
নির্মল কান্তির পূর্ব পুরুষেরা কোথায় বসবাস করেছিল তার জানা নেই। নির্মল কান্তি তাঁর বাবা প্রভাকরের কাছ থেকে শুনেছেন তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা এক কালে বসবাস করেছিল রাঙ্গুনিয়ায়। সেখানে জুম চাষ করে জীবন ধারন করত। রাঙ্গুনিয়ার পুরোনো নাম ছিল চাকমাদের দেওয়া রান্যে। রান্যে হতে রাঙ্গুনিয়ার জন্ম।
চাকমারা জুম চাষ করত বলে জায়গার নাম পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। তার প্রমাণ শাওন ফরিদের লেখা “পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদের নাম বৈচিত্র” (সুলাই-প-২০০৯)”। তিনি অনুসন্ধান করে পেয়েছেন কোন জায়গা কিভাবে নাম পরিবর্তন হয়েছে, নির্মল কান্তিও লক্ষ্য করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গার নাম পরিবর্তন হয়েছে। হচ্ছে। এক কালে গঙ্গারাম দোর নাম থাকলেও এখন আর নেই বললেই চলে।
গঙ্গারাম এলাকাকে বিভিন্ন নাম দিয়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। আগের মতো গঙ্গারাম আর নেই। গঙ্গারাম দোরে ব্রীজ হয়েছে। পাকা রাস্তা হয়েছে। ঘন বসতি হয়েছে। আগের মতো প্রকৃতি নেই। সবকিছু ধ্বংস হয়েছে, হচ্ছে।
চাকমারা ঝগড়া-বিবাদ, মারা-মারি, হানা-হানি পছন্দ করে না। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পায়। মারা-মারি, হানা-হানির সম্ভাবনা টের পেলেই সেখান থেকে সরে যায়। হয়ত একারণেই নির্মল কান্তির পূর্ব পুরুষেরা রান্যে হতে সরে এসেছে রাঙামাটির হাজারীবাকে। হাজারীবাক থেকে একেবারেই গঙ্গারাম গহীন জঙ্গলে বসবাস।
নির্মল কান্তির বাবা একদিন বলেছিল নির্মল, তোর দাদু খুব সহজ-সরল, সাদা-সিদে মানুষ ছিল। প্রতিবেশী কোনোদিন কারো সাথে দেখিনি ঝগড়া করতে। সে নিজের মতো করে থাকত। ধর্মপ্রাণ ছিল। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যে বুদ্ধ বন্দনা করত।
আমরা যখন হাজারীবাকে ছিলাম, তখন গ্রামের লোকেরা সবাই ভারত চলে যাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে গেল। যারা ভারতে চলে যাচ্ছে তারা সবাই বলেছে – এ দেশে আর শান্তি থাকবে না। প্রতিদিন গণ্ডগোল হবে। মারামারি হবে। মানুষ অঘাটে-অপথে মরবে। মানুষ মরবে বনের পাখির মতো।
কেউ এগিয়ে আসবে না। শিয়াল, কুকুরের মরার মতো মানুষের মৃত দেহ পড়ে থাকবে যেখানে-সেখানে। সৎকার করার মতো উপায় থাকবে না। রাস্তার পাশে মাছির ভন ভন শব্দ শুনে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে মানুষের পঁচা, গলা মৃত দেহ।
মৃত মানুষের মাংস শিয়াল কুকুরে খেয়েও শেষ করতে পারবে না। কাপ্তাই বাঁধ হচ্ছে। সবুজ পাহাড় আর সবুজ থাকবে না। বনের গাছ, বাঁশ ধ্বংস হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। কোনো পাহাড় খালি থাকবে না। জায়গা-জমি নিয়ে ব্যাপক কাড়াকাড়ি হবে। বিস্তর মারামারি হবে। তখন মানুষ মরবে।
জনসংখ্যা বাড়বে। ভবিষ্যতে এমন জনসংখ্যা বাড়বে যে, দুই বাড়ির মাঝখানে এক কোণা মাটি খালি থাকবে না। সুতরাং এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। এখানে থেকে শুধু শুধু মৃত্যুকে টেনে আনা ভালো হবে না। এখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম হবে। ভারত সরকার আমাদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিবে।
জীবনের নিরাপত্তা দিবে। দুঃখে কষ্টে ভারতে যেতে পারলে জীবনের গ্যারান্টি থাকবে। সেখানেই সুখে শান্তিতে থাকতে পারব। এ কথা অনেকে বিশ্বাস করেছে। অনেকে বিশ্বাস করেনি। কাপ্তাই বাঁধ নিয়ে অনেক ঠাট্টা করেছে। যারা বিশ্বাস করেছে, তারা ভারতে চলে গেছে। যারা বিশ্বাস করেনি তারা পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গেছে।
তাদের ধারণা ছিল – এত বড় জায়গায় কতোই বা মানুষ বাড়বে। আর কাপ্তাই বাঁধ! তারা ঠাট্টা করে বলেছে আমরা ছোট ছোট নদীতে বাঁধ দিয়ে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারি না। এত বড় বড়গাঙ (কর্ণফুলী) বাঁধ দিয়ে কিভাবে রাখবে পানি। অসম্ভব! এসব কথা অনেকে বিশ্বাস করলেও তোর দাদু বিশ্বাস করত না।
তাই সেও ভারতে চলে যাওয়ার জন্য বাড়ির যা কিছু ছিল, যেগুলি বিক্রয়ের যোগ্য ছিল সেগুলি বিক্রি করে দিল। যেগুলি বিক্রির যোগ্য নয়, সেগুলি দিয়ে দিল প্রতিবেশীদেরকে।
শুধুমাত্র রাখল ভাত রান্না করার জন্য একটি পাতিলা, তরকারি রান্না করার জন্য একটি পাতিলা। একটি চামচ, কিছু কাপড়-চোপড়। অল্প চাউল আর লবণ। এসব জিনিস-পাটি সঙ্গে করে আমরাও রওনা দিলাম ভারতে যাওয়ার জন্য।
তাও গভীর রাতে। গভীর রাতে মানুষ পালাচ্ছে অথচ প্রতিটি বাড়িতে হারিকেন, চেরাগের আলো দেখা যায়। হারিকেন আর চেরাগের আলো বাড়িতে দেখলে মনে হয় গৃহবধুরা মুখে দাবা দিয়ে, মনের আনন্দে দাবা টেনে শব্দ করছে। মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
আর চরকায় সুতা কাটছে। দাবার শব্দ আর চরকার শব্দ মিলে এক হচ্ছে। আসলে তা নয়। চেরাগের আলো দেখলেও বাড়িতে গেলে দেখা যায়, কেউ নেই। নীরব। কোনো মানুষের শব্দ নেই।
ভারতে চলে যাওয়ার সময় গভীর ঘুমে থাকা শিশুকে চিমটি দিয়ে জেগে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গভীর রাতে মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। দূরে, খুব দূরে দু’একটি শিয়ালের ডাক। সারারাত নিশ্চুপ, নিঃশব্দ, নিষ্প্রাণ গ্রাম।
ভোর হলে মোরগের ডাকে রাতের নিশ্চুপ ভেঙে গেলেও নিষ্প্রাণ গ্রাম, আগের মতো প্রাণ ফিরে পায় না। কিছু কিছু পাখির ডাক শুনলেও তবুও ভালো লাগে না।
সূর্যের আলো দৃশ্যমান হলে কিছু কিছু মানুষ চলাফেরা করে মুখ কালো করে। বেলা হলে গোয়ালে দড়িতে বাঁধা অবস্থায় গরু-মহিষ, হাম্বা হাম্বা করে ডাক দেয়।
কুকুরগুলো এদিক-সেদিক ঘুরাফেরা করে লেজ নামিয়ে। কুকুর সাধারণত লেজ নামায় ভয় পেলে। তাদের প্রভু যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তখন বোধহয় তাদের ভিতরে অজানা এক ভয়ের জন্ম নিল। যে বাড়িতে যাওয়া হয় সেই বাড়ি খালি। বাড়ির লক্ষী বিড়ালটি তার প্রভুকে খুঁজছে বাড়ির চারিদিকে।
আর খালি পেটে মেও মেও করছে। কি করুণ দৃশ্য। তোর দাদু এ অবস্থা দেখে আর এ দেশে থাকতে চায়নি। যেতে চেয়েছিল ভারতে। তখন তোর কাকা, পিসি ছোট ছিল। দুই পিসি, এক কাকার জস্ম হয়নি। আমরা তিন ভাই বোন ছিলাম।
যখন আমরা নৌকায় করে বরগাঙ উজানি রওনা দিয়েছি তখন কাচলং দোরে (মুখ) এসে তোর দাদু দ্বিধায় পড়ল কোনদিকে যাবে? সোজা কি বড়গাঙ উজানি দিয়ে ডেমাগ্রিতে প্রবেশ করবে না কাচলং উজানি দিয়ে যাবে। কারণ লংগদু বরকলক গ্রামে তোর দাদুর এক পিসি ছিল।
এক নাগারে তিনদিন নৌকায় চড়ে বরকলক গ্রামে পৌঁছে গেলাম। নৌকায় খেয়েছি। নৌকায় ঘুমিয়েছি। রান্না করেছি বালুচরে। বরকলকে পৌছে তোর দাদুর পিসি বাড়িতে উঠেছি। আমাদের দেখে তারা অবাক হল। তোর দাদুর পিসি জিজ্ঞেস করল- নুওধন এত সরঞ্জাম নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
সে তো জানে না, আমরা ভারতে যাচ্ছি।
তোর দাদু বলল, ভারতে।
তোর দাদুর পিসি আবার জিজ্ঞেস করল, কেন?
সবাই যাচ্ছে, তাই আমরাও যাচ্ছি। এ দেশে আর শান্তি হবে না ।
সবাই যাচ্ছে বলে তুমিও যাবে? তাতো হতে পারে না। এই দেখ, আমাদের গ্রামে অনেকে চলে গেছে। কিন্তু আমি তো যাইনি। অনেকে যায়নি।
তোর দাদু বললো, এ দেশে থাকলে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো না।
কে বলেছে? শান্তিতে থাকতে পারব না! আমার গোলাভরা ধান, একরকে একর জমি, গোয়ালভরা গরু মহিষ। কই। কেউ তো কেড়ে নিচ্ছে না। সবাই পাগল হলে তুমিও হবে?
তোর দাদুকে অনেক বিষয় যুক্তি দিয়ে বোঝাল তোর দাদুর পিসি বাবু। তোর দাদু নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাল। সেখানেই থেকে গেল। নতুনভাবে সংসার সাজানোর জন্য কাজ করতে লাগল।
প্রায় দুই বছর থাকার পর কাপ্তাই বাঁধের পানি এসে তোর পিসি বাবুসহ সকলের বাড়ি-ঘর সবকিছু গ্রাস করে নিল। কপালে হাত দিয়ে বিলাপ করতে লাগল।
তোর দাদুর স্বপ্ন আবার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাপ্তাই বাঁধের পানি সবকিছু গ্রাস করে নেওয়ার পর আমরা আর সেখানে কোথাও থাকলাম না।
এর আগে সবাই চলে গেছে ভারতে। তখন ভারতে যাবার কোন সুযোগ নেই আর। বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো উপায় না পেয়ে সোজা এই গঙ্গারামে এসে বসতি করা।
এটি একটি বিশাল এলাকা। আমার মনে আছে শুধু মাত্র চার পরিবার ছিলাম। আমরা যখন এখানে এসছি, সে সময়ে কাচলং নদীর এপার-ওপার গভীর বন ছিল।
বড় বড় গাছ ছিল। গভীর বাঁশ বন ছিল। ছিল হাতি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
মোট কথা পৃথিবীতে যতো গাছ-গাছালি, বন্য পশু-পাখি আছে, প্রায় সবই এখানে ছিল। কাচলং, গঙ্গারাম নদীতে মাছ, কাঁকড়া, শামুক প্রচুর ছিল। এখন যে দুটো জারুল গাছ আছে, তখনও ছিল। তখনও এরকম ছিল।
দুই নদীর মুখে গভীর পানি ছিল। এত গভীর পানি ছিল, দেখলে ভয় হতো। পানির রঙ একদম নীল। লোকেরা বিশ্বাস করত, এই জারুল গাছ আর গঙ্গারাম মুখে দেবতা আছে।
তাই জারুল গাছ আর গভীর পানি দু’টোকে পূজা করত ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি, ফল-মূল, টাকা দিয়ে। অনেকে মানতও করত।
তাদের বিশ্বাস ছিল, এখানে পূজা দিলে দেবতা খুশি থাকে। আপদে-বিপদে রক্ষা করে। অসুখ-বিসুখ হবে না। কাজের সফলতা আসে। এখানে একটি হাতিও ছিল।
সে হাতিকে গালাগাল করতে পারত না। সেই হাতিকেও অনেকে পূজা করত। হাতির উদ্দেশ্যে খই, মুড়ি, বিস্কুট, ফর রাস্তায় পেলে রাখত।
কাচলং নদীতে কেউ বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করতে পারত না। নদীর দেবতা গরম হতো, করলে নদীর দেবতাকে শান্ত করার জন্য পূজা দিতে হতো।
তোর দাদু ভেবেছিল এখানে আর কেউ আসবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। ভারতের মত শান্তি না হলেও এখানে শান্তি কম হবে না। জায়গা-জমি নিয়ে ঝগড়া–বিবাদ হবে না। কাড়াকাড়ি, মারামারি হবে না।
মাত্র চার পরিবার মানুষ। কে বা ঝগড়া করবে! এতো বড়ো বিশাল এলাকা। কতোই বা জুম চাষ করবে। সে সময় বাঘাইহাটে বনবিভাগের অফিস ছিল। দুই একটি দোকানও ছিল।
জুমের উৎপাদিত সুতা, মরিচট, তিল এসব বেচা-কেনা হতো না বাঘাইহাটে। এসব বেচা-কেনা করতে দীঘিনালা অথবা মারিশ্যা বাজারে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হতো। একবার বাজারে গেলে দুই তিন দিন লাগত বাড়িতে ফিরে আসতে।
নির্মল কান্তির বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ সুরে বলল, তোর দাদুর আয়ু অর্ধেক হতে না হতে দেখতে পেল, সেগুন বাগান করার জন্য গভীর বন উজার করা হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ, যে গাছের অয়ু শত বছর, সে সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বাঁশ কেটি কাপ্তাই পেপার মিলে নেয়া হচ্ছে। গভীর বন ধ্বংস হওয়াতেই বনের পশু-পাখিরা পালিয়ে যাচ্ছে।
রাতে হরিণের মন মাতানো শব্দ, ভোরে বন মোরগের মিষ্টি মধুর ডাক, পাখির কিচির মিচির শব্দ ধীরে ধরে কমতে লাগল। ফেলান্ডিশন খুলে দেওয়াতে বহু পরিবার জুম চাষ করার জন্য এসেছে। এ অবস্থা দেখে আবার বলল নির্মল, আমরা একটু একটু শান্তি পেয়েছি। বোধহয় তোরা তাও পাবে না।
প্রায় ১৫-১৬ বছর পর ভারতে চলে যাওয়া থেকে দুই একজন এসেছে, দেশের আত্মীয় স্বজন খুঁজতে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান হতে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। স্বাধীন দেশে স্বজাতিরা কেমন আচে, দেখতে আসা। তারা এসে দেখতে পেল, বড়গাঙ নদী মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। যেদিকে তাকায় শুধু পানি আর পানি।
এত উঁচুতে কোনো কালে, কোন সময়ে বন্যার পানি উঠতে পারেনি, কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, এত উঁচুতে পানি উঠবে। সেসব জায়গা, গ্রাম, টিলা, পাহাড় সব পানিতে ডুবে তৈ তম্বুর হয়ে গেছে।
এক সময় যে গ্রামে অসংখ্য মানুষ, গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, মুরগি বিচরণ করত, যেসব জায়গা গুলো এক সময় নানা পশু-পক্ষীর আবাসস্থল ছিল, সেখানে এখন পানি থৈ থৈ করছে।
হয়ত গভীর পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিচরণ রয়েছে। যে ধান্য জমি মাঠ সবুজে ভরে থাকত, দখিনা বাতাসে ধাণের কচি পাতা হেলে পড়ত, সে ধান্য জমিতে পানির ঢেউর মেলা।
যে ধান্য জমিতে ধান পেকে ধানের সোনালী রঙে চোখ জুড়াত, মন ভরে যেত খুশিতে, সেখানে আজ স্বচ্ছ পানির উপর আলোর ঝিলিক ছাড়া আর কিছুই নেই।
শত শত গ্রাম, হাজার হাজার একর জমি, ছোট ছোট টিলা সবই পানির নিচে। ভারত থেকে আসা লোকেরা, কোথায় তাদের গ্রাম, কোথায় তাদের ধান্য জমি, কিছুই নির্ণয় করতে পারছে না।
যারা সুখের আশায় ভারতে চলে যায়নি, নিজ দেশে রয়েছে, তারা কোথায় গেল, হদিস পাচ্ছে না। তবুও আত্মীয়-স্বজনদের অনুসন্ধান করতে লাগল। পেয়েছেও কয়েকজন। তারা ভারতে গিয়ে কি অবস্থায় অছে, সবকিছু জানাল।
আর নিজ দেশে আত্মীয়-স্বজনরা কেমন আছে, কোথায় পালিয়ে গেছে-তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা সবকিছুই বলল। ভারত থেকে আসা মানুষের কথা শুনেছে নির্মল কান্তির বাবা।
নির্মল কান্তিকে বলল, নির্মল, তোর দাদু বড়ই ভুল করেছে, তার পিসি বাবুর কথা মেনে। যদি আমরা ভারতে যেতাম, তাহলে শান্তিতে থাকতে পারতাম।
কপালে দুঃখ আছে, তাই এই দেশে রয়েছি। কাপ্তাই বাঁধের পানি যা কেড়ে নেয়ার নিয়ে গেছে। শুনেছি, কি কোন এক সেটলার নামক এক উদ্ভাস্তু গোষ্ঠী নাকি অবশিষ্ট জায়গা কেড়ে নিচ্ছে। এখানে যে আমরা আছি, এখানেও আমরা থাকতে পারব না। সেটলাররা এখানেও আসবে।
যদি তারা আসে, আমাদের কি হবে, কে জানে? ভাগ্যে কী লিখন আছে, ভগবান জানে। নাকি এখান থেকেও পালিয়ে যেতে হয়। নাকি এখানেও জায়গা-জমির জন্য নিরীহ মানুষের প্রাণ বলি দিতে হয়। এভাবে কয়েকটা বছর অতীত হল। এক সময় নির্মল কান্তির বাবা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেল।
আশেপাশে হাসপাতাল ছিল না। বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। বনের লতা-পাতা আর গাছেল শাল খেয়ে কতদিন আর বেঁচে থাকতে পারে এক মুমূর্ষু রোগী।
নির্মল কান্তির বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়-দায়িত্ব তাঁর কাঁধে পড়ল। বিধবা এক মা, তিন ভাই; চার বোন নিয়ে তার সংসার। প্রতি বছর জুম চাষ করে ধান যা পায়, তা দিয়ে সংসার চলে।
যে বছর জুম চাষ বেশি হবে, ফলন ভালো হবে, সে বছর বেশ ভালোই যাই বছরটি। জুম চাষ ঠিকমতো করতে না পারলে, ফলন ভালো না হলে অভাব-অনটনে, টানা-হেঁছড়া করে বছরটি কেটে যায়। নির্মল কান্তি পরে বিয়ে করল পাশে জুমচাষীর এক মেয়ে মনোরমাকে।
মনোরমা খুব সুন্দরী, লক্ষী, আদর্শবান এবং নিরলস একটি মেয়ে। নতুন বৌ। নতুন যা কিছু পাওয়া যায় তা নিয়ে অনেক কিছু আশা থাকে, স্বপ্ন থাকে। নতুন বৌ হলে ওরও বেশি বেশি আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, কল্পনা থাকে।
একে একে তিন ভাই, চারবোনকে বিয়ে দিল। ছোট ভাইরা বিয়ে করে নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল। নির্মল কান্তির এক ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে সুন্দর সুখী সংসার গড়েছে।
নির্মল কান্তির মা অবশ্যই ছোট ছেলের বাসায় স্থায়ীভাবে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু নির্মল কান্তি ও তাঁর স্ত্রী কিছুতেই রাজি হল না।
স্বামী-স্ত্রীর সাফ কথা, মার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে। কিন্তু পাঁচ-দশ দিন থাকতে পারবে, আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না। তবে স্থায়ীভাবে কোন বাসায় থাকতে পারবে না। এই বাসায় থাকবে। নির্মল কান্তির এক পরিবারে যেমন চার পরিবার হয়েছে, সেরকম গঙ্গারাম এলাকায় ও অনেক পরিবার বসতি করেছে।
বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন নিয়ে বসতি হয়ে গঙ্গারাম বড় একটি গ্রামে রুপ নিল। এরা মূলত এসেছে বিভিন্ন গ্রামে সেটলার কর্তৃক বিতারিত হয়ে নিরাপদে থাকার আশায়। বাড়ি-ঘর বেশি হওয়াতে গঙ্গারাম নামটি খন্ড খন্ড হয়ে বিভিন্ন গ্রামের নাম হয়েছে। বাঘাইহাটে জমজমাট, পূর্ণাঙ্গ বাজার হয়েছে।
পাকা রাস্তা, আর্মি ক্যাম্প, পুলিশ ফাঁড়ি, ফরেস্ট অফিস হয়েছে। ব্যবসায়িকভাবে বেশ কয়েকজন বাঙালি বাড়ি-ঘর করে বসতি করেছে বাঘাইহাট বাজারে। জুমের উৎপাদিত পণ্য সবকিছু বিক্রয় হয় বাঘাইহাট বাজারে। নির্মল কান্তির পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে।
শিক্ষার ব্যাপারে জেনে দুই সন্তানকে শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াস জেগে ওঠে। অনেক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নির্মল কান্তি তবুও মনে করে, এখানে কিছু হবে না। কারণ আশেপাশে কোন সেটলার নেই।
কিন্তু নির্মল কান্তির বিশ্বাস তেম ফলপ্রসূ হলো না। বাজারে গেলে শুনতে পায়, দীঘিনালা হতে বাঘাইহাট পর্যন্ত পাকা রাস্তা হয়েছে। এবার বাঘাইহাট থেকে সাজেক পর্যন্ত পাকা রাস্তা হবে।
নির্মল কান্তি এ কথা শুনে মনে মনে ভাবে সরকারের অসম্ভব কিছুই নেই। সে মনে করেছে, পাকা রাস্তা হলে আমাদের সুযোগ-সুবিধা হবে। পাকা রাস্তা যে কাল হয়ে দাঁড়াবে, তার ধারণা ছিল না।
এ কথা শুনার দুই তিন বছর পর রাস্তায় কাজ শুরু হলো। গঙ্গারামে আর্মি ক্যাম্প হলো। বড় বড় গাড়ি নিয়ে রাস্তায় কাজ করতে লাগল আর্মিরা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আশা লোকজন অবাক হচ্ছে এত বড় রাস্তা দেখে।
এত বড় রাস্তা পেয়ে অনেকের খুশিতে মন জুরে যাচ্ছে। দম ফেলে মনে মনে চিন্তা করে আনন্দ পায়, এবার বুঝি কষ্ট থেকে মুক্তি পাব। কত আর পারা যায় মাথায় করে ভারি জিনিস বাজারে নিতে। গাড়ি আসবে।
মাথার বোঝা এবার পায়ের তলায় থাকবে। ছোট শিশুরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বড় রাস্তা পেয়ে মনের আনন্দে ছুটাছুটি করে। কাদামাটি নিয়ে খেলা করে।
খেলা খেলতে অনেক সময় শিশুদের মুখের সুন্দর, মিষ্টি, নিষ্পাপ হাসি ম্লান হয়ে থেমে যায়। ভাবে কাদা মাটিতে চাপা পড়ে যাবো না তো। খেলার ফাঁকে তাদের ভেতর আতংক এস পড়ে। পাকা রাস্তার কাজ যখন পুরোদমে চলছে, তখন আরেকটি কথা শুনা যাচ্ছে।
সরকার নাকি একসাথে সেটলারকে এখানে বসতি করে দেবে। সেটলারদের কর্তৃক বিতারিত হয়ে একটু শান্তিতে নিরাপদে থাকার আশায় এখানে আসা।
বাঘাইহাট বাজারের আশেপাশে অনেক অপরিচিত বাঙালি বাড়ি-ঘর বানিয়েছে। রাস্তার কাজ শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু সেটলার এস ছোট ছোট বাসা বানাতে লাগল।
এ বাসাগুলিকে বাড়ি বলা যাবে না। কারণ একটি বাড়িতে যা থাকার প্রয়োজন, এ বাসাগুলিতে তা নেই। সেটলাররা বাসা বানিয়েছে নির্মল কান্তির কলাবাগানে। শুধু নির্মল কান্তির বাগানে নয়, কয়েকজনের কলাবাগানে বসতি স্থাপন করতে লাগল কোনো ধরণের অনুমতি ছাড়াই।
বাঁধা দিতে গেলে, সেটলার এসে চাকমাদের সাথে ঝগড়া করতে লাগল। চাকমাদের উচ্ছেদ করার জন্য বনের হিংস্র হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। তাদেরকে সহায়তা করতে লাগল বাঘাইহাট, গঙ্গারাম দুই ক্যাম্পে থাকা সেনাবাহিনীরাও।
আতংক আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে লাগল চাকমারা। তারা সব সময় চিন্তায় থাকত, সেটলাররা কখন এসে না জানি হামলা করে। কখন না জানি বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয় জঙ্গলে।
সেটলাররা থাকত সুযোগ-সন্ধানী, সুঁই পরিমাণ সুযোগ পেলেই, সুযোগ বুঝে কোপ মারার জন্য। মাঝে মধ্যে চাকমাদের কলাবাগান অথবা বাড়ি থেকে জিনিসপাটি চুরি করত।
এসব ঘটনা ঘটানো হতো বড় ধরণের হামলার পরিকল্পনার মাধ্যমে। তাদের পরিকল্পনা মাফিক গঙ্গারামে হামলা হলো। সেই হামলার ঘটনায় একজন নিরীহ চাকমা মারা গেল।
বহু বাড়ি-ঘর সেটলারদের হাতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। জীবন বাঁচানোর তাগিদে চাকমারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল গভীর জঙ্গলে।
