গারো উপকথা: সূৰ্য্য গ্রহণ
1001
আলো ছায়ায় ঘেরা পাতালপুরীর মায়াময় কোন এক স্থানে আনিং জিনজিনি ছিনিং জিনজিনার বাস। পাহাড়ী ঝর্ণার ধারে অপূর্ব বাগান ঘেরা বাড়ীখানা দেখে সকলের চোখ জুড়িয়ে যায়।
কালো দিঘীর লাল-সোনালী মাছগুলোকে খাবার দিতে দিতে আনিং জিনজিনি আনমনা হয়ে যায়-তার গর্ভে যে আসছে সে কেমন হবে? ছেলে অথবা মেয়ে সে যা-ই হোক, সুন্দর হবে তো?
সাত বৎসর গর্ভে ধারণ করে, সাত দিন গর্ভ যাতনার পর মুনীর জন্ম হল।
দেখা গেল পাকস্থলী বলতে কিছুই নাই – কিছুদিন লালন পালনের পরও জন্মের সময়ে যেমন সেই অবস্থাতেই সে রইল – বৃদ্ধি কিছুই হলনা।
রাগে, দুঃখে ও লজ্জায় আনিং জিনজিনা ভাবতে লাগল কি করা যায়। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সে মন স্থির করে ফেলে।
তাই আনাং ও মামা দিলথাংকে ডেকে ডেকে সে বলল – “এমন সৃষ্টিছাড়া সন্তান আমি চাই না, একে কোথাও কেলে দিয়ে এসো।”
শলা পরামর্শ করে মামা ভাগ্নে দুই জনে মিলে আগুদারে রংফাদারেতে বিরাট এক পাথরের উপরে মুনীকে রেখে এলো।
এদিকে খরেংফা মিকখিং বান্দা খফিনিফা জাথেং ছূআ খোড়ের সন্ধানে ঐ পথ দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল। মুনীকে দেখে সে ছোঁ মেরে একটা মরা গাছের ডালে এনে তুলল।
কিন্তু আজব কাণ্ড। সেখানে সেই বসা অবস্থাতেই ঘুমে তার চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে এলে এবং ক্রমে ক্রমে সে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
তার হাত থেকে ফসকে গিয়ে মুনী দ্রি আ‘খুছং ছি ব্রাস এর পাশাপাশি সাতটি বাশ ঝাড়ের তলায় পড়ে গেল। সেখানে সে পত্র বহুল সতেজ একটি গাছ হয়ে গজিয়ে উঠল।
সেই সময়ে নিবা আজেফা জনজা গিলজেফা নামে বিরাট এক সম্পদশালী লোক বাস করত। তার টাকা পয়সা, সোনা-দানা, হীরা-মানিক কোন কিছুরই অভাব ছিল না।
একদিন সে আ’খং গিলে বাজারে রওনা হল। সেই সময়ে এক একটা বাজার লোকালয় থেকে বহু দুরে অবস্থিত ছিল।
যেতে আসতে এক সপ্তাহ লেগে যেত। তাই লোকেরা প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সঙ্গে করে পথে রাত্রি যাপন করত।
পথে নিবা আজেফার সাথে সালপ্রা (সুৰ্য দেবতা)র দেখা হল। সালগ্রা তার বাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছিল।
আখংগিত্তেল বাজারে যাওয়া জরুরী প্রয়োজন হওয়াতে নিবা আজেফা সালাগ্রার সাথে নিজ বাড়ীতে ফিরে যেতে পারল না। ক্ষমা প্রার্থনা করে সে বলল।
“আপনি আমার সম্মানিত অতিথি, কিন্তু আমি আপনার সাথে ফিরে যেতে পারছি না। আ’খং গিত্তেল বাজারে যাওয়া আমার জরুরী প্রয়োজন।
কোন অসুবিধা নাই। বাড়ীতে আপনার নামছিক (বৌ, ভাগ্নী , সম্পর্ক ) আছে যত্নের ত্রুটি হবে না।”
“ঠিক আছে, তুমি বাজারের কাজ সেরে এসো।”
এরপর দু’জন দুদিকে চলে গেল।
সালপ্রা নিবা আজেফার ঘরে পৌঁছালে স্বামীর অনুপস্থিতিতে রেছি দিলজে সম্মানিত অতিথির উপযুক্ত আদর আপ্যায়নের নির্দেশ দান করল।
