চাকমা জাতি
1856
চাকমা জাতির বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পাহাড় অধ্যুষিত, সবুজ অরণ্য পরিবেষ্টিত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জুম্ম জনগােষ্ঠীর অন্যতম চাকমা জনগােষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলায় চাকমাদের বসবাস রয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে অধিক চাকমা জনসংখ্যা রয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সংরক্ষিত বনাঞ্চলেও ১১টি স্থানে/গ্রামে চাকমাদের লােকজন রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল, অসাম, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশেও চাকমা জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। মিজোরাম প্রদেশে চাকমাদের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদও রয়েছে। মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের আকিয়াব জেলায়ও চাকমাদের কিছু লােক রয়েছে। তারা সেখানে দৈননাক (অথবা দৈনতাক বা দৈনদাক) নামে পরিচিত।
চাকমা পরিচিতি
নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে চাকমারা মঙ্গোলীয় বংশােদ্ভূত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মায়ানমার, থাই, কম্বােডিয়ান, লাওশিয়ান ও ভিয়েতনামিদের সাথে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য (তালুকদার ২০০৬)। বাংলায় তাদের ‘চাকমা বা ইংরেজীতে ‘Chakma বলা বা লেখা হলেও বাস্তবে তারা নিজেদেরকে বলে ‘চাঙমা (Changma)।
চট্টগ্রামের বাঙালিরা বলেন ‘চামােয়া’ বা ‘চাম্মােয়া’। ভারতের ত্রিপুরারা ‘চাউঙমা’ (দেবনাথ,) বা চাখুমা (মজুমদার ১৯৯৭)। ১৮৬৭ লিখিত এক চিঠিতে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন লিখেছিলেন Chukma অর্থাৎ চাকমা’ বা ‘চুকমা’। ম্রোরা বলে ‘আচাক’।
খিয়াংদের কাছে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা উভয়েই সাক (Sak)। মারমারা বলে ‘সা-ক’ (Saak)। একদা তঞ্চঙ্গ্যারা বলত ‘আনক্যা’ (Anokya)। পাংখােয়ারা বলে থাকে ‘আইএং’। লুসাইরা ডাকে ‘তাকাম’ (Takam) বলে। কুকিরা বলে ‘টুইথেক’ (Tuithek)। বর্মীদের (Burmese) ভাষায় চাকমাদের বলা হয়—সাক, থেক বা থেট (Sak Thek or Thet)। আবার আরাকান অঞ্চলে বসবাসকারী চাকমারা সেখানে ‘দৈননাক’ (Doingnak) বা দৈনতাক’ (Doingtak) কিংবা ‘দৈনদাক’ (Doingdak) নামে পরিচিত।
আর দৈননাকরা নিজেরাও সেখানে নিজেদেরকে ‘চাঙমা’ বা ‘চাকমা বলে। তবে বর্তমানে চাকমা’ বা ‘চাঙমা’ পরিচয়টিই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বহুল প্রচলিত।
জনসংখ্যা
১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশ সরকারের আদমশুমারি প্রতিবেদনেও জাতিভিত্তিক কোনাে গণনা না থাকায় সাম্প্রতিককালে চাকমাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। বাংলাদেশ সরকারের ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—এই তিন পার্বত্য জেলায় চাকমাদের মােট জনসংখ্যা ২,৩৯,৪১৭ জন।
ঐ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রায় ৬০ হাজার চাকমা শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছিল; যাদের গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া উক্ত গণনায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী চাকমাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে সেখানে চাকমাদের জনসংখ্যা আনুমানিক ৩ হাজার। নিম্নে আদমশুমারিভিত্তিক চাকমাদের জনসংখ্যা তুলে ধরা হলাে-
আদমশুমারি ১৮৭১ ১৯০১ ১৯৫১ ১৯৮১ ১৯৯১
চাকমা জনসংখ্যা ২৮,০৯৭ ৪৪,৩৯২ ১৩৩,০৭৫ ২৩০,২৭৩ ২৩৯,৪১৭
লেখক-গবেষক সুগত চাকমার মতে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমাদের জনসংখ্যা ৩ লক্ষের মতাে হবে। আবার কারও কারও ধারণা এই সংখ্যা৫ লক্ষাধিক হবে (দেওয়ান ২০০৭)। ১৯৯৭ সালে পান্নালাল মজুমদার লিখেছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৪ লক্ষ চাকমা বসবাস করে (মজুমদার ১৯৯৭)।
অপরদিকে ভারতের আদমণ্ডমারি অনুযায়ী ত্রিপুরা রাজ্যে চাকমাদের জনসংখ্যা ১৯৭১ সালে ২৮,৬৬৫ জন, ১৯৮১ সালে ৩৪,৭৯৯ জন (মজুমদার ১৯৯৭)। ১৯৯৪ সালে লিখিত কে এস সিং-এর লেখা অনুযায়ী ১৯৮১ সালে মিজোরামে চাকমাদের জনসংখ্যা ছিল ৩৯,৯০০ জন। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে চাকমারা দ্বিতীয়।
অরূণাচলে বর্তমানে চাকমাদের জনসংখ্যা প্রায় ৬৫,০০০ (চাকমা)। পান্নালাল মজুমদার লিখেছেন, ভারতে প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার চাকমা বসবাস করেন। তিনি আর ও লিখেছেন, বার্মার আরাকান অঞ্চলে এক লক্ষাধিক চাকমা বংশােদ্ভূত দৈননাক বসবাস করে আসছে। ব্রিটিশ আমলের ভারত সরকারের ১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ঐ সময়ে আরাকানে ৬,৩৫৫ জন দৈননাক ছিল। বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা ২০,০০০ মনে করা হয়।
চাকমাদের স্থানান্তর
জীবন-জীবিকার তাগিদে কিংবা প্রাকৃতিক কারণে বা রাজনৈতিক কারণে বাধ্য হয়ে চাকমাদের বার বার স্থান বদল বা বসতি পরিবর্তন করতে হয়েছে। একদা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আলেখদ্যয়ং (বর্তমান বান্দরবানের আলিকদম) চাকমাদের প্রধান বসতি ছিল। পরবর্তীতে নানা কারণে চাকমারা আরাে উত্তর দিকে সরে আসে।
বর্তমান চট্টগ্রামের জজ আদালত পাহাড় ও ডিসি হিলে চাকমারা জুম চাষ করেছিল বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। একসময় বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন যথাক্রমে শিলক ও রাজানগরে চাকমা রাজার রাজধানী ছিল। রাজানগরে চাকমা রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ সেই সাক্ষ্য বহন করে।
চাকমা জাতীয় জীবনে স্থানান্তর নিয়ে ‘চাদিগাঙ ছাড়া পালা’ নামে একটি পালাগানও রয়েছে। যাতে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার করুণ ও মর্মস্পর্শী কাহিনীর বর্ণনাও রয়েছে।স্থানান্তরের ক্ষেত্রে চাকমা জাতীয় জীবনে সবচেয়ে দুর্যোগময় অধ্যায় কাপ্তাই বাঁধের ফলে স্থানচ্যুতি বা উদ্বাস্তু হয়ে পড়া।
এটাকে চাকমাদের জাতীয় ইতিহাসে চাকমা ভাষায় ‘বড়অ পরং’ (বড় স্থানান্তর) নামে সমধিক খ্যাত। স্থানীয় আদিবাসী জুম্ম জনগণের ভাগ্যকে তােয়াক্কা না করে ১৯৬২ সালে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রধানত চাকমা অধ্যুষিত এই এলাকার আদিবাসী মানুষেরা মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিকভাবে ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
এতে প্রায় ৫৪,০০০ একর কৃষি জমি পানিতে ডুবে যায়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মােট কৃষি জমির প্রায় ৪০%। এতে মােট ১২৫টি মৌজার ১৮ হাজার পরিবারের প্রায় ১ লক্ষ লােক উদ্বাস্তু হয়। এর মধ্যে হাজার হাজার মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামেরই অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এসব উদ্বাস্তু জনগােষ্ঠীকে যথাযথভাবে পুনর্বাসনের কোনাে উদ্যোগ নেয়নি। চাষােপযােগী জমির অভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত ও দুর্বিষহ। এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে ১৯৬৪ সালে লংগদু, বরকল ও বাঘাইছড়ি এলাকা হতে ৩৫ হাজার চাকমা জনগােষ্ঠির লোক ভারতের প্রথমে মিজোরামে, পরে ত্রিপুরারাজ্যে এবং আসামে আশ্রয় নেয়।
পরে তাদের অনেককেই বর্তমান অরুণাচল রাজ্যে পুনর্বাসন করা হয়। অর্ধ শতাব্দী ধরে অরুণাচল প্রদেশে বাস করলেও তারা এখনাে ভারতের নাগরিকত্ব পায়নি। নাগরিকত্বহীন পরবাসী জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে।
এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ১৯৯৭ সালের পর হতে ১৯৯৭ সাল অবধি সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়নের কারনেও হাজার হাজার আদিবাসী পাহাড়ি পরিবার নিজ গ্রাম ও এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে।
তার মধ্য প্রায় বেশ কয়েকবার তারা ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে গহীন অরণ্যে বা অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে যাদেরকে ‘অভ্যন্তরীণ ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই চাকমা, যারা এখনাে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিগত কয়েক দশকে বিশেষত পেশাগত ও শিক্ষাগত কারণে চাকমারা নগর, শহর ও উপজেলা সদরমুখী হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভূমি জবরদখলের ফলে নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদির কারণে অন্যান্য পাহাড়ি আদিবাসীসহ শত শত চাকমা পরিবার কাজের সন্ধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলে গমন করছে।
এমনকি কেউ কেউ সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। নগরমুখীতার ফলে চাকমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, রীতিনীতি ও সমাজব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী চাকমাদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা নেতিবাচক দিকের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
চাকমা জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি
চাকমা কিংবদন্তি অনুযায়ী, অতীতে চাকমারা চম্পকনগর নামে একটি রাজ্যে বাস করতাে। এক সময় সেই রাজ্যের সাধেংগিরি নামে এক রাজার বিজয়গিরি ও সমরগিরি নামে দু ছেলে ছিল। বড় ছেলে বিজয়গিরি পিতার জীবদ্দশায় দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম ও আরাকান জয় করেন। অতপর ফেরার পথে তিনি গ্রামে পৌছান তখন শুনতে পেলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তাঁর বৃদ্ধ পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং ছােট ভাই চম্পকনগরের রাজা হয়েছেন।
এ সংবাদে তিনি খুবই মর্মাহত হয়ে চম্পকনগরে আর না ফিরে নতুন বিজিত রাজ্যে রাজত্ব করার মনস্থির করেন। তিনি তার অনুগত সৈন্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে দক্ষিন দিকে অগ্রসর হয়ে সাপ্রেইকূলে চলে যান এবং তাঁর অনুগত সৈন্যদেরকে স্থানীয় রমণী বিয়ে করার অনুমতি দেন। কালে তাদের সাথে চম্পকনগরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং চম্পকনগর ও তার বাসিন্দারা কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, দিগ্বিজয়ে রাজা বিজয়গিরির প্রধান সেনাপতি ছিলেন রাধামন ও কুঞ্জধন। রাজার অনুমতি নিয়ে পরে সেনাপতি রাধামন তাঁর প্রেয়সী নববিবাহিত স্ত্রী ধনপুদি ও. পরিবারের টানে চম্পকনগরে প্রত্যাবর্তন করেন। আজকের চাকমাদের একান্ত বিশ্বাস তারা বিজয়গিরির চট্টগ্রাম ও আরাকান বিজয়ী সেইসব সৈন্যদের ‘আরাকানিদের ইতিহাসেও চাকমাদের উপরােক্ত জনপ্রিয় কিংবদন্তীর সমর্থন পাওয়া যায়। আরাকানিরা চাকমাদেরকে শাক্যবংশীয় লােক বলে মনে করে, তাই তারা চাকমাদেরকে সাক (Sak) বা থেগ (Thek) বলে!’
গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পূর্বেই শাক্যরা ভারত হতে বিতাড়িত হন এবং তিব্বত, নেপাল, কামরূপ (আসাম), সিয়াম (থাইল্যান্ড), জাভা ও সুমাত্রায় আশ্রয় গ্রহন করেন। শাক্যদের পতনের সাথে সাথে তাদের লােকদের একটি শাখা তাদের জন্মভূমি ত্যাগ করেন এবং বার্মা, সিয়াম (থাইল্যান্ড), কম্বােডিয়া ও মালয়ে বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু তারা তাদের জাতীয় পরিচয় বজায় রাখতে পারেনি, অন্য বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর অঙ্গীভূত হয়ে যায় ।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন, শাক্যদের অন্য একটি শাখা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তারা ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, কুমিল্লা ও সিলেটের মতাে জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের মতে চাকমারা উপরােক্ত শাক্যদের পরবর্তী বংশধর। বর্মীরাও চাকমাদের শাক্যদের বংশধর বলে উল্লেখ করেন।
এল বি চাকমা লিখেছেন, “চাকমাদের বিজক (ইতিহাস) ও গেংখুলী (চারণকবি)-দের সূত্র অনুযায়ী চাকমারা সূর্যবংশী ও ক্ষত্রিয় । তারা শাক্যদের বংশধর! চাকমাদের আদি রাজধানী ছিল কলাপনগর, দ্বিতীয় রাজধানী ছিল চম্পকনগর । তারা চম্পকনগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে লােহিত নদী অতিক্রম করে নতুন ভূমি জয় করেন এবং উক্ত অভিযানের সেনাপতি কালাবাঘা’র নামানুস ঐ জায়গার নামকরণ করে ”কালাবাঘা’’ । এই নতুন রাজ্যের রাজধানীর নামও রাখা হয় চম্পকনগর’।
উপরােক্ত কাহিনী থেকে জানা যায় যে, চাকমাদের আদি রাজধানী কলাপ” দ্বিতীয় রাজধানী চম্পকনগর, তৃতীয় রাজধানীও চম্পকনগর। উপরােক্ত কাহিনী থেকে আরও জানা যায় যে, শেষােক্ত ‘চম্পকনগর’ ত্রিপুরা রাজ্যেরই কাছাকাছি কোনাে জায়গায় অবস্থিত ছিল। এ ব্যাপারে নানা সাক্ষ্যও পাওয়া যায় ।
”ত্রিপুরা” রাজ্যের তেলিয়ামুড়া ও আগরতলার মধ্যবর্তী স্থানেও একটি চম্পকনগর খোঁজ পাওয়া যায়। এটি তেলিয়ামুড়া হতে ২৩ কিলােমিটার এবং আগরতলা হতে ২২ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। আর ত্রিপুরার নিকটবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা জেলা ও অবিভক্ত ভারতের শ্রীহট্ট জেলার অঞ্চলকেই চম্পকনগর যে রাজ্যের রাজধানী সে রাজ্যর ”কালাভাগা” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া তৎকালে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চলেও একটি টিলাময় চম্পকনগর পাওয়া গেছে।এই চম্পকনগরে প্রাচীনযুগের ইট ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক এখানে চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধধর্মের রাজাদের রাজপ্রাসাদ ছিল বলে মনে করেন ।
কিংবদন্তি অনুযায়ী পিতার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর রাজা বিজয়গিরি যখন সাপ্রেইকূলে রাজ্য স্থাপন করেন, সে সময় চাকমা বাহিনী বর্তমান কক্সবাজার জেলার রামু পর্যন্ত অধিকার করেছিল। জানা যায়, এখনও রামুর দু মাইল দূরে বাকখালী নদীর তীরে চাকমাদের নামানুসারে চাকমাকূল’ নামে একটি স্থান রয়েছে।
ঐ স্থানের পার্শ্বস্থিত স্থানের নামও ফতে খাঁ নামক একজন চাকমা রাজার নামানুসারে ফতেখাঁকূল’ বলা হয়। চাকমাকূলের অপরদিকে বাকখালী নদীর ওপারে চাকমা রাজাদের নামানুসারে রাজারকূল নামক স্থানটি অবস্থিত। অনেকে তাই চাকমাকূল অঞ্চলটিকেই বিজয়গিরির বর্ণিত সাপ্রেইকূল (সাকপ্রে-কূল) বলে মনে করেন।
আরাকানি ভাষায় সাক’ অর্থ চাকমা। আর ‘প্রে’ অর্থ হলাে দেশ। অতএব সাকপ্রে অর্থ হলাে চাকমাদেশ বা চাকমারাজ্য। উপরােক্ত সূত্রানুযায়ী, চাকমারা বিজয়গিরির উক্ত অভিযানকালেই বর্তমান চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূখণ্ডে প্রথম জনগােষ্ঠী হিসেবে প্রবেশ এবং বসতি স্থাপন শুরু করেছিল।
পান্নালাল মজুমদারের বইয়ে বিজয়গিরির শাসনকাল উল্লেখ করা হয়েছে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ। আবার প্রদীপ্ত খীসা তাঁর পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বইয়ে আনুমানিক ৫৯০ সালে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি ও তার সেনাপতি রাধামন খীসা রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), “, কাঞ্চননগর (কাঞ্চনদেশ) ও কালঞ্জর (কুকিরাজ্য) প্রভৃতি জয় করেন বলে উল্লেখ করেন। উপরােক্ত হিসাব অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের বসতি স্থাপনের ইতিহাস প্রায় এক হাজার চারশত বছর ।।
অশােক কুমার দেওয়ানের অনুমানে, উত্তর ত্রিপুরার কোনাে স্থানে বসবাসকারী চাকমারা সেখানে আনুমানিক দুশ থেকে আড়াইশ বছর কাল অতিবাহিত করার পর পঞ্চদশ সতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বদিকে সরে আসতে থাকে এবং পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এবং তার উপনদীসমুহের উপত্যকা ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই হিসাব অনুযায়া পাবত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন পাঁচশত বছরেরও অধিককাল আগে।
