
প্রেম, নীতি ও মূল্যবোধ, আত্মসম্মান, চক্ষুলজ্জা, সমাজ, গৃহ-সংসার, সুযশ-কুযশ, মানবিক-অমানবিক, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতি ভাবাবেগের সমাহারই হলো জীবন। এর মধ্যে প্রেমই পূর্বগামী; সেটি হোক পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ক-বন্ধন, তরুন-তরুণীর যুগল প্রেম, সার্বজনীন মানব প্রেম, জীব-বৈচিত্র্যের প্রতি প্রেম, স্রষ্টার প্রেম বা অনন্ত প্রেম সে যাই হোক। তবে তারুণ্যে যুগলপ্রেম অবধারিত না হলেও একেবারেই অন্যায্য বা নীতিবিরোধী নহে। বরং সেটি জীবনের একটি অধ্যায়। এর মধ্যে দিয়েই মানুষ জীবনের জন্য একটি সুখময় স্বপ্নের বীজ বপন করার চেষ্টা করে থাকে।
জীবনের প্রথম সিকি অধ্যায়ে(যুব বয়সে) প্রায় প্রত্যেক তরুণ-তরুণী একটি অনাবিল স্বপ্নময় ও সুখকর দাম্পত্য রচনার জন্য অনন্য এক প্রিয়জনকে খুঁজে পেতে চায়। সেটি স্বপ্রণোদিত হোক বা অন্য কারো মাধ্যমে হোক। অবশ্য পিতৃ-মাতৃ ও নিকটাত্মীয়ের উদ্যোগে রচিত বন্ধনেও সুখকর দাম্পত্যের নিদর্শণ আমাদের সমাজে বিস্তর পরিলক্ষিত হয়।
তবুও যৌবনে যুগল প্রেম ছিল চিরন্তন। কিন্ত সেটি সামাজিক লোকচক্ষু ও আত্মসম্মানের বিষয়টি একেবারেই অগ্রাহ্য করেনা। তবে প্রেমের নামে দ্বিপাক্ষিক কুরুচিপূর্ণ আচরণ ও সামাজিক বিধি-নিষেধে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ অনেক সময় সুদীর্ঘ খেসারত হয়ে ওঠে জীবনের নিত্য সঙ্গী। একদিকে সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ ও অপরদিকে প্রিয় সংযোগের তীব্র তাড়না। কিন্ত বয়সের ভাবাবেগে যুগলপ্রেম হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য ও অগ্রবর্তী। আবার যুগভেদে এটির আচরণ অনেক সময় ভিন্নতর রুপ ধারণ করে থাকে। আজকাল বিকৃত মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে পবিত্র যুগলপ্রেম একটি আতংকজনক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
স্মরনাতীত কাল থেকে আশির দশকের প্রায় অর্ধাংশ পর্যন্ত তরুন-তরুণীর পারস্পরিক প্রেমময় ভাবাবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে চাকমা লোক-সঙ্গীতের একটি শাখা “উভগীত”এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। তারুণ্যের ভাবাবেগ ছিল যুগে-যুগে দূর্বার ও অপ্রতিরোধ্য। অপরদিকে পারিবারিকভাবে মাতৃ-পিতৃ বা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি কঠোর মান্যতা ও সম্মানজনক মূ্ল্যবোধ। এতদসত্ত্বেও সুশৃংখল ও নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ বয়সের একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে এসে চঞ্চল তারুণ্যকে কঠোরভাবে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তাই সামাজিক লোকচক্ষুর অন্তরালে কাংখিত প্রিয়জনের কাছে নিজেকে তুলে ধরবার অনন্য সেতু-মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় তখনকার সময়ের “উভগীত”।
আড়ালে-আবদালে ইশারা-ইঙ্গিতে নিজের অষ্ফুট প্রেমময় মনোভঙ্গী প্রকাশে আত্মতৃপ্ত না হতে পেরে; অনেকটা বিমূর্ত সাঙ্গীতিক বয়ানে নিজের ভালোবাসার মর্ম কথাটি সুর-ছন্দের মিশেলে প্রকাশিত হত “উভগীত” আকারে। প্রেমময় ইঙ্গিতবাহী মর্মভেদী শব্দ প্রয়োগে ও সৃজনশীল বাক্য বিন্যাসে রচিত কাব্যিক ছন্দের উপর আবেদনময়ী একটি স্বতন্ত্র সুর সংযোজনে এটি গীত হত। এ উভগীত ছিল এক সময়কার তরুণ-তরুণীদের পারস্পরিক প্রীতিময় বন্ধনস্পৃহা প্রকাশের অনন্য প্রতীক। অবশ্য এটি একপ্রকার পালাগানও বটে।
প্রথমতঃ দু’জন তরুণ তরুণী বেশ আপনমনে বা নেপথ্যে একজন আরেকজনের উপর কিছুদিন ধরে আচরনিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তাদের মধ্যে যখন অনেকটা নিশ্চিতভাবে অনুমিত হয় যে; সমস্ত জীবনের জন্য একে অপরের বন্ধন নিরাপদ, তখন পর্যায়ক্রমে তাদের উভয়ের মধ্যে আত্মপ্রকাশ বা মনোসংযোগের বাসনা সৃষ্টি হয়। কিন্ত তখনো তাদের মধ্যে একটি আশা-নিরাশা ও জড়তার মিশ্রিত অনুভূতি কাজ করতে থাকে। ঠিক সে সময় এ উভগীত হয়ে ওঠে অনন্য, একে অপরের মনন সন্ধির অণুঘটক ও রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার একচেটিয়া সম্রাট। রাধামন-ধনপুদি, কুঞ্জধন-কুঞ্জবি, নোয়ারাম-চান্দবি দের স্মরনীয় ও ঐতিহাসিক যুগলপ্রেমে হয়তোবা উভগীতই ছিলো উভয়ের মনোঃসন্ধির প্রাণবন্ত বাহন বা অবলম্বন।
রাণ্যে বেরা, নদীর ঘাটে, পাহাড়ের এক টিলা থেকে অপর টিলায়, সারাদিনের ক্লান্তি ও অবসাদ নিংড়ানো চাঁদনী রাতে নিয়মিতই বাজতে থাকে শ্রুতিমধুর ও আবেদনময়ী গায়কীতে অনুভূতি প্রকাশের সুরেলা বাজনা । পালাক্রমে সলজ্জ অনুভূতি ও ইচ্ছা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এটি কন্ঠে কন্ঠে অণুরণিত ও গীত হয়ে একে অপরের সান্নিধ্য ঘটায়। সঙ্গত হয় আপন মাধুরী মেশানো হেঙগরং আর বাঁশির অনুপম সুর। তাইতো জুম সংস্কৃতি কেবল জুম্মদের নয়; সমস্ত মননশীল ও সৃষ্টিশীল শ্বাশ্বত সংস্কৃতি- প্রেমিকদের কাছে অকৃত্রিম ও অনবদ্য।
কিন্ত কালান্তরে দেশজ বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও আকাশ সংস্কৃতির প্রচন্ড আগ্রাসন এবং স্বকীয় সংস্কৃতির প্রতি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিরবচ্ছিন্ন অবচেতন প্রবণতা ও ঔদাসীন্যের কারণে এ মর্মভেদী ভাষা ও সুরসংযুক্ত উভগীত আজ বিস্মৃতির তলানীতে স্তপীকৃত অবস্থানে উপনীত হয়েছে।
এ রোম্যান্টিক ও ঐতিহ্যবাহী উভগীতকে বিস্মৃতির অতলান্ত থেকে স্মৃতির মৃদু স্পন্দনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে শৈশবে শ্রুত ভাষা ও সুরের স্মৃতিচারণপূর্বক রূপকভাবে “একজোড়া তরুণ-তরুণীর প্রণয়াবদ্ধ হওয়ার পর্যায়ক্রমিক কাহিনী”কে নিম্নোক্ত ভঙ্গীতে নমূনা আকারে উভগীতে রুপ দেয়ার চেষ্টা করেছি।
আশাকরি এ নমূনাটির মাধ্যমে চাকমা লোক-সঙ্গীতের বিপুপ্তপ্রায় অমূল্য সম্পদ “উভগীত” তার হারানো মাত্রা খুঁজে পাবে। তাই চলুন; সে রূপক “একজোড়া তরুণ-তরুণীর প্রণয়াবদ্ধ হওয়ার পর্যায়ক্রমিক কাহিনী”টি “উভগীত” আকারে মরমে উপভোগ করি।
(বিঃদ্রঃ- গানে “গাবুজ্যে” শব্দটি বাংলা শব্দগত অর্থে কোন এক “তরুন”কে এবং গাবুরী মানে কোন এক “তরুণী”কে বুঝানো হয়েছে)।
উভ গীত
[গাবুজ্যে-গাবুরী নাঙে ম’ উভ গীত্তো সাজেয়্যং। চ’ সালে গাবুজ্যেলোয়- গাবুরী কিঙিরী দি-জনে মন পা-পি অলাক।]
গাবুজ্যেঃ কুঝি কুমুরো ঘুণ পোজ্জে, বেড়াদন গাভুরলগ জুন পোজ্জে,
হেংগরঙ আর বাঝিবুও, বেলাবুও লঘে শিঙেবুও।
ফিবির ফিবির বোয়ের বায়, ম’রে দাগদন; ঝাদি আয়।
গাবুরীঃ তোলোয় বিজেলুং বিচ্চেনত, ঘুম-ধ ন এযের চোক্কুনত
সুদো কাদি চরগালোয়, কধা কঙর এধক্ষন মনানদোয়
মোক্কে ভাঙি কলগে, মরেয়্য নেজা-না দা, ত লগে।
গাবুজ্যেঃ আধা পধত ছাড়া ঘর, গায়-গায় যেবার দরাঙর,
ফোগোদি কানাদি চেই থেবে,তম্মা দেলে তুই মের হেবে।
গাবুরীঃ ইজোরো মাধান্দি হেদাক-তুক, সাঙুয়ান লামিম্বোই জুচ-জুচ-জুচ।
চুলত বানি ধুপ হবং, আলছরাবো বুক ভরণ,
কুজি হারু হা্ত ভরণ, ঠেঙত-হারু ঝণাত-ঝণ,
আগাঝর চান-তারা ঝাগে-ঝাক,এযঙর দা তুই মরে বাচ্চে থাক।
(জুন’ পোজ্জে লাঙেল দিগেলি দি-জনে যাদে যাদে)
একসমারেঃ ভরন্দি চানর ছদগত, আধির দি-জনে পত্তানত,
জিরেনি হলা লাঙেলত, বানা দি-জনে জূনপরত,
চেরোকিত্তে জুনিগুন, সাক্ষী আগন তারাগুন,
লাঙেল’ পিদিত জুর-ব, থুবেয়ে কধানি এবার ভাঙি-ক
মোঘোয় কাঙারা চাগ-বাদি, কন্না গোরিবো আরগানি।
গাবুজ্যেঃ মানেয় কুলর সুধোমত, জোড়া বানা পরে জনমত,
শিগের মারি পল্লানে, কারে দেখ্খোচ তুই পত্তমে,
ঘুত্তে মাধাত রাঙি-ক, কারে দিবে চিজি ত-মনান ভাঙি-ক।
গাবুরীঃ জুরি থোয়্যং মনানত, জদন থেলে কবালত।
শিগেরি কুরো আল দাঙর, ভাঙি কবার লাজাঙর।
কামত লামি আক্কলে(আগে-ভাগে), তুই ভাঙি-হ আক্কেনে।
গাবুজ্যেঃ মনত থোয়্যং যত্তনে, নঅ’ কং কন’দিন কাররে।
গাছসো কাবিনে টং টং টং, ন’কোচ চিজি কাররে ভাঙি কঙ
কুঝি রান্যে ভূর বন, গুরত্তুন ধরিনেয় তরে মন।
গোজেন’ নাঙে ফুল দিলুং, ম মন’কধাগান কোই দিলুং।
গাবুরীঃ পানত দিলুং সিবিদি, কিত্তে গরচ দা,তুই মল্লোয় বিগিধি?
দূঃখে মানেয় হা্ড়ভাঙা, মাত্তে পিলে চাড়ভাঙা।
দুলু বাজ’ থুরচুমো, ত’ মন’সত্যগান কুত্তুমো।
জুনি জ্বলদন জুনোমায়, জদন থেলে হামাক্কায়।
মরদ বিশ্বেস ছাবা-সান, আঝা দিনেয় পাজারান।
জুর’ আলু তোগাংগে, ন’ লভে ভিলিনে দোরাংগে।
গাবুজ্যেঃ বান্দরে হেলাক্কোয় মোক্কে থুর,
যেবং তোন তোগা জুর-জুর-জুর।
মেগুলো দেবায় গুজুরে, তরে মনত উদিলে চিত পুরে।
আলু কুড়ি টারেঙত, বুজ-দি ন’ পারং মনানত।
দভা-কাদি যত্তনে, নিত্য দেগং চিজি তরে মুই স্ববনে।
সত্য-ধর্ম কোই দিলুং, গোজেনত্তুন বর চেলুং,
বেদাগি আগা তোগেমবোই, তরে ন’ পেলে মোরিমবোই।
মুরত পোরিনে ভাবি-চা, চিজি ত মন’কধাগান কোই দি-যা।
গাবুরীঃ পানি ভোরি কুম ভরণ, মিলে জিংকানি দূখ ভরণ।
আগ্ পাদাগান ফেলেইয়্যং, বৈদ্য আজুত্তুন গোনেয়্যং।
মনে মনে বাচ্ছেয়্যং, বানা তরে কোচ্ পেয়্যং
দেবা কালা উত্তুরে, দেলে স্ববনে চিত পুরে।
ভাঙি ন-বাচ্চে স্ববনান, গোজেলুং দা তরে ম’ মনান।
কোচ্চে রাদা ডাক কারে, ঘরত গেলে কোমবোই মুই বেবেরে(নানুরে)।
পানি ভরিলুং মালালোই, মনান ভিরুং ভিরুং গরেল্লোই।
বীজ-বিজিদি কুরুমত, কি আঘে কিজেনি কবালত।
উত্তোমাজা বের বুনি, মা-মা শুনিলে কি কভ কিজেনি!
গাবুরীঃ আঝার মাস্যে পানি বান, দর’গরিনেয় মনান্ বান
নন্যে সিলোর পানি কুয়ো, কাদেবং দা তল্লোয় জনম্মো।
শামুক তুলি উজনি, কমলে জোড়া অভ দা, তল্লোই কিজেনি।
গাবুজ্যেঃ গাবুজ্যে-গাবুরী ঝাগে-ঝাক, চিদে ন-গুরিচ চিজি তুই বাচ্চেয় থাক।
বাচ্চুন কাবি কাত্তোনত, বেজি-কিনি বাজারত
বলিত দিমবোই কানবাজা, বান্যে দোগানর ঝাকবাঝা
তদাত ভরণ চিকছড়া, জলতরঙ্গ হা্লছড়া।
ময়-মুরুব্বি পুর-ঘাটত, পাদেয় দিমবোয় মাঘ মাঝত,
সুদো-ঘোচ্চে বেজিমবোই, টেঙা-পয়জে কামেমবোই
ভাত-পানিয়ে ঝালাব্বর, মাছ-সুগুনি থিদব্বর,
রুবোরাদিয়ে ঝোন-ঝোন্যে, ঢুলে দগরে সাজন্যে,
ফুলে-পাগোরে রোংচোঙ্গে, আদাম্যে-পাড়াল্যেয় আল্যেঙ্গে,
ফুল বারেঙ্য ভরিবুও, মা-মা তরে ঘরত তুলিবুও।
কুজি মোক্কে থুর ভাঙি, দিবো ঈশ্বরবো জুর বানি,
বাজেই তুলি তুগুনত, বজর বিদি যেই ফাগুনত।
দি-জনে একসমারেঃ দিলুং ভাত জোড়া গঙারে, মলে মরিবং সমারে।
চিবুং চাজি গব’ হা্র, গোজেন’ চরণত হা্জার বার।
চান-তারাগুন সাক্ষী লং, তল্লোয় হা্রাহা্রি ন’ অভং।
কালা ভঙরা মারিবং, আবদ-বিবদত্তানি কাদেবং।
ধুধুক বাজেয় ঢং ঢং ঢং, স্বর্গ সুগত ভাজিদং।
লেখক: ভদ্র সেন,
চাকমা সাধারন সম্পাদক, আরাঙ, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।