খোরাড় থেকে হৃষ্ট-পুষ্ট শূকর ও মোরগ ধরে সুস্বাদু খাবার তৈরী হল। ভুরি ভোজনের পর বিশিষ্ট অতিথির জন্য তৈরী “ছূ বিৎছি” (উত্তম মদ) পরিবেশন করলে সালগ্রা গভীর রাত পর্যন্ত পান করে চলল।
রেছি দিলজে ছিল অপরূপা এক নারী-পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন তার দেহে ধরে রাখা হয়েছে। তার চলাফেরায় অপূর্ব নৃত্যের ছন্দ, ওঠে মান্দাল ফুলের মাতাল করা হাসি, কথা যেন সুরেলা পাখীর গান।
সালগ্রা মদ খায় আর রেছি দিলজেকে দেখে-রেছি দিলজেকে দেখে আর মদ খায়। যতই দেখে তার প্রতি গভীর আকর্ষণ সে ততই অনুভব করে।
তার অসহিষ্ণ দেহ মন বলে উঠে “এই নারীকে আমার চাই-ই।” শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত করতে না পেরে সালগ্রা রেছি দিলজেকে জড়িয়ে ধরল।
সালগ্রার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করার বৃথা চেষ্টা করে সে বলল;
“আমি একজনের স্ত্রী আমাকে ছেড়ে দিন।”
আলিঙ্গন দৃঢ়তর করে সালগ্রা উত্তর দিলঃ
“তুমি নিষ্ঠুর হয়োনা রেছি দিলজে, আমি তোমার প্রেমাকাঙ্খী, আমার জীবনকে তুমি সার্থক কর। আমাকে বিমুখ করোনা লক্ষ্মীটি, এসো।
রেছি দিলজের কোন অনুরোধ উপরোধই সালগ্রা শুনতে রাজী হলো না।
আন্থিছারা আ‘খংগিত্তোলে যাওয়ার পথে নিবা আজেফা দ্ৰি আ‘খুছৎ ছি ব্রাস এর সাতটি বাঁশ ঝাড়ের তলায় গজিয়ে ওঠা মুনীর উপরে তার মি‘ল্লাম ও ফিটাকে তার গায়ে ঠেসান দিয়ে দুপুরের ভাত খেতে বসল।
সেই অবস্থাতেই সে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। সে বিশিকরম বিদতারে তাকে সেই অবস্থায় দেখতে পেয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললঃ “নিবা আজেফা জানজা গিলজেকা, তুমি এখানে কি করছ ?
তোমার মি‘ল্লাম ও স্ফি যে গাছটার উপরে রেখেছ সেটা তোমার স্ফির গোড়া ও কাপড়ের কোণায় বেঁধে নিয়ে যাও।” সে বিশিকরম বিদতারের কথামত কাজ করল।
বাজারে যাওয়ার পথে প্রথমে একটা সজারুর নাগাল পেল সে। তাকে দেখামাত্র সজারু সেই জায়গাতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
এরপর গোসাপ, -খেকশিয়াল, খরগোস, বুনাছাগল যার সাথেই দেখা হল সবাই পথ ভুলে সেই জায়গাতেই আচ্ছন্নর মত পড়ে রইল।
বাজার পৌছে যে দোকানে সে যায় তাকে দখামাত্র দোকানীর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে, জিনিষ কেনার জন্য দরদাম করার কোন প্রয়োজন পড়েনা, সে যে দাম বলে দোকানী সেই দামেই তাকে জিনিষ দিয়ে দেয়।
তার নিজের জিনিষ পত্রও সে নিজ ইচ্ছামত মূল্যে বিক্রি করে বাড়ীতে ফিরে এলো।
ব্যবসাতে তার প্রচুর লাভ হয়েছে, মন আনন্দে পরিপূর্ণ। রেছি দিলজের মনোরঞ্জনের জন্য সে অনেক জিনিষ কিনে নিল । স্ত্রীর কথা মনে হতেই তার চলার গতি আরও বেড়ে গেল।
বাড়ী পৌছালে রেছি দিলজের প্রতি সালগ্রার ব্যবহারের কথা বলতে কেউ সাহস পেলনা। বিশ্রাম গ্রহণ করে সুস্থির হবার পর দ’সুরায়ে আস্তে আস্তে সব কথা বলল।
শুনে চড়াৎ করে তার রক্ত মাথায় উঠে গেল-“বেইমান !” সঙ্গে সঙ্গে মি‘ল্লাম ও স্ফি নিয়ে সালগ্রাকে হত্যা করার জন্য সে সালস্বং ফাৎরা গুহার ধারে লুকিয়ে রইল।
প্রিয়ার সাথে মিলনের সময় উপস্থিত। অমিততেজি সালগ্রা আসছে – তার পদভারে মাটি কাঁপতে লাগল, পাহাড় টলে যাওয়াতে প্রকাণ্ড পাথরগুলো গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল।
পরাক্রমশালী সালগ্রার তেজ সহ করা নিাঁ আজেফার পক্ষে সম্ভব হলনা, সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তাকে এভাবে পালাতে দেখে খাৎছি বিয়ারী রাংসী থকিনি জিজ্ঞাসা করলঃ
“এত জোরে দৌড়াচ্ছে কেন?”
“সালার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছি।”
“আরে দড়াও, শোন। সালজং ফাৎরা গুহার দরজায় রাস্তার ঠিক মাঝখানে গর্ত করে জংপ্রেম ও জংবাংশির সাথে তোমার মুনীকে মাটিতে পুঁতে রেখে দিও তাহলেই সালগ্রা সেটা পার হয়ে আসতে পারবে না।”
নিবা আজেফা খাৎজি বিয়ারীর পরামর্শ মত কাজ করল। পরদিন সালগ্রা অভিসারে বার হতেই এক পা-ও অগ্রসর হতে পারনা। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল।
রেছি দিলতে বিরক্ত হয়ে তার স্বামীকে বললঃ অন্ধকারে যে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। সালগ্রা না থাকলে পৃথিবীর কোন বস্তু বাচবেনা। তুমি সালগ্রার সাথে একটা মীমাংসা কর হয় দ্বন্দ্ব যুদ্ধ নতুবা অর্থ দণ্ড দাবী কর।”
“যে আমাকে মানুষ বলে মনে করে না সেই সালগ্রাকে গিয়ে অনুরোধ করব। অন্ধকার? তাতে কি? মনের চোখ থাকলে সবই দেখা যায়। সালগ্রার কোন প্রয়োজন নাই।
এদিকে সূর্যের অভাবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় এমন অবস্থা। সালগ্রার অনুচরেরা পরামর্শ সভা ডাকল, স্থির হলঃ এমন অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না, সালাগ্রাকে উদ্ধার করতেই হবে। ওয়াসিফা ওয়াকসংফার উপরে সেই ভার দেওয়া হল।
ওয়াসিফা ওয়াকসংফা প্রথমে সালজং ফাৎরা গুহার দরজা পৰ্যবেক্ষণ করে এল। বহু অনুসন্ধানের পর সে নিবা আজেফার কীর্তি অবগত হল।
এরপর ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সে দরজার এক কিনার দিয়ে গিয়ে পুতে রাখা মুনীকে এক টানে তুলে ফেলে দিল, সালগ্রার উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হল।
পৃথিবী আবার সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
নিবা আজেফা বুঝতে পারল এবার আর তার রক্ষা নাই। বাড়ী-ঘর, ধনসম্পদ কোন কিছুর মায়া না করে সে রেছি দিলজের হাত ধরে সালাগ্রার কবল থেকে মুক্তি পাবার জন্য এ পাহাড় জঙ্গল পার হয়ে সমতল ভূমির দিকে দৌড়ে পালাতে লাগল।
কথকঃ দিংবান মারাক রাকসাম, গ্রাম: রংবিংগিরি গারো হিলস্
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।