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস অনুযায়ী বিজয়গিরিকে ১ম রাজা ধরলে ৩২/৩৩ তম রাজা হচ্ছেন অরুণযুগ (ইয়াংজ)। তার শাসনকাল আনুমানিক ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ। বলা হয়, এই সময়কালে তিনি উত্তর বার্মায় এক রাজা ছিলেন। এ সময় আরাকানরাজ মেঙগাদি সরাসরি আক্রমন নাা করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে রাজা অরুণযুগকে পরাজিত করেন । চাকমা ঐতিহাসিকদের মতে অরুণ যুগের পতনের পরপরই অর্থাৎ ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে চাকমারা বার্মা থেকে চট্টগ্রামে বা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন।
ত্রিপুরার রাজা ধন্যমানিক্যর শাসনকাল ১৪৯০-১৫১৪ সাল । তার সময় ‘চাকমা রাজ্য’ ত্রিপুরা মহারাজার অধীনে ছিল। ১৫১৬ থৈন সুরেশ্চরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র জনু রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৫২০ সালে চাকমা রাজার রাজার রাজ্যসীমা ছিল, পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাফ) নদী, পশ্চিমে সীতাকুণ্ড পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র ও উত্তরে চাঁইচাল পর্বতশ্রেণী।
ষােড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ Joao de Barros কর্তৃক অঙ্কিত Descripcao do Reino de Bengalla নামক একটি মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে কর্ণফুলি নদীর পার্শ্ববর্তী চাকোমাস’ (Chacomas) নামক একটি স্থানের নাম চিহ্নিত আছে।
১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে Gastaidi নামক একজন ইউরােপীয় কর্তৃক অঙ্কিত ‘BENGALA’ নামক মানচিত্রেও চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিকস্থ এবং আরাকানের উত্তর দিকস্থ একটি স্থানের নাম Chadma (চাডমা) হিসেবে পাওয়া যায়। ১৬০৭ সালে আরাকান রাজা মেংরাজাগ্রি ওরফে সেলিম শাহ চট্টগ্রামস্থ পর্তুগিজ ফাদারকে লিখিত এক চিঠিতে Chacomas শব্দটির পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।
এ সময় চাকমাদের উপর আরাকানিদের কর্তৃত্ব ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৬৮৪ সালে আরাকান রাজা চান্দা থুধম্মার (১৬৫২-১৬৮৪) মৃত্যু হলে চাকমাদের উপর আরাকানের প্রভাব কমতে শুরু করে এবং এর আরও কয়েক বছর পর আরাকানে সাথে চাকমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
মােঘল ও নবাবি আমলে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ; ফটিকছড়িসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল কার্পাস বা তুলা মহল হিসেবে পরিচিত ছিল। পার্শবর্তী চট্টগ্রাম জেলার ব্যবসায়ীদের সাথে চাকমা রাজ্যের প্রজাদের পণ্য বিনিময় ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে চাকমা রাজারা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস বা তুলা চট্টগ্রামের মােঘল রাজপ্রতিনিধিকে প্রদান করতেন। এ কার্পাস ‘শুল্ক’ কোনাে করদরাজ্যের কর ছিল না।
১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে এতদঞ্চলের তৎকালীন রাজা জল্পীল খান তার রাজ্যে কতিপয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় সমতল ভূমির বাঙালি ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবস্যা করার অনুমতি দানের জন্য মােঘল কর্তৃপক্ষকে এক পত্র প্রেরণ করেন এবং সেই সঙ্গে ১১ মণ তুলাও উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করেন। এভাবেই সর্বপ্রথম মােঘলদের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
উক্ত উপঢৌকনের সূত্র ধরে পরবর্তীতে মােঘল শাসকরা পার্বত্যাঞ্চলের সামন্ত রাজার কাছ থেকে খাজনা দাবি করে থাকে। কিন্তু যেহেতু এই পার্বত্য চাকমা রাজ্যটি মােঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ নয় তাই তৎকালীন রাজা খাজনা দিতে অস্বীকার সবেন। ফলে এক পর্যায়ে মােঘলদের সাথে উক্ত রাজ্যের শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
বলা বাহুল্য এতদঞ্চলের জনগণ সেসব আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে থাকে। তাই ব্যবসায়িক যােগসূত্র ছাড়া সমতল অধিবাসী তথা মােঘল কর্তৃপক্ষ এবং চাকমাদের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে এবং চাকমাদের স্বশাসন ব্যবস্থার উপর মােঘল শাসকদের কোনাে প্রভাব ছিল না। বস্তুত চাকমা স্বশাসনের ক্ষেত্রে প্রাক-উপনিবেশিক আমলে কোনাে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি।
উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে চাকমা রাজা তথা আদিবাসী জুম্ম রাজন্যবর্গরা এতদঞ্চলে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন। এ উপমহাদেশের প্রায় ৬০০ বছরের মােঘল শাসনও এতদঞ্চলের আদিবাসী চাকমা রাজ্যের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার ক্ষেত্রে কোনাে হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি বা করেনি। তাই এ যুগকে সুনির্দিষ্টভাবে চাকমা রাজ্যের স্বাধীন ও সার্বভৌম যুগ বলা যায়।
ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে চাকমা রাজ্যে বরাবরই একটা ধারাবাহিক সরল ও ঢিলে-ঢালা শাসনব্যবস্থা কার্যকরভাবে চলে এসেছিল। এমনকি জাতীয় জীবনের চরম সংকটকালেও এ শাসনব্যবস্থা খুব বেশি ভেঙে পড়েনি।
রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা এবং দেশরক্ষায় মূলত তালুকদার,দেওয়ান, খীসা ও নায়েব প্রমুখরা রাজ প্রতিনিধি হিসেবে রাজাকে সহায়তা করতেন । কার্যত স্বাধীনতাপ্রিয় কিন্তু রাজভক্ত জনসাধারণ ছিল এ শাসনব্যবস্থার মূল শক্তি ও উৎস।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজরা চাকমা রাজ্যসহ স্বাধীন জাতিগুলাের দিকে নজর দেয়। ইংরেজরা চাকমা রাজ্যে প্রথম অভিযান করে ১৭৭৭ সালে। সে সময় ইংরেজ বাহিনী শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। চাকমা রাজ্যটিকে ব্রিটিশ শাসনাধীনে আনা এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় সেই অভিযান।
এ সময় চাকমা রাজার প্রখ্যাত সেনাপতি রুনু খানসহ দুলুব, ছুরি, কন্নু, থুথাং, মুনগাজী প্রমুখ সেনাপতির নেতৃত্বে চাকমা রাজা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার আশপাশে সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর ১৭৮৩, ১৭৮৪ ও ১৭৮৫ সালে ইংরেজদের সাথে চাকমা রাজ্যের সৈন্যদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ইংরেজরা পরাজিত হয়।
ইতিহাসে এই যুদ্ধ ”তুলা যুদ্ধ” বা ‘তুলা বিদ্রোহ’ নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে। পরে ১৭৮৭ সালে চাকমা সামন্ত শ্রেণীর একটি অংশ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে চাকমা রাজা দুর্বল হয় পড়ে এবং একপর্যায়ে ইংরেজদের সাথে সমঝােতামূলক সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৭৯১ সাল থেকে কার্পাসের পরিবর্তে টাকায় রাজস্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ১৭৯২ সালে টাকায় কর ধার্য ছিল ১৮১৫ টাকা।
প্রায় ৭৩ বছর অর্থাৎ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা রাজাদের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোনাে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি এবং সামন্ত রাজারা অনেকটা স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ প্রশাসন চালিয়ে গেছেন বলা যেতে পারে।
যদিও চাকমা রাজাকে তার বিশাল ও উর্বর রাঙ্গুনিয়া তরফের উর্বর অঞ্চল কোম্পানির করায়ত্তে ছেড়ে দিতে হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কার্যত কোম্পানির করতলগত হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ উপমহাদেশে (১৭৫৭-১৮৫৭) ১০০ বছরের সরাসরি শাসনের কোনাে প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে পড়েনি বলা যায়।
কারণ কোম্পানির সরাসরি শাসনবহির্ভুত এলাকা (Non-regulation area) হিসেবে পার্বত্য অঞ্চল চিহ্নিত ছিল। আর চট্টগ্রামের মতাে অন্যান্য এলাকা যা কোম্পানির সরাসরি শাসনাধীন ছিল তাদেরকে Regulation area হিসেবে গণ্য করা হত।
পরবর্তীতে ব্রিটিশরা চাকমা রাজ্যকে বিভক্ত করে ১৮৭১ সালে বােমাং সাকেল নামে একটি নতুন সার্কেল গঠন করে। এরপর ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে চাকমা রাণী কালিন্দি-এর আমলে ব্রিটিশরা চাকমা রাজ্যকে আবারাে বিভক্ত করে উত্তরাঞ্চল নিয়ে নতুন মং সার্কেল গঠন করে।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশরা মিজোরামের দক্ষিণ লুসাই পাহাড়ি এলাকা নিয়ে সাভ, লুসাই পাহাড়ি এলাকা নিয়ে সাউথ লুসাই হিলস জেলা গঠনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্বাংশের উইপাম রেঞ্জ এলাকাটি উক্ত জেলায় যুক্ত হয় এবং এতদঞ্চলের চাকমারা ভারতের মিজোরামে অন্তর্ভুক্ত হয়।
উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিভিন্ন মৌজায় বিভক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রায় তিন শতাধিক মৌজায় বিভক্ত করে প্রত্যেক মৌজায় একজন মৌজা প্রধান হিসেবে হেডম্যান নিয়ােগ দেয়া হয়।
বৃটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগের প্রাক্কালে দেশ বিভাগের সময় অপরাপর অঞ্চলের ন্যায় এই অঞ্চলেও অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি ওঠে। বিশেষ করে স্নেহ কুমার চাকমা ও ঘনশ্যাম দেওয়ান এর নেতৃত্বে শিক্ষিত মহল এই দাবিতে সরব ছিলেন। কিন্তু তাদের দাবি প্রত্যাখ্যাত হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয় ।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের সাথে ছয় দফা দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলও আন্দোলিত হয়েছিল। সে সময় জুম্মদের অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতাে চাকমা ছাত্র-যুব সমাজ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে । অসহযােগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে পার্বত্য চট্টগ্রামেও দোকানপাট, রাস্তা-ঘাট অচল করে দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুম্মদের অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতাে অনেক চাকমা ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং অনেক চাকমা মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু পরে তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতা ও আমলার ষড়যন্ত্রে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অথবা অংশগ্রহণ করেও নথিভুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চাকমাসহ জুম্ম ছাত্র-যুবকরাও আন্দোলনে যােগ দিতে সংগঠিত হতে থাকে। তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ছাত্র-যুবকদেরও উদ্ভুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।
১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কোকনদাক্ষ রায়ও (রাজা ত্রিদিব রায়ের কাকা) মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন। এ সময় কয়েকশ’ চাকমাসহ জুম্ম ছাত্রযুবকও মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিল। প্রথম অবস্থায় তারা অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিল ।
কিন্তু পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমামের প্ররােচনায় জুম্ম ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযােগ বন্ধ করে দেয়া হয় বলে অভিযােগ রয়েছে। এ সময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কোকনদাক্ষ রায়কেও কোনাে অজুহাত ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। ফলে অনেক জুম্ম ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পেরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেরত আসে।
তৎসময়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) বাহিনীতে চাকমাসহ অনেক জুম্ম ছিল। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে রমণী রঞ্জন চাকমা রামগড় সেক্টরে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত হন। সিপাহি হেমরঞ্জন চাকমা বগুড়া সেক্টরে নিখোঁজ হন। তার লাশও পাওয়া যায়নি।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশবাহিনীতে অনেক চাকমা চাকরিরত ছিলেন। তাদের মধ্য বিমলেশ্বর দেওয়ান ও ত্রিপুরা কান্ত চাকমাসহ ২০/২২ জন জুম্ম সিভিল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বরেন ত্রিপুরা, কৃপাসুখ চাকমা, আনন্দ বাঁশি চাকমা ছিলেন অন্যতম।
কথিত আছে, খাগড়াছড়ি জেলার কমলছড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে চেঙ্গী নদী পার হওয়ার সময় নদীতে হাঁটু পানি থাকায় যাতে জুতা ও প্যান্ট ভিজে নষ্ট না হয় সেজন্য কমলছড়ি গ্রামের জনৈক মৃগাঙ্গ চাকমা মেজর জিয়াউর রহমানকে পিঠে তুলে নদী পার করে দেন।
এভাবে মেজর জিয়া বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য পাকবাহিনী মহালছড়ির সভ্য মহাজন (চাকমা), গৌরাঙ্গ দেওয়ান ও চিত্তরঞ্জন কার্বারিকে ধরে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী তাদেরকে আর ফেরত দেয়নি। তাঁদের লাশও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এজন্য অনেক চাকমা নারী বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনা সদস্যের ধর্ষণের শিকার হয়।
চাকমাদের সামাজিক সংগঠন
অনেক লেখক ও গবেষক চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও দৈননাক—তিন জনগােষ্ঠীকে একটি জাতির তিনটি বড় দল হিসেবে দেখিয়েছেন। একসময় তারা দীর্ঘ প্রায় পাঁচশত বছর বছর বার্মা ও আরাকানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। কিন্তু তারা ১৪শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আরাকানের পশ্চিমে অর্থাৎ চট্টগ্রামের চতুর্দিকে আগমন করে।
এ জনগােষ্ঠীর যে দল আরাকানের পশ্চিমাংশে আগমন করে আরাকানিদের কতৃক তাদেরকে বলা হয় আনক্যা’ (Anokkya)। তাদের ভাষায় আনক’ অর্থ পশ্চিম। আর যে দল আরাকানের পাহাড়ি এলাকায় থেকে যায় তাদেরকে তঞ্চঙ্গ্যা (Tangchongya) নামে ডাকা হয়। উক্ত দুটি দল ছাড়াও দৈননাক’ নামে এ জনগােষ্ঠীর আরও একটি দল ছিল।
তারা আরাকান সেনাবাহিনীতে কাজ করত। (দৈননাক’ {Dainnak) অর্থ হচ্ছে ঢালধারী সৈনিক। এই ‘দৈননাক’ জনগোষ্ঠী এখনাে আরাকানে বসবাস করছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদেরকে আলাদাভাবে জাতি হিসেবে দাবি করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত কতিপয় আইনে এবং সমাজ ও সাহিত্যেও তারা বর্তমানে স্বতন্ত্র ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ হিসেবে স্বীকৃত।
চাকমা গােত্র ও গােষ্ঠী
চাকমাদের মধ্যে অনেক ”গঝা” ও ”গুত্থি” রয়েছে। চাকমা ভাষায় গোষ্ঠী ও গোত্রকে যথাক্রমে ”গঝা”’ ও ‘গুত্থি’ বলা হয়। প্রত্যেক ‘গঝা বা গােষ্ঠী কয়েকটি ‘’গুত্থি” বা গোত্র নিয়ে গঠিত। এইচ এইচ রিজলি লিখেছেন, সম্ভবত গ্রীক ও রোমানদের মতো চাকমাদেরও তাদের ইতিহাসের শুরুতে দলগুলি সংগঠনের একক হিসেবে নির্দিষ্ট জনস্বার্থে ভুমিকা পালন করেছিল।
চাকমা সমাজে ‘গঝা’র সংখ্যা ত্রিশাধিক। অপরদিকে গুথির সংখ্যা প্রায় অর্ধশত । সতীশ চন্দ্র ঘােষ ‘গঝা’কে গোষ্ঠি হিসেবে লিখেছেন। অপরদিকে অশােক কুমার দেওয়ানের মতাে হলো, আরাকানি শব্দ মাথা (সর্দার বা দলনেতা) অর্থে ‘গং’ এবং সন্তান বা মানুষ অর্থে ছা যুক্ত হয়ে ‘গং + ‘ছা’ = ‘গংছা > ‘গঝা’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, অতীতে প্রথমে দলপতিদেরকে কেন্দ্র করে গঝাগুলি গঠিত হয়েছিল। পরে বসতি অঞ্চল বা নদীর নামানুসারে আরও গঝা গঠিত হয়। অতীতের পদবিবাচক ‘গঝা’গুলাে হলাে, ‘ধাবেং’ (গভর্ণর), ‘বোর্বুয়া’ (তিন সহস্র সেনার অধিনায়ক), ‘চেগে’ (সেনা অফিসার), বরচেগে’, ‘খ্যংচেগে’, ‘দুখ্যাচেগে’, ‘লচ্চর’ (লস্কর), নারান’ (কুরকুত্যা), ‘ওয়াংঝা ইত্যাদি।
স্থানের নামানুসারে গঠিত ‘গঝা হলাে, তৈন্যা গঝা’ (তৈনছড়ি তীরবাসী), মুলিমা গঝা’ (মুরিমা/মাতামুহুরী তীরবাসী), বুং গঝা’ (বােমু খালের তীরবাসী), ফাকসা গঝা’ (ফাস্যাখালী নদীর তীরবাসী) ইত্যাদি। এছাড়া চাকমাদের গঝার নামে টোটেমিক বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘বগা গঝা’ (বক-গঝা) তদেগা গঝা’ (টিয়া-গঝ), ‘কুদুগাে গঝা” (সজারু-গঝা) ইত্যাদি। নিম্নে চাকমাদের ‘গঝা’ ও ‘গুথি সমূহের নাম দেয়া হলাে।
ক্রমিক নং | গোজার নাম | গুত্থির নাম |
১ | বগা গোজা | ১। ধূর্য্যা গোজা ২। নিনাদ্ন্যা ৩। কাঠ্যেয়া ৪। রামদালিকা ৫।মুলিখাজা ৬।কাত্তুয়া ৭।ভেলে ৮।বোয়া ৯। নানুকতুয়া ১০। পোয়াকামার্য্যা ইত্যাদি |
২ | দার্য্যা গোজা | ১। কোমরেং ২। নাদুকতুয়া ৩। কাত্তুয়া ইত্যাদি |
৩ | লারমা গোজা | ১। চার্য্যা ২। পিড়াভাঙা ৩। বগা ৪। ভবা ৫। তদেগা ৬। সামঝা ৭। সাতভেইয়া ইত্যাদি |
৪ | ধামেই গোজা | ১। চাওন্যা ২। সকুয়া ৩। আগারা ৪। হাতি ৫। পিড়াভাঙা ৬। সুরেশ্বরী ৭। বাঘঅজা ৮। করেংগিরি ৯। আওনি কণা ১০। রাক্কোয়াবাপ ১১। নাদকতুল ১২। কাঙারা ইত্যাদি |
৫ | তোন্যা গোজা | ১। ধুর্য্যা ২। কুর্য্যা ৩। মুলিয়া ৪। পৈয়ব ইত্যাদি |
৬ | পোয়া গোজা | ১। কাক্কিনা ২। ফাত্তোয়া ৩। কলয় ইত্যাদি |
৭ | পোমা গোজা | ১।জান্দর ২। গুইয়া ৩। তুদা ইত্যাদি |
৮ | কুরাকুত্যা বা নারান গোজা | ১। নেন্দার ২। সুরেশ্বরী ৩। তদেগা ৪।পেনজাং ৫। কাঙারা ৬। তেতৈয়া ৭। পজা ৮। পিরাভাঙা ৯। আগুনা ১০। কাউয়া ১১। ভদং ১২। ভূত ১৩। ক্যকধরা ১৪। কবা ১৫। দেয়ান ১৬। রাজাকাবা ১৭। অমরি ১৮। কুগী ১৯।আউনাপুনা ২০। আমু ইত্যাদি |
৯ | ওয়াংঝা গোজা | ১।কাঙারা ২। শ্যাঠা ৩। পুংঝা ইত্যাদি |
১০ | লচ্চর গোজা | ১।ভিদ্দিলী ২।ওয়াংঝা ৩। গঝাল ৪।পিরাভাঙা ইত্যাদি |
১১ | কাম্ভেই গোজা | ১। মেন্দর ২। কালাপেনজাঙি ৩।জাঙি |
১২ | চেগে গোজা | ১। লুলাং ২। ভুরুমা ৩। কাঙরা ৪। ধাবানা ৫। বহুলা ৬। বান্যাব ৭। পিড়াভাঙা ৮। মগ ইত্যাদি |
১৩ | বড় চেগে গোজা | ১। খোট্যাল/গত্তাল ২। লোয়াকদ্দা ৩। চেলীপুনা ৪। উন্দুরতালা ৫।পুংজা ইত্যাদি |
১৪ | বুংসা গোজা | ১। কাঙারা ২। মৈষচরা ৩।চগদা ইত্যাদি |
১৫ | মুলিমা গোজা | ১।ধাবানা ২। মিদা ৩। নোয়ান্যা ৪। সিং হাসর্প ৬। আনন্দ্যা ৭। কলা ৮। রাঙসিলন্যা ৯। বাদালী ১০।সেবাজ্যা ১১। সকুয়া ১২। মানিয়া ১৩। সাদং ১৪। করম্যা ১৫। সল্যা ১৬। পজা ১৭। ইজা পজা ১৮। ক্ষাংথং ১৯। বামন চেগে ইত্যাদি |
১৬ | ফাক্সা গোজা | ১। বালকা ২। বরইবেচা ৩। কলা চেম ৪। কাঙ ৫। তিন ভেদা ৬। বড় কু্য্যা ৭। ছোট কুয্যা ৮। চিলা ৯। নাবালিকা ১০। গুড়াফাক্সা ইত্যাদি |
১৭ | আমু গোজা বা আঙু গোজা | ১। দয্যা ২। মগ ৩। সিঙিরা পুনা ৪। তালুকদারদাঘি ইত্যাদি |
১৮ | লেবা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
১৯ | ফিত্তিয়া গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২০ | ফেদুংসা গোজা /ফেদংসা গোজা | ১। মুলিয়া ২। কবার্যা ৩। পুংঝা ৪। কাশমানিক ৫। ইন্দুরতালা ৬। কালাপিলাবাপ ইত্যাদি |
২১ | খ্যংচেগে গোজা | ১।চৈদানী ২। চানৈ ৩। দোজা ৪। কবার্যা ৫। সম ৬। সর্দার ৭। কাগুনিকাল ৮। বেৎকাবা ইত্যাদি |
২২ | উচ্চুরী গোজা | আগুনাপুনা ইত্যাদি |
২৩ | তেইয়া গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৪ | বড় কান্তি গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৫ | বড়বুং গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৬ | ছোটবুং গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৭ | খ্যাঙজী/খ্যাংজয়/হেং্যা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৮ | ফেমা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
২৯ | পুরান তেইয়ে গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৩০ | হেইয়া/ঐয়া গোজা | ১। কুর্য্যা ২।ধুর্য্যা ৩।মুলিয়া ৪। পৈয়ব ৫। জাল্যা ৬। সল্যা ৭। পিড়াভাঙা ইত্যাদি |
৩১ | ফাকসা গোজা | ১। বালকা ২। বরৈবেচা ৩। কলাচেম ৪। কাঙ ৫। তিন্ ভেদা ৬। বরকুর্য্যা ৭। ছোতকুর্য্যা ইত্যাদি |
৩৩ | রাঙি গোজা | ১। লোয়াঝাত্তোয়া ২। পার্বোয়া ৩। জাদি ৪। কাল ৫। বরইয়া ৬। বাদালি ৭। চেগে/তালুকদার ইত্যাদি |
৩৪ | কুদুগা গোজা | ১। ভূলা ২। কালাবাঘা ৩। কাল ৪। পিড়াভাঙা ইত্যাদি |
৩৫ | পেদাংছাড়ি গোজা | ১। পেদাংছারি ২। কুর্য্যা ৩। মুলিয়া ৪। পৈয়ব ইত্যাদি |
৩৬ | চাদঙ গোজা | ১। সর্দার ২। শেয্যা ৩। রসিরি ইত্যাদি |
৩৭ | বাবুরা গোজা | ১। বাবুরা ২। গঝাল্যা ৩। মানাইয়া ৪। লোয়াকদ্দা ৫। ভগতপ ইত্যাদি |
৩৮ | বুর্বুয়া গোজা | ১। তবা দাগি ২। ফরা দাগি ৩। কাংদড়ি দাগি ৪। পাগালা দাগি ইত্যাদি |
৩৯ | চেক্কাবা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৪০ | পুঙ গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
৪১ | বুংযা গোজা | গোষ্ঠীর নাম এখনো সংগৃহীত হয় নি। |
চাকমাদের পরিবারের ধরন
চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। চাকমা পরিবারে সাধারণত পিতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পিতার পরে মাতা, মাতার পরে বয়ােজ্যেষ্ঠতা অনুসারে পুত্রদের মতামত স্থান পেয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে পিতৃতান্ত্রিক হলেও অনেক ক্ষেত্রে নারীদের মতামতও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে থাকে। অর্থাৎ পিতা বা স্বামী পরিবারের প্রধান কর্তা হলেও তৎপরে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মতামতেরই গুরুত্ব থাকে। তবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষরাই প্রাধান্য পায়।
চাকমাদের বংশ পরিচয় পিতৃসূত্রীয়। পিতার সূত্র ধরেই সন্তানদের ‘গঝা’ ও ‘গুখি’ নির্ণয় করা হয়। সমাজে সকল অবস্থাতেই একজন পুরুষের বংশ পরিচয় অপরিবর্তিত থাকে। বিয়ের পরে মেয়েরা স্বামীর পরিবারের লােক বলে গণ্য হয়। পূর্বে চাকমা সমাজে যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
বর্তমান পরিবারগুলি এককভাবেই পরিচালিত। পুত্ররা বিবাহ করার পরপরই মূল পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের আলাদা পরিবার গঠন করে। তবে বৃদ্ধ পিতা-মাতারা সাধারণত পুত্রের গৃহেই বার্ধক্যের জীবন অতিবাহিত করে। এক্ষেত্রে অন্য সন্তানেরা সহযােগিতা করে। দুই/তিন দশক আগেও একেকটি চাকমা পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড়ে ৫/৬ জন হতে ১০/১৫ জন। বর্তমানে চাকমা পরিবারগুলাে অনেক ছােট; সদস্য সংখ্যা গড়ে বড়জোর ৫/৬ জন। প্রত্যেক দম্পতির সন্তানের সংখ্যাও ১/২ হতে ৪ জনের মধ্যে।
একজন চাকমা ব্যক্তির জীবনচক্র
জন্ম ও রীতি-আচার
আগের নিয়মানুযায়ী গর্ভবতী মহিলাকে নিজের স্বামীর ঘরে বা স্বামীর গােষ্ঠীর ঘরে সন্তান প্রসব করতে হয়। স্বামীর ঘরে বা স্বামীর গােষ্ঠীর ঘরে যদি সন্তান প্রসব করা সম্ভব না হয় তাহলে সন্তান প্রসব করার জন্য একটি পৃথক ঘর নির্মাণ করে দিতে হয়। এখন অবশ্য এসব নিয়ম নেই বললেই চলে। পূর্বে ‘ওঝারাই (এক ধরনের ধাত্রী) কোনাে গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসব করাতেন।
এখনও গ্রামাঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু আছে। তবে বর্তমানে শহরাঞ্চলে বা শিক্ষিত সমাজে কোনাে গর্ভবতীকে হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়ে কোনাে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আধুনিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করানাে হয়। কোনাে পরিবারে শিশু জন্ম হওয়ার সাথে সাথে তার মুখে মধু দেওয়া হয়, যাতে আগামীতে তার জীবন মধুময় হয়ে ওঠে।
এরপর নবজাত শিশুর ‘ন্যেয়’ (নাড়/নাভী) ছিঁড়ে যাওয়ার পর সাধারণত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে (আগে-পরেও হতে পারে) ‘কোজোই পানি লনা’ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। এতে ওঝা ডেকে
“ঘিল- কোজোই-পানি” (পরিশুদ্ধ পানি) দিয়ে নবজাত শিশুর চুল ধুয়ে পবিত্র করা হয়। ”কোজোই পানি লনা” অনুষ্ঠানে সীমিত আকারে ঘনিষ্ঠ ও গণমান্য ব্যক্তিদের ডেকে খানাপিনা ব্যবস্থা করা হয়। ওঝার মাধ্যমে প্রসব হলে উক্ত অনুষ্ঠানে ওঝাকে পুরস্কৃত করা হয়। কিছুদিন পরে শিশুটি একটু বড় হলে শিশুটির চুল মুড়িয়ে দেয়া হয়, যাকে চাকমা ভাষায় বলে ‘বিষচুল মুরানা’ ।
বিবাহ
চাকমা সমাজে সাধারণত এক স্বামী ও এক স্ত্রী প্রথা প্রচলিত। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক স্বামী ও একাধিক স্ত্রীর পরিবারও দেখা যায়। এটি মূলত অভিজাত শ্ৰেণীর মধ্যে দেখা যায়। এই প্রথা ব্যতিক্রমী হিসেবে সমাজে অত্যন্ত নগণ্য বলা যায়। এ প্রথা সমাজে অবৈধ না হলেও স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। চাকমা সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলিত।
চাকমা সমাজে মামাতাে বােন, মাসতুতাে বােন বা অনাত্মীয় কাউকে বিয়ে করা যায়। কিন্তু আপন কাকাতাে বা জেঠাতাে বােনকে বিয়ে করা যায় না। চাকমা সমাজে দূরসম্পর্কের নানা-নাতনি, নানি-নাতি সম্পর্কের বিয়ে হতে পারে। কিন্তু মামা-ভাগ্নি, ফুফু-ভাইপাে ইত্যাদি সম্পর্কের বিয়ে অবৈধ বা নিষিদ্ধ।
স্ত্রীর বড় বােনকে বিয়ে করা যায় না, স্ত্রীর ছােট বােনকে বিয়ে করা যায়। সাধারণত অসম বয়সীদের মধ্যে বিয়ে মেনে নেয়া হয় না, যদিও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। চাকমা সমাজে একই গুত্থির একই রক্তের মধ্যে সাতপুরুষ (প্রজন্ম) পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ। বর্তমানে এটা পাঁচপুরুষে শিথিল করা হয়েছে।
আগেকার দিনে চাকমা সমাজে বিবাহের যে সমস্ত রীতিনীতি প্রচলিত ছিল, কালের বিবর্তনে সেগুলাের অনেক কিছুই আজ অচল। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের ধারায় বিবাহ ব্যবস্থায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তা সত্ত্বেও চাকমাদের বিবাহ প্রথা এখনও বেশ ঐতিহ্যমণ্ডিত। চাকমা সমাজে বিভিন্ন উপায়ে বা পদ্ধতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে । নিম্নে প্রধান কয়েকটি পদ্ধতি উল্লেখ করা গেল-
পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী :
বিশেষ করে আগেকার দিনে পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী পাত্র-পাত্রী ঠিক হয় এবং তদনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই প্রথা এখনাে প্রচলিত থাকলেও তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে দিন দিন তা উঠে যাচ্ছে।
পাত্র-পাত্রীর পছন্দ অনুযায়ী পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের সম্মতি সাপেক্ষে। বর্তমানে এই পদ্ধতি বেশ গ্রহণযােগ্য ও জনপ্রিয়। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে মধ্যে মন দেয়া-নেয়ার মধ্য দিয়ে একে অপরকে পছন্দ করে। পরে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পিতা- মাতা বা অভিভাবকদের জানানাে হয়। তারা সম্মত থাকলে প্রথা মোতাবেক বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়।
পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের অমত থাকলে পলায়ন করে বিবাহ :
অনেক সময় ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে একে অপরকে পছন্দ করলেও পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা এ বন্ধনে সম্মতি জ্ঞাপন করে না। ফলে অনেক যুবক-যুবতী পালিয়ে গিয়ে বৌদ্ধ বিহারে বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রেজিস্ট্রি বিবাহ করে থাকে। এ বিয়ের পর সামাজিক স্বীকৃতি স্বরূপ বিবাহ ভােজের আয়ােজন না করলে সমাজ খারাপ চােখে দেখে। অনেক সময় সমাজের পক্ষ থেকে অভিযােগ তােলা হয়।
আগেকার দিনে এভাবে পালিয়ে গেলে যুবক-যুবতীকে সালিশের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হতাে। চাকমা সমাজের নিয়ম অনুসারে সালিশে (কার্বারী বা হেডম্যান আদালতে) মেয়ের পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা বিয়েতে অমত থাকলে তার বা তাদের মেয়েকে ফেরত পায়।
ফেরত পাওয়ার পর আবার পালিয়ে গেলে পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা মেয়েকে দুইবার পর্যন্ত ফেরত পায়। তিনবারের মাথায় আর মেয়েকে ফেরৎ পায় না। সমাজ মেয়ের পিতা-মাতা বা অভিভাবককে বিয়ে দিতে বাধ্য করে বা সমাজ স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে যুবক-যুবতীদের বিবাহ সম্পন্ন করে দেয়। সমাজে এই প্রথা বর্তমানে প্রচলন নেই বললেই চলে।
জোরপূর্বক ধরে নিয়ে বিবাহ :
মেয়ে পক্ষ বিয়ে দিতে সম্মত না থাকলে অনেক সময় ছেলে মেয়েটিকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গেলেও সালিশে মেয়ের পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা মেয়েকে ফেরৎ পাওয়ার রীতি রয়েছে। এটা আগেকার দিনে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এটা গ্রহণযােগ্য নয়। তবু প্রত্যন্ত অঞ্চলে কালে-ভদ্রে এটা দেখা যায়।
চাকমাদের বিবাহ পদ্ধতি
সাধারণভাবে আগেকার দিনে বিবাহের পূর্বে ঘটক যাকে চাকমা ভাষায় বলে ‘উকিল’ বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করে। চাকমা বিবাহের নিয়মানুসারে পাত্রের বাবাকে পাত্রীর বাবার নিকট বিবাহের পূর্বে অন্তত তিন বার যেতে হয় । বলা বাহুল্য প্রতিবারই পাত্রের বাবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক সুখাদ্য এবং বস্ত্রদি উপহারস্বরূপ থাকে।
চাকমা বিবাহে মদের প্রয়ােজনীয়তা কম নয়। বিবাহের চুড়ান্ত দিন ধার্য করার জন্য পাত্রের বাবা পাত্রীর বাবার কাছে মদের বোতল সঙ্গে নিয়ে যায়। এটাকে চাকমারা মদপিলাং’ বলে। উক্ত তিনবার যােগাযােগের মধ্যে বিবাহের দিন ধার্য বাদেও কনের জন্য গয়নাগাটি এবংদাভার (পণের) টাকা ধার্য করা হয়। পূর্বে পাত্রীর বাবা পাত্রের বাবার কাছ
থেকে সামান্য কিছু টাকা টোকেন স্বরুপ নিতেন। অতীতে গয়না হিসেবে কনেকে রােপ্য নির্মিত কানের ঝুঙুলি, গলায় পিজিছরা, হাতির দাঁতের বাঙোরি, কুজিখারু, পায়ে থেঙতখারু ও নানাবিধ অলংকার দিতে হতাে। তবে বর্তমানে আধুনিক স্বর্ণালংকার দেয়া হয়।
বিবাহের দিন বরযাত্রীরা শুভক্ষণ দেখে কনের বাড়িতে রওনা হয়। তারা ‘ফুলবারেং’ (বাশ নির্মিত এক প্রকার ঝুড়ি)-এ করে কাপড়-চোপড়, অলংকারাদি ও প্রসাধনী সামগ্রীগুলাে সাজিয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে ফুলবারেং-এর পরিবর্তে আধুনিক স্যুটকেস ব্যবহার করা হচ্ছে।
বউ নিয়ে যাবার আগে কনের অভিভাবকেরা কনেকে আশীর্বাদ করে। একটা থালায় চাল ও তুলা আনা হয়। আশীর্বাদকারীরা ঐ থালা থেকে এক টুকরাে তুলায় সামান্য চাল নিয়ে ‘থু থু শব্দ করে কনের মাথা ছোঁয়ায় ও আশীর্বাদ করে।
এভাবে আশীর্বাদপর্ব সমাপ্ত হলে বরযাত্রীরা বৌ নিয়ে বরের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে। বস্তুত বরের বাড়িতে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। সেখানে অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হয় সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলাে-
আগপানিকুম তুলােনা ও পানপাদা ভাজেই দেনা (পবিত্র পানি সগ্রহ ও পাতা ভাসানাে)
ঊষার সাথে সচরাচর ছয়জন যুবতীসহ একজন সধবা মহিলা নদীতে জল আনতে যায়। তাদের মধ্যে একজন দুহাতে দু টুকরাে কলাপাতায় ফুল সাজিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আর একজন দুটি সরঅ-এর (মাটির তৈরি ঢাকনার) উপর দুটি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীতে নিয়ে যায়। স্নানের সময় সধবা মহিলাটি দু টুকরাে কলাপাতায় পান সুপারি রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
ঐ দু টুকরাে কলাপাতা যদি একত্রে ভাসতে থাকে, তবে বিবাহটি শুভ হিসেবে ধরা হয়। এ প্রথা অবশ্য বর্তমানে অচল। পবিত্র জলের কলসি নিয়ে যুবতীরা বিয়ে বাড়িতে ফিরে যায়। দুজন যুবতী সদর দরােজার দু পাশে দুটি কলসি রেখে দেয় এবং সধবা মিহলাটি মাটির প্রদীপ কলসি দুটির উপর জালিয়ে রেখে দেয়। কলসি দুটির গলায় সাতনালি সুতার বন্ধনি দেওয়া হয় ।
বৌ তুলােনা (বউ তােলা) :
বউ তুলােনার বাংলা হলাে, বউকে বরের বাড়িতে তােলা। বরযাত্রীরা কনেকে নিয়ে বরের বাড়িতে পৌছলে কনেকে এক ঐতিহ্যমণ্ডিত রীতিতে বাড়িতে তোলা হয়। প্রথমে বরের ছােট বােন বা ভাই অথবা বরের গােঝাভুক্ত কেউ (বরের বয়সে ছােট) কনের পা ধুয়ে দেয়। কনের হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে সুতা বেঁধে বরের মা কনেকে বাড়িতে তােলে। কনে দু কলসিতে বাঁধা সুতার বদ্ধনী ডিঙিয়ে বাড়িতে ওঠে। এরপরে কনেকে তার জন্য রাখা নির্দিষ্ট কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ কামরাকে বলা হয় ‘ফুলঘর’!
জরাবানা (জোড়া বাঁধা) :
বিবাহের শুভলগ্ন আগত হলে বর ও কনেকে বিবাহের আসরে পাশাপাশি বসানাে হয়। কনে বরের বাম পাশে বসে। এরপর সাবালা (যিনি বিবাহকার্য পরিচালনা করেন) সমাজের সম্মতি আদায়ের জন্য উপস্থিত সবাইকে, ‘জোড়া বেঁধে দেবার হুকুম আছে কিনা?’ তখন সাধারণত সবাই সমস্বরে আনন্দের সাথে বলে ‘আছে, আছে।
এভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা এবং তিনবারই জোড়া বাঁধার সম্মতি জানালে জরাবানা সম্পন্ন হয়। এরপর সাবালা একটি খাদি বা কাপড় দিয়ে একসঙ্গে বর ও কনের কোমরে একসঙ্গে বেঁধে দিয়ে কয়েক মিনিট জোড়াবদ্ধ অবস্থায় রাখে। এভাবেই জরাবানা কার্য সম্পন্ন হয় এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। সমাজে এটা বহুল প্রচলিত এবং সামাজিকভাবে সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য পদ্ধতি।
চুমুলুং:
আগেকার দিনে চাকমাদের বিবাহের মূল অনুষ্ঠান হিসেবে ‘চুঙুলাং’ (উচ্চারণ ভেদে চুমুলাঙ)। ‘চুঙুলাং’ পূজায় দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে শূকর, মােরগ ও মুরগি বলি দিয়ে উৎসর্গ করা হয়। অনেকে সাত জাতের ফুল দিয়েও ঐ পূজা সম্পাদন করে থাকে। চুঙুলাং পূজায় ডিম, মদ ইত্যাদিও পূজায় উৎসর্গ করা হয়।
এ পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে এ পূজার জন্য নববধুকে কলসি নিয়ে নিজে গিয়ে নদী কিংবা কোনাে জলাশয় থেকে জল নিয়ে আসতে হয়। ঐ পূজার সময় যে পাত্রে দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে জল দান করা হয় তাতে অবশ্যই মন্ত্রপড়া মদ মেশানাে হয় এবং বর ও নববধূকে সে জল একটু হলেও পান করতে হয়। তবেই সে পূজা তাদের জন্য সিদ্ধ হয় বলে ধরা হয়।
বর ও নববধূকে ঐ পূজার দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে হয়। তারা উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। এরপর তারা সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে এ প্রথার প্রচলন নেই বললেই চলে। কেবলমাত্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে কখনাে সখনাে এ প্রথায় বিবাহকার্য সম্পন্ন হতে দেখা যায়।
বিসুত্ ভাঙনা
চাকমাদের রীতি অনুযায়ী বিবাহের ৩ দিনের মধ্যে বরকে বধূসহ তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কমপক্ষে এক রাত যাপন করতে হয়। এটাকে বিসুত ভাঙানা বলে । এক্ষেত্রে বরের বাড়ি যদি দূরে হয়ে থাকে তখন নবদম্পতি নিকটস্থ কোনো ছায়াময় গাছের নিচে আমন্ত্রিত অতিথিদের বসিয়ে কিছু খাইয়ে ও গাছে পানি ঢেলে এ কার্য কার্য (বিসুত ভাঙানা) সম্পন্ন করে। সাধারণত বিসুত ভাঙানা কার্য যতক্ষণ না সম্পন্ন হয় ততক্ষন আপন গুত্থির লােক ব্যতীত কারাে বাড়িতে বর-কনে উঠতে পারে না।
পরিবর্তিত বিবাহ পদ্ধতি :
বর্তমানে চাকমাদের বিবাহ পদ্ধতিতে নতুন ধারা সংযােজিত হয়েছে। তার একটি হলাে ধর্মীয় অনুষঙ্গে বিবাহ। এটি মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোনাে বৌদ্ধ ভিক্ষুর দ্বারা সম্পন্ন করা হয় । কেউ কেউ অবশ্য ভিক্ষুর দ্বারা বিবাহ প্রথার ঘাের বিরােধী। দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে “জরাবানা” মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করা।
সমাজ থেকে পর পর তিনবার ‘জরাবানা’র (বিবাহের) সম্মতি পাওয়ার পর বর-কনের মধ্যে আংটি পরানাে এবং মালা বদলের মাধ্যমে এই বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে বিশিষ্ট বা ঘনিষ্ঠ দু একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বর ও কনেকে উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এ পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয়তা ও সামাজিকভাবে ব্যাপক গ্রহণযােগ্যতা লাভ করছে।
ইদানীং তৃতীয়ধারা দেখা যায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে; আর তা হলাে রেজিস্টার বিবাহ। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ বিবাহ সম্পন্ন করা হয় এবং বিবাহের একটা সনদপত্র নিয়ে নেয়। বিয়েতে পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের সম্মতি না থাকলে বা নানাবিধ সামাজিক বাধার কারণে সাধারণত এই রেজিস্ট্রি বিবাহ সম্পন্ন করা হয়।
এ বিবাহ সমাজে এখনাে তেমন স্বীকৃত নয়। তবে নারীবাদী কর্মীরা রেজিস্ট্রি বিবাহের পক্ষে বেশি মত দেন। প্রথাগত সামাজিক স্বীকৃতি বা ঐতিহ্যগত বিবাহ পদ্ধতির ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি বিবাহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্তমানে বিবেচনা করা হয়।
বৃদ্ধাবস্থা
বৃদ্ধাবস্থায় চাকমা নরনারীরা সাধারণত তাদের কোনাে বড় ছেলে বা অবস্থা অনুযায়ী যে কোনাে ছেলের বাড়িতে তাদের শেষ জীবন কাটিয়ে দেয়। চাকমা সমাজে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাধারণত একটা শিশুর ন্যায় অত্যন্ত যত্নসহকারে পরিচর্চা করা হয়। এজন্য একটি কথা প্রচলিত, বড় বুড়াে, আরও গুরাে’; অর্থাৎ বেশি বুড়ো আরও বেশি শিশু।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা নানা-নানিদের শেষ জীবনে দেখাশােনা করা স্ত্রী-পুত্র বা সন্তান-সন্ততিদের অত্যন্ত মূল্যবান দায়িত্ব-কর্তব্য বলে জ্ঞান করা হয়। চাকমা সমাজে বয়স্করা সাধারণভাবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
মৃত্যু ও সৎকার পদ্ধতি
কোনাে লােকের মৃত্যু হলে তার মরদেহ শুভ্র কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়। ঐ সময় বিশেষ ধরনের তালে ঢোল বাজানাে হয়। ঐ তাল (ঢােলের শব্দ) শুনে পাড়ার লােকেরা বুঝতে পারে যে কোনাে বাড়িতে লােক মারা গেছে। তখন
গৃহস্থেরা ঐ বাড়িতে খবর নিতে যায় এবং গৃহিণীরা গৃহের সদর দরােজায় মাটির বারকোষ বা অন্য কোনাে পাত্রে তুষ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখে। এটি কোনো অপদেবতা বা ভূত-প্রেত যাতে ঐ গৃহে উপদ্রব করতে না পারে তার জন্য করা হয়। শবদাহের দিন মরদেহ স্নান করানাে হয় ।
ঐ সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু ডেকে মৃতের আত্মীয়স্বজন মঙ্গলসূত্র পাঠের ব্যবস্থা করে। অতীতে লুরি নামে এক জাতীয় বিশেষ ধরনের বৌদ্ধ পুরহিত ডেকে জয়মঙ্গল তারা বা আঘর তারা নামক গ্রন্থাদি থেকে বিভিন্ন ‘তারা’ (বৌদ্ধ ধর্মের সুত্র) পাঠ করা হতাে। মৃতের আত্মীয়-স্বজনেরা তার আত্মার সদগতি কামনা করে এবং (বিশ্বাস মতে) ঘাট পারের ভাড়া হিসেবে তার বুকে টাকা পয়সা প্রদান করে।
শবটিকে বাঁশ নির্মিত ‘আলং ঘর’ নামে একটি বিশেষ বাহনে করে শশানে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃতদেহটি বাড়ি থেকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নামানোর সাথে সাথে বাড়ির (মৃতের বাড়ি) যাবতীয় পানি ও উনুনের ছাই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এটা মৃতের সাথে ঐ বাড়ির সম্পর্ক ছিন্নের প্রতীক।
মৃতদেহটির সাথে একটি পুটলিতে তার জন্য ভাত ও অন্যান্য খাদ্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐগুলো মৃতদেহ দাহ করার আগে তার মুখে শেষবারের মতাে স্পর্শ করানাে হয়। মৃত লােকটি পুরুষ হলে চিতায় পাঁচ স্তর লাকড়ি এবং স্ত্রীলােক হলে সাত স্তর লাকড়ি দিয়ে চিতা তৈরি করা হয়।
এরপর মৃতদেহটি ‘আলং ঘর’সহ চিতার চারিদিকে পুরুষ হলে পাঁচবার এবং স্ত্রীলােক হলে সাতবার ঘােরানাে হয় এবং প্রতিটি ঘােরানাে বা প্রদক্ষিণের পর একবার করে চিতার সাথে সামান্য ধাক্কা দিয়ে চিতায় তুলে দেওয়া হয়। মৃতের জেষ্ঠ্যপুত্র বা রক্তের সম্পর্কের নিকটস্থ কোনাে আত্মীয় প্রথম তার চিতায় অগ্নিসংযােগ করে; পরে অন্যরা চিতায় আগুন দেয়।
পরদিন তার স্বগােত্রেরা আত্মীয়রা শ্মশানে গিয়ে তার হাড়গুলাে থেকে কিছু হাড়সহ সামান্য ভশ্মবিশিষ্ট ছাই একটি নতুন হাঁড়িতে সংগ্রহ করে হাঁড়িটির মুখ সাদা কাপড়ে ঢেকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। একে হাড় ভাসানাে বলে। এরপর ঐ চিতার চারকোণে চারটি বাঁশ পুঁতে বাঁশের মাথাগুলােতে সাদা কাপড়ের চন্দ্রাতপ উড়িয়ে দেওয়া হয়।
ঐটি চিতায় ছায়া দান করে। কেউ কেউ বাঁশের মাথায় লম্বা ধরনের সাদা কাপড় টাংগােন’ উড়িয়ে দেয়। মৃতলােকটি কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি দুরারােগ্য ব্যাধিতে মারা গেলে তাকে অন্যান্য লােকের নিরাপত্তার কারণে কবর দেয়া হয়। এবং পরে আবার তা যথারীতি দাহ করা হয়। এছাড়া ছােট শিশুদের মরদেহও কবরস্থ করা হয়।
চাকমারা এখনও বুধবারে মৃতদেহ দাহ করে না। কেননা তারা বুধবারকে লক্ষ্মী বার মনে করে।চাকমাদের মধ্যে খাদ্যশস্যের দেবী মা লক্ষ্মী বুধবারে মর্ত্যধামে আগমন করে বলে চাকমা লােককাহিনীতে বর্ণিত আছে। তারা মনে করে বুধবারে গর্তের সাপটিও বের হয় না।
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান
সাধারণত চাকমারা মৃতদেহ দাহ করার পরে সপ্তম দিবসে পুনরায় বৌদ্ধভিক্ষু আমন্ত্রণ করে এনে পরিবারের মঙ্গল কামনা করে ধর্মীয় সূত্র ও দেশনা শ্রবন করে। তারা মৃতের সদগতি কামনা করে তার উদ্দেশে অর্থ, চাল এবং অন্যান্য দ্রব্যাদী দান করে। এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানটিকে চাকমারা ”সাদ্দিন্যা” (সাপ্তাহিক ক্রিয়া) বলে। এছাড়াও চাকমারা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে যাকে ‘বােঝােরী’ বলে । অবস্থাপন্ন ঘরে উপর্যুপরি তিন বছরকাল পর্যন্ত মৃতের ‘বোঝোরী’ দেওয়া হয়।
চাকমা জাতির ঐতিহ্যগত সামাজিক সংগঠন, প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থা
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনাে চাকমাসহ সকল জুম্ম জনগােষ্ঠীর জন্য ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংগঠন এবং প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। এই সংগঠন ও ব্যবস্থা সার্কেল প্রধান রাজা, মৌজা প্রধান হেডম্যান ও গ্রাম প্রধান কার্বারীদের সমন্বয়ে গঠিত।
সার্কেলের প্রধানকে ‘চিফ’ বা স্থানীয়ভাবে ‘রাজা’ বলা হয়। রাজার প্রধান কাজ হচ্ছে—১. সার্কেলের ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা; ২. আদিবাসীদের প্রথা, রীতি, নীতি, ও সামাজিক বিচার; ৩. পার্বত্য জেলা পরিষদ অধিবেশনে যােগ দেয়া; ৪. জেলা প্রশাসনকে পরামর্শ দেয়া; ৫. হেডম্যান নিয়ােগে সুপারিশ করা ও ৬. কার্বারী নিয়ােগ করা।
মৌজার হেডম্যান ভূমি বন্দোবস্ত, ইজারা, হস্তান্তর বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে পারেন। মৌজার বনজ সম্পদ সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করেন। উপজাতীয় রীতিনীতি, প্রথা অনুযায়ী সামাজিক বিচার করতে পারেন । গ্রামের কার্বারী গ্রামের প্রধান। তিনি সাধারণভাবে গ্রামবাসীদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, ও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। এছাড়া উপজাতীয় রীতি-নীতি প্রথা অনুযায়ী সামাজিক বিচার করেন।
গ্রামের কার্বারী’ যাবতীয় ঝগড়া-বিবাদ বা নানা রকম সমস্যার নিষ্পত্তি করে থাকেন এবং সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলিতে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। কার্বারীর বিচার বা রায় মনঃপূত না হলে হেডম্যান আদালতে আপিল করা যায়। আবার হেডম্যানের বিচার বা রায়ের বিরুদ্ধে রাজা বা সার্কেল চিফের আদালতে আপিল করা যায় ।
চাকমা জাতির ধর্মীয় অবস্থা
চাকমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ‘হীনযানী’ এবং সুদূর অতীত থেকেই তারা এই ধর্মটি পালন করে আসছে। আগেকার দিনে চাকমাদের ‘আঘরতারা’ নামে একটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থও রয়েছে, যা বর্মী ও পালি ভাষার বিকৃত রূপে লিখিত হয় বলে ধারণা করা হয়। সে সময় লুরি বা ভ্রাম্যমাণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারাই চাকমা সমাজে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন করা হত।
‘লুরি’ বা ‘রুরি’ নামক বৌদ্ধ পৌরহিতেরা এখন প্রায় লুপ্ত। একদা প্রাচীন লুরিরাই তালপাতার উপর তাদের ধর্মীয় সূত্রাদি লিখতো। তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ আঘরতারায় ২৮টির মতো সূত্র রয়েছে বলে জানা যায়।
চাকমা রাজ্যের তৎকালীন শাসনকর্তা রাণী কালিন্দী (১৮৪৪-১৮৭৩ সাল) এর পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন চাকমা রাজার রাজধানী (বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন) রাজানগরে ১৮৬৯/৭০ সাল একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়। বলা যায় তখন থেকেই আধুনিক বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা চাকমাদের মধ্যে শুরু হয়।
বৌদ্ধ হিসেবে চাকমারা বেশ কয়েকটি ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করে থাকে। যেমন -১ কঠিন চীবর দান, ২. বৈশাখী পূর্ণিমা, ৩. মাঘী পূর্ণিমা, ৪. মধু পূর্ণিমা, , ওয়া ধরানা (বর্ষাবাস গ্রহণ), ৬. ওয়া ভাঙানা (বর্ষাবাস শেষকরণ), ৭. ব্যুহ চক্র ৮ ফানাস বাত্তি উড়ানা (ফানুস উড়ানাে), ৯. গাড়ি টানা, ১০. আহ্জার বাত্তি জ্বালানা (হাজার বাতি প্রজ্জ্বলন করা) ও ১১. মহাসংঘ দান ইত্যাদি।
চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের মধ্যে এখনও প্রকৃতি, ভূত, প্রেত, দেবতা ইত্যাদি অতিপ্রাকৃতিক শক্তিরও বিশ্বাস আছে। চাকমারা সাধারণত বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারী হলেও ধর্মান্ধ নয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সহজ-সরল বৈশিষ্ট্যই সম্ভবত তাদেরকে যুগ যুগ ধরে তাদের প্রাচীন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত রেখেছে।
তাই তারা উল্লেখযােগ্য হারে কখনােই ধর্মান্তরিত হয়নি। তবে নানা কারণে বিভিন্ন সময় কিছু কিছু চাকমা অনেকটাই পরিস্থিতির শিকার হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। বর্তমানে জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, সেটেলার বাঙালি ও সরকারি বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ ও ভুমি চবর, চরম দরিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি কারণে চাকমাদের একটা অংশের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বাস ও সংস্কার
চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু প্রভাব লক্ষণীয়। কিছু কিছু দেবদেবীর পূজাও তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে অবশ্য এসবের তেমন একটা প্রচলন নেই। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কখনাে-সখনাে পালন করা হয় মাত্র। এসব পূজার মধ্যে অন্যতম হলাে—১. ভাতদ্যা পূজা ২. • থানমানা পূজা ৩. ধর্মকাম ৪. গঙাত ভাতজরা দেনা ৫. মা লক্ষীমা পূজা ৬. ঐয়া পূজা ৭. চুঙুলাং পূজা ৮. মাধা-ধনা ৯. জুমমারানা ১০. কুলুক মারানা ১১, ভুদা পূজা ১২. শিজি পূজা ১৩, এদা দাগানা ১৪. সিন্দি পূজা সংক্ষেপে সেগুলোর কয়েকটি বর্ণনা করা হলাে—
ভাত-দ্যা পূজা
‘পূর্ব পুরুষের আত্মার সদগতি কামনা করে এবং মৃত্যুর পর কে কোথায় পুনর্জন্ম নিলেন তা নির্ণয়ের জন্য এই ভাত-দ্যা’ পুজার আয়োজন করা হয়। এটি একটি গােত্র পূজা। এতে লুরিরা পৌরহিত্য করেন। বিগত ।বিগত শতকের ৪০-এর দশকেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ভাত-দ্যা পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত শতাব্দীর মধ্য ভাগে থেকে এ পূজার প্রচলন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
থানমানা : চাকমাদের পূজার মধ্যে থানমানা পূজা বেশ বড় পূজা। প্রতিবছর গ্রামে থানমানা পূজার আয়ােজন করা হয়। গ্রামবাসীরা প্রত্যেকে মিলে পরিবার পিছু একটি মােরগ বা মুরগি এবং তার সঙ্গে প্রয়ােজন মতাে চাল ও টাকা পুজার উদ্দেশ্যে দান করে। গ্রামের মঙ্গলের জন্য বাস্তুদেবতা ‘থান’কে পূজা দেওয়া হয়। এটি গ্রামে নদীতীরে আয়ােজন করা হয়। এই পূজায় সর্বমােট ১৪ জন দেবদেবীকে পূজা দেওয়া হয়। বর্তমানে এ পূজার তেমন একটা প্রচলন নেই বললেই চলে।
ধর্মকাম
গৃহস্থের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য ধর্মকাম পূজা অরণ্যে করা হয়। এতেও লুরিরা পৌরহিত্য করে। এতে মূলত ভাত, তার সাথে আখ, কলা, মিঠাই ইত্যাদি বিবিধ উপকরণ প্রয়ােজন হয়। পূজায় বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ১৪টি মােরগমুরগিও বলি দেয়া হয়। বর্তমানে কালে-ভদ্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ কার্য সম্পন্ন হতে দেখা যায় ।
বুরপারা বা মাদাদোনা
বুরপারা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘ডুব দেওয়া বা ‘মাদাদোনা’ এর অর্থ মাথা ধােয়া। স্থানভেদে কেউ বুরপারা, কেউ বা মাদাদোনা বলে। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ‘ওঝাদের কর্তৃক ঘিলা (একপ্রকার বন্য বিচি ) কোজোই (বন্য ফল দেখতে তেঁতুলের মতাে), ইঝিং, সােনা ও রূপা ধৌত মন্ত্রপূত পানি দিয়ে মাথা ধুয়ে বিপদ-আপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বা পরিশুদ্ধ হওয়া।
যখনই কোনাে চাকমা গৃহস্থ মনে করে যে কোনাে কারণে তার ‘ফী-বলা’ অর্থাৎ বালা-মুছিবত বা আপদ-বালাই উৎপন্ন হয়েছে, তখন এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিজনসহ পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সমষ্ঠিগতভাবে একই গােষ্ঠীভুক্ত তাবৎ লােকজনকে এভাবে পরিশুদ্ধ হতে হয়।
টাবু বা খুমা
চাকমা ভাষায় ‘টাবু’ শব্দটির প্রতিশব্দ হলাে ‘খুমা’ । কোনো গোষ্ঠীতে যদি কোনাে টাবু প্রচলিত থাকে তবে সেই গােষ্ঠীর সব লােক তা মেনে চলে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, লারমা গঝার “চার্জ্যা” গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে একত্রে তিনটি চুলা তৈরি করা নিষেধ, বোর্বুয়া গঝার নাদুকতয়া গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে মিষ্টি কুমড়ার শাক রােপণ করা নিষেধ ইত্যাদি। বাবুরা গঝার গোঝাল্যা গুত্থির লােকেরা ‘কালা হেরা কচু’ (একপ্রকার কচু চারা) রােপণ করতে পারে না।
চাকমা জাতির আচার অনুষ্ঠান
হাল-পালনি
আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ ফসল ও ঐশ্বর্যের দেবী মা-লক্ষ্মীকে একটি থালায় মুরগি, ডিমসহ ভাত দেওয়া হয়। ঐ তরকারি গৃহিনী তার খাবারের সাথে খেলে পরিবারের উন্নতি হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এদিন মা-লক্ষ্মীর সম্মানে হালের বলদগুলিকেও চাষাবাদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। গৃহস্থরা জমিতে যায় না। এই দিনকেই হালপালনি দিন বলা হয়। এদিনে বিজুর মতাে সকলের জন্য ডিতে বাড়িতে মদ, পাজন ও নানা খাবার পরিবেশন করা হয়। এটি গ্রামে এখনও বেশ গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।
মালেইয়া
গ্রামের কোনাে গৃহস্থ জুম চাষের জন্য জঙ্গল কাটা অথবা জুমের ধান কাটা বা অন্য কোনাে বড় কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইলে একসঙ্গে গ্রামবাসীর (বিশেষ করে সমর্থ যুবক বা প্রতিবেশীদের) সাহায্য কামনা করে । এজন্য সে গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়।
কোনাে গৃহস্থের গ্রামবাসীদের কাছে সহযােগিতার এই আহ্বানকে বলা হয় মালেইয়া-দাগানা’ যা মূল অর্থ হচ্ছে দশের সাহায্য চাওয়া। নির্ধারিত দিন প্রত্যেক পরিবার থেকে প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে সহযােগিতার জন্য হাজির হয় এবং এতে অতি দ্রুত কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়।
এসময় এতে একটা উৎসবের আমেজ এবং পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সহযােগিতার মনােভাব বৃদ্ধি পায়। যারা সহযােগিতা করতে আসে তাদেরকে কোনাে মজুরি দিতে হয় না। এ উপলক্ষে কাজের শেষে কেবল একটা ভালাে ভােজের আয়ােজন করা হয়। আবার গৃহস্থের সচ্ছলতা না না থাকলে গ্রামবাসীরা এমনিই কাজ করে দিয়ে আসে।
ভাতমজা দেনা
‘ভাতমঝা দেনা’ কথার অর্থ হলাে কলা পাতায় মুড়িয়ে ভাত তরকারি দেওয়া। চাকমা সমাজে কোনাে প্রসূতি সন্তান প্রসব করলে তার আত্মীয় -স্বজন ও পাড়াপড়শিরা তার জন্য রুচিসম্মত ভাত, মাংস, মাছ, শুঁটকি, ডিম নানা তরকারি রেধে কলাপাতায় মুড়িয়ে (বর্তমানে অবশ্য কলাপাতার পরিবর্তে টিফিন ক্যারিয়ারে করে) প্রসূতিকে দিতে যায়। এতে প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্য ভালাে থাকে। এই প্রথাকে চাকমারা ‘ভাতমজা দেনা’ বলে।
সাগা
চাকমারা পাহাড়ের কোনো স্থানে যদি প্রথমে আড়াআড়িভাবে দু খন্ড বাঁশ দিয়ে চিহ্ন দিতো তবে তাকে ‘সাগা’ বলা হয়। এর অর্থ ঐ ব্যক্তি সেখানে জুম চাষ করবে। তখন গ্রামের কেউই আর তার নির্বাচিত ঐ স্থানে কোনাে চাষ করে না। জুম চাষের পরে ফসল সংগ্রহের পরবর্তী সময়কার জুমকে ‘রান্যা’ বলে, কেনাে জুম কোনো ব্যক্তির রান্যা হিসেবে পড়ে থাকে, ততদিন অন্য কোন ব্যক্তি সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
চাকমা জাতির সামাজিক উৎসব
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ জাতি চাকমা ! চাকমারা বিভিন্ন সামাজিক উৎসব পালন করে থাকে। এসব সামাজিক উৎসবের মাধ্যমে তাদের সামাজিক এ সাংস্কৃতিক সাত প্রকাশ পায়। নিম্নে তাদের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি সামাজিক উৎসবের বর্ণনা দেওয়া হলো-
চাকমাদের বিজু উৎসব
চাকমাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সর্ববৃহৎ ও সর্বজনীন ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব হলে ‘বিজু/বিঝু’ উৎসব’। এই উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ জনগােষ্ঠীর লােকেরাও নানা নামে পালন করে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে, বার্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশেও এই উৎসব পালন করা হয়।
এই উৎসব তিনদিন ধরে অর্থাৎ বাংলা বর্ষের শেষ দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনে পালিত হয়। সেই হিসেবে গােটা বিজু/বিঝু উৎসবটি তিন পর্বে বিভক্ত! প্রথম পর্বটি হচ্ছে ‘ফুলবিজু’, দ্বিতীয় পর্বটি মূলবিজু এবং তৃতীয় পর্বটি হচ্ছে ‘নুওবঝর’ বা নতুন বছরের ‘গােজ্যাপােজ্যা দিন।
ফুল বিজু
এদিন ভােরে বা দিবাগত রাতে শিশু-কিশােররা, তরুণ-তরুণীরা বাগান থেকে বা বন থেকে নানান রকমের ফুল সংগ্রহ করে আনে। সাতসকালে নদীতে গোসল করতে যায়, সে সময় পাতায় করে নদীতে ফুল ভাসিয়ে দেয়। সংগৃহীত ফুল দিয়ে তারা বাড়ির আঙিনা বা দরজা সাজাই। কিয়াঙেও বুদ্ধের উদ্দশ্যে ফুল দেয়।
এদিন (বা তারও আগে) গৃহকত্রীর নেতৃত্বে ঘরের কাপড়-চোপড় ও ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়। সন্ধ্যায় ঘরের আঙিনায় বা কিয়াঙে গিয়ে মােমবাতি জ্বালানো হয়। এদিনে শিশু ও কিশাের-কিশােরীরা ঝাঁক বেঁধে সকাল বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপালিত পশু-পক্ষীদের খাদ্য দিয়ে থাকে।
মূল বিজু
বিজুর তিনদিনের মধ্যে এই মূলবিজুর দিনটিই সবচেয়ে উৎসবমুখর, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দিন। এদিন ঘরে ঘরে খানাপিনার আয়ােজন করা হয়। এদিন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ, পরিচিত-অপরিচিত সবার জন্য ঘরের দরজা উন্মুক্ত থাকে। সবাইকে ঘরের যার যা আছে তা দিয়ে অত্যন্ত যত্ন ও আগ্রহ সহকারে আপ্যায়ন করা হয়।
এদিন ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের নানা স্বাদের পিঠা, তাজা ফলমূল ও বিভিন্ন সেদ্ধ করা আলুসহ একটি বিশেষ ধরনের উপাদেয় খাবার ‘পাজন’ পরিবেশন করা হয়। পাঁচ অন্ন (পাঁচন) শব্দ থেকেই সম্ভবত ‘পাজন’ শব্দের উৎপত্তি হতে পারে, যা তৈরি হয় ন্যূনতম পাঁচ পদের সবজি দিয়ে ।
সবাই চেষ্টা করে পাজন-এ সবৃজির পদ বা সংখ্যা বাড়াতে । অনেক সময় একশাে পদের বেশি সবজি দিয়ে শুটকি বা শুকনাে মাছ মিশ্রিত করে পাজন রান্না করা হয়। এটা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপাদান। আর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মদও পরিবেশন করা হয়।
এছাড়া সান্ন্যাপিঠা, বিনিপিঠা, কলাপিঠা, বিনি হগা, চিনি বানাহ্ প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী খাবার ও পানীয় পরিবেশনের রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে শহরাঞ্চলে এসব খুব কমই দেখা যায়। বর্তমানে সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টি, জিলাপি, চটপটি, মাংস ও নানা স্বাদের কোমল পানীয়সহ আরও অনেক খাবার পরিবেশন করা হয়।
দুপুরে তরুণ-তরুণীরা নদী-কুয়াে থেকে জল তুলে কলসি কাঁকে বয়স্কদের গোসল করায়। বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তিকে গােসল করানাে হয়। গােসল করা বা করানোটা হলো পুরানাে বছরের ময়লা-আবর্জনাস্বরূপ আপদবিপদ ধুয়ে পূতঃপবিত্র হওয়ার প্রতীক।
সন্ধ্যায় মােমবাতি দিয়ে বুদ্ধকে, গঙ্গী-মাকে (নদীকে) পুনরায় পূজা করা হয় | বাসার কামরায় ও দরজায় মােমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয় এবং গােয়ালঘরেও মােমবাতি দেয়া হয় এই উদ্দেশ্যে যে পরানাে . অজ্ঞানতা, আপদ-বিপদের অন্ধকার যেন দূরীভূত হয়ে যায় ।
গোজ্যাপােজ্যা দিন
গােজ্যাপােজ্যা দিনটি পালিত হয় মূলত ধর্মীয়-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এদিন অনেকে কিয়াঙে যান অথবা বাড়িতে কোনো ভিক্ষু আমন্ত্রণ জানিয়ে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করে, যাতে নতুন বছরটি ভালােভাবে কেটে যায়। আজকের দিনে এই দিনেও ‘মূলবিজু’র ন্যায় পরিপূর্ণ উৎসব ও খানাপিনার আয়ােজন বজায় থাকে। এছাড়া এ-দিনে বয়ঃজেষ্ঠ্যদের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহনের রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
চাকমা রাজপুণ্যাহ
‘রাজপুণ্যাহ’ মূলত একটি রাজকীয় অনুষ্ঠান। চাকমা রাজ কর্তৃপক্ষই এর মূল আয়ােজক। আগের দিনে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক লােকের সমাবেশ ঘটে এবং রীতিমতাে একটি বিরাট উৎসবে পরিণত হয়। রাজার সবচেয়ে দৃশ্যমান কাজগুলাের মধ্যে একটি হলাে বার্ষিক ‘পুণ্যাহ’ (শুভদিন) বা ‘দরবার’ ।
এটি একটি গণঅনুষ্ঠান যখন হেডম্যানরা তাদের রাজার কাছে ‘কর’ বা ট্যাক্স প্রদান করেন। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমাবেশও। সাথে বাজার বসে, বিনােদনমূলক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও থাকে। এই দিনটা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে রাজা কর্তৃক আয়ােজিত হতাে। রাজভাণ্ডার হতে সমাগত লােকদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হতাে।
রাজা সুসজ্জিত বিরাট চন্দ্রাতপতলে পাত্রমিত্র ও দেওয়ান তালুকদারগণের পরিবেষ্টিত হয়ে একটা বিশিষ্ট কারুকার্য শােভিত মণ্ডপে রাজকীয় পােশাক পরিহিত হয়ে উপবেশন করতেন। রাজপুণ্যাহ সম্পর্কে জানা যায় ‘রাজদরবার জনসমাবেশে পরিপূর্ণ হলে তােপধ্বনি সহকারে খাজনা উসুল করার কাজ শুরু হত ।
তখন খাটি রৌপ্য মুদ্রাই প্রচলন ছিল। এই উৎসব ২/৩ ” চলত। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন এই রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয় না। ১৯৭৮ সালে বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের অভিষেকের সময় এবং বিগত ২০০৬ সালে রাজা দেবাশীষ রায়ের পুত্র রাজকুমার ত্রিভুবন আর্যদেব রায়কে যুবরাজ হিসেবে ঘােষণার সময় চাকমা রাজার সর্বশেষ রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়।
চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা
ভাষা
গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী জনগােষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয়ান পরিবারের
‘ইন্দো-এরিয়ান বা ইন্দো-ঈরানীয় শাখার অর্থাৎ আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত। ‘চাকমা ভাষার মূল শব্দগুলির উৎসও হলাে সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত প্রভৃতি আর্য ভাষাগুলি।’ ভারতবর্ষের ইন্দো-এরিয়ান শাখাভুক্ত বাংলা, অসমীয়া, হিন্দি ইত্যাতি ভাষার মৌলিক শব্দগুলির সাথে চাকমা ভাষায় প্রাপ্ত মৌলিক শব্দগুলির ধ্বনিগত রুপগত ও অর্থগত সাদৃশ্য রয়েছে।
বাংলাভাষীদের সাথে চাকমাদের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক যােগসূত্র। ফলে চাকমা ভাষা দ্বারা বাংলা ভাষা যেমন প্রভাবিত হতে পারে তেমনি বাংলা ভাষার দ্বারা চাকমা ভাষাও অনিবার্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে। সে কারণেই সম্ভবত ড. জি এ গিয়ারসন চাকমা ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ বলেছেন।
অপরদিকে বর্তমান চাকমা ভাষা ইন্দো-এরিয়ান’ শাখার অন্তরভুক্ত হলেও চাকমাদের আদি ভাষা ‘সিনাে-টিবেটান বা ভােট-চীন’ ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। কেননা নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে চাকমারা মঙ্গোলীয় বংশােদ্ভূত। চাকমা ভাষার ন্যায় ইন্দো-এরিয়ান’ শাখার অন্তর্ভুক্ত অসমীয়া (অহােম বা আসামী) ভাষার আদিভাষাও ‘সিনাে-টিবেটান বা ভােট-চীন’ ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা ছাড়াও চাকমা ভাষার শব্দের সাথে পালি, সংস্কৃত, অহােম, আরাকানি, বর্মী, রাখাইন, মারমা, পাংখােয়া, লুসাই, ত্রিপুরা প্রভৃতি ভাষার শব্দের সাদৃশ্যের কথা জানা যায়। বিশেষ করে অহােম ও আরাকানি অনেক শব্দের সাথে চাকমা শব্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও বেশ কিছু শব্দ বর্তমানে চাকমা শব্দ হিসেবে পরিচিত, যেগুলাে আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু, চীনা, পর্তুগিজ, ইংরেজি ইত্যাদি শব্দ থেকে এসেছে।
বিগত কয়েক দশকে চাকমা ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পেলেও পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রভাবও কিন্তু কম বৃদ্ধি পায়নি। অনেকেই চাকমা ভাষী হওয়া সত্ত্বেও তারা চাকমা ভাষার অনেক শব্দ ভুলে যেতে বসেছে। নতুবা চাকমা ভাষায় চাকমা শব্দের পরিবর্তে বাংলা বা ইংরেজি মিশিয়ে এক বিকৃত চাকমা ভাষায় পরিণত করছে। এটা বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বেশি লক্ষণীয়। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া গেল।
প্রকৃত চাকমা -মুই কুরাে হেরাও খাঙ, গুরু হেরাও খাও আমা ইধু ন’লােই যা পরে মুই হাঘা যেন সিংগােবাত গরবা এস্টোন
বাংলা/ইংরেজি প্রভাবিত চাকমা-মুই কুলাের মাংস’-ও খাঙ, গরুর মাংস আমা ইধু নৌকালই যা পরে। মুই পায়খানা যেম। মুই টয়লেট যেম। ড্রইং রুম’ত গেস্ট এচ্চোন।
বর্ণমালা
চাকমাদের নিজস্ব ভাষা যেমনি আছে, তেমনি নিজস্ব বর্ণমালাও আছে । ঠিক কখন এর উৎপত্তি তার কোনাে সঠিক তথ্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। দৃশ্যত এই বর্ণগুলি অনেকটা বর্মী বা খেমার বর্ণমালার মতো। তবে চাকমাদের এই বর্ণগুলি যেমনি ঐতিহ্যবাহী, তেমনি স্বাতন্ত্র্য ও মৌলিকত্বের দাবিদার।
ভাষাবিদ ড. গিয়ারসন লিখেছেন, ‘ঐটি একটি হস্তাক্ষর বিশিষ্ট বর্ণমালা, যা বৈশিষ্ট্যর দিক থেকে খেমার অক্ষরের সাথে প্রায়ই একই রকম, যা পূর্বে কম্বোডিয়া, লাওস, শ্যাম দেশে ব্যবহৃত হতো। এ থেকে বর্মী বর্ণগুলাে উদ্ভূত হয়েছিল, কিন্তু চাকমা বর্ণমালা থেকে অধিকতর বিকৃত অবস্থায়।
চাকমা বর্ণগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলাে এ বর্ণগুলি আকারান্ত বিশিষ্ট বর্ণমালা। এ বর্ণগুলিকে আকারান্ত থেকে অকারান্ত করতে হলে এ বর্ণগুলির প্রত্যেকটির উপরে একটি করে ছােট দাগ (মাত্রা) সােজাভাবে দিতে হয়। এ জাতীয় আকারান্ত বর্ণ আর তিনটি জনগােষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে যথা, উত্তর বার্মার শান, ভারতের আসামের অহম এবং অরুণাচলের খামতি আদিবাসী।
তবে এগুলির মধ্যে ঐতিহ্যের দিক থেকে চাকমা বর্ণমালাই সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ (সূত্র : সুগত চাকমা) পূর্বে চাকমা ওঝা-বৈদ্যরা যে চাকমা বর্ণমালা ব্যবহার করে তাকে বলা হয় ‘অঝা-পাঠ। অন্যান্য বর্ণমালার মতাে চাকমা বর্ণমালায়ও ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণ রয়েছে। অঝাপাঠে বর্ণমালার সংখ্যা ৩৩। তবে সুগত চাকমার মতে, চাকমা বর্ণের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।
সুদূর অতীত থেকে চাকমা লিপিতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত নানা ধরনের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। এসকল পাণ্ডুলিপির মধ্যে চাকমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘আগরতারা’, গ্রামের ওঝা ও বৈদ্যদের তন্ত্রমন্ত্রের বই, ওষুধ ও চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘তালিক শাস্ত্র, চাকমা ইতিহাস গ্রন্থ, সুন্দরীদের সােন্দর্য, প্রেম ও বিরহ কাহিনী নিয়ে রচিত বারমাসি বা অন্য কোনো বিষয়ের উপর রচিত পালাগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এখনো গ্রামের ওঝা বা বৈদ্যরা চাকমা বর্ণমালায় তন্ত্রমন্ত্র ও প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলাে লিখে রাখে। ১৮৬০ সালে প্রথম খ্রিস্টান মিশনারিরা এলাহাবাদে একটি প্রেস থেকে সর্বপ্রথম বাইবেলরের একটি চাকমা অনুবাদ চাকমা বর্ণে প্রকাশ করে। ১৮৬২ সালে চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া পাহাড়িদের চাকমা ভাষা শেখানাে হতাে।
যদিও পরবর্তীতে ইংরেজ শাসক ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্তপ্রভুদের উদাসীনতার কারণে আদিবাসী ভাষায় শিক্ষাদান স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে মি. মিলার কর্তৃক ‘চাকমা প্রাইমার’ নামক শিশু পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও স্কুল পাঠ্য হিসেবে চালু করার প্রচেষ্টা করেন। খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ছিল বলে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিরােধিতার কারনে তা চালু হতে পারেনি।
এরপর ১৯৫৯ সালে নােয়ারাম চাকমা, চাকমা ও বাংলা বর্ণে ‘চাকমার পত্থম শিক্ষা’ নামে একটি শিশু পাঠ্য বই রচনা করেন। তাঁর সমসাময়িক হরকিশোর চাকমা ‘চাকমা লেখা শিক্ষা’ নামে আরও একটি চাকমা বর্ণমালার বই প্রকাশ করেছিলেন। আশি দশকে চিরজ্যোতি চাকমা ও মঙ্গল চাকমা কর্তৃক চাঙমার ‘আঘপুদি’ নামে একটি শিশুপাঠ্য বই প্রকাশ করা হয়।
১৯৬৯ সালের ৬ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল প্রধানদের ২৫তম অধিবেশনে যেসব পাহাড়ি জাতিসত্তা স্বকীয় বর্ণমালা রয়েছে; যেমন : চাকমা ও বার্মিজ ভাষাকে এই অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারের অনীহার কারণে তা বাস্তব রূপ লাভ করতে পারেনি ।
সাম্প্রতিককালে ২০০১ সালে ঢাকাস্থ আনন্দ আই টি এবং রাঙ্গামাটিস্থ জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগে কম্পিউটারে ব্যবহার উপযােগী চাকমা বর্ণগু লি নিয়ে একটি সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়। অপরদিকে ২০০৩ সাল থেকে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এবং রাঙ্গামাটিস্থ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের যৌথ উদ্যোগে রাঙ্গামাটিস্থ প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ৪ শতাধিক সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষককে চাকমা বর্ণমালাসহ চাকমা ভাষা শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেয়া হয়।
তবে কেবল এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে সীমিত থাকলে হবে না, এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে বা এর পেছনে যথেষ্ট পৃষ্টপােষকতা না থাকলে প্রবল বাংলা-ইংরেজির সামনে এই বর্ণমালা কেবল অসহায়ই হয়ে থাকবে।আধুনিক চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা অনেক আগে শুরু হলেও চাকমা বর্ণমালার ব্যবহার বা প্রচলন সেভাবে হয়নি। ইতােমধ্যে যারা চাকমা ভাষায় প্রচুর গল্প, কবিতা, নাটক, ছড়া ইত্যাদি রচনা বা চর্চা করেছেন সেগুলােও চাকমা বর্ণমালায় নয়, বাংলা বর্ণমালায়।
চাকমা জাতির লােক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য
প্রাচীনকাল থেকে চাকমাদের মধ্যে সমৃদ্ধ লােকসাহিত্য বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে ছড়া, ধাঁধা, ঘুমপাড়ানি গান, রূপকথা, কিংবদন্তি, গল্প, বিশেষ ধরণের গীতি ‘উভগীত, বারােমাসী, পালাগান, প্রবাদবাক্য, বাগধারা, ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। বিগত শতকের শুরু থেকে, বিশেষত ঐ শতকের ৭০ দশক থেকে আধুনিক চাকমা গান, কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প ইত্যাদির উল্লেখযােগ্য চর্চা এবং বিকাশ শুরু হয়।
এসময় জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ), গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, মুড়োল্যা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী, জাগরণী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, উন্মাদ শিল্পী গােষ্ঠী, রাধামন সাহিত্য গােষ্ঠী ইত্যাদি সংগঠন চাকমা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে বিরাট অবদান রাখে। তবে আশির দশকের একপর্যায়ে বিশেষ করে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী ছাড়া অন্য সংগঠনগুলাে সক্রিয় থাকতে পারেনি।
আশির দশকে গড়ে উঠে আরেকটি উলেখযােগ্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক) যা ইতােমধ্যে অন্যান্য আদিবাসীর সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ চাকমা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রেখে চলেছে এবং ইতােমধ্যে তার ২৫ বছর পূর্তি অতিক্রম করেছে। তবে সেসময় কোনাে চাকমা উপন্যাস রচিত হতে দেখা যায়নি। মাত্র সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ উপন্যাস রচনায় ব্যাপৃত হয়েছেন।
চাকমা গান/সংগীত
চাকমাদের সংগীত যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নানা ধারায় বিভক্ত। পান্নালাল মজুমদার তাঁর বইয়ে চাকমা লােকসঙ্গীতকে ৪ ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১. গেংখুলী গীত ২. উভােগীত ৩. অলিগীত ৪. বিজু গীত। গেংখুলী গানগুলাে মূলত চাকমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবন, প্রেম, বিরহ ও বীরত্বগাথাভিত্তিক। এগুলােকে পালাগানও বলা হয়ে থাকে।
এগুলাের মধ্যে রয়েছে—রাধামন-ধনপুদি পালা, চাদিগাং ছাড়া পালা, লােরবাে মিদুঙি পালা, লক্ষ্মী পালা, লাঙ্যা-লাঙনী পালা ইত্যাদি। অনেকের মতে, রাধামন-ধনপুদি পালা ও চাদিগাং ছাড়া পালা মহাকাব্য মর্যাদাসম্পন্ন। উভগীত’ হলাে প্রেম ও প্রকতিভিত্তিক এক ধরনের গীত। অলিগীত বা অলিদাগনিহীত হলাে এক ধরনের ঘুমপাড়ানি গীত ।
চাকমা মায়েরা বা অন্যরা শিশুকে দোলনায় রেখে ঘুম পাড়ানাের জন্য অত্যন্ত মিষ্টি সুরে এ গান করতো। আহে ঘরে ঘরে শিশু থাকলেই এই গান প্রচলিত ছিল। আর এ গান শুনে ঘুমিয়েও পড়তাে শিশু। আর বিজুকে কেন্দ্র করে রচিত গান ‘বিজুগীত’।এই সমস্ত ঐতিহ্যবাহী গানের পাশাপাশি বিগত কয়েক দশকে নতুন ধারার চাকমা গান বা আধুনিক চাকমা গানও যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম আধুনিক চাকমা গান লিখেছিলেন খ্যাতনামা চাকমা চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ান ১৯৪৬ সালে। এরপর ৬০-এর দশকে কিছু আধুনিক চাকমা গান লেখেন সলিল রায়। এগুলাে পরে সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার কন্ঠে ১৯৬৫ সালে ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামস্থ বেতার থেকে প্রথম প্রচারিত হয়।
এরপর ৭০-৮০ এর দশকে সুগত চাকমা, রঞ্জিত দেওয়ান, অধ্যাপক সমিত রায়, নন্দিত রায়, অমর শান্তি চাকমা, রাজা দেবাশীষ রায়, রিপন চাকমা প্রমুখ লিখিত ও সুরারোপিত চাকমা গানগুলাে তৎকালীন চাকমা সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে অনেক তরুণ চাকমা শিল্পী আধুনিক চাকমা গানের জগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন।
রােমান্টিক গানের পাশাপাশি চাকমা গণসঙ্গীতও তার নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।প্রাচীনকাল থেকে চাকমারা সঙ্গীত চর্চার জন্য নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে আসছে। এসব যন্ত্রের মধ্যে ধুদুক, হেঙগরঙ, শিঙা, বাঁশি, ঢুল, ডগর, সারিন্দ্যা, তাক ইত্যাদি।
চাকমা নৃত্য
বিগত শতকের ৭০ দশকের আগেও চাকমাদের মধ্যে আজকের মতাে কোনাে নাচ দেখা যেত না। বিশেষ করে মহিলাদের নাচ ছিল দুর্লভ ঘটনা। ‘চাকমাদের উচ্চশ্রেণীর লােকেরা এককালে কিছুটা রক্ষণশীল ছিল। এ কারণে অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীর মতাে চাকমা মহিলাদের নাচতে দেখা যায়নি।
‘(সূত্র : সুগত চাকমা) তবে সূদূর অতীতে বিজুকে কেন্দ্র করে বিজু নাচ’, জুমকে কেন্দ্র করে জুম নাচ’, রাঙ্গুনিয়ায় কদলপুরে বুদ্ধমেলাকে কেন্দ্র করে কদলপুর নাচ , থানমানা পূজাকে কেন্দ্র করে থানমানা নাচ’, মালেইয়্যাকে কেন্দ্র করে মালেইয়্যা নাচ’ ইত্যাদি নাচের কথা জানা যায়।
তবে বিগত শতকের ৭০ দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন চাকমা গানকে কেন্দ্র করে আধুনিক চাকমা নাচও তার যাত্রা শুরু করেছে। বর্তমান সময়ে চাকমা সমাজে চাকমা নৃত্যকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরিবেশন ব্যবস্থা না থাকায় ভালােভাবে বিকশিত হতে পারছে না।
নাটক
জানা যায়, প্রমােদ বিকাশ কার্বারী (পি বি কার্বারী) রচিত ও পরিচালিত প্রথম আধুনিক চাকমা নাটক ‘জাগি উধাে’ (জেগে ওঠো) মঞ্চস্থ হয় ১৯৬২ সালে রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার তুলাবান এম ই স্কুলে। এরপর সুগত চাকমা রচিত নাটক ‘ধেঙাবৈধ্য’ (শয়তান ওঝা) মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৮ সালে রাঙ্গামাটিতে! একই নাট্যকারের অপর নাটক ‘নীল মোন স্ববন’ (নীল পাহাড়ের স্বপ্ন) রাঙ্গামাটিতে মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৯ সালে।
১৯৮২ সালে মঞ্চস্থ হয় ডা. ভগদত্ত খীসা রচিত ‘হয় নয় বৈদ্য’ (হাতুড়ে চিকিৎসক)। এরপর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল’ – এর উদ্যোগে প্রতি বছরই অন্তত একটি করে চাকমা নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায় । এর মধ্যে কয়েকটি নাটক ভিডিও চিত্রায়ন হয়েছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়েছে।
উল্লেখযােগ্য নাট্যকার ও নাটকগুলাে হলাে : চিরজ্যোতি চাকমা রচিত — আনাত ভাঝি উধে কা মু’ (আয়নায় কার মুখ ভেসে উঠে), শান্তিময় চাকমা রচিত– যে দিনত যে কাল (যে দিনে যে কালে), বিজুরামর স্বর্গত যানা (বিজুরামের স্বর্গযাত্রা), আন্ধারত জুনি পহর (অন্ধকারে জোনাকির আলাে), মৃত্তিকা চাকমা বচিত— দেবঙসি আহ্ধর কালা ছাবা (অদৃশ্য হাতের কালাে ছায়া), গোঝেন (ভগবান), মহেন্দ্রর বনভাঝ (মহেন্দ্রর বনবাস), জোগ্য (যক্ষ), হককানীর ধন পানা (হককানীর ধন পাওয়া), ঝিমিত ঝিমিত চাকমা রচিত —অহদত (একই অবস্থায়), আন্দলত পহর (আড়ালে আলাে) ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
চাকমা সাহিত্য
চাকমা সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। চাকমা সাহিত্যের মধ্যে চাকমা কবিতা উল্লেখযােগ্য স্থান দখল করে আছে। কবি শিবচরণকেই চাকমাদের আদি কবি মনে করা হয়। তবে তাঁর রচনাকাল নিয়ে তিনটি মতাে পাওয়া যায়, যেমন : ১৭৭৭/১৮২২/১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর রচিত কবিতা বইটির নাম ‘গােঝেন লামা’। তিনি মূলত আধ্যাত্মিক কবি এবং দার্শনিক কবিও বটে। তিনি সংসার বিষয়ে উদাসীন ছিলেন এবং ধ্যান-সাধনাও করতেন। সাধারণ লােকের বিশ্বাস ছিল যে, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর অমরত্ব সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন।
এরপর ১৯৩০ সালে আরেকজন উল্লেখযােগ্য কবি প্রবােধ চন্দ্র চাকমা ওরফে ‘ফিরিংচান’ আলসি কবিতা’ নামে বাংলা হরফে একটি কবিতার বই লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। একসময় তার কবিতার কিছু কিছু পঙক্তি মানুষের মুখে শােনা যেত। এরপর রাণী বিনীতা রায়ের পৃষ্ঠপােষকতায় ১৯৩৬ সাল হতে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় ‘গৈরিকা’ নামের এক সাহিত্য পত্রিকা।
এই গৈরিকা নামটি দেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সময় চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ান, মুকুন্দ তালুকদার, কবি সলিল রায় প্রমুখ চাকমা কবিগণ কবিতা লিখে পাঠক সমাদৃত হন।এরপর এই শতকের ৭০ দশকে আধুনিক চাকমা কবিতা জগতে বিরাট জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এই সময় অবশ্য শুধু কবিতা নয়, চাকমা গানসহ সাংস্কৃতিক জগতে ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চাকমা সমাজে ব্যাপক উত্থান পরিলক্ষিত হয়।
৭০ দশক হতে এর পরবর্তী বিশিষ্ট কবিগণ ও রচনা হলাে—প্রমােদ বিকাশ কার্বারী ওরফে ফেলাযেয়্যা চাকমা-কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, সুগত চাকমা-রাঙামাত্যা (১৯৭০), রংধনু’ (১৯৭৮), দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা ‘পাদারংহোচপনা (১৯৭৮), শ্যামল তালুকদারের—কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, সুহৃদ চাকমা রচিত-বার্গী’ (১৯৮৭), মৃত্তিকা চাকমা রচিত – দিগবন সেরেত্তুন’ (১৯৯৫) ‘মন পরানী’ (২০০০), শিশির চাকমা রচিত- কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, তরূণ কুমার চাকমা- ‘এচ্যা বিজুত মা গঙ্গি তরে দিবে বিজু ফুল’ (২০০৫) ইতাদি উল্লেখযােগ্য।
ইতােমধ্যে বেশ কিছু তরুণ কবিও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া কবিতার দুটি উল্লেখযােগ্য প্রকাশনা হলাে হেমল দেওয়ান, পল্লব চাকমা, হিরন মিত্র চাকমা ও শরৎ জ্যোতি চাকমার সম্পাদনায় ”চাকমা শ্রেষ্ঠ কবিতা” সংকলন (২০০৬), নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত চাকমা কবিতা’ (২০০৮)।
চাকমা ছড়াও কম সমৃদ্ধ নয়। এক সময় মুখে মুখে বড়দের কাছে এসব ছড়া শােনা যেত। বেশ জনপ্রিয় এসব চাকমা ছড়ার রচয়িতা কে এবং রচনাকাল জানা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চাকমা কবিতা যেভাবে রচিত হয়েছে, ছড়া কিন্তু সেভাবে রচিত হতে দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু চাকমা ছড়া লেখা হচ্ছে এবং চাকমা ছড়া সংকলনও প্রকাশিত হচ্ছে। চাকমা লিমেরিক লিখে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন ডা. ভবদত্ত খীসা। তাঁর রচিত লিমেরিক পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়।
জনপ্রিয় চাকমা ছড়া
চাকমা ভাষা – কবাজাং কবাজাং মােনাে উগুরে বাহ্ যাং। চাক ন’খাং ঘিলুক খাং ইককু বদালই ঘত যাংt
বাংলা অনুবাদ -কবাজাং কবাজাং পাহাড়ের উপর রাত কাটাবাে। চাক খাবাে না ঘিলু খাবাে একটি ডিম নিয়ে বাড়ি যাবাে!
চাকমা ভাষা -কবাজাং কবাজাং মামু ত বেরেদ’যাং ম’মামি দিব’ কুরাে কাবি চিত ঘিলেলােই খাং।
বাংলা অনুবাদ-কবাজাং কবাজাং মামার বাড়ি বেড়াতে যাবাে। মামি দেবে মােরগ কেটে কলিজা দিয়ে খাবাে।
চাকমা ভাষা– ঝিগুককুক ঝিগুককুক বরব’ বাত্তে শুনােনি?
