খুমি জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (আয়ু আখাইনা)

Jumjournal
Last updated Dec 15th, 2019

973

featured image

খুমি বিবাহ বিচ্ছেদ

খুমি পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘আয়ু আখাইনা’ বলা হয়।

 

বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি

স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে খুমি সমাজসিদ্ধ একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘আয়ু আখাইনা’ হতে পারেঃ-

ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কার্বারীর আদালতের সিদ্ধান্ত মতে ‘আয়ু আখাইনা’ হতে পারবে।

খ) স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে কার্বারীর আদালতে দ্বারস্থ হয়ে কার্বারীর আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদন করতে পারে।

গ) খুমি সমাজে কার্বারীর উপস্থিতিতে কার্বারীর আদালতে অথবা কার্বারী আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালতে আপীল করতে পারে। এ বিষয়ে সার্কেল চীফের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। তবে অদ্যাবধি খুমি সমাজে ‘আয়ু আখাইনা’ সংক্রান্ত কোনো প্রকার সামাজিক মোকদ্দমা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।

 

কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘আয়ু আখাইনা’ দাবী করার অধিকার লাভ করে: নিম্নোক্ত কারণে খুমি সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘আয়ু আখাইনা’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ

ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে  অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘আয় আখাইনা’ দাবী করতে পারে।

খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় তাহলে এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে অপরজন ‘আয়ু আখাইনা’ দাবী করতে পারে। স্বামী দোষী সাব্যস্ত হলে সেক্ষেত্রে তার শ্বশুরকে ১টি মাদী শূকর ও ৬০ টাকা (পোংনেহ) জরিমানা দিতে হয়। পরকীয়া অপরাধে দোষী সাব্যস্ত স্বামী বা স্ত্রীকে তার সাথে পরকীয়াতে জড়িত মহিলা বা পুরুষটিকে বিয়ে করতে হয় এবং সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্ব স্বামী বা স্ত্রীর নিকট বিবাহকালীন খরচের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। যৌতুক হিসেবে দেয়া মুরগী, শূকর ও মাথার পাগড়ি ফেরত দিতে হয়। সামাজিক আদালতে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা (আপ্রেই) ও ১টি মাদি শূকর দিতে হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে যে কোনো এক পক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদন করে দ্বিতীয় বার বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।

ঘ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা’ প্রদান করতে পারে।

ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন গুরুতর অপরাধে দন্ডিত হয়ে দীর্ঘদিন যদি কারাবাসে থাকে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষের সম্মতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আইয়ুলানা পই’’ ফেরৎ দিয়ে ‘আয় আখাইনা’ দাবী করতে পারে।

চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা, সম্পাদন করতে পারে। তবে সামাজিক বিচারে স্ত্রীকে মারপিট করে রক্তাক্ত ও জখম করলে সেই অপরাধে একটি শূকরসহ অর্থদন্ড দিতে হয়।

ছ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদন করতে পারে।

জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয়ু আখাইনা’ প্রদান করতে পারে।

 

বিবাহ বিচ্ছেদের (আয়ু আখাইনা) আইনগত ফলাফল:

ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘আয় আখাইনা’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

খ) ‘আয়ু আখাইন’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনের কারণে গর্ভজাত সন্তান অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘আইয়ুলানা পই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূনঃ বিবাহ দ্বারা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।

ঘ) ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়। তবে স্বামীর দ্বারা ‘আয়ু আখাইনা’ হলে সামাজিক সিদ্ধান্ত অনুসারে তাকে জরিমানা স্বরূপ স্ত্রীকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

ঙ) ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।

চ) ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদনের সাথে সাথে স্ত্রী তার স্বামীর আইনগত উত্তরাধিকার হারায়, তবে স্ত্রীর আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা অসুস্থতার জন্য সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে স্ত্রী এক বছরের খোরপোষ পাবার অধিকারী হয়।

ছ) ‘আয়ু আখাইনা হবার পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয় এবং স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে স্বামীর মৃত্যুর পর ‘আয়ু আখাইনা’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।

 

আয়ু আখাইনাসম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থা:-

ক) ‘আয়ু আখাইনা’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘আয়ু আখাইনা’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব স্বামীকে সন্তানের পিতৃত্বের দায় মেনে নিতে হয়।

উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় না। সন্তান পিতার সাথে থাকলে পিতার ভরনপোষণ ও উত্তরাধিকার লাভ করে।

তবে সন্তান যদি মায়ের সাথে থাকে সেক্ষেত্রে ৩ বছর পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকতে পারে। এই ৩ বছর সন্তানের ভরনপোষণের খরচ পূর্ব স্বামীকে বহন করতে হয় সামাজিক রীতি অনুসারে।

বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হয়, তাহলে সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকে। অবশ্য সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান করে তবে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।

খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘আয় আখাইনা’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী গর্ভ ধারণ করে, সেক্ষেত্রে ধাত্রী বিদ্যামতে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য নয়। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভজাত এ ধরণের সন্তানের দায়দায়িত্ব খুমি সমাজের রীতিনীতি অনুসারে সামাজিক আদালত নির্ধারণ করে।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা