চাকমা জনগোষ্ঠী বিবাহ বিচ্ছেদ (ছাড়াছাড়ি)
1315
চাকমা বিবাহ বিচ্ছেদ
চাকমা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘ছাড়াছাড়ি’ দেনা বলা হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি: স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে চাকমা সমাজে একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে তাদের জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি হতে বা ছাড়াছাড়ি হতে পারে:-
ক) স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একে অপরের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে।
খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম দ্বারা ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে পারে।
গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন মূলে বৈবাহিক সম্পর্কের সমাপ্তির প্রচার করে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে (যদিও তা সামাজিকভাবে প্রথাসিদ্ধ নয়)।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে/সুরকাগজ’ দাৰী করার অধিকার লাভ করে: নিম্নোক্ত কারণে চাকমা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ (ডিভোর্স লেটার) প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ-
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম সেক্ষেত্রে স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদ পত্র দ্বারা ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া প্রেম কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অপরজন ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ দাবী করতে পারে।.
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ একজন নিরুদ্দেশ হলে এবং ৬ মাস হতে ১ বছর পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘সুরকাগজ’ সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ছাড়াছাড়ি হতে ৰা ‘সুরকাগজ’ প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন কৃত জঘন্য অপরাধে দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাভোগে থাকে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ দাবী করতে পারে।
জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি সংসারত্যাগী হয়ে ধর্মীয় পুরোহিত (বৌদ্ধ ভিক্ষু) বা সাধুমা হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ছাড়াছাড়ি’ প্রচার করতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহ প্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ছাড়াছাড়ি’ ঘোষণা করতে পারে।
ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা, শিক্ষা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদন করতে পারে।
ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ছাড়াছাড়ি’ হতে পারে১।
বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল
সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ছাড়াছাড়ি হলে বা সুরকাগজ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
এরূপ বিবাহ বহু বিবাহ হিসেবে গণ্য হয় না। ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন হলে তা অবৈধ হয়।
এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ হিসেবে গণ্য হয়।
স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষের দ্বারা ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘চুমুলাং’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
তবে ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের পর উভয়ের যদি অন্যত্র বিবাহ না হয় সেক্ষেত্রেই ‘চুমুলাং’ অনুষ্ঠান সম্ভব হয়।
‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা সুরকাগজ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা সুরকাগজ সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত সম্পদের উপরেও স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে দাভা (পণ) সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।
‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থা
ক) ছাড়াছাড়ি হওয়ার বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়দায়িত্ব থাকে অথবা ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুৱকাগজ’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্বস্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি চাকমা সামাজিক প্রথা অনুসারে দিতে হয়।
উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ এবং আইনগত উত্তরাধিকার পায়।
বিচ্ছেদকালে যদি স্ত্রী গর্ভবতী থাকে তাহলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত মতে স্বামীর নিকট হতে ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবের যাবতীয় খরচ পায়।
তবে উক্ত সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে, সেক্ষেত্রে সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক অবস্থায় সন্তানের অভিভাবক হয়।
ধাত্রী বিদ্যামতে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর দ্বিতীয় বিবাহ ব্যতীত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ গণ্য হয় এবং তজ্জন্য বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য নয়।
তবে ‘ছাড়াছাড়ি’ হওয়ার বা ‘সুরকাগজ’ সম্পাদন পরবর্তী দিনগুলোতে স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে সেই গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্ব ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ চাকমা জাতীয় বিচার পদ্ধতি ও চাকমা উত্তরাধিকার প্রথা- শ্ৰী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, প্রথম প্রকাশ : রাঙ্গামাটি ১৯৮৬ খ্রি. দ্বিতীয় প্রকাশ : রাঙ্গামাটি : জুম ঈমথেটিক্স কাউন্সিল ২০০৩ খ্রি.
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।