চাকমা উপন্যাস চাই

Jumjournal
Last updated Jan 24th, 2020

1155

featured image

(এই লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালের জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল –এর বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু সংকলন ‘সাঙু’ তে। লেখাটি প্রকাশের পর চাকমা ভিন্ন অপরাপর পাহাড়ি জাতিগুলোর শিক্ষিত ও সচেতন মহলে লেখাটি নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনার জন্ম নেয়। মূলত শুধু চাকমাদের উপন্যাস চাই- এই দাবীর বিপক্ষে কিছু লেখাও প্রকাশিত হয়। কারণ এই পাহাড়ে চাকমা ভিন্ন আরো দশের অধিক পাহাড়ি জাতি থাকার পরও শুধু চাকমাদের উপন্যাস দাবী করার জন্যে এই লেখাটি সমালোচিত হয়। তবে চাকমা সাহিত্যের সাথে পরিচয় এবং শিক্ষিত চাকমাদের সাথে যোগাযোগের সুত্রেই লেখক চাকমাদের সম্পর্কেই লেখাটিকে আবৃত করেছেন। যদিও চাকমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস, পাহাড়ের অন্যান্য জাতিগুলোর ইতিহাসের সাথে এক সুত্রেই গাঁথা। তবে লেখকের মূল বক্তব্যটি এখনো অতি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। শুধুমাত্র যোগ করা যেতে পারে পাহাড়ের জাতিগুলোর নিজেদের জীবন নিয়ে নিজেদের ভাষায় উপন্যাস চাই)


চাকমা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ মোটে এক বছরের, তাও বাংলা অনুবাদের হাত ধরে। ভাসা ভাসা ধারনা নিয়ে এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ ফেঁদে বসা বেয়াদবির সামিল, এ ধরণের কম্ম ঘটান মস্ত মস্ত পণ্ডিত সমালোচকরা, তাদের কাছে বিদ্যা চর্চা মানে ছুরি কাঁচি নিয়ে শিল্পীদের ময়নাতদন্তে নামা।

কিন্তু আমি আমার মাতৃভাষায় তোতলাতে তোতলাতে গল্প উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি, কানা হোক, খোঁড়া হোক, সেগুলো আমার অনেক কষ্ট, অনেক সুখ, অনেক পুলক ও অনেক উত্তেজনার প্রকাশ, তাই ঐসব অজর, অক্ষম ও চোখে-পিঁচুটি জমা মহাপণ্ডিতদের অতো কঠিন কঠিন দায়িত্ব নেওয়া কি আমার পোষায়?

তবে আমি কোন সাহসে চাকমা সাহিত্য নিয়ে লিখি? আমার সাহস হলো চাকমা বন্ধুদের সঙ্গে দিনের পর দিন চিঠি লেখা আর চিঠি পাওয়া, বাঙ্গালায় তাদের কবিতা, গল্প, রুপকথা পড়া এবং চাকমা ভাষায় সেগুলো শোনা, তাদের সঙ্গে গল্প করা, ঝগড়া করা এবং আবার ভাব করার অভিজ্ঞতা। আরো আছে। কি?

সবচেয়ে বেশি সাহস পেয়েছি তাদের সঙ্গে পাহাড়ে, জনপদে, নদীতে, পাঠশালায়, বিহারে, গানের জলসায় এবং কবিতার আসরে তাদের খুব কাছে থেকে দেখে কয়েক মাস থেকে আমার কেবলি মনে হচ্ছে চাকমাদের উপন্যাস চাই।

চাকমা শিল্পীর লেখা চাকমা ভাষায় উপন্যাস চাই; সেই উপন্যাসের বেশীর ভাগ লোক চাকমা, তাদের বাড়ি রাঙ্গামাটি কি খাগড়াছড়ি কি বান্দরবানের কোন পাহাড়ি জনপদ, তাদের দৈনন্দিন জীবন জাপনের সঙ্গে বঞ্চনা, অপমান ও প্রতিরোধ এমন মিলেমিশে থাকবে যে একটি থেকে আরেকটি আলদা করা যাবে না।

