চাকমা জনগোষ্ঠীর বিবাহ (মেলা)

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

2211

featured image

বিবাহের সংজ্ঞা : আদিবাসী চাকমা সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। চাকমা সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে- চুমুলাঙ, জদনবানাহ এবং খানা সিরানা অনুষ্ঠান।

এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত চাকমা দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও জৈবিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। উপরোক্ত রীতি অনুসরণ ব্যতীত চাকমা সমাজে নর-নারীর জৈবিক মিলন, একত্রে বসবাস ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয়, বিধায় তা প্রথাসিদ্ধ নয় বলে গণ্য হয়।

সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে চাকমা সমাজে ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণ লক্ষ্য করা গেলেও ধর্মীয় রীতির সাথে চুমুলাঙ, জনবানাহ, খানা সিরানা ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা :

বিবাহের রীতি:

ক) প্রস্তাব প্রেরণ ও মতামত (সম্মতি বা অসম্মতি) সংগ্রহ: চাকমা সমাজে পাত্রের অভিভাবক নিজ উদ্যোগে অথবা নিকটাত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিবাহযোগ্য ও পছন্দনীয় পাত্রীর খোঁজ নেয়।

বিবাহযোগ্য ও পছন্দসই পাত্রীর খোঁজ পেলে আত্বীয় বা পাড়ার কোনো বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে সেই পছন্দনীয় পাত্রীর বাড়ীতে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছার কথা পৌঁছে দেওয়া হয়। চাকমা ভাষায় এ ধরণের ইচ্ছা প্রকাশকে ‘উল লনা’ (খোঁজ নেয়া) বলা হয়।

পাত্রীপক্ষের জবাব ইতিবাচক হলে বিবাহের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পর্বগুলো শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে বিবাহের চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়। যদি প্রস্তাবের বিপরীতে নেতিবাচক জবাব আসে তাহলে সেই পরিবারের সাথে বিবাহ সম্পর্কের উদ্যোগ সেখানেই শেষ হয়।

ব্যাখ্যা (১): পাত্রপক্ষের প্রস্তাব পাওয়ার পর পাত্রীপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে জবাব দেয় না। পরিবারের ঘনিষ্ট আত্মীয় যথাঃ- পাত্রীর পিতৃকুল ও মাতৃকুলের বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের মাধ্যমে পাত্রের পরিবারের আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, পাত্রের ব্যক্তিগত চরিত্র ও গুণাবলী সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর নেয়।

এতে যদি পাত্রের পরিবারের সাথে (বৈবাহিক) সম্পর্ক স্থাপন না করার মতো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পায়, তাহলে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষের প্রস্তাবে নেতিবাচক সাড়া দিতে পারে। আর যদি পাত্রপক্ষের পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি দেয়ার মতো অনুকুল মনে হয়, তাহলে পাত্রীপক্ষ ইতিবাচক সাড়া দেয়।

একবার সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে মত দেয়ার পর বিবাহের চূড়ান্ত অনুষ্ঠান পর্বের পূর্ববর্তী ধাপ/পর্বগুলো শুরু হয়ে যাওয়ার পর পাত্রীপক্ষ তাদের সম্মতি প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। অনুরূপভাবে পাত্রপক্ষও বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে পারে না।

কারণ, পাত্রী নির্বাচন ও বিবাহ পূর্ব আনুষ্ঠানিকতা বা পর্বগুলো শুরু হয়ে যাওয়ার পর ঘটনা সমাজে জানাজানি হয়ে যায়। তাই যে কোনো পক্ষ বিবাহের উদ্যোগ থেকে সরে গেলে সমাজে অপরপক্ষের সম্মানহানি ঘটে।

পাত্র বা পাত্রী যে পক্ষই অপরপক্ষের মানহানি বা সম্মানহানি ঘটায় সে পক্ষই অপরপক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ‘লাজভার’ দিতে বাধ্য।

কেইস রেফারেন্স: বিয়ের জন্য নির্বাচিত পাত্রীকে আশীর্বাদের পর একতরফাভাবে আশীর্বাদ ভেঙ্গে দেয়া কিংবা আশীর্বাদ ভেঙ্গে দিয়ে অন্য পাত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা চাকমা প্রথাগত আইন অনুসারে গুরুতর অপরাধ।

রাঙ্গামাটি শহরের বাসিন্দা নরেশ চাকমা ও তৃপ্তি চাকমার (তিনু) বিবাহের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ ভেঙ্গে দেওয়া সংক্রান্ত বহুল আলোচিত একটি বিরোধ নিয়ে চাকমা রাজ আদালতে বিচার হয়।

চাকমা রাজ আদালতের মোৰ্তফা মোকদ্দমা নং- ১/২০০৬ দ্বারা রাজা দেবাশীষ রায় চাকমা সমাজের বিবাহ রীতি ও প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। চাকমা সমাজের জন্য যুগোপযোগী অনেক দিক নির্দেশনা এ রায়ে তুলে ধরা হয়।

চাকমা রায় আদালতের রায়ের বিবরণ অনুসারে গুনেন্দু বিকাশ চাকমার কন্যা তৃপ্তি চাকমা (তিনু)-এর সাথে অমিয় প্রসাদ চাকমার পুত্র নরেশ চাকমার আশীর্বাদ হয়। এক পর্যায়ে নরেশের মা জ্যোতি প্রভা চাকমা একতরফাভাবে আশীর্বাদ ভেঙ্গে দেন এবং অন্য পাত্রীর সাথে ছেলের বিয়ে সম্পাদন করেন।

এতে তৃপ্তি চাকমা (তিনু) শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং পরিবারের মান-সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে বলে সুবিচার প্রার্থনা করা হয়। এই মোকদ্দমার বিষয়ে স্থানীয় সচেতন নারী সমাজ, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটি, আদিবাসী সমাজ সচেতন প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে উপযুক্ত প্রতিকার দাবী করে স্মারক লিপি দেওয়া হয়।

চাকমা রাজ আদালতের রায় অনুসারে একতরফাভাবে আশীর্বাদ ভাঙ্গার ঘোষণা দিয়ে নরেশ চাকমা, তার পিতা ও মাতা যথাক্রমে অমিয় প্রসাদ চাকমা ও জ্যোতি প্রভা চাকমা, চাকমা সামাজিক আইন, প্রথা ও রীতিনীতি লঙ্গন করেছেন।

এতে একদিকে তৃপ্তি চাকমার অধিকার খর্ব করে তার চরিত্রে ভিত্তিহীনভাবে ও প্রথা বিরুদ্ধভাবে কলঙ্ক দেবার সামিল হয়েছে এবং অন্যদিকে পিতা গুনেন্দু বিকাশ চাকমার পরিবারের সামাজিক মর্যাদাকেও ভিত্তিহীনভাবে ও প্রথা বিরুদ্ধভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে।

সামাজিকভাবে আশীর্বাদ না ভেঙ্গে আশীর্বাদকৃত পাত্রী ব্যতীত অন্যের সাথে বিবাহ সম্পাদন করে নরেশ চাকমা ও তার পরিবার চাকমা সামাজিক আইন ও প্রথা লঙ্ঘন করেছেন।

এতে সমাজের প্রতি তাদের সামাজিক দায়িত্বে বরখেলাপ হয়েছে। সামাজিকভাবে আশীর্বাদ না ভেঙ্গে আশীর্বাদকৃত ব্যক্তি ব্যতীত অন্যের সাথে বিবাহ সম্পাদনে নরেশ চাকমার ভূমিকায় প্রত্যক্ষ সহায়তা প্রদান করে কিশলয় চাকমা, চাকমা সামাজিক আইন ও প্রথা বিরুদ্ধ আচরণে লিপ্ত হয়েছেন।

এজন্য রাজ আদালত নরেশ চাকমাকে চল্লিশ টাকা জরিমানাসহ লাজভার হিসেবে শুনেন্দু বিকাশ চাকমাকে পাঁচশত টাকা ও বেআইনীভাবে আশীর্বাদ ভঙ্গের কারণে আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে খরচাদির ক্ষতিপূরণ স্বরূপ গুনেন্দু বিকাশ চাকমাকে আরও দশ হাজার টাকা প্রদানের নির্দেশ দেন।

রাজ আদালতের বিচারে সামাজিক ও মানসিক আঘাত প্রদানের কাছে আশীর্বাদের সময় তৃপ্তি চাকমাকে দেওয়া অলংকারাদির উপর নরেশ চাকমার পরিবারের অধিকার লোপ করা হয়। অমিয় প্রসাদ ঢাকার প্রতি চল্লিশ টাকা জরিমানাসহ লাজভার ও ক্ষতিপূরণ বাবদ নির্ধারিত অর্থের দায়ভার বর্তানো হয়।

জ্যোতি প্রভা চাকমাকে ত্রিশ টাকা ও কিশলয় চাকমাকে বিশ টাকা জরিমানা করা হয়। লাজভার ও ক্ষতিপূরণের অর্থ চাকমা রাজা আদালতের মাধ্যমে এবং জরিমানা রাজ আদালতে প্রদানের জন্য রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, তুপ্তি চাকমার সাথে আশীর্বাদ ভেঙ্গে দেবার পর কিশলয় চাকমার কন্যার সাথে নরেশ চাকমার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

