্বে অনুষ্ঠিত বিয়ের ঘোষণা দেয়া হয়/যায় মাত্র।

সুতরাং, খুমি যুবক-যুবতীরা হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে বলে যা বুঝাতে চায়, তা মোটেই সমাজসিদ্ধ বিয়ে নয়। সমাজসিদ্ধ বিবাহের পূর্ব শর্ত হচ্ছে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা।

মিশ্র বিবাহ (আলাংবাসাহয় অপুংনা): পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীসহ বৌদ্ধ এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী পাত্র-পাত্রীর সাথে খুমি পাত্র-পাত্রীর সাথে খুমি পাত্র-পাত্রী উভয়ের মনোমিলনে বা সম্মতিতে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অথবা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসারে সম্পন্ন হওয়া মিশ্র বিবাহের ক্ষেত্রে খুমি সমাজের স্বীকৃতি নিতে হয়।

এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী যে জনগোষ্ঠী হতে খুমি সমাজে এসেছে সেই পিতৃকুলের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা ও পারিবারিক পদবী তার লোপ পায় এবং স্ত্রী তার খুমি স্বামীর ধর্মীয় বিশ্বাস, বর্ণ, গোত্র ও পদবী ধারণ করে।

অনুরূপভাবে খুমি সমাজের কোনো মহিলার সাথে অন্য জনগোষ্ঠীর পুরুষের বিবাহ হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য জনগোষ্ঠীভূক্ত হলে সেই বিবাহিত মহিলা খুমি সমাজের উত্তরাধিকারসহ পদবী হারায়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহের (পালিয়ে গিয়ে গােপনে বিয়ে করা) আইনগত ফলাফলঃ

পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকাকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। যদি মেয়ের অভিভাবক তার মেয়েকে সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজী না হয় কিংবা প্রেমিকের অভিভাবক যদি প্রেমিকার অভিভাবকের কনেপণসহ আর্থিক ও অন্যান্য দাবী পূরণ করতে রাজী বা সমর্থ না হয়, তাহলে তাদের বিয়ে হয় না। এবং প্রেমিকাকে তার পিতার বাড়ীতে ফিরে যেতে হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকা এভাবে পলায়নের কারণে সামাজিক বিচারে জোর করে অপহরণ করার অভিযোগে পাত্রকে অপরাধী সাব্যস্ত করা না হলে এবং প্রেমিকার পিতা-মাতা সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেও পলাতক অবস্থায় বিবাহ বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের সামাজিকঅপরাধের জন্য সাজাভোগ করতে হয়, যেমনঃ- শূকর, মোরগ, মদ ও নগদ টাকা জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে তাদের মধ্যে বিয়ে হয়, যা সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য হয়।

সমাজে অনুমোদিত হলে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনের দ্বারা অনুগ্রহণকারী সেই সন্তানও বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় এবং পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হয়ে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে।

প্রেমিক বা প্রেমিকার পিতা-মাতার অসম্মতির কারণে প্রেমিক যুগলের বিয়ে না হয়ে যদি পলাতক অবস্থায় উভয়ের দৈহিক মিলনের কারণে প্রেমিকা গর্ভবতী হলে, তার ভূমিষ্ট সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

সন্তান যার ঔরসে জন্মলাভ করে সেই পিতার উত্তরাধিকারী এবং পিতার পারিবারিক মর্যাদার অধিকারী হয়। যদি সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে সন্তানটি পিতার অধিকারে থাকে, অন্যথায় উত্তরাধিকারী হয় না।

দেশের প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা ও সাজা হওয়ার আশঙ্কাঃ প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েতে তাদের অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে পলায়নের খবর জানাজানি হবার পর প্রেমিকার পিতা প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর আওতায় মামলা দায়ের করতে পারে।

আদালতে এ ধরণের মামলার ফলে প্রেমিক গ্রেপ্তার ও বিচারে সাজা হয়। আর যদি নাবালিকা হয় অথবা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপহরণ ও দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হয়েছে বলে আদালতে জবানবন্দি দেয়, তাহলে প্রেমিকের ১৪ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্তকারাদন্ড হতে পারে।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ (লানা): আত্মীয় সম্পর্কীয় সমগোত্রেরমধ্যে খুমি সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ হলে তা নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ বলে গণ্য হয় এবং নিষিদ্ধ সম্পৰ্কীয় বিবাহিত দম্পতির সন্তানগণ অবৈধ সন্তান হিসেবে সমাজে পরিচিত হয়। এ ধরণের নিষিদ্ধদম্পতিকে পাড়া এবং সমাজ হতে সমাজচ্যুত করা হয়।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিয়ের আইনগত ফলাফল: খুমি সমাজে নিষিদ্ধসম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং শাস্তিস্বরূপ শূকর জরিমানা দিতে হয়। দন্ড দেয়া সেই শুকরের মাংসও সমাজের অনেকে খায় না।

গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধের শাস্তি হচ্ছে অর্থদন্ড। এরপরেও উক্ত দম্পত্তি যদি দাম্পত্য জীবন অক্ষুন্ন রাখে তবে তাকে সমাজচ্যুত করে ‘এক ঘরে’ করা হয়।

ব্যাখ্যাঃ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ে হওয়া সমাজে একেবারে বিরল ঘটনা নয়। অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও এ ধরণের কিছু কিছু বিয়ের নজির খুঁজে পাওয়া যায়। সামাজিক রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত বিয়ের বৈধতা বা অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না।

তবে পালিয়ে গিয়ে ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠান ছাড়া ভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসকালে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বিয়ের কথা অস্বীকার করলে তখন বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

সেজন্য খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে চার্চ এল্ডারের বাড়ীতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা বাঞ্চনীয়। সচরাচর খুমি সমাজে এমন ঘটনা ঘটে না।

বিধবা বিবাহঃ খুমি সামাজিক প্রথামতে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা মহিলাও বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততি সহ স্বামীর পরিবারে বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরনপোষণ পাবার অধিকারী।

কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামী-শ্বশুরের পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরনপোষণ পায় না। খুমি সমাজে একজন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ প্রথাসিদ্ধ। তবে ঐ মহিলাকে পিতার বা ভাইয়ের বাড়িতে থেকে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়।

বহু বিবাহঃ খুমি সমাজে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। তবে বহু বিবাহ সচরাচর লক্ষ্য করা যায় না। একজন বিবাহিত খুমি স্বামী তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন না করে নিম্নোক্ত কারণে বহু বিবাহে আবদ্ধ হতে পারেন।

কারণসমূহঃ

(ক) সন্তানহীন দম্পতির বংশ রক্ষার তাগিদে;

(খ) স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে;

(গ) স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে;

(ঘ) স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি সাপেক্ষে স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর অমতে দীর্ঘ সময় পিত্রালয়ে বা দেশান্তরে থাকে;

(ঙ) স্ত্রী যদি ব্যাভিচারে কিংবা পরকীয়াতে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধে সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়।

মন্তব্য: বহু বিবাহ বলতে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় আরও এক বা একাধিক মহিলাকে বিয়ে করা বুঝায়। প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বা প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে সব সমাজেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার রীতি আছে।

বহু বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ খুমি সমাজে বহু বিবাহ অনুমোদিত। তাই কোনো ব্যক্তি একাধিক মহিলাকে বিয়ে করলেও সমাজ তাতে মাথা ঘামায় না। কারণ, একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকার ফলে পরিবারে যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব সমাজে খুব একটা পড়ে না।

পরিবারের লোকজনই, বিশেষতঃ স্ত্রীরাই অশান্তি ভোগ করে। প্রতিবাদ বা আপত্তি আসলে তা ভুক্তভোগী স্ত্রীদের কাছ থেকেই আসার কথা। পুরুষ শাসিত সমাজে এ ধরণের বিয়েতে স্ত্রীদের আপত্তি কিংবা প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই বললে চলে।

অবশ্য উপরোক্ত (৪)নং শর্ত ব্যতীত অবশিষ্ট ৬টি কারণেও যদি দ্বিতীয়বার বিবাহে স্বামী তার স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি গ্রহণ না করে তবে বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৪৯৪ ও ৪৯৫ ধারামতে তা দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। সেক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত বিধান অকার্যকর গণ্য হয় এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে ৭ হতে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

মন্তব্য: খুমি সামাজিক প্রথামতে একাধিক বিয়ে করা যায়। এই প্রথা না মেনে কোনো স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনের আওতায় মামলা করলে স্বামীর শাস্তি হতে পারে। যদিও সেই বিচার খুমি সামাজিক প্রথা সম্মত নয়।

বর্তমানে প্রচলিত কোনো প্রথা দ্বারা সমাজের বৃহত্তর অংশের ক্ষতিসাধিত হলে তা অবশ্যই সংশোধন করা যায়, এক্ষেত্রে খুমি সমাজের বিচার কাঠামোর বাইরে গিয়ে প্রতিকার চাওয়া এবং খুমি প্রথাগত আইন মেনে চলা এক নয়।

বিবাহের প্রমাণঃ খুমি সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। বিবাহ নিবন্ধীকরণের কোনো প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা কিংবা স্বীকৃত কোনো প্রকার সামাজিক রীতিনীতি কিংবা স্বীকৃত কোনয় প্রথার প্রচলন নেই। সাধারণত বিবাহের সত্যতা বা অস্তিত্ব প্রমাণ হয় নিম্নমতেঃ

ক) ‘আইয়ুলানা পই’/কিখেনা/ফাইলো খেনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তির সাক্ষ্য;

খ) ‘আইয়ুলানা পই’/কিখেনা/ফাইলো খেনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমাজপতি/কার্বারীর সাক্ষ্য;

গ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বাবা-মায়ের স্বীকৃতি;

ঘ) সমাজ স্বীকৃতভাবে স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস;

ঙ) স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার;

চ) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরস্পর-পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান;

ছ) সমাজপতি, কার্বারী, হেডম্যান বা সার্কেল চীফ/খুমি কুহুং হয় না লাং সংস্থা কর্তৃক বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত বা সনদপত্র;

জ) ‘আইয়ুলানা পই/ কিখেনা/ফাইলো খেনা অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য ছবি।

উপরোক্ত উপাদানগুলো বিয়ের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করে।

বৈবাহিক কর্তব্য:

(ক) স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করে এবং স্বামীর ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলে।

(খ) স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরনপোষণ দিতে বাধ্য থাকে।

(গ) উভয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকে।

আইনসঙ্গত বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং দায়িত্ব:

(ক) বিয়ের পর স্ত্রীর ওপর স্বামীর অভিভাবকত্বের দায় বর্তায়।

(খ) বিয়ের পর স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী পছন্দনীয় স্থানে স্বামীর সাথে বসবাস করতে হয় এবং স্বামীর সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়। অনুরূপভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরনপোষণ দিতে বাধ্য।

তথ্যসূত্র

 ১। Majority Act, 1875.

২। Guardians and Wards Act, 1890.

৩। Child Marriage Restraint Act, 1929.

৪। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply