ইতিহাসের আলোকে চাকমা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম
1926
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চাকমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম
চাকমাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা – রক্ষার প্রতিরোধ সংগ্রাম চাকমা ইতিহাস তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
চাকমা জাতি তথা অনেক স্বাধীনতাকামী বা দেশপ্রেমিক জাতির জন্য ও এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমাদের স্বাধীনতা রক্ষার এই প্রতিরোধ সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল ১৭৭২ থেকে ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
ব্রিটিশদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের পূর্বে চাকমা রাজা সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। তাদের ইতিহাসের উত্থান পতনে তাদের অঞ্চল – এলাকার শাসনের হাত – বদল হলেও ব্রিটিশদের পূর্বে কোথাও তারা পরাধীনভাবে বসবাস করে নাই। ব্রিটিশরা সিরাজুদ্দোলার পতন ঘটিয়ে যখন তাদের আধিপত্য বিস্তার করছিল, তখনও চাকমা রাজ্য স্বাধীন ছিল।
ব্রিটিশরা ন্যায়নীতি এবং আইনি চুক্তি লংঘন করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য চাকমাদের স্বাধীন রাজ্যে অন্যায়, অনাধিকার হস্তক্ষেপ করেছিল। চাকমা রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ ছন, কাঠ, হাতীর দাঁত আহরন এবং গুরুত্বপুর্ণ জায়গায় বিভিন্ন প্রকার চৌকি বসিয়ে ট্রানিজট শল্ক, চারনভূমি, পশুচানণ, জুমভূমির উপর চেক্স আদায় করছিল। এতে তাদের সাথে চাকমাদের বিরোধ শুরু হয়।
এককালে পাহাড়ী ও বাঙালীদের পন্য বিনিময়ের সুবিধার্থে চাকমারা ৫০১ মন কার্পাস মোগলদেরকে উপঢৌকন স্বরুপ দিত। মোগলদের উত্তরাধীকারী হিসেবে ব্রিটিশরা তা দাবী করলে তাদের সাথেও এই ধরনের চুক্তি হয়। তারা এই চুক্তি লংঘন করে। মোগলদের থেকে চট্টগ্রাম জিলা হস্তান্তরের সময় চট্টগ্রাম জিলার কালেক্টরেটের সীমানা সুনির্দিষ্টকরণ না থাকায় তারা রাঙ্গুনিয়া থেকে রাজস্ব আদায় শুরু করে। রাঙ্গুনিয়া ছিলো চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী চাকমা রাজ্যের একটি অঞ্চল।
ব্রিটিশদের সাথে সংগ্রাম শুরু হলে চাকমারা রাঙ্গুনিয়ার সমতল এলাকা থেকে পূর্বদিকে পার্বত্য অঞ্চলে চলে আসতে বাধ্য হয়। চাকমা পরিত্যক্ত ভূমি এলাকা ব্রিটিশ খাস ঘোষননা করে সমতল থেকে বাঙালী জমিদার ও বাঙালী চাষী (রায়ত) এনে ফলে চাকমাদের ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠে।
রাঙ্গুনিয়ায় ব্রিটিশ দখলকে ঠেকানোর দুইটি পদ্ধটি প্রয়োগ করে। একটি হচ্ছে বাধাদানমূলক পদ্ধতি যা ছিল ব্রিটিশ দখলিত এলাকায় সব ধরনের ব্যবসা-বানিজ্য সম্পর্কে বন্ধ করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ শোষনকে প্রতিহত করা বান চেক দেয়া। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে আক্রমনাত্ম পদ্ধতি যা ছিল ব্রিটিশদের দখলদারী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে এবং দখলকৃত এলাকার জমিদার এবং রায়ত (সেটেলার চাষী) দেরকে হুমকি দেয়।
এই যুগে গণতন্ত্র, জাতির স্বাধিকার, স্বায়ত্বশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার, প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। এই ধরনের অধিকার লঙ্গিত হলে এইসব রক্ষা বা আদায়ের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত, ন্যায়সঙ্গত এবং যথাযত।
একারণে একজাতি নয়, এক দেশের সকল জাতির দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীলদের অবশ্যই ঐক্রবদ্ধভাবে এইসব অধিকারের জন্য সংগ্রাম করা উচিত। কারণ প্রক্রিয়াশীলরা শুধু পরজাতিকে নয়, নিজ জাতির লোকদেরও শোষন-নিপীড়ন-অন্যায় করে। অপরদিকে কবুলিয়ত-পাট্টা দিয়ে খাজনা আদায় করতো এবং জমিতে নিশানা দিয়ে জমির মালাকানার গ্যারান্টি দিত।
এই যুদ্ধে স্বয়ং চাকমা রাজা , অভিজাত সামন্ত এবং সাধারণ প্রজারা সকলেই সক্রিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং অংশগ্রহন করেছিল। চাকমা রাজার স্থায়ী কোন বাহিনী ছিলনা। কিন্তু প্রতিরােধ যুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে চাকমারা দলে দলে এসে প্রতিরােধকারী যােদ্ধা (পালােয়ান) হিসেবে যােগ দিয়েছিল।
এছাড়া এই যুদ্ধে চাকমারা ত্রিপুরা,কুকি এবং সমতলের বাঙালীদের। সহায়ক মিত্র শক্তি হিসেবে লাভ করেছিল। এই যুদ্ধে চাকমাদের মহান সেনাপতি ছিলেন রাঙ্গুনীয়ার দেওয়ান এবং শিকদার রুনু খান(চাকমা)।
শেষ যুদ্ধে সেনাপতি রুনু খানের বাহিনী পরাজিত হয়। কিছু সংখ্যক চাকমা যােদ্ধা সারেন্দার করতে বাধ্য হয় এবং বাকীরা পুর্বদিকে প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আত্মগােপন করে। রনু খান বশ্যতা স্বীকার না করে গ্রেফতার এড়ানাের জন্যে দোহাজারির দিকে চলে যান এবং সেখানে বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সেনাপতি রুনু খানের, যিনি ছিলেন আপােষহীন, অদম্য সাহসী, আন্তরিক দেশপ্রেমিক, অধ্যবসায়ী, ধৈর্যশীল , ক্লান্তিহীন বীর যােদ্ধা একারণে তিনি ২৭ বছর সফলভাবে এবং দক্ষতার সাথে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।
বিশ্বে অগ্রসর চাকমাদের এই গেরিলা যুদ্ধে উপনিবেশিক যুগে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ও করতে চাই। চাকমা জাতির অন্যতম বীরপুরুষ রুনু খানকে এত বড় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদও ধরতে বা বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেনি ২৭ বছরেও।
এ কারণে তিনি চাকমাদের কাছে চির স্মরনীয়-বরনীয়-গৌরব হয়ে থাকবেন। চাকমাদের পরাজয় হচ্ছে তখনকার ব্রিটিশদের আধুনিক হাতিয়ার বন্দুক-কামানের কাছে চাকমাদের আদিম হাতিয়ার তলােয়ার আর তীর-ধনুকের পরাজয়।
ব্রিটিশদের রণনীতি ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজ্য-অঞ্চল-এলাকা দখল করা। আর রণকৌশল ছিল প্রতারনা, ষড়যন্ত্র, নির্যাতন, নিপীড়ন করা। তা হলেও তাদের আধুনিক হাতিয়ার না থাকলে এবং জায়গায় জায়গায় সেনাক্যাম্প না বসলে এবং অর্থনৈতিক অবরােধ না করলে, চাকমাদের পরাজিত করতে পারতােনা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রজন্ম-পরম্পরা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ন্যায় সংগ্রামকে শ্রদ্ধা করা, স্মরণে রাখা এবং অনুসরণ করা উচিত। বিশ্বে যারা দেশপ্রেমিক, গনতন্ত্রী, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী তারাও অবশ্যই এই যুদ্ধকে সমর্থন ও শ্রদ্ধা করবে। কারণ চাকমাদের এই যুদ্ধ ছিল তাদের স্বাধীনতা, স্বাধিকার রক্ষার জন্য আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম।
এই যুগে গণতন্ত্র, জাতির স্বাধিকার, স্বায়ত্বশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার, প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। এই ধরনের অধিকার লঙ্গিত হলে এইসব বলা আদায়ের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত, ন্যায়সঙ্গত এবং যথাযত।
একারণে একজাতি নয়, এক দেশের সকল জাতির দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীলদের অবগষ্ট ঐক্যবদ্ধভাবে এইসব অধিকারের জন্য সংগ্রাম করা উচিত। কারণ প্রক্রিয়াশীলরা শুধ পরজাতিকে নয়, নিজ জাতির লােকদেরও শােষন-নিপীড়ন-অন্যায় করে।
চাকমারা ২৭ বছর যুদ্ধ করতে পেরেছিল, একমাত্র তাদের রাজা-প্রজা-অভিজাত সকলে। ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে। বিশাল শক্তি থাকা স্বত্বেও নবাব সিরাজুদ্দোলার পতন ঘটেছিল তার সেনাপতি মীরজাফর ও অন্যান্যদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে।
চাকমা জাতি তথা জুম্মাে জাতিরা যতদিন ঐক্যবদ্ধ থাকবে, স্বাধিকার সচেতন থাকবে এবং অধিকার আদায়ের জন্য বাস্তব উপােযােগী প্রচেষ্টা বা ন্যায় সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, বিশ্বের যে প্রান্তে থাকুকনা কেন তারা স্বাধীন, সমৃদ্ধ জনগােষ্ঠী হিসেবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে।
ইতিহাসে দেখা গেছে ক্ষুদ্র কিন্তু ন্যায় সংগ্রাম বৃহৎ কিন্তু অন্যায় শক্তির পতন হয়েছে। অন্যায় নীতি যত কৌশলই প্রয়ােগ করুক না কেন পতন তার অনিবার্য। ইতিহাসে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
বীরেরা আত্মমর্যাদা বা স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে শুধু একবারই মরে। বীরভােগ্য বসুন্ধরা। তাই ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ বা সম্প্রসারনবাদের বিরুদ্ধে চাকমাদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে প্রতিরােধ সংগ্রাম চাকমা জাতির ইতিহাসে চির অমর, চির স্মরনীয়, চিরবরনীয়, চির গৌরবান্বিত হয়ে থাকবে।
এই সংকলণটি হচ্ছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির সংগ্রাম বিষয়ক বিভিন্ন লেখক এর মতামত, গবেষণা সমূহ বিভিন্ন প্রকাশনা বা বই পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে সেই সমস্থ প্রবন্ধ সমূহ আমি শুধু সংকলণ ও সম্পাদনা করেছি। পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলাে আমাদের মূল লক্ষ্য।
১৭৭৭-১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের চাকমা বিদ্রোহ
– হিমেল রহমান
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পরবর্তী প্রায় ২০০ বছরব্যাপী ইংরেজরা বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ শাসক করে। কিন্তু তাদের শাসনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয় নি।
তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ও শােষণের বিরুদ্ধে বাংলার অধিবাসীরা বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে, বিদ্রোহ করেছে, যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তিতুমীরের বিদ্রোহ, সিপাহী বিপ্লব, মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রামের বিদ্রোহ, নেতাজী সুভাস বসুর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর বিদ্রোহের কথা বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
কিন্তু আলােড়ন সৃষ্টিকারী এসব বিদ্রোহ ছাড়াও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে আরাে অসংখ্য বিদ্রোহ-বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, যেসবের ইতিহাস সম্পর্কে এদেশের অধিকাংশ মানুষই অবগত নন। এরকমই একটি ইংরেজ বিরােধী সংগ্রাম ছিল ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৭ সালে সংঘটিত চাকমা বিদ্রোহ।
চাকমা বিদ্রোহ সম্পর্কে আলােচনার আগে চাকমাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেয়া জরুরি। চাকমারা বাংলাদেশর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী একটি জাতি। যাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান।
চাকমাদের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন তাদের রাজাগণ। বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতান, সুবেদান এবং নবাবদের সম্পর্কে ছিল সৌহাদ্যপূর্ণ। চাকমা রাজা বাংলাদেশের শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন এবং বশ্যতার নিদর্শনস্বরুপ তাদেরকে সীমিত হারে রাজস্ব দিতে হতাে।
চাকমাদের সমাজব্যবস্থায় তখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না। দ্রব্যবিনিময়ের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলতাে। এজন্য মুদ্রার পরিবর্তে দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে রাজস্ব পরিশােধ করতেন। বিনিময়ে বাংলাদেশর শাসকরা চাকমা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরত থাকতেন। তাঁদের অধীনে চাকমারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভােগ করছিল। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমেই বাংলাদেশর রাজনীতির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। ১৭৬০ সালে ইংরেজদের অনুগত নবাব মীর জাফর তাদের বিরাগভাজন হন এবং ইংরেজরা তার জামাতা মীর কাসিমকে বাংলাদেশের নতুন নবাব পদে অধিষ্ঠিত করে। বিনিময়ে মীর কাসিম ইংরেজদেরকে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল প্রদান করেন। এর ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ইংরেজ কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে।
ইংরেজরা যথারীতি গণ্ডগােল শুরু করে দেয়। আগেই বলা হয়েছে, সুলতানি, মুঘল ও নবাবি শাসনামলে চাকমাদের ওপর আরােপিত রাজস্বের হার ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৭৬১ সাল থেকে ইংরেজরা বারবার রাজস্বের হার বৃদ্ধি করতে থাকে। শুধু তাই নয়, ইংরেজরা তাদের স্বভাব অনুযায়ী চাকমাদের অভ্যন্তরীন বিষয়াবলীতে হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করে দেয়।
১৭৭২-১৭৭৩ সালে ইংরেজরা চাকমাদের কে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব প্রদান করতে বাধ্য করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুদ্রা ভিত্তিক অর্থনীতি প্রচলনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলে চাকমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নানারকম সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
ক্রমে ইংরেজ শাসনের প্রতি চাকমারা বীতশুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ১৭৭৭ সালে ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ওপর রাজস্বের হার আরাে বৃদ্ধি করে এবং রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য ‘উদাদার’ (চুক্তি বদ্ধ ইজারাদার) নিযুক্ত করে।
১৭৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজা জোয়ান তখশের অনুমতিক্রমে তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। রনু খাঁ স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উত্তোলন করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ঐ অঞ্চল ঘেঁষা নিম্নাঞ্চল ইংরেজ ও ইংরেজদের অনুগত কর্মচারীদের বিতাড়িত করেন।
রনু খাঁর বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বারবার পার্বত্য চট্টগ্রামে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে, কিন্তু প্রতিবারই তাদের অভিযান শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। ইংরেজদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মােকাবেলা করার জন্য রনু খাঁ গেরিলা পদ্ধতি যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
প্রতিটি যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যরা চাকমা বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বিশেষত ১৭৮০ সালে পরিচালিত একটি বড় মাত্রার ইংরেজ অভিযান সম্পূর্ণ রুপে ব্যর্থ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিকূল ভৌগােলিক পরিবেশ, চাকমাদের অসীম সাহসিকতা এবং রনু খাঁ’র রণকৌশল এই তিনের কাছে ইংরেজ শক্তি পর্যদস্ত হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম কার্যকর ভাবেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘ভিয়েতনাম ‘ পরিণত হয়।
ছল আর বল উভয়ই ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়ায় ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত কৌশলের আশ্রয় নেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে চাকমাদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে তারা চাকমাদের অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ১৭৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা লবণ, মাছ, শুটকি, লৌহজাত দ্রব্যাদি, মৃৎপাত্র প্রভৃতি আমদানি করতাে চট্টগ্রাম থেকে। ইংরেজরা এসব দ্রব্য সরবরাহ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর অবরােধ কঠোরভাবে আরােপ করে। বােধহয় তারা মনে মনে ভাবছিল, হু হু! এইবার তােমাদের বাগে পেয়েছি, বাছাধন!
(Hutchinson, 1906)
ভাগ্যের পরিহাস এই যে, ইংরেজ অবরােধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মহা-পরাক্রমশালী জার্মান সাম্রাজ্যকে কাবু করে ফেলেছিল, সেই ইংরেজ অবরােধ চাকমাদের গায়ে ফুলের টোকাও দিতে পারেনি। উল্টো রণু খাঁ ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজদের ওপর পাল্টা অর্থনৈতিক অবরােধ আরোপ করেন।
সেসময় লবণ ব্যবসা ছিল ইংরেজদের প্রধান ব্যবসা। ভূমি রাজস্বের পর লবণ ব্যবসাই ছিল তাদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস। ইংরেজদের লবণ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। গায়ে এবং এই লবণ উৎপাদনের জন্য অতি প্রয়ােজনীয় জ্বালানি কাঠের প্রাই ষােল আনাই আসত পার্বত্য থেকে। রনু খাঁ সেই জ্বালানি কাঠ সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন!
ঠিক যেন বীমরুলের চাকে টিল পড়ল! ইংরেজরা দেখল এ তাে বয়াবহ সর্বনাশ! চাকমাদের উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে তাদের নিজেদের অর্থনীতিই বারােটা বেজে গেল। লবণ ব্যবসা থেকে তাদের প্রচুর আয় হত। আর প্রায় পুরােটাই বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ ইংরেজদের অবরােধ নামক অস্ত্র বুমেরাং হয়ে তাদের কপালেই আঘাত করলাে!
সরিয়া হয়ে ইংরেজরা আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আবারাে তারা বিপর্যয়ের মুখােমুখি হলাে। ১৭৮২ ও ১৭৮৫ সালে প্রেরিত তাদের বহৎ দুইটি সৈন্যবাহিনী চাকমাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে ইংরেজদের মান-সম্মান নিয়ে নতুন করে টানাটানি পড়ে যায়।
ছল-বল-কৌশল কোনােটাই তাদের কাজে এলাে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইংরেজদের ব্যর্থ অভিযানসমূহ এবং চাকমাদের আরােপিত অর্থনৈতিক অবরােধের কারণে ইংরেজরা মারাত্মক সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, পরাজয় স্বীকার ব্যতীত এ যুদ্ধে থেকে পরিত্রাণ উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ১৭৮৭ সালে তারা চাকমা রাজার সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি শর্তানুযায়ী,
(১) ইংরেজরা নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে চাকমাদের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।
(২) মুদ্রার পরিবর্তে দ্রব্যের মাধ্যমে রাজস্ব প্রদানের পদ্ধতি পুনঃপ্রচলিত হয় এবং চাকমা রাজা। ইংরেজদের বার্ষিক ৩০০ মণ তুলা রাজস্ব হিসেবে দিতে স্বীকৃত হন।
(৩) সমতল ভূমি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিবাসন বন্ধ করার জন্য ইংরেজরা রাজি হয়।
(৪) আরাকানের যুদ্ধেবাজ জাতিগুলাের আক্রমণ থেকে চাকমা রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য ইংরেজরা চাকমা রাজাকে সহায়তা করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় এবং এ উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য মােতায়েন রাখা হয়।
এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী চাকমা বিদ্রোহের অবসান ঘটে। বিদ্রোহের অবসান ঘটায় ইংরেজরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, অন্যদিকে চাকমারাও তাদের পূর্ণ অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা তথা স্বায়ত্তশাসন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।
টীকাঃ চাকমাদেরকে আমাদের দেশে সাধারণত ‘উপজাতি’ বলা হয়, যা সঠিক নয়। ‘উপজাতি’ অর্থ কোনাে জাতির অন্তর্গত ৩ একটি ক্ষুদ্র ভাগ। কিন্তু চাকমারা অন্য কোনাে জাতির অংশ নয়। চাকমারা বাঙালিদের মতােই একটি স্বতন্ত্র জাতি। চাকমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে, নিজস্ব সমাজব্যবস্থা আছে, স্বঅঙ্গ একটি ইতিহাসও রয়েছে। এজন্য চাকমাদেরকে জাতি বলাটাই যুক্তিসঙ্গত।
১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে সংঘটিত ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের পর থেকে কোনাে ক্ষুদ্র জাতির কাছে কোনাে বৃহৎ জাতির পরাজয়কে ‘ভিয়েতনাম’ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন-১৯৭৯-১৯৮৯ সালের আফগান যুদ্ধকে বলা হয় ‘সােভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম’। সেই অর্থে চাকমা বিদ্রোহের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ইংরেজদের ভিয়েতন-পাম।
‘বুমেরাং’ অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের ব্যবহৃত এক ধরনের অস্ত্র, যেটিকে নিক্ষেপ হলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করলে সেখানেই পড়ে থাকে, আর আঘাত না করলে আবার নিক্ষেপকারীর হাতে ফিরে আসে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৭৭৬-১৭৮৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইংরেজদের পরাজিত করে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রায় একই সময়ে (১৭৭৭-১৭৮৭) চাকমারাও ইংরেজদের প্রাজিত করে অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১) বাংলাদেশের ইতিহাস (লেখক-ড. মুহম্মদ আব্দুল রহিম)।
২) Wikipedia : Chakma People
৩) জুমজার্নাল ব্লগ
ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম (১৭৭২-১৭৯৮)
– ড. সুনীতি ভূষন কানুগো
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম।
এই প্রতিরোধ সংগ্রামের অনেকগুলি কারন ছিল। তার মধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি প্রধান। প্রথমত, মোগল শাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চাকমাদের নিকট থেকে অযৌক্তিক ভাবে বার্ষিক ৫০০ মন কার্পাস তুলা কর হিসাবে দাবি করে। দরিদ্র চাকমা কৃষিজীবীদের পক্ষে এই বিপুল পরিমান কার্পাস সরবরাহ করা একরূপ অসম্ভব ছিল।
দ্বিতীয়ত, সমতল ভূমির অধিবাসীরা চাকমা কর্তৃপক্ষকে কোন শুল্ক বা কর না দিয়েই ইচ্ছামত চাকমা রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরন করতে থাকে।
তৃতীয়ত , ইংরেজ কর্তৃপক্ষের পৃষ্টপোষতায় সমতল চট্টগ্রামের অধিবাসীরা চাকমা রাজ্যের ভূমি দখল করতে থাকে। রাঙ্গুনিয়া ভূখন্ড এই ভূমি আগ্রাসনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাজ্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উর্বর স্থান ছিল।
ইংরেজ সরকার রাঙ্গুনিয়াতে বৃটিশ আধিপত্য স্থাপন পূর্বক চাকলাদারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে ইংরেজ ও চাকমা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। রাঙ্গুনিয়াতে চাকমা রাজের দেওয়ান ছিলেন রনু খাঁন, তিনি রাঙ্গুনিয়াতে বৃটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেন।
১৭৭৬ সালে চট্টগ্রামের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ রনু খানের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরন করলে উভয় পক্ষে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। ইংরেজ সেনাবাহিনী চাকমা যোদ্ধাবাহিনির বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে পারে নি।
১৭৭৭ সালে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ চাকমাদের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। কিন্তু পাহাড়ে অগ্নিসংযোগ ছাড়া এই সেনাবাহিনী বিশেষ কিছু করতে পারলো না রনু খানের নেতৃত্বে চাকমা দ্বারা রাঙ্গুনিয়ার অধিবাসীদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করতে আরম্ভ করে।
আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে চাকমা যোদ্ধারা তীর ধনুক,বর্শা বল্লম , কিরিচ, লম্বা দাও ইত্যাদি নিজস্ব নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন।
১৭৮১ সালে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পুনরায় সেনাবাহিনী প্রেরঙ্করে। কিন্তু এবারেও তাঁদের অভিযান ফলপ্রসূ হয় নাই।
অতঃপর চট্টগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর মিঃ আরুইন সমগ্র চাকমা ভূখন্ডে এক সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। চাকমা ভুখন্ডে অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করা হলো।
১৭৮৫ সালে ব্রিটিশ বাহিনী চাকমা রাজ্যের রাজধানী রাঙ্গামাটি অধিকার করে। চাকমা রাজ জান বখ্শ্ খান রাজধানী ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহন করেন। ১৭৮৬ সালে চাকমা রাজ জান বক্স খানের সাথে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। ১৭৯৩-৯৪ সালে ইংরেজ বাহিনী চাকমা বাহিনীকে পরাজিত করলে চাকমা প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে । ১৭৯৮ সালে চাকমা রাজ জব্বর খান ইংরেজ বাহিনীর আত্মসমর্পন করে।
তথ্য সূত্র:
ড. সুনীতি ভূষণ কানুগো
১) ব্রিটিশ বিরোধ চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম
– এম.এন.লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্দেশন
২) পার্বত্য চট্টগ্রাম ইতিহাসঃ সমাজ ও সংস্কৃতি
– রেগা প্রকাশনী
৩) CHAKMA RESISTANCE TO BRITISH DOMINATION..
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জাতির বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭)
– সজল কান্তি দাশ গুপ্ত
অধুনা বাংলাদেশের অন্তগর্ত চট্টগ্রাম জেলার অঞ্চলে চাকমা নামক এক পাহাড়িয়া উপজাতি বসবাস করত। এরা মূলত যাযাবর কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। প্রথম দিকে এই চাকমারা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ প্রান্তে বসবাস করত। কিন্তু বহ্মযুগের সময় মগেরা এসে চাকমাদের সেই স্থান থেকে বিতারিত করলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ প্রান্তে বসবাস করত। কিন্তু ব্রহ্মযুগের সময় মগেরা এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে । প্রকৃতির সাথে নিরবিচ্ছিনভাবে কঠোর সংগ্রাম করে জীবন ধারন করতো।
চাকমা জুম চাষ
এ্যাকেঞ্জি সাহেবের গ্রন্থ থেকে এই আদিম জাতির চাষবাস প্রথা সম্পর্কে জানা যায়-
“যে প্রথায় সকল পাহাড়িয়া জাতি জমি চাষ করিত, তাহার নাম ‘জুম’ প্রথা। প্রতি বৎসর এপ্রিল মাসে গ্রামের সমস্ত লোক কোন একটা সুবিধাজনক স্থানে যাইয়া বসতি স্থাপন করে। তাহার পর প্রত্যেক পরিবারের সকল লোক জঙ্গল কাটিয়া চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জমি আবাদ করিয়া লয়।
ফসল পাকিবার সময় বন্য পশুপক্ষীর হাত হইতে শস্য রক্ষা করিবার জন্য তাহারা জুম এ দল বাধিয়া জমি পাহারা দেয়। দুই বৎসর চাষের পর জমির উর্বর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এই ভাবে যখন গ্রামের চারিপাশের সমস্ত উর্বর জমি চাষ করা হইয়া যায়, তখন সক্ল লোক ঐস্থান ত্যাগ করিয়া অন্যস্থানে গিয়া বসতি স্থাপন করে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চাকমারা এইভাবে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা অনুর্বর জমিতে তুলার ফসল ফলায়। আর সেই তুলা সমতল ভুমিতে নিয়ে এসে তার বিনিময় চাল, লবণ ও অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। এইভাবে এই উপজাতিরা কঠোর পরিশ্রমের কিন্তু স্বাধীন জীবন যাপন করতো।
সেখানে কোন বাইরের কারোর হস্তক্ষেপ পছন্দ করতো না।এমনকি মোঘল আমলে ও তারা নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখে ছিল। তারা কেবলমাত্র তাদের উৎপাদিত শস্যের একটা সামান্য অংশ মোঘল সম্রাটকে রাজস্ব হিসাব প্রদান করতো।
কিন্তু এই অঞ্চলেটি ইংরেজ শাসনের অধীনে আসার পর থেকেই চাকমাদের স্বাধীন জীবন ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। ইংরেজদের নানাবিধ শোষন ব্যবস্থায় তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এই সময় ফড়িয়া নামক এক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে।
এই ফড়িয়ারা নানা রকমের উৎপীরন দ্বারা এই অমানুষিক পরিশ্রমের উৎপন্ন ফসলের উপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এই ফড়িয়া ইজারাদারেরা পার্বত্য আদিবাসিদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা আদায় করত। এবং আদায় কালে নানা রকম ছল চাতুরী দ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা থেকে কয়েকগুন বেশি তুলা আদায় করত এবং তারা চুক্তি অনুযায়ী তুলা ইংরেজ শাসকদের হাতে তুলে দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করত।
অবশ্য ইংরেজ প্রভুদের অনুমতি নিয়েই ইজারাদারেরা এই কাজ করত। ইংরেজ শাসকেরা ইজারাদার দের কাছ থেকে রাজস্ব হিসাবে প্রপ্ত তুলা দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তির মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করে মুদ্রা রোজগার করত। তারা ঐ দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে একটা নির্দিষ্ট মূল্যে চুক্তি করত। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি চুক্তি মতো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়ে বাকি তুলা থেকে ফটকাবাজি দ্বারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করত।
ইজারাদার এবং এই দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির ফলে তুলাচাষিদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। প্রথমে ইজারাদারেরা রাজস্ব আদায়ের নামে নানা ছলচাতুরীর দ্বারা সহজ সরল চাকমাদের কাছ থেকে সেটা বেচতে গিয়েও তারা নানাভাবে ঠকে যেত। ঐ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ফাতকাবাজি দ্বারা নাম মাত্র মূল্যে অবশিষ্ট তুলা কিনে নিত।
চাকমা চাষীদের ঠকাবার আর এক্তি প্রথা ছিল বিনিময় প্রথা। তারা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমান ওজনের দ্রব্য নিতে অভ্যস্ত ছিল। তুলার ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগটা নিত।
তারা আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলা আত্মসাৎ করে বিনিময়ে দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণ। এইভাবে একটি দুটি কিনেই চাষীদের সমস্ত তুলা শেষ হয়ে যেত। কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত তুলা থেকে আদিবাসীদের বেঁচে থাকার রসদের ভগ্নাংশও জোগার করে উঠতে পারত না।
অনাহার, অর্ধাহার আর মৃত্যু ছিল তাদের জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। দিনের পর দিন শোষিত হতে হতে যখন তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায় তখন কেবলমাত্র বেঁছে থাকার তাগিদে আদিবাসীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
প্রথম চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৭৭)
চাকমারা প্রথম বিদ্রোহ করে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় চাকমা দলপতি রাজা শেরদৌলত এবং তার সেনাপতি রামু খাঁ। চাকমা সমাজে রামু খাঁ সেনাপতি বলে পরিচিত ছিলো। এবং সাধারণ চাকমা জনসাধারণের উপর তার প্রভাব ছিলো অপরিসীম।
ইজারাদাদের শোষণ , উতপীড়ন এবং ঐ দ্বিতীয় ফাতকাবাজির ব্যক্তিটির কারসাজিতে চাকমা কৃষকেরা যখন ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় তখন এই রামু খাঁ সকল চাকমাদের একত্রিত করে বিদ্রোহের ডাক দেয়।
প্রথমে তারা কার্পাস কর বা তুলা দেওয়া বন্ধ করে দেন। তারপর তারা দলে দলে ইজারাদারদের তুলার গোলা লুঠ করতে থাকে। তাদের সমস্থ তুলা চাকমারা লুঠ করে নিয়ে যায়। এরপর রুনু খাঁ দলবল নিয়ে ইজারাদারদের ঘাটিগুলি আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে দেয়। ইজারাদারদেরেরা এবং তাদের কর্মচারীরা পলায়ন করে। বহু কর্মচারী চাকমাদের হাতে নিহত হন।
ইজারাদারগণ তখন সাহায্যের জন্য ইংরেজ শাসকের কাছে প্রার্থনা করেন। ইংরেজ শাসকগণ তখন ঐ অঞ্চলে সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করে। অন্যান্য আদিবাসী বিদ্রোহের মতো এক্ষেত্রেও এক অসম লড়াই হতে পারত। কিন্তু চাকমাগণ বুঝতে পেরেছিল যে তাদের তীরধনুক ও বর্শা দিয়ে ইংরেজদের আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই তারা প্রথম থেকেই গেরিলা যুদ্ধের ব্যবস্থা করে।
যখনই ইংরেজ বাহিনী আক্রমন করতে আসে তারা সদলবলে গভীর পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। আবার ইংরেজ সেন দল তাদের খুঁজে না পেয়ে চলে গেলে চাকমারা দেশে ফিরে আসে। এবং সুযােগ বুঝে সমতল ঞ্চলে নেমে এসে ইজারাদারদের ঘাঁটি এবং ব্যবসায়ীদের দোকান পয়সার লুঠ করে আবার গভীর পার্বত্য জঙ্গলে ফিরে যায়।
ইংরেজ বাহিনী তাড়া করেও চাকমাদের নাগাল পায় না। এই ভাবে চাকমাদের দমন করা অসম্ভব দেখে ইংরেজ অফিসার একটি কৌশল অবলম্বন করে। তারা আর চাকমাদের পিছু তাড়া না করে সমতলের বিভিন্ন বাজারে সৈন্যদের পাহারায় বসিয়ে দেয়।
কেননা ইংরেজরা জানত যে তুলার বিনিময়ে চাল, লবণ ইত্যাতি সংগ্রহ করতে চাকমাদের বাজারে আসতেই হবে। অবশেষে ইংরেজদের কৌশল সফল হল। খাদ্য ও লবণ চাড়া চাকমাদের বেশিদিন পালিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তারা বাধ্য হয়ে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করল। রামু খাঁ ইংরেজদের বার্ষিক ৫০১ মণ তুলা রাজস্ব বাবদ দিতে সম্মত হয়েছিল। এইভাবে রুনু খাঁর নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ প্রথম চাকমা বিদ্রোহের অবসান হয়।
দ্বিতীয় (১৭৮২), তৃতীয় (১৭৮৪) ও চতুর্থ (১৭৮৭) চাকমা বিদ্রোহ
যতদিন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের জন্য ইংরেজ শাসকরা ইজারাদারদের নিযুক্ত করে রেখেছিল। ততদিন পর্যন্ত চাকমারা বার বার বিদ্রোহ করেছিল। ইংরেজ শাসক, ইজারাদারেরা মিলে অর্থনৈতিক অবরােধ করে সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করলে ও চাকমাদের বিদ্রোহের আগুন নেবাতে পারেনি।
তাইতাে প্রথম বিদ্রোহ অবসানের কয়েক বৎসর পরেই অল্প সময়ের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র জানবক্স খা’ দলপতি হয়েই চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়।
কেননা চাকমাদের প্রথম বিদ্রোহের অবসানের পর ইজারাদাররা আবার আগের মতােই চাকমাদের উপর অত্যাচার চালাত। কিন্তু চাকমাদের এই বিদ্রোহও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ইংরেজ প্রশাসন আগের মতােই অর্থনৈতিক অবরােধ করে চাকমাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করায় তবে ১৭৮৩ থেকে ১৭৮৫ এই তিন বছর ইজারাদারদের চাকমারা তাদের অঞ্চলে ঈস্থবেশ করতে দেয়নি।
ইজারাদাররা কোন রুপ রাজস্ব আদায়করতে পারেনি। ফলে ঐ তিন বছরের জন্য ইংরেজ প্রভুরা রাজস্ব মুকুব করে দিতে বাধ্য হয়। জানবক্স-এর নেতৃত্বে চাকমারা বশ্যতা স্বীকার করে। জানবকসের পর দ্বিতীয় দৌলত খাঁ নামে অপর একজন চাকমা নেতার আর্বিভাব ঘটে। এবং তার নেতৃত্বে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে চাকমারা আবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় দৌলত খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেন।
আধুনিক আগ্নেয় অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চাকমারা যে রণ কৌশল অবলম্বন করে ছিল তা গেরিলা যুদ্ধেরই নামান্তর। ইংরেজ সৈন্যদল যখন চাকমাদের গ্রামে প্রবেশ করত তখন চাকমারা স্ত্রী-পুত্র, কন্যা এবং অস্থাবর সম্পত্তিসহ গভীর পার্বত্য জঙ্গলে পালিয়ে যেত। ইংরেজ সৈন্যদল কাউকে না পেয়ে চাকমাদের বাড়ি ঘর ক্ষেত নষ্ট করে দিত।
তারপর ওদরে খুঁজতে খুঁজতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করত। শেষ পর্যন্ত কাউকে খুঁজে না পেয়ে যখন সৈন্যরা ফিরে আসতে যেত তখন পিছন থেকে চাকমারা সৈন্যদের আক্রমণ করত। ওদিক বড়গাছ ভারী পাথর ইত্যাদি দিয়ে সৈন্যদের ফেরার পথও বন্ধ করে দিত।
চারিদিক অবরুদ্ধ সৈন্যদের তখন গােপনস্থান থেকে ঝাক বিষাক্ত তীর মেরে হত্যা করত চাকমারা। এই ভাবে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে চাকমার আন্দোলন করে বহু ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করেছে। যুদ্ধ করে ইংরেজরা কখনই চাকমাদের পরাজিত করতে পারেনি। তারা বশ্যতা স্বীকার করেছে মলত বাজারে এসে খাদ্য লবণ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে না পেরে এবং অর্থনৈতিক অবরােধের জন্য।
দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে আন্দোলন করবার পর শেষ পর্যন্ত ইংরেজ শাসকরা বুঝতে পারে যে ইজারা প্রথার অবসান না ঘটালে চাকমাদের আন্দোলন বন্ধ করা যাবেনা। ইজারাদারদের অত্যাচার ও শােষণের ফলেই তারা বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্য কর্তা হ্যারিস সাহেব রেভিনিউ বাের্ড- এর কাছে সুপারিশ করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেই জারা প্রথা তুলে দিয়ে ইংরেজ শাসকরা যেন সরাসরি চাকমা দলপতির মাধ্যমে কার্পাস কর সংগ্রহ করে।
সেই সুপারিশ অনুযায়ী ইংরেজরা চাকমা দলপতিকে বলে যে খাজনার হার বৃদ্ধি পাবে না। এবং দলপতি নিজেই এই রাজস্ব চাকমাদের কাছ থেকে সংগ্রহ। করে কালেক্টরের অফিসে জমা দিয়েদেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।
১৭৭৬ থেকে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর পূর্ব ভারতে যে গণ আন্দোলনগুলি ঘটেছে তার। মধ্যে উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে চাকমা আদিবাসীরা গেরিলা যুদ্ধের দ্বারা যেভাবে ইংরেজ শাসকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে তা ইতিহাসে বিরল। এর অব্যবহিত পরেই বীরভূম, বাঁকুড়া জেলায় আর এক ব্যপক আদিবাসী বিদ্রোহ হতে দেখা যায়। এই বিদ্রোহই ‘পাহাড়িয়া বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
তথ্য সূত্র: আদিবাসী জাগরন – রেণু প্রকাশনী কলকাতা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭)
– সুপ্রকাশ রায়
চাকমা জাতির জীবনধারা
চট্টগ্রাম জেলার সমতল ভূমির উপরিভাগ অবস্থিতপাহাড়-পর্বতময় অঞ্চলটির নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি “যাযাবর চাষীদের বাসস্থান। প্রকৃতির কঠোরতা এবং ততােধিক দুর্ধর্ষ ও বন্য প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করিয়া ইহাদের জীবন ধারণ করিতে হয়।”১
ভারতবর্ষের অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের মতােই এই অঞ্চলের চাকমা কুকি প্রভৃতি অধিবাসীরা প্রকৃতির সহিত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কঠোর সংগ্রাম করিয়া জীবন ধারণ করে। সেই কঠোর সংগ্রামই তাহাদিগকে দুর্ধর্ষ করিয়া তুলিয়াছে।
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলটি প্রথম ছিল কুকি জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান। পরে চাকমাগণ কুকিদের আরও উত্তর-পূর্ব দিকে তাড়াইয়া দিয়া আরাকান অধিকার করে। কিন্তু ব্রক্ষযুদ্ধের সময়(১৮২৪-৫২) মগেরা আসিয়া চাকমাদের বিতাড়িত করিয়া চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশ অধিকার করিলে চাকমাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করিয়া সেই স্থায়িভাবে বসবাস করিতে থাকে।২
এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অদিবাসীরা এমনকি মােগল যুগেও নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখিতে পারিয়াছিল। সেই যুগেও তাহারা তাহাদের নিজস্ব স্বাধীন জীবিকার ব্যবস্থা অক্ষত ও অব্যাহত রাখিতে সক্ষম হইয়াছিল। তখন তাহারা কঠোর কায়িক পরিশ্রমে পস্তরময় অনুর্বর জমিতে যে শস্য উৎপাদন করিত তাহার সামান্য একটা অংশ রাজস্ব হিসাবে মােগল সম্রাটদের দিয়া তাহারা স্বাধীনভাবেই বাস করিত।
কিন্তু এই অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হইয়া যায় এবং অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মতাে এই পর্বত অরণ্যাচারী আদিম মানুষগুলি ও ক্রমশ ইংরেজ রাজের শােষণ-ব্যবস্থার নাগপাশে আবদ্ধ হইয়া ক্রমশ এই অঞ্চলের৩ উপরেও ইংরেজ রাজের শােষণ যন্ত্রগুলি একে চাপিয়া বসিতে থাকে।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে এক সন্ধি দ্বারা ইংরেজদের “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” মীর কাসেমের হস্তে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নবাবী দান করিয়া প্রতিদান স্বরূপ বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। সুতরাং সেই সঙ্গে এই ক্ষুদ্র চাকমা রাজ্যটি ও পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য ইংরেজ বণিকদের কুক্ষিগত হয়।৪
সেই সময় হইতেই ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী ও উহার শােষণের অনুচরগণ এই আদিবাসীদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিতে আরম্ভ করে। এই আদিবাসীদের জীবনধারা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেক জান্দার ম্যাকেঞ্জি সাহেব লিখিয়াছেন:
“চট্টগ্রাম বিটিশ অধিকার আসিবার সঙ্গে সঙ্গেই এই পার্বত্য অঞ্চলের কোন অংশে ব্রিটিশ শাসক প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সেই সময় বিটিশ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে দুইজন মাত্র পাহাড়িয়া দলপতির সন্ধান পাইয়াছিল। তাহাদের একজন ছিল ‘ফ্রু’ নামক আদিম জাতির নায়ক অপর জন চাকমা জাতির নায়ক। এই দলপতিগণ মুসলমান শাসকদের নিকট রাজস্ব হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস পাঠাইত।
তাহারা প্রথমে ব্রিটিশ শাসকদিগকেও কার্পাসের দ্বারা রাজস্ব দিত। কিন্তু রাজস্বেও কার্পাসের পরিমাণ সম্ভবত এক এক বৎসর এক এক রূপ হইত। এই জন্যই প্রতি বৎসর এই “কার্পাস মহল” একজন ফড়িয়ার (Speculator) নিকট ইজারা দেওয়া হইত। এই ইজারাদার ফড়িয়া ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সহিত কার্পাস-রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করিত এবং এইভাবে এই অঞ্চলের সমস্ত কার্পাস একচেটিয়া করিয়া ফেলিত।”৫
ম্যাকেঞ্জি সাহেবের মতে, মােগল যুগেই “কার্পাস মহল” বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফড়িয়া আ ‘স্পেকলেটর’ নামক শােষকদের আবির্ভাব ঘটে। ইংরেজ শাসকগণ এই পার্থ জাতিগুলির উপর তাহাদের শােষণ-যন্ত্রের অপরিহার্য অংশ রূপে এই ফড়িয়াদের লোক ফড়িয়ারা ইংরেজ শাসকদের সহিত রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করিয়া নানাবিধ উঠি কার্পাস মহলের প্রস্তরময় অনুর্বও জমিতে পাহাড়িয়াদের অমানুষিক পরিশ্রমে উৎপন্ন একমাত্র উপর একচেটিয়া প্রভুত্ব স্থাপন করে।
এই অঞ্চলের আদিম প্রথায় চাষবাস ও ভূসম্পত্তি প্রথার নিম্নোক্ত বিবরণটি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের গ্রন্থে পৗয়া যায়:
“যে প্রথায় সকল পাহাড়িয়া জাতি জমি চাষ করিত, তাহার নাম “জুম” প্রথা। প্রতি বৎসর এপ্রিল মাসে গ্রামের সমস্ত লােক কোন একটা সুবিধাজনক স্থানে যাইয়া বসতি স্থাপন করে। তাহার পর প্রত্যেক পরিবারের সকল লােক জঙ্গল কাটিয়া চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জমি আবাদ করিয়া লয়।
ফসল পাকিবার সময় বন্য পশুপক্ষীর হাত হইতে শস্য রক্ষা করিবার জন্য তাহার “জুম” বা দল বাধিয়া সারা রাত্রি জমি পাহারা দেয়। দুই বত্সর চাষের পর জমির উর্বর শক্তি নিঃশেষ হইয়া যায়। এইভাবে যখন গ্রামের চারিপাশের সমস্ত উর্বর জমি চাষ করা হইয়া যায়, তখন সকল লােক ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া অন্য স্থানে গিয়া বসতি স্থাপন করে।
সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এই প্রথায় চাষের ফলে কোন জমির উপই জুমিয়াদের (যাহারা জুম চাষে অংশগ্রহণ করে) স্থায়ী স্বত্ব জন্মিতে পারে না, এবং এই সকল জমির রাজস্ব নির্ধারণ কম কোন উপায় থাকে না। এই জন্যই এমনকি দলপতিরাও জমি বা বনের উপর কে অধিকার দাবি করে না।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা প্রভৃতি আদিবাসীরা এইভাবে অনুর্বও পার্বত্য জমিতে তুলার ফসল ফলাইয়া এবং সেই তুলা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে লইয়া আসিয়া ইহার বিনিময়ে চাউল, লবণ প্রভৃতি প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিত।
ব্রিটিশ শোষণ-পদ্ধতি
ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বিবরণ হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অধিবাসীরা ছিল যাযাবর চরিত্রের মানুষ। ইংরেজ শাসনের পূর্বে এবং অব্যবহিত পরেও ইহাদের মধ্যে জমির উপর ব্যক্তিগত স্বত্বের উদ্ভব হয় নাই। ব্যক্তি গত সম্পত্তির উত্তর না মধ্যে হইবার ফলে ইংরেজ শাসকগণ প্রথমে এই অঞ্চলের উপর তাহাদের প্রত্যক্ষ শােষণের জাল বিস্তার। করিতে না পারিয়া পরােক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিল। পরােক্ষ ব্যবস্থাটি ছিল নিম্বরূপ:
ইংরেজ শাসকগণ বাহিরের কোন ব্যক্তির সহিত কার্পাস কর আদায়ের চুক্তি করিয়া তাহাকে পার্বত্য অঞ্চল ইজারা দিত। ইজারাদার বিভিন্ন কৌশলে এই সরল প্রকৃতির পার্বত্য অধিবাসীদের নিকট হইতে রাজস্বেও নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা হইতে কয়েকগুণ অধিক তুলা আদায় করিয়া আনিত এবং চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা শাসকের নিকট জমা দিয়া বাকি তুলা আত্মসাৎ করিত। ইহার পর ঐ তুলা বাজারে বিক্রি করিয়া প্রচুর মুনাফা লাভ করিত।
অবশ্য ইজারাদার ইংরেজ প্রভুদের সম্মতি লইয়া ইহা করিত। শাসকগণ রাজস্ব হিসাবে যে তুলা পাইত তাহা। বিক্রয় করিয়া মুদ্রায় পরিণত করিবার জন্য অন্য কোন ব্যক্তির সহিত চুক্তি করিত। এই চুক্তিতে মুদ্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকিত। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি শাসকগণের হস্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়া বাকি তুলা হইতে ফটকাবাজি দ্বারা (স্পেকুলেশন) প্রচুর মুনাফা করিত।৭
এই ব্যবস্থার ফলে পার্বত্য অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব হইয়া ওঠে। প্রথমত, প্রথম ইজারাদারটি তাহাদের নিকট হইতে রাজস্বের নামে প্রায় সমস্ত তুলাই লুটিয়া লইত। দ্বিতীয়ত, তাহার লুণ্ঠনের পর যে সামান্য পরিমাণ তুলা বাকি থাকিত তাহা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে লইয়া গিয়া উহার বিনিময়ে বা উহার বিক্রয়লব্ধ অর্থে আদিবাসীদের পক্ষে খাদ্য প্রভৃতি প্রয়ােজনীয় সামগী সংগ্রহ করা দ্বিতীয় ব্যক্তিটির পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিত।
কারণ, গেন ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে ঐ অবশিষ্ট তুলা নামমাত্র দামে তাহার নিকট বিক্রয় করিতে আদিবাসীদের বাধ্য করিত। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমান ওজনের দ্রব্য লইতে অভ্যস্ত ছিল।
সুতরাং তুলার ব্যাপারী দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণের বিনিময়ে আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলা আত্মসাৎ করিত ৷৮ এইভাবে কোন একটি বা দুইটি দ্রব্য ক্রয় করিতেই আদিবাসীদের সমস্ত তুলা নিঃশেষ হইয়া যাইত। এই উভয়বিধ শােষণের ফলে এই অঞ্চলের আদিবাসীরা অনিবার্য মৃত্যুর মূখে আসিয়া দাঁড়াইল। অবশেষে তাহারা আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহের পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইল।
প্রথম চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৭৭)
প্রথম চাকমা-বিদ্রোহ সম্পর্কে সরকারি রেকর্ডে কেবলমাত্র একখানি পত্রের উল্লেখ দেখা যায়। এই পত্র দ্বারা চট্টগ্রামের তৎকালীন কালেক্টর গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে এই বিদ্রোহের সংবাদ দিয়াছিলেন। এই পত্রে কালেক্টর সাহেব নিম্নোক্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন;
“রুনু খা এক পাহাড়িয়া তুলার চাষের জন্য কোম্পানিকে সামান্য রাজস্ব দেয়। আমার এই স্থানে আসিবার পর হইতে, ইজারাদার গণের দুর্ব্যবহারের জন্যই হউক অথবা তাহার বিদ্রোহী চরিত্রের জনাই হউক, রুনু খাঁ কয়েক মাস যাবৎ কোম্পানির ইজারাদারগণের সহিতভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা চালাইতেছে। রামু থাকে বন্দী করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা চলিতেছে।”৯ কিন্তু কালেক্টরের এই চেষ্টা সফল হয় নাই, কারণ রুনু খাঁ তাহার বাসস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছে।”১০
পরবর্তী কালে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা রুপে আসিয়া আলেকজান্দার ম্যাকেঞ্জি এই লইন, আর, এইচ এস, হাচিন প্রতি উদ্য পায় ইংরেজ কবিগণ তা এই বিলােয় ও অনান্য বিয়ে সম্পর্কে এই তথ্য খুজিয়া বাহির কবেন। ইহাদের মধ্যে লুইন-এর বিবরণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্য ভাগে চাকমাগণ প্রথমবার বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এই বিদ্রোহের ছিলেন চাকমা-দলপতি “রাজা” শের দৌলত ও তাহার সেনাপতি রুনু খাঁ। ইহারা উভয়ে ছিলেন পরস্পরের আত্মীয়। রুনু খাঁ সাধারণের নিকট সেনাপতি বলিয়া পরিচিত ছিলেন।
উপর সেনাপতি রুনু খার অসাধারণ প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। ইংরেজ শাসকদের দ্বারা ইজারাদারগণের শােষণ-উৎপীড়ন সহ্যেও সীমা অতিক্রম করিলে রুনু ও শের দৌলত চাকমা জাতির সকল লােককে একত্র করিয়া ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসনের মূলােচ্চেদ কবির প্রস্তুত হন।
প্রথমে কার্পাস-কর দেওয়া বন্ধ হয় এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে ইজারাদারগণের কল গােলা লুষ্ঠিত হয়। রুনু খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ ইজারাদারদের বড় বড় ঘাটি ধ্বংস করিয়া ফেলে। রাঙ্গুনিয়া প্রভৃতি স্থানের বড় বড় গােলা লুণ্ঠন করিয়া সমস্ত তুলা বিদ্রোহীরা লইয়া যায়। ইজারাদার ও তাহার কর্মচারিগণ চাকমা অঞ্চল হইতে পলায়ন করে এবং বহু কর্মচারী চাকমাদের হস্তে নিহত হয়।
ইংরেজ শাসকগণ ইজারাদাদের সাহায্যে অগ্রসর হয় এবং এই অঞ্চলের সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করে। চাকমাগণ তাহাদের তীর-ধনুক ও বর্শা দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অসম্ভব বুঝিয়া গভীর পার্বত্য অঞ্চলে সরিয়া পড়ে।
ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের কোন সন্ধান না পাইয়া ফিরিয়া আসে। চাকমাগণ সুযােগ বুঝিয়া আবার অগ্রসর হয় এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিয়া ইজারাদাদের ঘাটি ও ব্যাপারীদের দোকান প্রভৃতির উপর আক্রমণ চালাইতে থাকে। ইংরেজ বাহিনী আবার পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করিয়া বিদ্রোহ দের পশ্চাদ্ধাবন করে। কিন্তু এবারেও বিদ্রোহীরা গভীর পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য হইয়া যায়।
এই ভাবে বিদ্রোহী চাকমাদের দমন করা অসম্ভব বুঝিয়া শাসকগণ এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে। চাকমাগণ সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারে আসিয়া তাহাদের উদ্ধৃত্ত মূল্যের বিনিময়ে বাজার হইতে খাদ্য, লবণ প্রভৃতি সংগ্রহ করিত। শাসকগণ জানিত যে, চাকমারা তুলা বাজারে লইয়া আসিতে না পারিলে খাদ্য সংগ্রহ করিতে পারিবে না এবং খাদ্রাভাবে শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইবে।
সুতরাং তাহারা সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারের পথে বহু স্থানে সৈন্যের পাহারা বসাইয়া চাকমাদের বাজারে আসা বন্ধ করিবার ব্যবস্থা করে। অবশেষে তাহার” কোশল সাফল্য লাভ করে চাকমাগণ বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। রুনু খাঁ ইংরেজ শাসকগণকে ৫০১ মগ তুলা বার্ষিক রাজস্ব স্বরূপ দিতে সম্মত হইয়াছিলেন।১১
এই প্রথম চাকমা-বিদ্রোহ ও উহার প্রধান নায়ক রুনু খাঁর নাম এখনও চাকমা জাতির স্মৃতি হইতে মুছিয়া যায় নাই, এখনও নাকি চাকমাগণ এই বিদ্রোহ ও রুনু খার কাহিনী গর্বের সহিত স্মরণ করে।১২
দ্বিতীয় চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮২)
প্রথম বিদ্রোহের পর হইতে রুনু খার আর কোন উল্লেখ দেখা যায় না। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে চাকমা-দলপতি শের দৌলত খার মৃত্যুর পর তাহার পুত্র জানবকস খাঁ “রাজা” (দলপতি) নির্বাচিত হন।
“জানবক্স খাঁ জমিদার বলিয়া নিজের পরিচয় দিলেও তিনি বহুকাল পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন।”১৩ জানবক্স খাঁ দলপতি হইয়া চাকমা অঞ্চলে ইজারাতার গণের প্রবেশ বন্ধ করিয়া দেন। ১৭৮৩ হইতে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোন ইজারাদারই এই অঞ্চলে প্রবেশ করিতে বা রাজস্ব আদায় করিতে পারে নাই।
সেই হেতু ইংরেজ প্রভুরা ইজারাদারগণের উপর সদয় হইয়া ১৭৮৩, ১৭৮৪ এবং ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহী হইয়াছিল। এই বিদ্রোহের কারণস্বরূপ ক্যাপ্টেন লুইন লিখিয়াছেন:
“ইজারাদারগণ এই উপজাতির উপর ভীষণ অত্যাচার করিত। তাহার ফলে বহু চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অঞ্চলেও পলায়ন করিয়াছিল। চাকমাগণ জানবক্স এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। কিন্তু স্থানীয় শাসকগণ পূর্বের মত অর্থনৈতিক অবরােধের মুখে আবার তাহাদের বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য করে।”১৫
এই বিদ্রোহের সময়ে ও ইংরেজ বাহিনী চাকমাদের দমন করিতে পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু জানবক্স ও সকল গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করিয়া এই অভিযান ব্যর্থ করিয়া দেয়।১৬
তৃতীয় ও চতুর্থ চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮৪-৮৭)
জানবক্স খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহ করে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। এই বিদ্রোহ দীর্ঘকাল ধরিয়া চলিয়াছিল। জানবকস্ অবশেষে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে বশ্যতা স্বীকার করেন। হাচিন্সনের বিবরণে দেখা যায় ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দেই আর একজন শের দৌলত খার নেতৃত্বে চাকমাদের আর একটি বিদ্রোহ ঘটিয়াছিল। ইহাকে হাচিন্সন দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ নামে অভিহিত করিয়াছেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেন।১৭
ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ভূমি অধিকারিগণের সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবরােধের ফলে চাকমাগণ কোন কোন সময় আপস করিলেও যতদিন পর্যন্ত এই অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা-প্রথা বলবৎ ছিল, ততদিন, অর্থাৎ ১৭৭৬ হইতে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চাকমা-বিদ্রোহ চলিয়াছিল।
বিদ্রোহ-কালে চাকমাগণ যে পদ্ধতিতে উন্নত অস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সহিত যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছিল। তাহা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। সেই যুদ্ধ ছিল একালের গেরিলা যুদ্ধেরই অনুরূপ ইংরেজ বাহিনী চাকমা অঞ্চলে প্রবেশ করিবামাত্র তাহারা সুম্মুখযুদ্ধে বাধা দিবার চেষ্টা না করিয়া স্ত্রীপুত্র ও অস্থায়ী সম্পত্তিসহ গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করিত এবং এইভাবে ইংরেজ বাহিনীকে গভীর পার্বত্য অঞ্চলে টানিয়া লইয়া যাইত।
ইংরেজ সৈন্যগন চাকমা গ্রাম, বাড়িঘর ক্ষেতের শস্য সমস্ত কিছু জ্বালাইয়া দিতে দিতে অগ্রসর হইত। এইরূপে বহুদূর অভ্যন্তর প্রবেশ করিয়াও যখন ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের সন্ধান পাইত না, তখন তাহারা ফিরিতে আরাম্ভ করিবামাত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণ আরাম্ভ হইত। চাকমাগণ বড় বড় গাছ কাটিয়া পার্বত্য পথগুলি বন্ধ করিয়া, পর্বত গহ্বরের মূখে ফাঁদ পাতিয়া ও পানীয় জল নষ্ট করিয়া দিয়া ইংরেজ বাহিনীকে অবরূদ্ধ করিয়া ফেলিত।
তাহার পর তাহারা গােপন স্থান হইতে বিষাক্ত তীর বৃষ্টি করিয়া দলে দলে ইংরেজ সৈন্য সংহার করিত। ১৭৭৬ হইতে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে পর এই চৌদ্দ বৎসৱে কত ইংরেজ সৈন্য ও ভারতীয় সিপাহী যে বিদ্রোহী চাকমাদের বিষাক্ত কী প্রাণ দিয়াছে, কত সৈন্য ফাঁদ-পাতা পর্বত গহ্বরে পড়িয়া এবং পানীয় জলের অভাবে পিপাসায় ছটফট করিয়া মরিয়াছে তাহার হিসাব নাই।
ইংরেজ শাসকগণ অন্ত্রের জোরে বিদ্রোহী চাকমাদের পরাজিত করিতে সক্ষম হয় নাই, পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে এবং অর্থনৈতিক অবরােধের ফলে, অর্থাৎ সমতল ভূমির হাট-বাজারে আসিয়া তুলার বদলে খাদ্য সংগ্রহ করিতে না পারিয়াই তাহারাশেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিল। কিন্তু এই অঞ্চল হইতে ইজারাদারের মারফত রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা যতদিন বর্তমান ছিল ততদিন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নাই। ইজারা- প্রথার অবসান করিয়াই ইংরেজগণ এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছিল।
চাকমাগণ বার বার বিদ্রোহ করিবার ফলে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়িয়া উঠে। তাহারা বুঝিতে পারে যে, তাহাদের এবং ইজারাদারদের অবাধ শােষণ ও বর্বরসুলভ উৎপীড়নই চাকমা-বিদ্রোহের কারণ এবং যতদিন এই ইজারা-প্রথার অবসান না হয় ততদিন চাকমাগণ শান্ত হইবে না।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্যকর্তা হ্যারিস সাহের সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করিয়া ‘রেভিনিউ বাের্ড’ -এর নিকট সুপারিশ করেন যে, ইজারাদারের হতে পার্বত্য অঞ্চলের কার্পাসের একচেটিয়া বাণিজ্য-ঈস্থথা রহিত করিয়া সরাসরি জুমিয়াদের বা দলপতির সহিত বন্দোবস্ত করা উচিত।
এই প্রস্তাব অনুসারে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ শাসকগণ স্থির করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইজারা-প্রথা রহিত করা হয় কার্পাস কর তুলিয়া দিয়া জুমিয়াদের বা চাকমা সর্দারগণের সহিত পরিমিত জমা (টাকা) ধার্য করা হইবে।
ইহা ব্যতীত আশ্বাস দেওয়া হইল যে, এই কর নিয়মিতভাবে কালেক্টরের নিকট জমা দিলে উহা আর বৃদ্ধি করা হইবে না হবে না’ ১৮ কিন্তু শাসকগণ এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই।এই জমা দিলে উহা আর বৃদ্ধি করা হইবে না’১৮ কিন্তু শাসকগণ এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই। এই সময় আরও স্থির করা হইয়াছিল যে, চাকমাদের নিকট হইতে করস্বরূপ তুলা আদায় করিবার নিমিত্ত সরকারের পক্ষ হইতে একজন কর্মচারী নিযুক্ত করা হইবে।
এই কর্মচারীই কর বাবদ দেয় সমস্ত তুলা আদায় করিয়া পরে তাহা নিলামে বিক্রয় করিবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা করা হইত না, সমুদয় তুলা ঢাকন্থিত কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে চালান দেওয়া হইত।১৯
রুনু খার সময় রাজস্ব হিসাবে ৫০১ মণ তুলা ধার্য হইয়াছিল। রুনু খাঁ মৃত্যুর পর ৫০১ মণ তুলার মূল্য আরও বর্ধিত করিয়া টা. ২২২৪/৪ পাই নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয়। পরে আপসের শর্তানুসারে চাকমা সর্দারগণই এই রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া কালেক্টরের অফিসে জমা দিত।
তথ্যনির্দেশঃ
১। Alexander Mackenzie: History of the North-East Frontier of Bengal, P. 332 ২। Chittagong Hills Tracts (District Gazetteer), P.8
৩। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা কুকি প্রভৃতি আদিম অধিবাসীদের বাসভূমিতে কার্পাস বা তুলা জন্মিত এবং তাহারা তুলা দ্বারা রাজস্ব দিত বলিয়া এই অঞ্চলটি “কার্পাস মহল”।
৪। সতীশচন্দ্র ঘােষ: চাকমা জাতি, পৃ. ১৩।
৫। Alexander Mackenzie: History of the North-East Frontier of Bengal, P. 332
৬। Ibid, P.331
৭। Halhed Commission of Chittagong (1829), P. 59.
৮। সতীশচন্দ্র ঘােষ: চাকমা জাতি, পৃ. ১০।
৯। Letter from the Collector of Chittagong to the Governor-Gen Dated 10th, April, 1777 (Quoted from T.H. Lewine’s The Hill Tracts of Chittagong, P. 64).
১০। Capt. T. H. Lewine: The Hill Tracts of Chittagong, P.64.
১১। Sir Henry Cotton: Reveme History of Chittagong, P.73.
১২। Capt. T. H. Lewine: The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers therein, P.21.
১৩। i Sir Henry Cotton: Revenue History of Chittagong, p.74.
১৪। সতীশচন্দ্র ঘােষ: চাকমা জাতি, পৃ.৭৫।
১৫। Sir Henry Cotton: Ibid, P.64.
১৬। সতীশচন্দ্র ঘােষ: চাকমা জাতি, পৃ.১০।
১৭। R. H. S Hutchinson: An Account of the Chittagong Hill Tracts, P. 122,
১৮। Sir Henry Cotton: Ibid, P, 81.
১৯। A Letter of the Board Quoted in সতীশচন্দ্র ঘােষ প্রণীত চাকমা জাতি, পৃ. । ৮১
সংগ্রহ:
১) ভারতে কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম – র্যাডিক্যাল কলকাতা – সুপ্রকাশ রায়।
২) বাংলাদেশের নিম্নবর্গ, দ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরােধ (১৭৬৩-১৯৫০)কথাপ্রকাশ – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত।
তুলা-করের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির বিদ্রোহ
– সালেক খােকন
বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমা, কুর্কি প্রভৃতি আদিবাসীদের বাস। এই পার্বত্য আদিবাসীদের প্রকতির সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করে জীবনযাপন করে আসছিল, যা তাদের দুর্ধর্ষ করে তােলে।
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলটিতে প্রথমে বসবাস ছিল কুকিদের। এক সময় চাকমারা কুকিদের আরও উত্তর-পূর্ব দিকে সরিয়ে দিয়ে আরাকান দখলে নেয়। কিন্তু ব্রক্ষযুদ্ধের (১৮২৪-৫২) মগেরা এসে চাকমাদেরই বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম অংশ দখল করে। তখন চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
এরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ‘জুম’ চাষ করত। এ আদি নিয়মে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে গ্রামের সমস্ত লােক কোনাে একটি সুবিধাজনক স্থানে বসতি গড়ত। অতঃপর প্রতেকে সকল লােক জঙ্গল কেটে চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জমি আবাদ করত।
ফসল পাকলে তা বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা ‘জুম’ বা দলবেধে সারা রাত জমি পাহারা দিত। দুই বৎসর চাষের ফলেই জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এভাবে যখন গ্রামের চারপাশের সব উর্বর জমি চাষ করা শেষ হয়ে যেত তখন তারা অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করত। এই তালি প্রায় চাষের ফলে কোনাে জমির ওপরই জুমিয়াদের স্থায়ী স্বত্ব তৈরি হতাে না। ফলে ওই সকল জমির রাজত্ব নির্ধারণেরও কোনাে উপায় ছিল না।
এভাবে জুমের মাধ্যমে দুর্গম পাহাড়ে অনুর্বর পার্বত্য জমিতে চাকমারা কাপাস বা তুলা চাষ করত। অতঃপর সে তুলা সমতলে নিয়ে এসে তার বিনিময়ে সংগ্রহ করত প্রয়ােজনীয় চাল, লবণ ও অন্যান্য জিনিস। এছাড়া ওইসময়ে উৎপাদিত শস্যের একটি সামান্য অংশ তারা মােগল সম্রাটকে কর হিসেবে প্রদান করত। এভাবে মােগল আমলেও চাকমারা প্রায় স্বাধীনভাবেই বসবাস করেছিল।
কিন্তু এই অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকমাদের স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হতে থাকে। এক সময় অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মতাে তাদের উপর ও ইংরেজদের শােষণ আর অত্যাচার নেমে আসে।
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। এক চুক্তি দ্বারা ইংরেজদের ‘ইস্টর ইন্ডিয়া কোম্পানি’ মীরকাসিমের কাছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি দান দান করে এবং প্রতিদান হিসেবে বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। এর ফলে চাকমাদের পার্বত্য অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যটির ইংরেজ বণিকদের হাতে চলে যায়।
বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির লেখা তথ্যমতে, চট্টগ্রাম অঞ্চশেই তারা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি; বরং সে সময় ব্রিটিশরা মাত্র দুইজন পাহাড়িয়া দলপতির সন্ধান পেয়েছিল। এদের একজন ‘ফ্রু’ নামক আদিম জাতির নায়ক আর অপরজন চাকমা জাতির নায়ক। এই দলপতিরা প্রথমে ব্রিটিশ শাসকদের কার্পাস বা তুলা কর হিসেবে দিত।
কিন্তু তার পরিমাণ নির্দিষ্ট ছিল না। একেক বত্সরে করের পরিমাণ একেক রূপ থাকত। ফলে ইংরেজরা অধিক কর আদায়ের উপায় হিসেবে ওই সময় ফড়িয়া নায়ক এক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটায়।
ফড়িয়ারা ইংরেজদের কাছ থেকে ওই অঞ্চলের কার্পাস বা তুলা-কর আদায়ের ইজারা নেয়। নিদিষ্ট পরিমাণ তুলা কর হিসেবে আদায়ের কথা তাকলে ও ফড়িয়ারা নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে নির্ধারিত পরিমাণ থেকে কয়েকগুণ বেশি তুলা চাকমাদের কাছ থেকে আদায় করে।
অতঃপর কর হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ইংরেজ শাসকদের হাতে তুলে দিয়ে বাকিটা নিজেরা আত্মসাৎ করতে থাকে। ওই তুলা বাজারে বিক্রি করেও তারা প্রচুর মুনাফা লাভ করত। ফড়িয়াদের এই কাজে ইংরেজদেরও সম্মতি ছিল।
আবার ইংরেজ শাসকগণ রাজস্ব হিসেবে যে পেত তা বিক্রি করে তা মুদ্রায় পরিণত করত। এর জন্য তারা চুক্তি করত অন্য কোনাে ব্যক্তির সঙ্গে। চুক্তিতে মুদ্রায় পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকত।
ফলে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি ইংরেজ শাসকদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ্রা জমা দিয়ে তুলা হতে ফটকাবাজির মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা হাতিয়ে নিতে থাকে। এ ব্যবস্থার ফলে চাকমাদের কর হিসেবে তুলা প্রদানের পর যে তুলা তাদের কাছে অবশিষ্ট থাকত তাও তারা বাজারে ফটকাবাজদের নিকট নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হতাে। এতে ধীরে ধীরে চাকমাদের উৎপাদিত তুলা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এছাড়া বিনিময় প্রথায় সহজ-সরল চাকমা আদিবাসীরা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমান ওজনের দ্রব্য গ্রহণ করত। এটা ছিল তাদের আদি রেওয়াজ। কিন্তু এ সুযােগটি নেয় তুলা ব্যবসায়ী, ফটকাবাজ ও ইজারাদারেরা।
তারা চাকমাদের আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলার বিনিময়ে দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণ প্রদান করে। ফলে একটি বা দুটি জিনিস নিলেই চাকমাদের সকল তুলা শেষ হয়ে যেত। এভাবে পরিবারে নেমে আসে অভাব। নানা শােষণ ও নিপীড়নে তাদের জীবন কাঠে অনাহার ও অর্ধাহারে। এক সময় বেচে থাকার তাগিদেই নতুন জীবনের স্বপ্নে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে চাকমা আদিবাসীরা।
প্রথম বিদ্রোহের তথ্য পাওয়া যায় চট্টগ্রামের তকালীন কালেষ্টর কর্তৃক গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে লেখা একটি সরকারি পত্র থেকে। পত্রটি ইংরেজ শাসকদের অনুগত কালেষ্টরদের নিজের মতাে করে লেখা হলেও সেটিতে বিদ্রোহের বিষয়টি স্পষ্ট।
কালেষ্টর সেখানে লিখেছেন- “রামু খাঁ নামক এক পাহাড়িয়া তুলা চাষের জন্য কোম্পানিকে সামান্য রাজস্ব দেয়। আমরা ওই স্থানে আসার পর থেকে ইজারাদারগণের দুর্ব্যবহারের জন্যই হােক, অথবা তার বিদ্রোহী চরিত্রের জন্যই হােক, রুনু খাঁ কছেশ মাস কোম্পানির ইজারাদারগণের সঙ্গে ভীষণ দাঙ্গা হাঙ্গামা চালাচ্ছে। রুনু খাকে বন্দি করার জন্য বিশেষ চেষ্টা চলছে।”
কিন্তু কালেক্টরের এই চেষ্টা সফল হয়নি। পরবর্তী কালে ওই অঞ্চলের শাসনকর্তারূপে দায়িত্বপালন করেন আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি , ক্যাপ্টেন টি, এইচ লুইন ও এইচ এস হ্যাচিলন প্রভৃতি উচ্চ পদস্ত ইংরেজগণ। চাকমাদের সম্পর্কে তারা বহু তথ্য উদঘাটন করেন। কলেটন লটন এর বিবরণটিতে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে সত্য তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
লুইন তার ‘দা হিলট্র্যাকশ অৰ চিটাগাং’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য ভাগে চাকমাগণ প্রথম বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা দলপতি রাজা শের দৌলত ও তার সেনাপতি রনু খাঁ। তারা উভয়েই পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন। রুনু খাঁ ছিলেন সকলের নিকট সেনাপতি হিসেবে অধিক পরিচিত।
চাকমাদের ওপর ছিল তার অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি। ইংরেজ শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত ইজারাদারগণের শােষণ উৎপীড়ন সহেরে ৫ অতিক্রম করলে রুনু ও শের দৌলত চাকমা জাতির সকল লােকদের ঐক্যবদ্ধ করে।
অতঃপর ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসনের সকল অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়। প্রথমে তারা তুলা কর দেওয়া বন্ধ করে এবং ইজারাদারদের তুলার গােলা লুট করে। রুনু খাঁর নেতৃত্বে এ সময় চাকমারা ইজারাদারদের বড় বড় তুলার ঘাটিগুলাে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন স্থানের বড় বড় গােলা লুট করে সমস্ত তুলা নিয়ে যায় তারা। ফলে ইংরেজদের অনুগত ইজারাদারদের বহু কর্মচারী এ সময় চাকমাদের হাতে মারা পড়ে।’
বিদ্রোহের ঘটনা জানার পর ইংরেজ শাসকগণ ওই অঞ্চলে সামরিক অফিসারসহ একদল সেনা পাঠায়। চাকমারা তখন তির-ধনুক ও বর্শা নিয়ে গেরিলা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ইংরেজ সেনাদল যখন আক্রমণ করতে আসত তারা তখন গভীর পার্বত্য অহচলে লুকিয়ে থাকত। আর সুযােগ বুঝে সমতলে নেমে এসে ইজারাদারদের ঘাটিগুলােতে আক্রমণ চালিছেন সরে পড়ত। এ রকম গেরিলা আক্রমণের ফলে বহুদিন সেনারা তাদের কোনাে নাগাল পায়নি।
ইংরেজ শাসকগণ তখন নতুন কৌশল আটে। তারা জানত তুলার বিনিময়ে চাল লবণ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পাহাড় থেকে সমতলের বিভিন্ন বাজারে সেনাদের পাহারা বসায়। ফলে বহুদিন চাকমারা সমতলে আসতে পারে না।
কিন্তু খাদ্য ও লবণ ছাড়া তাদের বেশিদিন লুকিয়ে থাকার সম্ভব ছিল না। ফলে এক সময় তারা ইংরেজদের এই কৌশলের কাছে ধরা দেয়। চাকমারা তখন বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। রুনু খাঁ বৎসরে ৫০১ মণ তুলা ইংরেজ শাসকগণকে কর হিসেবে দিতে রাজি হয়।
এভাবেই চাকমাদের প্রথম বিদ্রোহের অবসান ঘটে। পুরােপুরি বিজয় না ঘটলে ও এই প্রথম চাকমা বিদ্রোহ এবং তার প্রধান নায়ক রুনু খাঁর নাম এখনও চাকমারা গর্বের সাথে স্মরণ করে।
প্রথম বিদ্রোহের পর ইজারাদাররা আগের মতােই চাকমাদের ওপর অত্যাচার ও শােষণ একে ফলে অল্প কয়েক বত্সর বিরতি দিয়ে তারা আবারও বিদ্রোহের ডাক দেয়।
১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা দলপতি শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর চাকমাদের দলপতি বা রাজা হন করে পত্র জানবক্স খাঁ। তিনি দলপতি হয়েই চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারগণের প্রবেশ বন্ধ করে তে ১৭৮৩ হতে ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত কোনাে ইজারাদারগণের প্রবেশ করতে বা রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। ইংরেজরা এবারও আগের মতােই অর্থনৈতিক অবরােধ করে জানবক্স খাঁ’র বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু ওই তিন বৎসরের কর তারা মওকুফ করতে বাধ্য হয়।
জনবক্স খাঁ’র সময়ের বিদ্রোহ ও এর কারণ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন লুইন লিখেছেন-‘ইজারাদার গণ এই উপজাতির উপর বীষণ অত্যাচার করতে। ফলে বহু চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অলে পলিয়ে গিয়েছিল। চাকমাগণ জানবক্স খাঁ’ এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। কিন্তু স্থানীয় শাসকগণ পূর্বে মতােই অর্থনৈতিক অবরােধের মাধ্যমে তাদের বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হয়।’
এই বিদ্রোহের সময়েও ইংরেজ বাহিনী চাকমাদের দমন করতে পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করে। কিন্তু জানবক্স ও সকল চাকমা গহিন পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে থেকে অভিযান ব্যর্থ করে দেয়। জনক খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা আবার বিদ্রোহ করে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ওই বিদ্রোহটি কয়েক বছর চলে। অতঃপর ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে একই কারণে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন।
আবার হাচিন্সনের লেখা বিবরণ থেকে দেখা যায়, ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দেই আরেক জন শের দৌলত খাঁর নেতৃত্বে চাকমারা আরেকটি বিদ্রোহ ঘটায়, যা দ্বিতীয় খর বশ্যতা স্বীকার করে ইংরেজদের কাছে।
ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয়দের অর্থনৈতিক অবরােধের ফলে বিদ্রোহী চাকমারা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সময়ে আপস করলেও যতদিন ওই অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের ইজারাপ্রথা চালু ছিল, ততদিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৭৬ হতে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তারা বিদ্রোহ অব্যাহত রেখেছিল।
বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সেনারা চাকমা গ্রাম গুলােতে যখন প্রবেশ করত তখন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে গভীর পার্বত্য জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত। এটা ছিল সেনাদের জঙ্গলে নেওয়ার একটি কৌশল। সেনারা চাকমাদের কাউকে না পেয়ে বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে, তাদের খুঁজতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করত।
কিন্তু তাদের না পেয়ে জঙ্গল থেকে ফেরার পথেই চাকমারা বড় গাছ, ভারী পাথর ফেলে ফাঁদ পেতে সেনাদের অবরুদ্ধ করে, চারদিক থেকে তিন মেরে হত্যা করত।
ইংরেজ শাসকগণ অস্ত্রের জোরে বিদ্রোহী চাকমাদের কখনও পরাজিত করতে পারেনি। পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাব থাকায় সমতলে এসে খাদ্য ও লবণ সংগ্রহ এবং অর্থনৈতিক অবরােধের জন্যই তারা ইংরেজদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
চাকমাদের বিদ্রোহ ও সংগ্রামে কেটে যায় দীর্ঘ চৌদ্দ বছর। এক সময় ইংরেজ শাসকদের টনকনড়ে। তারা বুঝতে পারে, পার্বত্য অঞ্চলে ইজারাদারদের অত্যাচার, শােষণ ও বর্বরসুলভ উপীড়নই চাকমা বিদ্রোহের কারণ। তাই এই ইজারাপ্রথা চালু থাকলে চাকমাদের বিদ্রোহ চলবেই।
১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্যকর্তা হ্যারিস সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে রেভিনিউ বাের্ড এর কাছে একটিন সুপারিশালা প্রেরণ করেন। তাতে প্রধান বিষয় ছিল-ইজারাদারদের হাতে থাকা পার্বত্য অঞ্চলের কার্পাস বা তলার একচেটিয়া বাণিজ্যপ্রথা তুলে দিয়ে জুমিয়াদের বা চাকমা দলপতির সঙ্গে বন্দোবস্ত বা চুক্তি করা।
হ্যারিসের সুপারিশ ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ শাসকগণ পার্বত্য। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইজারাপ্রথা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর তুলা-কর একই রেখে তা সরাসরি চাকমা দলপতির মাধ্যমে সংগ্রহের ঘােষণা দেওয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকগণ সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। সে সময় আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, চাকমাদের নিকট থেকে করস্বরূপ তুলা আদায় করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একজন কর্মচারী নিযুক্ত করা হবে। ওই কর্মচারী করবাবদ প্রাপ্ত সমস্ত তুলা আদায় করে তা নিলামে বিক্রি করবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা না করে সমস্ত তুলা ইংরেজরা ঢাকাস্থ কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দিতে থাকে।
১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলের গণআন্দোলন গুলির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর চাকমা আদিবাসীরা ইংরেজ সেনাদের ওপর যে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাহসের ভিত ভেঙে দিয়েছিল তা ছিল ইতিহাসে বিরল ঘটনা। চাকমাদের এ লড়াই-সংগ্রামই পরবর্তীতে অন্যান্য বিদ্রোহীদের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
সংগ্রহ: বিদ্রোহ সংগ্রামের আদিবাসী কথা প্রকাশন – সালেক খােকন
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম
– নিরঞ্জন চাকমা
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুন পলাশীর রনক্ষেত্রে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার সাথে প্রতারনামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। তারা কিন্তু ২০বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম চাকমাদের দ্বারা ভীষন যুদ্ধের সম্মুখীন হয়।
বলা যায় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে এটাই হল আদিবাসী সকলের স্বাধীনতা রক্ষার প্রথম উদাহরণ (তজিম) এবং দীর্ঘস্থায়ী ধরণের যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ চলে দফা দফা (তপপে তপপে) করে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও চাকমাদেরকে হাতিয়ার দিয়ে পরাজিত করা যায়নি।
পরে ভীষন কুচক্রী ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক অবরােধ করলে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারা ব্রিটিশের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। অবশ্য এই মাথা নত করার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকেদিন ধরে চাকমার মধ্যে প্রশাসন স্থায়ী ছিল। পরে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ‘Act XXII of ১৮৬০’ আইনের দ্বারা ভিন্ন “পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা” বানানাের সঙ্গে সঙ্গে চাকমারা সত্যিই ব্রিটিশ শাসনের অধীন (হানজামে) হয়ে যায়।
কিন্তু আফশােসের বিষয় হল যে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের এই দীর্ঘস্থায়ী এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা ভারত ইতিহাসে উল্লেখহীন অবস্থায় রয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের মতাে বিভিন্ন ধরনের বড় আদিবাসী সম্প্রদায় সাঁওতালদের প্রায় পৌণে এক শত বর (১৭৮৪ থেকে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত) দীর্ঘস্থায়ী ভীষন সংগ্রামের কথা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মিথ্যাচারী (ভন্দেইয়্যা) ভারত-ইতিহাসে দীর্ঘকাল যাবত বিবেচনা এবং গুরুত্ব পায়নি।
তাই স্বনামধন্য সাঁওতালী পন্ডিত ও গবেষক শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ বাস্কে নানু তার ব্যাপক প্রচারিত এবং পাঠক সমাদৃত (লােবিয়ত পেইয়্যা) “সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস” নামক বইয়ের ভূমিকায় (আরকানিত) আফশােস করে লিখেছেন: ইতিহাস লেখা হয় সমাজের, দেশের ঘটনা আর কাহিনী। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে ভিন্ন রকম দৃষ্ট হয়।
ঐতিহাসিকরা লিখে গেছেন রাজা বাদশাদের, বড়লােকদের কাহিনী। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত সব জাতি অনুন্নত জাতি বলে (লেপোচ্যা জাত) চিনতে পারছে, তাদের কথা তারা লেখে নাই। বীরের মতাে যে জাত দেশের জন্যে প্রাণ দিল বিদেশী শাসন উৎখাত করার জন্যে তীর-ধনুক, বর্শা, কিরিচ (টাঙ্গি-ধাম) সম্বল করে কামান বন্দুকে সুসজ্জিত (নাজপুরাে) দক্ষ ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করলাে, তাদের কথা লেখা হল “অশিক্ষিত (আন্ধান্যা) জাতির বিদ্রোহ” নতুবা স্থানীয় হাঙ্গামা বলে।
সত্য কথা বলতে কি, স্বনামধন্য জাতীয় ঐতিহাসিকদের রচনায় আদিবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। অবশ্য বর্তমান কালে সমগ্র ভারত কৃষক সভার পশ্চিমবঙ্গ আর তৎসঙ্গে (তক্ষিনায়) সাওতাল কৃষকদের বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উৎসব পালনের দ্বারা এবং স্বনামধন্যা লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর চৌমুখী কাজকর্মের ফলে সাঁওতালী বীর শহীদদের অতুল অবদানের কথার ইতিহাস যথাযথ স্বীকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চাকমা আদিবাসীদের সংগ্রামের কথা এখনও ঐতিহাসিকদের কাছে (নিত্তাগে) হেলাফেলার বিষয় অথবা প্রায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অবহেলিত চাকমা আদিবাসীদের এ অতুল স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা আমরা কিন্তু শুধু জানতে পারি শ্রী সুপ্রকাশ রায়ের লেখা “বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রাম” নামের বই থেকে ।
এই বইয়ে লেখক ব্রিটিশ রাজ কর্মচারীদের কতগুলি বই, প্রশাসনিক বিবরণ, চিঠিপত্র দলিলনামা এবং চাকমা ইতিহাসের মতাে রচনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ উদ্দেশ্যে (পয়দানে) বিশেষ গুরুত্ব সহকারেও আলােকপাত করেছেন। এছাড়াও, এখন শুধু ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বদৌলতে (তক্ষিনায়) “লেখক সমাবেশ” নামক এক লিটল ম্যাগাজিনে খন্ড খন্ড (তপ্পে তপ্পে) করে প্রকাশিত রচনায়ও এ ব্যাপারে (পয়দানে) একটু-আধটু পর্যালােচনা (তেম্মাং) করেছেন।
ইহা ছাড়াও দেশি-বিদেশি কোন বড় বইয়ে এ বিষয়ে (পয়দানে) কদাচিৎ (হদাংশিক) উল্লেখ আছে বলে আমার জানা নেই। যাই হােক, চাকমা আদিবাসীদের বিদ্রোহ অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে (পয়দানে) শ্রী রায় তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন: “১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ খিষ্টাব্দে পর্যন্ত এই চৌদ্দ বছর কত ইংরেজ সৈন্য এবং ভারতীয় সিপাহী যে বিদ্রোহী চাকমাদের বিষাক্ত তীরে প্রাণ দান, কত সৈন্য ফাঁদপাতা পর্বতের গর্তে পড়ে আর পানির তৃষ্ণায় ছটপট করে মরে গেছে তার হিসেব নেই।
ইংরেজ শাসকরা হাতিয়ার বলে বিদ্রোহী চাকমাদের পরাজিত করতে পারেনি। পাহাড় এলাকায় খাদ্যের অভাবে এবং অর্থনৈতিক অবরােধের ফলে অর্থাৎ সমতলে হাট বাজারে গিয়ে তুলাের বদলে খাদ্য সংগ্রহ করতে না পেরে তারা শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।(পৃ: ৮৫) ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন স্থায়ীত্বের আগের সময়ে সংঘটিত চাকমাদের এধরণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা ভারত ইতিহাসে কেন এখনও পর্যন্ত জায়গা পেলনা সেটার রহস্য (মুরভিদি) কারণ আমার জানা নেই।
তিনি কিন্তু মােটামুটি (আরকানিত) পৰ্যালােচনা/আলােচনা করেছেন যে, গােটা ভারত। আদিবাসী গুষ্ঠির মধ্যে চাকমারাই সর্ব প্রথমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উল্লেখযােগ্য (তজিম) এবং দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে সম্মুখীন হয়েছিল। এখন আলােচনার (তেম্মাঙর) আসল (আরাং) বিষয়ে এগিয়ে যাবার আগে আমি সৈজন্যে এই কথাগুলাের সত্যিকার উদ্দেশ্যে (পইদানে) ভালভাবে যাচাই করতে পারি।
অনেক পূর্বে দুইটি মাত্র আদিবাসী বিদ্রোহের কথা ব্রিটিশের নথিপত্রে উল্লেখিত আছে। সেইগুলি হচ্ছে: ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল এলাকায় সংঘটিত সাওতাল বিদ্রোহ এবং ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্ট কাছে এলাকায় জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ। প্রথম সাওতাল বিদ্রোহটি তেমন উল্লেখযােগ্য ছিলনা। এই বিদ্রোহ ঘটনায় ব্রিটিশের সঙ্গে রাজমহল এলাকার সাওতালদের শুধু ছােটখাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
স্বাভাবিক ভাবে এ ঘটনায় উপরে তেমন গুরুত্ব পড়েনা। হলের সেজন্যে সুপন্ডিত ধীরেন্দ্রনাথ বাঙ্কে নানু তার “সাওতাল গণ-সংগ্রাম ইতিহাস” নামের বইয়ে এ ঘটনার কথা একটু করে আলােচনা করলেও বইয়ের শেষদিকে যুক্ত সাওতাল বিদ্রোহের ঘটনাপঞ্জীতে (ঘটনা-তালিক) এ ঘটনার লক্ষ্যে (পইদানে) কথাচিত (হদাংশিক) উল্লেখ করেননি। তিনি ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ভাগলপুর এবং রাজমহলে অনেক এলাকা জুড়ে তিলকা মুর্মুর নেতৃত্বে সংঘটিত ঘটনাকেই “প্রথম সশস্ত্র” সাওতাল বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন।
অপর দিকে, ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ বিষয়ে (পইদানে) বিটিশ প্রশাসন আলেকজান্ডার মেকেঞ্জী তার ‘দা নর্থ ইষ্ট ফ্রন্তিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে কোন এক ব্রিটিশ লেখক তখন প্রশাসক “পেম্বাটন” এর তথ্য তুলে ধওে বলেছেন: দই ১৭৭৪, Jynteeah is said to have been attacked by a force under Major Henniker, but of the causes which led to this step there appears to be no records in the archives of Government সেজন্যে (সিয়ানে) এটাও লিখেছেন, এটা একটা আলাদা ঘটনা, যা উজ্জ্বলভাবে (পােত পােত্যা গরি) কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
সেজন্যে এটা নির্দিষ্ট ভাবে (থায়থিক গরি) বলতে পারা যায় য়ে, সমগ্র ভারতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে চাকমাদের সঙ্গে ব্রিটিশের প্রথম উল্লেখযােগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী (দিঘােল বাত্যা) সংগ্রাম ঘটেছিল।
ব্রিটিশের সঙ্গে চাকমাদের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক বিশেষ (হাভাল) লক্ষ্যে (পৃইদানে) আমাদের ধারণা নেওয়া দরকার। ১৫ শতাব্দীর সময়ে চাকমারা এখনকার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব-দক্ষিণে আলীকদম এবং টেকনাফ এলাকা অর্থাৎ আরাকানের সীমান্তবর্তী (ধুজিঘাজি) বসতি করেছিল।
এর আগে তাদের বসতি থাকলেও তা ছিল উচ্চ বার্মার এলাকায়। আরাকান সীমান্ত এলাকায় বসতির সময় আরাকানিদের আক্রমণ থেকে বাচার জন্যে তারা চট্টগ্রামের মুগল শাসকদের ঘনিষ্ট হন। আর এই ঘনিষ্টতার চিহ্ননিমুনা স্বরূপ (নিঝেনি মজিম) চাকমা রাজারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও মুসলিমদের সঙ্গে নিজের নাম এবং রাজ উপাধি গ্রহণ করেছিল। আস্তে আস্তে করে চাকমারা পরে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
আর ব্যবসা বানিজ্যের জন্যে চট্টগ্রামের মুল শাসকদের সাথে তদপবাবে (ঘুনাজ-মনজি) মিশে যান। সেইসম্পর্কের সুত্র (সুদোনাল) ধরে ১৮শ শতাব্দীর অর্ধেকের (অদ্ধাঅদ্ধি) সময়ে চাকমা রাজারা চট্টগ্রামের মুগল শাসকদের কে নানা রকম নিত্য দরকারি জিনিষ পত্রাদি (দপ ভেলর) বদলে সমমান অনুযায়ী (অজনমাক্যা) সুতাে দেবার চুক্তি করে।
অস্ত্র দিকে মুসলমান বেপারিরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিতরে জুমব্যবসা করতে চায় না। মানে জুম ব্যবসার বদলে ব্যাপারিরা চাকমা রাজাদেরকে পরিমাণ অনুসারে/অনুযায়ী/মাফিক (অজন মুজিম) খাজনাকর দিতাে।
এদিকে পালাশী যুদ্ধের জয়ের শেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন (সেনে) ইংরেজদেরকে বাংলার নবাব মীর কাশিম থেকে ১৭৬০ সেপ্তেম্বর তারিখে চট্টগ্রামের জমিদারী নামা আদায় করে নেয়। সেই থেকে সবসময় (নিত্ত্যগে) চাকমাদের সাথে ব্রিটিশের কতবড় দ্বন্দ্ব (আরবানি)। অবশ্য চাকমারা আগের মতাে করে মুগলদেরকে দেয়ার মতাে ব্রিটিশকে সুতাে সরবরাহ করা শুরু করলাে। কিন্তু ব্রিটিশের সুতাের চাহিদা ছিল বেহাল (বেয়াল) আর সবসময় বাড়তিমুখী।
তারা ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের কাছে ফেনীনদীর মােহনায় জগদিয়া (Jugdia) নামক জাগায় গড়ে তুলেছিল প্রথম কাপড়ের কারখানা। শেষে তারা নােয়াখালীতেও গড়ে তুলেছিল একই রকমের কারখানা। ব্রিটিশরা চাকমা রাজাদের সুতাে দেবার চুক্তি/নিয়ম/রেওযাজটাকে (কামিনানরে) ট্যাক্স বলে মনে করতাে (মেহক গরতাক)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটা ছিল সুতাে ফলনের সবচেয়ে ভাল জায়গা ব্রিটিশ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সেটা ধরতে পেরেছিল। সেই থেকে ব্রিটিশ প্রশাসন ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেভাবে পারা যায় সুতাে সংগ্রহের দিকে মন দিল। চট্রামের তুলল্য ব্যাপরিরাও ব্রিটিশের সুতাের দিকে বিক্রির ধারা আছে বুঝে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের থেকে বােলচাল চালিয়ে (ভ-ভান্ধা গরি) সতো সংগ্রহের নামে উঠে পড়ে নেমে গেল।
শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ আসার আগের নিয়ম মাফিক (সদোয়া একেক সমতল এলাকার ব্যাপারিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাথে ব্যবসা বানিজ্য কত বদলে চাকমা রাজাদেরকে পরিমাণ মাফিক (অজনমাক্যা) খাজনা দেবার বাধ্যগত ছিল।
ব্রিটিশ এ এলাকায় রাজ ক্ষমতা নিয়ে পৌছার ফলে তারা চাকমা রাজাকে খাজনা দেয়া বন্ধ করে দিল। এভাবে আরম্ভ হয় সমতলের বাঙালীদের সাথে আদিবাসীদের লাগালাগি। অপর দিকে ব্রিটিশ কর্তারাও চাকমা রাজা থেকে বাড়তি পরিমাণ (অজনে) সুতাে খাজনা আদায়ের জন্যে চাপ দিতে শুরু করলাে। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সে সময়ের রাজা চাকমা শের দৌলত খাঁ ব্রিটিশকে সুতাে যােগান দেয়া বন্ধ করে দিল। আর ব্যাপারিদের থেকে নিয়ম মাফিক খাজনা/ট্যাক্স আদায়ের চাপ দিল।
ব্রিটিশের সঙ্গে চাকমাদের বিবাদ (কেজ্যা) ১৭৭৬ খ্রি. থেকে আরম্ভ হলেও উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথম যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ভাগ থেকে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিল কেপ্টেন লেন, চাকমা রাজাদের দৌলত খার পক্ষে সেনাপতি রনু খাঁ।
কর্ণফুলির (বড়গাঙর) টেকে “কিল্লামুড়া” নামক জায়গায় উভয়দলের (দ্ব্যদাঘির) ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদল হেরে যায়। দ্বিতীয়বার যুদ্ধটি ঘটে ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে। এবারে পরপর দুইবার যুদ্ধে ব্রিটিশের আধুনিক যুদ্ধ হাতিয়ারে সুসজ্জিত (ঝনঝন্যা) সৈন্যরা হেরে যায়। যুদ্ধ দুইটি হয় কর্ণফুলির কবাখালী আর বেদাগীনদীর দুই জায়গায়। দুই যুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে ক্যাপ্টেন টারমার আর চাকমারাজা শের দৌলত খার পক্ষে রনু খাঁ।
তারপরে চাকমা রাজা জান বক্স খা (১৭৮২-১৭৯২ খ্রি.) এর আমলে ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে জান বক্স খা ব্রিটিশের দাবী অগ্রাহ্য করার জন্যে মহাপ্রুমে একটা শক্তিশালী দুর্গ বানায়। আর ব্রিটিশের আক্রমণ ঠেকাবার পরিকল্পনা নিয়ে ইছামতী নদীর মােহনায় সৈন্যসহ সেনাপতি রনু খাঁকে, ধরং এলাকায় রনু খাঁকে, রাঙ্গামাটি এলাকায় নারান দেওয়ানকে আর নিজে সে মহাপ্রুম দুর্গে থেকে যুদ্ধের সুযােগ/সুবিধা (আড়ি) নিল।
তিনি তার সব সৈন্যদেরকে চারিভাগ করে চারি এলাকায় এমনভাবে সাজিয়ে রাখলেন যাতে ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমন করলে চারিদিক থেকে আগেভাগে আসা যায় এবং আক্রমন করা যায়। এই পরিকল্পনা অনুসারে তিনি ব্রিটিশদের সাথে ১৭৮৩, ১৭৮৪ আ ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পরপর তিনটি যুদ্ধ করে ছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ গুলাে ছিল স্থল পথের যুদ্ধ (মাদি হাদার যুদ্ধ)। প্রথম দুইটি যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যরা হরে যায়। তরে তৃতীয় যুদ্ধে ব্রিটিশ চরা নির্দিষ্ট ভাবে (থায়থিক) খবর নিয়ে তারা তার নিজের মহাপ্রুম দুগটিকে আক্রমন করে। এই আকস্মিক (অদংকরল) যুদ্ধে মহাম দুর্গটির পতন হলাে, জান বক্স খাঁ পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন।
জানবক্স খাঁ যুদ্ধে হরে গেলেও এতটুকু মনমরা হননি। তিনি নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ/সমাবেশ/ একত্রিত করে ব্রিটিশের ভীষন আক্রমন ঠেকাবার ব্যবস্থা নিলেন। কিন্তু এবারে ব্রিটিশরা ভিন্ন সুযােগ/ব্যবস্থা (আড়ি) নিলেন।
তারা পাহাড় পর্বত এলাকায় সামনাসামনি আক্রমনে না গিয়ে চট্টগ্রামের সমতল এলাকায় চাকমাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরােধ (আড়াল) গড়ে তুললাে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী সমতল জায়গায় সব বাজারগুলি বন্ধ করে দিল যাতে চাকমা বিদ্রোহীরা সেখান থেকে ধান চাল সহ নানা নিত্য তরকারি দ্রব্যাদি কিনতে না পারে।
এই অর্থনৈতিক অবরােধ দেয়ার ফলে শেষ মেশ চাকমা রাজা জানবক্স খাঁ প্রজাসকলের ভীষন অভাবের (নিদানর) কথা চিন্তা করে ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বশ্যতা স্বীকার করেন। তিনি নিজে কলকাতায় গিয়ে গভর্ণর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং- এর ক্ষমা চেয়ে ছিলেন। আর বছরে ৫০০মণ সতাে দেবার রাজী হয়ে আসেন।
কিন্তু জান বক্স খার আত্মসমর্পণের পরেও ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে আরেকবার চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁ নাম নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বলে। শ্রী সুপ্রকাশ রায় তার “ভারতের কৃষক বিদ্রোহ এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রাম” বইয়ে উল্লেখ করেছেন। R.H. Huchinson Chittagong Hill Tracts এর বই থেকে তিনি উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেছেন: এই দ্বিতীয় শের দৌলত খা ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বশ্যতা স্বীকার করেছেন। (পৃ: ৮৪)।
যাই হােক তিনি কিন্তু আরাকানিত উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারা ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পন করলেও ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তার ভিতরের নিজ শাসনের বিষয়ে (পইদানে) ব্রিটিশের হাত পড়েনি।
ব্রিটিশ চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা স্থীয়া হলে প্রথমে ভেবেছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা মূল চট্টগ্রামের অংশ। এ রকম ভাবার বড় কারণ হলাে: বানিজ্য দেয়া-নেয়ার উদ্দেশ্যে চাকমা মুগল শাসকদেরকে যে সুতাে খাজনা দিত, সেটাকে তারা মনে করেছিল অধীনতামূলক ট্যাক্স বলে।
এতে তারা যে দিক-ভ্রান্ত (দিক-কাবুলাে) হয়েছিলেন সেটা ঠাহর পাওয়া যায় ইদানিং কালে প্রকাশিত “Chittagong Hill Tracts Gazetteer” নামক বই থেকে। যেমন: Hallhead, Commissioner stated that the hill tribes were not British subject, hut merely tributaries and that he recognized no right to the British to interfere with their internal arrangement.
তাই ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বীরবুক দিয়ে (বির ভুগেদি) পরবর্তী সময়ে বার্মা অভিযান, কুকির বিরুদ্ধে অভিযান, আসাম মনিপুরের উপরে অধিকার বিস্তারের নানা রাজনৈতিক অভিষ্ট (এগেম) পূরণ করার জন্যে তারা চাকমাদেরকে ব্যবহার করবার। চেয়েছিল। বিজগে (নিত্যগে) চাকমারা বার্মা আর কুকি অভিযানে বিভিন্ন ভাবে ইংরেজদের সহযােগিতা দিয়েছিল।
সূত্র: ছদক প্রকাশনা – ত্রিপুরা রাজ্য ভারত।
চাকমা রাজ বীর সেনাপতি রনু খান
– প্রমোদ বিকাশ কার্বারী
বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমাদের সংগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটা ছিল চাকমাদের বৈধ সরকারের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব। ব্রিটিশদের কাছে এই যুদ্ধটা ছিল চাকমাদের রাজ্যের উপর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
ব্রিটিশরা অন্যায়ভাবে চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চল এবং সম্পদ গ্রাস করতে তাদের সাথে চাকমাদের সংঘাত শুরু হয়। চাকমাদের নেতাদের মধ্যে যারা ব্রিটিশ আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অত্যন্ত সাহসী, বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী সংগ্রাম নেতা ছিলেন রনু খাঁ দেওয়ান। তিনি ছিলেন চাকমাদের বীর সেনাপতি।
রনু খাঁন ছিলেন রাঙ্গুনিইয়ার দেওয়ান। তিনি চাকমা অভিজাতদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। তখন কার সময়ে শিকদারদের ছিল প্রাশাসনিক এবং বিচারিক দায়িত্ব। রনু খান ও ছিলেন একাধারে রাঙ্গুনিয়ার দেওয়ান ও শিকদার। দেওয়ান হিসেবে তিনি রাজস্ব সংগ্রহ করেন এবং শিকদার হিসেবে প্রশাসনিক কাজগুলি করেন।
চাকমা রাজ্যের সরকার এককেন্দ্রিয় সরকার নয়। তবে চাকমা রাজ্যের কোন আঞ্চলিক বিভাগ ছিল বলে কোন ধারনা পাওয়া যায়নি। তবে রুনু খাঁনের রাঙ্গুনিয়া অঞ্চল ছিল চাকমা রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক ইউনিট।
ব্রিটিশরা তাদের শাসিত চট্টগ্রাম জেলাকে নয়টি চাকলায় ভাগ করে এবং প্রত্যেক চাকলায় একজন চাকলাদার নিয়ােগ করে রাজস্ব আদায়ের জন্যে। তারা রাঙ্গুনিয়াকে তাদের নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম জেলার সাথে যুক্ত করে নেয়।
নগদ টাকা হিসাবে রাজস্ব আদায়ের জন্য রাঙ্গুনিয়ার একজন চাকলাদার নিযুক্ত করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে রাঙ্গুনিয়া থেকে চাকমা রাজার কর্তৃত্বের অবসান ঘটানাে এবং দখলকৃত জায়গায় ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা করা। ব্রিটিশ কালেক্টরের মতলব হচ্ছে দেওয়ান পদবী থেকে রনু খানকে শুধু বঞ্চিত করা নয়, তাকে তার অঞ্চল থেকে উৎকাতর করা।
রাঙ্গুনিয়াকে চাকমা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ অঞ্চলভুক্ত করার পলিসিটা চাকমাদের প্রশাসন কাজে পুরাে পুরি একটা রাজনৈতিক অনধিকার হস্তক্ষেপ। তাদের এই কাজটি বেআইনি, নীতি গর্হিত এবং যুক্তিহীন। এটা ন্যায়বিচার, ন্যায়কাজও নয়। তাদের অনিয়ন্ত্রণ এলাকায় একটা স্বেচ্ছাচার ব্যবস্থাপনা চালিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
১৭৭৩ সালে ৫০১ মন তুলা রনু খান সরবরাহ দেবে -এই শর্তে রনু খানের সাথে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসন একটা চুক্তি করে ছিল। কিন্তু বিটিশ সরকার এই চুক্তির প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করেনি বরং উল্টো রাঙ্গুনিয়ার উপর রাজস্ব/ভূমি কর বসিয়েছিল।
আইনের দৃষ্টিতে রনু খানের সাথে চুক্তিমতে কাজ করতে তারা বাধ্য, চুক্তি বাতিল করতে নয়। যদি ব্রিটিশ সরকার কোন চুক্তি করতে চায়, তাহলে তা রনু খানের সাথে করতে হবে, কারণ রুনু খা চাকমা সরকারের আইনি কর্মসম্পাদনকারী। কিন্তু বিটিশ সরকার চুক্তি আইনি-দিক তােয়াক্কা না করে রাঙ্গুনিয়াকে (চট্টগ্রামের সাথে) অন্তর্ভূক্ত করে নেয় এবং নিজস্ব ধাচের ব্যবস্থা অঞ্চলটির উপর চাপিয়ে দেয়।
যেখানে রাজস্ব সংগ্রহ দেওয়ান রনু খান করে যাচ্ছেন সেই রাঙ্গুনিয়ায় একটা চাকলাদার নিয়োগ করার ক্ষমতা চট্টগ্রামের কালেক্টরকে দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে রনু খানের সাথে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটা কাজের চুক্তিতে আসতে বাধ্য ছিল। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে কালেক্টর রনু খানের সাথে কার্পাস মহল চুক্তি পাত্তা না দিয়ে তারা চাকলাদারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এটা স্পষ্ট বন্ধুত্ব ও আস্থার লংঘন।
ব্রিটিশদের রাঙ্গুনিয়া দখলকরনে চাকমাদের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। কারণ রাঙ্গুনিয়ার চার ভাগের তিন ভাগ ছিল সমতল যা উর্বর বলে প্রচুর শস্যাদির ফলন হতাে। ব্রিটিশদের আক্রমনের ভয়ে রাঙ্গুনিয়ায় বসবাসকারী চাকমারা রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে পাহাড়ে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
চাকমা পরিত্যক্ত জায়গাগুলি খাস ঘোষনা করা হয় এবং সমতলের বাঙ্গালীদের সেখানে বসতিস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। সমতলের জমিদারদের উৎসাহিত করা হয় রাউজানের জমিগুলি দখল করার জন্যে। চাকমা পরিত্যক্ত সমগ্র এলাকা সমতল চট্টগ্রামের জমিদারদেরকে খন্ড খন্ড করে ভাগ করে দেয়া হয়।
কৃষক (প্রজা) জমাবন্ধী প্রজাদের কে বিনা খাজনায় চাষ করতে দেয়া হয়। নির্দিষ্ট জমাবন্ধী প্রজাদেরকে পাট্টা মঞ্জুর করাতে নতুন বসতিকারীরা তাদেরকে প্রদত্ত জমিগুলির উপর একধরণের দখলীস্বত্ব অধিকার লাভ করে।
চাকমাদের উপর এই আগ্রাসী-জোর দখল নীতির ফলে চাকমা যােদ্ধারা গ্রুপ গ্রুপ করে সংগঠিত হয় এবং রাঙ্গুনিয়ার দখলকৃত এলাকায় অতির্কিত হামলা করা শুরু করে। তাদের লক্ষ্য হলাে ব্রিটিশ দখল বানচাল করে দেয়া এবং যারা ব্রিটিশদেরকে সাহায্য-সহযােগিতা করেছে সেই জমিদার ও কর্মচারীদের কে শাস্তি দেয়া।।
ব্রিটিশদের ধীর ধীর চাকমা অঞ্চল দখলীকরন চাকমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল দখলকৃত অঞ্চলগুলি থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করা। ব্রিটিশদের উদ্ধত কার্যকলাপ ব্রিটিশ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে উঠে। চাকমা রাজার সৈন্যবাহিনী না থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল সংখ্যক চাকমা স্বেচ্ছায় প্রতিরােধকারীদের সংগঠিত সংস্থায় যােগদান করে।
ব্রিটিশদের রাঙ্গুনিয়া দখল থেকে উৎখাত করার জন্য চাকমা ‘প্রতিরােধকারীরা’ রনু খানের নেতৃত্বে সংগ্রামের দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিরােধাত্বক এবং আক্রমনাত্বক। প্রতিরােধাত্বক মানে ব্রিটিশ দখলকৃত অঞ্চল সমূহে ব্রিটিশদের ব্যবসা-সম্পর্কিত সবকাজ বন্ধ করে দেওয়া এবং চাকমা রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ শােষনকে বাধা দেওয়া। আক্রমনাত্বক মানে দখলকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে শারিরীক শক্তি প্রয়ােগ করা এবং দখলকৃত এলাকার জমিদার ও কৃষক প্রজাদেরকে হুমকি/শাস্তি দেয়া ।।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা এবং অভিজাত সদস্যরা। রাজা শের দৌলত খান তার ছেলে জান বক্স খান, দেওয়ান রনু খান, কন্নো খান বুলব, চোরি এবং টুথেং ছিলেন প্রতিরােধ যুদ্ধেও নেতা। উল্লেখযােগ্য নেতা, ইত্যাদি। তাদের মধ্যে চাকমা রাজার নায়েব ও রাঙ্গুনিয়ার দেওয়ান রনু খান ছিলেন চাকমাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের আপোসহীন, বিচক্ষন, সাহসী বীর নায়ক-চাকমা সেনাপতি।।
রনু খান এবং অন্যান্য নেতাদের অধীনে যারা চাকরী নিয়েছিল চাকমা অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ শাসনকে নির্মূল করার জন্য তাদেরকে ‘পালােয়ান’ বলা হতাে। তারা শুধু রাঙ্গুনিয়া নয়, চাকমা অঞ্চলের অন্যান্য অংশেও সক্রিয় তৎপর ছিল।।
চাকমা প্রতিরােধ যােদ্ধারা (পালােয়ানরা) তীর ও ধনুক, বর্শা ও তলােয়ার, গাদা বন্ধুক ইত্যাদি আদিবাসী অস্ত্রশস্ত্রাদি দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। পূর্বে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত দুর্ধর্ষ উপজাতীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কিছু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লােকও তাদের মধ্যে ছিল। বস্তুতপক্ষে, তারা দখলদারী সৈন্যদেরকে বাধা দিয়ে হটিয়ে দেয়া এবং তাদের সহযােগীদেরকে আজ জন্য তারা গােপন অভিযান/হামলা চালাত।
ব্রিটিশ দখলকৃত রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে রনু খানের নেতৃত্বে প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসকদের তিনি শুধু যে পাত্তা দেন নি তা নয়, তার কর্তৃত্বমূলক আদেশ জারী করার অধিকারের কথাও তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন। হৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্যে পালােয়ান বাহিনীরা কতকগুলি পদ্ধতি অবলম্বন করে।
চাকমা পালােয়ানরা রাঙ্গুনিয়ার বাঙালী বসতিকারীদেরকে তাদের থেকে পাট্টা (লীজ) নিতে বাধ্য করতাে তারা যদি সেখানে থাকতে চায়। তাদেরকে (বাঙালী) কবলা দিতে এবং তাদের থেকে পাট্টা নিতে পালােয়ানরা তাগাদা দিত। তারা ব্রিটিশ পাট্টা বে-আইনি ঘােষনা করে নিজেদের পাট্টাগুলাে প্রচলন/চালু করতাে। বাইরের থেকে কোন বাধা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা সম্পত্তি ভােগ করতে পারবে- এই নিশ্চয়তা পালােয়ানরা দিত।
পালােয়ানরা কৃষিজমির সীমানা নির্ধারন করে দিত এবং জমাবন্দী-জমিতে নিশানা/চিহ্ন বসিয়ে দিত যাতে বাইরের লােক প্রবেশ করতে না পারে। পালােয়ানরা চাকমা সরকারের পক্ষে কর/খাজনা তােলার অধিকার আছে এটা বলে দিত এবং বাস্তবেই নতুন বসতিকারীদের থেকে কর সংগ্রহ করতাে। তারা তাদের (তালুকদার এবং প্রজাদের) থেকে নজর ও সিধা (Nuzzers & Seedahs) জোরকরে আদায় করতাে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বনজ সম্পদে পরিপূর্ণ যা রাজার সম্পত্তি। সেখানে অনুমতি ছাড়া গাছ-বাঁশ কাটা, ঘাস-ছন, জ্বালানী-কাঠ বা যে কোন সামগ্রী আহরন কঠোর শাস্তিযােগ্য অপরাধ বলে পালােয়ানরা ঘােষনা করে এবং সতর্ক করে দেয়। রাঙ্গুনিয়ার কৃষকদের থেকে চাকমা সরকারকে খাদ্য শষ্য এবং উপঢোকন দেবার জন্য পালােয়ানরা দাবী করেছিল। যারা খাদ্যশষ্য সংগ্রহ করেছে এবং গােলায় মজুদ করেছে, তারা তাদের দাবী না মানলে মাঝে মাঝে পালােয়ানরা গােলা থেকে জোর পূর্বক খাদ্যশষ্য নিয়ে যেত।
পশুচারন ভূমির মালিক চাকমা সরকার। পশুচারন করলে পশুচারনের কর (গুরকেট মহল) দিতে হয়। রাঙ্গুনিয়ায় প্রচুর খিলা বা পতিত ভূমি রয়েছে পশুচারনের । পশুচারণের জন্য চাকমা কর্তৃপক্ষ থেকে নতুন বসতকারীদের ছিল পার্মিশন, আর তারা না দিত কর্তপক্ষকে কোন গুৱকেটি মহল । রনু খানের পালােয়ানরা খালি ভূমিতে গবাদি পশু না চরানোর জন্য সতর্ক করে দিত এবং সেখানে কোন জন্তু প্রবেশ করলে সেটাকে তাড়িয়ে দিত বা ধরে রাখত ।।
চাকমা যােদ্ধারা নতুন বসতিকারীদেরকে বেগার (জোরপূর্বক কাজে) খাটাতো । রনু খানের সহযােগীরা তাদের খামারবাড়ী ও ঘর মেরামত করতে বসবাসকারীদেরকে বাধ্য করত। চাকমা যােদ্ধাদের দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ বিরােধিতার কারণে আঠার শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়ার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রন/প্রশাসন কার্যকর ছিলনা।
রাঙ্গুনিয়াকে সংযুক্ত করণের পর থেকে রাঙ্গুনিয়ায় সর্বত্র অরাজকতা ও গােলমাল বিরাজমান ছিল । তথায় অফিসিয়েল কাজ করতে চাকলাদের যেতে পারেনি। ভূমির সত্বাধিকারী তার প্রাপ্ত ভূমিতে রাজস্ব সংগ্রহ করতে যেতে পারেনি। প্রজা বা কৃষক নিরাপদে জমি চাষ করতে পারেনি। কারণ রুনু খানের পালোয়ানরা বিভিন্ন রকম অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসে চাষের জমিতে যাদেরকে পেত তাদেরকে মারপিট করত, আহত করত, তাদেরকে উৎখাত করতাে, তাদের সম্পত্তি ফসলাদি লন্ডভন্ড করে দিত।
প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের দখলকৃত (রাঙ্গুনিয়া) অঞ্চলে কোন আইন-শৃংখলা ছিলনা । ১৭৭২-৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়া থেকে ব্রিটিশরা কোন রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারেনি । চাকমারা ঘােষনা করে দিয়েছিল চাকমা রাজ্যের কোন জিনিসের উপর কর বসানাের অধিকার ব্রিটিশদের নেই।
চাকমারা প্রকাশ্যে ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায়ের জন্য আদেশ সমূহ অমান্য করতো। রাজত্ব আদায় করতে না পেরে এবং আইন-শৃংখলা রক্ষা করতে না পেরে, রুনু খানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করে এবং পরোয়ানা পত্র দুজন পিয়নের মাধ্যমে পাঠায়। রুনু খান পারােয়ানা পত্রটি অবজ্ঞাভরে ছিড়ে ফেলেন এবং পিয়নদেরকে অপমানিত করেন।
১৭৭৭ সালে এপ্রিলে ৫০ জনের একটি সিপাহী দল রুনু খানের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ায় প্রেরিত হয়। দলটি প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় এবং তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়। পরে ১১৫ জনের একটি সিপাহী পাঠানাে হয় রনু খানের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ায় যুদ্ধ হয়।
বহুসংখ্যক কুকী রনু খানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। যার ফলে এবারও ব্রিটিশ অভিযান পুরাপুরি ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধে স্থানীয় বাঙালী ভূমি-মালিকরা রনু খানের প্রতি সহানুভূতি ছিল। তারা রনু খানকে যা প্রয়ােজন সেসৰ সরবরাহ করতাে। যদিও রনু খানকে রাঙ্গুনিয়া হেডকোয়ার্টার থেকে অন্যত্র সরে যেতে হয়েছিল, কিন্তু সমগ্র পার্বত্য অঞ্চল ছিল তার অপারেশনের ঘাটি ।
রনু খানকে গ্রেফতার করার জন্য ১৭৮১ সালের শেষের দিকে একটি সেনাদের পাঠানাে হয়। কিন্তু কার্যকর কোন ফল হয়নি। কারণ রনু খান দুর্গম অঞ্চলে দুর্ভেদ্য জায়গাগুলিতে থাকতেন। চাষী (রায়ন) দের পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের রক্ষার্থে সেনারা সেখানে অবস্থান নিলেও, রনু খানকে আত্মসমর্পন করানাে যায়নি।
তখনো রনু খানের অধীনে জমি/ভূমি গুলি থেকেই গিয়েছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের কে হয়রানী করার জন্য রনু খান পার্বত্যাঞ্চলে শক্রদের উপর অপারেশন চালানাের জন্য তার বাহিনীকে ছােট ছােট গ্রুপে বিভক্ত করেন।
তাকে ধরার জন্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য সর্বরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রনু খানের আস্তানা জানার জন্য গােয়েন্দা নিযুক্ত রাখে। তারা ত্রিপুরা রাজাকেও বলে দেয় যে রনু খান সেখানে থাকলে তাকে যেন বন্দী করে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।
তারা এক সেজুয়াল পাঠায় রাঙ্গুনিয়ায় রাজস্ব আদায়ের জন্য এবং তার প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে সেনাবাহিনীও রাখে। সেনাবাহিনী সেজুয়ালকে রক্ষা করতে পারে নাই। সে রনু খানের হাতে বন্দী হয়ে আটক থাকে।
রনু খানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী মােতায়েন করেও তাঁকে নতি স্বীকার করানাে যায়নি। বারবার চেষ্টা করেও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। রনু খানকে বন্দী করার আদেশ, বারংবার গ্রেপ্তারী পরােয়ানা বা কালেক্টরের কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। শিকদারকে (সেজুয়াল) ছেড়ে দেয়ার জন্যে হুমকি দিয়ে রনু খানের কাছে পত্র দেয়া হয়। রনু খাঁনও জানিয়ে দেন যে সিপাহীদের ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তিনিও শিকদারকে (সেজুয়াল) ছেড়ে দেবেন।
প্রথমত: চাকমা রাজ্যে যাতে চট্টগ্রাম থেকে কোন মালপত্র যেতে না পারে এজন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাহাড়ীদের চট্টগ্রামের বাজার-মার্কেটে প্রবেশ নিষেধ করে। এভাবে চাকমা অঞ্চলকে একঘরে করা, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা। দ্বিতীয়ত: নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে চাকমা যােদ্ধাদেরকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করা।
ব্রিটিশ সৈন্যরা চাকমা রাজ্যের গভীর অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালায়। প্রতিরােধকারীরা যাতে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারে এজন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে ব্রিটিশ সৈন্য মােতায়ন রাখে। এজন্য তারা গুরুত্ব পূর্ণ জায়গা গুলিতে ব্রিটিশ সৈন্য মােতায়ন রাখে। প্রতিরােধকারীরা ও ব্রিটিশ সৈন্যদের গতিপথ কাঠেরগুড়ি দিয়ে অবরােধ করে রাখে। নদীপথও তারা অবরােধ করে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
রাজা জান বক্স খান ব্রিটিশ আক্রমণ ঠেকাতে না পেরে তার হেড কোয়ার্টার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার রাজধানী ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে চলে যায়। চাকমা রাজধানীর আশেপাশে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে চাকমারা প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিল।
দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকমারা সর্বরকম কষ্ট স্বীকার করে ব্রিটিশ আক্রমণ প্রতিরােধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে চাকমাদের পেরে উঠার কোন কথাই উঠে না। চাকমাদের ছিল সাধারণ দেশীয় অস্ত্র আর ব্রিটিশদের ছিল আধুনিক অস্ত্র।
চাকমাদের সামরিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর ব্রিটিশদের সামরিক অপারেশনও শেষ হয়। সবদিকে চাকমা অঞ্চলের উপর ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রবল আক্রমণ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু সংখ্যক প্রতিরােধকারী আত্মসমর্পন করে। চাকমা পালােয়ানরা গভীর জঙ্গলের গােপন আশ্রয়ে চলে যায়। যদিও চাকমা প্রতিরােধ বিধ্বস্ত হয়েছিল, রাজা জান বক্স খানকে ইংরেজ কর্তৃত্ব স্বীকার করাতে পারেনি ইংরেজরা।
রাজা স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, পরিণতি যাই আসুক না কেন। তিনি গােপন আস্তানা থেকে প্রতিরােধকারী যােদ্ধাদের গােপনে নির্দেশ দিতেন। ব্রিটিশ সরকার চাকমা রাজসিংহাসন শূণ্য ঘােষনা করলেও সেখানে কোন রাজা বসায়নি।
ব্রিটিশ সরকার রাঙ্গুনিয়ার জমিগুলি বন্দোবস্তী দেবার ব্যবস্থা নিয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। চাকমারা এই বন্দোবস্তী প্রত্যাখান করেছিল এবং করও দেয়নি।
জান বক্স খানকে বশ্যতায় আনা। গেলেও তার সাথে কোন সুরাহা যায়নি। ব্রিটিশ সামরিক পদক্ষেপ আংশিক সফল হয়েছিল মাত্র। প্রতিরােধ সংগ্রামের নেতাদের কাউকে বন্দী করা যায়নি। ব্রিটিশরা তাদের দখলকৃত অঞ্চলে সৈন্য মােতায়েন করতে চেয়েছিল। যাতে জান বক্স খানকে আত্মসমর্পন করে অথবা সমগ্র অঞ্চল থেকে অন্যত্র কোথাও গিয়ে আত্মগােপন করে।
চাকমা অঞ্চল দখল করে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কিছুই লাভ হয়নি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের। চাকমাদের পরাজিত করে কিছু পাবার আশা নেই। অপর দিকে এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে চাকমাদের অর্থনৈতিক এবং নৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।
এই অবস্থায় চাকমা রাজা জান বক্স খান এবং গভর্নও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে বৈরীদ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমন্ত্রনে জান বক্স খান কলিকাতায় যান ১৭৮৭ সালে।
চাকমা রাজ্য থেকে ব্রিটিশ সৈন্য অপসারণের ব্যবস্থা করার জন্য তাদের আলােচনা হয়। শাক্তিচুক্তির মাধ্যমে বেরীদ্বন্দ্ব সমাপ্তির জন্য তারা রাজী হন। চুক্তিমতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জান বক্সকে রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়।
ব্রিটিশ সরকার উপজাতিদের নিজস্ব শাসন সংরক্ষণ করবে, সমতলের লােক পাহাড়ীদের অঞ্চলে স্থানান্তর নিয়ন্ত্রন করা হবে। চুক্তি ট্রুপ চাকমা অঞ্চলে থাকবে চাকমাদেরকে ভয় লাগানাের জন্যে নয় , বরং পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য দুর্ধর্ষ ট্রাইবদের থেকে তাদের ভূমি রক্ষার জন্যে।
এটা সত্যিকার অর্থে কোন শান্তিচুক্তি নয়। এটা চাকমা রাজা ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে একটা ঐক্যমত্য ছাড়া আর বেশি নয়। যতদূর জানা যায় এই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। যদিও চাকমাদের কিছুটা স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই শ্বায়ত্বশাসনকে কখনাে মর্যাদা দেয়া হয়নি।
চাকমা রাজাকে তার পূর্বেকার কর্তৃত্ব এবং মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। চাকমা রাজার শারিরীকভাবে নিরাপদে সিংহাসনে বসার কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। চাকমা অঞ্চলের সীমানা কখনাে পূর্বাবস্থায় পূণস্থপিত হয়নি।
দখলকৃত অঞ্চল কখনাে বৈধ মালিককে জায়গা-জমি ফেরত দেয়া হয়নি। রাঙ্গুনিয়া থেকে উৎখাতকৃত চাকমাদের তাদের পূর্বের জায়গায় পূণবসতিকরনের কোন অফিসিয়েল বা সরকারি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চাকমা অঞ্চলের গুরুত পূর্ণ জায়গাগুলাে (Strategic Positions) থেকে ব্রিটিশ সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়নি।
সেই থেকে ব্রিটিশ সরকার একপাক্ষিকভাবে পদক্ষেপ এবং ব্যবস্থা নিয়েছিল চুক্তি প্রতি। জনগনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি কোন শ্রদ্ধা দেখায়নি। যদিও পার্বত্যাঞ্চলসহ চট্টগ্রামে রাজস্বব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল (১৭৯১ সালে), রাঙ্গুনিয়ায় চাকমা অঞ্চল থেকে কোন রাজস্ব সংগৃহীত হয়নি, কারণ চাকমারা যে কোন ধরণের ট্যাক্স দিতে নারাজ ছিল। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চাকমা অঞ্চলে এটা কার্যকর হয়েছে বলে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
জান বক্স খান নির্বাচনে মারা যান। দেওয়ান রনু খান কখনাে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করেননি এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরােধ যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। ১৭৯৫-৯৬ সালের বিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং জংগলে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে যাতে ধরা না পড়েন, সেই জন্যে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
চাকমা সেনাপতি রনু খান ছিলেন অদম্য যােদ্ধা। ইংরেজদের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে (১৭৭২-৯৬ সাল) তিনি সকল প্রকার পতিকুল অবস্থার মােকাবেলা করেছেন। তিনি অদম্য সাহসের সহিত ব্রিটিশ আক্রমণ অভিমান প্রতিরােধ করেছেন এবং ব্যর্থ করে দিয়েছেন। প্রতিরােধ সময়ের ব্যাপ্তিটা ছিল বিরামহীন দুঃখ-কষ্টের। কিন্তু এই দুঃখ-কষ্ট স্বাধীনতার স্পিরিটকে, স্পৃহা-উদ্দীপনাকে ক্ষীন করতে পারে নাই তার অপরাজেয় নীতি-চরিত্র বলকে।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তার অবিচল প্রতিরােধ রক্ষার জন্য জাতীয় অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি যে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরােধ সংগ্রাম করেছিলেন, তা চাকমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শ্রদ্ধা, প্রশংসা এবং গৌরবের সহিত শিক্ষাযােগ্য ও স্মরনযােগ্য হয়ে থাকবে।
তিনি চাকমা জাতিকে যে আলাের পথ দেখিয়েছেন, এজন্য তিনি ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিরােধ এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবেন।
তথ্য সহায়ক উৎস:
১। Chakma Resistance To British Domination- Dr. Suniti Bhushan Qanungo
২। আলাের পথ দেখালাে যারা – রেগা প্রকাশনী প্রমােদ বিকাশ কার্বারী
তথ্যসুত্রঃ ইতিহাসের আলোকে চাকমা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম
সংকলন ও সম্পাদনায় : ইন্টুমনি তালুকদার
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।