খেয়াং রূপকথা: উহাম চ খুই (কুনো ব্যাঙের গল্প)
1427
অনেক দিন আগের কথা। তিত্তির পাখি আর ব্যাঙ একটা বনে বাস করত। যে গাছের ডালে তিত্তির পাখির বাসা, সেই গাছের তলায় একটা ছােট গর্তের মধ্যে ব্যাঙ থাকত।
রোজ সকালে খাবারের খোঁজে ব্যাঙ গাঁয়ের দিকে যেত আর তিত্তির পাখি বনে ঘুরে ঘুরে খাবার সগ্রহ করত। বিকেলে দুই বন্ধু ফিরে এসে খানিক গল্প-গুজব করত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত।
একদিন ব্যাঙ খাবার খুঁজতে খুঁজতে এক গাঁয়ে গিয়ে পড়ল। সে গাঁয়ে একদল দুষ্ট বালক ছিল। ব্যাঙ সে বালকদের খপ্পরে পড়ে মার খেয়ে আধমরা অবস্থায় কোন রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসল।
এদিন বিকেলে ব্যাঙ-এর বাসস্থানে ফিরে যেতে দেরী হল। ব্যাঙকে দেরীতে আসতে দেখে তিত্তির পাখি বলল, “ব্যাঙ বন্ধু, আজ ফিরতে দেরী হল কে ?” জবাবে ব্যাঙ বলল, “বন্ধু, আজ আমি খাবার খুঁজতে খুঁজতে শহরে গিয়ে পড়েছিলাম, তাই ফিরে আসতে দেরী হল।
শহরে গিয়ে এক অদ্ভুত খবর পেয়েছি।” তিত্তির পাখি বলল, “অদ্ভুত খবরটা কি?” জবাবে ব্যাঙ বলল, “আজ মধ্যরাতে কালবৈশাখী ঝড় প্রবল বেগে আঘাত হানবে। তাতে নাকি গাছপালা, পশু-পাখি কোন কিছুই রক্ষা পাবেনা। তাই শহরের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে এবং খবরটা প্রচার করছে।”
ব্যাঙ-এর বানানো খবর শুনে তিত্তির পাখি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। বেচারা কি করবে ভেবে পায়না। সে মনে মনে ভাবল যে, তার বাসাটি খুব মজবুত নয়, ঝড়ে এক ধাক্কায় উড়ে যাবে।
এ মনে করে নিজের বাসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও আশ্রয় খুঁজে পেলনা বা এতটুকু ক্ষুদ্র দেহটি নিয়ে কোথাও থাকা নিরাপদ মনে করলনা। ঠিক ঐ সময়ে একটা গাছের ডালে এক ঈগল পাখি মুখ হাঁ করে ঘুম যাচ্ছিল।
এটা দেখে তিত্তির পাখি ভাবল যে, তাতে আশ্রয় নিলে তার খুব নিরাপদ লাগবে। তাই হাঁ করা ঈগল পাখির মুখে ঢুকে পড়ল। যে মাত্র ঢুকে গেল ঠিক সে মুহুর্তে ঈগল পাখি ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ বিকট শব্দে চিৎকার করল।
ঈগল পাখি যে গাছের ডালে ছিল সে গাছের পাশে আর একটি গাছের ডালে বানর (য়োং) থাকত। সেদিন বানর খাবারের জন্য জুম হতে একটা বড় কুমড়া (মইমী থেইট) চুরি করে নিয়েছিল।
কিন্তু কুমড়াটি এত বড় ছিল যে, বানরের পক্ষে পুরোটা খাওয়া সম্ভব হলনা। কুমড়া বানরের প্রিয় খাদ্য ছিল। তাই সে অর্ধেক খেয়ে বাকী খন্ডাংশটি পরদিন খাওয়ার জন্য রেখে দিল।
কিন্তু বানরটির সে প্রিয় খাদ্য কুমড়া খন্ডটি কোথাও রাখা নিরাপদ মনে হলনা। তাই যে গাছের ডালে থাকত সে গাছের ডালে কুমড়া খন্ডটি ধরে বানর গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল। আবার যে গাছে বানর ছিল সে গাছের তলায় এক গর্ভবতী হরিণী (ছকী) শুয়েছিল।
ঈগল পাখির বিকট শব্দের চিৎকারে বানরের কুমড়া খন্ডটি ঠিক গর্ভবতী হরিণীর পিঠে গিয়ে পড়ল। হরিণীটি এতে ভীষণভাবে আঘাত পেয়ে দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে এক জায়গায় এসে সে এক অজগর সাপের মাথা মাড়িয়ে চলে গেল।
কিন্তু হরিণীটি এত দ্রুত দৌড়াচ্ছিল যে, কোথায় কিসের উপর দিয়ে চলে গেল টের পায়নি। এদিকে অজগর সাপটি খাবার শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার মাথায় হঠাৎ হরিণীর পায়ের আঘাত লাগায় সাপটি পালাতে লাগল।
এক বন মুরগি অনেকগুলো ডিমের উপর বসে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। সাপটি পালাবার পথে এটা দেখতে পেল। সে বন মুরগিকে ফোঁস ফোস করে তাড়িয়ে দিল এবং তার সমস্ত ডিম খেয়ে ফেলল।
কন মুরগি তার ডিমগুলো হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল এবং অন্যস্থানে উড়ে চলে গেল। ঠিক সে স্থানে একদল পিপড়া ডিম নিয়ে ছুটাছুটি করছিল। বন মুরগি এটা দেখতে পেয়ে মুহুর্তেই তাদের ডিমগুলি খেয়ে ফেলল। পিপড়ার দল আর উপায় না দেখে প্রাণ নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেল।
এক শূকরী শুয়ে তার বাচ্চাদের দুধ খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় পিপড়ার দলটি সেখানে গিয়ে পড়ল। তারা এটা দেখে শূকরীর স্তনটি কামড়াতে লাগল।
শূকরীটি পিপড়ার কামড়ের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। এ অবস্থায় সে রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করল। রাজা শূকরীটিকে বিচারের আশ্বাস দিয়ে সেদিনের মত বিদায় দিল।
পরদিন রাজার কাছে শূকরী ও পিপড়ার দলের বিচার হল। রাজা পিপড়ার দলকে শূকরীর স্তনে কামড় দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করল। পিপড়ার দল বলল, “মহারাজ, এ অপরাধের জন্য আমরা দায়ী নই।
আমরা যখন ডিম নিয়ে ছুটাছুটি করছিলাম তখন এক বন মুরগি এসে আমাদের সমস্ত ডিম খেয়ে ফেলে। তাই হতভম্ব হয়ে কোথায় গিয়ে কি ক্ষতি করেছি তা আমরা কিছুই জানিনা। তার জন্য বন মুরগিই দায়ী।”
রাজা কন মুরগিকে ডাকার আদেশ দিল। রাজার আদেশে বন মুরগি এল। সেও রাজাকে একই জবাব দিল এবং তার অপরাধের জন্য অজগর সাপকে দায়ী করল। অজগর সাপকে ডাকা হল।
একে একে গতী হরিণী, বানর, ঈগল পাখি, তিত্তির পাখি ও ব্যাঙকে ডাকা হল। এরা সকলে নিজ নিজ অপরাধ স্বীকার করল এবং একে অপরকে দায়ী করল।
সবশেষে রাজা ব্যাঙকে জিজ্ঞাসা করল যে, সে কোথায় বা কার কাছ থেকে খবরটি পেয়েছিল। রাজার প্রশ্নের জবাবে ব্যাঙ হানা কিছুই উত্তর দিতে পারলনা।
সেদিন এক গাঁয়ে গিয়ে দুষ্ট বালকদের হাতে মার খেয়ে ব্যাঙের আধমরা অবস্থা হয়েছিল, তাই ব্যাঙ তার বন্ধুকেও (তিত্তির পাখি) এ অবস্থায় ফেলতে চেয়েছিল।
একারণে ব্যাঙ তিত্তির পাখিকে মিথ্যা এবং বানানো খবর দিয়েছিল। তাই রাজাকে ব্যাঙ হ্যাঁ-না কিছুই জবাব দিতে পারল না। ব্যাঙের হা-না জবাব না পেয়ে রাজার বুঝতে বাকী রইল না যে, ব্যাঙ মিথ্যা খবর পরিবেশন করেছিল এবং সেই-ই প্রকৃত অপরাধের মূল উৎস।
রাজা তক্ষুণি আদেশ দিল যে, “মিথ্যা ভাষণের শাস্তি হিসেবে কাঁঠাল গাছে বেঁধে ব্যাঙের চামড়া তোল এবং তারপরতাতে লবণ আর কাঁঠাল গাছের আঠা মেখে ছেড়ে দাও।” রাজার আদেশ মত তা-ই করা হল।
তখন থেকে ব্যাঙ আর ব্যাঙ থাকল না, পরিণত হল কুনো ব্যাঙে। ব্যাঙের পিঠে যে লবণ দেওয়া হয়েছিল তা গুটিতে পরিণত হল। আর কুনো ব্যাঙ নড়াচড়া করলে গুটি থেকে এক প্রকার দুধের মত সাদা তরল পদার্থ বের হতে দেখা যায়, এটি কাঁঠাল গাছের আঠা ছাড়া আর কিছুই নয়।
লেখকঃ টিং হাউ খেয়াং
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।