বাংলা অনুবাদ – ঝিককুক ঝিগুককুক ঘূর্ণিঝড় বইছে শুনছ কি?ভেরােন গাজর গুণনি
চাকমা রূপকথা ও লোককাহিনী
চাকমাদের রূপকথা বা লােককাহিনী একসময় ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিশেষ করে রাত্রে ঘুম যাওয়ার পূর্বে শুয়ে শুয়ে নাতি-নাতনি বা ছেলে-মেয়েদেরকে এসব কাহিনী শোনাতেন নানা-নানি বা বাবা-মায়েরা।
এসব রূপকথা বা লোককাহিনী মূলত দীর্ঘদীন ধরে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এসব রূপকথা বা লোককাহিনী রচিত হয়েছিল মূলত কোনাে পশু-পাখি, নদী, ছড়া, রংধনু ইত্যাদি প্রকৃতি, সৃষ্টি সম্পর্কিত, ভূত, দেবতা, ডাইনী ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ।
প্রবাদ প্রবচন
চাকমা ভাষায় প্রচুর প্রবাদবাক্য রয়েছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে অহরহ এসমস্ত প্রবাদ বাক্য ব্যবহৃত হয়। নিম্নে কয়েকটি প্রবাদবাক্য প্রদান করা হলাে—
চাকমা বাংলা অনুবাদ
লােগ মুয়ত জয় লােগ’ মুয়ত খয় লােকের মুখে জয়, লােকের মুখে ক্ষয়
ভাত ভালা চুধা খা, পথ ভালা বেঙা যা ভাত ভালাে হলে তরকারি ছাড়াও খাওয়া যায়
পথ ভালাে হলে বাঁকা পথেও যাওয়া যায়।
আমনত্তুন থেলে খা, পরত্তুন থেলে চা নিজের থাকলে খাও, পরের থাকলে চাও।
লাভে লুয়া বয়, অলাভে তুলায়্য ন’ বুয়ায়। লাভে লােহা বহন করে, অলাভে তুলাও
বহন করে না।
চাকমা ধাঁধা
চাকমা ভাষায় ধাঁধার সংখ্যাও কম নয়। চাকমারা ধাঁধাকে বলে ‘বানাহ্’। নিম্নে কয়েকটি ধাঁধার উদাহরণ দেয়া হলাে-
চাকমা: এই আঘে এই নেই, এ দেজত তে নেই। উত্তর : ঝিমিলানি
বাংলা অনুবাদ : এই আছে এই নেই, এই দেশে ও নেই । উত্তর : বিজলি
চাকমা: চিগোন বুজ্যা দারিহ্ ফোরফোর্জ্যা। উত্তর: মোক্যা
বাংলা অনুবাদ : ছােট্ট বুড়া দাড়ি ফরফরা। উত্তর : ভুট্টা
চাকমা: ঘর আঘে দুয়ার নেই, মানুচ আঘে র নেই। উত্তর : চমকঘর
বাংলা অনুবাদ: ঘর আছে দুয়ার নেই, মানুষ আছে রব নেই। উত্তর : দেশলাই
চাকমা : কালা মোরঙত মালা ভাঝে। উত্তর : চান
বাংলা অনুবাদ : কালাে জলাবর্তে মালা ভাসে। উত্তর : চাঁদ
চাকমা : আহরেলে তগায় পেলে ন’ আনে। উত্তর : পথ
বাংলা অনুবাদ : হারালে খুঁজে পেলে আনে না। উত্তর : পথ।
চাকমাদের পোশাক পরিচ্ছদ
চাকমাদের পােশাক-পরিচ্ছদ ও পরিধেয় কাপড়-চোপড় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয় ডিজাইন করা। ‘বেইন’ নামক একপ্রকার কোমর তাঁতে চাকমা নারীরা কাপড় তৈরি করে। বুননের সরঞ্জামকে সজপদর বলে । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলাে-তাগলক, বিয়ােঙ, তারাম, ব-কাদি, সুচ্ছেক বাঁশ, সিয়েং, তাম্মে বাশ, তাচ্ছিচাম, কুদুক কাদাক, ঠুটচুমাে বা থুচ্চুমাে, চরগা, চোরগি, রিবেঙ, নাদেই, বেইনাে ভেরা, রিঝি, রদং, লেভলেভি, মুম ইত্যাদি।
নারীদের পােশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে—১. পিনােন (নিচে পরার জন্য), ২. খাদি বক্ষ বন্ধনীর জন্য), ৩. কাগই ৪, খবং পাগড়ি), ৫. আলাম (নকশার নমুনা) ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। আলাম প্রকৃতপক্ষে পরার কোনাে পােশাক নয়, এটি নানা রঙের নানা ডিজাইনের ফুলে বােনা একটি কাপড়। এটিকে বলা যেতে পারে ডিজাইন ক্লথ। এটা নারীরা তাদের বুনন কাজে ব্যবহার করে।
অলংকার
চাকমা মহিলারা এককালে সােনা, রূপা ও হাতির দাঁতের তৈরি রকমারি অলংকার পরতো। বিশেষ করে আগের দিনে গলায় রোগ্য নির্মিত ‘হালছরা’ (চন্দ্রাহার), হাসুলি(বাহুতে পরে), রােপ্য মুদ্রায় নির্মিত ‘তেঙাছড়া’ (মুদ্রামালা), স্বর্ণের নেকলেস, বাহুতে ‘তাজ্জুর’, হাতে রােপ্য নির্মিত ‘কুজি খারু’, হাতির দাঁতের তৈরি ‘বায়োরি’ (বালা), বিভিন্ন ডিজাইনের স্বর্ণের চুড়ি এবং কানেও পরেন নানা ধরনের দুল ‘কানফুল’। কানফুল সাধারণত তিন ধরনের, যেমন : ‘কজফুল, ‘রাজ্জুর’ ও ‘ঝুমুলি’। নাকে পরেন ‘নাগফুল’। আর পায়ে রোপ্য নির্মিত’ থেংখারু’। তবে আধুনিক যুগে চাকমা মহিলারা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সব ধরনের অলঙ্কারই ব্যবহার করে।
তৈজসপত্র
আগের দিনে চাকমাদের তৈজসপত্র বলতে কাঠের, বাঁশ বা বেতের, পাকা ফলমূল থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন জিনিসের ব্যবহার দেখা যায়। তবে মাটির তৈরি, টিন বা পিতলের তৈরি নানা বাসনকোসন ও বিভিন্ন পাত্রের ব্যবহারও ছিল। এগুলাে তারা বাঙালি ব্যাপারীদের কাছ থেকে ক্রয় করত বা বিভিন্ন শহর থেকে কিনে আনত।
নিজেদের তৈরি তৈজসপত্র হলাে –দাবা (হুক্কা), দুলাে, লুদুঙ, মেজাঙ, ফুলবারেঙ, কুলাে, চালােন, খাজা, বিজোন, তলােই, পাক্কোন, ঝাগা, ফুনি, কাদি, সাম্মাে, জুরগাে, কালি চাবারা, ভেরা, কাল্লোঙ, পুল্যাঙ, পিরে, মজরা, ইজি চেয়ার প্রভৃতি।
চাকমাদের খাদ্য
আমাদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে রান্না করা খাদ্য ইতােমধ্যে দেশি-বিদেশি অতিথিদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। রান্নার পদ্ধতির মধ্যে উচ্যা, সিক্যা, হলা, গুদেয়্যা, কেবাং, গরাঙ, কোরবাে উল্লেখযােগ্য। কোনাে তরকারি সেদ্ধ করে খাওয়াকে উচ্চ্যা বলা হয়। প্রধানত শাক-শবজিই সেদ্ধ করে খাওয়া হয়।
সিক্যা হচ্ছে লবণ, হলুদ আর মরিচ মিশিয়ে মূলত বিভিন্ন মাংসখণ্ড আগুনে সেঁকে খাওয়া। ‘হলা’ হলো কম ঝােল দিয়ে মাছ-মাংস রান্না করা। ধাতব কোনাে পাত্রে বা বাঁশের চোঙায় মরিচের পরিমাণ বেশি দিয়ে মিশ্রিত বা চুর্ণ করে প্রস্তুতকৃত কোনাে তরকারিকে ‘গুদেয়্যা’ বলে। কলা পাতা বা অন্যান্য পাতা মুড়িয়ে আগুনে রান্না করা কোনো তরকারিকে ‘কেবাং’ বলে ।
পাতার দিয়ে রান্না করা হয় বলে এক বিশেষ সুগন্ধি ও স্বাদ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মসলা সহকারে মিতিঙ্গা (বাংলা নাম) বা পারবাে (বাংলা নাম) বাঁশ দিয়ে রান্না করাকে গরাঙ বলে। প্রচুর মরিচ আর পেঁয়াজ বা শুটকি বা সিদোল মিশিয়ে কোনাে শাকসবজি মিশ্রিত করে প্রস্তুত খাদ্যকে ‘কোরবাে’ বলে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জুম্ম জনগােষ্ঠীর মতো (শুকনাে মাছ ও চিংড়ি), সিদোল ও জুমে উৎপাদিত মসল্লা অত্যন্ত প্রিয়। সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি শুকিয়ে দেশের উপকূল অঞ্চলে শুটকি তৈরি হয়। আর সমুদ্রের ছোট মাছ ও চিংড়ি দিয়ে গুড়াে করে বিশেষ প্রক্রিয়াজাত মণ্ডকে সিদোল’ বলে।
উপকূল অঞ্চলে বিশেষত কক্সবাজার জেলার উপকূলবর্তী এলাকায় রাখাইন সমপ্রদায়ের লােকেরা এই সিদোল তৈরি করে। আমিষ খাদ্যে মসল্লা ব্যবহার করে আর নিরামিষে শুঁটকি ও সিদোল (এক ধরনের জৈব মসল্লা) থাকে সবসময়।জুমে চাকমা ভাষায় ‘ফুজি’ নামে একপ্রকার পাতা মসল্লা, দেখতে অনেকটা ধনিয়া পাতার মতাে, চাকমাদের খুব প্রিয়।
সবজি ও আমিষ জাতীয় খাদ্যে এই ফুজি দিলে বেশ উপাদেয় হয়। এছাড়া সাবারাং’ নামে আরেক প্রকার মসল্লা রয়েছে যা দেখতে তুলসী পাতার মতাে। এই সাবারাং চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয়। এছাড়া ইয়ারেং বা বরনা শাক, ওজোন শাক, ম্যেয়ে শাক, লুমফুল ইত্যাদি শাক চাকমাদের খুবই প্রিয়।
চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা
চাকমাদের ইনডাের ও আউটডাের উভয় ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা রয়েছে। আউটডাের খেলার মধ্যে ঘিলে খারা, নাধেং খারা, গুদু খারা, বলি খারা, পাের খারা, পত্তি খারা, আরি খারা, চি-কুতকুত খারা, হুম ভাঙা খারা, মাচ খারা ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। আর ইনডাের খেলার মধ্যে পেইক খারা, শামুক খারা, পাঝা খারা, পল্লাপল্লি খারা, কাত্তোল খারা ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ছাড়াও চাকমারা জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, ব্যাটমিন্টন, দাবা, এথলেটিক্স ইত্যাদি খেলায় সুনাম অর্জন করেছে। চাকমা ক্রীড়াবিদ ও এথলেটরা ইতােমধ্যে দেশের বাইরেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন শর্মিষ্ঠা রায়, অরুন দেওয়ান, বরুন দেওয়ান, কিংশুক চাকমা, চম্পা চাকমা। নিম্নে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী খেলার বিবরণ দেয়া গেল-
ঘিলা খেলা
‘ঘিলা’ নামে একপ্রকার বন্য বিচি দিয়ে এই খেলা হয়। অবশ্য ইদানীং ঘিলার অভাবে গাছ দিয়ে তৈরি ঘিলা দিয়েও খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত এই খেলা হয় দুই দলের মধ্যে। খেলাটি হয় তের স্তরে (ওভারে) এবং প্রত্যেকটি স্তরে এক পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়।
স্তরগুলাে (ওভারগুলাে) যথাক্রমে হলো- চুন্দী, তদলা, (গদলী/গতনা), পুনদলা (রান), আদত্তো, পিলাং, গুরগজি, মধ্যমা, নককজি, কেরেই, ভাদ, বিরি (বেরেই), তুর গােদা, চুলেং ইত্যাদি। এক স্তরের (ওভারের) মধ্যে পাতানাে ঘিলাগুলােকে নির্ধারিত দূরত্বে স্থানচ্যুত করতে পারলে দল পরবর্তী ওভার মারার সুযােগ পায়। উভয় দল এভাবে খেলার পর পয়েন্ট হিসাব করে বেশি পয়েন্ট প্রাপ্ত দল বিজয়ী হয়।
নাদেং খেলা
চাকমা ভাষায় নাদেং’ অর্থ বাংলায় লাটিম। এই খেলা হয় একক ভাবে একসাথে কয়েকজনের মধ্যে। প্রতিদ্বন্দ্বি দুই খেলােয়াড়ের মধ্যে একজন নাদেং ঘুরিয়ে দেয় আর প্রতিপক্ষ খেলােয়াড়টি উক্ত নাদেংটিকে লক্ষ করে নিজের নাদেং দিয়ে সজোরে আঘাত করবে বা ‘ঘেই’ মারে।
আঘাতকারী খেলোয়াড়-এর নাদেংটি মাটিতে কমপক্ষে আড়াই পাক ঘুরতে থাকলে এবং প্রতিপক্ষ নাদেংটি ‘মরে’ গেলে আঘাতকারী খেলােয়াড় ১ (এক) পয়েন্টের অধিকারী হয়। প্রতিদ্বন্দ্বি দুই খেলােয়াড়ের মধ্যে প্রত্যেকে তিনবার করে ‘ঘেই’ মারার সুযােগ পায়। এভাবে খেলার পর যে খেলােয়াড় বেশি পয়েন্ট পায় তাকেই বিজয়ী হিসেবে ধরা হয়।
চাকমাদের অর্থনৈতিক সংগঠন
চাকমা সমাজ এখনও কৃষিনির্ভর সমাজ। বলা বাহুল্য, মাত্র কয়েক দশক আগেও চাকমা সমাজ পুরােপুরি কৃষিনির্ভর ছিল। অপরদিকে ইতােমধ্যে এই কৃষিভিত্তিক সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তারপরও এখনও সিংহভাগ চাকমার পেশাই কৃষি। জুম চাষ, সমতল জমিতে চাষ ও বাগান চাষ নিয়েই চাকমাদের কৃষি।
অতীতে চাকমারা জুমচাষ করত কেবল নিজেদেরই ভােগের জন্য। উৎপাদিত কোনাে ফসল বাজারজাত করত না বা বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে চাষাবাদ করত না। অথবা বাজারজাত করলেও অতিরিক্ত ফসলই কিছু কিছু বাজারে নিয়ে আসত। বস্তুত তখন চাকমাদের বাজার থেকে কোনাে ধান/চাল বা শাকসবজি কিনতে হতাে না।
বাজারে তারা কেবল শুটকি, লবণ, তেল ইত্যাদি ও ধাতব সরঞ্জাম কিনতে যেত। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বর্তমানে তারা ধান/চাল নিজেদের জন্য রেখে দিলেও অন্যান্য অধিকাংশ ফসল সুবিধা অনুযায়ী বাজারজাত করতে নিয়ে আসে।
চাকমাদের ভুমি মালিকানা, প্রথাগত অধিকার, ভূমি হারানাে
চাকমাদের ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা মূলত স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা তাদের প্রথা ও রীতিনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। একদিকে বাসস্থানসহ একটা নির্দিষ্ট স্থানে তাদের ব্যক্তি মালিকানা থাকলেও ব্যক্তি মালিকানা বহির্ভূত অন্য সকল ভুমিতে রয়েছে তাদের সামাজিক মালিকানা।
এই ব্যক্তি মালিকানা প্রচলিত আইনের ব্যক্তি মালিকানা নয়। বস্তুত কোনাে নির্দিষ্ট ভূমিতে তার যে বিশেষ অধিকার থাকে তাই এখানে ব্যক্তি মালিকানা বােঝানাে হয়। কিছু নির্দিষ্ট প্রথা বা রীতিনীতির কেউ যে কোনাে ভূমি ব্যবহার করতে পারে। এজন্য তাদের কোনো দলিল-দস্তাবেজেরও প্রয়ােজন হতাে না।
বস্তুত যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিক ভাবে চাকমারা এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে বলে এবং এই ভূমিগুলাে আবাদ বা ব্যবহার করে আসছে বলে চাকমারা এই ভূমিকে তাদের পূর্বপুরুষের বা পিতৃপুরুষের ভূমি বলেই জেনে আসছে এবং তারাই এই ভূমির বৈধ উত্তরাধিকার বা মালিক বলে তাদের বিশ্বাস।
তাই তারা অতীতে কোনাে সময়ই ভূমি বন্দোবস্তি করা বা জমি রেকর্ডভুক্ত করার বিষয়ে আগ্রহী হয়নি। আর পাকিস্তান আমল বা বাংলাদেশ আমলে কোনাে কোনাে চাকমার এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হলেও অধিকাংশ চাকমা বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় এখনও উদ্যোগী নয়।
ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ করে অনেক বহিরাগত সেটেলার পরিবার ইতােমধ্যে চাকমাদের অনেক ভূমি বেদখল করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এমনকি চাকমাদের রেকর্ডভুক্ত অনেক ভূমিও বহিরাগতরা বেদখল করে নিয়েছেন। যেগুলাে এখনও তারা ফেরত পাননি।
চাকমাদের উত্তরাধিকার আইন ও সম্পত্তির মালিকানা
চাকমা সমাজে সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পুত্রসন্তান পিতার বৈধ উত্তরাধিকার। ছেলের বর্তমানে কন্যাসন্তান কেবলমাত্র বিবাহকাল পর্যন্ত ভরণপােষণ পাওয়ার অধিকারী থাকে। পিতার মৃত্যুর পর সকল ছেলেই সমানভাবে পিতৃসম্পত্তির অধিকার লাভ করে । মাতার কোনাে সম্পত্তি থাকলে ছেলেরা তাও উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে।
কিন্তু কোনাে কন্যা সেই সম্পত্তি পায় না। মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর পুত্রসন্তানেরা সমানভাবে উত্তরাধিকার লাভ করে। চিররুগ্ন, মস্তিষ্ক বিকৃত ছেলেও পিতামাতার সম্পত্তি লাভ করে। কেউ অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানরা যাবতীয় পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে।
কেউ অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তির সহােদর ভাইরা যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। অবৈধ সন্তান উত্তরাধিকারী হতে পারে না। তবে সে মাতার সম্পত্তির মালিক হতে পারে। কোনাে ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় স্বেচ্ছায় তার নিজ মালিকানাধীন সম্পত্তির অংশ বিশেষ তার ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী বা প্রিয়জনকে দান করে যেতে পারে। আবার কোনাে ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় স্বেচ্ছায় তার নিজ মালিকানাধীন সম্পত্তির অংশবিশেষ স্ত্রীকে বা কন্যাকে দান করে যেতে পারে।
চাকমাদের পেশা ও শ্রম ব্যবস্থা
চাকমাদের প্রধান পেশা কৃষি । কৃষি ক্ষেত্রে রয়েছে জুমচাষি, লাঙ্গল চাষি ও উদ্যান চাষি। লাঙ্গলচাষির মধ্যে রয়েছে ধনী কৃষক, মাঝারি কৃষক ও গরিব কৃষক। আর কৃষিতে রয়েছে কৃষি শ্রমিক। চাকমাদের উল্লেখযােগ্য পরিমাণে শিল্প শমিক নেই । কর্ণফুলি পেপার মিল, কর্ণফুলি রেয়ন মিল, পাল্পউড কারখানা, রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মিল ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য শিল্পকারখানা থাকলেও এতে চাকমাসহ জুম্মদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযােগ তেমন একটা নেই।
ইদানীং ইপিজেড এলাকায় চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করতে দেখা যায় । পেশাগত দিক থেকে চাকমাদের মধ্যে আরাে রয়েছে চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফরেস্ট ভিলেজার, মৎস্যজীবী ইত্যাদি।
উন্নয়নের প্রবল আগ্রাসন তথা বিশ্বায়নের করালগ্রাসে আদিবাসী চাকমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনি প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েছে তেমনি জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অন্যান্য জুম্ম জনগােষ্ঠীর মতাে চাকমারা অনেক নতুন পেশা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। আগেকার দিনের জুম চাষ ও লাঙ্গল চাষের ক্ষুদে উৎপাদক পেশা থেকে বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
বাজার অর্থনীতি বিকাশের প্রক্রিয়ায় আদিবাসী চাকমাদের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হতে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যের যেসব ক্ষেত্রে চাকমাদের বিচরণ দেখা যায় তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে ঠিকাদারি, গাছ-বাঁশের ব্যবসা, কানদারি, সিনেমা হল ব্যবসা, কাঁচা তরকারি ব্যবসা প্রভৃতি। তবে বাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য এবং প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে চাকমা ‘মাদের পক্ষে প্রতিযােগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হয়ে উঠে না।
এছাড়া ফল চাষি, মৎস্যজীবী, ফরেস্ট ভিলেজার, কৃষি শ্রমিক, শিল্প শ্রমিক প্রভৃতি পেশার লােক বিশেষত ষাট দশকের পর থেকে চাকমাদের মধ্যে থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটে।কাপ্তাই বাঁধের পর জমির তীব্র অভাব দেখা দিলে বিকল্প হিসেবে চাকমারা এসব পেশা গ্রহণ করতে থাকে। ফল বাগান চাষিরা ষাট দশকে কিছুটা সফলতা অর্জন করলেও বাজারজাতকরণের অবকাঠামাের অভাবে এবং মাটির উর্বরতা
শক্তিহাসের কারণে তা স্থায়ী হতে পারেনি। এর মধ্যে কিছু অংশ জুম্ম কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার করে থাকে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য বাজারও বাড়া থাকার কারণে চাকমা মৎস্য শিকারিরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে । ফলে এ পেশা মৎস্য শিকারী চাকমাদের মধ্যে জীবিকার প্রধান পেশা হিসেবে স্থান করে শমিক হিসেবে কাজ করে নিতে পারেনি।
জুমচাষিদের মধ্যে একটা অংশ বন বিভাগের বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাদের ফরেস্ট ভিলেজার হিসেবে বলা হয়ে থাকে। চন্দ্রঘােনায় পেপার আর রেয়ন মিল প্রতিষ্ঠার ফলে এবং বনজ সম্পদের উপর গড়ে উঠা শিল্প কারখানায় কিছু আদিবাসী চাকমা শ্রমিক হিসেবে নিয়ােগ লাভ করে।
কিন্তু বর্তমানে বহিরাগত বাঙালি শ্রমিকদের আগমনে এ পেশায়ও চাকমারা প্রতিযােগিতায় পেরে উঠছে না। অন্যান্য পেশার মধ্যে রাস্তা নির্মাণ, মাটি কাটা, ইট ভাঙা, কাঠের আসবাবপত্র তৈরি প্রভৃতি শ্রমিকের পেশা এখনাে চাকমাদের মধ্যে তেমন বিস্তার লাভ করেনি।
অন্যান্য পাহাড়ি আদিবাসীসহ শত শত চাকমা পরিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলে ইপিজেড, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। অনুমান হয়, কেবল চট্টগ্রাম ইপিজেড-এ ২০ হাজার এবং সাভার ইপিজেড-এ ৭ হাজার জুম্ম শ্রমিক বা চাকরি রয়েছে। এদের অধিকাংশই চাকমা।
এর ফলে চাকমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, রীতিনীতি ও সমাজব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা নেতিবাচক দিক শহরাঞ্চলের বসবাসকারী চাকমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে অভিযােগ শােনা যায়।
বর্তমানে চাকমা সমাজে যে সমস্ত পেশার লােক দেখা যায় সেগুলাে হলো- সরকারের বিভিন্ন সিভিল প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের চাকরিজীবী, বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার, এ্যাডভােকেট, সাংবাদিক।
রাজনীতিক, বিভিন্ন সংস্থার জনপ্রতিনিধি, কন্ট্রাকটর, খেলােয়াড়, বড় ও মাঝারি গাছ-বাঁশ-মাছ ব্যবসায়ী, দোকান ব্যবসায়ী, কারুশিল্প ব্যবসায়ী, ভাড়া প্রদানকারী বাড়ির মালিক, হােটেল-রেস্টুরেন্ট-পর্যটন ব্যবসায়ী, ছােট-মাঝারি আকারের যানবাহনে মালিক,যানবাহনের চালক, পেশাজীবি-কাম-বাগান চাষি, কৃষিজীবি-কাম-চাষি, জুম চাষী ,সমতল জমিচাষি, জেলে, দিনমজুর, অনিয়মিত ক্ষেতমজুর।
কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী, পিনন ব্যবসায়ী, ক্ষুদে গাছ-বাঁশ-মাছ ব্যবসায়ী, কাওন্যা (প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল গাছ/ বাঁশ বিক্রেতা), নিম্ন পর্যায়ের নির্মাণ শ্রমিক, দোকান কর্মচারী,ভিক্ষুক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাকটর, সরকারি চাকরি ইত্যাদি পেশার প্রতি ঝোঁক বেশি লক্ষণীয়। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রতিষ্ঠিত উন্ন্যন সংস্থার পেশায়ও ঝোঁক লক্ষ করা যায়।
চাকমা জাতির শিক্ষা
চাকমাদের শিক্ষাসংক্রান্ত পরিসংখ্যান, আনুমানিক হার
১৮৬২ সালে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায় বিটিশদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চন্দ্রঘােনা বাের্ডিং স্কল’ নামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে এটি এম ই স্কুল করা হয় এবং ১৮৯০ সালে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়, যা বর্তমানে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত।
দীর্ঘ ৪১ বছরের ব্যবধানে ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় স্কুল মহাপূরুমে। এরপর ধীরে ধীরে আরও স্কুল প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং চাকমাদের মধ্যে দ্রুত শিক্ষার বিস্তার হতে থাকে। বিশেষ করে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তৎকালীন সরকারের শিক্ষা বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর ও পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ কৃ কিশাের চাকমার নেতৃত্বে বেশ কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চাকমা সমাজে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক গতি সঞ্চারিত হয়।
এরপর ধীরে ধীরে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৬০ সাল হতে ১৯৪৬ সাল (ব্রিটিশ আমল) পর্যন্ত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ১৪৪টি এবং নিম্ন মাধ্যমিক/মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা মাত্র ১টি।
চাকমাদের শিক্ষার হার সম্পর্কে সঠিক কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। সরকারি পরিসংখ্যান বইয়ে জাতিভিত্তিক আলাদা কোনাে তথ্য না থাকায় চাকমাদের শিক্ষার হার জানা যায় না। মােহাম্মদ রাফি ও এ মুশতাক আর চৌধুরী সম্পাদিত ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘কাউন্টিং দ্য হিল, এসেসিং ডেভেলপমেন্ট ইন চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের জরিপে চাকমাদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি, ৩৭.৭%।
পরিবার প্রধানদের ক্ষেত্রেও চাকমা পরিবার প্রধানদের শিক্ষার হারই সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৮.১%। আর আনুপাতিকভাবে অধিকতর নিরক্ষর পরিবার সবচেয়ে কম চাকমাদের মধ্যে (৩৬.৩%)। অপরদিকে চাকমা পরিবার সমূহের প্রায় ২৯.৬% ভাগকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শিক্ষাগতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন’ হিসেবে। তাদের উক্ত জরিপ মূলত নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রামে। তাই উক্ত তথ্য চাকমাদের প্রকৃত শিক্ষার হার প্রতিফলিত হয় না।
চাকমাদের উচ্চ শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষা
পাকিস্তান আমলের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চাকমাদের উচ্চশিক্ষার গ্রহন করার প্রবণতা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর তারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে ভর্তির আশায়। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে ভর্তি হতে পারছে না তীব্র প্রতিযােগিতায় টিকতে না পেরে।
আবার অনেকে আছেন আর্থিক দুরবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন না। সরকার একদা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চালু করে। এই কোটা ব্যবস্থা চলছে এডহক ভিত্তিতে।
লিখিত বা আইনানুগ কোনাে নীতিমালা নেই। ফলে সেটাও যথাযথভাবে সবসময় কার্যকর হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকমা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান চাহিদা ও বাস্তবতার তুলনায় পর্যাপ্ত নয় এবং আরও উচ্চতর গবেষণা কাজে তাদের তেমন অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয় না।
অপরদিকে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে অনেক আলােচনা বা উদ্যোগের কথা জানা গেলেও বাস্তবে সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনাে কাজ শুরু হয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক স্তর থেকে চাকমাসহ আদিবাসী শিশুদের ঝরে পড়ার অন্যতম একটি কারণ হলাে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অভাব। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণের বিধান থাকলেও সরকারের অনীহার কারণে তা আজ অবধি কার্যকর হয়নি।
চাকমা নারীর অবস্থা
সকল শােষণমূলক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ন্যায় চাকমা সমাজেও নারীর অবস্থান পুরুষের সমমর্যাদার নয়। এখনও অনেক পরিবারে নারীদেরকে কেবল বুনন রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন, গৃহস্থালির কাজের উপযােগী বলে বিবেচনা করা হয়। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের প্রাধান্য চেয়ে অনেক বেশি।
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বা সুযােগে পুরুষের চেয়ে কম। তবে বিভিন্ন বৈষম্য সত্ত্বেও চাকমা সমাজে নারীদের গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈষম্যমূলক অনেক প্রাচীন প্রথা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে। বিভিন্ন পেশায় ও সংস্থায়ও নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
সচরাচর চাকমা সমাজে নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা কম। যৌতুক নিয়ে নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, স্ত্রীকে খুন করা, ধর্ষণ ইত্যাদি চাকমা সমাজে দেখা যায় না। তারপরও নানাভাবে নানামাত্রায় নারীর উপর সহিংসতা বিদ্যমান। নারীকে গালিগালাজ, কখনাে কখনাে মারধর,পরিশ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদি নিপীড়ন অনেক চাকমা নারীকে ভোগ করতে হয়।এ জাতীয় নির্যাতন সাধারণত অভাব অনটনের পরিবার ও মাতাল স্বামীর ঘরে বেশি দেখা যায় ।
চাকমা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পিতৃসম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার থাকে না। কেবল পিতা বা স্বামী কর্তৃক দান হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপরই তার অধিকার রয়েছে। আবার কোনাে ব্যক্তি তার নামে উইল করে গেলে সে সম্পত্তির উপর কোনো নারীর অধিকার থাকে। তবে আধুনিক যুগে চাকরিজীবী বা উপার্জনকারী মহীলা নিজ প্রচেষ্টায় কোনাে অর্থ বা সম্পত্তি অর্জন করলে সেই অর্থ বা সম্পত্তির উপর তার অধিকার রয়েছে বলে মেনে নেয়া হয়।
বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী গােষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অন্যতম শিকার হচ্ছে চাকমাসহ আদিবাসী নারীরা। বিশেষ করে তারা উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠী কর্তৃক ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, জোরপূর্বক বিবাহ ও ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি সন্ত্রাসের শিকার হয়ে আসছে।
তারা আদিবাসী হিসেবে সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার আর নারী হিসেবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে আবদ্ধ বিধায় পুরুষের চেয়ে চাকমা নারীদের দ্বিগুণ শােষণবঞ্চনার শিকার হতে হয়। ১৯৯৬ সালে ১২ জুন রাতের আঁধারে কল্পনা চাকমাকে সন্দেহভাজন লে. ফেরদৌস গং কর্তৃক অপহরণের ঘটনা হচ্ছে দেশে-বিদেশে ব্যাপ্ক আলােড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম একটি উদাহরণ।
চাকমা সমাজে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপোষণের অধিকারী হয়। একজন চাকমা নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃকসূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বউপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে।
বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট হতে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর নিকট থেকে খােরপােষ লাভের অধিকারী হয়। বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক
সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারী হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে। স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখে। পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংসক হলে অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হয়।
চাকমাদের রাজনৈতিক সংগঠন
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের মধ্যে বৃহত্তর জনগােষ্ঠী হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চাকমাদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। তবে সার্বিকভাবে সাধারণ চাকমারা রাজনৈতিক দিক থেকে অসচেতন বলা যায়। তাদের সামন্তশ্রেণীর শােষণ-নিপীড়নের উপর ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজমান।
তারা ইসলামিক সম্প্রসারণবাদের শাসন-শােষণ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ফলে দেশের শাসকগােষ্ঠীর বঞ্চনা, অবহেলা ও বৈষম্যের অবসান কামনা করে। কিন্তু এসব বৈষম্য ও বঞ্চনা অবসানের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মানসিকতা সাধারণ চাকমাদের মধ্যে খুব কমই লক্ষ করা যায় ।
চাকমারা যুগ যুগ ধরে সাধারণভাবে চাকমা সামন্তশ্রেণীর শােষণ-নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৫ সালে রাজমােহন দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা চাকমাদের সর্বপ্রথম সংগঠন ‘চাকমা যুবক সমিতি।
কিন্তু এ সংগঠন সার্বিকভাবে কে অভিজাতশ্রেণীর স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এরপর ১৯১৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘চাকমা যুবক সংঘ’। ১৯২০ সালে গঠিত হয় কামিনী মােহন দেওয়ানের নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি’। এ সংগঠন চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল আদিবাসী জনগােষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার চেষ্টা করে ।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে চাকমাসহ চট্টগ্রামের আদিবাসীরা প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পায়।পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে কামিনী মোহন দেওয়ান, ১৯৬২ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে নির্বাচিত হন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়।
১৯৬৫ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রথমে বোমাং রাজা মংশৈ প্রু চৌধুরী নির্বাচিত হন, কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তিনি মন্ত্রী নিযুক্ত হলে উক্ত শূন্য আসনে নির্বাচিত হন রাজা ত্রিদিব রায়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে রাজা ত্রিদিব রায় এবং একই সালের ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে দুটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও অং শৈ প্রু চৌধুরী নির্বাচিত হন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের আলােকে তৎকালীন সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন এবং তার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগােষ্ঠীর আন্দোলন গড়ে উঠে।
আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলােতে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক চাকমা নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছে। অপরদিকে বরাবরই চাকমাদের মধ্য থেকে একটি প্রভাবশালী অংশ রাজনীতির ক্ষেত্রে সুবিধাবাদি ভূমিকা গ্রহণ করতেও লক্ষ করা যায়।১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে চাকমাদেরও আসন সংরক্ষিত রয়েছে।
এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে ৫টি সাধারণ (পুরুষ ও মহিলা) এবং ১টি মহিলা আসন চাকমাদের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে যথাক্রমে ১০টি, ৯টি ও ১টি আসন সংরক্ষিত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও চাকমাদের মধ্য থেকে মন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এছাড়া বিগত জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলেও চাকমাদের মধ্য থেকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদে তিন পার্বত্য জেলায় চাকমা জনগোষ্ঠী ঠেকে অনেকে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে পদে নির্বাচিত হয়েচে।
পক্ষান্তরে ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় ২৫ টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে চাকমা জনগোষ্ঠী থেকে ৬ (ছয়) জন চেয়ারম্যান পদে , ৬ (ছয়) জন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং ৮ (আট) জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় পৌরসভাগুলোতেও চাকমা জনগোষ্ঠী থেকে অনেকে চেয়ারম্যান পদে এবং কমিশনার পদে নির্বাচিত হয়েছে।
লেখকঃ সঞ্জীব চাকমা।
তথ্যসূত্র
১. চাকমা,সুগত,চাকমা ও চাক ইতিহাস আলোচনা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাংগামাটি,২০০০।
২.বাংলাদেশ উপজাতি , বাংলা একাডেমী, ডিসেম্বর ১৯৮৫।
৩. বাংলাদেশের চাকমা ভাষা ও সাহিত্য , প্রকাশনায়ঃ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাংগামাটি,২০০২।
৪. বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীদের সমাজ , সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার ,নওরোজ কিতাবিস্তান,দ্বিতীয় সংস্করন ২০০২।
৫. ত্রিপুরা, সুরেন্দ্র লাল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাংগামাটি , অক্টোবর ১৯৯৪।
৬. দেওয়ান, অশােক কুমার, চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার (দ্বিতীয় খণ্ড), জুলাই ১৯৯৩।
৭. দেওয়ান, তনয়, চাঙমাতারা, রাঙ্গামাটি, সেপ্টেম্বর ২০০৭।
৮ খীসা, প্রদীপ্ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, ঢাকা, আগস্ট ১৯৯৬।
৯. চাকমা, শরদিন্দু শেখর, মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকা, জানুয়ারি ২০০৬।
১০ চাকমা জাতির সমাজ ব্যবস্থা (খসড়া), প্রকাশনায় : রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা হেডম্যান কল্যাণ সমিতি, ৩০ আগস্ট ২০০০ খ্রি
১১। তালুকদার, ডা. প্রমােদ বিকাশ, সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী ও চাকমা সমাজ ব্যবস্থা,রাঙ্গামাটি, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯।
১২. লুইন, ক্যাপ্টেন টি এইচ, (চাকমা, অধ্যাপক হিরহিত অনুদিত), চট্টগ্রামের পার্বত্য
অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৬।
১৩. মুসা, মুহম্মদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জানুয়ারি ১৯৯৮।
১৪. আহমেদ, মহিউদ্দিন; চাকমা, মঙ্গল কুমার; হাসান, সােহরাব; ইকবাল, রাশেদ,(সম্পাদিত), জুম পাহাড়ের জীবন, গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার, ঢাকা, ২০০৮।
১৫. চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ,সংশােধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ : ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩।
১৬.Talukdar, Supriya, The Chakma Race. Tribal Cultural Institute,Rangamati; 2006.
১৭. Majumdar, Pannalal, The Chakmas of Tripura, Tripura State tribal cultural research Institute & Museum, Government of Tripura ,Agartala; December 1997.
১৮. Debnath, Rupak, Ethnographic Study of Tanchangya of CHT, CADC , SITTUE and South Tripura ,kreativmind ,60CC/3 Anupama Housing Complex,VIP Road,Kolkata 700052.
১৯.Chakma ,Sri L B (ed) ,Silver Jnbilee Sonvenier 1972-1997,- Published by Chakma Autonomous District Council,Kamalanagar ,Chawngte,Mizoram ; 1997.
২০. Rafi, Mohammad,Mustaque a, Choudhury, R(ed),Counting The Hill assessing development in CHT,The University Press Limited ,2001.
২১. AsiannIndegenous Peoples Pact(AIPP) , A Brief account of Human Rights Situation of the Indigenous peoples in Bangladesh ,Chiang MAi,Thailand ,2007.
প্রবন্ধ
১ . চাকমা, সুগত, ‘চাকমা’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
২ খীসা, অঞ্জুলিকা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার শিক্ষা : একটি নিকট পর্যবেক্ষণ’, পৃ- ২৯-৩৪, মাওরুম ও জুম, সাংগ্রাই-বিষ্ণু-বৈসুক-বিজু-বিহু উদযাপন সংখ্যা ২০০৭।
৩. চাকমা, মঙ্গল কুমার, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগােষ্ঠীর জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সমস্যা ও প্রতিকারের উপায়, জাক’র ২৫ বছর পূর্তি সংকলন, রাঙামাটি, ২০০৫।
৪. সামাজিক ও জাতিগত নিপীড়ন থেকে জুম্ম নারী সমাজের প্রকৃত মুক্তি কোনাে পথে? মঙ্গল কুমার চাকমা
৫. চাকমা, মঙ্গল কুমার, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা : স্বরূপ ও সংস্কার, পার্বত্য
চট্টগ্রামের উন্নয়ন শীর্ষক কনফারেন্স-এ পঠিত প্রবন্ধ, ১৮-১৯ ডিসেম্বর, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৮ ।
৬. খীসা, সুধাসিন্ধু, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মদের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের রূপরেখা’ (অপ্রকাশিত)
৭. শরদিন্দু শেখর চাকমার রচিত ‘জুম্ম জনগণ যাবে কোথায়’?
|
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।