 ব্যাখ্যা (২): পাত্রপক্ষের প্রস্তাব (একবার) গৃহীত হওয়ার পর অন্য কোনো পক্ষ আর সেই পাত্রীকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাতে পারে না। যদি কেউ সেই পাত্রীর বিবাহের উদ্যোগের কথা জেনেও তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠায়, তাহলে তা সমাজে শান্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

কনে দেখা (বৌ চা যানা): পাত্রীপক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর পাত্রপক্ষ থেকে পাত্রীপক্ষকে জানিয়ে নির্ধারিত একটি শুভদিনে পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন রোক সামর্থ্য অনুযায়ী মদ, পান, সুপারী, নারিকেল (কমপক্ষে একজোড়া), শুটকি মাছ, কয়েক প্রকারের পিঠা নিয়ে পাত্রীর বাড়ীতে যান এবং সেদিনই বিবাহের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন।

পাত্রীপক্ষের আনুষ্ঠানিক সম্মতি লাভের পর পাত্রীপক্ষের দাবী-দাওয়ার বিষয়গুলো চূড়ান্ত করার জন্য। পাত্রপক্ষকে কয়েকবারই পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে যেতে হয়।

উভয়পক্ষের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনে কনে দেখার দিন-তারিখ ঠিক করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই বিবাহের শুভ দিনক্ষণ নির্ধারণ ও পাত্রীপক্ষের দাভা (পণ) যথাঃ- কনে সাজানোর পোশাক, অলংকারের প্রকার, সংখ্যা এবং প্রত্যেকটি অলংকারের গুন নির্ধারণের জন্য পাত্রপক্ষের তরফ হতে দ্বিতীয়বার পাত্রীপক্ষের বাড়ী যাওয়ার প্রয়োজন হয়।

দ্বিতীয়বার পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে যাওয়াকে চাকমা কথায় ‘দ্বিপুর’ (দ্বিতীয় সফর) বলে। ধাবা বলতে নগদ টাকা, চাউল ও দ্রব্যসামগ্রী, যেমনঃ- কিছু নগদ টাকা, ২০/২৫ সের বা এক/দুই মণ চাউল, বিবাহ উপলক্ষে ভোজের জন্য কমপক্ষে একটি শুকর ইত্যাদি দাবী করা হয়ে থাকে।

উভয়পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই দাভার পরিমাণ নগদ টাকায় ও অন্যান্য সামগ্রী নির্ধারণ করা হয়। অনুরূপভাবে পাত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া অলংকারাদির প্রকার ও প্রত্যেকটির ওজনও উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।

দ্বিপুর বা দ্বিতীয়বার পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে গিয়েও বিবাহের চুড়ান্ত দিন, তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই তৃতীয়বার যাওয়ার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে।

সাধারণতঃ তৃতীয়বারে পাত্রীর পক্ষের বাড়ীতে যাওয়ার পরই বিবাহের চুড়ান্ত দিন, তারিখ নির্ধারণ হয়ে যায় বলে এই পর্বকে মদ পিলাং গজানি (মদের বোতল গছানো) বলা হয়।

ব্যাখ্যাঃ চাকমা সমাজে পাত্রপক্ষই কনেপক্ষকে পণ দেয়। ‘দাভা’ হল বরপক্ষের তরফ হতে কনেপক্ষকে দেয়া পণ। তাছাড়া কনের অলংকারাদিও বরপক্ষকে (কনেকে) দিতে হয় এবং তাও কনে পক্ষের দাবী অনুযায়ী।

চাকমা ভাষায় কনেপক্ষকে দেয় পণ (দাভা) বরপক্ষের অতিরিক্ত খরচ (উবোর খুজ্জি) হিসেবে ধরা হয়। পাত্রীপক্ষের দাবী এবং পাত্রপক্ষের সামর্থ্য অনুযায়ী যত প্রকার ওজনের অলংকারাদি পাত্রপক্ষ দেয়, তাকে চাকমা ভাষায় ‘বোয়ালি’ বলা হয়।

থক ধরা যানা (বিবাহের প্রস্তুতির ব্যাপারে শেষবারের মত খবর নেয়া): বিবাহের দিন, তারিখ নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর উভয়পক্ষে বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি যথাঃ- বিবাহের ভোজে নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা, ভোজের মাছ-মাংসের পরিমাণ, নিমন্ত্রিতদের জন্য চোলাই মদ, চাল, ডাল ইত্যাদি খরিদ করা শুরু হয়ে যায়।

বিয়ের নির্ধারিত তারিখের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে পাত্রীপক্ষের দাবীকৃত সাভা যথাঃ- শূকর, চাউল ও নগদ টাকা এসব পাত্রপক্ষের পরিবারের একজন সদস্য বা নিকটাত্মীয় নিজ দায়িত্বে পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে পৌছে দেয়।

এছাড়াও নির্ধারিত দিনে পাত্রীপক্ষ বিবাহ অনুষ্ঠান বা মেলা (বিবাহ) সম্পন্ন করতে প্রস্তুত আছে কিনা বা পরিবারের সবাই সুস্থ আছে কিনা কিংবা কোনো অনিবার্য কারণে বিবাহের দিন পিছিয়ে দিতে হবে কিনা ইত্যাদি খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য পাত্রপক্ষের কোনো একজন আত্মীয়কে অনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে যেতে হয়।

ব্যাখ্যাঃ এটি বিবাহের একটি আনুষ্ঠানিক পর্ব না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উভয়পক্ষের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই নির্ধারিত তারিখে বিবাহ (মেলা) সম্পন্ন করা যায়।

এটি অস্বাভাবিক কিছু নয় যে, বিবাহের নির্ধারিত তারিখের আগেই পাত্র বা পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে বা কোনো ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয়ের বাড়ীতে কারোর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া, এমনকি কোনো একজনের মৃত্যু বা গুরুতর বিপত্তি দেখা দিতে পারে।

এই অনানুষ্ঠানিক পর্বকে ‘থক ধরা যানা’ বলা হয়। তবে আধুনিক (চাকমা) সমাজে এটি অনেকটা বিবাহের একটি আনুষ্ঠানিক পর্বে পরিণত হয়েছে।

মেলা/বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানঃ মেলা (আনুষ্ঠানিক বিবাহ পর্ব):

চাকমা মূল বিবাহ অনুষ্ঠানের নিম্নোক্ত কয়েকটি পর্ব রয়েছেঃ-

(ক) কনে/বৌ আনতে যাওয়া (বরযাত্রী): পাত্র ও পাত্রীপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ‘বৌ হজা যেয়ে’ (বৌ আনার দল) ও ‘বৌ বারে দিয়া’ (বৌকে বরের বাড়ী পৌছানো) দলের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করে নেয়।

বরপক্ষ থেকে ‘বৌ হজা যেয়ে’ দল বেজোড় সংখ্যক বৌ আনার জন্য যায়। ‘বৌ হজা যেয়ে’ ও ‘বৌ বারে দিয়া’ দলের সদস্যদের মধ্যে যুবকযুবতীরা সংখ্যায় বেশী থাকে। উভয় দলের বাকী সদস্যদের মধ্যে থাকে বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা, যারা বর ও কনেপক্ষের প্রভাবশালী ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

তবে বরপক্ষের কয়েকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য সদস্য থাকেন তারা হলেন যথাক্রমেঃ- সালা (ছায়লা), বৌ আহুদানি (কনের পথ প্রদর্শক) ও “ফুর বারেং বুগনি’/‘ফুল বারেং বুগনি’ (কনে সাজানোর পোশাক ও অলংকারাদি বহনের জন্য কারুকার্যময় ঝুড়ি বহনকারী)।

‘বৌ আহ্দনি’ হলেন বরের ঠাট্টা সম্পর্কীয় যথাঃ- আপন বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নানু (নানী) বা অনুরূপ সম্পর্কের একজন শ্ৰেীড়া মহিলা। ‘সাবাল’ হলেন বরের ঠাট্টা সম্পর্কীয় ঘনিষ্ঠ আত্বীয় বিশেষত।

আপন অথবা কাকাতো, জেঠাতো বোনের স্বামী (ভগ্নিপতি) সম্পর্কের একজন সমর্থ পুরুষ যিনি বরপক্ষ ও কনেপক্ষের যুবতী মেয়েদের সাহায্যে কনেকে অলংকারাদি পরান। তাকে অবশ্যই স্বপত্নীক হতে হয়।

তার আরেকটি কাজ হলো, কনের পিতা-মাতা বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মতিতে কনেকে বাপের বাড়ী থেকে আনা, এমনকি প্রয়োজনে কনের আবেগকে সামল দিয়ে তাকে আনা।

(খ) বৌ তুলানা (বধূবরণ): কনে নিজ বাড়ী থেকে বরের বাড়ী পৌছুলে সদর দরজার দু পার্শ্বে স্থাপিত কলসির উপর রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং বাড়ীতে বৌ তোলার (বধূবরণ) অনুমতি দেয়া হয়।

বৌ তোলার অনুমতি পাবার পর বরের ছোট ভাই বা ছোট বোন অথবা বরের নিকট আত্মীয় সম্পর্কের একজন ছেলে অথবা মেয়ে বাড়ীর মূল প্রবেশ পথে একটা পিড়ি পেতে কনের পা ধুইয়ে দেয়।

অতঃপর বরের মা (যদি সধবা হন) অথবা অন্য একজন সধবা বয়স্ক মহিলা এক গুচ্ছ দীর্ঘ সাদা সূতরি একপ্রান্ত কনের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে বেঁধে দেয় এবং সূতাগুচ্ছের অপর প্রান্ত ধরে কনেকে বরের বাড়ীতে প্রবেশ করায়।

তৎপরে প্রবেশ পাথের দুইপাশে রাখা দুটি কলসির গলায় বাঁধা সাত নাল সুদা (সাত প্রস্থ সুতা) কেটে দেয়। এরপর বৌকে ফুল ঘরে (ফুল দিয়ে সাজানো কনের জন্য নির্ধারিত কক্ষে) নিয়ে যাওয়া হয়।

মন্তব্যঃ বধুবরণ বা বৌ তোলা অনুষ্ঠানে বাড়ীর সদর দরজা বা প্রধান প্রবেশ পথে যে দুটো পানি ভর্তি কলস রাখা হয়, সেগুলোকে ‘মঙ্গল কলসি’ মনে করা হয়। আর সেই মঙ্গল কলসির ঢাকনার উপর মোমবাতি বা সলতে (প্রদীপ) জ্বালানো হয়।

বন্ধু বরের বাড়িতে প্রবেশের পর, কলসির গলায় বাঁধা সুতা কেটে দেয়ার পর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে কনেকে এভাবে বাড়ীতে তোলা হয়। মঙ্গল কলসির ঢাকনার উপর রাখা মোমবাতি বা সলতের আগুন যাতে বিপত্তি না ঘটায় সেভাবে সতর্ক থেকে কনেকে সাতনাল সুতার উপর দিয়ে ডিঙ্গিয়ে হেঁটে বাড়ীতে প্রবেশ করা অন্যতম রীতি।

চুমুলাংচুলাংপুজা): চাকমা সমাজে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান হলো চুমুলাং। ‘চুমুলাং’ অনুষ্ঠানে একজন ওঝা বা পুরোহিতের দরকার হয়। তাকে বর-কনের উপরিস্থ ‘খেইল্যা কুদুম’ (বিশেষ সম্পর্কীয়) হতে হয়।

চুমুলাং-এর সময় একই বেদীতে দুটি পুজার ঘট বসানো হয়। বরের জন্য নির্দিষ্ট ‘সামমুয়া’তে চাল ও কনের জন্য দেওয়া হয় নি। ‘সাশমুয়া’ হলো বাঁশ-বেতের তৈরী ঢাকনাযুক্ত তৈরী বেতের পাত্র।

চুমুং পুজায় একটি শুকর, একটি মোরগ ছোট দুটি মুরগী ও মদ দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। তবে তৎ পরির্বতে সাত জাদি (সাত প্রকার) ফুল দিয়েও চুমুলাং/চুঙুলাং পূজা করা হয়।

ঐ পূজার ওঝা মন্ত্রপাঠ করে থাকে। চুমুলাং এর অন্যতম দেবী হলেন পরমেশ্বরী। চুমুলাং পুজার মাধ্যমে নব দম্পতির দাম্পত্য জীবন শুরু করার জন্য সমাজের উপস্থিত সকলের সম্মতি গ্রহণ করতে হয়। চুমুলীং পুজার পরিচালনাকারী ওঝা বিয়ের একজন প্রধান সাক্ষী রূপে গণ্য হয়ে থাকে।

জদনবানাহ: চাকমা সমাজে বিয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নাম জনবানাহ। ‘জদনবানাহ’ এর অর্থ হলো, বর-কনের জোড়া বাঁধা বা জোড়া বন্ধন। এই অনুষ্ঠানটি মূলতঃ সামাজিক আচার নির্ভর।

এতেই বর-কনে সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। এখানে মন্ত্রোচ্চারণের কোনো বালাই নেই। বরের বড় ভগ্নিপতি সম্পৰ্কীয় একজন ‘সাবালা’ এসে নবদম্পতির জন্য সাজানো একটি কক্ষে বরের বামে কনেকে বসিয়ে উচ্চস্বরে বিয়েতে উপস্থিত জনমন্ডলীর মতামত প্রার্থনা করে- ‘অমুক আর অমুকের জদনবানি দিবার উঘুম আঘেনে নেই’।

অর্থাৎ অমুক আর অমুক বর-কনের জোড়া বাধার হুকুম (অনুমতি) আছে কিনা, সবাই তেমনি উচ্চস্বরে ‘আছে-আছে’ বলে স্বীকৃতি জানালে সেই সাবালা ব্যক্তিটি সাত হাত লম্বা এক খন্ড সাদা বস্ত্র দিয়ে বর-কনে উভয়ের কোমরে জড়িয়ে বেঁধে দেয়।

সমাজে যাতে গোপনে কোনো অবৈধ বিয়ে হতে না পারে সেজন্য এরূপ বিধি-বিধান চালু রাখার মূখ্য উদ্দেশ্য। আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার পরে আবার সমাজের অনুমতি নিয়ে বাঁধন খুলে দেয়া হয়।

উপবিষ্ট বর আর কনে তখন তড়িৎ গতিতে যার যার আসন থেকে উঠে দাঁড়ায়। সমাজের বিশ্বাস, আসন থেকে যে আগে উঠতে পারে সেই সারাজীবন অপরজনের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারে

খানা সিরানা/খানা সিরেদেনা: খানা সিরানা/খানা সিরেদেনা- এর অর্থ হলো সমাজের দায়-শোধ করা। বিবাহ কার্যে সমাজের স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে বর সমাজের কাছে ঋণী হয়। তার এই ঋণ বা দায়শোধ করতে সে বাধ্য।

খানা সিরানার মাধ্যমে সমাজের কাছে তার এই দায়-শোধ হয়ে যায়। বিয়েতে সামর্থ্য অনুসারে একটি সামাজিক খানা দেয়া (ভোজের আয়োজন) এক প্রকার বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় ঘটলে সামাজিক দন্ডের বিধান আছে।

বিয়ের খানায়, ‘টক’ জাতীয় একটি অপরিহার্য তরকারী (ব্যঞ্জন) থাকে, যাকে চাকমা ভাষায় ‘খাদা’ বলা হয়। খাদা খাওয়া না হলে ‘খানা সিরানা’ ব্যাপারটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই ‘খানা সিরেদেনা’ কাজ সামাজিক বৈধ বিবাহের অপরিহার্য অঙ্গ।

খানা সিরানার পর এই বিবাহ সম্পর্কে সমাজের আর কোনো প্রকারের আপত্তি বা দাবী-দাওয়া থাকে না। যারা বিয়ের ‘খানা সিরেদেনা’ পর্ব সমাপ্ত করে না তাদের মৃত্যু হলে সমাজের লোকেরা তাদেরকে শ্মশানে নেয়ার সময় কাঁধের নীচে করে নেয়া হয়, কাঁধে তুলে না।

ব্যাখ্যা (১): চাকমা ভাষায় ‘খানা’ অর্থ ভোজ বুঝায়। ‘খানা সিরেদেনা/খানা সিরানা’ অর্থে বিবাহ উপলক্ষে বর-কনের কাছে সমাজের প্রাপ্য ভোজের দাবী মিটিয়ে দেয়া।

অর্থাৎ চুমুলাং ও জদনবানাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবনযাপনের জন্য নবদম্পতি সমাজের কাছ থেকে যে অনুমতি লাভ করে তার ভোজের বিনিময়ে আয়োজনের দ্বারা সমাজের কাছে তাদের দায়-শোধ হয়।

ব্যাখ্যা (২): নিমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার পর হলো বিবাহ কাজের চুড়ান্ত অনুষ্ঠান, এটিকে চাকমা কথায় বলে ‘খানা সিরেদেনা’।

এই অনুষ্ঠানের সময় বর-কনে উভয়পক্ষের কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি এবং স্থানীয় পাড়া বা সমাজের বিশিষ্ট গণ্যমান্য কয়েকজন এক সাথে বাড়ীর একটি স্থানে মন্ডলাকারে মুখোমুখি হয়ে বসেন।

সেখানে মদের বোতলসহ রান্না করা মোরগ/মুরগী ও শূকরের মাংস একটি মেজাংএর উপর ঢাকনা দিয়ে সাজিয়ে মলাকারে আসীন সবাইকে প্রণাম করে বর-কনেকে পরিবেশন করতে হয়।

চাকমা সমাজে এরূপ আনুষ্ঠানিকতাকে ‘গোজে দেনা’ (গছিয়ে বুঝিয়ে দেয়া) বলে। বর-কনের ‘খানা সিরেদেনা’ কাজে সাবালা’কে সাহায্য করতে হয়। এই কাজ শেষ হলে সাবালা’র দায়িত্ব শেষ হয়। ‘খানা সিরেদেনা’ অনুষ্ঠানটি সামাজিক বিবাহের অপরিহার্য অঙ্গ।

বরের শ্বশুরালয় গমন (বেষুত ভাঙ্গা যানা): বিবাহ কার্য সম্পন্ন হবার পরের দিন, অগত্যা দ্বিতীয় দিনে বর ও নববধূকে কনের পিতার বাড়িতে যেতে হয়। এই যাবার নাম চাকমা কথায় ‘বেষুত ভাঙ্গা’ বলে।

এই বেষুত ভাঙ্গার কাজ সম্পন্ন না করে নবদম্পতি সহবাস ও এক্ষত্র বসবাস করতে পারে না। এমনকি ‘বেষ্ণুত ভাঙ্গা’ সম্পন্ন না করে বর ও নববধূর অন্য কারো বাড়িতে যাওয়া নিষেধ।

বেষুত ভাঙ্গা যাবার সময় সাধারণতঃ নবদম্পতি বাড়িতে তৈরী নানা রকমের পিঠা শ্বশুরালয়ে নিয়ে যায়।

কোনো কারণে কনের পিতার বাড়িতে নির্দিষ্ট সময়ে বেষুত ভাঙ্গা’য় যাওয়া সম্ভব না হলে নিকটস্থ কনের স্বগোত্রীয় গুরুজন সম্পৰ্কীয় কোনো পুরুষ আত্মীয়ের বাড়িতে বেষুত ভাঙ্গা সম্পন্ন করা বিধেয়।

তাও সম্ভব না হলে চিরসবুজ ছায়াযুক্ত গাছের ছায়ার তলে বেষুত ভাঙ্গার কাজ সম্পন্ন করার বিধি আছে। যথাসময়ে বেষুত ভাঙ্গার কাজ সম্পন্ন হলে বাড়িতে নববধূসহ ‘বুরপারার’ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। অধুনা ‘বুরপারার’ পরিবর্তে বৌদ্ধ ভিক্ষু (পুরোহিত) দ্বারা ফারেন্স (মন্ত্র) শুনা হয়।

ব্যাখ্যা: নির্দিষ্ট দিনে পাত্রের শ্বশুরালয়ে গমনের রীতি বর্তমানে অনেকটা শিথিল করা হয়েছে। সাধারণতঃ বিবাহের পরের দিনই বর তার নববধূকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ী যায়।

বর্তমানে নবদম্পতিকে ‘বেষুত ভাঙ্গা’ উপলক্ষে কনের বাড়ীতে একদিনের বেশী থাকতে হয় না। যেদিন যাবে সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারে। কনের পিতার বাড়ীতে রাত্রি যাপনেরও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

সম্ভবতঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে অতীতে নবদম্পতিকে বেষুত ভাঙ্গার আনুষ্ঠানিকতায় কনের পিত্রালয়ে কয়েকদিন থাকতে হতো। হয়তো বা আসা-যাওয়ার পথেও দু/একদিন সময় লেগে যেতো।

তাই বেষুত ভাঙ্গা সারতে ৩/৪ দিন লাগতো। যোগাযোগের এই বাধা বা অসুবিধা দূরীভূত হবার ফলে নবদম্পতি কনের পিত্রালয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে প্রথম রাত্রি যাপনের রীতি শিথিল করা হয়েছে।

ঘরজামাই (জামেই উদানা): পাত্রকে ঘরজামাই তুলে বিয়ের রীতিও চাকমা সমাজে সামাজিক নিয়মিত বিবাহ হিসেবে স্বীকৃত। তবে এ ধরণের বিবাহ আড়ম্বরপূর্ণ হয় না এবং পাত্রের কাছে পাত্রীর পিতার কোনো কিছু দাবী থাকে না।

পাত্রীর বাড়ীতে ঘরজামাই ওঠার পর সামাজিক নিয়মে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। সাধারণতঃ পুত্র সন্তানের অবর্তমানে কিংবা পাত্রপক্ষের আর্থিক অসামর্থ্য বা উপযুক্ত অভিভাবক না থাকার কারণে ঘরজামাই তোলা হয়।

 শিগোলী (দেনা): চাকমারা, বিশেষতঃ অবস্থাপন্ন লোকেরা অতীতে তাদের ছেলে/মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছ থেকে দর্শনী (অর্থ) পেতেন, যদিও সেটা একেবারে বাধ্যতামূলক ছিল না।

চাকমা ভাষায় এই দর্শনীর (অর্থ) প্রদানকে ‘শিগোলী’ বলা হয়। এই অর্থের কোনো নির্দিষ্ট অংক নির্ধারণ করা থাকে না। আমন্ত্রিত অতিথিরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এই দর্শনী দিয়ে থাকেন। একটু অবস্থাপন্ন লোকেরা নিজের আর্থিক সামর্থ্য প্রদর্শনের লক্ষ্যে একটু বড় অংকের শিগোলী দিয়ে থাকেন।

এক্ষেত্রে প্রায় সবাই সমাজে নিজের মানসম্মান রক্ষার্থে সামর্থ্যের মধ্যেই শিগোলী দিয়ে থাকেন। ১৯৫৮-৫৯ সনে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়ে তঙ্কালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে, এতে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো প্রায় ভেঙ্গে যায়।

এর পরিণতি স্বরূপ তারা তাদের অধিকাংশ সামাজিক রীতিনীতি হারিয়ে ফেলে। অর্থনৈতিক অবস্থায় কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে পাবার পরই তারা তাদের সেই পুরোনো সামাজিক রীতিনীতি পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসে। বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় এই শিগোলী প্রথা আবার চালু হয়েছে।

শিগোলী প্রথা সম্পর্কে বর্তমান মনোভাব: প্রথা হিসেবে শিগোলী বর্তমান চাকমা সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলন না থাকলেও তা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি। গ্রাম সমাজে নগদ টাকায় যে শিগোলী দেয়া হয়, সেই প্রথা শহরাঞ্চলের শিক্ষিত সমাজেও ভিন্নভাবে চালু আছে বলা চলে।

শহরের বিয়ে অনুষ্ঠানে সাধারণতঃ বর ও কনেপক্ষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা যথাঃকাকা-কাকী, মামা-মামী, বড় ভাই-বোন, সামর্থ্য অনুযায়ী বিশেষতঃ কনেকে সোনার এক প্রস্থ বা একাধিক গয়না অথবা কাপড়-চোপড়, যথাঃ- শাড়ী-চাদর ইত্যাদি উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন।

এছাড়া বরকনের বন্ধু-বান্ধবীরাও ডিনার সেট, টেলিভিশন, নিত্য ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী, শাড়ী, শার্ট-প্যান্টের কাপড়, রান্নার পাত্র ইত্যাদি উপহার দিয়ে থাকেন।

এসব দ্রব্য-সামগ্রীও নগদ টাকার পরিবর্তে একধরণের শিগোলী। তবে নগদ টাকায় শিগোলী যেমন সামাজিক রীতি অনুসারে অনেকটা বাধ্যতামূলক, উপহার সামগ্রী সে রকম বাধ্যতামূলক নয়।

নবদম্পতিকে তাদের নূতন সংসার জীবনে অনেকটা উৎসাহ ও প্রেরণা যোগানোর উদ্দেশ্যেই এ ধরণের উপহার সামগ্রী দেয়া হয়ে থাকে বলা যায়।

দুধলী তেঙা দেনা :পাত্রী নির্বাচনের পর বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে পাত্রীপক্ষের দাবী-দাওয়ার বিষয়টিও পাত্রীপক্ষের সাথে ফয়সালা করে নিতে হয়। পাত্রীপক্ষের (দাবীর) যুক্তি হল যে, পিতা অন্ন, বস্ত্র, স্নেহ, মমতা দিয়ে কন্যাকে লালন-পালন করেছেন, তিনি কন্যার ভরনপোষণ ও লালন-পালনের ব্যয় হিসেবে পাত্রপক্ষের কাছে তার ইচ্ছানুযায়ী নগদ টাকায় একটি অংক অথবা অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রী কনেপণ হিসেবে দাবী করতে পারেন।

অন্যদিকে, কনের মাতাও জন্মকাল থেকে দুধ খাইয়ে তার কন্যাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং বড় করেছেন। তিনিও সেজন্য নগদ টাকা দাবী করতে পারেন এবং তা দেয়া হয়ে থাকে।

মেয়েকে দুধ খাওয়ানোর জন্য পাত্রীর মাকে যে টাকা দেয়া হয় সেটাকে চাকমা ভাষায় ‘দুধলী তেঙা বলা হয়। চাকমা ভাষায় টাকাকে তেঙা বলা হয়।

বিয়ের দিন কনেকে পিতার বাড়ী থেকে শ্বশুর বাড়ীতে নিয়ে যাবার সময় এই টাকা দেয়া হয়। নববধূ ‘বিষুদ ভাঙা’ উপলক্ষে পিতার বাড়ী গেলে তখনও জামাতা (নতুন জামাই) শাশুড়ীকে এই টাকা দিতে পারে। বর্তমানে তাই-ই করা হচ্ছে।

ব্যাখ্যা:যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তার ‘তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিবাহ প্রথা ও পদ্ধতি’ নিবন্ধে তাদের সমাজে দুধলী তো ৭.০০ টাকা বলে উল্লেখ করেছেন। চাকমাদের মধ্যে এরূপ নির্দিষ্ট কোনো টাকার অংক নির্ধারিত ছিল কিনা জানা যায়নি।

বর্তমানে শুধুমাত্র প্রথাকে মেনে চলার স্বার্থে/লক্ষ্যে নাম মাত্র টাকা যথাঃ- ৫ বা ১০ টাকা ‘দুধলী তেঙা’ হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে।

বিবাহের যোগ্যতাঃ চাকমা সমাজে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য যোগ্যতার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকার মাপকাঠি নেই। চাকমা সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অনুসারে বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে (১) সাবালক বা প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হয়, (২) শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হয়, (৩) শারীরিক অসামর্থ্য যেমনঃ- কানা, বোবা, খোঁড়া নরনারী অবশ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে যদি বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর উভয়ের সম্মতি থাকে।

চাকমা সমাজে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার নির্দিষ্ট বয়সসীমার বাধ্যবাধকতা নেই। সাবালকত্ব অর্জনের মাপকাঠি সমাজের অনুমান বা প্রচলিত ধারণার ওপর সচরাচর নির্ভরশীল।

গ্রামাঞ্চলের অর্থ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সমাজে কম বয়সে বিবাহের হার বেশী। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে এ ধরণের বাল্য বিবাহ সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা কিংবা বারণ করা বা বাধা প্রদান করতে দেখা যায়।

সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ সকল আইনে অপরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সনের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় শিশু ও বালক বলতে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং নারী হলে ১৮ বছরের কম বুঝাবে।

চাকমা জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত কম বয়সের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের বিদ্যমান আদালতে যদি কোনো কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং যদি প্রমাণিত হয় যে বিবাহিত পক্ষগণ নাবালক, তাহলে চাকমা সামাজিক প্রথামতে নাবালকের বিবাহ কার্যটি সমাজসিদ্ধ হলেও তার কোনো প্রকার আইনগত বৈধতা থাকবে না, বরঞ্চ তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

চাকমা সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক :চাকমা সমাজে গুত্থিগত (গোত্রগত) সম্পর্ক বা যে সব আত্মীয়/আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে হতে পারে না, চাকমা ভাষায় সে সব সম্পর্ক বা আত্মীয়কে ‘গর্বা কুদুম’ বলা হয়। নীচে এসব নিষিদ্ধ সম্পর্ক বা আত্মীয়দের একটি তালিকা দেয়া হলোঃ-

চাকমা সমাজে কতিপয় আত্মীয়তার ক্ষেত্রে বিবাহ হতে পারে না। এগুলির মধ্যে নিম্নে (ক) থেকে (গ) পর্যন্ত গুত্থিগত (গোত্রগত) সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হয় না। আবার কতগুলি অসম প্রজন্মের মধ্যে বিয়ে হয় না; নিমে ক্রমিক নং- (ঘ) থেকে (ঞ) পর্যন্ত বিবাহের ক্ষেত্রে এ জাতীয় নিষিদ্ধকে গর্বা কুদুম সম্পর্ক রয়েছে।

(ক) একই গুত্থির (গোত্রের) আত্মীয়ের মধ্যে গুত্থি (গোত্র/বংশ) ভেদে তিন পুরুষ (প্রজন্ম) অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত; নিষিদ্ধ সম্পৰ্কীয় চাকমা পুরুষ ও নারীদের মধ্যে কোর্ট ম্যারেজ হলেও সামাজিক আদালতে উক্ত বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণার কর্তৃত্ব থাকবে।

খ) একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন মায়ের গর্ভজাত পুত্র-কন্যা;

গ) সহোদর ভাইদের ছেলেমেয়ে কিংবা একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রগণের ছেলেমেয়ে। অর্থাৎ জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোন সম্পর্কের আত্মীয়;

ঘ) কাকা-ভাইঝি সম্পর্কের আত্মীয়;

ঙ) পিসি-ভাইপো সম্পর্কের আত্মীয়;

চ) মাসি-ভাগিনা সম্পর্কের আত্মীয়;

ছ) মামা-ভাগিনী সম্পর্কের আত্মীয়;

জ) সৎপুত্র-সৎমাতা সম্পর্কের আত্নীয়;

ঝ) পিতা-কন্যা সম্পর্কীয়;

ঞ) মাতা-পুত্র সম্পৰ্কীয় আত্মীয়।

কেইস রেফারেন্স: চাকমা সমাজে অতীতে একই গঝা ও গুত্থির খেলা কুটুথের মধ্যে ৭ পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ৫ পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ সম্পাদন নিষিদ্ধ করা হয়। এ বিষয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তার আদালত হতে একটি নির্দেশনা প্রদান করেন।

রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ১৫২নং গোরস্থান মৌজার রংকাবা পাড়ার কার্বারী শ্ৰী সুৰ্যমোহন চাকমা এবং একই মৌজার গেট্যা মহাজন পাড়ার কার্বারী গুনসেন্ধু চাকমা উভয়ে দুই সহোদর ভাইয়ের নাতি-নাতনীদের মধ্যে সম্পাদিত বিবাহের আইনগত বৈধতা সম্পর্কে চাকমা রাজ আদালতের পরামর্শ চান।

উভয়ের আবেদনে নোটারী পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেট -এর সম্মুখে নাতি-নাতনীর মধ্যে বিবাহ সংক্রান্ত সম্পাদিত হলফনামার আইনগত মর্যাদা সম্পর্কেও পরামর্শ চাওয়া হয়।

চাকমা রাজ আদালতের নথিপত্র ও যথাযথ তদন্ত এবং গবেষণার ভিত্তিতে রাজা দেবাশীষ রায় সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, অতীতে একই গুত্থির খেল্যা কুটুম্বের মধ্যে ৭ পুরুষ অতিবাহিত না হলে বিবাহ সম্পাদন করা যেতো না।

পরবর্তীতে চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের আমলে চাকমা সমাজে একই গুথির আত্মীয়দের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ৫ পুরুষ অতিবাহিত হলে বিবাহ সম্পাদন করার রীতি সমাজের স্বীকৃতি অর্জন করে।

তবে দুই সহোদর ভাইয়ের পুত্রগণের ঔরসজাত নাতিনাতনীদের (এক গুত্থিন্দি-দ্বআজু নাদিন) মধ্যে বিবাহ আইনগতভাবে সিদ্ধ বলে চাকমা সমাজের প্রথাগত আইনে অথবা কোনো যথাযথ আদালতের রায়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এমতাবস্থায় চাকমা সমাজে অনুরূপ আত্মীয়দের মধ্যে (এক গুথিন্দি আজু-নাদিন এর মধ্যে) বিবাহ চাকমা প্রথাগত আইন বহির্ভূত বলে পরিগণিত হয়। এরূপ সম্পর্কের অবৈধ মিলন হলে সংশ্লিষ্ট উভয়কে পৃথক করে তাদের স্ব-স্ব পরিবারের কাছে ফেরত পাঠিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হয়।

এরপ সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ হয়েছে মর্মে নোটারী পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেট এর সম্মুখে হলফনামা সম্পাদন করা হলেও সেই হলফনামার দ্বারা এরূপ অবৈধ সম্পর্কের বিবাহ প্রথা মতে বৈধ হয় না।

রদং কাবা পাড়া ও পেট্যা মহাজন পাড়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবেধ সম্পর্কে লিপ্ত চাকমা যুগলকে আলাদা করে তাদের স্ব-স্ব পরিবারের সদস্যদের সাথে সিংশ্লিষ্ট মৌজা হেডম্যান ও কার্বারীকে চাকমা রাজা পরামর্শ দেন।

চাকমা রাজ আদালতের ১৪ জানুয়ারী ২০০৬ তারিখের প্রতিবিধানে (এক গুত্থিন্দি, আজু-নাদিন) এর মধ্যে বিবাহ চাকমা সামাজিক আইন ও প্রথামতে সিদ্ধ নয় উল্লেখ করে বলা হয় চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের মধ্যে প্রচলিত আইন ও রীতির মধ্যে এক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।

উভয়ক্ষেত্রেই এরূপ অবৈধ সম্পর্কের উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে বিবাহিত যুগলের ওপর সামাজিক অপরাধের জন্য দন্ড আরোপের বিধান করা হয়।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কতিপয় অনুসরণীয়/পালনীয় রীতিনীতি:

(ক) সাধারণভাবে একজন চাকমা পুরুষ একজন চাকমা মহিলাকে বিবাহ করে।

(খ) পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত হতে হয় ।

(গ) পাত্র-পাত্রীকে রক্ত সম্পর্কজনিত বিধি নিষেধ মেনে বিয়ে করতে হয়।

(ঘ) পাত্র-পাত্রীকে সাবালকত্ব অর্জন করতে হয়।

(ঙ) পাত্র-পাত্রীকে চুমুলাং, জদনবানাহ ও খানাসিরানা সম্পন্ন করতে হয়।

(চ) ‘বেষুদ ভাঙা’ (কনে/বউসহ শ্বশুর বাড়ী গমন) রীতি অনুসারে পাত্রকে যেতে হয়।

বিবাহের প্রকারভেদ: চাকমা সমাজে সচরাচর দুই ধরণের বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছেঃ

(ক) সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ

(খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ/ধাবা মান্যা। এছাড়া বিধবা বিবাহএবং বহু বিবাহের প্রচলনও সমাজে রয়েছে।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহঃ যে বিবাহ/বিয়ে পিতা-মাতা বা অভিভাবকের নির্বাচিত পাত্র-পাত্রীর সাথে এবং উভয়পক্ষের অভিভাবকের সম্মতিতে সম্পন্ন হয়, তাকেই সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ বলা হয়।

আবার পাত্র পাত্রীর পরস্পরের পছন্দ ও উভয়পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতিক্রমে অনুষ্ঠিত বিবাহবিয়েকেও সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

কেইস রেফারেন্স: চাকমা রাজ কার্যালয়ের মোৰ্তফা মোকদ্দমা নং ৩/২০০৪ এর বাণী প্রভাত চন্দ্র চাকমা বিবাদী সুভলেন্দু চাকমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, বাদীর কন্যা জেসি চাকমাকে বিবাগী হুমকি দেখিয়ে ও জেসি চাকমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ করে।

চাকমা রাজ আদালত জেসি চাকমার এবং বাদী ও বিবাদীসহ পক্ষদ্বয়ের সাক্ষীগণের সাক্ষ্য গ্রহণ করে রাজা দেবাশীষ রায় মোকদ্দমার প্রতিবিধান করেন।

রাজ আদালতের হুকুমে বলা হয় যে, অতীতে সামাজিক রীতিনীতিসমূহকে বর্তমান প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচলিত মানবাধিকার ও নারী অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে পূনঃ মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।

ইদানীংকালে চাকমা পরিবারে কন্যার সম্মতি নিয়েই পাত্রপক্ষের বিয়ের প্রস্তাবে কন্যার পিতা সম্মতি দিয়ে থাকেন। এরূপ রেওয়াজকে বর্তমান সমাজের সম্মতিক্রমে বিবাহ সংক্রান্ত পরিবর্তিত রীতি হিসেবে গণ্য করতে হয় বলে চাকমা রাজ আদালতের হুকুমে উল্লেখ করা হয়।

চাকমা রাজ আদালতে মোকদমার যাবতীয় বিষয় পর্যালোচনা করে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট বিবাহের ব্যাপারে জেসি চাকমার এবং তার পিতার সম্মতি জ্ঞাপনের কার্যাদি স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে ও স্বাভাবিক অবস্থায় প্রদান করা হয়েছে মর্মে ধরে নেওয়া যায়।

অতএব, বাচনিকভাবে জেসি চাকমা ও তার পিতা বিবাহের সম্মতি প্রদান করলেও তা আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্মতি বলে পরিগণিত হতে পারে না।

সুতরাং, চাকমা বিবাহের আনুষ্ঠানিক কার্যটি সম্পাদন করা হলেও আইনগতভাবে বিবাহ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় না। রাজ আদালতের হুকুমে বিবাদী ও জেসি চাকমার মধ্যে যথাযথভাবে বিৰাহ ব্যতীত পলায়নের সামাজিক অপরাধে উভয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করে বিবাদীকে ৫ মুঠের শূকর ও বেশী চাকমাকে ৩ মুঠের শূকর জরিমানা করা হয়।

জেসি চাকমার পক্ষে তার পিতাকে জরিমানা দিতে বলা হয়। এছাড়া বাদীর সম্মতি জ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিবাদীগণের আর্থিক ক্ষতিপূরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ সমাজে প্রচলিত রীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে একজন চাকমা যুবক (পুরুষ) এবং একজন চাকমা যুবতী (মহিলা) উভয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা চাকমা সমাজের প্রথা অনুযায়ী আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে।

বিবাহিত দম্পতির দৈহিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে বৈধ সন্তানও পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্ত্রী তার স্বামীর ভরনপোষণও সামাজিক মর্যাদা পায় এবং স্বামীর পারিবারিক পদবীর অধিকারী হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (ধামান্যা): চাকমা সমাজে পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে সামাজিকভাবে প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক-যুবতীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরের মনোমিলনে নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে পলায়ন বিবাহ ধামান্যা বলে।

চাকমা সমাজে এরূপ পলায়ন বিবাহ (ধামান্যা) রীতি বিদ্যমান রয়েছে। এরূপ বিবাহ চার প্রকারে সম্পন্ন হতে দেখা যায়। একজন যুবক এবং একজন যুবতী পরম্পরকে ভালবেসে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হবার ইচ্ছা পোষণ করতেই পারে।

সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক অবস্থা, নিষিদ্ধ পর্যায়ের সম্পর্ক ইত্যাদির কারণে কোনো একপক্ষ বা উভয়পক্ষের অভিভাবক পাত্র-পাত্রীর সেই ভালবাসা ও পরস্পরের বিয়ের বিরোধিতা করতে পারে।

এমনও হতে পারে, পাত্রের পিতামাতা অন্যত্র তাদের ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছে অথবা পাত্রীর বিয়ে দেবার জন্য পাত্রীর পিতা-মাতা অন্যত্র পাত্র ঠিক করেছে। এমতাবস্থায় ভালবাসার মর্যাদা রক্ষার্থে পিতা-মাতা বা অভিভাবকের অজ্ঞাতে তারা পরস্পরের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে আত্বীয় বা পরিচিত ব্যক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নেয়।

ঘটনা উভয়পক্ষের পরিবারের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলে সাধারণতঃ ছেলের পক্ষ থেকে মেয়েপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়। ছেলে এবং মেয়ের বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয় না হলে এবং মেয়ের পিতা-মাতার পাবী-দাওয়া।

পাত্রপক্ষ মানতে রান্ধী হলে সমাজের দাবী পূরণ সাপেক্ষে পলাতক যুগলের বিয়ে হওয়াকে সমাজ অনুমোদন করে। কিন্তু সব পলায়নের ঘটনা যে বিবাহের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে তা নয়।

চাকমা সমাজে পাত্র-পাত্রী উভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় কোনোভাবে যদি পাত্রীপক্ষের কারো কাছে ধরা পড়ে, তাহলে পাত্রীকে কেড়ে নিয়ে তার পিতার বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার অধিকার সমাজ স্বীকৃত।

তবে মনোমিলনে পালিয়ে যাওয়া পাত্র-পাত্রী কোনোভাবে যদি পাত্রের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে যায়, তাহলে পাত্রী সেই বাড়ির বউ হিসেবে সমাজের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে। এক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী উভয়ে বিবাহসিদ্ধ গোত্রভূক্ত হতে হয়।

এ ধরণের পলাতক যুবক-যুবতীর মধ্যে পরে বিয়ে হোক বা না হোক চাকমা সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী গোপনে পালিয়ে গিয়ে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে সামাজিক বিচারে উভয়ের সাজা হয়।

সাজা হিসেবে যুবককে দিতে হয় একটি শূকর, কিছু নগদ টাকা ও এক বোতল মদ, আর যুবতীকে দিতে হয় একটি মোরগ, কিছু নগদ টাকা ও এক বোতল মদ। পলাতক যুবক-যুবতী সাবালক হলে এবং রক্ত সম্পৰ্কীয় নিষিদ্ধ সম্পর্কিত নিকটাত্মীয় না হলে বৌদ্ধ ভিক্ষুর নিকট মঙ্গল সূত্র শ্রবণ করে শুদ্ধ হবার পর তাদেরকে সমাজে গ্রহণ করা হয়।

পরে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘চুমুলাং, জদনবানাহ ও ‘খানা সিরানা’ অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়। সাধারণতঃ এই ধরণের বিয়েতে আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করার প্রয়োজন হয় না।

কোর্ট ম্যারেজ: কোর্ট ম্যারেজ মূলতঃ আদালতের কোনো প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক চাকমা সমাজে ইদানিং পরিবারের অসম্মতিতে বিবাহে ইছুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলা চলে প্রাচীনকালের মনোমিলনে পলায়ন বিবাহের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে কোর্ট ম্যারেজ, যদিও এটি নিছক একটি শপথনামা মাত্র। তাই এ বিবাহ অলঙ্ঘনীয়ও নয়।

তবে বিবাহিত পাত্র-পাত্রী এক্ষেত্রে সাবালক হলেও বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় নিকটাত্রীয় হলে সম্পাদিত কোর্ট ম্যারেজ সমাজের কাছে বৈধ হয় না। সর্বোপরী এ ধরণের কোটি ম্যারেজ প্রথাসিদ্ধ নয়, তা অসামাজিক বিবাহ।

ব্যাখ্যা: মূলতঃ কোর্টে কোনো বিবাহ হয় না। পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত পাত্র-পাত্রীকে স্বেচ্ছায় কোর্টে আসার পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। পরে কোর্টে এসে উভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে এই প্রকার Love Marriage এর সমর্থনে একটি শপথ সম্বলিত বিবৃতি Affidavit দেয় এবং এভাবে বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করে। কার্যতঃ এই প্রকার শপথ সম্বলিত বিবৃতি অর্থাৎ এফিডেবিটের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসবর্ণে প্রণয়ঘটিত বিবাহগুলো উভয়পক্ষের অভিভাবকদের অসম্মতিতে হয়ে থাকে। এরূপ বিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের অব্যবহিত পরেই কোর্টে গিয়ে তাদের বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করতে হয়, যাতে যে কোনো পক্ষের অভিভাবকের উদ্যোগে থানায় অথবা কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের হলে এই দলিল তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়ক হয়”। (সূত্রঃ- হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান)

এরূপ প্রণয়াসক্ত হয়ে চাকমা যুবক-যুবতী কোর্টে আসার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। কোর্টে এসে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে আমরা পরস্পরকে বিবাহ করলাম মর্মে বিবৃতি (হলফনামা) সম্পাদন করে দেয়।

অর্থাৎ তারা কোর্টেই একে অপরকে বিয়ে করার ঘোষণা দেয় মাত্র। কোর্টে আসার আগে বিয়ে করে না। আগেই বলা হয়েছে যে, কোর্টে কোনো বিয়ে হয় না। পূর্বে সম্পন্ন হওয়া বিয়ের ঘোষণা কোটে এসে দেয়া হয় মাত্র।

সুতরাং, যুবক-যুবতী হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে বলে যা বুঝাতে চায়, তা মোটেই সমাজসিন্ধ বিয়ে নয়। চাকমা সমাজসিদ্ধ বিবাহের পূর্ব শর্ত হচ্ছে চুমুলাং’ ‘জদনবানাহ ‘ ‘খানা সিরানা’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করা।

বৌ ঘরত উদানা (কনের শ্বশুর বাড়ীতে উঠা): একজন যুবক ও একজন যুবতীর ভালবাসার পরিণতিতে প্রেমিক-প্রেমিকার সিদ্ধান্তক্রমে প্রেমিকা একদিন খুব ভোরে শশুর বাড়ীতে এক কলসী পানিসহ উঠলে, সেটাকে ঘরত ‘বৌ উদানা’ বা ‘বাড়ীতে বৌ উঠা’ বলে।

এভাবে কারও বাড়ীতে একজন পাত্রী বৌ হয়ে উঠলে চাকমা প্রথামতে তাকে তাড়িয়ে দেবার রীতি নেই। কারণ বাড়ীতে এভাবে একজন পাত্রীর বৌ হয়ে আগমনকে বৌয়ের বেশে লক্ষ্মীর আগমন বলে বিবেচনা করা হয়।

এ ধরণের ঘটনায় সমাজের অনুমতি নিয়ে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে সম্পাদন করে দিলে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে বসবাস করতে পারে।

মিশ্র বিবাহঃ পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসী এবং ভিন্ন জাতির ছেলে মেয়েদের উভয়পক্ষের সম্মতিতে ‘চুমুলাং’ জদনবানাহ’ ‘খানা সিরানা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া বিবাহকে চাকমা সমাজে স্বীকৃত বিবাহ রূপে গণ্য করা হয়।

এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রী যে সম্প্রদায় হতে চাকমা সমাজে এসেছে তার সেই সম্প্রদায়ের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা, পদবী লোপ পায় এবং সেক্ষেত্রে স্ত্রী তার চাকমা স্বামীর ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা, পদবীর অধিকারী হয়।

অনুরূপভাবে চাকমা সমাজের কোনো মহিলার সাথে অন্য সম্প্রদায়ের পুরুষের বিবাহ হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত হলে সেই বিবাহিত মহিলা চাকমা সমাজের উত্তরাধিকার ও পদবী হারায়।

পলায়ন/অনিয়মিত (ধবা মান্যা) বিবাহের (পালিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে করা) আইনগত ফলাফলঃ

পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকাকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। যদি মেয়ের অভিভাবক তার মেয়েকে প্রেমিকের সাথে বিয়ে দিতে রাজী না হয় কিংবা প্রেমিকের অভিভাবক প্রেমিকার পিতা-মাতার কনেপণসহ আর্থিক ও অন্যান্য দাবী পূরণ করতে রাজী বা সমর্থ না হয়, তাহলে তাদের বিয়ে হয় না এবং প্রেমিকাকে তার পিতার বাড়ীতে ফিরে যেতে হয়।

যদি প্রেমিকা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার পর্যন্ত পালিয়ে গিয়ে প্রেমিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক না হয় কিংবা চতুর্থবার পর্যন্ত প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম না হয়, তাহলে তাদের বিয়ে হয় না।  

আদালতে এ ধরণের মামলা হবার ফলে প্রেমিক গ্রেপ্তার ও বিচারে তার সাজা হয়। আর প্রেমিকা যদি নাবালিকা হয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে অপহরণ ও দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হয়েছে বলে সামাজিক বিচারে জোর করে অপহরণ করার অভিযোগে পাত্রকে অপরাধী সাব্যস্ত করা না হলে এবং প্রেমিকার পিতা-মাতা সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেও পলাতক অবস্থায় বিবাহ বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের অপরাধে সাজাভোগ করতে হয়।

যেমনঃ- শূকর, মোরগ, মদ ও নগদ টাকা জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে তাদের মধ্যে বিয়ে হলে সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য হয়।

সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত হলে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনের দ্বারা জন্মগ্রহণকারী সেই সন্তানও বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় এবং পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হয়ে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে।

প্রেমিক বা প্রেমিকার পিতা-মাতার অসম্মতির কারণে প্রেমিক যুগলের বিয়ে না হয়ে পলাতক অবস্থায় দৈহিক মিলনের কারণে প্রেমিকা গর্ভবতী হলে সেই ভূমিষ্ট সন্তান সমাজের দৃষ্টিতে অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

সন্তান যার ঔরসে জন্মলাভ করেছে/করে সেই পিতার উত্তরাধিকারী এবং পিতার পারিবারিক মর্যাদার অধিকারী হয় না। তবে পরবর্তীতে সামাজিকভাবে উভয়ের মধ্যে বিবাহ হলে অবৈধ সন্তান পিতার উত্তরাধিকার হয়।

পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে না হলে সামাজিক অপরাধসহ প্রেমিকের নিম্নোক্ত আইনগত পরিণতি হতে পারে।

(ক) পালিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে করার অপরাধে প্রেমিকের পিতামাতা প্রেমিককে ত্যাজ্যও ঘোষণা করতে পারে, যার পরিণতিতে সে পিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

দেশের প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা ও সাজা হওয়ার আশংকা:

প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েতে তাদের অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে পলায়নের খবর জানাজানি হবার পর প্রেমিকার পিতা প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর আওতায় মামলা দায়ের করতে পারে।

সে আদালতে জবানবন্দি দেয়, তাহলে প্রেমিকের ১৪ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহঃ চাকমা সমাজে একই গোত্রভুক্ত রক্ত সম্পৰ্কীয় নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। এ ধরণের রক্ত সম্পর্কীয় নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কোনো প্রকার বিবাহ হলে তা নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহ বলে গণ্য হয়।

এ ধরণের নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ যুগলকে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয় এবং সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এ ধরণের বিবাহকে নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহের নিম্নোক্ত প্রকারের শ্রেণীর উল্লেখ রয়েছে।

(ক) সমাজ অনুমোদিত একই গোত্রে বিয়ে (নির্দিষ্ট কয়েক পুরুষ পর্যন্ত আত্মীয়দের মধ্যে)

(খ) গর্বা কুদুম (নিষিদ্ধ সম্পর্ক) বিয়ে করা

প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে বিবাহ করার জন্য বাড়ী হতে পালিয়ে যায় বা আদালতে গিয়ে বিবাহের শপথনামা সম্পন্ন করে সমাজ স্বীকৃত রীতি অনুসারে ‘চুমুলাং’ জlনবানাহ’ ও ‘খানা সিরানা’ অনুষ্ঠান সম্পাদন করে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করলেও নিষিদ্ধ সম্পর্ক বা অন্য কোনো কারণে সে ধরণের বিবাহগুলো নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহ হিসেবে গণ্য হয়।

কেইস রেফারেন্সঃ চাকমা সমাজে নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে গরবা কুটুম্ব ও খেল্যা কুটুম্ব এর মধ্যে সংঘটিত অপরাধের বেলায় চাকমা প্রথাগত আইন অনুসারে গরবা কুটুম্বের মধ্যে বিয়ে অপরাধ গুরুতর হিসেবে গণ্য হয়।

চাকমা রাজ আদালতের এক আদেশে বলা হয়, চাকমা সমাজে যে কোনো বিবাহিত নারী বা পুরুষের সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত কোনো ব্যক্তির দৈহিক মিলন হলে তা চাকমা প্রথাগত আইন অনুসারে দন্ডনীয় অপরাধ। তবে অপরাধের মাত্রাও প্রদানযোগ্য শাস্তির পরিমাণ নির্ভর করবে অপরাধী নারী ও পুরুষের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপর।

রাজা দেবাশীষ রায় তাঁর আদেশে উল্লেখ করেন, সংশ্লিষ্ট নারী-পুরুষের মধ্যে যদি গরবা কুটুম্বের সম্পর্ক থাকে অর্থাৎ একে অপরের মাসি, পিসি, জেঠি, কাকী, মামী, ভাগ্নী, ভাইঝি ও মামা, কাকা, জেঠা, পিস, মেসো, ভাগ্নে, ডাইপো এরূপ সম্পর্ক থাকে তাহলে এ ধরণের সম্পর্কের মধ্যে দৈহিক মিলন গুরুতর অপরাধ এবং প্রদেয় শাস্তিও শুরু হবে।

অপরদিকে সংশ্লিষ্ট নারী-পুরুষের মধ্যে যদি খেলা কুটুম্বের সম্পর্ক থাকে অর্থাৎ একে অপরের দুরসম্পর্কের ভাই-বোন, দুরসম্পর্কের নাতিনাতনী ও আজু-নানুর (ঠাকুরদা-ঠাকুরদি) সম্পর্ক থাকে অথবা অন্য কোনো ভাই-বোন তুল্য সম্পর্ক থাকে তাহলে এরূপ সম্পর্কের মধ্যে দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে তা গরবা কুটুম্বের সাথে দৈহিক মিলনের চাইতে লঘু অপরাধ বলে গণ্য হবে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর উপজেলা চেমী মৌজার চেমী ডলু চাকমা পাড়া নিবাসী বীর লাল চাকমার আবেদনের প্রেক্ষিতে চাকমা রাজ আদালত হতে এ সিদ্ধান্ত প্রদান করা।

নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে এবং গোপনে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস ইত্যাদি সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য। চাকমা সামাজিক প্রথামতে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং শাস্তিস্বরূপ শূকর জরিমানা দিতে হয়।

গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধের শাস্তি হচ্ছে অর্থদন্ড। সমাজ এ ধরণের নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়েকে স্বীকার করে না। বিধায় প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না।

এর ফলে তাদের মধ্যে কোনো সময় বিরোধ দেখা দিলে এবং একে অপরের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অস্বীকার করলে, তারা পরস্পর পরস্পরের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তাদের মধ্যে এরূপ দাম্পত্য কলহ বা বিরোধ দেখা দিলে সমাজ বা কোনো আত্মীয় তাদের সেই বিরোধ বা কলহ নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসবে না।

ব্যাখ্যা: নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ে হওয়া সমাজে একেবারে বিরল ঘটনা নয়। অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও এ ধরণের কিছু কিছু বিয়ের নজির খুঁজে পাওয়া যায়। সামাজিক রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত বিয়ের বৈধতা বা অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণতঃ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

তবে পালিয়ে গিয়ে ‘চুমুলাং’, `জদনবানাহ’, ‘খানা সিরানা’ ছাড়া ভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসকালে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বিয়ের কথা অস্বীকার করলে তখন বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সচরাচর চাকমা সমাজে এমন ঘটনা ঘটে না।

বিধবা বিবাহঃ চাকমা সামাজিক প্রথামতে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা মহিলাও বিয়ে করতে পারে।

একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারে বা শ্বশুর-শাশুরির সাথে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরনপোষণপাবার অধিকারী।

কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামী-শ্বশুরের পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরনপোষণপায় না। একজন বিধবার দ্বিতীয় বিয়েকে চাকমা ভাষায় ‘ঘর ধরানা’ বলা হয়, যার অর্থ হল পুনরায় সংসার জীবন শুরু করা।

বহু বিবাহঃ চাকমা সমাজে একজন পুরুষের একাধিক বিয়ে করার ও একাধিক স্ত্রী রাখার ঘটনা দেখা গেলেও একজন পুরুষ ঠিক কতজন স্ত্রী রাখতে পারে, এরূপ সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

পরিবারে একজন স্বামীর একাধিক স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলেও সমাজ এরূপ একাধিক বিয়েতে গায়ে পড়ে হস্তক্ষেপ করে না, এটাই সত্য।

তবে একজন বিবাহিত চাকমা পুরুষ তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন না করে স্ত্রীর সম্মতিতে নিম্নোক্ত কারণে বহু বিবাহে আবদ্ধ হতে পারেঃ

(ক) সন্তানহীন দম্পতির বংশ রক্ষার তাগিদে;

(খ) স্ত্রী কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে;

(গ) স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে;

(ঘ) স্ত্রী শারীরিক পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলে;

(ঙ) স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি সাপেক্ষে;

(চ) স্ত্রী যদি কোনো অপরাধে দীর্ঘদিন কারান্তরালে থাকে;

(ছ) স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর অমতে দীর্ঘ বৎসর পিত্রালয়ে বা দেশান্তরে থাকে;

(জ) স্ত্রী যদি ব্যাভিচারে কিংবা পরকীয়াতে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধে সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়।

মন্তব্যঃ বহু বিবাহ বলতে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় আরও এক বা একাধিক মহিলাকে বিয়ে করা বুঝায়। স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে বিয়ে করাকে বহু বিবাহ বলা যায় না। (চ)নং কারণে বিয়ে করাটাও বহু বিবাহ নয় ।

প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বা প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে সব সমাজেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার রীতি আছে। তাই বলে সেটা বহু বিবাহ নয় ।

বহু বিবাহের আইনগত ফলাফল: চাকমা সমাজে বহু বিবাহ অনুমোদিত। তাই কোনো ব্যক্তি একাধিক মহিলাকে বিয়ে করলেও সমাজ তাতে মাথা ঘামায় না।

কারণ একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকার ফলে পরিবারে যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, তাতে সমাজে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। পরিবারের লোকজনই, বিশেষতঃ স্ত্রীরাই অশান্তি ভোগ করে।

প্রতিবাদ বা আপত্তি এলে তা ভূক্তভোগী স্ত্রীদের কাছ থেকেই আসার কথা। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে এ ধরণের বিয়েতে স্ত্রীদের আপত্তি কিংবা প্রতিবাদ করার সুযোগ তেমন নেই বললে চলে।

উপরোক্ত (৪)নং শর্ত ব্যতীত একাধিক বিয়ে করার অপরাধে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৪৯৪ ও ৪৯৫ ধারায় মামলা দায়েরের সুযোগ আছে। স্বাম দ্বিতীয় বিয়ে করায় প্রথম স্ত্রীই এই অপরাধের জন্য মামলা করতে পারে।

অপরাধ প্রমাণিত হলে ৭ ও ১০ বছর কারাদন্ড হতে পারে। সেক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত বিধান অকার্যকর গণ্য হয়।

মন্তব্য: চাকমা সামাজিক প্রথামতে একাধিক বিয়ে করা যায়। এই প্রথা মেনে কোনো স্ত্রী, স্বামীর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনের আওতায় মামলা করলে স্বামীর শাস্তি হতে পারে। কিন্তু সেই বিচার চাকমা সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিসম্মত নয়।

বর্তমানে প্রচলিত কোনো প্রথা দ্বারা সমাজের বৃহত্তর অংশের ক্ষতিসাধিত হলে তা অবশ্যই সংশোধন করা যায়। চাকমা বিচার কাঠামোর বাইরে গিয়ে প্রতিকার চাওয়া এবং চাকমা প্রথাগত আইন মেনে চলা অবশ্যই এক নয়।

বিবাহের প্রমাণ: চাকমা সমাজের রীতি অনুসারে বিয়ে নিবন্ধনের কোনো প্রথা নেই। চাকমা সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। এমনকি বিয়ের প্রমাণ স্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো লিখিত দলিলও তৈরি করা হয় না।

তবে সাধারণতঃ বিবাহের পদ্ধতি বা রীতিনীতির বিষয়ে সামাজিক ও আইনগত বৈধতার প্রশ্নে কোনো প্রকার সমস্যার উদ্ভব হলে সেক্ষেত্রে বিবাহের সত্যতা বা অস্তিত্ব প্রমাণ হয় নিম্নমতেঃ-

(ক) বিয়ের অনুষ্ঠানে (ভোজে) উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের মৌখিক সাক্ষ্য;

(খ)সমাজপতি যথাঃ- রাজা, হেডম্যান, কার্বারী প্রদত্ত সনদপত্র;

(গ)জোড়া বন্ধন পরিচালনাকারী সাবালা, চুমুলা অনুষ্ঠানের ওঝা অথবা বৌদ্ধ পুরোহিত;

(ঘ)বিয়ের শপথ নামা (যদি থাকে);

(ঙ) সমাজ স্বীকৃত পন্থায় স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলন;

(চ) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান;

(ছ) স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার;

(জ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বাবা-মায়ের স্বীকৃতি চুমুলাং;

(ঝ) জদনবানাহ, খানা সিরানা অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য ছবি। উপরোক্ত উপাদানগুলো বিয়ের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করে।

বৈবাহিক কর্তব্য:

(ক) স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করে এবং স্বামীর ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলবে।

(খ)স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরনপোষণদিতে বাধ্য থাকবে।

 (গ) উভয়ে দাম্পত্য জীবনে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকবে।

আইনসঙ্গত বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং দায়িত্ব:

(ক) বিয়ের পর স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারিত স্থানে স্বামীর সাথে বসবাস করতে হয় এবং স্বামীর সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়। অনুরূপভাবে স্বামীকেও উপযুক্ত মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং তাকে পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরনপোষণদিতে বাধ্য থাকবে।

তথ্যসূত্র

১.শ্রী মুদোম – এডভোকেট করুনাময় চাকমা।

২. চাকমা জাতীয় বিচার পদ্ধতি ও উত্তরাধিকার প্রথা -৩/ শ্ৰী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান

৩. প্রাগুক্ত

৪. প্রাগুক্ত

৫. চাকমা সামাজিক প্রথা ও শাসনবিধি (অপ্রকাশিত) শ্ৰী যামিনী রঞ্জন চাকমা।

৬. চাকমা পূজা পার্বন -শ্রী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, রাঙ্গামাটি : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।

৭. চাকমা জাতীয় বিচার পদ্ধতি ও চাকমা উত্তরাধিকার প্রথা- শ্ৰী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান।

৮. Majority Act, 1975,

৯. Guardians and Wards Act, 1890.

১০. Child Marriage Restraint Act. 1929.

১১. নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০।

১২. হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান।

১৩. শ্রী সুদোম এডভোকেট করুনাময় চাকমা।

১৪. চাকমা সামাজিক প্রথা ও শাসন বিধি- শ্ৰী যামিনী রঞ্জন চাকমা।

১৫. শ্রী সুদোমঃ এডভোকেট করুনাময় চাকমা ।

১৬. প্রাগুক্ত।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা