গারো উপকথা: নীরে-সিনজে
820
গভীর অরণ্যে আবৃত আবেত রাংগে দেবতার বাস স্থানটি নানা ধরণের হিংস্র জন্তু জানোয়ারে পরিপূর্ণ ছিল।
সেখানকার গাছ পালা এত ঘন ছিল যে দিনে দুপুরেও সূর্যের আলো দেখা যেত না। রাত ভেবে বাদুড় সব সময়ে উড়ে বেড়াত, অন্ধকারে জোনাকীরা শুধু জ্বলত এবং নিভত।
ভয়ে সেই জঙ্গলে যাওয়ার কথা কেউ চিন্তা করতনা সকলের বারণ সত্বেও অকগিলমা ছাগিলমার স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে সংসার পাতল।
দিন গড়িয়ে যায় তাদের সংসারে নতুন অতিথির আগমনের সম্ভাবনা দেখা দিল। একদিন হঠাতে সেই নির্ভীক জোয়ান পুরুষটা মারা গেল।
স্বামীর মৃত্যুতে যুবতী স্ত্রী শোকে ভেঙ্গে পড়ল। দিন রাত সে বিলাপ করতে লাগল।
“ঘরের চাল ফুটো হলে কে ছাউনী দেবে, ঘরের খুটি নষ্ট হলে কে বদলে দেবে। ঘরের চারিপাশের বন জঙ্গল পরিস্কার করবার লোক আর রইলনা।
এই স্বামী-হীনার এ কে চাষ বাস করে দেবে, এখন পরের বাড়ীতে দামীবৃত্তি করে দিন কাটাতে হবে।
সে জন্মালে কিভাবে লালন পালন করব। আমার প্রিয় স্বামী বালমান অঞ্চলে চিকমাং দেশে চলে গেল।
যে গাছের সাথে গরু বাধা হয় তার ছায়ায় বিশ্রাম করে মিসাং মিশাল ছারাশে দুপুরের ভাত খেয়ে যেও।”
দিন কারো জন্য বসে থাকে না। সময় হলে সারা গ্রামের লোকেরা ঝুম ক্ষেত পোড়ালো। সে ও তার স্বামীর পরিস্কার করে যাওয়া ক্ষেতে আগুন দিল।
ধান, কাউন, কচু, আদা, হলুদ, সব কিছু লাগানো হলো। চারা গজালে দেখা গেল তার ক্ষেতের ফসল সবার চেয়ে ভাল হয়েছে।
এত দুঃখের মাঝেও সে কিছুটা সান্ত্বনা পেল। কিন্তু শীঘ্রই আর এক বিপদ দেখা দিল। প্রতি রাত্রে হরিণের পাল জঙ্গল থেকে নেমে এসে।
ধান ও অন্যান্য ফসল খেয়ে যেতে লাগল। এদিক থেকে তাড়িয়ে দিলে ওদিকে, ওদিক থেকে তাড়ালে এদিকের ফসল খেতে থাকে।
সারারাত না ঘুমিয়ে সে কেবল হরিণ তাড়াতে লাগল। আর কত সহ্য হয়? রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত ক্লিষ্ট গর্ভবতী বিধবা নারী অসহ্য হয়ে বললঃ
“বিধবা নারী অমি, আর পারিনা। কেউ যদি হরিণের পাল মেরে শেষ করে দিত আমার বাচ্চা জন্মালে তাকে দিয়ে দিতাম।
মেয়ে হলে সে তাকে বিয়ে করত, ছেলে হলে দস্যু বানাত।”
প্রতিরাতে সে এভাবে গর্ভস্থ সন্তানকে বিলিয়ে দেবার কথা বলত। এই কথা শুনে একদিন বাঘ তাকে বলল : “আমি যদি আপনার ক্ষেতের হরিণের পাল শেষ করে দিই আপনি কি আপনার মেয়েকে আমার জন্য দেবেন ?”
“দেব বই কি, বনের পশু পাখী সে যে-ই হোক না কেন, আমি আমার গর্ভস্থ সন্তানকে তার জন্য দেব।”
“আচ্ছা, তাহলে আমি সে কাজ করব।”
বাঘ প্রতি রাত্রে সেই ক্ষেত পাহারা দিয়ে হরিণের পাল শেষ করে দিল। আর কোন দিনই তাদের দেখা গেলনা।
কিছুদিন পর বিধবা নারী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল। মেয়েটির নাম রাখা হল “নীরে-সিনজে”।
বুকের দুধ খাওয়ার সময়ে স্বাস্থ্যবতী শিশুটির দিকে তাকিয়ে মায়ের বুক হু হু করে কেঁদে ওঠে।
আহা, এমন ফুলের মত শিশুকে বাঘের হতে দিতে হবে। দিন যায়, শিশুটি ক্রমে বড় হয়ে উঠে। একদিন বাঘ এসে বলল:
“আপনার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন। আমি মেয়েটিকে নিতে এসেছি , মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাঁদতে সে বলল: “আমার কথা আমি নিশ্চয়ই রাখব। তুমি আমার মেয়েটিকে কোন দিন কষ্ট দিওনা।”
“মেয়েটির নাম কি?”
“নীরে-সিনজে।”
চোখ মুখে মেয়ে টির গালে অসংখ্য চুমু খেয়ে সে মেয়েটিকে বাঘের হাতে দিল। বাঘ অত্যন্ত খুশী হল।
নাম ভুলে যাবার ভয়ে সে “নীরে সিনজে” তে বলতে পথ চলতে লাগল। আপন মনে পথ চলার সময়ে একটা বুনা ছাগলের সাথে হঠাতে তার ধাক্কা লাগল।
দুজনেই ভীষণ ভাবে চমকে দু-দিকে লাফ দিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বাঘ মেয়েটির নাম ভুলে গেল।
সে আবার নীরে-সিনজের মায়ের কাছে এসে নাম জিজ্ঞাসা করল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল:
“ওর নাম নীরে-সিনজে। ওকে দেখলে আমার বুক ফেটে যায়, তুমি আর কোনদিন ওকে নিয়ে আমার কাছে এসোনা”।
ভুলে যাবার ভয়ে বাঘ মনে মনে নামটি আওড়াতে আওড়াতে পথ চলতে লাগল।
এদিকে রাস্তার ধারে একটা হরিণ মনের সুখে ছিরোরে গাফের ফল ছিড়ে খাচ্ছিল, হঠাতে বাঘ দেখে সে এক লাফ দিয়ে পালালো। বাঘটিও চমকে উঠে আবার নীরে-সিনজের নাম ভুলে যায়।
বাঘ পুনরায় মেয়েটির মায়ের কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইল। মনের দুঃখ চেপে রেখে ভয়ে ভয়ে সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বাঘটিকে নাম বলে দিল।
বাঘ এবার মনটাকে শক্ত করে নাম মুখস্থ করতে করতে নিজ বাড়ী পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছালো।
বহু যত্নে সে মেয়েটিকে লালন পালন করতে লাগল। প্রতিদিন নানা উপাদেয় খাদ্য গ্রহণ করে নীরে-সিনজে দিনে দিনে চন্দ্র কলার মত বড় হতে লাগল।
তার দেহে যেন রূপ আর ধরেনা। বাঘ তাকে নানা অলঙ্কারে সাজালো, পরনের জন্য মুগার তৈরী কাপড় এনে দিল।
ধারে কাছে কোন প্রতিবেশী না থাকায় বাঘ ছাড়া আর কারো সাথে মেয়েটির দেখা সাক্ষাৎ হবার উপায় ছিলনা। সেই বুনোফুল বনে ফুটে বনেই সুবাস ছড়াতে লাগল।
কৌতুহলী হয়ে এ দিন নীরে-সিনজে তার নিজের বিষয়ে বাঘটিকে প্রশ্ন করল। বাঘ তার প্রেমে এত মুগ্ধ ছিল যে, কোন কিছু গোপন না করে তাকে সব কথা খুলে বলল।
নীরে সিনজের প্রাণ তার হতভাগ্য মায়ের কেঁদে উঠল। মর্মান্তিক দুঃখে সে মনে মনে বলল:
“বাঘের হাত থেকে উদ্ধার পাবার উপায় এখন আর নাই। কি জানি ভবিষ্যতে হয়তো সুযোগ আসতে পারে।”
এই ভাবে দিন যায়, মাস আসে, বছর ঘুরে। একদিন বাঘ নীরে-সিনজেকে বলল:
“তুমি ফালওয়াং বাজার এবড়োতে যাবে?”
“তুমি নিয়ে গেলে যাব।”
“ঠিক আছে, প্রস্তুত হও।”
বাঘের নির্দেশ মত নীরে-সিনজে হাতে সোনার বালা, গলায় হার, কানে ঝুমকো, মাথায় টায়রা, কোমরে বিছা, পায়ে পায়েল দিয়ে, মুগার তৈরী সোনালী পোষাকে সজ্জিত হয়ে একটি সোনার প্রতিমার মত বাজারে রওনা হল।
এই বাজারটিকে বিবাহের পাত্রী ও শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচনের কেন্দ্র বলা যেতে পারে। যুবতী কন্যারা সেজে গুঁজে এই বাজারে বেড়াতে আসত, স্বভাবতই যুককেরা মধু লোভী।
মৌমাছির মত তাদের চারিপাশে গুণ, গুণ, করে বেড়াত ও নিজেদের জীবন সঙ্গিনী বেছে নেবার প্রয়াস পেত।
নীরে-সিনজের রূপ নিয়ে বাঘের একটা গর্ব ছিল, লোক সমক্ষে সেটা জাহির করবার জন্যই সে আজ তাকে নিয়ে বাজারে উপস্থিত হল। বাজারে পৌঁছা মাত্র সকলে তাদের ঘিরে ধরল।
“এই রূপসী কন্যা কার? কোন গ্রামের বিয়ে হয়েছে কি?” ইত্যাদি নানা প্রশ্ন চারিদিক থেকে বযিত হতে লাগল।
কেউ কেউ জবাব দিল “এ নাকি বাঘের বউ।”
“আহা বেচারা! বাঘের বউ? এত রূপ সব বৃথা গেল।” বলবান ও সাহসী কোন কোন যুবক মনে মনে মেয়েটিকে নিয়ে পালাবার পরিকল্পনা করতে লাগল। কিন্তু এদিকে যে আবার বাঘের ভয়?
বাঘ আর নীরে-সিনজে যে দিকে যায় যুবকেরা সেদিকেই ভিড় জমায়। এক সময়ে বাঘ নীর-সিনজেকে বলল:
“তুমি এখানে বসে বিশ্রাম কর, আমি আরও কিছুক্ষণ বাজার ঘুরে দেখি।”
“তাড়ি ফিরে এসো।”
বাঘ চলে গেল। মাৎছি অঞ্চলের নাফাক বলরাম গ্রামের রাক্ক্য মারাক অত্যন্ত সাহসী এক যুবক। এমন সুবর্ণ সুযোগ সে হেলায় হারাতে রাজী হল না।
নীরে-সিনজেকে নিজের ঘোড়ায় তুলে সে চোখের নিমিষে উধাও হয়ে গেল।
বাঘ এসে দেখে কেউ নাই। জ্ঞান শূন্য হয়ে বোকার মত সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, আর লোকজনদের বলাবলি করতে শুনল :
“দেখলি, চোখের পলকে কেমন করে পালিয়ে গেল।”
“কে নিয়ে পালালো রে? মাৎছি অঞ্চলের নাফাক বলরাম গ্রামের রাক্ক্য মারাক।
এমন সুন্দরী বাঘের ঘরে মানায়?” “সাবাস বেটা!” সব শুনে দাঁতে দাত ঘষে বাঘ বলল: “তুমি কেমন জোয়ান তা দেখে নেব।”
গভীর দুঃখ ও লজ্জা নিয়ে সে বাড়ীতে ফিরে আসে। কিন্তু নীরে-সিনজে বিহীন গৃহ তার কাছে অসহ্য মনে হলো খাওয়া-দাওয়া ভুলে সে পাগলের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল।
অবশেষে সে রাক্ক্য মারাকের সাথে যুদ্ধ কতে মনস্থির করল। সাতদিন সাতরাত ভীষণ যুদ্ধ হল।
একে নীরে-সিনজেকে হারিয়ে সে মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল তার উপরে নিয়মিত খাওয়া ও বিশ্রামের অভাবে দৈহিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
যুদ্ধে তার পরাজয় হল। নীরে-সিনজেকে পাবার আশা চিরদিনের মত জলাঞ্জলী দিয়ে সন্ধ্যায় অন্ধকারে সেই রণক্লান্ত, আহত, পরাজিত বাঘ ধীরে ধীরে নিজ গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
কথকঃ ধরণ সিং সাংমা, তুরা, গারো হিলস্।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।