খেয়াং রূপকথা: প্রেংঞাম মংপিয়া খুই (গুণবতী রাণীর গল্প)
807
একদা এক রাজা ছিল। তার অর্থ-বৈভব, সৈন্য-সামন্ত কোন কিছুর অভাব ছিলনা। প্রাচুর্যের মধ্যে ভোগ-বিলাস, নানা দেশের সুন্দরী যুবতীর সমাবেশ, নৃত্যগীত আর মদিরার (নাটটওছ) সাহচর্যে দিন কাটত।
তার এক রাণী, রাণীর রূপ ছিল কুৎসিত কিন্তু গুণ ও বুদ্ধিমত্তায় (প্রেং) রাণী ছিল অদ্বিতীয়া। রাণী রাজাকে খুবই ভালবাসত। রাজাও রাণীর অনুমতি ব্যতীত কোথাও যেত না।
একদিন রাজা রাণীকে নিয়ে বাণিজ্যতে (কুনপও) যাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করল। রাণীও খুশি মনে সায় দিল । ধনসম্পদ লোক-লস্করে বারটি জাহাজ পূর্ণ করে রাজা রাণী উভয়েই বণিক বেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে রাজা দেখতে পেল, নির্জন সমুদ্র বেলাভূমির (তুইকমচা) তীরে লতা-পাতার ছাউনি দেয়া ছোট্ট কুঁড়ে ঘর থেকে এক অপূর্ব সুন্দরী কলসি কাঁখে জল নিতে সাগর পাড়ে আসছে।
মেয়েটির নব বিকশিত লজ্জাকাতর রূপ দেখে রাজা আক্ষেপ করতে লাগল। রাজার এ আক্ষেপ শুনে রাণী মনে মনে খুব দুঃখ পেল। তখন রাণী বলল, “প্রিয়তম একি বলছেন। মেয়েটির এ অবস্থার জন্য শুধু স্বামীই বা দায়ী হতে যাবে কেন? ছি ছি, আপনি কেবল বিচক্ষণ রাজাই নন একাধারে সেবক, প্রজাকুলের পরম হিতৈষী।
আপনি একজন সত্যিকারের আদর্শবান রাজাধিরাজ। আপনার মুখে এ ধরনের মন্তব্য আদৌ শোভা পায় না। আমার দৃষ্টিতে মেয়েটির ব্যাপারে দায়ী মেয়েটি নিজেই।
কারণ আমাদের নারীরাই সংসারের সকল সুখের উৎস। অর্থ-ধন-সম্পদ স্বামীর উপার্জন করার দায়িত্ব বটে, কিন্তু স্বামীর উপার্জিত সেই অর্থ, সেই ধন-সম্পদ স্ত্রীর চতুরতা ও কর্মদক্ষতায় ভরে ওঠে।
যার স্ত্রী এ বিষয়ে অপটু ও চরিত্রহীনা, তার স্বামী হাজার উপার্জন করুক, তা সবই বাঁধ ভাঙা জলের মতো। সুতরাং আমাদের নারীদের বাইরের সৌন্দর্য দেখে অনুমান করা যায় না; ভেতরের সুন্দর অন্তরটাই আসল কথা।
আজ আমার দৃষ্টিতে, আমার বিবেচনাতে মেয়েটি নিশ্চয় দ্বিচারিনী আর মন্দ স্বভাবের। যার ফল আজকে তাদের এই চরম দরিদ্রতা।”
রাণীর একথাগুলোরাজা কিছুতে মেনে নিতে পারল না। দুজনের মধ্যে তুমুল বাক-বিতন্ডা শুরু হলো। কেউ হার মানতে রাজী নন। উপস্থিত মন্ত্রিবর্গ, সৈন্য-সামন্ত সবাই তাজ্জব বনে গেল।
এভাবে অনেকক্ষণ তর্ক-বির্তকের পর রাণী রাজাকে বলল, “প্রিয়তম, আমাদের মধ্যেকার এই বিবাদ সমাধানের একটা মাত্র উপায়। তা আমি বলছি, যদি অনুমতি দেন?” রাজা বলল, “হ্যা হ্যা, রাণী প্রিয়তমা, তাড়াতাড়ি নির্ভয়ে বল।”
রাণী বলল “আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এই আমরা দুজন দুজনারই চিরকাল এই তিন সত্যি প্রতিজ্ঞাবদ্ধে কিছুকাল আমরা দু’জনে দু’ভুবনের বাসিন্দা হবে। আমি এখানে গরীবের স্ত্রী হয়ে এই গরীবের ছোট্ট কুড়ে ঘরে থেকে যাবো।
আর আপনি গরীবের এই সুন্দরী স্ত্রীকে আমার মর্যাদায় বাণিজ্যতে নিয়ে যাবেন। তারপর ঘটনার সত্যতা তিন সত্যিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। রাণী জাহাজ থেকে নেমে এই নির্জন বেলাভূমিতে গরীবের স্ত্রীরূপে গরীবের এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থেকে গেল।
আর রাজা গরীবের ঐসুন্দরী স্ত্রীকে রাণীরূপে রাণীর মর্যাদায় জাহাজে তুলে বাণিজ্যতে নিয়ে গেল। এখানে রাণী জাহাজ থেকে নেমে লতা-পাতার ছাউনি দেয়া গরীবের এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে গিয়ে দেখল, নিরালা নিঝুম অন্ধকার।
এমনকি তেল কিনে বাতি দেয়ার সামর্থ্য পর্যন্ত তাদের নেই। নোংরা বিশ্রী পরিবেশ। ঘরের চারিকোণে বহুদিনের আবর্জনার স্কুপ কদর্য অবস্থায় পরে আছে তাতে শ্বাস নেয়া অস্বস্তিকর।
ঘরটাতে ঢুকে রাণীর মনে হলো কোন আধ-মরা জগতের সঙ্গে সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে আছে। কিন্তু ত্যাগ করার উপায় নেই।
আস্তে আস্তে সমস্ত ঘরটাকে ঝাড়ু দিয়ে ময়লা আবর্জনা সব এক জায়গায় স্থূপ করে আগুনে দিল। তারপর আধ ময়লা কাপড় থালা-বাসন ইত্যাদি পরিষ্কার করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় রইল।
এদিকে সন্ধ্যা যখন নেমে এল, রাণী দেখতে পেলো দূর অজপাড়াগাঁয় ভিক্ষে করে ফিরে আসছে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। রুক্ষ বাস্তব জীবনের কঠোর সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত চেহারা আর তার সমস্ত অবয়বে ফুটে উঠেছে করুণ প্রতিচ্ছবি।
বগলে ছেড়া ছাতা, কাঁধে ঝোলানো লম্বা একটা ঢিলেঢালা থলে। থলেতে কিছু চাল। ঘরের দরজায় এসে ডাক পাড়ল, “প্রিয়তমা, আমি এসেছি। দরজা খোল। জান, আজ আমি অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী চাল পেয়েছি”।
কণ্ঠে আনন্দের ধ্বনি। রাণী দরজা খুলে দিয়ে বলল, “আজ থেকে আমিই তোমার স্ত্রী, তুমিই আমার স্বামী”। আর বৃদ্ধের ভিক্ষে করা থলের চালগুলো নিয়ে রাণী মাত্র একদিনের খোরাক রেখে অবশিষ্ট চালগুলো বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “তুমি এই চালগুলো বাজারে বিক্রি করে তেল, বাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে বাকী টাকাটা আমার হাতে তুলে দিবে”।
বৃদ্ধটি রাণীর কথা মত বাজারে গিয়ে চাল বিক্রি করে তেল, বাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার পর অবশিষ্ট টাকাটা এসে রাণীর হাতে তুলে দিল। রাণী টাকাটা নির্দিষ্ট এক জায়গায় রেখে ঘরে বাতি জ্বেলে আলো দিল।
তারপর রান্নাবান্না করে দু’জনে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে কাকডাকা ভোরে উঠে বৃদ্ধটি আবার দূর অজপাড়াগাঁয় ভিক্ষে করতে চলে গেল। আর রাণী ঘর-দোর পরিষ্কার করে সন্ধ্যায় ঘরে বাতি দিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় রইল।
সন্ধ্যায় স্বামী ফিরে এলে স্বামীর ঐভিক্ষের চাল থেকে রাণী মাত্র একদিনের খোরাক রেখে বাকী চালগুলো ঐ একই নিয়মে বাজারে বিক্রি করে টাকাগুলো রেখে দিল।
এভাবে চাল বিক্রির জমানো টাকা দিয়ে ঘরে নতুন নতুন জিনিষ কিনতে লাগল। বৃদ্ধটিকেও রাণী আসার পর থেকে ভিক্ষে করতে গেলে অনেকে এমনিই দয়া করে হাজার টাকা পর্যন্ত দান করত।
সব মিলিয়ে তাদের সংসারে দিন দিন সচ্ছলতা ফিরে এল। তাদের আর ভিক্ষে করতে হয় না। জমানো পুঁজিপাটা নিয়ে তারা এখন রীতিমত ধনী বনে গেল।
তাদের ঐ লতাপাতা ছাউনি দেয়া ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটাও পরিবর্তন হয়ে নতুন দালানে পরিণত হালো। এভাবে রাণী গরীবের সংসারে গরীবের স্ত্রী হয়ে দীর্ঘ কঠোর শ্রম ও অধ্যবসায় দ্বারা আজ ধনীরূপে এখানে সুখে বাস করতে লাগল।
এদিকে রাজা গরীবের যে সুন্দরী স্ত্রীটিকে নিয়ে রাণীর মর্যাদায় বাণিজ্যতে গেল সে মেয়েটি এতদিন অভাব, অনটন ও নির্মম দারিদ্রে তিলে তিলে বঞ্চিত হয়েছে।
যৌবনের ঐশ্বর্য ভরা দিবস রজনী তার বৃথায় কেটেছে। কোনদিন মেয়েটির দুবেলা পেট পুরে আহার পর্যন্ত ভালভাবে জোটেনি। সে মেয়েটি আজ কিনা আলৌকিক স্বর্গরাজ্যের রাণী।
বিরাট বিরাট সুরম্য জাহাজ। জাহাজে বিপুল ধন-সম্পদ, লোক লঙ্করে ভরপুর। এত ঐশ্বর্যের জীবন-যাপন দেখে মেয়েটি শৃঙ্খল-ছিন্ন উম্মাদের মতো জাহাজে জাহাজে ঘুরতে লাগল।
আর পেটুকের মতো সারাদিন বিভিন্ন রকমের দামী দামী খাবার খেতে থাকে। খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ জাহাজের কোণে কোণে স্থূপাকারে রেখে দিত।
তারপর সারাদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানা বিচিত্র রঙের মণি-মুক্তাখচিত অলংকার পরে সাজসজ্জায় ব্যস্ত হয়ে যেত। রাণীর এ অবস্থা দেখে জাহাজের কর্মচারীদের মন অসহ্য হয়ে উঠে, কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়না।
ভেতরে ভেতরে তাদের অসন্তোষের দানা বাঁধতে থাকে। রাজাও মহাভাবনায় পড়ে গেলেন নতুন রাণীর এই চালচলন দেখে। তার অবচেতন মনটাততক্ষণে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে গেল। রাজা জীবনের কত বড় উজ্জ্বল চিরন্তন সত্যকে উপেক্ষা করেছেন।
দিন দিন ব্যবসার অবনতি ঘটতে থাকে। লাভ তোদূরের কথা। লোকসানের দায়ে জাহাজ পর্যন্ত একটা একটা করে বিক্রি করতে করতে আর অবশিষ্ট মাত্র একটি জাহাজ রইল।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজা এই একটা জাহাজ নিয়ে বাণিজ্য থেকে ফিরে আসতে লাগল। একদিকে লোকসানের দায়ে জাহাজ বিক্রি, অন্যদিকে নিজের অন্ধ মোহে পুরনো রাণীকে একটা গরীবের কুঁড়ে ঘরে রেখে আসা, ঐহতভাগারাণীর সাথে জীবনে আর দেখা হবে কিনা? এখন লোকসানের চাইতেও এ প্রশ্নটাই রাজার মনে বড় হয়ে দেখা দিল।
এভাবে আসতে আসতে ঐ ঘাটে এসে পৌছাল, যেখানে রাণীকে রেখে গিয়েছিল। তখন রাজা জাহাজ নোঙর করে গরীবের ঐ ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটাকে নীরব দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগল । কিন্তু রাজা দেখল ওখানে আর কুঁড়ে ঘর নেই।
এখন সেই কুঁড়ে ঘরের জায়গায় একটা নতুন পাকা দালান দাঁড়িয়ে আছে। রাজা ভাবল তার রাণী বোধ হয় আর বেঁচে নেই। এটা এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ী।
তখন রাজা পুরনো রাণীর শোকে পাগল প্রায়! কাঁদতে কাঁদতে জাহাজ থেকে নেমে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। এদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রাণীও ততক্ষণ ধরে রাজার এসব দৃশ্য অবলোকন করছিল।
রাণীও আর নীরব থাকতে পারল না, ছুটে এসে পরিচয় দিয়ে বলল, “প্রিয়তম, আমিই আপনার সেই হারানো রাণী এতদিন যাকে গরীবের এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে গরীবের স্ত্রী করে রেখেছিলেন, শুধু আপনারই ভুল ভাঙ্গাতে। আর এই দালান বাড়িটা হচ্ছে আমার।”
তখন রাজা তার বিদীর্ণ ব্যথার ভেতর থেকে অশ্রুময় আনন্দকে টেনে বলল, “রাণী প্রিয়তমা,এখনও বেঁচে আছে ? এখনও এই অপরাধী, মহাপাপিষ্ঠ রাজার প্রতি সৃষ্টিকর্তার এতটুকু করুণা আছে ?” সুদীর্ঘ বিরহ আবেগে আপ্লুত হয়ে রাজারাণী উভয়ে আবার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
লেখক: ক্য সা মং খেয়াং
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।