খুমী রূপকথা: আমুয়ু হই অমনন (দুই বোন ও সাপ)
1103
প্রেমি খুমী অনেক দিন আগের কথা। এক সময় দুই বোন জুম চাষ করতো। জুম চাষ করতে করতে অনেক দিন চলে গেল। ধান কাটার সময় আসল।
তখন বড় বোন বললঃ “আমার খুব শীত লাগছে। এত শীতের সময় কেউ যদি সাহায্য করতে আসত, তাহলে তাকে আমি বিয়ে করতাম।”
তার ছোট বোন বলল, “দিদি, এমন কথা বলিও না।” বড় বোন বলল, “এমন বলব না কেন? আমার আর ধৈর্য হচ্ছে না বোন।”
ব্যাঙ ঐ কথাগুলো শুনে ফেলল। ব্যাঙকে একটুর জন্য সাপ খেয়ে ফেলত। সাপকে দেখে ব্যাঙ বলল, “সাপ আমাকে খেয়ো না। আমার একটা অনুরোধ রাখ। আমি তোমাকে একটা আনন্দের সংবাদ দেব।”
সাপ ব্যাঙকে বলার জন্য সুযোগ দিল। তখন ব্যাঙ বলল, “ঐ জুমে দুই বোন ধান কাটছে। বড় বোন বলছে কেউ যদি তাকে সাহায্য করত তাহলে সে তাকে বিয়ে করত।
কথাগুলো আমি শুনে ফেলেছি।” তারপর সাপ বললঃ “তুমি এই কথাগুলো কি সত্যি বলছ?” “হাঁ সত্যি বলছি।” তারপর সাপ আগুন জ্বালিয়ে দিল।
আগুন দেখে ছোট বোন বলল, “এই যে দেখ, কেউ হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে”। তারপর বড় বোন আগুন দেখে সেখানে গেল। সাপটি ওখানে বসেছিল।
বড় বোনের সংগে সাপের ভাব হয়ে গেল। অবশেষে সাপের সংগে বিয়েও হয়ে গেল। তখন সাপও তাদের সংগে থাকত। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। সাপ এত যে খাবার খেতে পারে তা কল্পনা করা যায় না।
সে সাত গামলা ভাত আর সাত গামলা তরকারি খেত। এভাবে প্রায় একমাস হয়ে গেল। তাদের খাবার প্রায় শেষ হয়ে গেল। বড় বোন ছোট বোনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল বাড়ী থেকে চাউল নিয়া আসার জন্য। ছোট বোন বাড়ীতে গেল।
ছোট মেয়েকে দেখে তাদের মা-বাবা বললঃ “তোমার স্বাস্থ্য এত খারাপ হল কেন মা?”
মা-বাবা অবাক হয়ে গেল এবং জিজ্ঞেস করলঃ “তুমি ভাত খাওনি?” ছোট মেয়ে বললঃ “না কিছুই হয়নি।”
মা-বাবা ছোট মেয়ের চিকিৎসা করল এবং বাড়ীতে কয়েকদিন থাকার জন্য বলল। কয়েকদিন থাকাকালে বড় বোনের অবস্থা সব মা-কে বলে দিল, “মা, আমাদের বড় বোন সাপকে বিয়ে করেছে। এই কারণে আমি কোন সময় পেট ভরে খেতে পাই না। দুলা ভাই খুব বেশী ভাত খায়। যার ফলে আমার স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে গেছে।” মা সব কথা শুনল এবং স্বামীকে সব কথা খুলে বলল।
পরদিন তাদের বাবা তাদের জুমে গেল। বড় মেয়েকে বললঃ “অন্য পাড়াতে আজ আনন্দ উৎসব হবে। সেখানে তুমি যেও। খুব ভাল অনুষ্ঠান হবে।”
কিন্তু বড় মেয়ে সেখানে যেতে চাইল না। বাবার কথায় বাধ্য হয়ে সে যেতে রাজী হল। ফিরে আসার সময় গরুর মাংস নিয়ে আসার জন্য বাবা বড় মেয়েকে বলে দিল। বড় মেয়ে মেলা দেখতে গেল।
তখন বাবা ছোট মেয়েকে বললঃ “তোমার দুলা ভাইকে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে। আস।” ছোট মেয়ে সাপকে খাবার জন্য ডাকল। শালীর ডাক শুনে সাপটি খেতে আসল।
তখন বাবা সাপকে বললঃ “তুমি যদি আমার সত্যিকারের জামাই হও তাহলে তুমি এখানে মাথা রাখবে।” বলে এক টুকরো কাঠ বসিয়ে দিল। সাপটি ওখানে মাথা রাখল। মাথা রাখার সংগে সংগে তার শ্বশুর তার মাথা কেটে দিল।
তারপর সাপের মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলল। খাওয়া শেষ হয়ে গেল। খাওয়া পর হাড়গুলো গর্তের ভিতরে পুঁতে দিল।
সকালে মেলা থেকে বড় মেয়ে ফিরে আসলে মাংসগুলো ভাল করে রান্না করল। রান্না হলে ছোট বোনকে বলল, “তোমার দুলা ভাইকে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে আস।”
ছোট বোন দুলা ভাইকে ডাকল। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। ছোট বোন সব জানত। তাই সে বলল, “আমার এখন খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমরা আগে খেয়ে ফেলি।”
বড় বোন বলল, “তাহলে তুমি খাও, আমি তোমার দুলা ভাইকে দেখতে যাচ্ছি।” যাবার সময় তার ছোট বোনটিকে বলল, “যদি আমি ওকে না পাই, তাহলে আমি ওখানে মরে যাব।” যাবার সময় তার ছোট বোনটিকে তার মাথার সবচেয়ে লম্বা চুলটি দিয়ে বলল, “এই আমার উপহার।”
বড় বোন তার স্বামীকে খুঁজতে গেল। তার স্বামী সাপকে না পেয়ে পুকুরে ডুব দিয়ে মারা গেল। ছোট বোন তার দিদি আসছে না দেখে সেখানে গেল এবং দেখতে পেল, তার দিদি পানিতে ডুবে মারা গেছে।
তখন সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সেই কান্নার সুর এতই সুন্দর যে, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তার পাশে জড়ো হয়ে আসল এবং তারাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
একদিন রাজা ও মন্ত্রী শিকার করতে গেল। বনে তারা কান্নার শব্দ শুনতে পেল। মন্ত্রী সে দিকে গেল। তার কাছে কান্নার শব্দ খুব সুন্দর লাগলো এবং তার মায়াও লাগল। মন্ত্রী রাজাকে এই কথা জানাল। কিন্তু রাজা বিশ্বাস করল না।
আবার মন্ত্রীকে পাঠাল। মেয়েটির কান্নার শব্দ শুনে মন্ত্রী অবাক হয়ে গেল। মন্ত্রী তার কাছে গেল এবং তার কাছ থেকে একটা জিনিষ চেয়ে বলল, “আমি তোমাকে একটা কথা বলব। তুমি মনে নেবে ?” মেয়েটি বলল, “বলুন।” “তোমার চুল আমাকে দিতে পারবে ?”
মন্ত্রীর কথা শুনে মেয়েটি চিৎকার করলঃ “কেন?” মন্ত্রী বলল, “আমাদের রাজা তোমার চুল দিতে চেয়েছে। মেয়েটি অবাক হয়ে গেল।
মন্ত্রী বলল, “তোমার চুল যদি আমাকে না দাও তাহলে আমাদের রাজা আমাকে মেরে ফেলবে।” একথা শুনা মাত্র মন্ত্রীকে নিজের চুল টেনে দিয়ে দিল। চুলটি খুবই সুন্দর এবং লম্বায় প্রায় এক মাইল। মন্ত্রী তার চুল দেখে অবাক হয়ে গেল।
সে মনে মনে ভাবল, এত লম্বা চুল আমার জীবনে কোনদিন দেখিনি। তারপর মন্ত্রী চুলটি নিয়ে রাজার কাছে গেল। এত লম্বা চুল দেখে রাজাও অবাক হয়ে গেল। তারপর রাজা তাকে বিয়ে করতে চাইল এবং তাকে বিয়ে করে ফেলল।
রাজা তাকে ঘোড়ার পিঠে বসাল। ঘোড়ার পিঠে বসার সময় মেয়েটি বলল, “আমার জীবনে কোনদিনও আমি ঘোড়াতে চড়িনি। আমার এই প্রথম ঘোড়ায় চড়া।” সে খুশীতে গান গাইতে লাগল। রাজা তাকে প্রাসাদে নিয়ে গেল।
এমনি করে এক মাস দুই মাস হয়ে গেল। তখন তার পেটে সন্তান আসল। রাজাকে সে কথা জানাল। রাজা এই কথা শুনে আনন্দিত হল।
একদিন রাজা অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় তার স্ত্রীকে বলে দিল, “যখন তুমি সন্তান প্রসব করবে তখন এই রশি দিয়ে আমাকে টানবে।” বলে কোমরে একটা রশি বেধে চলে গেল। রাজা যেতে যেতে বহু দূরে চলে গেল।
সন্তান প্রসবকালে বড় রানীরা উপস্থিত ছিল। তারা ছোট রানীকে দেখতে পারত না। ছোট রানী সাত ছেলে এক মেয়ে জন্ম দিল। বড় রানীরা বাচ্চাগুলোকে পুকুর পাড়ে পুঁতে রাখল।
বাচ্চার বদলে সাতটা কুকুর ছানা রেখে দিল। তারপর বড় রানীরা রাজার কোমরের রশি টানলো। রাজা যখন ফিরে আসল, তখন বড় রানীরা কুকুরের বাচ্চাগুলোকে রাজাকে দেখাল। রাজা রাগে ছোট রানীর ডান হাত, ডান পা এবং ডান স্তন কেটে দিল। তারপর রানীকে কবুতর রাখার বাক্সে রেখে দিল।
পুকুর পাড়ে পুঁতে রাখা রানীর বাচ্চাগুলোকে তার বড় বোন (সাপের স্ত্রী) লালন পালন করল। একদিন তাদের মায়ের অবস্থা সব খুলে বলল। একদিন সকালে রাজা পুকুর ঘাটে মুখ ধুতে আসল।
তখন পুকুর পাড়ে তার বাচ্চারা গান গাইছিল। রাজা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কারা?” বাচ্চারা উত্তর দিল, “আমরা আপনার সন্তান। আমাদের মা হচ্ছে ডান হাত, ডান পা কাটা রানী।
তারপর তারা বললো, “বড় রানীরা আমাদেরকে পুকুর পাড়ে পুতে দিয়েছিল।” রাজা তাদেরকে কোলে নিল এবং ছোট রানীকে কবুতর বাক্স থেকে উদ্ধার করল । তখন আবার রাজা ছোট রানীকে গ্রহণ করল।
রাজা বড় রানীদেরকে ছোট রানীকে যেভাবে করা হয়েছিল, ঠিক তা-ই করল। তাদেরকে হাত-পা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিল।
লেখকঃ প্রেমি খুমি
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।