সকলের সাথে নির্মল কান্তি ও তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেল। অনেকদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, মশা, পোকা-মাকড়ের কামড় খেয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার পর আবার গ্রামে ফিরে এল আর্মিদের আশ্বাসে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিল আর্মিরা। নির্মল কান্তি আবার নতুন করে সংসার সাজাতে লাগল। দূর থেকে গাছ, বাঁশ, শন সংগ্রহ করে সুন্দর একটি বাড়ি বানাল।
নতুন বাড়ি, নতুন স্বপ্ন দেখতে লাগল। বাগান-বাগিচা করতে লাগল। গ্রামবাসীরা যার যার সুবিধা মতো বাড়ি-ঘর বানিয়ে তারাও কৃষিকাজে মনযোগ দিল। তখন কিন্তু সেটলাররা বেদখল করা যায়গা থেকে সরে যায়নি।
বরং আরও সেটলার আসতে লাগল। এবস্থা দেখে চাকমারা ভাবল সেটলার আসলেও কিছু করার নেই। যা আছে তা নিয়েই থাকতে হবে। ছেলে মেয়েরা আবার স্কুলে যাচ্ছে। চাষীরা কাজ করছে।
এভাবে দুই বছর পার হওয়ার পর আবার শুরু হলো সেটলারদের সাজানো চক্রান্ত, গণ্ডগোল। কখনও বাঘাইহাট থেকে মাচালং পর্যন্ত গাড়ি বন্ধ, কখনও বাঘাইহাট বাজার বন্ধ।
মাঝে মাঝে চাকমাদের উপর সেটলাররা হামলা করে। এ অবস্থায় পথে-ঘাটে দেখা হলে চাকমারা বলাবলি করে, সেটলাররা নাকি আবার হামলা করার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি নিচ্ছে। কখন হঠাৎ করে হামলা করে বলা যাচ্ছে না।
একে অপরকে সতর্ক দিচ্ছে সজাগ থাকতে। সেটলারদের হামলার ভয়ে মাতা-পিতারা তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। আতংকের দিন অতিবাহিত হতে না হতেই গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে গঙ্গারামে এস সেটলাররা চাকমাদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দিল।
বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ২০ ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনীসহ সেটলাররা দল বেঁধে সুপরিকল্পিতভাবে চাকমাদের গ্রামে হামলা করতে লাগল। সেনাবাহিনীরা ব্রাশ ফায়ার করতে লাগল। পুড়ে গেল পাঁচ শতাধিক বাড়ি-ঘর। দুটি বৌদ্ধ বিহার, একটি গির্জা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
সেনাবাহিনীর গুলিতে চারজন মারা গেল। আহত হলো অনেকে। অনেক নিরীহ চাকমাকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেল। হাজার হাজার চাকমা বাড়ি-ঘর হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ল।
প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল আবার গহীন জঙ্গলে। সকলের বাড়ির সাথে পুড়ে গেছে নির্মল কান্তির সুন্দর করে গড়া বাসাটিও। পুনরায়, চুরমার হয়ে গেল নির্মল কান্তির স্বপ্ন।
সহায় সম্বল হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পোড়ানো বাড়িতে ছাইয়ের ওপর বসে, গালে হাত দিয়ে নির্মল কান্তি অফসোস করে, ভারতে কেন গেলাম না।
কেন এদেশে থেকে গেলাম। নিজের জন্মভুমিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করা কি অপরাধ! এসব অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করার জন্য কি এ দেশে (নিজ জন্মভুমিতে) আছি?
লেখকঃ কে. ভি. দেবাশীষ চাকমা