চাকমাদের পুরনো কাব্য-উপাখ্যান ‘রাধামন ধনপুদির’র বাঙলা অনুবাদ হয়েছে কিনা জানি না, আমি এক তরুন চাকমা বন্ধুকে দিয়ে এর ছিটেফোঁটা সামান্য অংশ অনুবাদ করিয়ে নিয়ে পড়েছি, আর গল্পটা শুনেছি অনেকের মুখে।

গেংগুলি বা কথকরা পুরুষানুক্রমে চাকমা জনপদে জনপদে এই উপাখ্যান সুর করে আবৃতি করে বেড়ান। এটি ছাড়াও সমিল ছন্দে রচিত আরো অনেক কাহিনী গেংগুলিরা এখনো আবৃতির সঙ্গে সঙ্গে চাকমা গাথার নতুন নতুন প্রসঙ্গ যুক্ত হয়, পুরনো কিছু কিছু অংশ হয়তো ঝরেও পড়ে।

তবে বড়ো ধরণের যোগ-বিয়োগ বোধ হয় ঘটে না, কারণ পুরনো চাকমা গাথা তাদের গভীর ভালোবাসা ও ভক্তির সম্পদ, এর গায়ে বড়ো ধরণের চিড় ধরানো চাকমা গেংগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং যতোই জনপ্রিয় হোক, আধুনিক চাকমা কি এই উপাখ্যানগুলিতে সম্পূর্ণ সাড়া দিতে পারেন?

বাংলায় চাকমা কবিতা পড়েছি অনেক, বাঙলা অনুবাদ পড়ে ও মূল চাকমায় শুনে এটুকু বুঝি যে চাকমা কবিরা আজ ক্ষুব্ধ, কেউ কেউ ক্রুদ্ধ।

পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার দুর্যোগ ও নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার অপমান তাদের কবিতাকে দিন দিন উত্তেজিত করে তুলেছে।
আগে চাকমারা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে গেছে জীবিকার আগিদে; সেটা গৃহচ্যুতি তো নয়ই, এমন কি গৃহত্যাগও তাকে বলা যাবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো আগে সমগ্র চট্টগ্রামের সমস্ত পাহাড় জুড়েই ছিলো তাদের বাড়ি, চাকমারা ছিলো মস্ত বড়ো বিশাল বাড়ির বাসিন্দা।

সব পাহারড়ই তাদের কোল দেওয়ার জন্য উন্মুখ, নিজেদের শরীর তারা উর্বর করে রাখতো, একেকটি পাহাড় নিজের সমস্ত রস উজার করে দিয়ে এইসব শান্ত ছেলেমেয়েদের মুখে অন্ন তুলে দিতো।

পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা পাহাড়ের স্নেহ নিংড়ে নিয়ে ফের পাড়ি জমাতো অন্য পাহাড়ের দিকে। আবার এই ‘অন্য’ পাহাড়টিও তার দুগ্ধভারাক্রান্ত স্তন নিয়ে নিরবে তাকিয়েই থাকতো, ছেলেমেয়েরা এসে তার বুকের অন্ন তুলে নিলেই তার পরম তৃপ্তি।

খেয়েদেয়ে তৃপ্ত ছেলেমেয়েরা পা বাড়ায় সামনের দিকে আর সুখী পাহাড় একটুখানি ঘুমিয়ে নিয়ে ফের নিজেকে উর্বর করে সাজাতে তৈরী হয়।

পাহাড় এই ছেলেমেয়েদের কি না দিয়েছে? জুম চাষ করে তারা পাহাড়ের বুক থেকে তুলে এনেছে ধান, যব, নানান সব্জি, পাহাড়ের বন থেকে পেয়েছে পশু, পাখি, কতো রকমের ফল, আবার ছেলেমেয়েদের পরনের কাপড় তো হয়েছেই, এই তুলা দিয়ে রাজার খাজনাও মেটানো গেছে।

তাই এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে যাওয়া পাহাড়িদের গৃহত্যাগ নয়, বরং মায়ের এক স্তন থেকে আরেক স্তনে মুখ গুঁজে মাকে নিবির করে অনুভব করা।

এই মায়ের বুক থেকে শিশুর মুখ উপড়ে ফেলাত চক্রান্ত কিন্তু আজকের নয়। দু’শো বছর আগে গোটা উপমহাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করার দক্ষযজ্ঞের শিকার হয়েছে এই পাহাড়ি জাতিরাও।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে নিয়োজিত হয়েছিলো চাকমারাও। ঐ সময় তো পূর্ব ভারতের সবটা জুড়েই বিস্ফোরণ। সন্যাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, ওয়াহাবি, ফরায়েজি।

এর সঙ্গে কার্পাস মহলের জুমিয়ারা যে অন্যায় খাজনা দিতে প্রত্যাখান করে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তার মহিমা ঘোষণা করতে আমাদের এতো দ্বিধা কেন? দেশের ইতিহাসে তারা ঠাই পায় না কেন? সে কি দেশের এক কোণে থাকার কারণে তারা ইতিহাসেরও আড়ালে পড়ে যায়? না-কি তাদের আড়াল করে রাখার চক্রান্তের অংশ হলো অন্য জাতের কাছে তাদের ইতিহাস গোপন করা আর তাদের নিজেদের ইতিহাস চাকমাদের ভুলিয়ে দেওয়া?

ফরাসি বিপ্লবের নেতাদের বংশধরেরা লুকিয়ে রাখেন পূর্ব-পুরুষদের শৌর্যের কাহিনী। সাম্রাজ্যবাদের তোষণে নিয়োজিত হয়ে জাতির ইতিহাস মুছে ফেলতে তারা তৎপর হয়ে ওঠেন।

এতে ইতিহাসের ঘটনা হয়ত চাপা পড়ে, নায়কদের নাম ভুলে যায় মানুষ, ফন্দিবাজ পেশীশক্তির কাছে মাথা না নুইয়ে নিজেদের তুলার স্তুপে আগুন জ্বালাবার কথাও কেউ মনে রাখে না। কিন্তু সেই আগুন নেভে না। ধিকিধিকি করে তা জ্বলতে থাকে চাকমা রক্তের ভেতরে। তাদের উপর একেকটি ঘা এলে তাই লাফিয়ে ওঠে দীপ্ত শিখায়।

উপমহাদেশের রাজনীতি থেকে পাহাড়িদের আড়াল করে রাখার যতো চেষ্টাই করা হোক, এর ফল থেকে তারা রেহাই পাবে কেন? দেশ ভাগ হয়, দফায় দফায় দেশ স্বাধীন হয় আর চাকমাদের ঘরে লাগে নতুন নতুন ধাক্কা।

গোটা দেশে আলো জ্বালাবার জন্য তাদের বাড়িঘর ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্ধকার পানির নিচে। বাঁচার জন্যে তারা চলে যায় আরো ভেতরে, আরো আড়ালে।

বাঁচার জন্যে লড়াই করতে করতে কষ্ট, দুর্যোগ ও অপমানে নিজেদের পরিচয় নিজেদের কাছে স্পষ্ট হয়। তারা উদ্যোগ নেয় সেই পরিচয় প্রতিস্থা করার আয়জনে। তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন রাষ্ট্রের কাছে গণ্য হয় স্পর্ধা বলে।

এই স্বপ্ন মুছে ফেলার আদেশ তারা প্রত্যাখান করলে পেশীশক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। আবার নতুন করে গৃহচ্যুত হবার পালা। তবে এবার শুধু পালানো নয়।

আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবার তারা ফুটিয়ে তোলে স্পৃহায়, সেই স্পৃহা বিস্ফোরিত হয় সংকল্পে। চাকমারা, পাহাড়িরা রুখে দাঁড়ায়।

চাকমা কবিতা আজ এই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার সংকল্পে উত্তেজিত। নরনারীর প্রেম সেখানে গৌণ। প্রকৃতি কেবল প্রকৃতি বলে কবিতায় ঠাঁই পায় না, প্রকৃতির হৃতসর্বস্ব চেহারা তাদের ক্রোদের কারণ।

তাদের প্রকৃতি আজ পেশীসর্বস্ব শক্তির দ্বারা লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত। পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের জন্য সঞ্চিত পাহাড়ের বুকের অন্ন চলে যায় আজ অন্যের গ্রাসে, গাছপালা চেঁছে পাহাড়ের আব্রুহরণ চলছে অহরহ।

পাহাড়ে চিবিদ গাছের জায়গায় আজ জলপাই রঙের ছাউনি, গোলাবারুদের গন্ধে পালিয়ে গেছে রংরাং পাখি। চাকমা কবিতা আজ গৃহচ্যুতি, মৃত্যু হত্যায় নীল এবং একই সঙ্গে প্রতিরোধের সংকল্পে রক্তাক্ত।

কবিতা হলো মানুষের অনুভুতির সারাৎসার। চাকমা কবিতা থেকে তাদের বেদনা ও ক্রোধ বেশ আঁচ করা যায়। কিন্তু তাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন ও এর পটভূমিতে ভাবনা ও প্রতিক্রিয়াকে না পেলে তাদের সামগ্রিক চেহারা দেখবো কি করে? চাকমা সমাজে আধুনিক ব্যক্তির উত্থান ঘটেছে বলেই তো জাতিগত অপমান তাদের গায়ে এভাবে লাগে, প্রত্যেককে স্পর্শ করে ব্যক্তিগতভাবে।

তো এই আধুনিক ব্যক্তিকে সমাজের ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে এবং প্রতিবাদ, অসন্তোষ ও প্রতিরোধের ভেতর জানতে হলে উপন্যাস ছাড়া আর কোন উপযুক্ত মাধ্যম আছে কি?

আধুনিক ব্যক্তির অনুভুতিতে সমাজবোধ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম উপন্যাস। শুধু একক অনুভুতি নয়, কোন একক মহাপুরুষের আধ্যাত্মিক উপলব্দি নয়, কোন সাধক পুরুষের জ্ঞানচর্চা নয়, কিনবা কেবল সামাজিক বিকাশের ইতিহাস নয়, রাজনৈতিক আন্দোলনের কালপঞ্জি নয় কিংবা কেবল আত্মপ্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষণাও নয়, বরং জীবনযাপনের মধ্যে মানুষের গোটা স্বত্বাটিকে বেদনায় উদ্বেগে প্রকাশের দায়িত্ব নেয় উপন্যাস।

এভাবে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যোগাযোগ ঘটে এবং ব্যক্তি মানুষ হবার জন্য তাগিদ পায়। মানুষের সমগ্র স্বত্বাটির প্রতি এরকম মনোযোগ দেওয়া এখন অন্য কোন মাধ্যম কি শাস্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়।

দর্শনের আবেদন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে, কবিতা স্পর্শ করে আবেগকে। বিজ্ঞানের প্রধান বিবেচনাও মানুষ এবং মানুষই। সৃষ্টি, মহাশূন্য ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে আজ বিজ্ঞান জেভাবে নিয়োজিত তারও চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের কল্যাণ।

কিন্তু মানুষের কল্যাণ সাধন যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের দিকে, তার বেদনা ও কষ্টের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানুষকেই ছাড়িয়ে যায় তখন তার সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ আর থাকে না।

আধুনিক ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানেরই তৈরী। কিন্তু এই ব্যক্তির বিশ্লেষণ ও তার স্বপ্নকে লালন করার দায়িত্ব বিজ্ঞান নেয় না। ব্যক্তির নিঃসঙ্গতাকে সনাক্ত করে মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার স্পৃহাকে জাগিয়ে তলার কাজটি নিয়েছে উপন্যাস।

আর থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে স্পেনের সারভান্তেস একটি রুগ্ন ঘোড়ায় চরিয়ে দিয়েছিলেন ডন কুইকসোটকে। কুইকসোটের মৃত্যু তো তার যাত্রা রোধ করতে পারেনি। যেখানেই ব্যক্তির বিকাশ ঘটেছে, উপন্যাস সেখানেই হাজির হয়েছে তার আয়না হয়ে।

