পার্বত্য চট্টগ্রাম টু নেফা, ভারত : বড়পরং যাত্রা
1554
শৈশব আর কৈশাের : কাজলং পারের স্মৃতি
আমার নাম বুদ্ধধন চাকমা, পিতা কামিনী কান্ত চাকমা, মাতা নন্দমুখি চাকমা, ৯ নম্বর মারিশ্যা চর মৌজা, রাঙামাটি, কাপ্তাই বাঁধের পর মধ্য বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি।
আমরা হাম্বে গােজার থিইয়ে গােষ্ঠীর বংশধর। কাজলং নদীর পার ঘেঁষেই ছিল আমাদের বাড়ি, ‘গুদাম ঘর’ মানে মাটি দিয়ে বানানাে। আমাদের আর কাকাদের পরিবার নিয়ে বিশাল যৌথ সংসার। আসলে তখনকার সময়ে সবারই যৌথ সংসার ছিল। আমার বাবা দুই বিবাহ করেছিলেন। আমরা ছােট মায়ের সস্তান। আমার বাবার প্রথম স্ত্রী মানে বড়মা অসুখে ভুগে মারা গেলে বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। আমার বাবার প্রথম ঘরের ৪ (চার) সন্তান। তারমধ্যে অনিল বরণ চাকমা বড়।
তিনি চাকমাদের সমাজে একজন কবি ছিলেন। কাজলং নদীর পারের সন্তান হওয়াতে প্রতিবছর কাজলং নদীর নানা রূপ আমরা দেখতে পেতাম। বর্ষার সময় কাজলং নদীর চেহারা ভয়ংকর হয়ে যেতাে, শান্ত নদীর জল উত্তাল হয়ে দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে যেতাে, নদীর পাড় থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে দেখতাম বিশাল বিশাল গাছ, বাঁশ আর মাঝে মাঝে পশু পানিতে ভেসে যাচ্ছে।
আর বন্যার সময় কাজলং-এর চেহারা বদলে যেতাে! যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। আর শীতকালে! শান্ত একেবারে। আমি জানি না এখনও কাজলং নদীতে এইরকম বন্যা হয় কিনা!! এই দূর প্রবাসে বসে ভাবি এখনাে কি বন্যার সময় আগের মতাে পানি হয়! আমার এখনাে বর্ষার কাজলং নদীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কোনােদিন আর দেখা হবে না আমার সেই কাজলং নদী (দীর্ঘশ্বাস!)।
বাঁধ : মরণ ফাঁদ
আসলে ১৯৫৩ খ্রি. কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হবার কথা ছিল অন্য একটা জায়গায় রঙরাঙহুল মােন, চিলাক ঢাক’-এর গােড়ায়। এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বিদেশ থেকেও ইনঞ্জিনিয়ার এসেছিল। পরে কোনাে এক কারণে সেটা বন্ধ করে কর্ণফুলির কাপ্তে/কাপ্তাই নামক জায়গায় এই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
যে নতুন জায়গায় বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় সেটার আরেক নাম হচ্ছে রাম-লক্ষ্মণ-সীতাদের ঘাট। রেইভং বা রেইখ্যং বাজারের একটু নিচে এই জায়গাটি শিকার করার স্থান হিসাবে বিখ্যাত ছিল। প্রচলিত ছিল মগরা এই জায়গায় শিকার করতে গেলে শিকার ধরা পড়তাে না। রাম-লক্ষ্মণরা নাকি শিকারদের তাড়িয়ে দিতাে। সেখানেই বাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ শুরু হলাে। যেটাই বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধ নামে পরিচিত।
কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেয়ার পর বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, সে তলিয়ে যাওয়ার জায়গার পরিমাণ কতটুকু হতে পারে সে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে জরিপ করা হয়েছিল। আর সেই জরিপের ভিত্তিতে বাঁধের পানিতে ডুবে যাওয়া জমির মালিকদের ও এলাকার মুরব্বিদের ডেকে ক্ষতিপূরণ নেয়ার জন্য সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল সরকারের হিসাবের চেয়েও বেশি জায়গা বাঁধের পানিতে তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষের গ্রাম দেখতে দেখতে পানিতে তলিয়ে যায়। খুব কমসংখ্যক মানুষ প্রথমেই বিশ্বাস করেছিল যে এই বাঁধের পানিতে এতাে বিশাল এলাকা ডুবে যাবে। তারা এটা স্বপ্নেও ভাবেননি।
আমি এখনাে সন্দিহান বাঁধের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত সকল জায়গার মালিকরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল কিনা। আসলে তখন এইসব কাগজে হিসাব কেউ রাখার সময় পায়নি। বিশ্বাস-অবিশ্বাস দোলাচালের ভেতরেই বাঁধের পানি একেবারে নিজের দোর গােড়ায় হাজির হয়ে গেল! পানিতে বাড়ি ডুবে যাচ্ছে আর সকলেই নৌকায় উঠছে- এই দৃশ্য ছিল তখনকার সময়ে খুবই স্বাভাবিক। যদিও আমরা পানি আসার আগেই চলে এসেছিলাম। সম্ভবত আমাদের পরিবারই প্রথম যারা বাঘাইছড়িতে এসে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যখনই আমরা জানলাম যে কাপ্তাই এলাকায় একটা বাঁধ হবে তাতে আমাদের গ্রাম ডুবে যাবে এবং এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোনাে এক জায়গায় চলে যেতে হবে। এই কথা শোনার পর থেকেই আমাদের সুখশান্তি সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের সবাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল কোথায় যাবে, ভেবে। আজু পিজুদের* জন্মভূমি ড় যাওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এখন যতটা সহজে কথা বলছি তখন এতাে সহজ ছিল না।
ক্ষতিপূরণ এবং গাছ কাটিং
যদ্দুর মনে আছে, তখনকার সময়ে আমার আজু এবং বাবা আমাদের জায়গাজমির ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা হাতে পেয়েছিলেন। বাবা আজুকে নিয়ে তখনকার রাঙামাটি গিয়ে এই ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে এসেছিলেন। তখন বাবার নামে জমি কম ছিল, সবই ছিল আজুর নামে। আমাদের তাে সে সময় দুনকে দুন জমি ছিল।
তখন তাে জমি জিরাত হিসাব হতাে দুন’ দিয়ে। এখন ‘একর’ হিসাব। বধের পানিতে সব তলিয়ে যাবে, এই জায়গা ছাড়তে হবে- এলাকায় এই খবর পৌঁছানাের পর এলাকার লােকেরা মিটিং-এর পর মিটিং করতে শুরু করে দিয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন ছিল যে কে কোন দিকে যাবে, কোথায় বসতি গড়ে তুলবে? এরই ভেতর গাছ কাটিং শুরু হয়ে গেল। আমরা দেখলাম কিছু শ্রমিক এসে গ্রামের বড় বড় গাছ কাটা শুরু করে দিয়েছে।
কিন্তু এই গাছ কাটিং কেন? বাঁধের পানিতে তলিয়ে যাওয়া জায়গার ওপর দিয়ে যাতে নৌকা বা লঞ্চ চলাচলের ব্যাঘাত না ঘটে, তাই এই গাছ কাটিং। অবশ্য আমরা আমাদের বড় বড় গাছের জন্য ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। কত পেয়েছি জানি না। কিন্তু সকলে পেয়েছে কিনা আমি সেটা জানি না।
মধ্য বাঘাইছড়ি : নতুন আবাসভূমি
তাে বাঁধ দেওয়ার সময়ই আমরা চলে এলাম বাঘাইছড়িতে। নতুন জায়গায় আমাদের পরিবারের জন্য যে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হলাে সেটা আমাদের পরিবারের। জন্য ছিল অনেক কম।
তারপরও আজু বাবারা পুরনাে গ্রামবাসীর সঙ্গে নতুন জায়গায় নতুন গ্রাম পত্তন করলেন। আমাদের পাশাপাশি ছিল ধামেই গােজা ও হাম্বে গােজার বংশধরেরা। হাম্বে গােজার লােকজন এসেছে জীবতলী থেকে। এই বাঘাইছড়িকে তিন ভাগে ভাগ করে নাম দেয়া হলাে মধ্য বাঘাইছড়ি, নিচের বাঘাইছড়ি আর বড় বাঘাইছড়ি। আমরা মধ্য বাঘাইছড়ির বাসিন্দা হয়ে গেলাম। আসলে এলাকার লােকজন সবাই তো সবারই আত্মীয়।
তখনকার সময়ে বালু-হালে- আর ঝগড়াবিলের লােকদের মাঝে আত্মীয়তা থাকলেও তাদের মধ্যে সৎভাব ছিল কম। এসব এলাকায় ধামেই গােজার পিড়ি তাপ গোষ্ঠী, বাপ হাবা গোষ্ঠী লােকদের বসতি ছিল অনেক।
আমার মা পিড়ি ভাঙ্গা গোষ্ঠীর মেয়ে। আমাদের সমাজের প্রথাগত নিয়ম অনুসারে ঐ গােষ্ঠীর মেয়েরা সুগুরি গুলাে মানে মিষ্টি কুমড়াের বিচি মাটিতে পুততে পারতাে না । নিষেধ ছিল। এই মধ্য বাঘাইছড়ি থেকেই আমরা পরে বর-পরং-এ সবার সাথে ভারতে চলে আসি এবং পরবর্তীকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আন্ধার ছড়াতে বসতি গড়ে তুলি। এই গ্রামেও ধামেই গােজার তিন পরিবারের বসতি গছে। সেটা ১৯৬৫/৬ খ্রিস্টাব্দের কথা । সব কথা এখন আর মনেই নেই।
এভাবেই আমাদের মধ্য ৰাঘাইছড়িতে নতুন জীবন শুরু হলাে। সংসার একেবারে নতুন করে শুরু করতে হলো। সূর্যের আলাে যে এলাকায় পড়ে না, এমন জঙ্গল কেটে সাফ করে, হিংস্র পশুপক্ষী রােগ শােককে মােকাবিলা করে নতুন আশায় সংসার আবার শুরু করলাম আমরা। কোন উপয়ান্তর না দেখে সবকিছু আর আগের মতো হবে না মেনে নিয়েই শান্তভাবে আমরা আমাদের নতুন জীবন শুরু করলাম নতুন এলাকায়- মধ্য বাঘাইছড়িতে।
আনসার কোম্পানি নামে মুসলিম বাঙালির আগমন
আমাদের নতুন জায়গা বাঘাইছড়িতে বাঙালি বলতে তখন শুধু কয়েক পরিবারের সে ছিল। তাদেরকে আমরা ‘সাহা’ বলে থাকি। তাদের সাথে আমাদের কোনাে না ছিল না। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমাদের সেই কঠিন নতুন জীবনে নতুন উৎপাত শুরু হলো। নতুন এই উৎপাতের নাম আনসার কোম্পানি।
দেশের বিভিন্ন জয়গা থেকে মুসলমান বাঙালি শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত একটি কোম্পানি। যে কোম্পনি জঙ্গলে বড় বড় গাছ কাটে আর হাতি ধরার কাজ করে থাকে। তাদের সাথে থাকা বিশাল বিশাল মেশিন, যেগুলাে গাছ কাটতে ব্যবহৃত হতাে আর পশু মানে হাতি ও অন্যান্য জীবজন্তু ধরার কাজেও ব্যবহৃত হতাে।
অনেক সব জঙ্গলের ভেতরের নদীতে এই কোম্পানির শ্রমিকেরা বাধ দিতাে। আর দূরবর্তী জায়গায় আসতে যেতে সুবিধার জন্য এই আনসার কোম্পানি কাজলং নদীর পারে তাদের ক্যাম্প বসায়।
আর এই কোম্পানি আসার পরপরই আমাদের এলাকায় নানান ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। তবে এই কোম্পানি আমাদের গ্রামে ঢুকেনি। বংশা গােজার এলাকা দিয়ে ঢুকেছে। কোম্পনির শ্রমিকদের আর এলাকার চাকমাদের মধ্যে কোনাে কিছুতেই মিল ছিল না।
আমি জানি না ঠিক কী কারণে আমাদের চোখে তারা ছিল খুবই আর অবিশ্বাসী। অথচ বহু বছর ধরে রাঙামাটিতে বাস করা যেসব বাঙালি এসেছে তাদের সাথে কোনাে সমস্যা হয়নি, জীবনভর আমাদের মধ্যে ওঠাবসা ছিল। কিন্তু এই আনসার কোম্পানির আসার কারণে আমাদের জীবনে অনেক সমস্যা শুরু হয়ে যায়।
হতাশার জীবন
এদিকে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিভিন্ন রােগশােকে আর শত শত মানুষের মৃত্যু- বিশেষ করে নারী, বৃদ্ধ এবং শিশুদের অসুস্থতায় করুণ মৃত্যুতে সকলেই হতাশ হয়ে পড়ে। নতুন করে প্রিয়জন হারানাের বেদনায় আমরা সকলেই কাতর হয়ে পড়ি।
সেসময় কলেরা ম্যালেরিয়া টাইফয়েডসহ কত ধরণের রােগে মানুষ মারা গেছে। প্রায় খবর আসতাে অমুককে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে, অমুককে ‘ভুতে গুলি’ করেছে । কত যে ‘মিথ’ মানুষের মুখে মুখে। এরই ভেতর এলাকায় আনসার কোম্পানির আগমন, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের সমাজের লােকদের মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে।
মানুষের মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগে এভাবে বাঙালি বেড়ে যেতে থাকলে আমাদের এই জায়গায় টিকে থাকা কঠিন হবে। তাছাড়া এমনিতেই এই এলাকায় মানুষ বেশি কিন্তু জায়গা কম, সকলের জন্য জায়গা ঠিকমতাে সংকুলানও হচ্ছিল না।
যাই হােক, এভাবেই আমাদের দিন চলে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে আমাদের এলাকার মুরব্বি বসন্ত তালুকদার মারা যান। তিনি মারা গেলে গ্রামের সকলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে গাড়ি টানা হবে। আর এই গাড়ি টানা হয় ধামেই গােজা বনাম হাম্বেই গােজার মধ্যে। বালুকাল্যে বনাম ঝগড়াবিল কুল্যে।
তখন তাে গাড়ি টানার জন্য প্রয়ােজনীয় কোনাে কিছুরই অভাব ছিল না। গাড়ি টানার জন্য কেরেট’র দড়ি, চাকা সব কিছু আছে। কিন্তু সেদিন এই ধর্মীয় গাড়ি টানাটানিতে এলাকার তিনজন লােক মারা যায়। রূপকারী থেকে ২ জন আর মাচ্যে ছড়া থেকে ১ জন।
ভাগ্য ভালাে আমাদের গ্রাম থেকে কেউ মারা যায়নি কিন্তু তিন জন মানুষের মৃত্যুতে আমরা সকলেই দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আর এভাবেই নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় সমস্যায় ধীরে ধীরে আমাদের জীবনে, সমাজে উরােতুল/বিশৃংখলা শুরু হয়। আমরা সকলেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ি।
একজন কুসুম চাকমা এবং বর-পরং’ যাত্রা এক
এরই মধ্যে এলাকার কিছু লােক ভারতে আসা-যাওয়া শুরু করে দিলাে। তারা ” থেকে ফিরে এসে এলাকার লােকদের ভারতে চলে যেতে নানা ধরণের প্রলােভন দেখাতে শুরু করে।
তাদের কথা শুনে বাকিরা ভারতে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বাবার কাছ থেকে শোনা= সে সময়ে ভারতের সরকার নাকি আমাদের জন্য ভালাে কিছু করবে, নানান কিছু দেশে এই রকম খবর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রচারিত হয়েছিল। এমনকি রেডিওতেও নাকি প্রচার হয়েছিল।
আর সেই খবরও আমাদের এখানে পোজালে এলাকার লোকদের মধ্যে ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে কথা শুরু হয়। তো এই হিড়িকের মধ্যে পড়ে আমার বাবা আজুরাও আলােচনায় বসলেন ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে।
শুধু আজু বাবার না, প্রত্যেক ব্লকে ব্লকে মৌজাতে মুরুব্বিরা আলোচনা শুরু করে দিলেন। তখন তাে প্রত্যেক মৌজাতে হেডম্যান খীজা মানে খীসা, দেবান মানে দেওয়ানদের প্রভাব ছিল অনেক। এসব দেওয়ান খীসা আর গ্রামের মুরুব্বিরা আলােচনা করে ঠিক করলেন ভারতে চলে যাবেন।
যে হারে বাঙালি বাড়ছে তাতে আমাদের জীবনেও চাপ পড়ছে। এই বাঙালিদের সাথে সুখে থাকতে পারবাে না, এটা নিশ্চিত বুঝে এলাকার মুরুব্বিরা কীভাবে কখন কোন সময় নিরাপদে এই দেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া যায় তা নিয়ে মিটিং করতে লাগলেন।
ঠিক এই আলােচনার সময়ে সতীশ কানুনগাে নামে একজন চেনাজানা লােক রাঙামাটি থেকে বাঘাইছড়িতে ফিরলেন। তিনি সেখানে চাকরি করতেন। সাথে আর একজন ফিরেছেন রাঙামাটির কলেজের ছাত্র কুসুম চাকমা।
শােনা কথা, এই কুসুম চাকমার সাথে এক বাঙালি বড়ুয়া মেয়ের ‘আই পাই’ মানে ‘প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়ের বাবা কিছুতেই এই সম্পক মানবে না, তাই তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ দিয়ে দিলেন। এই নালিশের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে খোঁজা শুরু করলাে। ফলে সে রাঙামাটি থেকে বাঘাইছড়িতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলাে।
সে হাম্বে গােজার বংশের ছেলে। তার সাথে আরেকজন এসেছে, সে ললিত কানুনগাের ছেলে খোকন। খােকন এখন সাধু হয়ে এখানে মাছমারাতে ধ্যান নিয়ে থাকে। সতীশ কানুনগাে, কুসুম চাকমা এবং খােকন এদের সবার এই বাঘাইছড়িতে দেখা।
এই তিনজনে মিলে সকলের সাথে আলােচনায় বসলেন এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়। কী করা উচিত। অনেক আলােচনার পর ঠিক হলাে যে ভারতে গিয়ে দেখা উচিত সেখানে যাওয়া যায় কিনা। কারণ সবাই একমত যে এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কুসুমকে পাঠানাে হয় ভারতের দেমাগ্রীতে । সে আবার আমার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে হয়। সে রাঙামাটি থেকে ফেরত এসেই আমাকে বলেছিল কাকা ভালাে হােক মন্দ হােক। আমাদের জেঠা সতীশ তালুকদার হেডম্যান ছিল। আমাদেরকেই সবাইকে পথ দেখাতে হবে। আমি আগে দেমাগ্রী গিয়ে সেখানে যাবার রাস্তাটা পরিষ্কার করে আসি। আমার জানামতে তখন পর্যন্ত কেউ দেশ ছেড়ে যায়নি। শুধুমাত্র কয়েকজন মিজোরাম আর এইজশ আসা-যাওয়া করছিল।
তো কুসুম দেমাগ্রী চলে যায় ওখান থেকে শিলচরে, তার সাথে একজন কুকি ছিল তাকে সাহায্য করার জন্য। দেমাগ্রী থেকে ফিরে সে বললাে যে ভারত সরকার চলে যেতে বলেছে। ভারতে গেলেই তারা আমাদের দায়িত্ব নেবে।
তখন জহুরলাল নেহেরুর সরকার ছিল। এই কথার ভিত্তিতেই ‘বরপরং’ বা ভারতে যাওয়া সিদ্ধান্ত হয়। এরপরেই তাে বাঘাইছড়ি সাজেক হতে দিঘীনালার মইনী চেঙেই থেকে দলে দলে মানুষ চলে গেল বর-পরং-এ।
বড়-পরং যাত্রা-দুই
প্রাথমিকভাবে ঠিক হলাে একটা গ্রামের মানুষ চলে যাবার পর আরেকটা গ্রামের লোক যাবে। আবার এটাও ঠিক হলাে যে, পাশাপাশি দুটো গ্রামের বাসিন্দারা কই সাথে যাবে।
প্রথমে একটা গ্রাম যাবে কিছু দূর যাবার পর তারা ‘গােলাক’ মানে বাজি ফুটিয়ে সংকেত পাঠাবে এবং সেই বাজি ফোটানাের শব্দ শুনেই আরেকটি গ্রামের লােকজন চলে যাবার জন্য গ্রাম ছাড়বে। এইভাবে ঠিক হয় আরেকবার গ্রাম ছাড়ার। একদেশ থেকে আরেক দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা। যেখানে আমাদের কেউ নেই।
সিদ্ধান্ত অনুসারে যারা ভারতে যেতে চাইছে তারা গ্রাম ছাড়ছে । কিন্তু কোন একটা কারণে আমরা মানে আমাদের পরিবারের সময়মতাে গ্রাম ছাড়া হলােনা। আমি মনে করি এই গ্রাম না ছাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিজের জায়গার প্রতি ভালােবাসা।
মায়া। নিজের দেশ, জন্মভূমি বলে কথা। তাে একদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ভালাে থােক আর মন্দ হােক তুমিই একমাত্র যে কথা বলতে পারাে আর বুঝতে পারাে। আর কিছু পড়াশুনাও জানা আছে তােমার । ভারতে যাওয়ার আগে তুমি একবার ভারতের দেমাগ্রী ঘুরে আসাে আর দেখে আসসা সেখানকার পরিস্থিতি।
এখন পর্যন্ত কত মানুষ সেখানে গেল এবং সেখানে কোন কোন এলাকার লােক বেশি, সব কিছু দেখে আসাে। বাবার কথামতাে আমি পথা চলে গেলাম। সেখানে আমাদের এক আত্মীয় আগে থেকে বসতি “ছিলেন, তিনি সম্পকে আমার জেঠা হন। তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন ‘ভাইপত তুমি এসেছাে! এখানে থাকলে ঠিকমতাে জায়গা পাবাে ” পামনের দিন কীভাবে কাটাবাে? আমরা অন্য জায়গায় চলে যাবাে।
সব কিছু পণ্ডেনে আমি আর আমার ঐ জেঠাকে সাথে করে বাঘাইছড়িতে ফিরে এলাম। শঙ্কা এসেই বাবা আজুকে বললেন, ভারতে যাওয়া নিরাপদ। ভারত সরকার আমাদের জন্য সবকিছু করে দেবে। তাছাড়া ভারতে এমন ধুতি পাওয়া যায় সে ধুতিটা একটা ছােট্ট বােতলে ঢুকানাে যায়। শুনেই আমার বাবা বললেন, তাহলে আর এখানে থাকবাে না । চলে যাবাে ।
বড়-পরং যাত্রা-তিন
একদিন সতীশ কানুনগাে বলল, সরকার থেকে আমরা যে জায়গা পেয়েছি তাতে বিক্রি করা যাবে না, সেসব তাে রেখে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের মন্দিরের যে ‘গোঁয়েই’ মানে বুদ্ধমূর্তি আছে, সেটার কী হবে! এই ‘গােয়েই’কে ফেলে রেখে আমরা যেতে পারি না।
সবাই ভাবল, তাই তাে। এই বুদ্ধমূর্তিটা দান করেছেন একজন মগ ভান্তে। সুদূর বার্মা থেকে এনে দিয়েছিলেন। কি সুন্দর ঝকঝকে মূর্তি! তাে ঠিক হলাে আমরা এই বুদ্ধমূর্তিটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবাে!
ভারতে চলে যাবাে, সব ঠিকঠাক হওয়ার পর আমরা বুদ্ধমূর্তিটাকে কাল্লোং-এ ঢুকিয়ে ঢাকনা দিয়ে রেডি করে রাখলাম। নতুন করে বানানাে জায়গা-জমি বাড়ি তাে আর বিক্রি করা যাবে না। তবে বাড়ির পােষা মুরগি গরু-ছাগল যে যেভাবে পেরেছে বিক্রি করে দিয়েছে। সতীশ কানুনগাে একদিন আমায় বললাে, তুমি যেভাবে পারাে সেভাবে গরু বিক্রি করে দাও। বাবা বললেন, সাবধান এইসবে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। টাকা পয়সার ব্যাপার।
তবুও আমি যেভাবে পারলাম সবাইকে সাহায্য করলাম। কিন্তু বছর পাঁচেকের মধ্যে আরেকবার ভিটা ছাড়া হওয়া। বাপের আজন্ম ভিটে ডুবে যাওয়া আর সেখান থেকে উচ্ছেদের বেদনা অনেক গভীর অনেক আক্ষেপের।
কিন্তু নতুন করে আবার ভিটা বা দেশ ছাড়ার বেদনাটাও কম না। বরং অনেক বেশি গভীর কষ্টের। আসলে এই দুঃখ আক্ষেপ বােঝানাে কঠিন। আমরা যে ধান চাষ করেছিলাম তখন মাত্র সেই ধান পাকতে শুরু করেছে, সেসব ফেলে এলাম। যারা আগে যাচ্ছে তারাই গােলাক মেরে মেরে জানান দিয়ে যাচ্ছে যে আমরা চলে যাচ্ছি।
আর যারা ভাের বেলায় ওষুধ-এর দোকানে যেতাে ওষুধ কিনতে, যেমন কুইনিন, তখন তাে এখনকার মতাে ট্যাবলেট জাতীয় পাওয়া যেতাে না, তখন কুইনিন ছিল পাউডার সেসব কিনলেই বুঝতে হবে তারাও দেশ ছাড়ার জন্য রেডি।
এরই মধ্যে পাকিস্তান সরকারও জেনে গেছে যে দলে দলে শ’তে শ’তে চাকমারা ভারতে চলে যাচ্ছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ইসলাম কানুনগাে এবং হায়দার সাহেব নামে দুজনকে পাঠানাে হয় চাকমাদের সাথে আলােচনার জন্য।
যেন তারা ভারতে চলে না যায় । কিন্তু আমরা চলে এলাম ভারতে। তখন আমার ছেলে জন্মায়নি। আমার ছেলের জন্ম ৬৩-এর শেষের দিকে। আমি বলছি ৬৩-এর আগের কথা। যাবাে যাবাে করেও অনেক সময় মাস চলে গেল। তাে ভগবানের ভাস্যা ছাড়াই আমরা ভারতে ঢুকলাম আর দেমাগ্রীতে ভর্তি হলাম। মানে হাজারাে মানুষের সাথে শিবিরে নাম লেখালাম।
দেমাগ্রী টু নেফা-২২ গ্রুপ : ১
আমার স্মরণশক্তি বলছে দেমাগ্রী শিবিরে ২২টা গ্রুপে আমাদেরকে ভাগ করা হয়েছিল। এক একটা গ্রুপে ছিল ১০০০ জনের বেশি মানুষ। তবে আমার গ্রুপের নাম্বার হচ্ছে ২২ সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৬২ জন। আর আমিই হচ্ছি এই গ্রুপের নেতা। ভালাে-মন্দ মিলিয়ে আমাকে নেতা মেনে আমার গ্রুপের লােকেরা আমার সাথে সাথে চলে এসেছিল।
আমাদের গ্রামের বুদ্ধমূর্তিটা আমার গ্রুপের সঙ্গে। এখনাে সে বুদ্ধমূর্তিটা আমাদের গ্রামের মন্দিরে রক্ষিত আছে। বুদ্ধমূর্তির – চল ১ কেজি কম ১ মণ। সাথে মং একটা ছিল ২ কেজি ওজনের।
আমাদের গ্রুপের যে ব্যক্তি বুদ্ধমূর্তিটাকে বহন করে এনেছে সে কোনাে অভিযােগ বেনি। বরং সে বার বার বলছিল যে এতাে ওজনের জিনিস পিঠে করে আনছে নব কখনাে মনে হয়নি।
তাকে আমরা দিন ১০ টাকা করে পারিশ্রমিক দিতাম। দেমাগ্রীতে মানুষ আর মানুষ। ভারত সরকার আমাদের থাকার জন্য ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছে। শিলছড়া, মনা ছড়া, আনিপুর- হাজা জেলাসহ অনেক জায়গায় । পথে পথে ক্যাম্প বানিয়ে রেখে দিয়েছে।
দেমাগ্রীতে মানুষ বেশি হয়ে যাওয়াতে সরকার ঠিক করলাে এইবার রওয়ানা দেয়া দরকার। এখান থেকে নেফা বর্তমান অরুণাচলে আমাদের নিয়ে যাবে। আইজল থেকে নেফার দূরত্ব অনেক। দেমাগ্রী থেকে হেঁটে আমরা আনিপুরের ক্যাম্পে পৌছাই। আমার মনে আছে তখন আমাদের বলা হয়েছিল দূরত্ব ৭০০ মাইল।
কিন্তু এখন মনে হয় আরাে অনেক বেশি। দেমাগ্রীতে যখন আমাদের নাম লিস্টে লেখা হচ্ছিল তখন আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমাদের কাছে মূল্যবান জিনিস মানে সােনা রুপা টাকা আছে কিনা। থাকলে জমা দিতে হবে।
আমার মা বেশ বুদ্ধিমতি ছিলেন। মা ছিলেন ধামেই গােজার মেয়ে। মা তৎক্ষণাৎ চিন্তা করলেন এখন এখানে জমা দিলে পরে যদি ফেরত না পাই? তাে মা কী করলেন, তার কাছে যা ছিল জমা না দিয়ে তার পরা পিনন-এর লাল পাড়ে লাল কাপড় দিয়ে পকেট সেলাই করে কিছু টাকা, মানে ২২/২৩ হাজার টাকা সেলাই করে লুকিয়ে মাখলেন।
তখন পাকিস্তানের ১০০ টাকা দিলে ইন্ডিয়ার ১৩০ টাকা পাওয়া যেতো। শুধু টাকা না, যাদের কাছে দেশীয় বন্দুক, কার্তুজ ছিল সেসবও জমা দিতে হয়েছে। বলা হয়েছিল কোনাে বন্দক ফেলে না আসতে। যেকোনাে ধরণের বন্দুক থাকলেই সাথে করে নিয়ে এসে জমা দিতে।
দেমাগ্রী টু নেফা : ২
যতদূর মনে পড়ে দেমাগ্রী থেকে মােট ৩১ দিনের মতো আমাদের হাটতে হয়েছে। প্রথমেই গেছে সুমতি তালুকদার।তার বাবার নাম আদেচন্দ্র হেডম্যান। দেমাগ্রী থেকে যাত্রা শুরু হবার পর শুধু হাঁটতে হতাে।
রাস্তায় ৬ মাইল পর পর বিশ্রামের জন্য ক্যাম্প বানিয়ে রাখা ছিল। রাস্তায় রাস্তায় ভলানটিয়ার হিসাবে ইন্ডিয়া সরকার মানুষ রেখে দিয়েছিল। যারা অসুস্থ, বৃদ্ধ আর গর্ভবতী না তাদের জন্য ছিল গাড়ি।
যারা রাস্তায় মারা যাচ্ছে বা যাবে বলে বুঝা তাদেরকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। অবশ্য সাথে ১ বা ২ জন ভলানটিয়ার থাকতো। তাদের জন্য শেষ যাত্রা বলে কোনাে কিছুই থাকতাে না।
মারা যা পর পথের ধারে কোনােরকমে আগুনে দিয়ে আসতে বা মাটিতে চাপা দিতে আর যেসব গর্ভবতী মা সন্তান জন্ম দেবে বা দিচ্ছে তাদেরকেও রেখে আসতে হয়েছে ক্যাম্পে। সন্তান জন্ম দেবার পর নিজেরাই পথ চিনে নিয়েছে সেসব মা । কত মানুষ যে রাস্তায় অসুখে বিপদে পড়ে মারা গেছে সেসব হিসাব কেউ কোনােদিন আর পাবে না। আমরাই তখন কেউ এই হিসাব রাখতে পারিনি ।
দেমাগ্রী টু নেফা :৩
মানুষের ঢলে মানুষের বিষ্ঠার গন্ধ ৩ (তিন) মাইল দূর থেকেও পাওয়া যেতাে। রাস্তার দু’ধারে দেখা মিলতাে বাচ্চাদের মৃতদেহ, অর্ধেক মাটির নিচে পুতানো। তাড়াহুড়াতে পুরােটা মাটি চাপা দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেক মানুষ মারা পড়েছে অর্ধেক রাস্তায়।
পরিবেশ, ঠিকমতাে খেতে না পাওয়া, পরিশ্রম- সব মিলিয়ে অসুখে ভুগে এক বুড়ো আর ছােট বাচ্চারাই বেশি মারা গেছে। যারা একেবারে চলতে অক্ষম ছিল তাদেরকে রাস্তায় ফেলে আসতে হয়েছে। কি করুণ পরিস্থিতি!
অনার আজো চোখে ভাসে আমাদের সেই হাঁটার দৃশ্য। রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। কোথায় যাচ্ছি জানে না কেউ। শুধু জানে ভারত সরকার এখন যেখানে নিতে চাইছে সেখানে যেতে হবে।
তবে ভাগ্য ভালাে বলতে হবে, আমাদের গ্রুপে মানুষ হতাহত কম হয়েছে। শুধুমাত্র একজন মারা গেছে। সম্ভবত আমাদের সাথে ভগবান মানে বুদ্ধমূতি ছিল, হয়তো সে কারণে। অন্য গ্রুপে বেশি মারা গেছে। আমরা চেষ্টা করতাম এই বুদ্বমুর্তিকে বন্দনা করতে।
দেমাগ্রী টু নেফা : ৪ মনছড়া ক্যাম্প
মনছড়া নামের জায়গা আমাদের জন্য ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার। শন দিয়ে সব ক্যাম্প বানানো। ক্যাম্পে আসার পর আমাদের জন্য চাল, চালগুলো খুবই ভালো ছিল, জেত্তেল মানে সরিষার তেল আর শুটকি দেয়া হলো।
আমি যদিও লিডার ছিলাম কিন্তু আমি তাে ইংরেজি জানি না। আমাদের সেই ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে ছিল একজন আসামিজ ক্যাম্প কমান্ডার । একদিন একটা ত লেখা কাগজ নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলাে, আমার নাম বুদ্ধচন্দ্র কিনা।
আমি তো ইংরেজি জানি না, তাই আরেকজনকে ডেকে কাগজটি দেখিয়ে দিয়ে বললাে, এখান থেকে তােমাদের নেফা মানে বর্তমানের অরুণাচল যেতে হবে। কাগজে সেটাই লেখা আছে। এই কাগজটি হাতে পাবার পর আমাদের আবার পথে নামতে হলাে। এইবার আনিপুর ক্যাম্প।
দেমাগী টু নেফা : ৫. আনিপুর ক্যাম্প
আবার মনছড়া ক্যাম্প থেকে হাটা ধরলাম আমরা। এইবার আনিপুর। সেখানে আমাদের জন্য ক্যাম্প বানিয়ে রাখা হয়েছে। শুনেছি আমরা সেখানে পৌছার আগে সরকার সেখানকার স্থানীয়দের বলে রেখেছিল যে সাবধানে থাকবে। চাকমারা কিন্তু মানুষ খায়।
তােমাদেরকে যদি তারা খেয়ে ফেলে তাহলে সরকারের দোষ নাই। আমরা আনিপুর ক্যাম্পে পৌছালাম। আমাদেরকে স্থানীয়রা ভয় পেতাে যদি সত্যি সত্যি আমরা তাদের খাওয়া শুরু করি।
শিবিরে আসার পর রেশন দেয়া হলাে। মাথা পিছু ১ ঢ’ চাল। চাল, কেরােসিন তেল, সরিষার তেল, শুটকি ও বেৰ্মা । চাল ভাগ করে দেয়ার দায়িত্ব প্রথমেই মােহন্তকে দেয়া হয়। পরে আমাকে দেয়া হয়।
চাকমারা শুধু খাওয়া নিয়ে চিন্তা করে। আর হিন্দুরা শুধু সম্পত্তি বানায়। আমার মা লুকিয়ে যে ২২/২৩ হাজার টাকা এনেছিল সে টাকা নিয়ে আমি করিমগঞ্জে গেলাম। পাকিস্তানী টাকা থেকে ইন্ডিয়ান টাকা বদলানাের জন্য। সেখানে গিয়ে দেখলাম এক হাতের পাতা সমান বদলা ছুড়ি শুটকি। আর আমারে মানা করে কে! সেসব কিনে শিবিরে ফিরলাম।
আমি এমনিতেই একটা দুষ্ট প্রকৃতির লােক ছিলাম। তাছাড়া মদও খেতাম। লিডার ছিলাম তাই সবাই ভয় পেতাে। কাউকে যদি বলতাম মদ তৈরি করে দিতে সে ভয়ে আমার জন্য মদ তৈরি করে দিতে বাধ্য হতাে।
এখানে আসার পর ভারত সরকার আমাদেরকে একটা করে কাগজ দিলাে আর এই কাগজ পেয়েই আমাদের বেড়ে গেল। এখন আমাদেরকে আর কেউ ভারত থেকে বের করে দিতে পারবে না।
আনিপুর ক্যাম্পে আসার পর থেকে আমার মদ খাওয়ার সাথে সাথে জুয়া খেলাও যোগ হলো। এমনকি ক্যাম্পের বাইরেও আমার মদ আর জয়ার সাথী জটে গেল। ভারত সরকার ১৭ টাকা মাসে ২ বার করে টাকা দিতাে, যাতে আমরা টাকাগুলাে একেবারে শেষ করতে না পারি। সেখানে তাে লাকড়ি সস্তা ছিল খুব ১০ পয়সা করে। তখন আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের টাকার বেশ দাম ছিল।
মদ আর জয়ায় আমি সব টাকা সেখানে ফেলে আসতাম। আনিপুর ছিল মুসলিমদের জায়গা । তারা আমাদের বন্ধু বলে সম্বােধন করতাে। ক্যাম্পে কারাের কাছে ধার পাওয়া যেতাে না। সবারই তাে একই অবস্থা। সুখ বলতে কিছুই নেই।
এতাে দুঃখের ভেতরেই জীবন চলতে থাকে। জীবনের নিয়মে বিয়ে হতাে, কিন্তু এই শরণার্থী শিবিরে আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বিয়েতে দাবা* ধরাধরিও বন্ধ হয়ে গেল। কোনাে রকমে সুধােম** অনুযায়ী মেলা মানে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে হতাে। কারণ কারাের হাতে টাকা নেই। সবাই ভারত সরকারের রেশনের উপর নির্ভরশীল। এভাবে থাকতে থাকতে এই আনিপুর ক্যাম্পেই ছােট করে একটা বৌদ্ধমন্দির বানিয়ে দিলাে সরকার।
ক্যাম্পের বাইরে বাগান বাজার নামে এক দোকানে ক্যাম্পের সকল লিডার গােছের পুরুষরা মদ খেতে যেতাে। সেখান থেকে ক্যাম্পে কেউ মদ আনতে চাইলে একটা কাগজ নিতে হতাে ক্যাম্পের দায়িত্বে যারা ছিল তাদের থেকে এমনিতে মুসলমানদের এলাকা। তার ওপর আমরা মদ খেয়ে প্রায় ঝামেলা করতাম। এতে এলাকার লােকেরা আমাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
একদিন আমাদেরই একজন রাস্তায় সাইকেল চড়ে আসা এক স্থানীয় ব্যক্তিকে লাঠি মেরে ফেলে দেয়। এই নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। আমাদের সাথে স্থানীয় মুসলমানদের মারামারি লেগে গেল। ক্যাম্পের যারা চোর ছিল তারা মুসলমান এলাকায় গিয়ে খুঁজতাে কার গরু কী রকম। এভাবে স্থানীয় লােকদের গরু মহিষ হারিয়ে যেতে লাগলাে।
আর এসব অপর্কম আমাদের ক্যাম্পের লােকেরাই জড়িত সে নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। বেচারা মুসলমানদের গরু মহিষ আঁখবাগানসহ সব ধরণের অস্থায়ী সম্পত্তি শেষ করে দিয়েছিলাম আমরা।
এই আনিপুর ক্যাম্পে প্রথমে আমাদের ২ মাস থাকার কথা থাকলেও থাকতে থাকতে ৩ (তিন) বছর রয়ে গেলাম। এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পে গ্রুপ গ্রুপ করে রয়ে গেলাম। এরই মধ্যে কেউ কেউ গ্রুপ করে নেফা মানে অরুণাচল গিয়েছে সেখানকার এলাকা দেখতে। আমার এক পিসীত ভাই ফণিভূষণও সেখানে গিয়েছে পরিস্থিতি দেখতে। আমাদের বরপরং প্রথম গ্রুপে সেও ছিল।
তাে সে নেফা থেকে ফিরে এসে বলল, ‘নেফায় গিয়ে থাকবাে কী করে। খুবই ঠাণ্ডা। এতাে ঠাণ্ডায় আমরা মরে যাবাে। আমাদের আগের জায়গার সাথে কিছুই মিলে না। আর এতদূর নেফা!’ এইসব শুনে আমাদের নেফা যাওয়ার ইচ্ছেই চলে গেল।
আমরা সরকারকে বললাম আমরা নেফা যাবে না । শুনে সরকার বললো, তােমরা যদি নেফাতে যেতে না চাও না যাও, তারপরও নিজে গিয়ে একবার দেখে আসো জায়গাটা।
এরপর আমাদের ক্যাম্প থেকে আরেকটা গ্রুপ নেফায় যায়। কী একটা কারণে আমার নেফা যাওয়া হলো না। আমি গেলে হয়তো অন্যরকম হতো। যাই হােক। তারা গিয়ে দেখলো জঙ্গল আর জঙ্গল। বৃষ্টি হলেই সে বৃষ্টির পানিতে হাতি ভেসে আসে।
শুধু হাতি না ‘গবও’* ভেসে আসে। এই ঝড়- এই পানি। আর কনকনে ঠাণ্ডা। সেই গ্রুপ ফিরে এসে জানালাে, যদি নেফা যায় যাওয়া মাত্র সকলেই মারা পড়বাে। কী বৃষ্টি! বৃষ্টির সাথে ঠাণ্ডা। মরে যাবাে। আমরা কেউ যাবাে না, এই সিদ্ধান্ত হলাে।
আমরা এখন কী করবাে? বাবা আমাকে বললাে, তুমিতাে একটু লেখাপড়া জানো। এক কাজ করাে, তুমি ত্রিপুরা একবার ঘুরে আসাে। সেখানে আমাদের ভাই অনিল বরণ চাকমা বাস করে।
ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার সময়ে একটা গ্রুপ পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসে। সেই গ্রুপে জ্ঞানেন্দু চাকমা, রেবতি রজ্ঞন চাকমা, বিপিন তালুকদার মাস্টারসহ অনেকে ছিলেন। এবং তারা তখন চলে আসাতে ভালাে জায়গায় বসতি স্থাপন করতে পেরেছে। বাবা আমাকে বলল বড় ভাই অনিল চাকমার সাথে যােগাযােগ করতে।
এদিকে ভারত সরকার ঠিক করেই রেখেছে আমাদের নেফায় নিয়ে যাবেই। আর আমরা যাবাে না। আমরা ইতােমধ্যে ঠিক করেছি (আমার গ্রুপ আর ফণীভূষণ গ্রুপ) নেফায় না যাওয়ার। এইটা শুনে ভারত সরকারের প্রতিনিধি বললাে এই সব গ্রুপের লিডার আর মেম্বারদের রেশন বন্ধ করে দিতে হবে আর রেশন বন্ধ করলেই নেফা চলে যাবে।
এবং সত্যি সত্যি রেশন বন্ধ করে দিলাে। এখন আরেক মরণ দশা। কী খাবাে কীভাবে বাঁচবাে। তারপর আমি বাধ্য হয়ে ক্যাম্প কমান্ডারকে বলে আসলাম ঠিক আছে আমরা যাবাে। কিন্তু আমাদের একটু সময় দিতে হবে। এদিকে সরকার শিবিরের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে নেফাতে নেওয়ার জন্য। রেশন বন্ধ হবার ভয়ে অনেকের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও নেফা যেতে বাধ্য হলাে।
এই ফাকে আমি বাবাকে বললাম, তুমি বরং বড় ভাই অনিল বরণের বাড়ি ত্রিপুরায় একবার ঘুরে আসে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবাে কোথায় যাবাে কী করবাে। এরই ভেতর আমরা ক্যাম্পের লােকজন আবার ভেতরে ভেতরে আলােচনা করলাম যাবাে যাবাে কোথায় যাবাে, কেমন করে যাবাে, থাকলে কীভাবে থাকবাে।
সবাই মিলে ঠিক করলাম, আমরা ভারত সরকারকে দস্তখত দিয়ে আসি, এই বলে আমরা আর পাকিস্তান ফিরবাে না। এখানেই থাকবাে, এই ভারতেই।
এরপর ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা লােকজন আমাদের জিজ্ঞেস করলাে থাকবে তো থাকবে, কিন্তু কোথায় থাকবে ঠিক করেছাে?
আনিপুর ক্যাম্প টু ত্রিপুরা
এরই ভেতর বাবা ত্রিপুরাতে বড় ভাই অনিল বরণ চাকমার বাড়ি ঘুরে আসার পর বললেন আমরা নেফায় না গিয়ে ত্রিপুরাতেই চলে যাবাে। ত্রিপুরাতে এখনাে জায়গা আর জঙ্গল আছে অনেক। সেখানেই আমরা সেটেলড় হবাে।
যেই কথা সেই কাজ। আমরা একদিন সুযােগ বুঝে গভীর রাতে চুপিসারে আনিপুর ক্যাম্প ছাড়লাম। প্রথমেই আমরা কয়েক পরিবার ক্যাম্প ছেড়ে চলে আসি। পরবর্তীকালে আরাে ৩৭ পরিবার চলে আসে ত্রিপুরাতে।
আমাদের বড় ভাই থাকাতে ত্রিপুরাতে বসতি করে স্থায়ী হওয়া আমাদের পরিবারের জন্য সহজ ছিল। কিন্তু বাকিদের জন্য ছিল কঠিন। কারণ এখানে ভারত সরকারের রেশন ছিল না, ছিল না কেউ যে একবেলা খেতে সাহায্য করবে। শুধু প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হয়ে লড়াই করতে হয়েছিল তাদের।
আমরা আসার পরে ঘন জঙ্গল ২ বছরের মধ্যে সাফ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আমরা আন্ধার ছড়াতে স্থায়ী হয়ে গেলাম আর বাকি ৩৭ এর অধিক পরিবার বাঁচার তাগিদে পং ছড়ার দিকে বসতি গড়ে তুললাে। সেখানে দাড়বাে মানে লাকড়ি বিক্রি করা যায় শন বিক্রি করে টাকা পাওয়া যায়।
অজানা ইতিহাস : বড়-পরং
আপনাদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কে ছিল?
আমি যতদূর জানি উদোংগাে মুনি চাকমা নামে একজন ব্যক্তি চাকমাদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে। সেও দেশ থেকে এসেছে। এই ব্যক্তিই আগে থেকে জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। পরে কুসুম চাকমা আমাদের নিয়ে আসে।
অবশ্য পরে এই উদোংগাে মুনি চাকমারা কুসুম বাবুকে নেফা থেকে বের করে দেয়। আমি যতদূর জানি, বর্তমানে এই কুসুম চাকমা লামডিং-এ বসতি গড়েছে। সেখানকার একটা বড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে ডিব্রুগড়ে বসবাস করছে। অবশ্য কুসুম চাকমা দেশে থাকতে এক চাকমা মেয়েকে বিয়ে করেছিল।
অজানা ইতিহাস- বড়-পরং: বিহার
আমি যতটুকু জানি, ভারত সরকার কিছু চাকমাদের বিহারেও নিয়ে গেছে। আন্ধামানেও কিছু নিয়ে যায়। বিহারে যারা যায় তাদের সংখ্যা ২০/৩০ পরিবার হবে। বিহারে যারা গিয়েছেল তারা সেখানে গিয়ে দেখে যে সে এলাকায় কোনাে বৃষ্টি নাই শুধু রােদ আর রােদ। চালের অভাব, শুধু গম খেতে হতাে। মেশিন দিয়ে পানি তুলতে হতাে।
অবশ্য তারাও তিন বছর পর ফিরে আসে বিহার থেকে। ত্রিপুরার কুমার ঘাট এলাকায় একটা মাঠ আছে, সেখানে রিফুজি ক্যাম্প করে রেখেছিল চাকমাদের। এখনাে ঐ জায়গাটা খালি আছে। ঐ ক্যাম্পে যারা ছিল তারাই বিহারে যায়।
এলােমেলাে কথা : এক
আমাদের পানিতে ডুবে যাওয়া গ্রামে তাল গাছ, বিশাল কলা বাগান আর গাব গাছের বাগান ছিল। তখনও আমাদের মানুষদের হুঁশ জ্ঞান হয়নি যে কী হারাচ্ছে! কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে।
সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা পেয়েছে, সেসব দিয়ে রাঙামাটি গিয়ে কলের গান কিনে এনেছে কেউ কেউ। গ্রাম ছাড়ার সময় নতুন জায়গায় যাবার সময় কেউ কেউ কলের গান বাজিয়ে বাজিয়ে এসেছে।
আর কেউ নৌকায় বসে করুণ সুরে ‘বেলা বাজিয়ে বাজিয়ে জায়গা ছাড়ার দুঃখকে ভুলতে চেয়েছে। নৌকার মাঝি ছিল বাঙালি। মেয়েরা গ্রাম ছাড়ার সময় কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। আর অনেকে খুব ফুর্তি সহকারে গ্রাম ছেড়েছে।
আমাদের গ্রাম ডুবে যেতে ১ দিন ১ রাত লেগেছিল। সুবলং এলাকায় যে বৌদ্ধমন্দিরটি ছিল, সে বৌদ্ধমন্দিরটি পানিতে তলিয়ে গেলে বুদ্ধমূর্তিটিও ডুবে যায়। সেটি আর পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। আমরা এখান থেকে শুনি এখনাে নাকি সেই বুদ্ধমূর্তিটাকে মাঝে মাঝে দেখা যায় পানির উপরে ভেসে থাকতে।
আশপাশে কোনাে লঞ্চ না থাকলে সেটি ভেসে উঠে আর লঞ্চ দেখলেই ডুবে যায়! সত্য মিথ্যা জানি না। আমরা এখান থেকে এসব শুনি। আমরা যে বুদ্ধমূর্তিটি দেশ থেকে বয়ে এনেছিলাম সেটি নেফার বুদ্ধ পেদা চাকমা চুরি করেছিল ক্যাম্প থেকে।
দেমাগ্রীতে নাম লেখার আগে আমরা বলেছিলাম আমাদের কাছে বুদ্ধমূর্তি আছে। তারা সেখান থেকে ক্যাম্পে একটা কাগজ পাঠায়, যেখানে লেখা ছিল ২২ নম্বর গ্রুপে একটা বুদ্ধমূর্তি আছে। সেই বুদ্ধমূর্তিটা ঠিকমতাে পৌছালাে না পৌছালাে?- একদিন ক্যাম্প কমান্ডার সেই কাগজ নিয়ে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাে, তুমি আসার সময় কী এনেছাে? কোনাে কাগজ আছে কিনা? আমি তাকে বললাম, আমার স্ত্রীর একটা কানের দুল ছিল, সেটি সে এনেছে। সেটি আমরা জমা দিইনি।
তারা আবার জিজ্ঞেস করলাে, আরাে কিছু ছিল কিনা যেটি আমরা জমা দিইনি? যারা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল তারা আসামিজ। আমি তাদের কথা কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। তাই তারা একজন বাঙালিকে ডেকে নিয়ে আসে তিনি আমাকে বুঝিয়ে বলেন যে তারা একটা বুদ্ধমূর্তি খোজ করছেন।
আমি তখন বললাম, আমার সেই বুদ্ধমূর্তিটা কেউ একজন চুরি করেছে। তখন তারা সেই বুদ্ধমূর্তিটাকে খুঁজতে শুরু করলেন। অবশেষে সেটা পাওয়া গেল। নেফার বুদ্ধ পেদা চাকমার বাড়িতে। এখন সেই বুদ্ধমূর্তি আশ্বিন ছড়া, আন্ধার ছড়াতে আছে।
এলােমেলাে কথা : দুই
এখন আমার বয়স একেবারে শেষের দিকে। এখন এই মন্দিরে শ্রমণ হিসাবে আছি। কখন কি হয়। এই কাপ্তাই বাঁধের ঘটনা নিয়ে নিজেরা নিজেরা আলােচনা করলেও এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। বয়সের কারণে এখন অনেক কিছু ভুলে গেছি। আসলে সময়ে আর বয়সের সাথে সাথে সব শেষ হয়ে যায়।
একা থাকলে বা দেশের কাউকে পেলে কত স্মৃতি এসে ভীড় করে। পুরােনাে জায়গা, নতুন জায়গা কত কষ্ট করে জঙ্গল সাফ করে বসতি করেছি, সে জায়গা ছেড়ে নতুন দেশে পালিয়ে আসা! কাপ্তাই বাঁধে ডুবে যাবে আজু পিজুদের জায়গা সম্পত্তি, তাদের শ্মশান, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আসার সময় কত হা-পিত্যেস! কত কান্না! শুধু কি আমাদের কান্না, পশু পক্ষীর কান্না ছিল শরীর হিম করে দেওয়ার মতাে।
ছন্নছাড়ার মতাে কুকুর বিড়াল শিয়াল চিৎকার করতাে। তাদের চিৎকারে আমাদের প্রাণ হিম হয়ে যেতাে। প্রাণে ভরপুর গ্রাম প্রাণহীণে পরিণত হয়েছিল। চারিদিকে মৃত মানুষের মতাে আমরা ঘােরাফেরা করতাম একে অপর থেকে বিদায় নিতাম।
মারিশ্যার বঙলতুলির লােকেরা আগে বর-পরং যাবে বলে দেশ ছেড়েছিল। আমরা ত্রিপুরাতে আসার পর ত্রিপুরার চাকমারা অনেক সাহায্য করেছিল। কতদিন আধাপেটা করে খেতে হয়েছে আমাদের। অথচ কি ছিল না আমাদের, আমাদের দেশে। সেসব এখন পানির তলে।
আমাদের পুরােনাে জায়গায় বিশাল মাটির বাড়ি ছিল শন দিয়ে। এখানে এসে আমরা টিনের চাল দিয়ে ঘর বানিয়েছি ঠিকই কিন্তু শরণার্থী তাে। কি আর করা! ভগবান হয়তাে এভাবেই আমাদের দেখতে চেয়েছে।
এখানে আসার পর অনেক পরে আমি কংগ্রেসে যােগদান করি। এখন শ্ৰমণ হিসাবে আছি। দেশ ছাড়ার পর থেকে আমি আর ফিরিনি আমাদের দেশে। আমার পরিবারের লােকেরা গিয়েছিল আমার শ্বশুর মৃত্যুর সময়। দেশে যেতে কতাে ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে কি- মনে মনে তাে আমি সেখানেই থাকি। আজু পিজুরা তাে ওখানেই রয়ে গেছে। কিন্তু নানা কারণে আমার আর যাওয়া হয়নি। না যাওয়ার অন্যতম কারণ ওখানে গেলে আমার আত্মীয়-স্বজন হয়তাে আমাকে ঠাট্টা করবে, আমাদের চলে আসা নিয়ে। হয়তাে বলবে এইবার কেন মরতে এলে। সেটা আমার সহ্য হবে না। তাই যাওয়া হয়নি। হয়তাে আর কখনাে আমার দেশকে দেখা হবে না।
লেখকঃ বুদ্ধধন চাকমা
৯ নম্বর মারিশ্যা চর মৌজা, কাপ্তাই বাঁধের পর মধ্য বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি।
২২ নং গ্রুপের নেতা*
তথ্যসুত্র : “কাপ্তাই বাঁধ : বর-পরং – ডুবুরীদের আত্মকথন” – সমারী চাকমা।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।