কিন্তু ব্যক্তির স্বপ্ন ও সংকটকে কেবল সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিফলন করেই কিন্তু উপন্যাস ফুরিয়ে যায় না, তার ব্যক্তিগত সংকটকে সনাক্ত করে সামাজিক সমস্যা বলে এবং এইভাবে শিক্ষিত সম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে সহায়তা করে। সংগঠিত শিক্ষিত সম্প্রদায় সচেতন হয় গোটা সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে।

চাকমা ব্যক্তির উদ্বোধন টের পাই তার তীব্র অপমানবোধের ভেতর, তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে ও তার পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংকল্পে। এই অপমানবোধ ও প্রতিরোধের স্পৃহা গৌরবান্বিত হয় চাকমা কবিতায়।

কিন্তু কেবল মহিমা ঘোষণায় অনুসন্ধান সম্পন্ন হতে পারে না। উপন্যাসে চাকমা সত্ত্বা কেবল অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া আর সংকল্প দিয়ে চিহ্নিত হবে না, এর সবই আসবে জিজ্ঞাসা আর বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে।

কেবল তখনই চাকমা আধুনিক ব্যক্তি চাকমা ইতিহাস, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যকে জীবনযাপনে নতুন ভাবে সন্ধান করার উদ্যোগ নেবে।

চাকমাদের সমৃদ্ধ কাব্য-উপাখ্যান, অপূর্ব রূপকথা, লোকগীতি সবই নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হবে চাকমা উপন্যাসে। লোক সাহিত্য শুধু মিউজিয়ামে তাখার বস্তু নয়।

চাকমা শিল্পীর কণ্ঠে চাকমা লোকগীতির সুরের আধুনিক প্রয়োগ শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আধুনিক সংকটে তার প্রয়োগ না করতে পারলে তার আবেদন তীব্র হবে কেন? গেংগুলিরা তাদের পূর্বপুরুষের গানের প্রতি ভক্তিতে গদগদ।

তাদের গান যেমন চলছে, তেমনি চলবে। কিন্তু ঐ ভক্তির প্রতি সশ্রদ্ধ হয়েও বলি, ভক্তি ঐতিহ্যকে আটকে রাখে সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে, ঐতিহ্যের গতিতে তা বরং বিঘ্নের সৃষ্টি করে।

ভক্তির জায়গায় জিজ্ঞাসা ও বিশ্লেষণ না এলে আধুনিক চাকমাকে তা কতোদিন আর উদ্বুদ্ধ করতে পারবে? গেংগুলিদের ঐতিহ্যকে জিজ্ঞাসা আর বিশ্লেষণের সাহায্যেই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিকে মেলাতে পারেন চাকমা ঔপন্যাসিক।

আবার বলি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই জিজ্ঞাসা ও বিশ্লেষণের মধ্যেই সংঘটিত করতে পারে গোটা সমাজকে। সপ্নের বিশ্লেষণ ছাড়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার আয়োজন নেওয়া যায় না। জিজ্ঞাসা বঞ্চিত স্বপ্ন এক ধরণের ইচ্ছাপূরণ মাত্র।

উপন্যাসই সাধারণ মানুষের জীবনযাপনেও স্বপ্নকে সনাক্ত করে এবং তার বিশ্লেষণ করে তাকে সংকল্পে, সামাজিক সংকল্পে রূপান্তরিত করার আয়োজন ঘটায়।

উপন্যাস কোন সমস্যার সমাধান দেয় না, কিন্তু মানুষের অন্তহীন সম্ভাবনার দিকে ইংগিত দেখায়। বঞ্চিত, অপমানিত ও নিগৃহীত চাক্মার সংকটে ও সংগ্রামে উপন্যাস তাকে প্রতিফলন ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনবোধকে পরোক্ষভাবে হলেও সংগঠিত করতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করি।

চাকমা সমাজে ব্যক্তির উদ্বোধনের এই ক্রান্তিলগ্নে চাকমা ভাষা ও চাকমা জাতি আজ উপন্যাসের প্রতিক্ষা করছে। অনুপ্রাণিত ও দায়িত্বশীল চাকমা শিল্পী কি মাতৃভূমির এই তৃষ্ণা মেতাবার উদ্যোগ নেবেন?


লেখকঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা